গুচ্ছকবিতা/ রাহুল দাশগুপ্ত
প্রভু ২
মানুষ খেতে পেত না সেই দেশে
প্রভু তাদের সমস্ত লুটেপুটে নিয়েছিলেন
অমন লুটপাট কেউ কখনও দেখেনি
শুধু খাদ্য বা বস্ত্র নয়
মানুষের রুচি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য
সমস্ত লুট হয়ে গিয়েছিল
দেশের মানুষকে ভিখিরি করে দিয়েছিলেন তিনি
মানুষ টেরও পেল না
ভাবল, ভিখিরি হয়ে বাঁচাই বুঝি
জীবনের স্বাভাবিকতা
তারা ভিক্ষা নিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেল
প্রভু কালেভদ্রে ভিক্ষা দেন
তখন সেই ভিক্ষা পাওয়ার জন্য লাইন লেগে যায়
সামান্য ভিক্ষা পেয়ে মানুষ কৃতার্থ বোধ করে
কিন্তু তাদের পেট ভরে না
মানুষের কাজ নেই, তবু লুটপাট চলে
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়,
তবু লুটপাট চলে
যারা অর্জুন হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল
তাদের সব বৃহন্নলা বানিয়ে দিয়েছেন প্রভু
কেউ প্রাপ্য কিছু চাইতে গেলেই
প্রভু রেগে যান
বলেন, অনেক তো দিয়েছি, আর কেন, এত লোভ কেন
মানুষ ক্ষিদেয় কাঁদে
প্রভু কানে তুলো গুজে ঘুমোন
মানুষ সম্মান চেয়ে, প্রাপ্য মর্যাদা চেয়ে কাঁদে
প্রভু কানে তুলো গুজে ঘুমোন
মানুষ যোগ্যতার পুরস্কার চেয়ে কাঁদে
প্রভু কানে তুলো গুজে ঘুমোন
এমন সময় খবর আসে
শত্রুরা ঘিরে নিয়েছে নগর
যে কোনও সময় শুরু হবে আক্রমণ
প্রভু জেগে ওঠেন
বিনা পয়সায় খাবারের ব্যবস্থা করেন
খুলে দেন লঙরখানা
বলে দেন, খাবারগুলো যেন সুস্বাদু হয়
ক্ষুধার্ত মানুষেরা দলে দলে ছুটে আসে
লাইন দিয়ে দাঁড়ায়
সামান্য কিন্তু সুস্বাদু খাবার চেটেপুটে খায়
কতদিন খায়নি তারা
সেকথা ভাবে না
কেন তাদের খাবার জোটেনি
সেকথা ভাবেনা
কে তাদের লুটপাট করে গেছে
সে কথা ভাবে না
কেন তাদের এখন খাবার জুটছে
সেকথা ভাবে না
কতদিন এই খাবার জুটবে
সেকথা ভাবে না
শুধু খাবার জোটার আনন্দে
প্রভুকে তারা আশীর্বাদ করে
প্রভুর তারা প্রশস্তি করে
তারা হয়ে ওঠে প্রভুর সমর্থক
রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে
সেই বিপুল সমর্থকদের দেখে
প্রভু মুচকি হাসেন
এবার তিনি তৈরি, দেখে নেবেন শত্রুকে...
মানুষ তার পিছনে আছে
শুধু ভিক্ষা দিয়েই
তিনি নিজের সৈন্যবাহিনী তৈরি করে ফেলেছেন
যারা বীর হতে পারত
তারা হয়ে গেছে কাপুরুষ
যারা যোগ্য হতে পারত
তারা হয়ে গেছে ভিখারি
যারা সৎ হতে পারত
তারা জেনে গেছে, মিথ্যা ছাড়া বাঁচবে না
মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে
তাদের শরীর থেকে মেরুদণ্ড বার করে
প্রভু এখন সেগুলো দিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন...
শত্রুকে তিনি দেখিয়ে দেবেন
মানুষ তার পিছনে আছে...
প্রভু ৩
সবার চোখের সামনে
প্রভু নিচে নামতে শুরু করলেন
আর প্রভুকে দেখে
নিচে নামতে শুরু করল সবাই
কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে রইল
তাদের কেউ গ্রাহ্য করল না
যারা দূরে দাঁড়িয়ে রইল
তাদের মধ্যে কেউ বলল,
প্রভু যা করলেন
তাঁর অতীতকে আর কেউ মনে রাখবে না
সেই অতীতে তবু কিছু মর্যাদা ছিল
কিন্তু প্রভু যা করেছেন
সবই তো নিচে নামার জন্য
গোটা দুনিয়াকে দেখানোর জন্য
তিনি শুধু প্রভু হতে চান, আর কিছু নয়...
আর তার জন্য
তিনি সবকিছু ছাড়তে পারেন
এমনকি মানুষকেও
প্রভু এখন নিচে নেমে চলেছেন
তিনি আরও কত নিচে নামবেন
জানা নেই
মানুষের শরীর থেকে ছাল–চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে
তিনি তাদের ভৃত্য বানিয়ে ছাড়ছেন
ভিখিরি বানিয়ে ছাড়ছেন
কঙ্কাল বানিয়ে ছাড়ছেন
কাপুরুষ বানিয়ে ছাড়ছেন
তাদের ঠেলে দিচ্ছেন অন্ধকারে, নোংরায়, আস্তাকুঁড়ে
যেখানে তাদের হামাগুড়ি দিতে সুবিধা হবে
আর প্রভু এভাবেই
ক্রমশ আরও নিচে নামতে নামতে
আরও বেশি করে প্রভু হয়ে উঠছেন...
প্রভু ৪
নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে প্রভু বললেন,
তোকে আমার আত্মা দিয়ে দিলাম
এবার তুই জন্ম নিতে পারিস
সবাই ভাবল, এবার একটা সুন্দর মানুষের জন্ম হবে
কারণ, প্রভু তো একজন মানুষই
যদিও প্রভুত্ব করাই তাঁর কাজ
আর প্রভুত্ব করেই তিনি পেয়েছেন প্রভুত ক্ষমতা আর অর্থ
আর ওসব যার আছে, সে তো সুন্দর হবেই, আর মানুষও...
কিন্তু কোনও মানুষ নয়
জন্ম নিল একটা হিংস্র কুকুর
ভয়াবহরকমের হিংস্র
জন্মের পরই সে দেশের লোককে ধরে কামড়াতে শুরু করল
দেশের লোক অবাক হয়ে বলল,
এ দেশ তো তোমারই, প্রভু তোমাকেই দিয়েছেন
নিজের দেশের মানুষকে তুমি কামড়াচ্ছ কেন?
সে কোনও উত্তর দিল না, শুধু ঘেউ ঘেউ করল
আর যেখানে পারল সেখানেই চুরি করতে শুরু করল
দেশের লোক আরও অবাক হয়ে গেল, বলল,
এ দেশ তো তোমারই, নিজের দেশেই তুমি চুরি করছ?
এ দেশ তো তোমারই, নিজের দেশেই তুমি জোচ্চুরি করছ?
এ দেশ তো তোমারই, নিজের দেশেই তুমি ডাকাতি করছ?
এ দেশ তো তোমারই, নিজের দেশেই তুমি লুটপাট করছ?
এ দেশ তো তোমারই, নিজের দেশের মানুষের কাছেই তুমি মিথ্যা কথা বলছ?
হ্যাঁ গো, তুমি কী একটাও সত্যি কথা বলতে পারো না?
এ দেশ তো তোমারই, সেই দেশের মানুষকেই তুমি ঠকাচ্ছ?
তুমি কী নিজেকেই ঠকাচ্ছ না?
সে কিন্তু কানে তুলো গুজে হুঙ্কার ছাড়ল,
এ দেশে আমার কিছুই নেই, সব আমি বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি
তোমাদের আমি ভিখিরি করে ছাড়ব
লোকে জানতে চাইল, কিন্তু কেন? এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাঠিয়ে কী লাভ?
তুমি বিদেশের কেউ হও না। তুমি তো এদেশেরই। তোমার শরীরে যে রক্ত বইছে
তোমার ভিতরে যে আত্মা রয়েছে, তা তো এদেশেরই...
তাহলে এদেশের সঙ্গে তুমি এভাবে প্রতারণা করছ কেন?
এদেশের মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিচ্ছ না কেন?
বিদেশে সম্পদ জমিয়ে শেষ পর্যন্ত কী পাবে তুমি?
তোমার এই লোভ, এই মিথ্যাচার, এই দুর্নীতি, এসবই কী বিকৃতি নয়?
একটি মেয়ে বলে উঠল, কিন্তু এই নোংরা কুকুরটার মধ্যে কী প্রভুর আত্মাই নেই?
প্রভু সকলের সামনে তাঁর আত্মাকে কী দিয়ে দেননি এর জন্মের সময়
যাতে প্রভুর স্বরূপকে আমরা চিনতে পারি
প্রভুর ভিতরে লুকিয়ে থাকা আসল প্রভুকে আমরা চিনতে পারি
এই নোংরা কুকুরটাই কী সেই আসল প্রভু নয়?
একটি ছেলে বলে উঠল, কিন্তু প্রভু যে ছবি আঁকেন
বই লেখেন, গান করেন, সংস্কৃতিকে বাঁচাতে চান
তাঁর সন্তান এত নোংরা হয় কী করে?
একজন বৃদ্ধ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন,
প্রভু নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানেন
তিনি মুখোশ পরে থাকেন
ছদ্মবেশে থাকেন
যাতে তাঁকে আমরা পুজো করি
কিন্তু তাঁর মধ্যে যতটুকু খাঁটি, নির্ভেজাল, আসল
তার সবটাই তিনি দিয়েছেন নিজের সন্তানকে
আর আমরা পেয়েছি একটা নোংরা কুকুরকে
ওই নোংরা কুকুরটাই আসল প্রভু
বাকি যা আছে, যা আমরা দেখতে পাই, সেই সমস্ত আড়ম্বর
একটা প্রকান্ড মিথ্যে
একটা বিপুল ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়
প্রভু আসলে একটা বিভ্রম
আর নোংরা কুকুরটাই এই দেশের আসল সত্য
প্রভু সেই সত্যটাকে চিনিয়ে দিয়েছেন
আর আমরা এখনও সেই বিভ্রমের দিকে তাকিয়ে আছি
আশা করে আছি মঙ্গলের অপেক্ষায়
আসলে আমরা সরল আর নির্বোধ
প্রভু আমাদের খাঁচায় ভরে রেখেছেন
আর বাইরে দাপিয়ে বেরাচ্ছে একটা হিংস্র কুকুর
প্রভুর আত্মা
প্রভুর সন্তান
তার হিংস্র দাঁত ফালাফালা করে দিচ্ছে গোটা দেশ
খাঁচার গায়ে হাত রেখে
সেই হিংস্র কুকুরের গর্জন শুনতে শুনতে
আমরা স্বপ্ন দেখে চলেছি সুখের, আশার, স্বাধীনতার...
রাহুল দাশগুপ্তের বই
গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস মিলিয়ে রাহুল এ পর্যন্ত কুড়িটিরও বেশি বই লিখেছেন |
তাঁর কয়েকটি ------
গল্প সংকলন
গল্প সমগ্র (প্রথম খন্ড )
প্রভু ও তাঁর পৃথিবীতে এক দেবদূত
কবিতা সংকলন
শিরামুখ খুলে গেছে ক্ষতে * প্রার্থনার স্পর্শে একা * এক অবিরাম স্বীকারোক্তি
উপন্যাস
সার্টিফিকেট * বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ নেই *
যখন কেউ হত্যাকারী হয়ে ওঠে * একলা চলার পথ ইত্যাদি
প্রবন্ধ সংকলন
বাংলা উপন্যাসকোশ
উপন্যাসের মহাবিশ্ব
সম্পাদনা গ্রন্থ
বব ডিলান:কবিতায় ,গানে ,প্রতিবাদে

প্রভুর প্রভুত্বের এই নগ্নরূপ দেখতে দেখতে শরীর আত্মা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আত্মদহনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব। আজকের সমাজবাস্তবতার ভয়াবহ রূপ। অনেক ভালোবাসা ও অভিনন্দন।
উত্তরমুছুনপ্রভুর প্রভুত্বের এই নগ্নরূপ দেখতে দেখতে শরীর আত্মা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আত্মদহনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব। আজকের সমাজবাস্তবতার ভয়াবহ রূপ। অনেক ভালোবাসা ও অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন