বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

ড. শুভঙ্কর দে


 



      ইতিহাস তাঁর নিরলস চর্চার বিষয় , তাঁর চিন্তা - চেতনার ধ্যানবিন্দু | কিন্তু ইতিহাসের পাতাতেই নয় শুধু ,তাঁর  দৃষ্টি  ছুঁতে চায়  শিল্প - সাহিত্য - জ্ঞান -বিজ্ঞান - প্রযুক্তির নানা দিক | আর তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল সমৃদ্ধ করে আমাদের চলমান জীবনপ্রবাহ | এখানে ইতিহাসের আলোকে তেমনই একটি নিবন্ধ আমরা পাঠ করি |                                   



বিজ্ঞান , চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও পরিবেশের ইতিহাস: বিকল্প ভাবনা


ড. শুভঙ্কর দে

সহকারি অধ্যাপক  

ইতিহাস বিভাগ

সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, 

পুরুলিয়া



‘In the land of ox- cart.. one must not expect the pace of motor car’

                          -   Resolution, 23rd May 1914, Government of India  


‘The Asiaticks had claimed the heights (of/in) science before the Greeks had learned their alphabet’

                                               - David Kopf  



 সূচনায় উল্লেখিত আপাতবিরোধী দুটো বক্তব্যের মধ্যেই কিছু সত্য লুকিয়ে রয়েছে।প্রথমটি আবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ পুষ্ট ভাবধারার সার্থক প্রতিফলন।প্রথম বক্তব্যকে আর একটু গভীর ভাবে আনুধাবন করলে দেখা যাবে, ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসনের একটা দীর্ঘ সময় ধরে ওরিয়েন্টের প্রতি এরকম বক্তব্য ও প্রতর্ক বারবার বিভিন্ন অফিশিয়াল ডিসকোর্স, আধিকারিকদের লেখাপত্র, মেমোয়ার, চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদিতে উঠে আসতে দেখা যাবে বারে বারেই। অপরদিকে এর একটা বিপরীত ছবিও ছিল।১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উইলিয়াম জোন্স ,ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি সাহেবদের হাত ধরে শুরু হয়ে যায় ভারতবর্ষের গৌরবময় অতীত ইতিহাস চর্চা।প্রাচ্যবিদ বা ওরিয়াণ্টালিস্টদের এই আলোচনার মূল যে বক্তব্যটি উঠে আসছিল, ক্রমাগত তাঁর সারাংশ ছিল এই যে , প্রাচীন হিন্দু ভারতবর্ষের বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং মধ্যযুগের মুসলিম শাসনে তার পতন এবং সেইসাথে আধুনিক ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সেই লুপ্ত গৌরবকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করা।বলা বাহুল্য পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী ঘরানার আদর্শের সাথে এটি অনেক সময় হবহু মিলে যায়। বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চায় সমগ্র উপনিবেশিক কালপর্বে আমরা দেখবো জাতীয়তাবাদী ঘরানার সাথে শাসকের সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের টানটান  লড়াই। বিগত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ইতিহাসকে নতুনভাবে ভাবার চেষ্টা করেছেন সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন লেখকেরা। ইতিহাস চর্চার একটি স্বতন্ত্র এবং উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে পরিবেশের ইতিহাস ,সেই প্রেক্সিটে  সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান ক্ষেত্র। বর্তমানকালের  গবেষণায় উঠে আসছে উপনিবেশবাদ, শাসক শাসিতের প্রেক্ষাপটে,বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও ইতিহাসের আন্তঃসম্পর্কের কথা। সাম্প্রতিককালে  বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসকে আদতে সমাজ-সংস্কৃতি ও চিন্তাজগতের বৃহৎ ক্ষেত্র রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। 


সাদা চামড়ার মানুষদের দায়িত্ব:


ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় গোটা পর্ব ধরেই প্রাচ্য তথা  ভারতবর্ষ অনেকাংশে প্রতিভাত হয়েছে অন্ধকারময়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি নতুন কিছু গ্রহণে অনিচ্ছুক ও নিরুৎসাহি  কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদের নতুন সংজ্ঞা নির্মিত হতে থাকে। এই মতবাদের সর্মথকরা গলা ফুলিয়ে প্রচার করতে থাকে ভারতবর্ষের যাবতীয় উন্নতি এবং হিতসাধন একমাত্র ব্রিটিশদের দ্বারাই সম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদ তাদের কাছে ছিল শুধুমাত্র নিত্যনতুন অঞ্চল ও মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করাই নয়, একই সাথে সেখানকার মানুষ এবং ভূখণ্ডকে কান ধরে উন্নত এবং আধুনিকীকরণে সামিল করা । প্রাচ্যের উপনিবেশিক পরিমণ্ডলে এই জাতীয় ধ্যান-ধারণাকে বারবার শক্তিশালী ও পুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে খানিকটা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা দেখব সমগ্র উনবিংশ শতক জুড়ে ভারতবর্ষ তথা প্রাচ্যের বিভিন্ন মহামারি ও রোগব্যাধির মূল কারণ হিসেবে, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুকে দায়ী করা হতে থাকছিল। ১৮৩৭ সালে রোনাল্ড মাটিনের ‘নোটস অন মেডিকেল টোপোগ্রাফি’ প্রকাশিত হয়।  ইংরেজদের জাতি গর্বের পাশাপাশি ভারতীয় সমাজ ,স্বাস্থ্য, অশিক্ষা ও অভ্যাসের চূড়ান্ত সমালোচনা গ্রন্থের প্রত্যেকটা বাক্যে যেন ফুটে উঠেছিল ।   ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, ইউরোপে ‘এশীয় কলেরার’ আবির্ভাব ঘটে। ইউরোপীয় জনমানসে প্রাচ্য মাত্রই অস্বাস্থ্যকর ,অপরিষ্কার তথা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চাৎপর এই ধারণা ও বিশ্বাস গেথে যায়।এই ভাবেই রোগব্যাধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কু বাতাস তত্ত্বকে(MiasmaTheory) সামনে রেখে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় উপনিবেশে বিভিন্ন রোগের মূল কারণ হল আসলে নেটিভরা এবং তাদের অস্বাস্থ্যকর ও অনৈতিক কার্যাবলী । এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা কিংবা নেটিভদের আরো কিছু নেতিবাচক অভ্যাস সামাজিক ও আচার আচরণকে।স্বাভাবিকভাবেই আরেকবার সাদা চামড়ার মানুষের ঘাড়ে গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে স্বাস্থ্য সংস্কারের।গঠিত হয় স্বাস্থ্যবিধি।উপনিবেশিক রাষ্ট্রের দ্বারা ভৌগলিক ভূখণ্ডের আধিপত্যের ক্ষেত্রটা এবার সম্প্রসারিত ও প্রসারিত হয়ে একেবারে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে ।  কিন্তু মজাটা হলো অতি চালাকির সাথে এড়িয়ে যাওয়া হতে থাকে ব্রিটিশ শাসনের ফলে উদ্ভূত অপুষ্টি, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, বিকলাঙ্গ অর্থনীতি কিংবা দ্রুতহারে ঘটে যাওয়া অপ্রকল্পিত নগরায়নের মত প্রশ্নগুলিকে।


 প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্য:


 অধ্যাপক দীপক কুমার সম্প্রতি তার একটি প্রবন্ধে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে আধুনিকতা এবং আধিপত্যবাদের কথা বলেছেন । প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব এর অধিকাংশটাই ঔপনিবেশিক সময়ে সৃষ্ট ও পুষ্ট হয়েছিল। মেট্রোপলিটন এবং ‘পেরিফেরি’ সবসময়ই একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত, উপকৃত এবং নানান সময়ে সহযোগী হিসাবে কাজ করেছিল বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। ভারতীয়রা নতুন কিছু গ্রহণ এবং পরিবর্তনে আগ্রহী নয়, এই মতবাদ  যে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছিল তা হয়তো সর্বাংশে সত্য নয়। ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন পর্তুগীজদের আগমনের সাথে সাথে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যার সাথে ভারতীয় আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান আদান-প্রদান সংক্রান্ত অবিরাম বিনিময়ের কথা । জ্ঞানের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই পর্তুগীজদের আগমনের বহু পূর্বেই ভারতীয় চিকিৎসা ও তার  পদ্ধতি সংক্রান্ত বই আরব বণিকদের দ্বারা পশ্চিমে গিয়েছিল এবং  ত্রয়োদশ শতকে বেশ কিছু এরকম গ্রন্থের ল্যাটিন অনুবাদ হয়েছিল যা সেই সয়ে ইউরোপে অনুশীলন করার ডাক্তারদের পাঠ্যপুস্তক ছিল । পর্তুগীজদের লেখা বিভিন্ন মেডিকেল গ্রন্থ গুলিতে আমরা এই সময় ভারতীয় ডাক্তার ও তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখি। ইউনানী কিংবা কবিরাজি চিকিৎসা কখনোই একে অপরের বাধা হয়ে দাড়ায় নি, বরং আমরা এটা লক্ষ্য করব তারা একে অপরের অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে। বিখ্যাত পরিবেশের ইতিহাসবিদ রিচার্ড গ্রোভ দেখিয়েছেন, পরিবেশ সংরক্ষণের যে ভাবনা তা উপনিবেশ থেকেই প্রথম উদ্ভূত হয়। উপনিবেশে নিরলসভাবে কাজ করে চলা বিভিন্ন অরণ্যকর্মী ও গবেষক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, প্লান্টার প্রমুখদের সংরক্ষণ বিতর্কে মেট্রোপলিটনে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল । 


ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক সময় আমরা দেখতে পারব বিশেষত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি নিজেদের জ্ঞানচর্চা ও তার ব্যবহারকে যেমন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল, ঠিক একইভাবে নতুন পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে তারা সরাসরি ও সাদরে গ্রহণ করতে কখনো পিছপা হননি।হাকিমি মতে বেশকিছু ওষুধ এর ব্যবহার শুরু করেছিলো বৈদ্যরা। অপরদিকে বিপরীত পক্ষের গ্রহণের চিত্রও লক্ষ্য করা যায়।। প্রজিত বিহারি মুখার্জি সম্প্রতি তার একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, দেশীয় মতে চিকিৎসা করা ব্যক্তিগণের দ্বারা স্টেথোস্কোপ ব্যবহৃত হয়েছিল । উনবিংশ শতকে, গঙ্গাপ্রসাদ সেন প্রথম আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত পত্রিকা সঞ্জীবনী প্রকাশ করেন, এমনকি তিনি আয়ুর্বেদিক ঔষধ ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাতেন । পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার বিভিন্ন প্রয়োগকে প্রাচ্য সবসময় দূরে ঠেলে দেয়নি । ভারতবর্ষে কালাজ্বরের ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ নিয়ে গেছে, এর সার্থকতা উপলব্ধি করে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মতের আদান প্রদান বিভিন্ন সময়ে মেট্রোপলিটনকে সাহায্য ও সমৃদ্ধ করেছে । 


   কিন্তু এখানেই গুরুত্বপূর্ণভাবে আরেকটি কথা উঠে আসে, সেটি হলো গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যর প্রসঙ্গ ,যা কখনই পর্যাপ্ত ছিল না। মজার বিষয় হলো ম্যালেরিয়া রোগের সফল প্রতিষেধক আবিষ্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য রোনাল্ড রস লাভ করেছিলেন পাতিয়ালার মহারাজের কাছ থেকে। উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীকে দীর্ঘদিন কেরোসিনের আলোয় ও বিনা পরীক্ষাগারে গবেষণা করতে হয়েছে । পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কৃষ্ণস্বামি আইয়েরকে মাদ্রাজ মেডিকেল কাউন্সিল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এই মর্মে যে তিনি দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ-এর সাথে যুক্ত ছিলেন ।  দীপক কুমার , জাহির বাবর প্রমুখেরা যুক্তি দেখিয়েছেন, প্রযুক্তি বিজ্ঞান সহ মেডিকেল রিসার্চে উপনিবেশিক সরকার খুব কম দৃষ্টিপাত করেছিল তুলনায় ভৌগোলিক অনুসন্ধান, সেনাবাহিনীতে তাদের বিনিয়োগ ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো । 


 ভারতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি , পরিবেশ : ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার


 ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ও পরবর্তীকালে তাদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্বেই সমাজে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসার সুমহান ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও বহুকাল ধরেই এই তিনটি ক্ষেত্রকেই পশ্চিমের অগ্রাধিকার, প্রাধান্য ও পশ্চিমকেই প্রচারক রূপে দেখানো হয়েছিল। এইভাবে অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটা বড় অংশ জুড়ে উপনিবেশগুলোতে বিজ্ঞান এর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস  জুড়ে দেওয়ার অসৎ প্রবণতা আমরা লক্ষ করি  । ভারতবর্ষ সহ এশিয়া মহাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অপরিশোধিত ঋণ ইউরোপ ও সমগ্র বিশ্বে ছিল তা দেখিয়েছেন ইতিহাসবিদ  জোসেফ নিডহ্যাম(Joseph Needha) ও লিন হোয়াইট(Lynn White) । সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে লুই পাস্তুর(1822-1865)সফল টিকা আবিষ্কারের পশ্চাতে ‘Sillarai kovai’ নামক একটি অখ্যাত তামিল গ্রন্থের কথা । জাহির বাবর (Zaheer Baber) তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ দেখিয়েছেন, আনুমানিক 400 খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রচিত সূর্যসিদ্ধান্তে বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে গ্রহের গতি ও অবস্থান, সূর্য -চাঁদের উদয় ও অস্ত যাওয়া, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রের বর্ণনাসহ  সৃষ্টিতত্ত্বের বিভিন্ন দিক, এমনকি  সূর্য ও চাঁদের বেশ কিছু ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সুচিন্তিত বিশ্লেষণ । প্রাচীন ভারতবর্ষে পরিবেশের উপাদান হিসেবে নদী, জল ,গাছপালা ও পশুদের সাথে  মানুষ অস্তিত্বকে একাত্ম করা হয়েছিল। বৈদিক যুগের একটি শ্লোকে পশুকে পুত্র রূপ বর্ণনা করে, রুদ্র দেবতাকে তাদের  ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছিল ।  প্রাচীন ভারতে নাড়ী পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়ের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর ‘sangadharasamhita’ নামক গ্রন্থ থেকে। সুশ্রুত সংহিতায় অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ও তার সঠিক প্রয়োগের কথা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। মধ্যযুগের বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিপ্লব না ঘটলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয় পরিবর্তন আমরা লক্ষ করতে পারি। অষ্টম শতাব্দীর শেষে  ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের আরবীয় পার্সিতে অনুবাদকৃত গ্রন্থগুলি খলিফার দরবারে পৌঁছে যায়। দশম শতাব্দীতে আরব চিকিৎসক আলী ইব্ন শাহী অল তাবরী(Ali Ibn Sahl al Tabri) এর গ্রন্থ Firdaws al Hikma পার্সিতে অনূদিত ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের গ্রন্থ গুলির পরিচয় দিয়েছিল। ভারতবর্ষে পর্তুগীজদের অনুপ্রবেশের সূত্র ধরে বেশ কিছু নতুন ফসলের ভারতীয় শস্য সূচিতে সংযোজিত হতে শুরু করেছিল। ভারতবর্ষে 1613 সালে গুজরাটে প্রথম তামাকের চাষ শুরু হয়, পরবর্তীতে তা অন্যত্র ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে। এই শতাব্দীতেই অন্যতম খাদ্যশস্য ভুট্টা চাষ শুরু হয়। ইউরোপ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর পরবর্তী সময় থেকেই দূরবীক্ষণ যন্ত্র আসতে থাকে। দিল্লিতে রাজা জয়সিংহের মান মন্দিরে(1730) দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিকৃত কাটা নাকের মেরামত করা1686 সালে নিকোলাস মানুচির লেখা দক্ষিণ ভারত থেকে এক প্রতিবেদনে জানা যায়। পরিবহনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ভারতে ইউরোপীয় ঘোড়ায় টানা বগি গাড়ি তৈরীর প্রয়াস নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর, যদিও এটি ছিল সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। তিনি যে বগি গাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন তা ছিল সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আনা বগি গাড়ির অবিকল অনুকৃতি। তবে এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজন। প্রথমত মধ্যযুগে আমরা যেই সময়টার কথা বলছি সেখানে যুদ্ধ এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলি ছিল এই সময়ে প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়বস্তু। ফলস্বরূপ সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিজ্ঞান  প্রযুক্তির প্রশ্নে দেখতে পাবো পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংহ ভারী বন্দুক ও মোরটরের জন্য অমৃতসর, লাহোরে ঢালাই -এর কারখানা স্থাপন করেছিলেন। 1820, 1830 এর দশকে এখানে নিয়মিত গুলি তৈরি হতো। এই সময়কালে রচিত বিভিন্ন লেখকের এর চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তক যেমন গোবিন্দদাসের ভেষজ রত্নাবলী, মাধবের আয়ুর্বেদ প্রকাশ্য (1734), আকবর আরজানির  টিব – ই- আকবরী (1700) প্রভৃতি গ্রন্থগুলো জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রোগ তার বিস্তারিত, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের চিত্র, রসায়ন সম্পর্কিত পর্তুগীজ ও পারসিকদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য Nurul Haq এর  Ainul Hayat (1691) ছিল প্লেগ সম্পর্কিত অন্যতম পারসিক গ্রন্থ । অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুটি সংস্কৃত গ্রন্থ Hikmatprakasa এবং  Hikmatparadipa তে বহু আরবি ও  পারসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত শব্দ প্রয়োগের পাশাপাশি ইসলামীয় ও চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।


উপনিবেশিক শাসনপর্বে ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যর অধিগ্রহণকে বেশকিছু ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় বিপর্যয় রূপে চিহ্নিত করেছেন ।  আমারা অবশিষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারবো, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার ক্ষেত্রে তারা কি ধরনের কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 1898 সালে দেশীয় রাজ্যে মহীশূরে  ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছিল । রাজা জয়সিংহের উদ্যোগ ও  প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, 1722-1739 সময়ের মধ্যে জয়পুর দিল্লি ,মথুরা,বেনারসে  জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পর্যবেক্ষণাগার গড়ে উঠেছিল  (Astronomical observatories)। তাঞ্জোরের মারাঠা শাসক  Raja Serfoji II(1798-1832)  নিজ উদ্যোগে ও সেখানকার  ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এবং Father Schwartz এর সহায়তায়, ভারতবর্ষ ত বটেই  সেই সঙ্গে পশ্চিমের চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল বড় গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সংগ্রহে বেশকিছু অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি সহ, পশু পাখিদের রোগ ও তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত  তামিল এবং সংস্কৃত গ্রন্থের দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ছিল । 


                                          স্বাভাবিকভাবেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসকবর্গরা বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার প্রসার ও সেই সাথে তার অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করাকে civilizing mission রূপে  প্রতিভাত করতে চাইত।  বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা কে তারা শাসক ও শাসিতের পার্থক্য হিসেবে তুলে ধরত।একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।  আর্থিক দিক থেকে প্রচুর লাভজনক ক্যারোলিনা চালের উৎপাদন ব্রিটিশরা বাংলায় ও মাদ্রাজে শুরু করেছিল। দু’জায়গাতেই এটি চূড়ান্ত ভাবে অসফল হয় । এর কারণ হিসাবে উপনিবেশিক সরকার ভারতের চিরাচরিত সনাতন কৃষি ব্যবস্থা সহ নতুন ব্যবস্থা গ্রহণে অনিচ্ছুক গোটা কৃষক সম্প্রদায়কে দায়ী করেছিল । এই ধরনের উচ্চ মনোভাব আত্মবিশ্বাস আত্ম অহংকার আধুনিকীকরণের সীমা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় লর্ড কার্জনের সময়(1899-1905) । বেশ কয়েক দশক আগে প্রকাশিত George Basalla এর প্রবন্ধে আমরা পুনরায় উপনিবেশে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শাসকের অবদানের কথা পরোক্ষভাবে শুনতে পাবো । 


যদিও জ্ঞানপ্রকাশ এর মতো কিছু ইতিহাসবিদ এই তত্ত্ব  মানতে রাজি নন। তিনি দেখাচ্ছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে থেকেই পশ্চিমী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে ইংরেজি শিক্ষিতদের একটি শ্রেণি ক্রমাগত দেশীয় কুসংস্কার  ও ধর্মের ঊর্ধ্বে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘agent of modernity and progress’ ‘হিসেবে কার্যকারী ভূমিকা পালন করেছে। বোম্বের এলফিনস্টোন কলেজের প্রথম ভারতীয় অংকের শিক্ষক বালগঙ্গাধর জাভেদকার বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য 1831 সালে প্রকাশ করেন বোম্বে দর্পণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাংলায় নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা রাজা রামমোহন রায়, তৎকালীন এডিনবার্গের ডাক্তার জন প্যাটারসনকে করোটি সংক্রান্ত পরীক্ষার গবেষণার জন্য দশটি হিন্দু মাথার খুলি পাঠিয়েছিলেন ।  সম্প্রতি প্রতীক চক্রবর্তী তার একটি গবেষনালব্ধ প্রবন্ধ দেখিয়েছেন ১৯০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস এর ভারতীয়করণ শুরু হয়েছিল। একই সঙ্গে শাসক এবং শাসিতের আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণের প্রশ্নে একটি চাপা উত্তেজনাকর  পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ১৮৯০ সালে একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র Civil and Military Gazette লেখে : ‘One has to be very careful because the crooked native mind could transfer any knowledge as it had done with modern education rather than accepting as an idea of reason into and ideology of dissent ’।বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতির এক সার্থক বর্ণনা আমরা পাই এক পুরানো পন্থি ঘরানার সমর্থক অবিনাশ চন্দ্র কবিরত্ন নামক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত  এক সমসাময়িক পত্রিকার সম্পাদক। তিনি লিখছেন:


“ কেন যে ভারতবাসী নিশ্চয়ই ঘুমায় আছেন, তাহা সম্যক বুঝিবার পক্ষে কারণ বিস্তর থাকলেও আজ কিছু আমরা চিকিৎসা সম্মিলনীর পাঠককে বুঝাইতে চেষ্টা করিব। বহু শতাব্দী পূর্বে এই ভারতবর্ষে যে সকল পুণ্যকর্ম ঋষি জন্ম গ্রহণ করিয়া ঔষধ প্রচারে যেরূপ অসাধারণ নৈপুণ্য ও কল্পনাতীত জ্ঞান-গরিমার আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, সত্য বলিতে কি, তেমন গভীর অলৌকিক জ্ঞান এজগতে অদ্যাবধি আর কোথাও প্রকাশ হয় নাই। সুতরাং ভারতবাসী যখন সেই আর্য ঋষি কৃত নির্মল সংশয় রোহিত রাশি.. কেউ পদাঘাত কোরিয়া , আজ বিদেশি ও অসম্পূর্ণ জ্ঞানের সেবা করিতেছে, সে জাতিকে নির্ধারিত না বলিয়া আর কি বলিব?......... প্রাচ্য শিক্ষায় বিভূষিত মহাত্মা গণশিক্ষা গৃহগুলি মহাত্মাগণ প্রতীচ্য শিক্ষার গৃহগুলি আরো উন্নত করিবেন, কিন্তু তা না করিয়া যখন তাহারাই প্রতীচ্য শিক্ষায় বধির হইয়া আছেন, তখন ভারত নির্ধারিত না বলিয়া ক্ষান্ত তো হইতে পারি না” 


 অবিনাশ চন্দ্রের চিন্তা (পড়ুন দুশ্চিন্তা) অমূলক ছিল না। দীপেশ চক্রবর্তী যুক্তি দেখিয়েছেন ভারতের জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সনাতন ভারতীয় চিন্তাভাবনার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতার একটা সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন । স্বাভাবিকভাবেই  ইংরেজ আনীত ‘আধুনিকতা’ ‘দেশীয় উন্নতি’ “প্রগতি”র প্রতি  একদিকে যেমন শিক্ষিত শ্রেণীর   মানুষেরা আকৃষ্ট হতেন , তেমনি অন্যদিকে ভয় ছিল যে, এই সকল আইডিয়ার বল্গাহীন চর্চায় ভারতীয়ত্বই না  লোপ পায় l। তিলকও মারাঠা পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার করতেন পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা ও আয়ুর্বেদের চিন্তাধারার সুচিন্তিত সংমিশ্রণ অত্যন্ত জরুরী এবং আবশ্যক। The Hindu Chemistry র লেখক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সব সময় চেষ্টা ছিল আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশকে বিজ্ঞান গবেষণায় স্বনির্ভর হিসাবে গড়ে তোলা। তিনি  তাঁর প্রবন্ধ ‘জাতীয় সম্পদের মূলে বিজ্ঞানের শক্তি” তে লিখছেনঃ 


“উচ্চশিক্ষার নামে কতকগুলি বড় বড় বই মুখস্থ করিয়া বিদেশের ছেলেরা বেকার অবস্থায় ঘরে বসিয়া বৃথা সময় নষ্ট করিতেছে। পূর্বপুরুষদের অধুনা বিলুপ্ত বাহাদুরির বড়াই করিয়া, বেদ বেদান্ত উপনিষদ এর দোহাই পাড়িয়া জাতির দুঃখ ঘুচিবে না, দারিদ্র দূর হইবে না হিন্দু হোক আর মুসলমানই হোক, বিজ্ঞানের সাধনায় যতদিন না তাহারা নিজেদের মিলিত শক্তি নিয়োগ করিতে শিখিবে যতদিন দেশের ও জাতির উন্নতির কোন আশা নাই ”


বিগত কয়েক দশক ধরে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বিষয় হিসাবে বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস নতুনভাবে আলোচিত হয়ে আসছে ।  পরিবেশের ইতিহাস এই ধারার নবতম  সংযোজন । Carlo Ginzburg এর হাত ধরে সত্তরের দশকের কাছাকাছি মাইক্রো হিস্ট্রি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে । আঞ্চলিক ইতিহাস, ছোট ছোট ঘটনা, ঐতিহাসিক সমাজতত্ত্বের বিষয়গুলির উপর গবেষণার নতুন ভাবে সূত্রপাত ঘটতে থাকে। সাবল্টার্নদের লেখা পত্রে আমরা দেখব ধীরে ধীরে জায়গা করে নেবে ইতিহাসের ‘স্মল ভয়েস’। বিজ্ঞান প্রযুক্তির ইতিহাসে এই মডেলকে আমরা বেশকিছু ইতিহাসবিদদের দ্বারা ফলো করতে দেখব। প্রজিত বিহারী মুখার্জির গবেষণায় উঠে আসবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নাম-না-জানা বেশকিছু ডাক্তার ও তাদের বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা |



৩টি মন্তব্য: