বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

অলোক কোৱা






  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইতিহাস বিভাগের  তরুণ  গবেষক এবং প্রতিশ্রুতি মান লেখক অলোক । ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ । কিন্তু তাঁর শক্তিশালী কলম সুন্দরবনের জল - জঙ্গল পরিকীর্ণ প্রান্তর ঢুড়ে তুলে আনে তদসংলগ্ন মানুষজনের কঠিন-কঠোর জীবন সংগ্রাম ।এখানে এমনই একটি লেখা -----


সুন্দরবন :বাওয়ালী-মউলে-জেলে জীবন 


অলোক কোৱা 



     

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভের পর বাংলার নবাব মীরজাফরের থেকে কোলকাতার জমিদারী পায়। ২৪টি পরগণা বা মহল ছিল কোলকাতার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত। কোম্পানি কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের কোলকাতার জমিদারী লাভের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে O’Malley’র Bengal District Gazetteer 24 Parganas-এ। ২৪টি পরগণা বা মহল একত্র করে পৃথক জেলা গঠনের কৃতিত্বের অংশীদার হলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। সে ভাবেই আত্মপ্রকাশ ২৪ পরগণা জেলার। এক সময় এই ২৪ পরগণা জেলাকে ‘আঠারো ভাটির’ দেশ বলে গণ্য করা হত। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য, হরিদেবের রায়মঙ্গল কাব্যে আঠারো ভাটির উল্লেখ দেখা যায়। ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণাংশ হল সুন্দরবন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে ভারত ও বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবন দ্বিখণ্ডিত হয়। সুন্দরবনের বেশির ভাগ অংশটাই বাংলাদেশের মধ্যে চলে যায়। সুন্দরবনের মোট আয়তন ২৫,৫০০ বর্গকিলোমিটার। ভারতীয় সুন্দরবনের আয়তন ৯৬৩০ বর্গকিলোমিটার। বাকি ১৫,৮৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে বাংলাদেশ সুন্দরবনের অবস্থান। সমগ্র সুন্দরবনের ২/৩ অংশ বাংলাদেশ ও ১/৩ অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

   

 ১৭৭০ সাল থেকে ক্লাউড রাসেলের তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের সংস্কার কাজ শুরু হয়। যশোহর জেলার তৎকালীন জেলাশাসক টিলম্যান হেঙ্কেল ১৭৮৩ সালে অয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে সুন্দরবন সংস্কারের প্রস্তাব দেন। সেইমত ১৭৮৪ সালে সুন্দরবনের প্রায় ৬৫ হাজার বিঘা জমি অনুমতি লাভ করে সংস্কারের জন্য। যত সময় এগতে থাকে সুন্দরবন সংস্কারের পরিধি ও বাড়তে থাকে। ১৮২৯ সালে হজেস সুন্দরবনের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেন, ১৮৩১ সালে এই কাজ সম্পূর্ণও করেন। ভারতীয় সুন্দরবনের সীমানা হিসাবে বলা যেতে পারে “দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বিশাল জলাশয়/ ডাম্পিয়ার হজেজ লাইন উত্তরে অক্ষয়/ রায়মঙ্গল, কালিন্দী আর ইছামতী নদী/ পূর্বদিকে আছে জেনো বহে নিরবধি/ পশ্চিমদিকে হুগলী নদী জানিও নিশ্চয়/ কাকদ্বীপ থেকে বসিরহাট রেখায় দক্ষিণ ভাগ হয়”। ১৯৩৯ সালে সুন্দরবনের লোকালয় হিসাবে এবং সংরক্ষিত বন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হলেও ১৯৫০-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন সংস্কারের কাজ চলে। বর্তমান সুন্দরবন ১০২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ৫৪টি দ্বীপে জঙ্গল হাসিল করে আবাদ তৈরি হয়েছে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পেছে, কিন্তু বাকি ৪৮টি দ্বীপ সংরক্ষিত যেখানে কোন জনবাসতি নেই। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ১৩টি ব্লক ও উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ৬টি ব্লক সহ সর্বমোট ১৯টি ব্লক নিয়ে বর্তমান ভারতীয় সুন্দরবন। ৫৪টি দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। জনসংখ্যার আনাগোনা শুরু সেই অতীত থেকেই। জঙ্গল হাসিলের কাজে, বাদাবন সংস্কার করার জন্য ছোটনাগপুর, হাজারীবাগ ও রাঁচি থেকে আগত বিভিন্ন উপজাতির মানুষকে নিয়ে এসে এই বিপদসঙ্কুল অরণ্যে নিযুক্ত করা হয়েছিল। দেশ ভাগের পর প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের যশোর, খুলনা ও বরিশাল থেকে প্রচুর মানুষ সুন্দরবনে জমায়েত তৈরি করে। অবিভক্ত মেদনিপুর থেকেও মানুষ এসে বসতি বিস্তার করে সুন্দরবনে। 

     সুন্দরবনের জনবসতি অঞ্চল ও সংরক্ষিত অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক, রয়েছে অচ্ছেদ্যো বন্ধন। দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং ভয়ংকর ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে সুন্দরবনের জনবসতিকে রক্ষা করে চলেছে ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এই বনভূমি মনুষ্য সৃষ্ট নয়, প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টি। সুন্দরবন নোনাজল বেষ্টিত দ্বীপ অঞ্চল। দ্বীপগুলিকে ঘিরে রয়েছে নদী খাঁড়ি ও সুতিখাল। ৩৫০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ সমগ্র সুন্দরবনের রক্ষক। রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, কালিন্দী, হাতানিয়া-দোয়ানিয়া, মাতলা, ঠাকুরান, সপ্তমুখি, হুগলী, পিয়ালি নদীগুলি সুন্দরবনের অলংকার। নদিগুলির নামকরণ পাল ও সেন যুগের সময়ে। শিকারী, ধীবর, মউলে ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারায়ও নদীগুলির নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। সুন্দরবনের অরণ্যে লবণাম্বু বৃক্ষের বনভুমিকে বিশ্বের মানুষ ম্যানগ্রোভ বলে জানে। ম্যানগ্রোভ হল দলভুক্ত বিশেষ উদ্ভিদগোষ্টী। ম্যানগ্রোভের স্থানীয় নাম বাদাবন। এই দ্বীপের বাদাবন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। পৃথিবীর অন্য কোন বাদাবনে ২০টির বেশি প্রজাতি নেই। সুন্দরবনের বাদাবনে ৬৪টি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রকৃত ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ৩০টি। ২০০৯ সালে প্রনবেশ সান্যাল মহাশয় সুন্দরবনের ৯৪টি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির কথা বলেছেন। প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ৩১টি এবং সহবাশি ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ৬৩টি। ম্যানগ্রোভ গুলির মধ্যে সুন্দরী, গরাণ, গেঁওয়া, বাইন, খলসি, কেওড়া, হেঁতাল, গোলপাতা, গর্জন পশুর প্রধান। প্রতিটি ম্যানগ্রোভের মধ্যে প্রাকৃতিক ঔষধির গুনাগুন রয়েছে। কোন কোন ম্যানগ্রোভ আবার অর্থনৈতিক গুনে সম্পন্ন। জীব বৈচিত্রের আকর সুন্দরবন। সুন্দরবনের জঙ্গল ও খাঁড়িতে ১৫৮৬ প্রজাতির প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। ২০০-২৫০ প্রাজাতির পাখি দেখা যায়। ৭০ প্রাজাতির কাঁকড়া-শামুক-ঝিনুক, ১৩০ প্রাজাতির মাছ দেখা যায় এই বাদাবনে। সুন্দরবন পরিচিত র‍্যয়েল বেঙ্গল টাইগার এর ভয়ংকরতায়। ভারতবর্ষের মোট বনভূমির শতকরা ২৩ ভাগের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৩ শতাংশ, যার অধিকাংশই সুন্দরবন, ২৩০০ বর্গকিলোমিটার। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের জলবায়ুকে অনেটা নিয়ন্ত্রন করে এই ভয়াল ভয়ংকর সুন্দরবন। সন্দেহ নেই- সুন্দরবন একটা বৃহৎ সম্পদশালী বনরাজ্য। সুন্দরবনের দ্বীপ গুলিকে নদী ও খাঁড়ি চারদিকে ঘিরে রয়েছে। বাদাবনের নদ-নদী বা নদীর চর প্রায় ১৯৬৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদকে ঘিরে লাখোলাখো মানুষ কঠোর পরিশ্রমকে আশ্রয় করে বাওয়ালী, মউলে ও জেলে জীবন অতিবাহিত করে কেবলমাত্র আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে। স্বল্প পরিসরে আলোচিত হবে এই সমস্ত মানুষদের জীবন জীবিকা তথা দৈনন্দিন পরিস্থিতির কিছু বাস্তবিকতা। 

     বাওয়ালিঃ বনজীবি মানুষেরা বন্য হিংস্র জন্তুর থেকে মুক্ত হতে সর্বদাই ওঝা-গুণিনদের ওপর ভরসা করে চলে বা চলতো। এদের বিশ্বাস ওঝা-গুণিনরা মন্ত্রপুত করে জঙ্গলের সর্বপ্রকার বিপদকে দূরে সরাতে পারে। বাঘ-কুমিরেরের মুখ যেমন বন্ধ করতে পারে, তেমনি ভাবে ভূত প্রেতের থেকে জীবন বাঁচাতে ও পারে। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে ‘বাউলে’ বলা হয়। সময়ের হাত ধরে বাউলে শব্দটির মৃত্যু ঘটেছে। ধারনা করা হয় এই বাউলে শব্দ থেকে বাওয়ালী নামের উৎপত্তি হয়েছে। সুন্দরবনের অরণ্যে যারা কাঠ সংগ্রহ করতে, গোলপাতা সংগ্রহ করতে যায় তারাই বাওয়ালী নামে পরিচিত। 

     বন বিভাগের কাছ থেকে বনের সম্পদ সংগ্রহের পাশ পারমিট বা অনুমতি পত্র সংগ্রহ করে মাহাজনেরা বা নৌকার মালিক। চুক্তিভিত্তিক বা নির্দিষ্ট বেতনে বাওয়ালীরা বনে কাজ করতে যায়। পাঁচ, সাত, বা দশ পনেরো জনের এক একটা দল জঙ্গলে প্রবেশ করে। পনেরো দিন বা এক মাসের চাল, ডাল, আলু, নুন, তেল ও প্রয়োজনীয় পানীয় জল নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে। 

    

 বাওয়ালীরা নিজেদের মধ্যে কাজের জায়গা ভাগ করে নেয়। কেউ নৌকা চালায়, কেউরান্না করে, কেউ নৌকা পাহারা দেয়। সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করে না। দু-এক জনের হাতে নৌকার দায়িত্ব দিয়ে বাকিরা জঙ্গলে ঢোকে। এদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রয়োজন হয় না, প্রকৃতি এদের বড় শিক্ষক। বিভিন্ন জাতের মানুষ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই কাজে যুক্ত হয়। সুন্দরবনের অসংখ্য করুণ কাহিনীর মধ্যে বাওয়ালীদেরও অনেক কাহিনী আছে। বিপদ আপদ তাদের নিত্যকালীন সঙ্গী। ভাগ্য ভালো থাকলে বাড়ি ফেরা হয়। নতুবা কাগজের রঙ্গিন পাতায় পাঠকের কাছে রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের শিরোনামে ধরা দেয়। বাওয়ালীরা জঙ্গলে অসুস্থ হয়ে পরলেও নিয়তি তাদের পথ দেখায়।

     মউলেঃ সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ হল মধু। মোমও কোন অংশে কম নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে সুন্দরবনের বনজীবি মানুষেরা মধু ও মোম সংগ্রহে নিয়োজিত রয়েছে। সুন্দরবনবাসিদের কাছে জঙ্গলের মধু সংগ্রহ অন্যতম জীবিকা। মোমের চাহিদা বর্তমান মানুষের কাছে আগের মতোই আছে। বিদ্যুৎ ও কেরোসিনের সহজলভ্যতার পাশে মোমের একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যারা এই অরণ্যের সম্পদ নিয়ে আসে সমগ্র বিশ্বের কাছে তারাই মউলে বা মৌয়াল বা মৌয়ালীয় নামেই পরিচিত। 

     সরকারের বনবিভাগের অফিস থেকে পাস কালেক্ট করে মউলেরা ছোট-বড় নৌকো নিয়ে সাত আট জনের বা ১২-১৩ জনের এক একটা দল তৈরি করে জঙ্গলে মধু ও মোম সংগ্রহ করতে যায়। বাওয়ালীদের মত মউলেরাও সবাই জঙ্গলে একসাথে প্রবেশ করে না। এক জন নৌকাতে থাকে। সে সবার রান্নার বাবস্থা করে, সংগৃহীত মধু ও মোম কে পৃথক পৃথক পাত্রের মধ্যে হেফাজত করে। ইনিই মউলেদের ভাষায় দারোগা নামে খ্যাত। 

     মধু সংগ্রহে মউলেদের জীবনের ঝুঁকি থাকে খুব। মৌমাছিদের গতিবিধির ওপর ভালো করে নজর রাখতে হয়। এই সময় দিক ভ্রান্ত হয়ে বাঘের সম্মুখে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ‘সূর্যমুখী’ নামে পরিচিত এক ধরনের মৌমাছিদের আক্রমণের থেকেও নিজেদেরকে বাঁচাতে হয়। কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ও এই সমস্যা থেকে মুক্ত হয় না। প্রতি বছর সুন্দরবনে ৪৫০০ নৌকা নিয়ে মউলেরা মধু সংগ্রহ করতে যায়। প্রতি বছর গড়ে ৫০০ কুইন্ট্যাল মধু ও ৩০০০ কিলোগ্রাম মোম সংগ্রহ করে সুন্দরবনের মউলেরা। হাজার হাজার ভূমিহীন মানুষ অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে ভয়ংকর বিপজ্জনক জীবিকার সন্ধানে পুরুষানুক্রমে বনেজঙ্গলে মধু ও মোম সংগ্রহের নেশায় নেমে পড়ে। জঙ্গল দেবী প্রসন্ন হলে প্রাণ নিয়ে সংসারে ফেরে। নতুবা জঙ্গলে থেকে য়েতে হয় নশ্বর দেহ নিয়ে।

     জেলেঃ সুন্দরবনের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সুন্দরবনের নদী খাঁড়ি ও মোহনায় মৎস্যশিকারের উপর নির্ভরশীল। মৎস্য সম্পদের আকর সুন্দরবন। বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন ধরনের মাছের দেখা মেলে সুন্দরবনের নদী-খাঁড়ি-মোহনায়। এত মাছের প্রাচুর্য যে জেলে মৎস্যজীবিরা সারা বছর ধরেই মাছ সংগ্রহের কাজে যুক্ত থাকে। সুন্দরবনের এই মৎস্য সম্পদ বারো মাসই আহরণ করা হয়। বনের কাঠ সংগ্রহ এখন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলত বাওয়ালীরা নিজস্ব জীবিকা পরিত্যাগ করে জেলে সম্প্রদায়ে নাম লিখিয়েছে। সুন্দরবনে এখন জেলের সংখ্যা অধিক। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে সুন্দরবনের মানুষের কাছে নির্দিষ্ট কোন জীবিকা নেই, বলা যায় একটা কাজে এরা সারা সময় অতিবাহিত করে না। কঠোর মানবিকবলে ভর করে সমস্ত জীবিকায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করে।

সুন্দরবনের জেলেরা ছোট-বড়-মাঝারি সমস্ত
ধরনের নৌকা নিয়ে মৎস্য সম্পদ সংগ্রহের
কাজে নিয়োজিত হয়। বর্তমান কালে নৌকা
গুলিতে ইঞ্জিন বসিয়ে আধুনিক ভাবে গড়ে
তোলা হয়েছে। মাছ ধরার জন্য জেলেরা
বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে। জাল
গুলির নামও বিভিন্ন। বেন জাল, খ্যাপলা জাল,
গয়সা জাল, মনোফিল জাল, কলভেসালি জাল,
চরপাটা জাল প্রভৃতি। 

     বংশানুক্রমিক ভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে মালো ও রাজবংশীরা। এরা জাত জেলে নামেই পরিচিত। দেশ ভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে সুন্দরবনের নানা জায়গায় এরা বসবাস শুরু করেছে। হাস্নাবাদ, কচুখালি, রায়দিঘি, ঝড়খালি, গোসাবা, সাতজেলিয়া প্রভৃতি জায়গায় রয়েছে রাজবংশী ও মালোরা। রাঢ়অঞ্চল থেকে আসা বাগদীরাও সুন্দরবনের জেলে মৎস্যজীবী। মাছ সংগ্রহের পাসাপাশি এই জীবিকার মানুষেরা নদী ও জঙ্গলের বাগদার মীন ও কাঁকড়া ধরেও জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। হাজার হাজার নর-নারী, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, স্কুল ছুট বাচ্চারা ও এই মীন ধরার কাজে নিযুক্ত। ভোর রাত থেকে মীন ধরার জাল নিয়ে এরা নদীর চরে পড়ে থাকে। খুব সামান্য অর্থের জন্য এরা সারা বছর ধরে নদীর বুক আগলে পড়ে থাকে। জেলেরা জঙ্গলে মাছ ধরতে গেলে নারী-পুরুষ উভয়ই এই কাজে অংশগ্রহণ করে। ১০-১২ দিন কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এরা বাড়ির বাইরে থাকে। সুন্দরবনের সমস্ত মানুষের মধ্যে আন্তরিক সখ্যতা রয়েছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা রয়েছে। একে ওপরের বিপদে পাশে এসে দাড়ায়। জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়ে খাদ্যদ্রব্য প্রয়োজন হলে মাছে বিনিময়ে জেলেরা বাওয়ালীদের কাছ থেকে চাল, ডাল, জলও সংগ্রহ করে। ক্যানিং, গোসাবা, সাতজেলিয়া, সাগর, কাকদ্বীপ, নামখানা, বকখালি, পাথরপ্রাতিমা, প্রভৃতি অঞ্চলের জেলে মৎস্যজীবী মানুষেরা সরকারি লোন নিয়ে বা ব্যক্তিগত মালিকানায় যন্ত্রচালিত নৌকোয় করে মাছ শিকারে সাগরে পাড়ি দেয়। 

     জঙ্গলে যারা মাছ শিকারে যায় প্রতি পদে তাদের বিপদের ভয় থাকে। বাঘ ও ডাকাতের ভয় ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়। সুন্দরবনের কোর এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। আবার কোর এলাকায় মাছ বেশি পাওয়া যায়। সমস্ত বিপদকে উপেক্ষা করে মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিয়তির উপর বিশ্বাস রেখে ঢুকে পড়ে এই সমস্ত বিপদসঙ্কুল এলাকায়। 

     শৌর্যে, বীর্যে, ও মাধুর্যে ঘেরা এদের জীবন। জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত হলেও পরাজিত নয়।    



তথ্যসুত্রঃ

১। W. W. Hunter, A Statistical Account Of Bengal -24 Parganas and Sundarbans - Vol 1, Trubner and Company, London, 1875

২। ইন্দ্রাণী ঘোষাল, সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জীবন, তাদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্য, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০৬

৩। শঙ্করকুমার প্রামাণিক, সুন্দরবন জল-জঙ্গল-জীবন, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা, ২০১৪

৪। সুকুমার সিং, দক্ষিণ ২৪ পরগাণা জেলার ইতিহাস, মাস এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১০

৫।  রঞ্জন চক্রবর্তী ও ইন্দ্রকুমার মিস্ত্রী, সুন্দরবনের অর্থনীতি জনসংস্কৃতি ও পরিবেশ, রিসা রিভার্স সার্ভিস, কলকাতা, ২০০৭

৬।  কানাই লাল সরকার, সুন্দরবনের ইতিহাস, পাণ্ডুলিপি, কলকাতা, ২০১৭ 

৭। প্রনব সরকার ( সম্পাদনা ), চব্বিশ পরগনা ও সুন্দরবন পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য রচনা, লোক, কলকাতা, ২০১৩

৮। সুভাষ মিস্ত্রী, লোকায়ত সুন্দরবন, লোক, কলকাতা, ২০১৩


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন