বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

তোমায় খুঁজে ফিরি

 শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি

                    লক্ষ্মী দেবী 


১)

(লক্ষ্মী দেবী শ্রীরামকৃষ্ণের অগ্রজ রামেশ্বরের কন্যা।)


     দক্ষিণেশ্বরে আমরা তখন নহবতে থাকতাম। ঠাকুরের শোবার বসবার ঘরখানিতে লোকজন থাকলে তিনি ইশারায় নাকের কাছে একটি গোল চিহ্ন দেখিয়ে মাকে বোঝাতেন। মার নাকে নথ ছিল তো! আবার নহবতকে বলতেন -খাঁচা। আমাদের দুজনাকে বলতেন -শুক সারি। এধারে মার নামও সারদা। মা কালীর প্রসাদ ফলমূল মিষ্টি তাঁর ঘরে নামলে, রামলালদাকে বলতেন (নিজের নাকের কাছে গোল-চিহ্ন দেখিয়ে) 'ওরে, খাঁচায় শুক-সারি আছে। ফলমূল, ছোলাটোলা কিছু দিয়ে আয়।' বাইরের লোকেরা বুঝত, বুঝি সত্যি সত্যি পাখি আছে। মাষ্টারমশাইও প্রথম প্রথম ঐ ধারণাই করেছিলেন।

     ‎ নানান জায়গার মেয়েরা সব এসে মাকে কত কি বলত। ঠাকুরের কানে মাঝে মাঝে সেসব কথাও যেত। তিনি মাকে বলতেন, 'দেখ, ওরা সব এসে হাঁসপুকুরের চারধারে ঘুরে বেড়ায়, আর আমায় দেখেশুনে গিয়ে সব আপনাদের ভেতর কত কি কথাবার্তা কয়। আমি সব টের পাই। বলে, ''এঁর সব ভাল। তবে ঐ যে রাত্তিরে স্ত্রীর সঙ্গে একস্তরে শোন না -এই যা।'' ওদের কথাবার্তা, পরামর্শ -তুমি শুনোনি বাপু। ওরা সব বলবে, আমার মন ফেরাতে ওষুধপালা কর। দেখো, তাদের কথায় আমায় ওষুধপালা করোনি। আমার সব আছে। তবে ভগবানের জন্য, সব শক্তি তাঁতে দিয়ে রেখেছি।' মা আলতো আলতো ভাষায় জবাব দিতেন 'না না, সেকি কথা!'

     ‎ নহবতে তখন ঐটুকু ঘরে কিন্তু কি করে যে কুলিয়ে যেত, তাই এখন ভাবি। ঠাকুরেরই খেলা! মা, আমি, আর একটি মেয়ে। আবার কলকাতা থেকে কখন কখনও স্ত্রীভক্তেরা গিয়ে থাকতেন। কামারহাটির গোপালের-মা মাঝে মাঝে থাকতেন। তাঁর মস্ত মোটা-সোটা শরীর ছিল। ঐ তো একটুখানি ঘর। কিন্তু তার মধ্যেই কত কাণ্ড। এক বৃহৎ সংসার। আমাদের সব জিনিসপত্র। রাঁধবার সাজ সরঞ্জাম -তেল, নুন, লঙ্কা, তেজপাতা, মসলা, চালুনি, কুরুণি, বাসন-কোসন, হাঁড়ি-কুড়ি। ভাঁড়ারে সবই থাকত। খাবার জলের জালা। আর ঠাকুরের পেট খারাপ সহ তাঁর জন্য অনেক রকম পথ্যের জোগাড় থাকত। কই, সিঙ্গী, মাগুর জিওল মাছ যখন যা পাওয়া যেত।

     ‎ ঠাকুরের তো রাত্তিরে বেশি ঘুম হত না। অন্ধকার থাকতে থাকতে তিনি বেড়াতে বেড়াতে নহবতপানে এসে আমাকে ডাকতেন, 'ও লক্ষ্মী! লক্ষ্মী! উঠরে উঠ। তোর খুড়ীকে তোল রে! আর কত ঘুমোবি? রাত যে পোহাতে চলল। এইবার কাক-কোকিল ডাকল বলে। মার নাম কর।'


২)

     তখন শীতের সময়, ওঁর সাড়া পেলে মাঝে মাঝে মা লেপের ভেতর শুয়ে শুয়ে আমাকে আস্তে আস্তে বলতেন, 'তুই চুপ কর। ওঁর চোখে ঘুম নেই। এখনও উঠবার সময় হয়নি। কাক-কোকিল ডাকেনি। সাড়া দিস না।' সাড়া না পেলে তিনি নিজেই উপরে উঠে, জল নিয়ে দরজার গোড়ায় চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে ঢেলে দিতেন। তখন সব ভিজে যাবার ভয়ে তাড়াতাড়ি অগত্যা আমাদের উঠে পড়তেই হত। এক একদিন বিছানা ভিজেও যেত।

     ‎ ঠাকুরের মাথার চুল পেকেছিল দুচার গাঁজা। দাড়িরও কিছু কিছু। মাথার সামনে গরমের দরুন খানিকটা চুল উঠে গিয়েছিল। আর তিনি বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকতে মোটেই চাইতেন না। বলতেন, 'লোকে যে ঐ বলবে, রানী রাসমণির কালীবাড়িতে একটা 'বুড়ো'-সাধু থাকে, সেকথা আমি সইতে পারবনি বাপু। মা বলতেন, 'ওকথা কি বলতে আছে? তোমার কি এর মধ্যেই যাওয়ার সময় হয়েছে? আর বুড়ো হয়ে এখানে থাকলেও লোকে বলবে -রাসমণির কালীবাড়িতে কেমন একজন 'পিরবীণ' সাধু থাকেন। ঠাকুর: 'হ্যাঁ! লোকে তোমার পিরবীণ মিরবীণ অতশত বলতে যাচ্ছে আর কি!'

     ‎ আমি যখন বিয়ের পর বাপের বাড়িতে বিধবাবেশে ফিরে আসি, তখন তিনি আমায় একদিন বলেছিলেন, 'ধর্ম-কর্ম যা, সব ঘরে বসে করবি। বাইরে তীর্থে তীর্থে একলাটি ঘুরে বেড়াবি না। কার পাল্লায় পড়বি, কে জানে? ঐ খুড়ীমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। বাইরে বড় ভয়।'

     ‎ কামারপুকুরে থাকবার সময় ঠাকুর প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর পৈতৃক বাড়ির দরজার পাশে বসে থাকতেন এবং রাস্তা দিয়ে যারা যেত তাদের লক্ষ্য করতেন। সব মেয়েদেরই পুকুর থেকে জল আনার জন্য ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে হতো। তারা কলসী নিয়ে আসত এবং ঠাকুরকে দেখে সামনের ছোট উঠানে কলসী রেখে তাঁর পাশে বসে পড়তে। ঠাকুরের ঈশ্বরীয় কথা ও গান শোনার আনন্দে তারা সব কিছু ভুলে যেত। পাছে তারা নিজেদের কর্তব্যে অবহেলা করে, ঠাকুর তাদের ঐ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতেন। একটি মেয়ে বললো, 'আমার একটি গরু আছে। যখন শুনলুম আপনি আসছেন, এক মাসের মত খড় কেটে ঘর ভর্তি করে রেখেছি।' আর একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোর কোলের ছেলে কেমন আছে?' সেই বলল, 'এই রে আমি ভুলে গিয়েছিলুম, ওকে পাশের বাড়িতে রেখে এসেছি।' সে এক মাইলেরও বেশি পথ হেঁটে এসেছিল ঠাকুরকে দেখবার জন্য।

     ‎ একদিন ঠাকুর মেয়েদের বললেন, 'আজ তোরা গা, আমি শুনি।' তারা সবাই চুপ করে রইল। কেউ টু-শব্দ করতে সাহস করল না। কিন্তু একটি মেয়ে ছিল, তাকে ঠাকুর খুব ভালবাসতেন, সে না এলে ঠাকুর তাকে ডেকে পাঠাতেন। যেই সে দেখলো যে আর কেউ গাইবে না, অমনি সে ক্ষীণ মিহি ও কাঁপা গলায় একটি গান গাইতে আরম্ভ করল। অন্য মেয়েরা হাসতে লাগলো। কিন্তু তার গান শেষ হলে ঠাকুর আনন্দ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, 'দেখ, এর কত ভক্তি। আমি বললুম বলেই ও এত সহজ ও সরলভাবে গান গাইল। তোদের মধ্যে শুধু এরই সত্যি সত্যি ভক্তি আছে।'

     ‎ মেয়েরা নির্লজ্জ বেহায়া হবে, তা তিনি সহ্য করতে মোটেই পারতেন না। মাকে বলতেন ওদের মত তুমি হবে কেন? এক পা বেলতলায় আর এক পা বটতলায় দিয়ে, বেহায়ার মতন চলতে চায়? মেয়েদের সরম-লজ্জা থাকবে। নারীর লজ্জাই ভূষণ।

                   

 ৩)

    চিনু শাঁখারী আমাদের কামারপুকুরে পাড়ার মধ্যে খুব পরিচিত, ঠাকুরের বাল্যসখা। সাধন করতে করতে তাঁর ভেতরে একসময় কিছু বিভূতি সিদ্ধাই ফুটেছিল। সৌম্যমূর্তি পরম বৈষ্ণব। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হলে, তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিনুদাদা আদর করতেন আর বলতেন, 'ওরে গদাই, তোকে দেখে আমার গৌরকে মনে হয়।' একবার আমাদের দেশের কয়েকজন লোক গঙ্গা নাইতে দক্ষিণেশ্বরে যায়। গিয়ে ঠাকুরকে তারা চিনুদাদার অদ্ভুত শক্তির কথা গল্প করলে। -একসময় ঘুরতে ঘুরতে কতগুলো লোক কামারপুকুরে চিনুদার বাড়িতে গিয়ে অতিথি হলো। তখন আমের সময় নয়। কিন্তু দাদাকে বললে, 'আমাদের আমের টক দিয়ে মৌরালা মাছ খেতে বড় ইচ্ছা!' মাছ জোগাড় হল। অতিথি নারায়ণ, তাঁরা আম দিয়ে টক খাবেন বলেছেন! চিনুদা ভেবেই অস্থির। কেমন করে মুখ রক্ষা হবে! কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিনুদা উপায়ান্তর না দেখে, জোড়হাতে গলায় কাপড় দিয়ে একটি আম গাছের তলায় গিয়ে বললেন, 'আমার ভিটেয় আজ ছলনা করতে নারায়ণ অতিথিরূপে এসে বলছেন, -এই সময়ে আম দিয়ে মাছের টক খাবেন। আমি বড় গরিব দীন-হীন পথের কাঙাল। কেমন করে তাঁদের তুষ্ট করব? হে দেবতা! কি দয়া করবেন না?' তারপর আশ্চর্য! সত্য সত্য গুটিকয়েক কাঁচা আম গাছ থেকে পড়ল। চিনুদা আহ্লাদে আটখানা হয়ে নাচতে নাচতে তাই দিয়ে টক রাঁধিয়ে তাদের পরিতুষ্ট করলেন।

     ‎ঠাকুর ওই গল্প শুনলেন। তারপর দেশে যান, তখন চিনুদাকে বলেছিলেন, 'ছিঃ দাদা, বিভূতি সিদ্ধাই হ্যাক-থু! এমন আর করোনি। তা হলে ব্যাটা বেটিরা তোমার মাথা খাবে। অষ্টপ্রহর বিরক্ত করবে। তোমার নিজের সাধন-ভজন অষ্টরম্ভা হবে। খবরদার ওসব আর করতে যেওনি। ওসবে মন দিলে মন নেমে যাবে।'

     ‎ঠাকুর পুরীতে যাননি। বলরামবাবু যখন একদিন মহাপ্রসাদ নিয়ে গিয়ে তাঁকে দিলেন, দেখেছি -তিনি মাথায় ঠেকালেন। প্রণাম করলেন। তাঁর ভাব হলো। পরে বললেন, 'জগন্নাথে যেন আমি গিয়েছি। সেখানে সবই বড়। বিরাট। সমুদ্র বড়। রাস্তা-ঘাট সব বড় বড়। এই শরীর নিয়ে সেখানে গেলে, এটা থাকবেনি।'

     ‎মায়ের সঙ্গে আমি তখন দক্ষিণেশ্বরে থাকতাম। একদিন মা বললেন, 'কাল উনি আমার জিভে মন্ত্র লিখে দিয়েছেন। তুইও যা না!' আমি বললুম, 'আমার বড় লজ্জা করে। কি বলে চাইব? কারা কারা সব থাকে।'

     ‎তারপর একদিন প্রণাম করতে গিয়েছি, কিছু বলিনি। তিনি আপনিই বললেন, 'তোর কোন ঠাকুর ভালো লাগে?' শুনে আমার ভারি ভেতরে ভেতরে আনন্দ। বললুম 'কৃষ্ণ'। তিনি ওই বীজ ও নাম জিভে লিখে দিলেন। আমার গলায় তুলসীর কন্ঠী মালা ছিল। কামারপুকুরের জমিদার লাহাবাবুদের পেসন্নদিদি পরিয়ে দিয়েছিল। বললেন, 'মালা রাখবি। তোকে বেশ দেখায়।'

     ‎আমি ও মা ইতোপূর্বে একজন উত্তর দেশীয় সন্ন্যাসীর কাছে দেবী ভজনের উপদেশ নিয়েছিলাম। বেশ মোটাসোটা খাসা চেহারা। শান্ত মূর্তি। নাম পূর্ণানন্দ স্বামী। বুড়ো দেখতে যেন পাকা আমটি। সে কথা মা পরে ঠাকুরকে বলেছিলেন। তিনি বললেন, 'তা হোক, লক্ষ্মীকে আমি ঠিকই দিয়েছি।' সন্ন্যাসী আমাদের কামারপুকুরে গিয়েছিলেন। শুনেছি, তাঁর কাছ থেকে ঠাকুর ও আমার বাবাও কি কি মন্ত্র সব শুনেছিলেন।

     ‎দক্ষিণেশ্বরে বসে যখন দেশের ৺শীতলার কথা মনে পড়তো তখন কেউ কিছু মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে গেলে বলতেন, 'লক্ষ্মীকে খাইয়ে দাও। তাহলেই মা শীতলার ভোগ হবে। ও তাঁরই অংশ।' গিরিশবাবুকে দিয়ে একবার এইরকম করিয়েছিলেন।

     ‎আবার কখনো কখনো তাঁর ঘরে কীর্তন গান ইত্যাদি হবার আগে রামলালদাকে বলতেন ঘরের নহবতপানের দরজাটি খুলে দিতে 'কত ভাব-ভক্তি হবে। ওরা সব দেখবেনি? শুনবেনি? কেমন করে তবে শিখবে?' পরেই হাসতে হাসতে 'ওরে রামনেলো, তোর খুড়ির পর্দা যে ফাঁক হয়ে গেল!' টাটির ভেতর ছোট ছেঁদা দিয়ে মা সব দেখতেন। তাতেই আনন্দ পেতেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন