বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১

প্রকাশের পথে

 স্বরবর্ণ   ১  

যাঁদের লেখায় সমৃদ্ধ হতে চলেছে 

ষোলোজন কবির কবিতা ,সংক্ষিপ্ত কবিকৃতিসহ

কবিরা হলেন 

সৈয়দ কওসর জামাল * নির্মল হালদার * চন্দন রায় * অশোক দত্ত * নীল কমল * 

রাহুল দাশগুপ্ত * বিশ্বনাথ পাল * তৈমুর খান * সব্যসাচী মজুমদার * কল্পোত্তম *

শিমুল আজাদ *  দীপ্তিশিখা দাস *  তপন পাত্র  * সুজিত ঘোষ * রাবেয়া খাতুন  * 

দেবাশিস সাহা  |

এছাড়া থাকছে 

গল্প - স্বপন চক্রবর্তী

প্রবন্ধ - সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়       ড : শুভঙ্কর দে

            অলোক কোৱা


কবিতা উপন্যাস ( ধারাবাহিক ) 

দীপংকর রায়

উপন্যাস ( ধারাবাহিক ) 

দেবাশিস সাহা 

থাকছে " প্রিয় কবিতা " এবং "তোমায় খুঁজে ফিরি " নামে দুটি নতুন বিভাগসহ  স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই -এর খবরাখবর  


সম্পাদকমণ্ডলী      

দেবাশিস সাহা                ড : শুভঙ্কর দে  

সৌম্যজিৎ দত্ত              অলোক কোৱা



 

বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১

দেবাশিস সাহা ( দুটি কবিতা )

                                                                    


 


স্বপ্ন 


রোজ আমি স্বপ্ন দেখি 

গুটিগুটি পায়ে দারিদ্রসীমা পেরোচ্ছে ভারতবর্ষ

প্রবঞ্চনা ফিরিয়ে দিয়েছে এদেশের একশো কুড়ি কোটি মানুষ

কোন নিমন্ত্রণ ছিল না যেসব শরীরে কোনদিন

সেখানেও উৎসব আজ

নির্মাণে নেমেছে নতুন শিশু

কুয়াশার প্রাচীর খেলে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ

এই প্রথম আলিঙ্গনে কেঁপে উঠছে এ দেশের মাটি

রাশি রাশি ধান আর ধানক্ষেতে

ভরে যাচ্ছে উঠোন

উঠোনে উঠোনে আজ ভোরের বাতাস

                                              নতুন সূর্যের হামাগুড়ি


রোজ আমি স্বপ্ন দেখি

গুটিগুটি পায়ে দারিদ্রসীমা পেরোচ্ছে ভারতবর্ষ...




আনন্দ



মুখ তোলো
তোমার মুখের এখন আমি একটা ছবি নেব।


তোমার মুখের এই হাসি
পাহাড়ি ঝরনার মতো এই খুশির ফোয়ারা
নাও থাকতে পারে কাল।


তোমার মুখের এই রোদ্দুর 
রোদ্দুরের ভিতরে নদীর এই উচ্ছলতা
মুছে যেতে পারে কাল ।


মুখ তোল
এইবেলা তোমার মুখের আমি একটা ছবি নেব ।

সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১

শ্রদ্ধার্ঘ : ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি উপলক্ষে

  শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি 

          নিস্তারিণী দেবী 

১)

(নিস্তারিণী ঘোষ ছিলেন নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী। দুজনেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন এবং এক পুত্র সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। নিস্তারিণী দেবী দশমহাবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিন্নমস্তার অংশ -শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন।)

     বহুদিন ধরে আমার স্বামী এমন একজন সাধুর খোঁজ করছিলেন যিনি তাকে ঈশ্বরলাভের উপায় বলে দিতে পারেন। তিনি একজন সাধুর উপদেশ মেনেও চলছিলেন। এমন সময় তার এক বন্ধু বললেন, 'তুমি এই ব্যক্তির পিছনে কেন সময় নষ্ট কর? দক্ষিণেশ্বরে যাও, সেখানে একজন পরমহংসকে দেখবে, উনি তোমার সমস্ত সংশয় দূর করে দেবেন।' অতএব আমার স্বামী ও আমি দক্ষিণেশ্বরে গেলাম এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করলাম। তিনি সস্নেহে আমাদের গ্রহণ করলেন এবং আমরা অনুভব করলাম যে তিনি একজন স্বর্গীয় পুরুষ।

     ‎এরপর তিন বৎসর আমরা দক্ষিণেশ্বর যাই নাই। আমার স্বামী কতকগুলো সাধনা অভ্যাস করছিলেন এবং ভাবছিলেন যে সেগুলো সম্পূর্ণ করে অন্য গুরুর কাছে যাবেন। একদিন হঠাৎ ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে একজন ভক্তকে বললেন, 'প্রায় তিনবছর আগে নবগোপাল ঘোষ নামে একটি লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তারপরে সে আর আসে নাই। তাকে বলো আমি তাকে দেখতে চাই।' তিন বৎসর পরেও তিনি আমার স্বামীর নাম মনে রেখেছিলেন। তিনি যখন আমাদের ডেকে পাঠালেন ঠিক সেই সময় আমার স্বামীও তার সাধনগুলো সম্পূর্ণ করেছিলেন।

     ‎ পরের রবিবার আমরা ঠাকুরের কাছে গেলাম। আর সেই সময় থেকে আমরা নিয়মিত ভাবে প্রত্যেক রবিবার যেতাম, এবং সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতাম।

     ‎ আমি যখন যেতাম তখন ঠাকুর সমস্ত পুরুষদের বাইরে যেতে বলতেন এবং আমার সঙ্গে একা কথা বলতেন। একবার তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আমি কেন আসি, ও তাঁর মধ্যে কি দেখেছি যা আমাকে দক্ষিণেশ্বরে বারবার আকৃষ্ট করে। আমি উত্তরে বলেছিলাম, 'আমি বলতে পারি না। কেবল এইটুকু জানি যে প্রহ্লাদ যাঁকে পেয়ে বাবাকে ভুলেছিল, এবং ধ্রুব ও অন্যেরা তাদের বাবা-মাকে ভুলেছিল, আমি এখানে তাই পেয়েছি।'


   

২)

     এক বন্ধু আমাকে 'হরিবোল' বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন এবং আমি তাই করতাম। কিন্তু আমার মনে সংশয় উৎপন্ন হলো। নিজেকে বললাম, 'আমি হরিকে ডাকছি অথচ আমি জানি একমাত্র গুরুর মাধ্যমেই মুক্তিলাভের চেষ্টা করতে হয়।' দক্ষিণেশ্বরে গেলাম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে কিন্তু আমার অশান্তির কথা বলার আগেই তিনি বললেন, 'গুরু আর হরি এক।'

     ‎একদিন ঠাকুর আমাদের বাড়িতে আসবেন বলেছিলেন এবং অনেক ভক্ত সমবেত হয়েছিল তাঁকে দর্শন করার জন্য। যখন তিনি এলেন, সোজা উপরে উঠে এলেন এবং আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেন। সেই সময় আমার পূজার ঘরে শ্রীকৃষ্ণের একটি ছবি ছিল এবং আমি তাঁকে বললাম, আমি শ্রীকৃষ্ণের দর্শনলাভের জন্য ব্যাকুল। তিনি নিচে চলে গেলেন, যেখানে সব ভক্তেরা সংকীর্তন করছিলেন। তারা তাঁর গলায় একটি ভারি মালা পড়িয়ে দিলেন, যেটি তাঁর পা পর্যন্ত ঝুলছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি সমাধিস্থ হলেন এবং অবিকল শ্রীকৃষ্ণের মতো রূপ ধারণ করলেন। তাঁকে দেখে সমস্ত ভক্তেরা এক উচ্চ ভাবে আবিষ্ট হলেন। পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সন্তুষ্ট হয়েছি কিনা। আমি বললাম আমি রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের পাশে দেখতে চাই। তিনি হাসলেন ও বললেন, 'ও, তা হলে তোমাকে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।'

     আর একবার তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখন তিনি শাড়ি ও অলংকারে সজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি ফল ঐ মিষ্টি খাওয়ায় সময় এমন ভাবে কথা বলতে লাগলেন, ঠিক যেন একটি তরুণী স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আরও গহনা চাইছে। এই অভিনয় এক ঘন্টা বা আরও বেশি সময় ধরে চালিয়েছিলেন। তাঁর অনুকরণ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।

     ‎ এক রবিবার আমরা সবাই দক্ষিণেশ্বরে ছিলাম। একটি গরিব স্ত্রীলোক ঠাকুরের জন্য চারটি রসগোল্লা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাঁর ঘরে এত ভক্ত বসেছিলেন যে সে ঘরে ঢুকে তাঁকে সেগুলো দিতে সাহস করছিল না। সে নহবতের বারান্দায় এসে করুণভাবে কাঁদতে লাগলো এই বলে যে ঐ চারটি রসগোল্লা আনাও তার পক্ষে এক মহান আত্মত্যাগ। যখন সে এইভাবে কাঁদছিল, হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গঙ্গার সন্মুখস্থ গোল বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তিনি কয়েক মিনিট গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে তাড়াতাড়ি নহবতের দিকে গেলেন। বারান্দায় উপস্থিত হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন, যেন কাউকে খুঁজছেন। তারপর গরিব স্ত্রীলোকটিকে দেখে তার কাছে গিয়ে বললেন, 'আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দিতে পার?' স্ত্রীলোকটি পরম আনন্দে রসগোল্লাগুলো তাঁকে দিল। তিনি চারটি রসগোল্লাই তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন এবং খেয়ে তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন। স্ত্রীলোকটি আনন্দপূর্ণ হৃদয়ে বাড়ি ফিরলো |

 ৩)

      জন্তুরাও তাঁর স্নেহপূর্ণ আশ্রয় পেত। একবার একটি বেড়াল তার তিনটি বাচ্চা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আশ্রয় নিল। মা-বেড়ালটি কখন কখনও তাঁর খাটের উপরে তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে থাকত আর যদি তিনি হাত বাড়িয়ে ছুঁতেন, সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে পড়ে তাঁকে যেন প্রণাম করত। ঠাকুর বেড়াল ও বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কি করবেন এই ভেবে উদ্বিগ্ন হলেন, কারণ তাঁর ধারণা হলো ওরা মন্দিরে উপযুক্ত খাবার পায়না। তাই একদিন আমি তাঁকে দর্শন করতে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি আমার জন্য কিছু করবে?' আমি হাত জোড় করে বললাম, 'সে যাই হোক না কেন, আমি করব।' কিন্তু তিনি আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন আর আমিও পূর্বের মত উত্তর দিলাম। তখন তিনি বেড়ালগুলো সম্বন্ধে আমাকে বললেন -ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে। তিনি বললেন, 'মনে রেখো, ওরা আমার আশ্রয় নিয়েছে, অতএব ওরা যেন আদর-যত্ন পায়।'

      ‎আমি ওদের বাড়িতে নিয়ে এলাম এবং যখনই দক্ষিণেশ্বর যেতাম তিনি বেড়ালগুলো সম্বন্ধে খুঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন -ওরা কি ঠিকমত খাওয়া পাচ্ছে? বাচ্চাগুলো কি বড়ো হয়েছে? ওদের নিয়ে আমি কি করতে চাই? তিনি চিন্তিত ছিলেন যে আমি হয়তো ওদের আর কাউকে দিয়ে দেব আর সে ওদের আদর-যত্ন করবে না। তিনি আবার মনে করিয়ে দিলেন, 'মনে রেখো, ওরা আমার আশ্রয় নিয়েছিল।' মা-বেড়ালটির আর বাচ্চা হয় নাই। বছরের শেষে বেড়ালটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় আমি তার মুখে গঙ্গাজল ঢেলে দিলাম এবং শ্রীরামকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করলাম।

      ‎ কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তিনি আবার আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন আসি। 'তোমার ছেলেপুলে আছে। তোমার অলংকার ও আসবাবপত্র আছে। তবে তুমি কেন আমার কাছে আসতে চাও?' আমি উত্তর দিলাম, 'আমি এই সব জিনিস চাই না। আপনাকে ভক্তি করি ও পেতে চাই বলে আসি। আমি আপনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।' তখনই তিনি সমাধিস্থ হলেন। সমাধি ভঙ্গ হলে আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

      ‎ একবার আমি কাশীপুরে ঠাকুরের জন্য কিছু মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর সামনে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে যখন দাঁড়ালাম, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কি চাও?' বললাম, 'আপনাকে কিছু মিষ্টি খাওয়াতে চাই।' 'আচ্ছা', এই বলে তিনি আমাকে তাঁর মুখের মধ্যে কিছু মিষ্টি দিতে বললেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, 'তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ?' 'না?' 'তবে কি চাও?' আমি হাত জোড় করে উত্তর দিলাম, 'আমি আপনাকে আরও মিষ্টি দিতে চাই।' তিনি আমাকে তাঁর মুখে আরও মিষ্টি দিতে দিলেন এবং আমাকে তখনও অতৃপ্ত দেখে তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন। আবার যখন খাওয়াতে চাইলাম, তিনি বললেন, 'না, এখন আর নয়। দাঁড়াও। তুমি এবং অন্যেরা যা নিবেদন করবে তা আমি সূক্ষ্ম শরীরে গ্রহণ করব।'

      ‎ একবার কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গিয়ে দেখলাম এত বেশি অভ্যাগতের সমাগম হয়েছে যে উপরে যাওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আছি, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর একটি ছবি দিয়ে বলে পাঠালেন, 'তাকে বল আজ এই ছবি দেখে সন্তুষ্ট থাকতে।' পরে আমাকে ছবিটি সম্বন্ধে বলেছিলেন, এটি রেলগাড়িতে ও সমুদ্রের জাহাজে যাবে, যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে। একে লোকেরা তাদের পকেটে, এমনকি ঘড়ির চেনেও ধারণ করবে।

     সমাপ্ত

মঙ্গলবার, ৯ মার্চ, ২০২১

স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর


সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েব ম্যাগাজিন হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করবে আগামী পয়লা বৈশাখ, চোদ্দশো আঠাশ। এপ্রিলের এক তারিখের মধ্যে কবি- লেখকদের লেখা পাঠাতে অনুরোধ করছি । লেখা পাঠাবেন  8777891532 এই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অথবাdebasishsaha610@gmail.com এই ইমেইল নম্বরে টাইপ করে । গল্প কবিতা প্রবন্ধ ভ্রমণ কাহিনী যে কোনও ধরনের লেখা পাঠানো যাবে । শব্দসীমা অনির্দিষ্ট । কিন্তু লেখাটি অবশ্যই মৌলিক ও অপ্রকাশিত হতে হবে ।


                                                                          সম্পাদক ---  স্বরবর্ণ 

সম্ভাব্য লেখকসূচি

 কবিতা

 

সৈয়দ কওসর জামাল    নির্মল হালদার    চন্দন রায়    অশোক দত্ত    রাহুল দাশগুপ্ত   দীপ্তিশিখা দাস  সব্যসাচী মজুমদার   কল্পোত্তম   বিশ্বনাথ পাল    নীলকমল    সুজিত ঘোষ  তৈমুর খান  তপন পাত্র  দেবাশিস সাহা 

  


গল্প 

স্বপন চক্রবর্তী


প্রবন্ধ 

সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়

অলোক কোৱা


কবিতা উপন্যাস ( ধারাবাহিক ) 

দীপংকর রায়

 

উপন্যাস ( ধারাবাহিক ) 

দেবাশিস সাহা 


তোমায় খুঁজে ফিরি 

স্বামী বিরজানন্দ 

অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 


স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই 


  

সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১

তোমায় খুঁজে ফিরি




 পঞ্চপ্রদীপে মাতৃদর্শন

      ‎স্বামী মাধবানন্দ (৪)

    ‎- অমিয়কুমার  বন্দ্যোপাধ্যায়    


১)

     কবিদের মধ্যে কাউকে কাউকে বলা হয় 'কবির কবি'। তেমনই সাধুমন্ডলীতে কাউকে কাউকে বলা চলে 'সাধুর সাধু'। অন্য সাধুরা তাঁকে কিরকম সন্মান দিচ্ছেন, কিরকম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম উক্তি বা জীবনচর্যার উল্লেখ করছেন -এ থেকে বোঝা যায় তাঁরা কত বড়। এইরকম এক সাধুর সাধু ছিলেন -শ্রীশ্রীমায়ের কৃপাধন্য সন্তান, শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের নবম অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী মাধবানন্দজী মহারাজ। ১৯২৯-এ তিনি মঠ-মিশনের সহকারী সম্পাদক হন। ১৯৩৮-এ সাধারণ সম্পাদক। মার্চ ১৯৬২-তে সহকারী অধ্যক্ষ। আগষ্ট ১৯৬২-তে অধ্যক্ষ।

     ‎আদর্শ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বলতে স্বামীজী বুঝতেন, এমন এক চরিত্র যাতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগ সুন্দরভাবে সমন্বিত। পূজনীয় মাধবানন্দজী এইরকম একটি ব্যক্তিত্ব। শুনেছি, শ্রীশ্রীমায়ের বিখ্যাত উক্তি -'সাধু ভাল, আর বিদ্বান সাধু আরও ভাল। যেন সোনা দিয়ে বাঁধানো হাতির দাঁত।' -উক্তিটি পূজনীয় নির্মল মহারাজকে লক্ষ্য করেই প্রথম বলা হয়েছিল। আরও শুনেছি, একদিন মা কয়েকজনকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। তরুণ নির্মল মহারাজও ছিলেন পঙক্তিতে। সেইসময় তাঁকে দেখিয়ে মা বলেছিলেন, 'এই ছেলেটি কবি হবে। কবি মানে জান? কবি মানে জ্ঞানী।'

     ‎সুপুরুষ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মাধবানন্দজী নিজে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তাঁর মুখে শোনা যেত, 'বিশ্রাম আবার কী? কার্যান্তরই তো বিশ্রাম।' অন্যের কাছ থেকে কাজ আদায়ে ছিলেন কঠোর, যাকে বলে 'hard task-master'. রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের এই কঠোর সম্পাদক পরে অধ্যক্ষ-পদে বৃত হওয়ায় যেন 'মা' হয়ে যান। ভালবাসায় পরিপূর্ণ তখন তিনি। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি বড় বেশি উদার, বড় বেশি অকৃপণ, দীক্ষাদানের ব্যাপারে একটু বেছে-টেছে দেওয়াই বোধহয় ভাল -এইরকম মৃদু অনুযোগে বলেছিলেন, 'মা যদি বেছে-টেছে কৃপা করতেন তাহলে কি আমি তাঁর কৃপা পেতাম? ওসব বাছবিচারে আমি নেই। মায়ের দেখানো পথেই আমি চলব।' একবার একজন এক সুদীর্ঘ পত্রে তার জীবনের তাবৎ কলঙ্ক-কথা অকপটে বিবৃত করেন। তিনি জানেন যে তিনি কৃপার অযোগ্য। কিন্তু তা জেনেও কৃপা-ভিক্ষা করেছেন তিনি। মাধবানন্দজীর একান্ত সচিব পত্রটির মর্ম কুন্ঠিতভাবে তাঁকে জানিয়ে জানতে চাইলেন ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি দেবেন কিনা। মাধবানন্দজী সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, 'মা তো আমাকে ইন্টারভিউ নিয়ে কৃপা করেননি! তুমি দীক্ষার দিন ঠিক করে আসতে লিখে দাও I '

২)

     এই অসাধারণ কৃপাময় সাধুটি তাঁর নিজের আধ্যাত্মিক জীবন মায়ের আদলেই গড়ে তুলেছিলেন, বা বলা যেতে পারে-মা তাঁর এই প্রিয় সন্তানের জীবনটি তাঁর আপন আদলেই গড়ে দিয়েছিলেন। স্বামী মাধবানন্দজী সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা বলা হল তার পরিপ্রেক্ষিতে মা সম্পর্কে তাঁর একটি রচনা 'শ্রীমা সারদাদেবী' খুঁটিয়ে পড়লে মা সম্পর্কে অসাধারন আলোকসম্পাত তো হয়ই, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের এই ছেলেটিও বোধহয় ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাদের উপলব্ধির দিগন্ত কৃপা করে স্পর্শ করে যান। স্বামী মাধবানন্দ লিখেছেন, 'ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মহাশক্তি হইয়াও শ্রীশ্রীমা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখিয়াই তাঁহার দিব্যজীবন যাপন করিয়াছিলেন।‌ কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, তাঁহার পুণ্যপ্রভাব অলক্ষ্যে দেশ-বিদেশের অসংখ্য নর-নারীর হৃদয় অধিকার করিয়াছে। নতুবা তাঁহার অদর্শনের মাত্র তেত্রিশ চৌত্রিশ বৎসরের ভিতর (১৯৫৪) তাঁহার নামে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের মধ্যে এরূপ উন্মাদনা সৃষ্টি হইত না। ...শ্রীমা সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন, 'ও সারদা -সরস্বতী, জ্ঞান দিতে এসেছে। ...ও কি যে সে! ও আমার শক্তি।' শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দও বেলুড় মঠে লিখিত তাঁহার এক পত্রে লিখিয়াছিলেন, '...শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। ...মা-ঠাকুরানী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী, মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে...।' তাঁহারই সুযোগ্য গুরুভ্রাতা স্বামী প্রেমানন্দও এক পত্রে লিখিতেছেন, '...এ কি মহাশক্তি! ...যে বিষ নিজেরা হজম করতে পারছি নে, সব মার নিকট চালান দিচ্ছি। মা সব কোলে তুলে নিচ্ছেন! অনন্ত শক্তি -অপার করুণা। ... সকলকে আশ্রয় দিচ্ছেন, সকলের দ্রব্য খাচ্ছেন, আর সব হজম হয়ে যাচ্ছে। মা, মা! জয় মা।' 

     ‎ 'শ্রীমার এইরূপ অবারিত দ্বার ছিল বলিয়াই আমাদের মত অনেকেই তাঁহার নিকট আশ্রয় পাইয়াছে। মনে পড়ে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের একটি দিনের কথা। পূজনীয় শশী মহারাজ তখন কলকাতায়, বলরামবাবুর বাড়িতে। আধ্যাত্মিক জীবনের পরম সহায়ক রূপে তিনি অন্য দুই চার কথার পরে বলিলেন, 'আর, মার কাছে থেকে দীক্ষা নিয়ে নাও। তাহলেই সব হবে।' প্রকৃতপক্ষে ইঁহারাই শ্রীশ্রীমায়ের মহিমা যথার্থ বুঝিয়াছিলেন, এবং সেজন্যই অত্যন্ত সম্ভ্রমের সহিত তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতেন। ...১৯০৮ সালের শেষভাগে পঠদ্দশায় তিন বন্ধুর সহিত জয়রামবাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের প্রথম দর্শনলাভ করি। দুঃখের বিষয় সেই দর্শনের অতি অস্ফুট স্মৃতিই এখন রহিয়াছে। দ্বিতীয়বার জয়রামবাটীতে যাই ১৯১০ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে, মঠের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ পূজনীয় বিরজানন্দ স্বামীর সহিত। ...মনে আছে, মা তাঁহার প্রিয় সন্তানকে অতি যত্নের সহিত খাওয়াতে ব্যগ্র ছিলেন, সেই সময় তাঁহার শ্রীমুখ হইতে শুনি যে, ঠাকুরই সব; সাধনভজন সকলের সহজসাধ্য নয়, উহা মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়া করিতে হয়; এবং সঙ্ঘের কাজ ঠাকুরেরই সেবা। ... তাঁহাকে কোনকিছু জিজ্ঞাসা করার কথা মনে উঠে নাই। তাঁহার চরণতলে বাস করিতেছি, ইহা ভাবিয়া তৃপ্তি বোধ করিতাম।'

 

৩)

     'কি উদ্বোধনে কি অন্যত্রে, অনেক ছোটখাট ব্যাপারের মধ্য দিয়া তাঁহার সহজ অকৃত্রিম মাতৃস্নেহ ও অহেতুক করুণার নিদর্শন পাইয়া ধন্য হইয়াছি। ইহাতে আমাদের গুণপনা কিছু নাই, ইহা তাঁহারই জগজ্জননীসুলভ মাহাত্ম্য। পরে যখন ভক্তগণ রচিত তাঁহার স্মৃতিকথা পাঠ করি, তখন এক একবার মনে হইয়াছে, মাকে ঐরূপ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে হয়ত ভাল হইত। কিন্তু তাঁহারই উক্তি হইতে আমরা ইহা জানিয়া আশ্বস্ত হই যে, তিনি দীক্ষাদানকালে শিষ্যের যাহা কিছু করণীয়, সব বলিয়া দিয়াছেন। সাধারণ গুরু হইতে এইখানেই তাঁহার পার্থক্য। ...সূর্য উঠিলে তাহাকে দেখাইবার জন্য দীপের প্রয়োজন হয় না। অবশ্য লোকে কৃতজ্ঞতা হেতু আরাত্রিক হিসাবে তাঁহার সন্মুখে দীপাদি প্রদর্শন করিয়া থাকে। ... শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীসারদাদেবী উভয়েরই জীবনে একথা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। তাঁহাদিগকে বড় করিয়া দেখাইবার প্রয়োজন হয় না। তাঁহাদের পবিত্রতা, লোভরহিত্য, অনহংকার, দয়া, প্রেম, ধৈর্য, ক্ষমা, ত্যাগ, তপস্যা, ঈশ্বরানুরাগ প্রভৃতি অসংখ্য স্বাভাবিক সদগুণ তাঁহাদের অসাধারণত্ব পদে পদে প্রকাশ করে। ...শ্রীসারদাদেবী সত্যসত্যই শ্রীরামকৃষ্ণগতপ্রাণা ছিলেন, এবং তাঁহারও জীবন আশৈশব কর্মময় ছিল। "কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ" -এ জগতে কর্ম করিতে করিতেই শতবৎসর বাঁচিতে ইচ্ছা করিবে -উপনিষদের এই উপদেশ যেন শ্রীশ্রীমায়ের জীবনে মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। আর দেখিতে পাই যে, তাঁহার ঐ কর্ম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরার্থেই অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। তিনি আজীবন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কায়িক পরিশ্রম করিয়া গিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনকালে তিনি উন্মাদগ্রস্ত বলিয়া জয়রামবাটী অঞ্চলে কত লোকে সারদাদেবীকে গঞ্জনা দিয়াছে, এক সময়ে তাঁহাকে দারুণ অভাবের মধ্য দিয়াও যাইতে হইয়াছে, তথাপি তিনি ঘুণাক্ষরেও উহা কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই। তাঁহারই যত্নে লালিত ভ্রাতাদের কাহারও নিকট হইতে তিনি কম কষ্ট পান নাই; বিশেষতঃ শেষ জীবনে তাঁহার আজন্ম পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্রী রাধু ও তাহার স্বামী-শোকে বিকৃত মস্তিষ্কের জননীর হস্তে তিনি অকারণে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করিয়াছিলেন। কিন্তু এ সকলের মধ্যেও তাঁহার উদারতা ও চিত্তের প্রশান্তি নষ্ট হয় নাই। এই দুঃখময় সংসারে কিভাবে জীবনযাপন করিলে মানুষ সুখী হইতে পারে, তিনি নিজেই দোষরহিত্য জীবনে তাহা দেখাইয়া গিয়াছেন। 'আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়।' ...জড়বাদপূর্ণ ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার এক অখ্যাত ক্ষুদ্র পল্লীগ্রামে তাঁহার ন্যায় অদ্ভুত শক্তিশালিনী মহীয়সী নারীর আবির্ভাব বাস্তবিকই জগতের এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। উহা ভারতের এমন কি সমগ্র পৃথিবীর নারীজাতির এক মহাঅভ্যুত্থানেরই সূচনা করে; বিশেষতঃ ভারতীয় নারীগণ শ্রীশ্রীমার জীবনবেদ হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিয়া তাহাদের আদর্শ বজায় রাখিয়াও আধুনিক পরিস্থিতির সহিত নিজেদের খাপ খাওয়াইতে পারিবেন। বিদেশীয় নারীগণও তাহাদের মধ্য দিয়া ভারতের যুগযুগান্তের পরীক্ষিত নিবৃত্তি মার্গের পরিচয় পাইবেন। ... শ্রীরামকৃষ্ণের ন্যায় তিনিও স্থূলশরীর পরিত্যাগ করিলেও সূক্ষ্মশরীরে বিদ্যমান রহিয়াছেন, একথা বুঝিতে বিলম্ব হয় না। ...ধর্মজগতের ইতিহাসে ইহার তুলনা মিলে না। শিবশক্তির এই অপূর্ব লীলা-অনুধ্যান করিবার সুযোগ পাইয়া আমরা সকলেই  ধন্য হইয়াছি I



৪)

     শ্রীশ্রীমায়ের দেবীত্ব সম্পর্কে মাধবানন্দজী প্রতি মুহূর্তে কিরকম সচেতন থাকতেন এবং ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক সমস্ত বিষয়ে শ্রীশ্রীমায়ের ভাবধারায় কতটা এবং কিভাবে চালিত হতেন তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য :

     ‎ এক। - শ্রীশ্রীমায়ের একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রচ্ছদে মায়ের একটি ছবি এঁকেছেন এক শিল্পী। একজন সাধু দেখে বললেন, 'কী কাণ্ড সব! মায়ের ঠোঁটে খানিক লাল রং লাগিয়ে বসে আছে!' মাধবানন্দজী তৎক্ষণাৎ বললেন, 'তাতে কী? মা দুর্গার ঠোঁটৈও তো লাল রং দেওয়া হয়।

     ‎ দুই। - একটি লোক আবাল্য মঠে যায়। বয়সে তরুণ। কলেজের ছাত্র। একদিন প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন মাধবানন্দজীকে, 'মহারাজ, শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, তৈলধারাবৎ অবিচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরচিন্তা করতে হবে। কিন্তু তা হবে কেমন করে? অন্য কাজকর্মও তো আছে?'

     ‎ প্রথমে মাধবানন্দজী কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে টেবিলে রাখা একটা কাগজ তুলে নিলেন -একটা ফর্ম। আবেদনকারীর স্বাক্ষরের জায়গাটায় আঙুল ছুঁয়ে বললেন, -এটা কি?

     ‎ -একটা লাইন, মহারাজ।

     ‎ -ঠিক। কিন্তু কীরকম লাইন?

     ‎ -স্ট্রেট লাইন, মহারাজ।

     ‎ -ভাল করে দেখে বলো।

     ‎ -ডটেড্ লাইন, মহারাজ।

     ‎ -ঠিক বলেছ। তা দেখ, ডটেড্ হলেও it has all the effects of a straight line, নয় কি? তাহলেই দেখ, তুমি যদি তোমার জন্য সব কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে ভগবানের নাম করতে পার, স্মরণ-মনন রাখতে পার, তাহলে ওই তৈলধারাবৎ অবিচ্ছিন্ন ঈশ্বরচিন্তার ফলই হবে। 

      একটু থেমে, উদাসদৃষ্টিতে তাকিয়ে, স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন, -মা কী বলতেন জান? মা বলতেন, 'বাবা, আমরা তো মেয়েমানুষ। সংসারের কাজ তো ছাড়া যাবেনা। এই জল দিয়ে ভাতের হাঁড়িটি চাপালাম। চাল ফুটতে লাগল। সেই ফাঁকে একটু জপ সেরে নিলাম। আবার ডালের জল চাপালাম। গরম হতে লাগল। আবার একটু জপ করে নিলাম। একটু পরে ডাল ছেড়ে আবার জপ করা গেল। এইরকম আর কি, বাবা...।'

      ‎ তিন। - তাঁর শেষ রোগশয্যায় মায়ের এই ছেলে মাঝে মাঝে প্রাণভরে উচ্চারণ করতেন -'মা মা'। আর মহাসমাধির দিনটিতে বারবার তাঁর ওষ্ঠে ফুটে উঠেছে এই প্রিয় নাম -'মা মা'। তাঁর শেষ কন্ঠস্বর এই নাম ঘোষণা করেই মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েন।

      ‎                                                                                                           ( সমাপ্ত )




' শব্দ আমার অগ্নিলতা ' আমার প্রথম কবিতার বই। বইটি বেরিয়েছিল উনিশশো নব্বই সালের ডিসেম্বরে । বইমেলায় । এই বইয়ের একটিই মাত্র কপি আমার সংগ্রহে আছে । এই বইয়ের কয়েকটি কবিতা আজ রইলো কবিতা প্রিয় পাঠকদের জন্য । আপনাদের মতামত অকপটে জানান ।



সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কথা 

দেবাশিস সাহা 


সাংঘাতিক কিছু শব্দের ভারে ঝুঁকে পড়েছে   

               দু ' হাজার একুশ বছরের বালক পৃথিবী 

কিন্তু , কেউ তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে 

                                  সাহায্য করছে না 

অথচ কত রকমের পতাকা উড়ছে পৃথিবীতে 

কতজন কত রকমের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর 

                                     কথা বলছেন 


কিন্তু , কেউ তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে 

                                  সাহায্য করছে না


সোজা হয়ে দাঁড়ানোর কথা বলে

সকলেই দ্যাখো কী ভীষণ কুঁজো হয়ে হাঁটছে  !

 



কবিতা 

দেবাশিস সাহা 

কবিতা ?

সে তো আমার ঘুমিয়ে পড়া শৈশব

জোড়াতালি দেওয়া মায়ের সিঁথি

ঘামে ভেজা বাবার ছেঁড়া শার্ট 


কবিতা ?

সে তো আমার হারিয়ে যাওয়া বোনের বিবর্ণ বুক 

একাত্তরে ভেসে যাওয়া ভাইয়ের রক্তাক্ত শব ..


২ 

দিনকাল ভালো নয় 

বুকের ভিতরে ঝড় উঠলে অমন আহলাদে আটখানা হোয়ো না 

বরং আগলে রেখো 

বুকের বাসন কোসন 


অন্ধকারকে শাসন করতে আলোর যুবকেরা আসছে 

তিয়েন আন মেন্ স্কোয়ার পেরিয়ে

ওরা ভারতবর্ষে

ঢুকে পড়লো বলে ..


৩ 

সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে 

কত উপরে উঠে যাচ্ছে মানুষ কত উপরে

 

ইটের পরে ইট গেঁথে গেঁথে 

কত উপরে উঠে যাচ্ছে মানুষ কত উপরে 


তবু মনুষ্যতা এত কাঁদছে কেনো





প্রিয়তমাকে  


বুকের কাছের বালিতে 

শুয়ে আছো ,তুমি 

এভাবেই শুয়ে থাকো চিরকাল 

ওপাশে আঁধার ,আঁধারে 

পুড়েছে সমস্ত সকাল I 

বুক তোলপাড় করে কখনও

যদি আসে প্রসিদ্ধ রোদ

বলো চুমু খাবো কোন গালে ,

কোন গালে বলো নির্জন হবো I 




  দাগ 


সে দাগ গায়ে লাগে না , গড়িয়ে যায় 

তাকে ধরে রাখতে হয় 

নীল জলধারায় ভিজিয়ে I 


ধুন্ধুমার রঙের প্রলেপ ছাপিয়ে এখন

আগুনের হালকা লাগে গায়ে এসে 

আগুনে ভিজে 

ভোর ভোর যে ভিখারি বেরিয়েছিল 

ভিক্ষার অন্বেষণে 

খরতাপে পুড়ে গ্যাছে ঝুলিটি তার 

চোখে সূর্যাস্ত 

এখন যা আছে ,ওই জীর্ণসার করোটি I 

 

সে দাগ গায়ে লাগে না ,গড়িয়ে যায় 

তাকে ধরে রাখতে হয় 

নীল জলধারায় ভিজিয়ে I নইলে ----

এমন দাগ দাও 

বৈভব মাড়িয়ে যাও রক্তাক্ত পায়ে 

ছানা কাটা জলের মতো

নষ্ট হয় অমৃত ..






পাড়ি


মাচায় তুলে রাখ
তোর ওই শ্মশান -চেরা হাসি

আমার এই সংক্ষিপ্ত মেঘ
হাতে গোনা কয়েকটা তারা
আর এই যে দেখছিস ছিন্নমূল পাহাড়
বিধ্বস্ত নদী
আরণ্যক বোধ ও বোধি
এসব ছিঁড়ে - খুঁড়ে

এখনও আমাকে পাড়ি দিতে হবে
মাইল মাইল অন্ধকার...







\