বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

প্রিয় কবি, লেখক এবং পাঠকদের প্রতি


স্বরবর্ণ -- ১  সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও অগোচরেই হয়তো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেল । আপনারা হাত ধরলে সেসব আমরা অচিরেই পেরিয়ে যাব।


স্বরবর্ণ --- ২  

প্রকাশিত হবে আগামী ১৫ জুন ২০২১। এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা (গল্প কবিতা প্রবন্ধ বা ভ্রমণ কাহিনি ) ৩০ মে - এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । শব্দসীমা অনির্দিষ্ট | লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠিয়ে দিন। "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর বেরোবে | আগে থেকে লেখা পাঠান | পরিকল্পনার সুবিধার জন্য | লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে |

হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com




কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় স্মরণে


শূন্য নতজানু হোক 

কবি 

তোমার অবিনশ্বর পঙক্তিমালায় 

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

                                                          



দীপংকর রায়   

কবিতার বই  *  অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

* আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 


কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 




 






আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ





মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 



 


শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস

                                     







সপনা সাহা 

তারা নিভে গেলে 


শুভজিৎ গুপ্ত 

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি

 শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি

                    লক্ষ্মী দেবী 


১)

(লক্ষ্মী দেবী শ্রীরামকৃষ্ণের অগ্রজ রামেশ্বরের কন্যা।)


     দক্ষিণেশ্বরে আমরা তখন নহবতে থাকতাম। ঠাকুরের শোবার বসবার ঘরখানিতে লোকজন থাকলে তিনি ইশারায় নাকের কাছে একটি গোল চিহ্ন দেখিয়ে মাকে বোঝাতেন। মার নাকে নথ ছিল তো! আবার নহবতকে বলতেন -খাঁচা। আমাদের দুজনাকে বলতেন -শুক সারি। এধারে মার নামও সারদা। মা কালীর প্রসাদ ফলমূল মিষ্টি তাঁর ঘরে নামলে, রামলালদাকে বলতেন (নিজের নাকের কাছে গোল-চিহ্ন দেখিয়ে) 'ওরে, খাঁচায় শুক-সারি আছে। ফলমূল, ছোলাটোলা কিছু দিয়ে আয়।' বাইরের লোকেরা বুঝত, বুঝি সত্যি সত্যি পাখি আছে। মাষ্টারমশাইও প্রথম প্রথম ঐ ধারণাই করেছিলেন।

     ‎ নানান জায়গার মেয়েরা সব এসে মাকে কত কি বলত। ঠাকুরের কানে মাঝে মাঝে সেসব কথাও যেত। তিনি মাকে বলতেন, 'দেখ, ওরা সব এসে হাঁসপুকুরের চারধারে ঘুরে বেড়ায়, আর আমায় দেখেশুনে গিয়ে সব আপনাদের ভেতর কত কি কথাবার্তা কয়। আমি সব টের পাই। বলে, ''এঁর সব ভাল। তবে ঐ যে রাত্তিরে স্ত্রীর সঙ্গে একস্তরে শোন না -এই যা।'' ওদের কথাবার্তা, পরামর্শ -তুমি শুনোনি বাপু। ওরা সব বলবে, আমার মন ফেরাতে ওষুধপালা কর। দেখো, তাদের কথায় আমায় ওষুধপালা করোনি। আমার সব আছে। তবে ভগবানের জন্য, সব শক্তি তাঁতে দিয়ে রেখেছি।' মা আলতো আলতো ভাষায় জবাব দিতেন 'না না, সেকি কথা!'

     ‎ নহবতে তখন ঐটুকু ঘরে কিন্তু কি করে যে কুলিয়ে যেত, তাই এখন ভাবি। ঠাকুরেরই খেলা! মা, আমি, আর একটি মেয়ে। আবার কলকাতা থেকে কখন কখনও স্ত্রীভক্তেরা গিয়ে থাকতেন। কামারহাটির গোপালের-মা মাঝে মাঝে থাকতেন। তাঁর মস্ত মোটা-সোটা শরীর ছিল। ঐ তো একটুখানি ঘর। কিন্তু তার মধ্যেই কত কাণ্ড। এক বৃহৎ সংসার। আমাদের সব জিনিসপত্র। রাঁধবার সাজ সরঞ্জাম -তেল, নুন, লঙ্কা, তেজপাতা, মসলা, চালুনি, কুরুণি, বাসন-কোসন, হাঁড়ি-কুড়ি। ভাঁড়ারে সবই থাকত। খাবার জলের জালা। আর ঠাকুরের পেট খারাপ সহ তাঁর জন্য অনেক রকম পথ্যের জোগাড় থাকত। কই, সিঙ্গী, মাগুর জিওল মাছ যখন যা পাওয়া যেত।

     ‎ ঠাকুরের তো রাত্তিরে বেশি ঘুম হত না। অন্ধকার থাকতে থাকতে তিনি বেড়াতে বেড়াতে নহবতপানে এসে আমাকে ডাকতেন, 'ও লক্ষ্মী! লক্ষ্মী! উঠরে উঠ। তোর খুড়ীকে তোল রে! আর কত ঘুমোবি? রাত যে পোহাতে চলল। এইবার কাক-কোকিল ডাকল বলে। মার নাম কর।'


২)

     তখন শীতের সময়, ওঁর সাড়া পেলে মাঝে মাঝে মা লেপের ভেতর শুয়ে শুয়ে আমাকে আস্তে আস্তে বলতেন, 'তুই চুপ কর। ওঁর চোখে ঘুম নেই। এখনও উঠবার সময় হয়নি। কাক-কোকিল ডাকেনি। সাড়া দিস না।' সাড়া না পেলে তিনি নিজেই উপরে উঠে, জল নিয়ে দরজার গোড়ায় চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে ঢেলে দিতেন। তখন সব ভিজে যাবার ভয়ে তাড়াতাড়ি অগত্যা আমাদের উঠে পড়তেই হত। এক একদিন বিছানা ভিজেও যেত।

     ‎ ঠাকুরের মাথার চুল পেকেছিল দুচার গাঁজা। দাড়িরও কিছু কিছু। মাথার সামনে গরমের দরুন খানিকটা চুল উঠে গিয়েছিল। আর তিনি বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকতে মোটেই চাইতেন না। বলতেন, 'লোকে যে ঐ বলবে, রানী রাসমণির কালীবাড়িতে একটা 'বুড়ো'-সাধু থাকে, সেকথা আমি সইতে পারবনি বাপু। মা বলতেন, 'ওকথা কি বলতে আছে? তোমার কি এর মধ্যেই যাওয়ার সময় হয়েছে? আর বুড়ো হয়ে এখানে থাকলেও লোকে বলবে -রাসমণির কালীবাড়িতে কেমন একজন 'পিরবীণ' সাধু থাকেন। ঠাকুর: 'হ্যাঁ! লোকে তোমার পিরবীণ মিরবীণ অতশত বলতে যাচ্ছে আর কি!'

     ‎ আমি যখন বিয়ের পর বাপের বাড়িতে বিধবাবেশে ফিরে আসি, তখন তিনি আমায় একদিন বলেছিলেন, 'ধর্ম-কর্ম যা, সব ঘরে বসে করবি। বাইরে তীর্থে তীর্থে একলাটি ঘুরে বেড়াবি না। কার পাল্লায় পড়বি, কে জানে? ঐ খুড়ীমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। বাইরে বড় ভয়।'

     ‎ কামারপুকুরে থাকবার সময় ঠাকুর প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর পৈতৃক বাড়ির দরজার পাশে বসে থাকতেন এবং রাস্তা দিয়ে যারা যেত তাদের লক্ষ্য করতেন। সব মেয়েদেরই পুকুর থেকে জল আনার জন্য ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে হতো। তারা কলসী নিয়ে আসত এবং ঠাকুরকে দেখে সামনের ছোট উঠানে কলসী রেখে তাঁর পাশে বসে পড়তে। ঠাকুরের ঈশ্বরীয় কথা ও গান শোনার আনন্দে তারা সব কিছু ভুলে যেত। পাছে তারা নিজেদের কর্তব্যে অবহেলা করে, ঠাকুর তাদের ঐ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতেন। একটি মেয়ে বললো, 'আমার একটি গরু আছে। যখন শুনলুম আপনি আসছেন, এক মাসের মত খড় কেটে ঘর ভর্তি করে রেখেছি।' আর একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোর কোলের ছেলে কেমন আছে?' সেই বলল, 'এই রে আমি ভুলে গিয়েছিলুম, ওকে পাশের বাড়িতে রেখে এসেছি।' সে এক মাইলেরও বেশি পথ হেঁটে এসেছিল ঠাকুরকে দেখবার জন্য।

     ‎ একদিন ঠাকুর মেয়েদের বললেন, 'আজ তোরা গা, আমি শুনি।' তারা সবাই চুপ করে রইল। কেউ টু-শব্দ করতে সাহস করল না। কিন্তু একটি মেয়ে ছিল, তাকে ঠাকুর খুব ভালবাসতেন, সে না এলে ঠাকুর তাকে ডেকে পাঠাতেন। যেই সে দেখলো যে আর কেউ গাইবে না, অমনি সে ক্ষীণ মিহি ও কাঁপা গলায় একটি গান গাইতে আরম্ভ করল। অন্য মেয়েরা হাসতে লাগলো। কিন্তু তার গান শেষ হলে ঠাকুর আনন্দ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, 'দেখ, এর কত ভক্তি। আমি বললুম বলেই ও এত সহজ ও সরলভাবে গান গাইল। তোদের মধ্যে শুধু এরই সত্যি সত্যি ভক্তি আছে।'

     ‎ মেয়েরা নির্লজ্জ বেহায়া হবে, তা তিনি সহ্য করতে মোটেই পারতেন না। মাকে বলতেন ওদের মত তুমি হবে কেন? এক পা বেলতলায় আর এক পা বটতলায় দিয়ে, বেহায়ার মতন চলতে চায়? মেয়েদের সরম-লজ্জা থাকবে। নারীর লজ্জাই ভূষণ।

                   

 ৩)

    চিনু শাঁখারী আমাদের কামারপুকুরে পাড়ার মধ্যে খুব পরিচিত, ঠাকুরের বাল্যসখা। সাধন করতে করতে তাঁর ভেতরে একসময় কিছু বিভূতি সিদ্ধাই ফুটেছিল। সৌম্যমূর্তি পরম বৈষ্ণব। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হলে, তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিনুদাদা আদর করতেন আর বলতেন, 'ওরে গদাই, তোকে দেখে আমার গৌরকে মনে হয়।' একবার আমাদের দেশের কয়েকজন লোক গঙ্গা নাইতে দক্ষিণেশ্বরে যায়। গিয়ে ঠাকুরকে তারা চিনুদাদার অদ্ভুত শক্তির কথা গল্প করলে। -একসময় ঘুরতে ঘুরতে কতগুলো লোক কামারপুকুরে চিনুদার বাড়িতে গিয়ে অতিথি হলো। তখন আমের সময় নয়। কিন্তু দাদাকে বললে, 'আমাদের আমের টক দিয়ে মৌরালা মাছ খেতে বড় ইচ্ছা!' মাছ জোগাড় হল। অতিথি নারায়ণ, তাঁরা আম দিয়ে টক খাবেন বলেছেন! চিনুদা ভেবেই অস্থির। কেমন করে মুখ রক্ষা হবে! কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিনুদা উপায়ান্তর না দেখে, জোড়হাতে গলায় কাপড় দিয়ে একটি আম গাছের তলায় গিয়ে বললেন, 'আমার ভিটেয় আজ ছলনা করতে নারায়ণ অতিথিরূপে এসে বলছেন, -এই সময়ে আম দিয়ে মাছের টক খাবেন। আমি বড় গরিব দীন-হীন পথের কাঙাল। কেমন করে তাঁদের তুষ্ট করব? হে দেবতা! কি দয়া করবেন না?' তারপর আশ্চর্য! সত্য সত্য গুটিকয়েক কাঁচা আম গাছ থেকে পড়ল। চিনুদা আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচতে নাচতে তাই দিয়ে টক রাঁধিয়ে তাদের পরিতুষ্ট করলেন।

     ‎ঠাকুর ওই গল্প শুনলেন। তারপর দেশে যান, তখন চিনুদাকে বলেছিলেন, 'ছিঃ দাদা, বিভূতি সিদ্ধাই হ্যাক-থু! এমন আর করোনি। তা হলে ব্যাটা বেটিরা তোমার মাথা খাবে। অষ্টপ্রহর বিরক্ত করবে। তোমার নিজের সাধন-ভজন অষ্টরম্ভা হবে। খবরদার ওসব আর করতে যেওনি। ওসবে মন দিলে মন নেমে যাবে।'

     ‎ঠাকুর পুরীতে যাননি। বলরামবাবু যখন একদিন মহাপ্রসাদ নিয়ে গিয়ে তাঁকে দিলেন, দেখেছি -তিনি মাথায় ঠেকালেন। প্রণাম করলেন। তাঁর ভাব হলো। পরে বললেন, 'জগন্নাথে যেন আমি গিয়েছি। সেখানে সবই বড়। বিরাট। সমুদ্র বড়। রাস্তা-ঘাট সব বড় বড়। এই শরীর নিয়ে সেখানে গেলে, এটা থাকবেনি।'

     ‎মায়ের সঙ্গে আমি তখন দক্ষিণেশ্বরে থাকতাম। একদিন মা বললেন, 'কাল উনি আমার জিভে মন্ত্র লিখে দিয়েছেন। তুইও যা না!' আমি বললুম, 'আমার বড় লজ্জা করে। কি বলে চাইব? কারা কারা সব থাকে।'

     ‎তারপর একদিন প্রণাম করতে গিয়েছি, কিছু বলিনি। তিনি আপনিই বললেন, 'তোর কোন ঠাকুর ভালো লাগে?' শুনে আমার ভারি ভেতরে ভেতরে আনন্দ। বললুম 'কৃষ্ণ'। তিনি ওই বীজ ও নাম জিভে লিখে দিলেন। আমার গলায় তুলসীর কন্ঠী মালা ছিল। কামারপুকুরের জমিদার লাহাবাবুদের পেসন্নদিদি পরিয়ে দিয়েছিল। বললেন, 'মালা রাখবি। তোকে বেশ দেখায়।'

     ‎আমি ও মা ইতোপূর্বে একজন উত্তর দেশীয় সন্ন্যাসীর কাছে দেবী ভজনের উপদেশ নিয়েছিলাম। বেশ মোটাসোটা খাসা চেহারা। শান্ত মূর্তি। নাম পূর্ণানন্দ স্বামী। বুড়ো দেখতে যেন পাকা আমটি। সে কথা মা পরে ঠাকুরকে বলেছিলেন। তিনি বললেন, 'তা হোক, লক্ষ্মীকে আমি ঠিকই দিয়েছি।' সন্ন্যাসী আমাদের কামারপুকুরে গিয়েছিলেন। শুনেছি, তাঁর কাছ থেকে ঠাকুর ও আমার বাবাও কি কি মন্ত্র সব শুনেছিলেন।

     ‎দক্ষিণেশ্বরে বসে যখন দেশের ৺শীতলার কথা মনে পড়তো তখন কেউ কিছু মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে গেলে বলতেন, 'লক্ষ্মীকে খাইয়ে দাও। তাহলেই মা শীতলার ভোগ হবে। ও তাঁরই অংশ।' গিরিশবাবুকে দিয়ে একবার এইরকম করিয়েছিলেন।

     ‎আবার কখনো কখনো তাঁর ঘরে কীর্তন গান ইত্যাদি হবার আগে রামলালদাকে বলতেন ঘরের নহবতপানের দরজাটি খুলে দিতে 'কত ভাব-ভক্তি হবে। ওরা সব দেখবেনি? শুনবেনি? কেমন করে তবে শিখবে?' পরেই হাসতে হাসতে 'ওরে রামনেলো, তোর খুড়ির পর্দা যে ফাঁক হয়ে গেল!' টাটির ভেতর ছোট ছেঁদা দিয়ে মা সব দেখতেন। তাতেই আনন্দ পেতেন।

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা --- সুবোধ সরকার

এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | প্রথম সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয় কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন স্বনামধন্য কবি সুবোধ সরকার |




আমাদের দিন

 সুবোধ সরকার


ককপিটে যেমন বসি, এই হাতে চুড়িও পরি 

মাঠে মাঠে খরার আগে, জল এনে কলসি ভরি ।


জল এনে দেবার লোক, বেশি নেই এ সংসারে

মেয়েরাই পাতাকুড়োনি, দুঃখকে কুড়োতে পারে ।


ঘরে করি লড়াই রাতে, আদালতের লড়াই দিনে

বাড়ি ফিরি বাবার কাছে, বাবাদের ওষুধ কিনে।


ভুল করে তাড়াহুড়োয়,এক কানের দুল পরেছি

আর ভুল করবো না গো,মার খেয়ে ভুল করেছি।


 আছি বেশ নিজের মতো, ফ্ল্যাট কিনে হাইরাইজে 

চোখে যদি জল না থাকে, বৃষ্টিতে কী হবে ভিজে?


ককপিটে যেমন বসি, এক আকাশ শাসন করি

নদী থেকে সিন্ধু থেকে জল এনে কলস ভরি ।


আমরাই অরুন্ধতী আমরাই কৃষ্ণকলি 

আমাদের স্বপ্ন আছে, দেখা হবে আজকে চলি ।

কবিতা উপন্যাস ---- দীপংকর রায়


 " বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল  ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় " লিখেছিলেন জীবনানন্দ । কবি দীপংকর রায়ের  কবিতা স্বতন্ত্রভাবে , অতলস্পর্শী ভাবনার গভীরতায় স্পর্শ করে  আমাদের চৈতন্যের নদী । দেশজ  আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে , বিরল পংক্তি বিন্যাসে এক মায়াময় ব্যতিক্রমী কবিতাজগৎ সৃষ্টি করেন তিনি । এখানে আমরা ধারাবাহিকভাবে পড়বো তাঁর একটি কবিতা উপন্যাস ।



কোথাকার অতিথি আমি ( মানসভ্রমণ )



দীপংকর রায় 

 


হাতে বেশি সময় নেই, চলুন বেরিয়ে পড়ি..... আলম তো বলেছে, ঘুরে আসুন, এখন করোনা ---পাশপোর্ট-ভিসা- ইমিগ্রেশন ,সরকারী ছাড়পত্রের নেই প্রয়োজন। চেকপোষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যাব। বাঁশ -টাঙ্গানো থাকে থাকুক, হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যাবো.... কতোদিনের স্বাদ, মানিক, মুনাই ,কার্তিক দেবনাথ, আরো যে যে যাবে.... তাপস কি যাবে, বাবলা, শক্তির খোঁজ নেই। সুশান্ত হাটতে পারে না, পায়ে ব্যথা। 

যাচ্ছি তো যাচ্ছি ই-- 

হ্যন্ডিকামে ছবি তুলছে মাগুরার ফাঁকা পথের ----এই দাঁড়াও, এই দ্যাখো বড়োপোল, চাউলে বাস-স্ট্যান্ডের ছবি তুলেছি, কী সুনসান....! স্বপন চক্রবর্তী বলছে। মাগুরা থেকে রূপন্তি বায়না ধরছিল যাবে। রীয়া বললো, সেলফি তুলবো যেমন খুশি। মানিক বলছে, সত্যিই দাদা, এটা ওয়ার্লেস মোড় না, এটা সত্যিই নবগঙ্গা --- 


বাতাসে বাতাসে পথ পায়ের উপর সোজা  

দেখেছ দেখেছ মানিক, দ্যাখো দ্যাখো ---দুহাজার  বহু পেছনে হারিয়ে গ্যাছে তো কী হয়েছে ---রাড়ীখালী তো রাড়ীখালীই ---কই দীপঙ্কর কই---তাকে দ্যাখা যাচ্ছে না কেন?.... উৎসবেরই বা কী হবে, খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই ---এই পথ তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে ,যেভাবে খুশি যাবো আসবো.... 

মানিক বলছে, তা তো হলো, সে কই---- জল-বাতাসে ঢেউ তুলে  , সকলেরই আরো একটু ঢেউ চাই -----নাহলে কি শরীর জুড়োয়, এসব সব তো চেনা ,'মুনাই বলছে, আপনারা না হয় নতুন, ও মানিকদা, কার্তিকদা ,চিতসাতার দিয়ে নিন , তারপর না হয় ডানা কাটুন জল, দেখবেন, সব ক্লান্তি একেবারে সাফ ---

সে তো হলো, সে কই , তোমরা তো আসল লোককেই খুঁজে পেলে না ,গ্যালো কোথায়? 

দ্যাখো এতক্ষণে উড়ে যেয়ে কোন ডালে বসেছে ,তার তো কতো শাখা-প্রশাখা ---

রূপন্তী বলছে ,এই তো, এই তো, এখন আমার হাত ধরা ---

বলে দিয়েছি, আর কোনো দিকে না, '

রিয়া বলছে, সেলফী সেলফী, শস্যফুল নেই তো কি, আমগাছের ডাল ধরেই ঝুলে পড়ি এসো। মানিক বলছে, তা নাহয় পড়লাম, কোথায় গ্যালো ' ইচ্ছে-পতঙ্গের কান্না? 

---আছে আছে, ভালো করে দ্যাখো মানিক ---সবটাই তো ইচ্ছ-পতঙ্গের কান্না, ওই যে.... ওই যে.....,'ওইখানে আছে তারা.... 

---আবার বলছে, এই বাবলা, তুই তোল কিছু , তাপস ,তুমি কিন্তু তুলে যেও, বলা তো যায় না, অনেকদিন পড়ে আছে হ্যন্ডিকামটা ---- মানিক বলছে, চিন্তা নেই, আমি তো নিচ্ছি ---কিন্তু আপনারা যে বলছেন সে আছে, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না? 

রূপন্তী বলছে, বললাম না, আমার কাছে, বাচাধনকে বলেছি, আর যাই করো, আর একদম এদিক ওদিক না। একজনেরই ছাড় আছে, বাকি অর্ধেক আমার, তাই তো আগলে রেখেছি, যদি পালায়,সময় এলেই ছেড়ে দেব, তখন না হয় চিলে ওড়া উড়ে দ্যখাবে, '  ঠিক আছে, ঠিক আছে, অনুষ্ঠান শুরু করে দেওয়া যাক, '....


সমবেত কন্ঠস্বরে উৎসব এখন ।

নবগঙ্গা থেকে এক আজলা জল তুলে মুনাই টেবিলে ছড়িয়ে দিল, বাকি কাজ যা যা গুছিয়ে রেখেছে আগেই বিধান। শুনুমামা কোথায় ছিলো, হাতে তালি দিয়ে উঠলো। সকলেই বিস্ময়-ভরা চোখে তার রবীন্দ্রসঙ্গীতে মন দিয়েছে ---সে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে আর বলছে, 'কে বলেছে আমি নেই..... '


তাপস, বাবলা, কার্তিক, মানিক সকলেই চেয়ে চেয়ে দেখছে আর বলছে, কাউকেই তো দ্যাখা যাচ্ছে না, তাহলে সুর ভেসে আসছে কোত্থেকে....? 

স্বপন চক্রবর্তী বলছে, মানিক, ওতো  শুনুমামা  , ওই যে.... ওই যে, দেখতে পাচ্ছ না? বিধান চোখ মুছছে। বিদ্যুৎ মামা চ্যাচাচ্ছে ,পাগল.... পাগল বলে। মামা বলছে, ও মামা, ও মামা ,আপনি তো জানেন,'  

 ---   দাদুভাই কিছু বলো?

মুনাই আকাশ থেকে দুহাতে সব মেঘ পেড়ে এনে, সমবেত দর্শকমণ্ডলীর দিকে চেয়ে আছে স্থির!

স্বপন চক্রবর্তী ফিসফিস করে, চলো, চলো, পরে বলছি, এখন চলো দেখাই সকল চরিত্রদের ,এই দ্যাখো, জাবা -চেনি রোদ্দুরে দেওয়া। এই দ্যাখো, মলন মলার খুঁটো ।এই তো গ্রীষ্মের রোদ্দুরে ভেসে বেড়াচ্ছে দিদিমা ---বড়ো -মা রা সকলেই। ওইখানে পোড়োবাড়ির উঠোন জুড়ে হা -ডুডু খেলছে ছুঁচো -ইঁদুরেরা ।এইখানে কালীমন্দির, দিদিমা ঘর আর নেই। 

----আরো আছে যা যা 

তা ওইখানে কোলে করে বসে আছেন নতুন মাসিমা! 

এতগুলি ক্যামেরায় যা যা উঠলো , নবগঙ্গার পাড়ে যেতেই হাওয়ায় হাওয়ায় ভেঙে গ্যালো যেন সব। মানিক চিৎকার করে উঠলো, আরে আরে, কী করছেন কি স্বপনদা,পড়ে যাবেন তো, ' পাউড়িতে দাঁড়ায় নাকি কেউ? 


এতক্ষণ কোথায় কোথায় যে ছিলাম, কোথায় কোথায় যে লুকিয়ে ঘুরিয়ে আনলো রূপন্তী, কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, বগুড়া না মাগুরা, মাগুরা না বগুড়া? অথচ এখানেই তো ছিলাম ওর ওড়নার আড়ালে.....?


রূপন্তী বলছে, ভালো হবে না কিন্তু, আমি তো  কখনই একটু আড়াল করেই ছেড়ে দিয়েছি, তুমিই তো বললে, একটু দেখিস, যদি কেউ খোঁজে তো বলিস, এই আমাকে দেখাস শরীরটা শুধু ----মনটার না হয় অনেক আতিথেয়তা থাকে, '


----এভাবেই বাতাসে বাতাস, মেঘে মেঘ, রোদ্দুরে রোদ্দুর ....সকলে মিলে কোথাকার অতিথি হলাম যেন...! 

নীলকমল নিঃশব্দ ছিল, যেমন থাকে, শুধু বললো, পাসপোর্টে ছাপ পড়লো না  যে? মুনাই -স্বপন চক্রবর্তী বললো একসাথে, খরচা নেই এই পর্যটনে .....



পর্যটন পর্ব ---2                                                  


অন্ধকার থাকতে থাকতে চলুন

এরপর নানা কৈফিয়ত ।

নলডাঙায় যাবো, প্রতিমার  মাকে দেখতে ---আজ সেই পথে চলুন 

মাগুরা ছাড়ালেই ---আর বাধা নেই, দিগন্তপ্রসারী মাঠ -----

শিশু-কড়াই-মেহগনী-জারুল ছায়ায় সকালের রোদ্দুরের খেলা ---


ওখানে কোনো বারণ নেই 

চা পেলে চা, না পেলে তো ধান-পাটের ভূইয়ে পাতলা মেঘেদের ছায়ায় ছায়ায় ঝিমুনি আছেই 

আকাশের তলায় শুয়ে থাকবো আমরা ডানা মেলে দোয়েল-শ্যমাদের মতো। 


নাড়া তুলে না হয় লাইটার জ্বালাবো ,ছোলা-গাছ পুড়িয়ে খেয়ে নেব সবাই -----

বলা তো যায় না, কী পাবো কী পাবো না 

ওই তো পথের ধারে বাঁশের মাচায় বসে পড়ি কিছুক্ষণ, 

এতগুলি মানুষ দেখে বন্ধ-দোকানের ঠিকই তুলবে ঝাপ ---

না হয় বলবো সব কথা ---না হয় বলবো পকেটের ভেতরে রেখেছি যাকে 

          তার মুখটি দ্যখাবো---


ভয় কী, কেউ দেখবে না। যে আছে সে থাক গোপনে। 

তার কথা বলা যাবে না এখন, সে তো একান্ত গোপন,…

সে আমার ওই হু হু হাওয়ায় মেশানো পথের মুগ্ধতায় কেবলই ডানা মেলা 

সে আমার মাঠ-ঘাট জোড়া দীর্ঘশ্বাস এক ,'


তাই, সে আছে যখন ম্যানেজ করে নেবে সব, যাকিছু লৌকিকতা ----

আমি তো তার হাতেই তুলে দিয়েছি এই পর্যটনের ভার, '


কে কার কথা শোনে, স্বপনবাবু বলছে, তাই কি হয়---? মুনাই বলছে, মামার না হয়  শ্বশুরবাড়ি, আমাদের তো শ্বশুরবাড়ি না ----মানিক বলছে, তাই তো, ঠিক-ই বলেছ মুনাই ,বিশ্ব কোত্থেকে জুড়ে গ্যালো, তাকে তো আনিনি ,আসার সময় তার কথা ভুলে গ্যাছিলাম একদম |

বিশ্ব সিগারেট বের করলো পকেট থেকে, বলছে, একদম দু-একটা ---নিন ধরুন, ওসব বাজেকথা রাখুন তো, মুনাই, এই মুনাই,চলো তো ,সামনের ওই যে জায়গাটা, ওখানে দেখি, 

তাপস বলছে, সে কি কথা, তাই কি হয়, বউদি কী বলবে? এইভাবে এক একজন এক এক কথা নিয়ে গোল,' পকেটে লুকোনো যে জন, সে হাসছে মিটি মিটি ,' 

সে তো জানে নানা কায়দায় ক্ষীর-সন্দেশ পুরে দিয়েছিল কীভাবে ঠাকুরদাস ---

ও বাবা তুমি তো বিষয়ী 

              জানোও ,'

তাই তো বলি এমন কাজ তো তোমারই ক্ষমতা ---এ যে অর্ধেক রাজত্বসহ রাজকন্যা ----  !

থুড়ি ,বলা যাবে না কাউকে। গোপন চুক্তি। 

একদমই মুখ বার করতে দেওয়া যাবে না। 

তার চাইতে হাততালি দিয়ে গুপি-বাঘার মতোন পার করে দি এইসময়---

না হলে মুনাই যে লৌকিকতার জন্যে ব্যস্ত 


না পেলে কী উপায়.....?

ছবি উঠছে , ছবি উঠছে--পুরো ছবিটাই হ্যান্ডিকামে 

ধরা থাকছে? 

স্বপনবাবু বলছে, মানিক, দীপঙ্করের শ্বশুরবাড়ির জন্যে কিছুটা রাখি, বলা তো যায় না, তুমি তো প্রথম,

 যদি কিছু ইচ্ছা হয়,'

বাতাসে ভাসছে কাঠ-পোড়া জ্বালানির গন্ধ। 

বাবলা-নীল কমল, কার্তিক মৌনব্রত পালন করছে নাকি? 

এই বাবলা, ছবি তোল, ছবি তোল, তোর ফেসবুকের কী হলো? 

স্বপনবাবু বলছে। 


বাবলা বলছে, ধুর, ফেসবুক আমি আবার পারি নাকি! কার্তিক বলছে, সবটাই আপনা কায়দা, না হলে পুজোটা কোথায়.....?  না না ,হাসলে হবে না কার্তিকদা, সবটাই কায়দা না, কিছু তো সত্যি ---তাপস বলছে। 


ঘুরে ঘুরে পথ চলছে পথের মতন ,ঘুরে ঘুরে ডোবা-পুকুর -মাঠ-খামার গোয়ালঘর ,রাজহাঁসের প্যাক প্যাক.... মোরোগের ডেকে ওঠা, স্কুলঘর--মাদ্রাসা ---খেলারমাঠ -----মাটির ঘরদুয়োর, সব চলকে চলকে ভেসে যাচ্ছে চোখে -মুখে ----


এই পথ সত্যি বাড়তি পাওনা, এই না হলে বাঙলাদেশ ? মানিক এবং বিশ্ব একসাথে বলে উঠলো। 

বিশ্ব, নমস্কার বাবা করোনা, তুমি এলে বলেই এমনভাবে আসা হলো ,তা না হলে যত সব ঝামেলা, আমার কি পোষায়? 

স্বপনবাবু গান ধরেছে ---'আজি দখিন-দুয়ার খোলা ----এসো হে, 

এসো হে, এসো হে, আমার  বসন্ত এসো। 

 দিব হৃদয়দোলায় দোলা,...... '


গানে গলা মেলাচ্ছে কেউ কেউ। কেউ কেউ আঙুলে আঙুলের ঠোকা দিয়ে সুরে সুর মেলাচ্ছে 

 এই বৈশাখে...., '

আড়ালে যেজন সেজন শুধু খোঁচা মারছে আর বলছে, কী হলো, এভাবে কত আর? 

আমি বলছি, কেন, বেশ তো আছো, সময় হোক, সময় হোক.... 

তাপস বলছে, কাউন্টারটা দিয়েন, সিগারেট পুড়ছে দুরন্ত বাতাসে। বাবলা ঝিমোচ্ছে ।নীল কমল মোবাইল ঘুরিয়ে চলেছে আপন ছন্দে। মানিক বলছে, বেশ তো, বেশ তো, এই পথ যদি না ফুরোয় .....বেলা চড়ছে,রোদেরা খেলা করছে ল্যাংটা-শিশুদের মতো পথের ধুলোয়। মানুষ -জন নেই ,শুধু পথ আর পথ বাতাসের ভরে আমরা কজন যেন ছুটে চলেছি ছেঁড়া- পাটের -আশের মতো .....


মুনাই বলছে, এই তো, এই তো স্বপনদা,নলডাঙার স্কুল, গৌতমের দোকান না. ..চলেন, চলেন ,নামি ....,'

কদমগাছতলায় এসে গ্যাছি, ডোবাটির ভেতর থেকে উঠে এলো প্রতিমার ঠাকুমা, বলছে ,জামাই এলে গো, জামাই এলো ---উলু দাও...... এগিয়ে আসছে একে একে সবাই, বাঘাকুকুরটা ডেকে উঠলো.... মধুকাকু বলছে, এই ---হেই ---আহা, তুমি যেন চেন না...? যা, যা, ওদিকে, আসেন, আসেন, ভালো আছেন তো? 

সন্তু -অন্তুকে দেখে মুনাই বলছে, তোরা কতো বড়ো হয়ে গেছিস রে...., স্বপনদা, চিনতে পারছেন...?স্বপনবাবু ঘুরছে আর বলছে, কতো পাল্টে গ্যাছে সব.... দু’হাজার আর দু’হাজার কুড়ি..... বুঝলে কিনা মানিক, ওই তো, ওইখানে ওরা পড়ছিল,সবাইমিলে হারিকেন জ্বলে..... হ্যা হ্যা গৌতম ভালো তো, তোমার দেওয়া খাতাখানি আজো আছে, একটা দাগ ও দিই নি ----কই ,দিদি কই ,এই তো, লাবনী- শ্রাবণী ভালো আছে তো? 


আমি স্থির, একেবারেই স্থির। ঠাকুমাকে দ্যাখা যাচ্ছে না আর। ডেকে দিয়েই ডুব! প্রতিমার দাদুকেও দেখলাম একঝলক শিউলিতলায় ,'ওমা, শিউলি গাছটা কোথায়? যেখানে গ্রুপ- ছবি তোলা হয়েছিল প্রতিমার দাদুর সাথে। বনির সেই লাল গেঞ্জিটাকতো ছোট দ্যখাচ্ছে এখন...... !

এরা সব কোথায় গ্যালো, ও স্বপনবাবু? 

---মুনাই নিয়ে গ্যাছে বেগবতীর দিকে--- 

বাশ-ঝাড় --জঙ্গল---বেতবন --শিশু --মেহগনির ছায়ায়, 

ও গৌতম, আমি কি দোতলায় যাবো?

গৌতম বলছে ,সে কি, উপরে তো আপনার বিছানা করে রেখেছে উর্মি ---যান না কজন যাবেন। বাড়িশুদ্ধ এ ওর মুখের দিকে চাইছে ----শ্বাশুরিরা বলছে, যাও, যাও তো বাবা ---হাত-মুখ ধুয়ে নাও গে, আর বলো না, কী দিন যে আসলো, '

ঘরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে খচমচ, ----কী হলো কী? 

বেরোবে না আমি? 

বলছি তো হবে, হবে, হবে রে বাবা, বস, তারপর না হয় লুকিয়ে পড়িস আবার, বুঝিস না কেন, শ্বশুর বাড়ি বলে কথা? 

ফিরে এসে সকলেই বিশ্রাম গ্যালো। 

সামনের লম্বা ছাদের উপর শুনতে লাগলাম বত্রিশ বছরের আলো -হাওয়াদের কথা বলাবলি। জামরুল গাছটা বলছে দিদি কই ও জামাইবাবু? নিচের জবাগাছটাও 

                  লালে লাল ----

সে যেন স্বপনবাবুর ক্যামেরা  আমাদের যুগলবন্দী মেলে ধরলো। 

কাকে যেন ডাকতে থাকলাম ---

কে যেন পিছন থেকে দুচোখ চেপে ধরে বলতে থাকলো, উ হু, একদম না ---একদম না, আগে বলুন তো আমি কে? কতোজনকে যে কতোজনের কথা বলি? 

সকলেই গোল হয়ে ঘিরে ধরলো। ----তা হবে না, তা হবে না -----বলতে তো হবেই.... ,'

যেই ফিরে দাঁড়ালাম ,ওমনি সে ছায়া হয়ে সরে গ্যালো গাঢ় অন্ধকারে----

কী যে করি ---কাকে যে বলি , তুমি যে কে....? 

ভেতর থেকে আবারো ---কী হলো, আমি যে একা----

বেশ তো লুকোচুরি খেলে !

কতো খেলার তুমি যে নায়ক-----.আপনারা জানেন কিছু ---?


একসাথে এতগুলি ক্যামেরা ,অমি কোনদিকে যে দাঁড়াই ,কেমনভাবে যে ঘোরাই মুখটা 

কোথাও নিজের মুখটাকে তো পাই না !

ডেকে ওঠে, চোখ গ্যালো, চোখ গ্যালো , চোখ গ্যলো পাখিটা -----,'

মুনাই আবার বলছে, খরচা নেই, খরচা নেই..... চলুন বেরিয়ে পড়ি, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির দেখে ঝুমকোজব| বনের ভেতর বেগবতীর চড়ায়, সেই সাকোটা ----কালীদহ স্নান করে নি চলুন। 

মানিক বলছে, মধুসূদনের বাড়ি যাবো না? কপতাক্ষ, কতো দুরে? 

তাপস বলছে, যাবো তো, এ সুযোগে পতিসর, শিলাইদহ, সাজাতপুর,  লালনের আখড়ায় বাউল হবো না, তাই কি হয়? 

রাতের আকাশ জুড়ে অসংখ্য নক্ষত্রেরা ঝুলে আছে মাথার উপর। 

ছাদে আমরা কজন 

বাঙলার এই রাত্রি আকাশে নক্ষত্রদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে 

যার যার কথা যার যার মনে, তাসের ঝোলা থেকে বেরিয়ে লুকিয়ে রাখা বস্তুটি ,,'

কার্তিক নেচে উঠলো , বাবলা বিশ্ব স্বপনবাবু মুনাই,যে যার মতো পাখি হয়ে গ্যাছে যেন, রাত পাখি...... 


মানিক বলছে, ওই যে.... ওই যে.... 

ছায়ার খিদেয় আমরা আজ মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, '

দেখি লক্ষ্মী-প্যাচা হয়ে বাদুড়ের ডানায় এই যে আমরা লিচুর খোসা ছাড়াচ্ছি , ও স্বপনবাবু, আমরা কি সকলেই এখন এক একটি ভেসে বেড়ানো প্যাচা ....?  কতকাল এই ঘুম-জাগরণে তাপসের লুকোনো বস্তুটি গলায় ঢেলে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের অপেক্ষায় বসে থাকবো তাই বলুন দেখি? 


বাতাসে এখন কাঠপোড়ার গন্ধ। বাতাসে এখন ঝি ঝি  পাকিদের চিৎকার। 

তবু বাতাবিফুলের গন্ধ আসছে ভেসে...... 

কে যেন ঝপ করে কোলের ভেতর পড়লো  মুখগুজে , শেষরাতের  কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো কিনতে থাকলো, 


এই মুখ- অন্ধকারে ওখানে তুমি কে?


 


 পর্যটন পর্ব ----- 3                         



সম্পর্কের ব্যবধান বোঝেনা এই যাত্রা পথ ---

কে যে কেবলই পেছনে পেছনে ছোটে -----


এক-জায়গার সকাল আর এক জায়গায় মনমরা। সমস্ত ঋতুমুখ ছুঁয়ে চলে এই ঘোর, '

কুয়াশায় মাখামাখি হয়, 'পথের দু-পাশ তুলে দেয় থোড়ো ধান-গাছের ঢেউ, '

বাচক -পাটের বোঝা নিয়ে চলে যায় যে চাষা 

তার সকল বৈশাখ চিনি আমি? 

তার শেষ বসন্তর কৃষ্ণচূড়া ডালে ডালে ----পাটমাদারেরা এখনো খানিকটা লাল, '


তুমি কেদনা  , কেদনা--- পথের ধুলায় তোমার আঁচল ছিঁড়ে যায় দেখি...,'


আসা -যাওয়া চলতেই থাকে , হোক তা বাউলের,' হোক তা বৈষ্ণবের খঞ্জনী,' হয়ে যাক একতারার টঙ্কার। 


তুমি কেদনা , কেদনা   অমন করে আর 

--এই শিশুগাছের ছায়ায় ছায়ায় ----

ফাঁকা পথের হলকায় 

যে-মুখ দেখি আমি 

তাকে কেমন করে পরিচয় করাই, চিবুকটি ধরে কেমন করেই বা বোঝাই 


চেয়ে দ্যাখো, চেয়ে দ্যাখো এই বাঙলায়,ওই পথপাশে আঙিনায়, বসে আছে যে বাঁশের খুঁটিটি…

ধরে ,কেমন জড়িয়ে আছে অজানা-অপেক্ষা ,এই সকালের 

               একচিলতে আলোয় আলোয়.....,'


হ্যাঁ হ্যাঁ সেই তো, সেই তো আমাদের বিভক্ত দেশ ও মৃত্তিকা ---

হাজার নিয়র ঝরা রাতের গল্প, বকুল ফুলের বৃষ্টি ভেজা রাতের গান, 

ঘুঘু - ডাকা এক একটি দুপুরবেলার স্মৃতি, '

কেবলই ভাসায় নৌকো ,

নৌকো ভাসায় মেঘভাঙা নদীতে ঝোড়ো হাওয়ারা 

                          এসে.....


সে কপোতাক্ষ আমি কীভাবে আজলায় তুলি 

কীভাবে বোঝাই 'সতত,হে নদ ,তুমি পড় মোর মনে।....,'


গান ধরেছে আবারো স্বপনবাবু, সুরে সুর মেলাই.... 


এসো, সবাই জন্মকোল থেকে তুলে ধরি তাঁর বাল্যকাল, যে কবি বেঁচে ছিল আশৈশব এই মুখটি নিয়ে বুকে 

সেই জননী-জান্হবী কাঁদছে যেন আজো 

      কপোতাক্ষের ঢেউয়ে--


আমরা যার অমিত্রাক্ষে চতুর্দশপদী ,'

শুনি, দাঁড়াও ,পথিক-বর, জন্ম যদি তব /বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!....,''


বলছিলাম গল্পটি ---মানিক, তাপস, কার্তিক মন দিয়েছিল। মুনাই তো জানেই, বিশ্ব বলছিল, ও বাবা, এখানেও কাহিনী? বাবলা,    হোক না, ক্ষতি নেই তো! 

অধৈর্য হলে হলো ,যে বাক ঘুরে ঘুরে এলে, এর প্রতিটি খাজে খাজে এক একটি গল্প, শোনো, মিথ্যা বলছি কি না? 

মুনাই, কোন খাদে যে কোন সোনা, সে তো খাদানের শ্রমিকই জানে,''

ওসব রেখে, চলো যাই আগে, সেবার তো এখানেই বিহ্বল বাপি, 

কবিতা পড়া শুরু করে দিল, কোথাকার গোল কোথায় গ্যালো যে? 

জল যেন আগুন, জলে যেন উতল এসেছিল এক,'


তারপর সব ছবি, কেউ কি দ্যাখে, আমি দেখি, আমি দেখি ,সমস্ত দেশটায় কী যে আবেগ, কী যে উৎসর্গ .

বলি না  তো, কিছুই বলি না, দুদিনেই ফুরিয়ে গ্যালো? 

হায়, সব শূণ্য , সব ----

নিতান্ত আবেগটুকুও নাই? 


মানিককে বলছিলাম,' ইতির-কথা', গল্পটি... 

চলো তাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। 

স্বপনবাবু বলছিল, যাবেন ,পথ কিন্ত অনেক 

শেষে যদি সমস্যায় পড়ি এতগুলি মানুষ, ওদিকে আবার লাবুর শ্বশুরবাড়ি, '

বললাম, মণিরামপুর, শ্রবণা, না না, দাড়ায়নিতো পথের মোড়ে,'

আবেগটাতো একপক্ষের না, ইতি নাহয় থাক, তাছাড়া কালের নিয়মে বয়েসও তো বাড়লো, ছেলে শুনেছি এখানেই কর্মরত, বঙ্সগত অধিকারে চাকরি ,কী দেখুন ,ছেলের জন্যে বাবার চাকরিটাই গ্যালো, এইতো, এখানেইতো ছিলো, এখন সেই মাঠের এককোণায় মিলছে খানিকটা জমি, আর আছে পদবীটা ,''


কার্তিক বলছে, তাই, আপনার আত্মীয়? কতোদিন ছড়িয়ে রেখেছেন যে লতাপাতা , ঐদিকে বলছেন 'পতিসর,' সেখানেও নাকি আছে, কী বললেন,চৌধুরী না কে, '


এই গান গাইবো একখানা? 

এরপর তার দুহাত বাড়িয়ে ,কাদ ঝাঁকিয়ে 

'"পরান মাঝে কী আছে লুকোনো ......,''

তারই খানিকটা ---


কে যে কাকে চিনি, কে যে কাতে পরিচিত হই.....?  কই ,কোথাও পেলে কি সেই ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত দালান, গাছগাছালির চিৎকার, ''

এখন তো রাজবদান্য পেয়ে বুকফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিমেন্টকাস্টিঙ,''

এ দশা তো শিলাইদহতেও ,এ মা  ,এ কী কুঠিবাড়ির চেহারা? 


শাদা কি সুফি-দরবেশ , শাদা কি শান্তি দেয় শুধুই? 

কোথাও রঙ থাকবে না 

কোথাও জীবন, সবটাই দুহাত তোলা? 


এই সব ভেল্কিতে বিশ্বাস নেই কারো, যে যেমন তাকে সেখানেই থাকতে দাও না, '

কখন যেন কপোতাক্ষের পাড়ে আমরা সবাই 

ঢেউয়েরা বলছে যেন, যে নদীটি আসমুদ্রহিমাচল ,'

যে নদীটি টেমস্ না হয়ে মাতৃদুগ্ধ ,'

আজ তার এ কী হাল? কল্পনায় কতো রঙই না থাকে মেশানো ,

কল্পনায়ই আমরা বাচি

না হলে বাস্তব তো বাস্তবই

 

 হাহাকারের আর এক অর্থ? 

তাপস সিগারেট ঝুলিয়ে ক্যামেরা তাক করেছে ----

হ্যণ্ডিকামের কী অবস্থা? 

ধরা কি সবটা পড়ে, ওই যে মোড়ে মোড়ে যতবার ঘুরি, এক একটি রঙে সেই যে বদলে যায়, '

এক একটি মন আমাদের, তার ছবি কী দিয়ে তুলে নি? 



মানিক বললো, আলাদা কিছুই না, একই দুর্দশা --ঐতিহ্যে আমরা বিশ্বের কারো ধারে কাছেও না 

না না, দেশ তাদের অনেক 

কিন্তু এসব, এসব রক্ষণাবেক্…


জানলা নেই। দরজা নেই। আছে তবু অনেক বড়ো সে-সব দরজা -জানলা ---পোশাকি নাম ইচ্ছা -পরিবহন? শিলাইদহ পৌঁছতে বেশ রাত। অবলম্বন বলতে করিমভাই , গেস্টহাউস খুলে দিলো, রাতের খাবার সাজিয়ে দিল, সেবার যেমন, '.....কেউ শুনবে না, যাবেই এই রাতে, দেখে আসবে রাতের নিঝুমতায় দাঁড়িয়ে আছেন কীভাবে রবীন্দ্রনাথ.....? 

আগামীকাল পদ্মায় পড়া হবে, ছিন্নপত্রাবলী ----

সকলে ফিরে যাবো নদীমাতৃক, যখন নদী ছিল একমাত্র পথ, বজরায় উঠে পৌঁছে যাবো সাজাতপুর, পরিসর, নাটোর নদীর কূলে, ''ছায়াসুনীবিড় নির্নিমেষ চোখের বড়ো বড়ো পল্লবের নীচে গভীর ছলছলে ভাবের মতো।'' বিষাদ বিষণ্ণতার ছোঁয়ায় যেখানে দাড়ানো সেই ঘর.... ',


নাই বললো, বেশ হবে, এটাই তো, এটাই তো, '....

যেভাবেই হোক বলেকয়ে বোটে  উঠে গড়াই, ইছামতী, আর্তাই ,চলনবিল হয়ে পৌঁছবো নগরের কূলে পতিসরের সেরেস্তায়, '-----


অন্তরালের জন উঠলো হেঁকে, সে কি যার সাথে কথা দেওয়া গোপনে, যাকে রাখলে একান্ত, তার ঘর ফেলে তোমরা পতিসরে কোথায় থাকবে? 

এতকাল পরেও আমি দেখবো না আমার গ্রামখানি ?

কতো স্বপ্ন-কল্পনায় তোমার সঙ্গে ঘুরেছি যে, এতকাল পরে তাকে একটু দেখাব না আমার কাঞ্চনপুর ,চৌধুরী মহাল? 

আরে না না, সে তো হবে ,যাবো তো বোটে,তারপর যে যেখানে থাকে সকলেরই তো আছে ইচ্ছা কিছু, যাক না যে যেখানে যায় যাক, শুনুক রাত-প্যাচার ডাক, হয়ে যাক না সকলেই আজ পদ্মায় রাত-পাখি ,বিচিত্র জল-কল্লোল  শুনুক খানিক, 

নদীপথ পাক একটি রাত হৃদয়ের সব ঘুমে...।

এই পর্যটন একান্তই গোপন। 


কে যেন বলছে ,''তুমি এসেছ, তোমাকে দেখে আমি বড়ো খুশি হয়েছি। ''......নির্জনতা যেন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ''...আবার বলছেন :''চারদিকে কেবল মাঠ ধু ধু করছে ---মাঠের শস্য কেটে নিয়ে গেছে, কেবল কাটা ধানের অবশিষ্ট হলদে বিছিলিতে সমস্ত মাঠ আচ্ছন্ন।....সূর্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারদিক কী যে সুন্দর হয়ে উঠলো। বহু দূরে একেবারে দিগন্তের শেষ প্রান্তে একটি গাছপালায় ঘের দেওয়া ছিল, সেখানটা এমন মায়াময় হয়ে উঠলো ---নীলেতে লালেতে মিশে এমন আবছা হ'য়ে এলো --মনে হ'ল ঐখানে যেন সন্ধ্যার বাড়ি.... সমস্ত অপার মাঠের উপর ছায়া পড়েছে ---একটি কোমল বিষাদ একটি নির্নিমেষ চোখের উপর বড়ো বড়ো পল্লবের নীচে গভীর ছলছলে ভাবের মতো।''


ছিন্নপত্রাবলী ----

পল্লীপ্রকৃতির কোলে  ফিরে যে অনুভব, তাই কয়েকটুকরো, পূর্ববঙ্গের কবিজীবন ,তার যেসব মূল্যবান রচনা ----পদ্মা-যমুনা -আর্তাই -নাগোর নদীটি ঘিরে যেখানে ক্ষুদ্রের মধ্যে বিশালকে খুঁজে পেলেন কবি ----

চলাচলের ছন্দ ঘা খেল যে চলনবিলে ,আমাদের সকলের মন- পথ সে পথেই ভাসতে চায় যেন আজ। কিন্তু কোথায় খুঁজে পাই তাকে, কোথায় কীভাবে আমরা সেই নদী-পথ পাবো --সেটাই ভাবছে সবাই। ঝড় উঠলো। পাল ছিঁড়ে গেল। জল-কল্ললে উথাল পাথাল , বৃদ্ধ পদ্মা-বোট কেবলই চড়ায় ঠেকে যাচ্ছে ---

নদী যেখানে আর নেই। নদী যেখানে কালের হাওয়ায় ভেঙ্গেচুড়ে ঢুকে গেছে মানুষের বাড়বাড়ন্তয় ,প্রয়োজন স্মৃতির ঘর-দুয়োর রাখেনি মনে। সময়কে করেছে ছোটো, সময়ের মারী ও মড়কে নিষ্প্রাণ হয়েছে কতো মানুষের মন,বুঝিনি সে কথা ---তাই পথ বুজে গ্যাছে, নিশ্চিহ্ন প্রায় আর্তাই --গড়াই ---নাগোরের যে কী হাল, চেয়ে দ্যাখো পদ্মার দিকে ----

মনে মনে ভাবো, মনের এই পর্যটনে ,দ্বিতীয় মনে ফিরে পাও যদি, দড়ি -কাছি -মাঝিমাল্লা ,স্রোতমুখের পালতোলা নদী ,

কিন্তু কোথাও নেই ---চিহ্ন নেই এখন চলন বিলের ও যেন, শুনেছি বর্ষা এলে জাগে নাকি, বুকের উপর ভাসায় স্প্রিট -বোট ,'


তথাপি কঙ্কালসার ফসিলের উপর অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি রেখেও যদি ডাকি ,সেই মহাকালের নিঝুমতা ভেঙ্গে কোনো সাড়া পাবো না তার, '  তাই মনে মনে যেতে চাইলেও, সেই পথ মনের হাতটি পাবে না খুঁজে-- এই নির্জনতা যতোটুকু, ততটুকু ই যেন সেই সত্য, ' তাছাড়া আর সেই সময়কে ঘিরে, এখনও যে অবয়বে চাই তাকে আমরা দক্ষিণের জানলায় বসে আছেন যেন আজো


দূর পথে লালন গাইছেন যেন গান, এখনি যেন দেখা হবে পড়শির সাথে ,' আকাশচুম্বী একতারাটার  শিরিশ শাখায় হাত রেখে গান ধরেছে যেন মহাকাল এসে.... 

আমরাও যেন কেবলই খুঁজে ফিরছি এই পথের ধুলায় ধুলায় সেই মানুষটিকে ,যে আমাদের ফেরায় ,যার জন্যে ফিরে আসে ভেতর মানুষের দ্বিতীয়-জন ?


লালন যেন গান এসে, 'হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি /ভেদ পরিচয় দেয় না আমার ওই খেতে ঝরে আখি। /পাখি -বুলি বলে শুনতে পাই /রূপ কেমন দেখি নে ভাই /বিষম ঘোর দেখি, /চিনাল্  পেলে চিনে নিতাম /যেত মনের ধুকপুকি ।/.....


                                           ( ধারাবাহিক )


                                                                                       


   









অলোক কোৱা






  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইতিহাস বিভাগের  তরুণ  গবেষক এবং প্রতিশ্রুতি মান লেখক অলোক । ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ । কিন্তু তাঁর শক্তিশালী কলম সুন্দরবনের জল - জঙ্গল পরিকীর্ণ প্রান্তর ঢুড়ে তুলে আনে তদসংলগ্ন মানুষজনের কঠিন-কঠোর জীবন সংগ্রাম ।এখানে এমনই একটি লেখা -----


সুন্দরবন :বাওয়ালী-মউলে-জেলে জীবন 


অলোক কোৱা 



     

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভের পর বাংলার নবাব মীরজাফরের থেকে কোলকাতার জমিদারী পায়। ২৪টি পরগণা বা মহল ছিল কোলকাতার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত। কোম্পানি কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের কোলকাতার জমিদারী লাভের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে O’Malley’র Bengal District Gazetteer 24 Parganas-এ। ২৪টি পরগণা বা মহল একত্র করে পৃথক জেলা গঠনের কৃতিত্বের অংশীদার হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। সে ভাবেই আত্মপ্রকাশ ২৪ পরগণা জেলার। এক সময় এই ২৪ পরগণা জেলাকে ‘আঠারো ভাটির’ দেশ বলে গণ্য করা হত। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য, হরিদেবের রায়মঙ্গল কাব্যে আঠারো ভাটির উল্লেখ দেখা যায়। ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণাংশ হল সুন্দরবন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবন দ্বিখণ্ডিত হয়। সুন্দরবনের বেশির ভাগ অংশটাই বাংলাদেশের মধ্যে চলে যায়। সুন্দরবনের মোট আয়তন ২৫,৫০০ বর্গকিলোমিটার। ভারতীয় সুন্দরবনের আয়তন ৯৬৩০ বর্গকিলোমিটার। বাকি ১৫,৮৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে বাংলাদেশ সুন্দরবনের অবস্থান। সমগ্র সুন্দরবনের ২/৩ অংশ বাংলাদেশ ও ১/৩ অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

   

 ১৭৭০ সাল থেকে ক্লাউড রাসেলের তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের সংস্কার কাজ শুরু হয়। যশোহর জেলার তৎকালীন জেলাশাসক টিলম্যান হেঙ্কেল ১৭৮৩ সালে অয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে সুন্দরবন সংস্কারের প্রস্তাব দেন। সেইমত ১৭৮৪ সালে সুন্দরবনের প্রায় ৬৫ হাজার বিঘা জমি অনুমতি লাভ করে সংস্কারের জন্য। যত সময় এগতে থাকে সুন্দরবন সংস্কারের পরিধি ও বাড়তে থাকে। ১৮২৯ সালে হজেস সুন্দরবনের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেন, ১৮৩১ সালে এই কাজ সম্পূর্ণও করেন। ভারতীয় সুন্দরবনের সীমানা হিসাবে বলা যেতে পারে “দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বিশাল জলাশয়/ ডাম্পিয়ার হজেজ লাইন উত্তরে অক্ষয়/ রায়মঙ্গল, কালিন্দী আর ইছামতী নদী/ পূর্বদিকে আছে জেনো বহে নিরবধি/ পশ্চিমদিকে হুগলী নদী জানিও নিশ্চয়/ কাকদ্বীপ থেকে বসিরহাট রেখায় দক্ষিণ ভাগ হয়”। ১৯৩৯ সালে সুন্দরবনের লোকালয় হিসাবে এবং সংরক্ষিত বন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হলেও ১৯৫০-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন সংস্কারের কাজ চলে। বর্তমান সুন্দরবন ১০২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ৫৪টি দ্বীপে জঙ্গল হাসিল করে আবাদ তৈরি হয়েছে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পেছে, কিন্তু বাকি ৪৮টি দ্বীপ সংরক্ষিত যেখানে কোন জনবাসতি নেই। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ১৩টি ব্লক ও উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ৬টি ব্লক সহ সর্বমোট ১৯টি ব্লক নিয়ে বর্তমান ভারতীয় সুন্দরবন। ৫৪টি দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। জনসংখ্যার আনাগোনা শুরু সেই অতীত থেকেই। জঙ্গল হাসিলের কাজে, বাদাবন সংস্কার করার জন্য ছোটনাগপুর, হাজারীবাগ ও রাঁচি থেকে আগত বিভিন্ন উপজাতির মানুষকে নিয়ে এসে এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যে নিযুক্ত করা হয়েছিল। দেশ ভাগের পর প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের যশোর, খুলনা ও বরিশাল থেকে প্রচুর মানুষ সুন্দরবনে জমায়েত তৈরি করে। অবিভক্ত মেদনিপুর থেকেও মানুষ এসে বসতি বিস্তার করে সুন্দরবনে। 

     সুন্দরবনের জনবসতি অঞ্চল ও সংরক্ষিত অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক, রয়েছে অচ্ছেদ্যো বন্ধন। দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং ভয়ংকর ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে সুন্দরবনের জনবসতিকে রক্ষা করে চলেছে ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এই বনভূমি মনুষ্য সৃষ্ট নয়, প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টি। সুন্দরবন নোনাজল বেষ্টিত দ্বীপ অঞ্চল। দ্বীপগুলিকে ঘিরে রয়েছে নদী খাঁড়ি ও সুতিখাল। ৩৫০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ সমগ্র সুন্দরবনের রক্ষক। রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, কালিন্দী, হাতানিয়া-দোয়ানিয়া, মাতলা, ঠাকুরান, সপ্তমুখি, হুগলী, পিয়ালি নদীগুলি সুন্দরবনের অলংকার। নদিগুলির নামকরণ পাল ও সেন যুগের সময়ে। শিকারী, ধীবর, মউলে ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারায়ও নদীগুলির নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। সুন্দরবনের অরণ্যে লবণাম্বু বৃক্ষের বনভুমিকে বিশ্বের মানুষ ম্যানগ্রোভ বলে জানে। ম্যানগ্রোভ হল দলভুক্ত বিশেষ উদ্ভিদগোষ্টী। ম্যানগ্রোভের স্থানীয় নাম বাদাবন। এই দ্বীপের বাদাবন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। পৃথিবীর অন্য কোন বাদাবনে ২০টির বেশি প্রজাতি নেই। সুন্দরবনের বাদাবনে ৬৪টি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রকৃত ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ৩০টি। ২০০৯ সালে প্রনবেশ সান্যাল মহাশয় সুন্দরবনের ৯৪টি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির কথা বলেছেন। প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ৩১টি এবং সহবাশি ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ৬৩টি। ম্যানগ্রোভ গুলির মধ্যে সুন্দরী, গরাণ, গেঁওয়া, বাইন, খলসি, কেওড়া, হেঁতাল, গোলপাতা, গর্জন পশুর প্রধান। প্রতিটি ম্যানগ্রোভের মধ্যে প্রাকৃতিক ঔষধির গুনাগুন রয়েছে। কোন কোন ম্যানগ্রোভ আবার অর্থনৈতিক গুনে সম্পন্ন। জীব বৈচিত্রের আকর সুন্দরবন। সুন্দরবনের জঙ্গল ও খাঁড়িতে ১৫৮৬ প্রজাতির প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। ২০০-২৫০ প্রাজাতির পাখি দেখা যায়। ৭০ প্রাজাতির কাঁকড়া-শামুক-ঝিনুক, ১৩০ প্রাজাতির মাছ দেখা যায় এই বাদাবনে। সুন্দরবন পরিচিত র‍্যয়েল বেঙ্গল টাইগার এর ভয়ংকরতায়। ভারতবর্ষের মোট বনভূমির শতকরা ২৩ ভাগের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৩ শতাংশ, যার অধিকাংশই সুন্দরবন, ২৩০০ বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের জলবায়ুকে অনেটা নিয়ন্ত্রন করে এই ভয়াল ভয়ংকর সুন্দরবন। সন্দেহ নেই- সুন্দরবন একটা বৃহৎ সম্পদশালী বনরাজ্য। সুন্দরবনের দ্বীপ গুলিকে নদী ও খাঁড়ি চারদিকে ঘিরে রয়েছে। বাদাবনের নদ-নদী বা নদীর চর প্রায় ১৯৬৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদকে ঘিরে লাখোলাখো মানুষ কঠোর পরিশ্রমকে আশ্রয় করে বাওয়ালী, মউলে ও জেলে জীবন অতিবাহিত করে কেবলমাত্র আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে। স্বল্প পরিসরে আলোচিত হবে এই সমস্ত মানুষদের জীবন জীবিকা তথা দৈনন্দিন পরিস্থিতির কিছু বাস্তবিকতা। 

     বাওয়ালিঃ বনজীবি মানুষেরা বন্য হিংস্র জন্তুর থেকে মুক্ত হতে সর্বদাই ওঝা-গুণিনদের ওপর ভরসা করে চলে বা চলতো। এদের বিশ্বাস ওঝা-গুণিনরা মন্ত্রপুত করে জঙ্গলের সর্বপ্রকার বিপদকে দূরে সরাতে পারে। বাঘ-কুমিরেরের মুখ যেমন বন্ধ করতে পারে, তেমনি ভাবে ভূত প্রেতের থেকে জীবন বাঁচাতে ও পারে। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে ‘বাউলে’ বলা হয়। সময়ের হাত ধরে বাউলে শব্দটির মৃত্যু ঘটেছে। ধারনা করা হয় এই বাউলে শব্দ থেকে বাওয়ালী নামের উৎপত্তি হয়েছে। সুন্দরবনের অরণ্যে যারা কাঠ সংগ্রহ করতে, গোলপাতা সংগ্রহ করতে যায় তারাই বাওয়ালী নামে পরিচিত। 

     বন বিভাগের কাছ থেকে বনের সম্পদ সংগ্রহের পাশ পারমিট বা অনুমতি পত্র সংগ্রহ করে মাহাজনেরা বা নৌকার মালিক। চুক্তিভিত্তিক বা নির্দিষ্ট বেতনে বাওয়ালীরা বনে কাজ করতে যায়। পাঁচ, সাত, বা দশ পনেরো জনের এক একটা দল জঙ্গলে প্রবেশ করে। পনেরো দিন বা এক মাসের চাল, ডাল, আলু, নুন, তেল ও প্রয়োজনীয় পানীয় জল নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে। 

    

 বাওয়ালীরা নিজেদের মধ্যে কাজের জায়গা ভাগ করে নেয়। কেউ নৌকা চালায়, কেউরান্না করে, কেউ নৌকা পাহারা দেয়। সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করে না। দু-এক জনের হাতে নৌকার দায়িত্ব দিয়ে বাকিরা জঙ্গলে ঢোকে। এদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রয়োজন হয় না, প্রকৃতি এদের বড় শিক্ষক। বিভিন্ন জাতের মানুষ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই কাজে যুক্ত হয়। সুন্দরবনের অসংখ্য করুণ কাহিনীর মধ্যে বাওয়ালীদেরও অনেক কাহিনী আছে। বিপদ আপদ তাদের নিত্যকালীন সঙ্গী। ভাগ্য ভালো থাকলে বাড়ি ফেরা হয়। নতুবা কাগজের রঙ্গিন পাতায় পাঠকের কাছে রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের শিরোনামে ধরা দেয়। বাওয়ালীরা জঙ্গলে অসুস্থ হয়ে পরলেও নিয়তি তাদের পথ দেখায়।

     মউলেঃ সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ হল মধু। মোমও কোন অংশে কম নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে সুন্দরবনের বনজীবি মানুষেরা মধু ও মোম সংগ্রহে নিয়োজিত রয়েছে। সুন্দরবনবাসিদের কাছে জঙ্গলের মধু সংগ্রহ অন্যতম জীবিকা। মোমের চাহিদা বর্তমান মানুষের কাছে আগের মতোই আছে। বিদ্যুৎ ও কেরোসিনের সহজলভ্যতার পাশে মোমের একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যারা এই অরণ্যের সম্পদ নিয়ে আসে সমগ্র বিশ্বের কাছে তারাই মউলে বা মৌয়াল বা মৌয়ালীয় নামেই পরিচিত। 

     সরকারের বনবিভাগের অফিস থেকে পাস কালেক্ট করে মউলেরা ছোট-বড় নৌকো নিয়ে সাত আট জনের বা ১২-১৩ জনের এক একটা দল তৈরি করে জঙ্গলে মধু ও মোম সংগ্রহ করতে যায়। বাওয়ালীদের মত মউলেরাও সবাই জঙ্গলে একসাথে প্রবেশ করে না। এক জন নৌকাতে থাকে। সে সবার রান্নার বাবস্থা করে, সংগৃহীত মধু ও মোম কে পৃথক পৃথক পাত্রের মধ্যে হেফাজত করে। ইনিই মউলেদের ভাষায় দারোগা নামে খ্যাত। 

     মধু সংগ্রহে মউলেদের জীবনের ঝুঁকি থাকে খুব। মৌমাছিদের গতিবিধির ওপর ভালো করে নজর রাখতে হয়। এই সময় দিক ভ্রান্ত হয়ে বাঘের সম্মুখে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ‘সূর্যমুখী’ নামে পরিচিত এক ধরনের মৌমাছিদের আক্রমণের থেকেও নিজেদেরকে বাঁচাতে হয়। কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ও এই সমস্যা থেকে মুক্ত হয় না। প্রতি বছর সুন্দরবনে ৪৫০০ নৌকা নিয়ে মউলেরা মধু সংগ্রহ করতে যায়। প্রতি বছর গড়ে ৫০০ কুইন্ট্যাল মধু ও ৩০০০ কিলোগ্রাম মোম সংগ্রহ করে সুন্দরবনের মউলেরা। হাজার হাজার ভূমিহীন মানুষ অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে ভয়ংকর বিপজ্জনক জীবিকার সন্ধানে পুরুষানুক্রমে বনেজঙ্গলে মধু ও মোম সংগ্রহের নেশায় নেমে পড়ে। জঙ্গল দেবী প্রসন্ন হলে প্রাণ নিয়ে সংসারে ফেরে। নতুবা জঙ্গলে থেকে য়েতে হয় নশ্বর দেহ নিয়ে।

     জেলেঃ সুন্দরবনের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সুন্দরবনের নদী খাঁড়ি ও মোহনায় মৎস্যশিকারের উপর নির্ভরশীল। মৎস্য সম্পদের আকর সুন্দরবন। বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন ধরনের মাছের দেখা মেলে সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-মোহনায়। এত মাছের প্রাচুর্য যে জেলে মৎস্যজীবিরা সারা বছর ধরেই মাছ সংগ্রহের কাজে যুক্ত থাকে। সুন্দরবনের এই মৎস্য সম্পদ বারো মাসই আহরণ করা হয়। বনের কাঠ সংগ্রহ এখন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলত বাওয়ালীরা নিজস্ব জীবিকা পরিত্যাগ করে জেলে সম্প্রদায়ে নাম লিখিয়েছে। সুন্দরবনে এখন জেলের সংখ্যা অধিক। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে সুন্দরবনের মানুষের কাছে নির্দিষ্ট কোন জীবিকা নেই, বলা যায় একটা কাজে এরা সারা সময় অতিবাহিত করে না। কঠোর মানবিকবলে ভর করে সমস্ত জীবিকায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করে।

সুন্দরবনের জেলেরা ছোট-বড়-মাঝারি সমস্ত
ধরনের নৌকা নিয়ে মৎস্য সম্পদ সংগ্রহের
কাজে নিয়োজিত হয়। বর্তমান কালে নৌকা
গুলিতে ইঞ্জিন বসিয়ে আধুনিক ভাবে গড়ে
তোলা হয়েছে। মাছ ধরার জন্য জেলেরা
বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে। জাল
গুলির নামও বিভিন্ন। বেন জাল, খ্যাপলা জাল,
গয়সা জাল, মনোফিল জাল, কলভেসালি জাল,
চরপাটা জাল প্রভৃতি। 

     বংশানুক্রমিক ভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে মালো ও রাজবংশীরা। এরা জাত জেলে নামেই পরিচিত। দেশ ভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে সুন্দরবনের নানা জায়গায় এরা বসবাস শুরু করেছে। হাস্নাবাদ, কচুখালি, রায়দিঘি, ঝড়খালি, গোসাবা, সাতজেলিয়া প্রভৃতি জায়গায় রয়েছে রাজবংশী ও মালোরা। রাঢ়অঞ্চল থেকে আসা বাগদীরাও সুন্দরবনের জেলে মৎস্যজীবী। মাছ সংগ্রহের পাসাপাশি এই জীবিকার মানুষেরা নদী ও জঙ্গলের বাগদার মীন ও কাঁকড়া ধরেও জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। হাজার হাজার নর-নারী, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, স্কুল ছুট বাচ্চারা ও এই মীন ধরার কাজে নিযুক্ত। ভোর রাত থেকে মীন ধরার জাল নিয়ে এরা নদীর চরে পড়ে থাকে। খুব সামান্য অর্থের জন্য এরা সারা বছর ধরে নদীর বুক আগলে পড়ে থাকে। জেলেরা জঙ্গলে মাছ ধরতে গেলে নারী-পুরুষ উভয়ই এই কাজে অংশগ্রহণ করে। ১০-১২ দিন কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এরা বাড়ির বাইরে থাকে। সুন্দরবনের সমস্ত মানুষের মধ্যে আন্তরিক সখ্যতা রয়েছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা রয়েছে। একে ওপরের বিপদে পাশে এসে দাড়ায়। জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়ে খাদ্যদ্রব্য প্রয়োজন হলে মাছে বিনিময়ে জেলেরা বাওয়ালীদের কাছ থেকে চাল, ডাল, জলও সংগ্রহ করে। ক্যানিং, গোসাবা, সাতজেলিয়া, সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, বকখালি, পাথরপ্রাতিমা, প্রভৃতি অঞ্চলের জেলে মৎস্যজীবী মানুষেরা সরকারি লোন নিয়ে বা ব্যক্তিগত মালিকানায় যন্ত্রচালিত নৌকোয় করে মাছ শিকারে সাগরে পাড়ি দেয়। 

     জঙ্গলে যারা মাছ শিকারে যায় প্রতি পদে তাদের বিপদের ভয় থাকে। বাঘ ও ডাকাতের ভয় ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়। সুন্দরবনের কোর এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। আবার কোর এলাকায় মাছ বেশি পাওয়া যায়। সমস্ত বিপদকে উপেক্ষা করে মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিয়তির উপর বিশ্বাস রেখে ঢুকে পড়ে এই সমস্ত বিপদসঙ্কুল এলাকায়। 

     শৌর্যে, বীর্যে, ও মাধুর্যে ঘেরা এদের জীবন। জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত হলেও পরাজিত নয়।    



তথ্যসুত্রঃ

১। W. W. Hunter, A Statistical Account Of Bengal -24 Parganas and Sundarbans - Vol 1, Trubner and Company, London, 1875

২। ইন্দ্রাণী ঘোষাল, সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবন, তাদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্য, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০৬

৩। শঙ্করকুমার প্রামাণিক, সুন্দরবন জল-জঙ্গল-জীবন, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা, ২০১৪

৪। সুকুমার সিং, দক্ষিণ ২৪ পরগাণা জেলার ইতিহাস, মাস এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১০

৫।  রঞ্জন চক্রবর্তী ও ইন্দ্রকুমার মিস্ত্রী, সুন্দরবনের অর্থনীতি জনসংস্কৃতি ও পরিবেশ, রিসা রিভার্স সার্ভিস, কলকাতা, ২০০৭

৬।  কানাই লাল সরকার, সুন্দরবনের ইতিহাস, পাণ্ডুলিপি, কলকাতা, ২০১৭ 

৭। প্রনব সরকার ( সম্পাদনা ), চব্বিশ পরগনা ও সুন্দরবন পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য রচনা, লোক, কলকাতা, ২০১৩

৮। সুভাষ মিস্ত্রী, লোকায়ত সুন্দরবন, লোক, কলকাতা, ২০১৩


ড. শুভঙ্কর দে


 



      ইতিহাস তাঁর নিরলস চর্চার বিষয় , তাঁর চিন্তা - চেতনার ধ্যানবিন্দু | কিন্তু ইতিহাসের পাতাতেই নয় শুধু ,তাঁর  দৃষ্টি  ছুঁতে চায়  শিল্প - সাহিত্য - জ্ঞান -বিজ্ঞান - প্রযুক্তির নানা দিক | আর তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল সমৃদ্ধ করে আমাদের চলমান জীবনপ্রবাহ | এখানে ইতিহাসের আলোকে তেমনই একটি নিবন্ধ আমরা পাঠ করি |                                   



বিজ্ঞান , চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও পরিবেশের ইতিহাস: বিকল্প ভাবনা


ড. শুভঙ্কর দে

সহকারি অধ্যাপক  

ইতিহাস বিভাগ

সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, 

পুরুলিয়া



‘In the land of ox- cart.. one must not expect the pace of motor car’

                          -   Resolution, 23rd May 1914, Government of India  


‘The Asiaticks had claimed the heights (of/in) science before the Greeks had learned their alphabet’

                                               - David Kopf  



 সূচনায় উল্লেখিত আপাতবিরোধী দুটো বক্তব্যের মধ্যেই কিছু সত্য লুকিয়ে রয়েছে।প্রথমটি আবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ পুষ্ট ভাবধারার সার্থক প্রতিফলন।প্রথম বক্তব্যকে আর একটু গভীর ভাবে আনুধাবন করলে দেখা যাবে, ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসনের একটা দীর্ঘ সময় ধরে ওরিয়েন্টের প্রতি এরকম বক্তব্য ও প্রতর্ক বারবার বিভিন্ন অফিশিয়াল ডিসকোর্স, আধিকারিকদের লেখাপত্র, মেমোয়ার, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদিতে উঠে আসতে দেখা যাবে বারে বারেই। অপরদিকে এর একটা বিপরীত ছবিও ছিল।১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উইলিয়াম জোন্স ,ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি সাহেবদের হাত ধরে শুরু হয়ে যায় ভারতবর্ষের গৌরবময় অতীত ইতিহাস চর্চা।প্রাচ্যবিদ বা ওরিয়াণ্টালিস্টদের এই আলোচনার মূল যে বক্তব্যটি উঠে আসছিল, ক্রমাগত তাঁর সারাংশ ছিল এই যে , প্রাচীন হিন্দু ভারতবর্ষের বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং মধ্যযুগের মুসলিম শাসনে তার পতন এবং সেইসাথে আধুনিক ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সেই লুপ্ত গৌরবকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করা।বলা বাহুল্য পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী ঘরানার আদর্শের সাথে এটি অনেক সময় হবহু মিলে যায়। বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চায় সমগ্র উপনিবেশিক কালপর্বে আমরা দেখবো জাতীয়তাবাদী ঘরানার সাথে শাসকের সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের টানটান  লড়াই। বিগত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ইতিহাসকে নতুনভাবে ভাবার চেষ্টা করেছেন সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন লেখকেরা। ইতিহাস চর্চার একটি স্বতন্ত্র এবং উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে পরিবেশের ইতিহাস ,সেই প্রেক্সিটে  সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান ক্ষেত্র। বর্তমানকালের  গবেষণায় উঠে আসছে উপনিবেশবাদ, শাসক শাসিতের প্রেক্ষাপটে,বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও ইতিহাসের আন্তঃসম্পর্কের কথা। সাম্প্রতিককালে  বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসকে আদতে সমাজ-সংস্কৃতি ও চিন্তাজগতের বৃহৎ ক্ষেত্র রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। 


সাদা চামড়ার মানুষদের দায়িত্ব:


ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় গোটা পর্ব ধরেই প্রাচ্য তথা  ভারতবর্ষ অনেকাংশে প্রতিভাত হয়েছে অন্ধকারময়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি নতুন কিছু গ্রহণে অনিচ্ছুক ও নিরুৎসাহি  কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদের নতুন সংজ্ঞা নির্মিত হতে থাকে। এই মতবাদের সর্মথকরা গলা ফুলিয়ে প্রচার করতে থাকে ভারতবর্ষের যাবতীয় উন্নতি এবং হিতসাধন একমাত্র ব্রিটিশদের দ্বারাই সম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ তাদের কাছে ছিল শুধুমাত্র নিত্যনতুন অঞ্চল ও মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করাই নয়, একই সাথে সেখানকার মানুষ এবং ভূখণ্ডকে কান ধরে উন্নত এবং আধুনিকীকরণে সামিল করা । প্রাচ্যের উপনিবেশিক পরিমণ্ডলে এই জাতীয় ধ্যান-ধারণাকে বারবার শক্তিশালী ও পুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে খানিকটা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা দেখব সমগ্র উনবিংশ শতক জুড়ে ভারতবর্ষ তথা প্রাচ্যের বিভিন্ন মহামারি ও রোগব্যাধির মূল কারণ হিসেবে, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুকে দায়ী করা হতে থাকছিল। ১৮৩৭ সালে রোনাল্ড মাটিনের ‘নোটস অন মেডিকেল টোপোগ্রাফি’ প্রকাশিত হয়।  ইংরেজদের জাতি গর্বের পাশাপাশি ভারতীয় সমাজ ,স্বাস্থ্য, অশিক্ষা ও অভ্যাসের চূড়ান্ত সমালোচনা গ্রন্থের প্রত্যেকটা বাক্যে যেন ফুটে উঠেছিল ।   ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, ইউরোপে ‘এশীয় কলেরার’ আবির্ভাব ঘটে। ইউরোপীয় জনমানসে প্রাচ্য মাত্রই অস্বাস্থ্যকর ,অপরিষ্কার তথা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চাৎপর এই ধারণা ও বিশ্বাস গেথে যায়।এই ভাবেই রোগব্যাধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কু বাতাস তত্ত্বকে(MiasmaTheory) সামনে রেখে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় উপনিবেশে বিভিন্ন রোগের মূল কারণ হল আসলে নেটিভরা এবং তাদের অস্বাস্থ্যকর ও অনৈতিক কার্যাবলী । এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা কিংবা নেটিভদের আরো কিছু নেতিবাচক অভ্যাস সামাজিক ও আচার আচরণকে।স্বাভাবিকভাবেই আরেকবার সাদা চামড়ার মানুষের ঘাড়ে গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে স্বাস্থ্য সংস্কারের।গঠিত হয় স্বাস্থ্যবিধি।উপনিবেশিক রাষ্ট্রের দ্বারা ভৌগলিক ভূখণ্ডের আধিপত্যের ক্ষেত্রটা এবার সম্প্রসারিত ও প্রসারিত হয়ে একেবারে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে ।  কিন্তু মজাটা হলো অতি চালাকির সাথে এড়িয়ে যাওয়া হতে থাকে ব্রিটিশ শাসনের ফলে উদ্ভূত অপুষ্টি, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, বিকলাঙ্গ অর্থনীতি কিংবা দ্রুতহারে ঘটে যাওয়া অপ্রকল্পিত নগরায়নের মত প্রশ্নগুলিকে।


 প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য:


 অধ্যাপক দীপক কুমার সম্প্রতি তার একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে আধুনিকতা এবং আধিপত্যবাদের কথা বলেছেন । প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব এর অধিকাংশটাই ঔপনিবেশিক সময়ে সৃষ্ট ও পুষ্ট হয়েছিল। মেট্রোপলিটন এবং ‘পেরিফেরি’ সবসময়ই একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত, উপকৃত এবং নানান সময়ে সহযোগী হিসাবে কাজ করেছিল বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। ভারতীয়রা নতুন কিছু গ্রহণ এবং পরিবর্তনে আগ্রহী নয়, এই মতবাদ  যে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছিল তা হয়তো সর্বাংশে সত্য নয়। ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন পর্তুগীজদের আগমনের সাথে সাথে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যার সাথে ভারতীয় আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান আদান-প্রদান সংক্রান্ত অবিরাম বিনিময়ের কথা । জ্ঞানের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই পর্তুগীজদের আগমনের বহু পূর্বেই ভারতীয় চিকিৎসা ও তার  পদ্ধতি সংক্রান্ত বই আরব বণিকদের দ্বারা পশ্চিমে গিয়েছিল এবং  ত্রয়োদশ শতকে বেশ কিছু এরকম গ্রন্থের ল্যাটিন অনুবাদ হয়েছিল যা সেই সয়ে ইউরোপে অনুশীলন করার ডাক্তারদের পাঠ্যপুস্তক ছিল । পর্তুগীজদের লেখা বিভিন্ন মেডিকেল গ্রন্থ গুলিতে আমরা এই সময় ভারতীয় ডাক্তার ও তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখি। ইউনানী কিংবা কবিরাজি চিকিৎসা কখনোই একে অপরের বাধা হয়ে দাড়ায় নি, বরং আমরা এটা লক্ষ্য করব তারা একে অপরের অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে। বিখ্যাত পরিবেশের ইতিহাসবিদ রিচার্ড গ্রোভ দেখিয়েছেন, পরিবেশ সংরক্ষণের যে ভাবনা তা উপনিবেশ থেকেই প্রথম উদ্ভূত হয়। উপনিবেশে নিরলসভাবে কাজ করে চলা বিভিন্ন অরণ্যকর্মী ও গবেষক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, প্লান্টার প্রমুখদের সংরক্ষণ বিতর্কে মেট্রোপলিটনে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল । 


ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক সময় আমরা দেখতে পারব বিশেষত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি নিজেদের জ্ঞানচর্চা ও তার ব্যবহারকে যেমন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল, ঠিক একইভাবে নতুন পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে তারা সরাসরি ও সাদরে গ্রহণ করতে কখনো পিছপা হননি।হাকিমি মতে বেশকিছু ওষুধ এর ব্যবহার শুরু করেছিলো বৈদ্যরা। অপরদিকে বিপরীত পক্ষের গ্রহণের চিত্রও লক্ষ্য করা যায়।। প্রজিত বিহারি মুখার্জি সম্প্রতি তার একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, দেশীয় মতে চিকিৎসা করা ব্যক্তিগণের দ্বারা স্টেথোস্কোপ ব্যবহৃত হয়েছিল । উনবিংশ শতকে, গঙ্গাপ্রসাদ সেন প্রথম আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত পত্রিকা সঞ্জীবনী প্রকাশ করেন, এমনকি তিনি আয়ুর্বেদিক ঔষধ ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাতেন । পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার বিভিন্ন প্রয়োগকে প্রাচ্য সবসময় দূরে ঠেলে দেয়নি । ভারতবর্ষে কালাজ্বরের ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ নিয়ে গেছে, এর সার্থকতা উপলব্ধি করে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মতের আদান প্রদান বিভিন্ন সময়ে মেট্রোপলিটনকে সাহায্য ও সমৃদ্ধ করেছে । 


   কিন্তু এখানেই গুরুত্বপূর্ণভাবে আরেকটি কথা উঠে আসে, সেটি হলো গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যর প্রসঙ্গ ,যা কখনই পর্যাপ্ত ছিল না। মজার বিষয় হলো ম্যালেরিয়া রোগের সফল প্রতিষেধক আবিষ্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য রোনাল্ড রস লাভ করেছিলেন পাতিয়ালার মহারাজের কাছ থেকে। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীকে দীর্ঘদিন কেরোসিনের আলোয় ও বিনা পরীক্ষাগারে গবেষণা করতে হয়েছে । পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কৃষ্ণস্বামি আইয়েরকে মাদ্রাজ মেডিকেল কাউন্সিল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এই মর্মে যে তিনি দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ-এর সাথে যুক্ত ছিলেন ।  দীপক কুমার , জাহির বাবর প্রমুখেরা যুক্তি দেখিয়েছেন, প্রযুক্তি বিজ্ঞান সহ মেডিকেল রিসার্চে উপনিবেশিক সরকার খুব কম দৃষ্টিপাত করেছিল তুলনায় ভৌগোলিক অনুসন্ধান, সেনাবাহিনীতে তাদের বিনিয়োগ ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো । 


 ভারতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি , পরিবেশ : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার


 ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ও পরবর্তীকালে তাদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বেই সমাজে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসার সুমহান ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও বহুকাল ধরেই এই তিনটি ক্ষেত্রকেই পশ্চিমের অগ্রাধিকার, প্রাধান্য ও পশ্চিমকেই প্রচারক রূপে দেখানো হয়েছিল। এইভাবে অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটা বড় অংশ জুড়ে উপনিবেশগুলোতে বিজ্ঞান এর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস  জুড়ে দেওয়ার অসৎ প্রবণতা আমরা লক্ষ করি  । ভারতবর্ষ সহ এশিয়া মহাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অপরিশোধিত ঋণ ইউরোপ ও সমগ্র বিশ্বে ছিল তা দেখিয়েছেন ইতিহাসবিদ  জোসেফ নিডহ্যাম(Joseph Needha) ও লিন হোয়াইট(Lynn White) । সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে লুই পাস্তুর(1822-1865)সফল টিকা আবিষ্কারের পশ্চাতে ‘Sillarai kovai’ নামক একটি অখ্যাত তামিল গ্রন্থের কথা । জাহির বাবর (Zaheer Baber) তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ দেখিয়েছেন, আনুমানিক 400 খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রচিত সূর্যসিদ্ধান্তে বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে গ্রহের গতি ও অবস্থান, সূর্য -চাঁদের উদয় ও অস্ত যাওয়া, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রের বর্ণনাসহ  সৃষ্টিতত্ত্বের বিভিন্ন দিক, এমনকি  সূর্য ও চাঁদের বেশ কিছু ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সুচিন্তিত বিশ্লেষণ । প্রাচীন ভারতবর্ষে পরিবেশের উপাদান হিসেবে নদী, জল ,গাছপালা ও পশুদের সাথে  মানুষ অস্তিত্বকে একাত্ম করা হয়েছিল। বৈদিক যুগের একটি শ্লোকে পশুকে পুত্র রূপ বর্ণনা করে, রুদ্র দেবতাকে তাদের  ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছিল ।  প্রাচীন ভারতে নাড়ী পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়ের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর ‘sangadharasamhita’ নামক গ্রন্থ থেকে। সুশ্রুত সংহিতায় অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ও তার সঠিক প্রয়োগের কথা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। মধ্যযুগের বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিপ্লব না ঘটলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয় পরিবর্তন আমরা লক্ষ করতে পারি। অষ্টম শতাব্দীর শেষে  ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের আরবীয় পার্সিতে অনুবাদকৃত গ্রন্থগুলি খলিফার দরবারে পৌঁছে যায়। দশম শতাব্দীতে আরব চিকিৎসক আলী ইব্ন শাহী অল তাবরী(Ali Ibn Sahl al Tabri) এর গ্রন্থ Firdaws al Hikma পার্সিতে অনূদিত ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থ গুলির পরিচয় দিয়েছিল। ভারতবর্ষে পর্তুগীজদের অনুপ্রবেশের সূত্র ধরে বেশ কিছু নতুন ফসলের ভারতীয় শস্য সূচিতে সংযোজিত হতে শুরু করেছিল। ভারতবর্ষে 1613 সালে গুজরাটে প্রথম তামাকের চাষ শুরু হয়, পরবর্তীতে তা অন্যত্র ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে। এই শতাব্দীতেই অন্যতম খাদ্যশস্য ভুট্টা চাষ শুরু হয়। ইউরোপ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর পরবর্তী সময় থেকেই দূরবীক্ষণ যন্ত্র আসতে থাকে। দিল্লিতে রাজা জয়সিংহের মান মন্দিরে(1730) দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিকৃত কাটা নাকের মেরামত করা1686 সালে নিকোলাস মানুচির লেখা দক্ষিণ ভারত থেকে এক প্রতিবেদনে জানা যায়। পরিবহনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ভারতে ইউরোপীয় ঘোড়ায় টানা বগি গাড়ি তৈরীর প্রয়াস নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর, যদিও এটি ছিল সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। তিনি যে বগি গাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন তা ছিল সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আনা বগি গাড়ির অবিকল অনুকৃতি। তবে এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজন। প্রথমত মধ্যযুগে আমরা যেই সময়টার কথা বলছি সেখানে যুদ্ধ এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলি ছিল এই সময়ে প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়বস্তু। ফলস্বরূপ সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিজ্ঞান  প্রযুক্তির প্রশ্নে দেখতে পাবো পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংহ ভারী বন্দুক ও মোরটরের জন্য অমৃতসর, লাহোরে ঢালাই -এর কারখানা স্থাপন করেছিলেন। 1820, 1830 এর দশকে এখানে নিয়মিত গুলি তৈরি হতো। এই সময়কালে রচিত বিভিন্ন লেখকের এর চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তক যেমন গোবিন্দদাসের ভেষজ রত্নাবলী, মাধবের আয়ুর্বেদ প্রকাশ্য (1734), আকবর আরজানির  টিব – ই- আকবরী (1700) প্রভৃতি গ্রন্থগুলো জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রোগ তার বিস্তারিত, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের চিত্র, রসায়ন সম্পর্কিত পর্তুগীজ ও পারসিকদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য Nurul Haq এর  Ainul Hayat (1691) ছিল প্লেগ সম্পর্কিত অন্যতম পারসিক গ্রন্থ । অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুটি সংস্কৃত গ্রন্থ Hikmatprakasa এবং  Hikmatparadipa তে বহু আরবি ও  পারসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত শব্দ প্রয়োগের পাশাপাশি ইসলামীয় ও চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।


উপনিবেশিক শাসনপর্বে ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যর অধিগ্রহণকে বেশকিছু ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় বিপর্যয় রূপে চিহ্নিত করেছেন ।  আমারা অবশিষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারবো, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার ক্ষেত্রে তারা কি ধরনের কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 1898 সালে দেশীয় রাজ্যে মহীশূরে  ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছিল । রাজা জয়সিংহের উদ্যোগ ও  প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, 1722-1739 সময়ের মধ্যে জয়পুর দিল্লি ,মথুরা,বেনারসে  জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পর্যবেক্ষণাগার গড়ে উঠেছিল  (Astronomical observatories)। তাঞ্জোরের মারাঠা শাসক  Raja Serfoji II(1798-1832)  নিজ উদ্যোগে ও সেখানকার  ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এবং Father Schwartz এর সহায়তায়, ভারতবর্ষ ত বটেই  সেই সঙ্গে পশ্চিমের চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল বড় গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সংগ্রহে বেশকিছু অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি সহ, পশু পাখিদের রোগ ও তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত  তামিল এবং সংস্কৃত গ্রন্থের দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ছিল । 


                                          স্বাভাবিকভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসকবর্গরা বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার প্রসার ও সেই সাথে তার অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করাকে civilizing mission রূপে  প্রতিভাত করতে চাইত।  বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা কে তারা শাসক ও শাসিতের পার্থক্য হিসেবে তুলে ধরত।একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।  আর্থিক দিক থেকে প্রচুর লাভজনক ক্যারোলিনা চালের উৎপাদন ব্রিটিশরা বাংলায় ও মাদ্রাজে শুরু করেছিল। দু’জায়গাতেই এটি চূড়ান্ত ভাবে অসফল হয় । এর কারণ হিসাবে উপনিবেশিক সরকার ভারতের চিরাচরিত সনাতন কৃষি ব্যবস্থা সহ নতুন ব্যবস্থা গ্রহণে অনিচ্ছুক গোটা কৃষক সম্প্রদায়কে দায়ী করেছিল । এই ধরনের উচ্চ মনোভাব আত্মবিশ্বাস আত্ম অহংকার আধুনিকীকরণের সীমা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় লর্ড কার্জনের সময়(1899-1905) । বেশ কয়েক দশক আগে প্রকাশিত George Basalla এর প্রবন্ধে আমরা পুনরায় উপনিবেশে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শাসকের অবদানের কথা পরোক্ষভাবে শুনতে পাবো । 


যদিও জ্ঞানপ্রকাশ এর মতো কিছু ইতিহাসবিদ এই তত্ত্ব  মানতে রাজি নন। তিনি দেখাচ্ছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে থেকেই পশ্চিমী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে ইংরেজি শিক্ষিতদের একটি শ্রেণি ক্রমাগত দেশীয় কুসংস্কার  ও ধর্মের ঊর্ধ্বে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘agent of modernity and progress’ ‘হিসেবে কার্যকারী ভূমিকা পালন করেছে। বোম্বের এলফিনস্টোন কলেজের প্রথম ভারতীয় অংকের শিক্ষক বালগঙ্গাধর জাভেদকার বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য 1831 সালে প্রকাশ করেন বোম্বে দর্পণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাংলায় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা রাজা রামমোহন রায়, তৎকালীন এডিনবার্গের ডাক্তার জন প্যাটারসনকে করোটি সংক্রান্ত পরীক্ষার গবেষণার জন্য দশটি হিন্দু মাথার খুলি পাঠিয়েছিলেন ।  সম্প্রতি প্রতীক চক্রবর্তী তার একটি গবেষনালব্ধ প্রবন্ধ দেখিয়েছেন ১৯০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস এর ভারতীয়করণ শুরু হয়েছিল। একই সঙ্গে শাসক এবং শাসিতের আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণের প্রশ্নে একটি চাপা উত্তেজনাকর  পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ১৮৯০ সালে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র Civil and Military Gazette লেখে : ‘One has to be very careful because the crooked native mind could transfer any knowledge as it had done with modern education rather than accepting as an idea of reason into and ideology of dissent ’।বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতির এক সার্থক বর্ণনা আমরা পাই এক পুরানো পন্থি ঘরানার সমর্থক অবিনাশ চন্দ্র কবিরত্ন নামক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত  এক সমসাময়িক পত্রিকার সম্পাদক। তিনি লিখছেন:


“ কেন যে ভারতবাসী নিশ্চয়ই ঘুমায় আছেন, তাহা সম্যক বুঝিবার পক্ষে কারণ বিস্তর থাকলেও আজ কিছু আমরা চিকিৎসা সম্মিলনীর পাঠককে বুঝাইতে চেষ্টা করিব। বহু শতাব্দী পূর্বে এই ভারতবর্ষে যে সকল পুণ্যকর্ম ঋষি জন্ম গ্রহণ করিয়া ঔষধ প্রচারে যেরূপ অসাধারণ নৈপুণ্য ও কল্পনাতীত জ্ঞান-গরিমার আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, সত্য বলিতে কি, তেমন গভীর অলৌকিক জ্ঞান এজগতে অদ্যাবধি আর কোথাও প্রকাশ হয় নাই। সুতরাং ভারতবাসী যখন সেই আর্য ঋষি কৃত নির্মল সংশয় রোহিত রাশি.. কেউ পদাঘাত কোরিয়া , আজ বিদেশি ও অসম্পূর্ণ জ্ঞানের সেবা করিতেছে, সে জাতিকে নির্ধারিত না বলিয়া আর কি বলিব?......... প্রাচ্য শিক্ষায় বিভূষিত মহাত্মা গণশিক্ষা গৃহগুলি মহাত্মাগণ প্রতীচ্য শিক্ষার গৃহগুলি আরো উন্নত করিবেন, কিন্তু তা না করিয়া যখন তাহারাই প্রতীচ্য শিক্ষায় বধির হইয়া আছেন, তখন ভারত নির্ধারিত না বলিয়া ক্ষান্ত তো হইতে পারি না” 


 অবিনাশ চন্দ্রের চিন্তা (পড়ুন দুশ্চিন্তা) অমূলক ছিল না। দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তি দেখিয়েছেন ভারতের জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সনাতন ভারতীয় চিন্তাভাবনার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতার একটা সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই  ইংরেজ আনীত ‘আধুনিকতা’ ‘দেশীয় উন্নতি’ “প্রগতি”র প্রতি  একদিকে যেমন শিক্ষিত শ্রেণীর   মানুষেরা আকৃষ্ট হতেন , তেমনি অন্যদিকে ভয় ছিল যে, এই সকল আইডিয়ার বল্গাহীন চর্চায় ভারতীয়ত্বই না  লোপ পায় l। তিলকও মারাঠা পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার করতেন পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা ও আয়ুর্বেদের চিন্তাধারার সুচিন্তিত সংমিশ্রণ অত্যন্ত জরুরী এবং আবশ্যক। The Hindu Chemistry র লেখক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সব সময় চেষ্টা ছিল আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশকে বিজ্ঞান গবেষণায় স্বনির্ভর হিসাবে গড়ে তোলা। তিনি  তাঁর প্রবন্ধ ‘জাতীয় সম্পদের মূলে বিজ্ঞানের শক্তি” তে লিখছেনঃ 


“উচ্চশিক্ষার নামে কতকগুলি বড় বড় বই মুখস্থ করিয়া বিদেশের ছেলেরা বেকার অবস্থায় ঘরে বসিয়া বৃথা সময় নষ্ট করিতেছে। পূর্বপুরুষদের অধুনা বিলুপ্ত বাহাদুরির বড়াই করিয়া, বেদ বেদান্ত উপনিষদ এর দোহাই পাড়িয়া জাতির দুঃখ ঘুচিবে না, দারিদ্র দূর হইবে না হিন্দু হোক আর মুসলমানই হোক, বিজ্ঞানের সাধনায় যতদিন না তাহারা নিজেদের মিলিত শক্তি নিয়োগ করিতে শিখিবে যতদিন দেশের ও জাতির উন্নতির কোন আশা নাই ”


বিগত কয়েক দশক ধরে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বিষয় হিসাবে বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস নতুনভাবে আলোচিত হয়ে আসছে ।  পরিবেশের ইতিহাস এই ধারার নবতম  সংযোজন । Carlo Ginzburg এর হাত ধরে সত্তরের দশকের কাছাকাছি মাইক্রো হিস্ট্রি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে । আঞ্চলিক ইতিহাস, ছোট ছোট ঘটনা, ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্বের বিষয়গুলির উপর গবেষণার নতুন ভাবে সূত্রপাত ঘটতে থাকে। সাবল্টার্নদের লেখা পত্রে আমরা দেখব ধীরে ধীরে জায়গা করে নেবে ইতিহাসের ‘স্মল ভয়েস’। বিজ্ঞান প্রযুক্তির ইতিহাসে এই মডেলকে আমরা বেশকিছু ইতিহাসবিদদের দ্বারা ফলো করতে দেখব। প্রজিত বিহারী মুখার্জির গবেষণায় উঠে আসবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নাম-না-জানা বেশকিছু ডাক্তার ও তাদের বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা |



প্রবন্ধ --- সুশান্ত চট্টোপাধ‍্যায়


প্রবন্ধ সাহিত্যে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় এককথায় অনন্য, অসাধারণ । গভীর অধ্যয়ন এবং সৃষ্টিশীলতা তাঁর রচনায় পরতে পরতে গেঁথে থাকে । অ্লোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় সম্পাদিত"আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস"গ্রন্থে সত্তর দশকের কবিতা' তাকে পরিচিতি দিয়েছে।১৯৯৫ সালে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর তাকে সাহিত‍্যে সিনিয়র ফেলো হিসেবে মনোনীত করে।  'স্বরবর্ণে ' আমরা তাঁর শামসুল হকের 'নুরুলদীনের সারাজীবন ' কাব্য নাটকের একটি মনোজ্ঞ আলোচনা পড়ব,যা আজকের পরিযায়ী শ্রমিক,কৃষক আন্দোলন কি অশান্ত নির্বাচনী পরিস্থিতি  উদ্ভুত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমাদের মনে হয়।



 বিবর্ণ ইতিহাস, বর্ণময় কথামালা


সুশান্ত চট্টোপাধ‍্যায়




বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অশীন দাশগুপ্ত "ইতিহাস ও সাহিত্য" প্রবন্ধে ইতিহাস ও সাহিত্যের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনাসুত্রে মন্তব্য ক‍রেন "যদি কোন বিরল সাহিত‍্যিক অন‍্য যুগের মনকে তার রচনায় ধরতে পারেন, পাঠক যদি সেই মনকে পৃথক ব'লে চেনেন কিন্তু স্বাভাবিক ব'লে মানেন তা হলে সেই সাহিত্য নি:সন্দেহে ইতহাসধর্মী " কিন্ত সেই বিরল সাহিত‍্যিক তো সবাই নয় ; কেউ কেউ নিশ্চয়ই। আধুনিক সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "সেই সময়" উপন‍্যাসের কথা অনেকেরই মনে পড়বে। কিন্ত কবিতায় সেই ধরনের কোনো প্রয়াস কি আমাদের নজরে এসেছে ? 


         এই সূত্রেই মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের প্রয়াত কবি ও কথাকার সৈয়দ শামসুল হকের রংপুর কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিকায় "নূরলদীনের সারাজীবন" কাব‍্যনাট‍্যটির কথা। সম্ভবত: এই সময়ের আয়নায় এটি একটি বিরল কাব‍্যনাট‍্য যার শিকড় রয়ে গেছে আমাদের অতীত ইতিহাসের বিবর্ণ আখরগুলির ভিতরে। তার নিজের উচ্চারণ থেকে জানতে পাই :


     সত্তর দশকের লন্ডন প্রবাসকালে আমার ইচ্ছে হয় ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস একটু বিস্তারিত পড়ে দেখব, সেই পড়াশোনা করতে গিয়েই একদিন দেখা পেয়ে যাই এই অসামান্য কৃষকটির, কিন্ত তার সম্পর্কে তথ‍্য প্রায় কিছুই আমি পেলাম না। সেই তথ‍্যের সন্ধানেই লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যাই, সেখানে সমকালীন বেশ কিছু নথিপত্র, দলিল, পুরনো বই কয়েকবছর ঘাটবার পর নূরলদীন এবং তার কাল সম্পর্কে একটা ছবি আমার মনের মধ‍্যে গড়ে ওঠে।


  এই ছিল সূচনা। তারপর এই কাব‍্যনাট‍্য লেখা হয়। ৯জানুয়ারি - ১২মে ১৯৮২। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮২ বাংলাদেশের "মহিলা সমিতি'র মঞ্চে " নাগরিক নাট‍্য সম্প্রদায়"-এর প্রযোজনায় নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়। অভিনয় শুরুর আগে প্রারম্ভিক ভাষণে নাট‍্যকার শামসুল হক জানান ১৯৮২ তে নূরলদীনের নেতৃত্বাধীন রংপুর কৃষক বিদ্রোহের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হবে।  নিজের শিকড়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও প্রতীতি কতো গভীর ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।


           "নূরলদীনের সারাজীবন" যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, তখন শামসুল হক লেখেন :


নিজেকে দেয়া অনেকগুলো কাজের একটি এই যে, আমাদের মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ‍্যমে কিছু করা, নূরলদীনের সারাজীবন" লিখে তার সূত্রপাত করা গেল। যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারে না। এই কাব‍্যনাট‍্যটি লিখে ফেলবার পর আমার আশা এই যে, এই মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এমন সব গণনায়কদের আমরা ভুলে গিয়েছি তাদের আবার আমরা সমুখে দেখব এবং জানবো যে আমাদের গণআন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের ও বড় মহিমার - সবার ওপরে , উনিশশো একাত্তরের সংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।' - সময় ও সমকালের সঙ্গে এইভাবেই সংরক্ত হয়ে যায় ইতিহাস। আরো একটি ব‍্যক্তিগত স্মৃতির কথা এইখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যারা বাংলাদেশে গেছেন এবং রায়েরবাজার গণকবর প্রাঙ্গণে গেছেন তারা অনুভব করতে পারবেন এই উচ্চারণের সারবত্তা।


 দুই


কিন্ত নাট‍্যরচনার উপাদান বলতে সামান্যই কিছু ছিলো তার সামনে। সুপ্রকাশ রায়ের " ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম "গ্রন্থে  রংপুর বিদ্রোহ বিষয়ে সাত পৃষ্ঠার আলোচনা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না তার সামনে‌ |

    সুপ্রকাশ রায় তার গ্রন্থের এক জায়গায় নূরলদীনের নাম উল্লেখ করেন : বিদ্রোহীদের আহ্বানে কোচবিহার ও দিনাজপুরের বহু স্থানের কৃষকগণও "নবাব " নূরুলউদ্দিনের বাহিনীতে যোগদান করিয়া নিজ নিজ অঞ্চলের নায়েব, গোমস্তাদের বিতাড়িত করে।" নূরুলউদ্দিনকে কৃষকেরা "নবাব" এই সম্বোধনে ভূষিত করছিল।  সুপ্রকাশ রায় একটু পরে লিখেছেন : বিদ্রোহীরা দেবী সিংহ ও ইংরেজ শাসনের প্রধান ঘাটি মোগলহাট বন্দরের উপর গুরুতর আক্রমণ করিলে এই স্থানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই বিদ্রোহের নায়ক "নবাব" নূরুলউদ্দিন গুরুতররূপে আহত হইয়া শত্রুহস্তে বন্দী এবং তাহার দেওয়ান দয়া শীল নিহত হন। নূরুলউদ্দিন সেই আঘাতের ফলেই অল্প কয়েকদিন পর প্রাণ ত‍্যাগ করেন"(পৃ ১১০) ।

 শামসুল হক লিখছেন : ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় নামটি লিখেছেন নূরুলউদ্দিন, আমরা বলব ওটা হবে নূরুদ্দিন, কিন্ত আমি ব‍্যবহার করেছি নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষেরা যেমনটি উচ্চারণ করবে"।


 তিন


 কিন্ত বিদ্রোহের কথামালা কাব‍্যনাট‍্যের আঙ্গিকে রচনা করা সহজসাধ্য নয়। বিশেষতঃ আগাগোড়া রংপুরের ব‍্যবহৃত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে এ নাটক। কিন্ত আশ্চর্য হতে হয় শামসুল হকের কারুবাসনার সৃজনের অনন‍্যতায়।

 চোদ্দটি দৃশ‍্যে বিন‍্যস্ত এ কাব‍্যনাট‍্যের শরীর জুড়ে শিল্পের শামিয়ানা, রংপুরের ভাষায় ভিতরেও আধুনিক কাব‍্যভাষার বিন‍্যাস : নূরলদীনের  একটি সংলাপ ----

আজিও নূরলদীন পস্ট সব পস্ট করি দেখিবার পায়,

মাথার উপরে সূর্য অগ্নি ঢালি যায়,  

একখান মরা গাছে স্তব্ধ মারি শকুন তাকায়। 

 নিচে , নাঙলের লোহার ফলায়  

ধীরে ধীরে মাটি ফাড়ি যায়। /

থরথর করি কাঁপে  মুষ্ঠি তার, হাত থামি যায়,

 বাপ উলটি ধমকায় , "বজ্জাতের ঝাড়,

 আবার থামিলে তোর ভাঙ্গি দেমো ঘাড়।"

 আবার নূরলদীন নাঙলের মুষ্টি ধরে চাপিয়া ঠাসিয়া,  

আবার জোয়াল টানি  বাপ যায় জমিন চষিয়া 

জমিন চষিয়া চলে বাপ তার ভাঙ্গিয়া কোমর, 

অগ্নি ঢালি যায় সূর্য বেলা দু'পহর।"


 এই নাটকে নূরলদীনের মৃত্যু নেই। পরাধীন ভারতবর্ষের এই বীর সেনানীর প্রতি নিবেদিত এই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় উদ্ভাসিত প্রতিবাদের আধুনিক ভাষ‍্য আমাদেরও প্রাণিত করুক। শিকড় অভিলাষী চৈতন‍্যের বিস্তার হোক আমাদের ভাবনায়, মননে।

 একেবারে শেষ দৃশ‍্য থেকে একটি অংশ : আরো একটি সংলাপ ---

পুন্নিমায় চান বড় হয় রে ধবল |

জননীর দুগ্ধের মতন তার দ‍্যাখো রোশনাই। 

 ভাবিয়া কি দেখিব , আব্বাস, যদি মরো, কোনো দু:খ নাই।

হামার মরণ হয় , জীবনের মরণ যে নাই। 

 এক এ নূরলদীন যদি চলি যায় ,

 হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।

এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়, 

অযূত নূরলদীন য‍্যান আসি যায়, 

নিযূত নূরলদীন য‍্যান বাঁচি  রয়। 

গল্প --- স্বপন চক্রবর্তী

   





   স্বপন চক্রবর্তীর রচনায়,  আমরা যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত করি , দেখতে পাই এক নির্জন কল্পনাতাপস , আপনমনে অন্তরাত্মার সঙ্গে যেন নিরন্তর কথা বলে চলেছেন । সেই কথা , তার অন্তর্লীন সুর, শেষ পর্যন্ত পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে । এখানে আমরা তার একটা ছোট লেখা পড়ে নিই ---





পথিক-জন্মদিন 

 স্বপন চক্রবর্তী 



প্রিয় সম্পূর্ণা, 

জন্মদিনের শুভেচ্ছা। 

এখন, এইমাত্র তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পরে পরেই   হঠাৎ করে লিখতে বসে গেলাম এই চিঠি। মনে মনে ভাবছি এখন কত আনন্দ-অনুষ্ঠান হচ্ছে তোমাদের বাড়িতে, তোমাকে ঘিরে ! 

আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে। 


এবারে যে পুরুলিয়া ভ্রমণ করে এলাম কদিন আগে, চার দিনের জন্য। ফিরে আসার দিনের একটি ঘটনা বলি। 

সেটাও পথের মধ্যে একটা জন্মদিনের উৎসব। 

আমরা পুরুলিয়া শহর ছাড়িয়ে কিছুটা পথ পার হয়েছি, আমাদের গাড়ি ছুটছে মসৃণ কালো পীচ-ঢালা পথ ধরে। পেন-ড্রাইভে আমাদের গাড়িতে গান বাজছে : ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী...!

 চারপাশের প্রকৃতিতে ফাল্গুনের তাপ ও শৈত্যের মিশ্র-প্রবাহ। অন্তর কী যে মনোরম হয়ে উঠলো অমনি, ওই গানের কথায় আর সুরে! 

ঠিক প্রায় তখুনি চায়ের জন্যে একটা ধাবায় এসে থামলো আমাদের গাড়ি। নেমে, মৃদু-মোলায়েম রোদ্দুরে ইতস্ততঃসাজিয়ে রাখা যে টেবিল-চেয়ারগুলো-- তারই একটা নিভৃত প্রান্ত বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। 

হঠাৎ খেয়াল করলাম  একটু দূরে ওই ধাবারই অপর প্রান্তে কয়েকজন তরুণ-তরুণীর একটি দল হৈ হৈ করে একটি রঙিন টোপর পরিয়ে দিলো তাদেরই দলের একটি মেয়েকে।

সেই মেয়েটিকে আমরা স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি না--  অনুমানে মনে হচ্ছে সে একটি কিশোরী, অথবা সদ্য-তরুণী। ওই দলের অন্যান্য সঙ্গী ছেলেমেয়েদের দেখেও তা-ই মনে হলো। 

মেয়েটির পরনে গোলাপি রঙের প্রিন্টেড চুড়িদার। আমাদের টীমের একজন সঙ্গী এসে বললো, "জন্মদিন! Birthday-Celebration !"

 ও মা, তা-ই ? হ্যাঁ, তা-ই তো ! 

এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, ওই কিছুটা দূরে ওদের টেবিলে সাজানো কয়েকটা রঙ-বেরঙের মোমবাতি। সেগুলো তারা জ্বাললো  ধীরে ধীরে ... মোমবাতির শিখাগুলো ফু- দিয়ে নিবিয়ে দেবার পর সেই রঙিন টোপর-পরা মেয়েটি এবার টেবিলে সাজিয়ে রাখা কেক কাটলো ...  ওই দলের একটি মেয়ে তাকে এক টুকরো কেক খাইয়ে দিলো ... এর পর ক্রিমের প্রলেপ লাগানো সেই কেকের কিছুটা জন্মদিনের মেয়েটির গালে আলতো করে মাখিয়ে দিয়ে বাকিটা সক্কলে মিলে এ-ওকে খাইয়ে দিলো। 


কী যে ভালো লাগছিল দৃশ্যটা ! 

অভিনব !

জীবনে কখনো এইরকম জন্মদিন- উৎযাপন দেখিনি। আমার অন্তর আবেগে বাঁধনহারা হয়ে উঠছিল। মনে মনে ভাবছি আমার কাছে যে লজেন্সগুলো রয়েছে, মুঠো ভরে সেগুলো তুলে দিয়ে আসি মেয়েটির হাতে : আজ তোমার জন্মদিনে এই শুভেচ্ছা। 

আরেকবার ভাবলাম, একটু ভিডিয়ো  তুলে রাখি এই চমৎকার অনুষ্ঠানের। 

শেষে ভয় হলো, যদি কিছু মনে করে । যদি রুক্ষ স্বরে বলে ওঠে, "কী ব্যাপার বলুন তো?" 


সামলে নিলাম নিজেকে। 

কেবল মনে মনে সেই অলৌকিক, না-যেন অতীব-লৌকিক সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠান-উৎযাপনটি প্রত্যক্ষ করলাম পথের প্রান্তে একটি ধাবায় বসে বসে। 

সেটা মাত্র চার দিন আগের ঘটনা, আজ থেকে। 


পথিক হয়ে পথে নামলে কত যে বিস্ময়! কত যে এরকম অন্তরস্পর্শী মুহূর্ত সামনে এসে পড়ে! 

ভালো লাগে খুব। মনে হয় জীবন পূর্ণ হয়ে উঠলো একটুখানি।



স্বপন চক্রবর্তী বহু অবিস্মরণীয়  গ্রন্থের প্রণেতা |

 তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ----


মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি * লৌকিক মাঘোৎসব * আত্মপ্রতিকৃতি * গীতবিতানের হাট 

যে কুসুম নিজের নাম না -জেনেই ফুটে আছে * স্মৃতি স্বপ্ন কান্না দরবারি *

হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্নের ডাক ইত্যাদি |