বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

প্রবন্ধ --- সুশান্ত চট্টোপাধ‍্যায়


প্রবন্ধ সাহিত্যে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় এককথায় অনন্য, অসাধারণ । গভীর অধ্যয়ন এবং সৃষ্টিশীলতা তাঁর রচনায় পরতে পরতে গেঁথে থাকে । অ্লোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় সম্পাদিত"আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস"গ্রন্থে সত্তর দশকের কবিতা' তাকে পরিচিতি দিয়েছে।১৯৯৫ সালে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর তাকে সাহিত‍্যে সিনিয়র ফেলো হিসেবে মনোনীত করে।  'স্বরবর্ণে ' আমরা তাঁর শামসুল হকের 'নুরুলদীনের সারাজীবন ' কাব্য নাটকের একটি মনোজ্ঞ আলোচনা পড়ব,যা আজকের পরিযায়ী শ্রমিক,কৃষক আন্দোলন কি অশান্ত নির্বাচনী পরিস্থিতি  উদ্ভুত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমান প্রাসঙ্গিক বলে আমাদের মনে হয়।



 বিবর্ণ ইতিহাস, বর্ণময় কথামালা


সুশান্ত চট্টোপাধ‍্যায়




বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অশীন দাশগুপ্ত "ইতিহাস ও সাহিত্য" প্রবন্ধে ইতিহাস ও সাহিত্যের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনাসুত্রে মন্তব্য ক‍রেন "যদি কোন বিরল সাহিত‍্যিক অন‍্য যুগের মনকে তার রচনায় ধরতে পারেন, পাঠক যদি সেই মনকে পৃথক ব'লে চেনেন কিন্তু স্বাভাবিক ব'লে মানেন তা হলে সেই সাহিত্য নি:সন্দেহে ইতহাসধর্মী " কিন্ত সেই বিরল সাহিত‍্যিক তো সবাই নয় ; কেউ কেউ নিশ্চয়ই। আধুনিক সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "সেই সময়" উপন‍্যাসের কথা অনেকেরই মনে পড়বে। কিন্ত কবিতায় সেই ধরনের কোনো প্রয়াস কি আমাদের নজরে এসেছে ? 


         এই সূত্রেই মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের প্রয়াত কবি ও কথাকার সৈয়দ শামসুল হকের রংপুর কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিকায় "নূরলদীনের সারাজীবন" কাব‍্যনাট‍্যটির কথা। সম্ভবত: এই সময়ের আয়নায় এটি একটি বিরল কাব‍্যনাট‍্য যার শিকড় রয়ে গেছে আমাদের অতীত ইতিহাসের বিবর্ণ আখরগুলির ভিতরে। তার নিজের উচ্চারণ থেকে জানতে পাই :


     সত্তর দশকের লন্ডন প্রবাসকালে আমার ইচ্ছে হয় ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ইতিহাস একটু বিস্তারিত পড়ে দেখব, সেই পড়াশোনা করতে গিয়েই একদিন দেখা পেয়ে যাই এই অসামান্য কৃষকটির, কিন্ত তার সম্পর্কে তথ‍্য প্রায় কিছুই আমি পেলাম না। সেই তথ‍্যের সন্ধানেই লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যাই, সেখানে সমকালীন বেশ কিছু নথিপত্র, দলিল, পুরনো বই কয়েকবছর ঘাটবার পর নূরলদীন এবং তার কাল সম্পর্কে একটা ছবি আমার মনের মধ‍্যে গড়ে ওঠে।


  এই ছিল সূচনা। তারপর এই কাব‍্যনাট‍্য লেখা হয়। ৯জানুয়ারি - ১২মে ১৯৮২। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮২ বাংলাদেশের "মহিলা সমিতি'র মঞ্চে " নাগরিক নাট‍্য সম্প্রদায়"-এর প্রযোজনায় নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়। অভিনয় শুরুর আগে প্রারম্ভিক ভাষণে নাট‍্যকার শামসুল হক জানান ১৯৮২ তে নূরলদীনের নেতৃত্বাধীন রংপুর কৃষক বিদ্রোহের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হবে।  নিজের শিকড়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও প্রতীতি কতো গভীর ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।


           "নূরলদীনের সারাজীবন" যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, তখন শামসুল হক লেখেন :


নিজেকে দেয়া অনেকগুলো কাজের একটি এই যে, আমাদের মাটির নায়কদের নিয়ে নাটকের মাধ‍্যমে কিছু করা, নূরলদীনের সারাজীবন" লিখে তার সূত্রপাত করা গেল। যে জাতি অতীত স্মরণ করে না, সে জাতি ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারে না। এই কাব‍্যনাট‍্যটি লিখে ফেলবার পর আমার আশা এই যে, এই মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন এমন সব গণনায়কদের আমরা ভুলে গিয়েছি তাদের আবার আমরা সমুখে দেখব এবং জানবো যে আমাদের গণআন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের ও বড় মহিমার - সবার ওপরে , উনিশশো একাত্তরের সংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।' - সময় ও সমকালের সঙ্গে এইভাবেই সংরক্ত হয়ে যায় ইতিহাস। আরো একটি ব‍্যক্তিগত স্মৃতির কথা এইখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যারা বাংলাদেশে গেছেন এবং রায়েরবাজার গণকবর প্রাঙ্গণে গেছেন তারা অনুভব করতে পারবেন এই উচ্চারণের সারবত্তা।


 দুই


কিন্ত নাট‍্যরচনার উপাদান বলতে সামান্যই কিছু ছিলো তার সামনে। সুপ্রকাশ রায়ের " ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম "গ্রন্থে  রংপুর বিদ্রোহ বিষয়ে সাত পৃষ্ঠার আলোচনা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না তার সামনে‌ |

    সুপ্রকাশ রায় তার গ্রন্থের এক জায়গায় নূরলদীনের নাম উল্লেখ করেন : বিদ্রোহীদের আহ্বানে কোচবিহার ও দিনাজপুরের বহু স্থানের কৃষকগণও "নবাব " নূরুলউদ্দিনের বাহিনীতে যোগদান করিয়া নিজ নিজ অঞ্চলের নায়েব, গোমস্তাদের বিতাড়িত করে।" নূরুলউদ্দিনকে কৃষকেরা "নবাব" এই সম্বোধনে ভূষিত করছিল।  সুপ্রকাশ রায় একটু পরে লিখেছেন : বিদ্রোহীরা দেবী সিংহ ও ইংরেজ শাসনের প্রধান ঘাটি মোগলহাট বন্দরের উপর গুরুতর আক্রমণ করিলে এই স্থানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই বিদ্রোহের নায়ক "নবাব" নূরুলউদ্দিন গুরুতররূপে আহত হইয়া শত্রুহস্তে বন্দী এবং তাহার দেওয়ান দয়া শীল নিহত হন। নূরুলউদ্দিন সেই আঘাতের ফলেই অল্প কয়েকদিন পর প্রাণ ত‍্যাগ করেন"(পৃ ১১০) ।

 শামসুল হক লিখছেন : ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় নামটি লিখেছেন নূরুলউদ্দিন, আমরা বলব ওটা হবে নূরুদ্দিন, কিন্ত আমি ব‍্যবহার করেছি নূরলদীন, রংপুরের সাধারণ মানুষেরা যেমনটি উচ্চারণ করবে"।


 তিন


 কিন্ত বিদ্রোহের কথামালা কাব‍্যনাট‍্যের আঙ্গিকে রচনা করা সহজসাধ্য নয়। বিশেষতঃ আগাগোড়া রংপুরের ব‍্যবহৃত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে এ নাটক। কিন্ত আশ্চর্য হতে হয় শামসুল হকের কারুবাসনার সৃজনের অনন‍্যতায়।

 চোদ্দটি দৃশ‍্যে বিন‍্যস্ত এ কাব‍্যনাট‍্যের শরীর জুড়ে শিল্পের শামিয়ানা, রংপুরের ভাষায় ভিতরেও আধুনিক কাব‍্যভাষার বিন‍্যাস : নূরলদীনের  একটি সংলাপ ----

আজিও নূরলদীন পস্ট সব পস্ট করি দেখিবার পায়,

মাথার উপরে সূর্য অগ্নি ঢালি যায়,  

একখান মরা গাছে স্তব্ধ মারি শকুন তাকায়। 

 নিচে , নাঙলের লোহার ফলায়  

ধীরে ধীরে মাটি ফাড়ি যায়। /

থরথর করি কাঁপে  মুষ্ঠি তার, হাত থামি যায়,

 বাপ উলটি ধমকায় , "বজ্জাতের ঝাড়,

 আবার থামিলে তোর ভাঙ্গি দেমো ঘাড়।"

 আবার নূরলদীন নাঙলের মুষ্টি ধরে চাপিয়া ঠাসিয়া,  

আবার জোয়াল টানি  বাপ যায় জমিন চষিয়া 

জমিন চষিয়া চলে বাপ তার ভাঙ্গিয়া কোমর, 

অগ্নি ঢালি যায় সূর্য বেলা দু'পহর।"


 এই নাটকে নূরলদীনের মৃত্যু নেই। পরাধীন ভারতবর্ষের এই বীর সেনানীর প্রতি নিবেদিত এই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় উদ্ভাসিত প্রতিবাদের আধুনিক ভাষ‍্য আমাদেরও প্রাণিত করুক। শিকড় অভিলাষী চৈতন‍্যের বিস্তার হোক আমাদের ভাবনায়, মননে।

 একেবারে শেষ দৃশ‍্য থেকে একটি অংশ : আরো একটি সংলাপ ---

পুন্নিমায় চান বড় হয় রে ধবল |

জননীর দুগ্ধের মতন তার দ‍্যাখো রোশনাই। 

 ভাবিয়া কি দেখিব , আব্বাস, যদি মরো, কোনো দু:খ নাই।

হামার মরণ হয় , জীবনের মরণ যে নাই। 

 এক এ নূরলদীন যদি চলি যায় ,

 হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।

এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়, 

অযূত নূরলদীন য‍্যান আসি যায়, 

নিযূত নূরলদীন য‍্যান বাঁচি  রয়। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন