শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি
নিস্তারিণী দেবী
১)
(নিস্তারিণী ঘোষ ছিলেন নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী। দুজনেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন এবং এক পুত্র সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। নিস্তারিণী দেবী দশমহাবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত ছিন্নমস্তার অংশ -শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন।)
বহুদিন ধরে আমার স্বামী এমন একজন সাধুর খোঁজ করছিলেন যিনি তাকে ঈশ্বরলাভের উপায় বলে দিতে পারেন। তিনি একজন সাধুর উপদেশ মেনেও চলছিলেন। এমন সময় তার এক বন্ধু বললেন, 'তুমি এই ব্যক্তির পিছনে কেন সময় নষ্ট কর? দক্ষিণেশ্বরে যাও, সেখানে একজন পরমহংসকে দেখবে, উনি তোমার সমস্ত সংশয় দূর করে দেবেন।' অতএব আমার স্বামী ও আমি দক্ষিণেশ্বরে গেলাম এবং শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করলাম। তিনি সস্নেহে আমাদের গ্রহণ করলেন এবং আমরা অনুভব করলাম যে তিনি একজন স্বর্গীয় পুরুষ।
এরপর তিন বৎসর আমরা দক্ষিণেশ্বর যাই নাই। আমার স্বামী কতকগুলো সাধনা অভ্যাস করছিলেন এবং ভাবছিলেন যে সেগুলো সম্পূর্ণ করে অন্য গুরুর কাছে যাবেন। একদিন হঠাৎ ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে একজন ভক্তকে বললেন, 'প্রায় তিনবছর আগে নবগোপাল ঘোষ নামে একটি লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তারপরে সে আর আসে নাই। তাকে বলো আমি তাকে দেখতে চাই।' তিন বৎসর পরেও তিনি আমার স্বামীর নাম মনে রেখেছিলেন। তিনি যখন আমাদের ডেকে পাঠালেন ঠিক সেই সময় আমার স্বামীও তার সাধনগুলো সম্পূর্ণ করেছিলেন।
পরের রবিবার আমরা ঠাকুরের কাছে গেলাম। আর সেই সময় থেকে আমরা নিয়মিত ভাবে প্রত্যেক রবিবার যেতাম, এবং সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত থাকতাম।
আমি যখন যেতাম তখন ঠাকুর সমস্ত পুরুষদের বাইরে যেতে বলতেন এবং আমার সঙ্গে একা কথা বলতেন। একবার তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আমি কেন আসি, ও তাঁর মধ্যে কি দেখেছি যা আমাকে দক্ষিণেশ্বরে বারবার আকৃষ্ট করে। আমি উত্তরে বলেছিলাম, 'আমি বলতে পারি না। কেবল এইটুকু জানি যে প্রহ্লাদ যাঁকে পেয়ে বাবাকে ভুলেছিল, এবং ধ্রুব ও অন্যেরা তাদের বাবা-মাকে ভুলেছিল, আমি এখানে তাই পেয়েছি।'
২)
এক বন্ধু আমাকে 'হরিবোল' বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন এবং আমি তাই করতাম। কিন্তু আমার মনে সংশয় উৎপন্ন হলো। নিজেকে বললাম, 'আমি হরিকে ডাকছি অথচ আমি জানি একমাত্র গুরুর মাধ্যমেই মুক্তিলাভের চেষ্টা করতে হয়।' দক্ষিণেশ্বরে গেলাম শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করতে কিন্তু আমার অশান্তির কথা বলার আগেই তিনি বললেন, 'গুরু আর হরি এক।'
একদিন ঠাকুর আমাদের বাড়িতে আসবেন বলেছিলেন এবং অনেক ভক্ত সমবেত হয়েছিল তাঁকে দর্শন করার জন্য। যখন তিনি এলেন, সোজা উপরে উঠে এলেন এবং আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেন। সেই সময় আমার পূজার ঘরে শ্রীকৃষ্ণের একটি ছবি ছিল এবং আমি তাঁকে বললাম, আমি শ্রীকৃষ্ণের দর্শনলাভের জন্য ব্যাকুল। তিনি নিচে চলে গেলেন, যেখানে সব ভক্তেরা সংকীর্তন করছিলেন। তারা তাঁর গলায় একটি ভারি মালা পড়িয়ে দিলেন, যেটি তাঁর পা পর্যন্ত ঝুলছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি সমাধিস্থ হলেন এবং অবিকল শ্রীকৃষ্ণের মতো রূপ ধারণ করলেন। তাঁকে দেখে সমস্ত ভক্তেরা এক উচ্চ ভাবে আবিষ্ট হলেন। পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি সন্তুষ্ট হয়েছি কিনা। আমি বললাম আমি রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের পাশে দেখতে চাই। তিনি হাসলেন ও বললেন, 'ও, তা হলে তোমাকে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।'
আর একবার তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তখন তিনি শাড়ি ও অলংকারে সজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি ফল ঐ মিষ্টি খাওয়ায় সময় এমন ভাবে কথা বলতে লাগলেন, ঠিক যেন একটি তরুণী স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে আরও গহনা চাইছে। এই অভিনয় এক ঘন্টা বা আরও বেশি সময় ধরে চালিয়েছিলেন। তাঁর অনুকরণ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।
এক রবিবার আমরা সবাই দক্ষিণেশ্বরে ছিলাম। একটি গরিব স্ত্রীলোক ঠাকুরের জন্য চারটি রসগোল্লা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাঁর ঘরে এত ভক্ত বসেছিলেন যে সে ঘরে ঢুকে তাঁকে সেগুলো দিতে সাহস করছিল না। সে নহবতের বারান্দায় এসে করুণভাবে কাঁদতে লাগলো এই বলে যে ঐ চারটি রসগোল্লা আনাও তার পক্ষে এক মহান আত্মত্যাগ। যখন সে এইভাবে কাঁদছিল, হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গঙ্গার সন্মুখস্থ গোল বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তিনি কয়েক মিনিট গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে তাড়াতাড়ি নহবতের দিকে গেলেন। বারান্দায় উপস্থিত হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন, যেন কাউকে খুঁজছেন। তারপর গরিব স্ত্রীলোকটিকে দেখে তার কাছে গিয়ে বললেন, 'আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দিতে পার?' স্ত্রীলোকটি পরম আনন্দে রসগোল্লাগুলো তাঁকে দিল। তিনি চারটি রসগোল্লাই তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন এবং খেয়ে তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন। স্ত্রীলোকটি আনন্দপূর্ণ হৃদয়ে বাড়ি ফিরলো |
৩)
জন্তুরাও তাঁর স্নেহপূর্ণ আশ্রয় পেত। একবার একটি বেড়াল তার তিনটি বাচ্চা নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে আশ্রয় নিল। মা-বেড়ালটি কখন কখনও তাঁর খাটের উপরে তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে থাকত আর যদি তিনি হাত বাড়িয়ে ছুঁতেন, সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে পড়ে তাঁকে যেন প্রণাম করত। ঠাকুর বেড়াল ও বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কি করবেন এই ভেবে উদ্বিগ্ন হলেন, কারণ তাঁর ধারণা হলো ওরা মন্দিরে উপযুক্ত খাবার পায়না। তাই একদিন আমি তাঁকে দর্শন করতে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি আমার জন্য কিছু করবে?' আমি হাত জোড় করে বললাম, 'সে যাই হোক না কেন, আমি করব।' কিন্তু তিনি আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন আর আমিও পূর্বের মত উত্তর দিলাম। তখন তিনি বেড়ালগুলো সম্বন্ধে আমাকে বললেন -ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে। তিনি বললেন, 'মনে রেখো, ওরা আমার আশ্রয় নিয়েছে, অতএব ওরা যেন আদর-যত্ন পায়।'
আমি ওদের বাড়িতে নিয়ে এলাম এবং যখনই দক্ষিণেশ্বর যেতাম তিনি বেড়ালগুলো সম্বন্ধে খুঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন -ওরা কি ঠিকমত খাওয়া পাচ্ছে? বাচ্চাগুলো কি বড়ো হয়েছে? ওদের নিয়ে আমি কি করতে চাই? তিনি চিন্তিত ছিলেন যে আমি হয়তো ওদের আর কাউকে দিয়ে দেব আর সে ওদের আদর-যত্ন করবে না। তিনি আবার মনে করিয়ে দিলেন, 'মনে রেখো, ওরা আমার আশ্রয় নিয়েছিল।' মা-বেড়ালটির আর বাচ্চা হয় নাই। বছরের শেষে বেড়ালটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় আমি তার মুখে গঙ্গাজল ঢেলে দিলাম এবং শ্রীরামকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করলাম।
কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তিনি আবার আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন আসি। 'তোমার ছেলেপুলে আছে। তোমার অলংকার ও আসবাবপত্র আছে। তবে তুমি কেন আমার কাছে আসতে চাও?' আমি উত্তর দিলাম, 'আমি এই সব জিনিস চাই না। আপনাকে ভক্তি করি ও পেতে চাই বলে আসি। আমি আপনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।' তখনই তিনি সমাধিস্থ হলেন। সমাধি ভঙ্গ হলে আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।
একবার আমি কাশীপুরে ঠাকুরের জন্য কিছু মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর সামনে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে যখন দাঁড়ালাম, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কি চাও?' বললাম, 'আপনাকে কিছু মিষ্টি খাওয়াতে চাই।' 'আচ্ছা', এই বলে তিনি আমাকে তাঁর মুখের মধ্যে কিছু মিষ্টি দিতে বললেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, 'তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ?' 'না?' 'তবে কি চাও?' আমি হাত জোড় করে উত্তর দিলাম, 'আমি আপনাকে আরও মিষ্টি দিতে চাই।' তিনি আমাকে তাঁর মুখে আরও মিষ্টি দিতে দিলেন এবং আমাকে তখনও অতৃপ্ত দেখে তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন। আবার যখন খাওয়াতে চাইলাম, তিনি বললেন, 'না, এখন আর নয়। দাঁড়াও। তুমি এবং অন্যেরা যা নিবেদন করবে তা আমি সূক্ষ্ম শরীরে গ্রহণ করব।'
একবার কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গিয়ে দেখলাম এত বেশি অভ্যাগতের সমাগম হয়েছে যে উপরে যাওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আছি, এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর একটি ছবি দিয়ে বলে পাঠালেন, 'তাকে বল আজ এই ছবি দেখে সন্তুষ্ট থাকতে।' পরে আমাকে ছবিটি সম্বন্ধে বলেছিলেন, এটি রেলগাড়িতে ও সমুদ্রের জাহাজে যাবে, যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে। একে লোকেরা তাদের পকেটে, এমনকি ঘড়ির চেনেও ধারণ করবে।
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন