বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

সম্পাদকীয়

 




 " বিস্ময়ই দর্শনের জনক " প্লেটো বলেছিলেন। আজ নয় । যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও চারশো  বছর আগে । তারপর পৃথিবী কত পথ পেরিয়ে এল। " হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে " । বিরামহীন । বিশ্রামহীন । কিন্তু , কথাটা  আজও সমান সত্যি । যে কোনো সৃষ্টির পিছনে কাজ করে এই বিস্ময়বোধ । বিস্ময়বোধ থেকে আসে আবেগ, অনুভূতি । আবেগ ধরতে চায় ব্যাখ্যাতীতকে শিল্পীর তুলিতে, কবির কলমে । কবিতা কী সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পরবর্তীকালে ওয়ার্ডসওয়ার্থও  বলবেন, "Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings : it takes its origin from emotion recollected in tranquility." কিন্তু সেই tranquility  বা মনের প্রশান্তির স্থিতাবস্থা আসবে কেমন করে, বিস্ময়বোধই যদি কাজ না করে ।

 এই যে চিরপরিচিত পৃথিবী, যেখানে আমি রয়েছি, হাসছি, খেলছি , মুহূর্তকাল পরেই হয়ত আর আমার এখানে থাকা চলবে না " কখন যে গাঙচিল ছিড়ে ফেলে শালিকের প্রাণ "। প্রশ্ন এই, তাহলে কোথায় ছিলাম আমি, এই জন্মের আগে ? থাকব কোথায় এই জন্মের পরে ? থাকব না যে , সে তো ধ্রুব সত্য । কিন্তু সত্য এ-ও, আমি না থাকি, আমার সৃষ্টিরা থাকবে এই ধুলায়, মৃত্তিকায়, " যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে " । এমন স্থির বিশ্বাসে, বিস্ময়বোধকে অন্য মাত্রায়  উস্কে দিয়ে সুধীন্দ্রনাথও  বলেন " রুপ যে অশেষ ! হেথাকার ফুল এমনি ফুটিয়া রবে  / আমাদের মত কত বিহঙ্গ কত বিচিত্র ক্ষণ পতঙ্গ / লভি তার সেই রূপের সঙ্গ / বসন্ত উৎসবে লইবে বিদায় / ধরণীর ফুল এমনি ফুটিয়া রবে । "

  সৃষ্টির এমনই অমলিন ফুল তুলতে চায় স্বরবর্ণ। চর্বিতচর্বণ নয় । এঁটোকাটা নয় । সৃষ্টির অবিনশ্বর ফুল তোলার সেই অভিপ্রায়ে তার যাত্রা । কয়েকটি নির্দিষ্ট পথে । গল্প-কবিতা- প্রবন্ধের চেনা পথ তো রয়েইছে । সেই সঙ্গে রয়েছে অন্তত দু'টি নতুন বিভাগ । চেনা ছকের বাইরে । একটি "কবিতা উপন্যাস " যেখানে কবিতা ও উপন্যাসের মূল স্বর মিলেমিশে পৌঁছতে চাইছে অন্য এক উচ্চতায় , ভিন্ন  মাত্রায়, ভিন্ন  আঙ্গিকে ।  আরেকটি বিভাগ " তোমায় খুঁজে ফিরি " যেখানে আমরা খুঁজবো জীবন-মৃত্যুর অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা । যদিও দুইয়েরই লক্ষ্য শিল্পের মধ্য দিয়ে স্বরবর্ণে পৌঁছনো।

এবার একটু চোখ ফেরাই চলমান সময় স্রোতে। সময়ের মতো উচিত শিক্ষক আর নেই, বলাইবাহুল্য । কখনো পার্থিব কোন ঘটনার অভিঘাতে, সে আমাদের দুটো চোখের বদলে হাজারটা চোখ খুলে দেয়। কখনো হাজারটা দূরে থাক, ঈশ্বরদত্ত দুটো  চোখকেই একেবারে দৃষ্টিহীন করে রাখে । যেমন রাখছে নির্বাচনের মুহূর্তে । দল বদল, ভোল বদলের সময় । অবশ্য শুধু নির্বাচনই  বা কেন, ব্যক্তিজীবনে কি সমাজজীবনে, অনেক সময়েই  আমরা দৃষ্টিহীন হয়ে যাই, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সাজি, চোখের সামনে ন্যায়-নীতি -মূল্যবোধ বিসর্জিত হতে দেখলেও। আবার হাজারটা চোখ খুলে দেয় কোন কোন ঘটনা । যেমন দিল বিভীষিকাময় মহামারী কোভিড নাইনটিন । এই অভূতপূর্ব প্যান্ডেমিক  ভিতরে-বাইরে সহস্র চোখ খুলে দিল আমাদের। কী দেখলাম আমরা ? দেখলাম মৃত্যু মিছিল সমস্ত পৃথিবী জুড়ে । দেখলাম  লকডাউন সোশ্যাল ডিসটেন্স মাস্ক স্যানিটাইজ অর্ধাহার অনাহার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু ইত্যাকার  অসহনীয় ঘটনাবলী । সাক্ষী হয়ে রইলাম এক ভয়াবহ দুঃসময়ের, যেরকম দুঃসময় এর আগে,  জ্ঞানত আমরা কোনদিন দেখিনি ।

 তবু আমরা বিশ্বাস রাখি, এই দুঃসময় কেটে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে । সেই আশা নিয়ে আমরা দাঁড়াব মানুষের পাশে। মিথ্যা বুলিতে নয় । শিল্প-সাহিত্যের অমোঘ শুশ্রূষা নিয়ে । কেননা আমরা বিশ্বাস করি " Pen is mighter than the sword  " যা আমরা দেখেছি ফরাসি বিপ্লবে, রুশ বিপ্লবে  কি আমাদের দেশে রামমোহন- বিদ্যাসাগর - মধুসূদনে । কবির সুরে সুর মিলিয়ে আমরা বলব, " এ কোন অন্ত্যেষ্টি যার লক্ষ বছর পরেও / আমাদের কোন ইতিহাস থাকবে না ! / আর বিবাহ একটা রাষ্ট্রের অরণ্যে স্বপ্ন দেখবে / নদী বেঁচে উঠছে ... তীরে তীরে ঢেউ লাগছে / শব্দ হচ্ছে...অবিরল শব্দে শব্দে লুন্ঠনের শস্য ভাসে... /  কতটা জরুরি তবে একটা হাত থেকে আর একটা হাতের দিকে যাওয়া " ( সব্যসাচী মজুমদার )। হীন রাজনীতি দলাদলির উর্দ্ধে, এই কঠিন সময়ে একটা হাত আর একটা হাতের দিকে এগিয়ে যাবে মমতায়, ভালোবাসায় এটাই কাম্য ।

 পরিশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব কবি-লেখকদের, যাঁরা তাঁদের মূল্যবান রচনা দিয়ে  সমৃদ্ধ করলেন বর্তমান সংখ্যাটিকে । আগামীতে যেমন তাঁদের প্রশ্রয় পাব, তেমনই , প্রিয় পাঠক, আমাদের পথ চলায় আপনাকেও সঙ্গে পাব, আশা ।

                                                                           দেবাশিস সাহা                                                                                       সম্পাদক ---স্বরবর্ণ                      

২টি মন্তব্য:

  1. সম্পাদকীয় পড়ে অভিভূত হলাম। সমসাময়িক সমস্যা, রাজনৈতিক তর্জা, মানুষের মনুষ্যত্ব বোধ বর্তমান সময়ে ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে এবং তা কোন জায়গায় থাকা উচিত তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন আপনি।
    আপনার এই জয়যাত্রা দীর্ঘায়িত হোক এই প্রত্যাশা আমার।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ উত্তমবাবু। ভালো থাকুন। অরন্ধন ব্যাপ্তি পাক।

    উত্তরমুছুন