একটু আগে আমি মারা গেছি । ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, ঘন্টা চারেক বাদে ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন। কিন্তু আমার দেহ থেকে আত্মা যে নির্গত হয়ে গেছে, তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমার আর কোন শরীর খারাপ নেই। সুগার নেই, প্রেসার নেই, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা নেই। আগে ব্যাচের পর ব্যাচ ছাত্র পড়াতে পড়াতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যেত, যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়ত, কিন্তু এখন আমার আর কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই । এখন আমি সব ব্যথা, সব জ্বালা যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে । এখন আমি আত্মা । আমাকে কোনো রোগ শোক হতাশা গ্লানি কারো ক্ষমতা নেই, স্পর্শ করতে পারে। এই জন্যই বুঝি আমার দাদু আমার নাম রেখেছিলেন অশোক, অর্থাৎ যে কি না সব শোকের ঊর্ধ্বে। কী দূরদৃষ্টি ছিল দাদুর ! ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি, দাদু খুব তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয়, দাদু নাকি বলতেন, আমার অশোকদাদা হবে হোমা পাখির মতো। শালিক চড়ুই টুনটুনি শ্যামা দোয়েল কোয়েল বসন্তবৌরি মাছরাঙা বাবুই --- কত রকমের পাখির নাম শুনেছি । কিন্তু হোমা পাখি কী, কেমন দেখতে, কোনওদিন শুনিনি। অনেক পরে হোমা পাখির নাম জানতে পেরেছি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত পড়তে গিয়ে। মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গিয়ে হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামে একবার হোমা পাখির একটা জীবাশ্ম দেখেছিলাম।
হোমা পাখির গল্প বলে শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্রনাথ, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ বলে ভুবনবিখ্যাত হয়েছেন, সেইরকম বিশেষ কিছু ভক্তদের স্বভাব বোঝাতে চাইতেন, অঢেল প্রাচুর্য থাকতেও ,যাঁরা সংসারের প্রতি নিরাসক্ত, যাঁরা ঈশ্বরকোটির মানুষ। সংসারের পাঁক যাদের স্পর্শ করতে পারে না। সংসারের সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে যাঁদের মন সবসময় হোমা পাখির মতো ঊর্ধ্বগামী হয়।
বেদেও হোমা পাখির উল্লেখ আছে। পুরান অনুসারে হোমা এক বিচিত্র পাখি। আকাশ ছেড়ে এই পাখি কখনও নিচে নামে না। আকাশ-মহাকাশ চিরে কেবলই ওড়ে, উড়তে থাকে। উঁচু থেকে আরো উঁচুর দিকে। উড়তে উড়তেই এদের ঘর-সংসার। উড়তে উড়তেই এদের জন্ম - মৃত্যু। হোমাপাখি যখন ডিম পাড়ে, অনেক উঁচু থেকে সেই ডিম পড়তে থাকে। একদিন দু'দিন না, দিনের পর দিন । এইভাবে পড়তে পড়তেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং সদ্যোজাত হোমা যখন পড়তে পড়তে একেবারে পৃথিবীর কাছে চলে আসে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে শিশু হোমা ফের আকাশের দিকে উড়তে শুরু করে, মা পাখির উদ্দেশে ।
দাদুর ইচ্ছের কথাটা বাবা আমাকে বলেছিলেন সেই কোন ছোটবেলায়, কিন্তু সেই থেকে আমার বুকের মধ্যে কোথায় যেন হোমা পাখি উড়ে বেড়ায়। আমি তাকে যতই ধরতে যাই, সে ততই উপরে উঠে যায়। এই যে এখন আমি মরে গেছি, তবুও মনে হচ্ছে আমার আত্মার কাছাকাছি কোথায় যেন পাখিটা উড়ছে। তার ডানার ঝাপট আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কোন সুদূর মহাকাশে তার জীবন। অথচ সারাক্ষণ তার ছায়া পড়ে আমার রক্তে,শিরা উপশিরায় ধমনীতে চোখের তারায় । পরিষ্কার দেখতে পাই না কোথায় আমার ভাতের থালা, জলের গ্লাস, জামা- গেঞ্জি , সানগ্লাস ,মানিব্যাগ । মাঝে মাঝে অলি -উপমার মুখটাও ঝাপসা মনে হয়। মনে হয় ওরাও যেন হোমা পাখি হয়ে দূর আরও দূর আকাশে উড়ে যাচ্ছে । আমি যতই ওদের ধরতে যাচ্ছি, ওরা ততই উপরে উঠে যাচ্ছে। আর আমি ধপাস করে পড়ছি এই পৃথিবীর শক্ত মাটির বুকে।
কিন্তু আমি হোমা পাখি হব কী করে , আমার যে আসক্তি ষোল আনা। রসগোল্লা দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে, পকেটের পয়সা নেই, কিন্তু হালফ্যাশনের জামাপ্যান্ট চোখে পড়লেই কিনতে ইচ্ছে হয়। সুন্দরী মেয়ে দেখলে চোখ শাসন মানে না,জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় | ব্যাংক লোন করে যা হোক তা হোক করে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি বটে, কিন্তু এখনো সাজানো-গোছানো বাকি। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল ---এসব ফার্নিচার কিছুই কেনা হয়নি। বইগুলো ডাই করে রাখা রয়েছে একটা ঘরে। ড্রয়িং রুমটাতে ওয়াল আলমারি বানাতে হবে। নাহলে দামি দামি বইগুলো পোকায় কাটবে । বন্ধুদের বাড়িতে গেলে কত সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের ওয়াল আলমারি,বইয়ের তাক দেখতে পাই। আর তাতে উঁকি দেন রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দ দাশ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-এর মতো কত যে বিচিত্র লেখক আর বিচিত্র সৃষ্টির সম্ভার।
আর সেখানে কিনা আমার বইগুলোর কিছু গড়াগড়ি খায় নড়বড়ে পায়া টেবিলটার উপর, নয়তো কিছু খাটের তলায় ইটের ওপর খবরের কাগজ পেতে তার ওপর স্তুপ করে রাখা ,আবার কিছু আদ্যিকালের কাঁচভাঙা শোকেসটার ভেতর। বন্ধুদের মতো অত বিচিত্র বইয়ের সম্ভারও অবশ্য আমার নেই। বিয়ের আগে টিউশনির পয়সা বাঁচিয়ে কেনা কিছু বই আর বিয়ের পরে মাঝেমধ্যে দুই-একটা করে করে কেনা পছন্দের কিছু বই। কত বই এখনো কেনা বাকি। উপমা একটা চাকরি-বাকরি পেলে, সংসারের বোঝাটা একটু হালকা হলে, তখন মনের মতো সব বই কিনব। লিস্ট তো কবে থেকেই তৈরি করে রেখেছি। কত বই এখনো পড়া বাকি। বন্ধুদের কাছে চেয়ে বই পড়তে মন চায় না। কারো কাছ থেকে বই চাওয়ার কথা মনে হলেই,একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়।
একবার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর আলমারিতে দস্তয়েভস্কির ' ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট' বইটা দেখে পড়ার খুব লোভ হয়েছিল, আবদারের সুরে বলেছিলাম, ক'দিনের জন্য বইটা দে না। মুখের উপর সে বলে দিয়েছিল, অশোক কিছু মনে করিস না ভাই, জানিস তো কেউ বই চাইলে আমার উত্তম কুমারের সিনেমার একটা ডায়ালগ মনে পড়ে যায় " বই আর বউ ঘরের বার হলে আর ফেরত আসে না। " মুখের উপরে কথাটা বলে দিয়ে খুব হেসেছিলো বন্ধুটা। কথাটা শুনে লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম । তার মানে পরোক্ষে ও আমাকে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বনের ইঙ্গিত করল। করুক। এমন সব অপমান কত সহ্য করতে হয়েছে এই পঞ্চাশ বছরে। এবার তো একটা ফ্ল্যাট হল নিজের। ড্রয়িং রুমটার তিন দিকের দেয়াল জুড়ে সুন্দর করে বই রাখার আলমারি বানাব।
তাছাড়া দেখতে দেখতে উপমাও তো বড় হয়ে গেল। একমাত্র মেয়েটার বিয়ে থা-র কথাও তো ভাবতে হবে | অলি মাঝে মাঝেই বলে,এখন থেকেই অল্প অল্প করে গয়না গাটি বানাতে শুরু করো, সোনার যা দাম ,একবারে পারবে হাতে কানে গলার গয়না বানাতে | ওর ঠাম্মার যা গয়না -গাটি ছিল ,তার কিছুই তো তুমি পাওনি | অলি ঠিকই বলে ,মা-র সোনা -গয়না যা যতটুকু ছিল, সব দাদা -বৌদিরাই ভাগাভাগি করে নিয়েছিল | ওসব যে কোনোদিন আমার কোনো কাজে লাগতে পারে ,মাথাতেই আসেনি তখন | আসার কথাও নয়,তখন আমি খুবই ছোট, বৈষয়িক জ্ঞান সেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি | আমি অবশ্য অলিকে বোঝাই ,মেয়েকে বিয়ে দেব একথা ভেব না ,মেয়ে বিয়ে করবে ওর মনের মতো যোগ্য ছেলেকে ,সেটাই ভাবো,তাছাড়া আগে নিজের পায়ে তো দাঁড়াক | বিয়ে -টিয়ে এখুনি কী ,কুসুমিতার মতো একটা কিছু হোক | সংসারের এত সব চিন্তা ভাবনা , মুক্তি মোক্ষ চাওয়ার আমার কি সময় আছে ? তবুও কেন যে হোমা পাখি আমার সর্বাঙ্গে ছায়া ফেলে আমার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয় !
তবে,এবার মনে হয় ,পাখিটাকে ধরতে পারব, আমার তো আর শরীর নেই বন্ধন নেই | এবার আমি আকাশ - মহাকাশ চিরে খালি উড়ব, জীবন-মৃত্যু তোলপাড় করে জানব আমার অস্তিত্ব, কে আমি।কী জন্য এই পৃথিবীতে আসা আমার ? শুধুই কী জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়না ? ' প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দি করি / রচেছো আমায় নির্মম নির্মাতা মম ' বুদ্ধদেব বসুর মতো মেনে নেব ? নাকি হোমা পাখির মতো আকাশ-মহাকাশ তোলপাড় করে খুঁজবো আমার অস্তিত্ব ,কে আমি ? কে ??
কিন্তু সে সব খোঁজাখুঁজি পরে হবে,এক্ষুনি হয়তো ডাক্তার এসে খসখস করে আমার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবে। যাক,তার আগে যে কথাটা বলছিলাম বলে নিই, আমার দাদু খুব তত্ত্ব জ্ঞানী ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত তো বটেই, বেদ-পুরাণ -উপনিষদ গীতা ভগবত সব খুব সহজে ব্যাখ্যা করতে পারতেন । আমার মায়ের উপর এই গুনটা অনেকটাই বর্তেছিল। দেহ -মন -আত্মা ছোটবেলায় এইসব ধারণা মা-ই আমাকে দিয়েছিলেন। পরে বড় হয়ে গল্প কবিতা উপন্যাসের পাশাপাশি বেদ উপনিষদ ভগবত গীতা-ও কিছু কিছু পড়েছি। গীতার শ্লোকের মর্মার্থ এখন আমি নিজের জীবন দিয়ে বেশ মিলিয়ে নিতে পারছি।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়: ।
অজো নিত্য : শাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।
আত্মার কখনো জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না অথবা পুনঃ পুনঃ তার উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না । তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চির নবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনো বিনষ্ট হয় না।
সত্যিই তো, ওই যে হাসপাতালের টেবিলে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, ওটা তো জাস্ট আমার দেহ, ছেঁড়া পোশাক,যা কিনা সাদা কাপড়ে ঢাকা। নাকে তুলো, মুখ বন্ধ, বাঁদিকের গাল বেয়ে একটু গ্যাঁজলা বেরিয়েছে। দুপুরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যে-ডেড বডিটা দেখেছিলাম, সেটার থেকে সামান্য আলাদা। সেটার মুখটা ছিল বেশ খানিকটা হাঁ -করা, আর আমার বডিটার মুখ বন্ধ , কিন্তু চোখের মনি দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে ।
একটু আগে অবশ্য একজন নার্স এসে চোখের পাতাদুটো ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে গেল, তা-ও মনে হচ্ছে, আমি প্রাণপণ তাকাতে চাইছি। আমার আত্মা কি তবে চোখ দিয়ে নর্গত হল ? আমি কি আবার মনুষ্য জন্ম পাব, না মনুষ্যেতর ? এই মুহূর্তে ওসব নিয়ে অবশ্য আমার মাথাব্যথা নেই। খালি মনে হচ্ছে কত কী দেখার বাকি ছিল এখনো ! সবে তো আমি পঞ্চাশ পেরিয়েছি । কতজনে দিব্যি আশি পঁচাশি পার করে দিচ্ছে। আমার কি এটা মরার বয়স হল ! বিয়ের পর গত পঁচিশ বৎসর কোচিং ছেড়ে একটা পা-ও কোথাও সেরকম বেরোতে পারিনি। লন্ডন প্যারিস দূরে থাক, কুলু-মানালি, দার্জিলিং-সিমলা, রাজস্থান, কন্যাকুমারী কোথাও যাওয়া হয়নি। বিভূতিভূষণ বলেছেন না ---অচেনার আনন্দকে পাইতে হইলে পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে তাহার মানে নাই ! আমি যেখানে আর কখনো যাই নাই, আজ নতুন পা দিলাম, যে নদীর জলের নতুন স্নান করলাম, যে গ্রামের হাওয়ায় শরীর জুড়াইল, আমার আগে সেখানে কেহ আসিয়াছিল কিনা, তাহাতে আমার কী আসে যায় ? আমার অনুভূতিতে তাহা যে অনাবিষ্কৃত দেশ। আজ সর্বপ্রথম মন বুদ্ধি হৃদয় দিয়া নবীনতাকে আস্বাদ করিলাম যে ! সেই হিসাবে আমিও একজন দেশ আবিষ্কারক ।
কিন্তু তাই-বা হল কোথায়, বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া কি নিদেনপক্ষে সুন্দরবন সাগরদ্বীপ ফ্রেজারগঞ্জ ধারে কাছে কোথাও অচেনার আনন্দ বুক ভরে টেনে নেওয়ার মতো অবসর-ও পাইনি জীবনে। তবে,হ্যাঁ, কোচিং থেকে ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে ওয়ানডে ট্যুরের প্রায় সবকটা স্পট ঘুরেছি। পুজালী সবুজদ্বীপ পিয়ালী নেচার পার্ক আটান্নগেট বুরুল হাট রায়চক বনগাঁ ফরেস্ট ইত্যাদি অনেক জায়গাতেই গেছি। কিন্তু সে তো ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দ দিতে, তাদের মন রক্ষা করতে। শীতের সময় বছরে একবার করে যেতেই হয়। পুরো কোচিং বায়না ধরে | সেটা কি একটা ঘোরা। হাজার রকম দায়িত্ব সামলাও। লাক্সারি বাস ভাড়া করা থেকে শুরু করে ক্যাটারিং এর লোকজন ঠিক করা, ছাত্র-ছাত্রীদের সামলানো,কে কোথায় চোখের আড়াল হল, হাজার রকম ঝক্কি । সবসময়ই একটা টেনশন কাজ করে। ষাট-সত্তর জনের টিম, কোথাও কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটলে, তার দায় এসে পড়বে ঘাড়ে। এত টেনশন মাথায় নিয়ে কি ' অচেনার আনন্দ ' খোঁজা যায়! দূরে কোথাও নির্জনে ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই ভয় হত, পাঁচ সাত দিনের জন্য যদি বেরোই, কটা ছাত্র যদি কোচিং ছেড়ে দেয়, তাহলে খাব কী ,মেয়ের স্কুলের মাইনেই বা দেব কী করে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। মাসে মোটা মাইনে। একবার যদি দিতে ফেল করো, পরের মাসে ফাইন দিয়ে ডবল মাইনে গুনতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা বছরে দু'বার মোটা অংকের ডোনেশন গুনতে হয়। একবার নতুন ক্লাসে ওঠার সময় আর একবার পুজোর আগে। |
এমনিতে ছাত্র-ছাত্রীরা যত কামাই করুক তাতে দোষ নেই। আজ মাসি বাড়ি, কাল পিসি বাড়ি তো পরশু অন্নপ্রাশন কি জন্মদিন লেগেই আছে। সে বেলায় দোষ নেই। কিন্তু স্যার যদি দু'দিন ছুটি দিয়ে কোথাও যায়, তো গার্জিয়ানদের মুখ ভার। " এ সময়ে ছুটি দিলেন স্যার ! সামনেই ইউনিট টেস্ট, জানেনই তো আপনার কাছে ছাড়া বাড়িতে বিন্দুমাত্র বই নিয়ে বসে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে গেম খেলা নয়তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা।” ইচ্ছে করে মুখের উপর বলে দি --- এত ছোট বয়সে মোবাইল কিনে দেন কেন ? কিন্তু পারিনা, প্রভু বলে কথা, যদি প্রেস্টিজে লাগে, গেল দুটো টিউশনি। শুধু কি দুটো ? একজন গেলে সঙ্গে চার পাঁচজন নিয়ে যায়। আর চার পাঁচজন কোচিং ছেড়ে চলে যাওয়া মানে দু' আড়াই হাজার টাকা ইনকাম কমে যাওয়া। থাক বাবা, বেড়াতে গিয়ে কাজ নেই। এই ভয়ে কোচিং ছেড়ে কোথাও যেতে পারি না | কত নেমন্তন্ন ক্যানসেল করি | আত্মীয় স্বজনদের বাড়িও যাওয়া হয়না কতকাল | কোচিং-এর জানলা দিয়ে যতটা আকাশ বাতাস বৃষ্টি ,যতটা অচেনার আনন্দ নেওয়া যায়, তাই নিই প্রাণ ভরে । আর মনে মনে রবীন্দ্রনাথে সান্ত্বনা খুঁজি ----
বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
মনে পড়ছে, দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বলতে একবার পুরি দু'বার দিঘা একবার বেনারস ও মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেছি, তাও অলির সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে । তা যাক, সব যাওয়া-যাইর আজ শেষ। ওই তো পড়ে আছে আমার দেহ নিঃসাড়, নিষ্পন্দ । এখন আমি যাকিছু দেখছি আত্মার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার দেহটার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, এই দেহের ভেতর আমি পঞ্চাশ বছর বাস করে এলাম ! একটু বাদেই শ্মশানে নিয়ে এই দেহটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে আসবে আমারই বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় পরিজন । এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি " খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। " দেহরূপ খাঁচার ভেতর দিয়ে অচিন পাখি অর্থাৎ আত্মা বার বার আসে যায়। দেহ পুড়ে ছাই হয়, কিন্তু আত্মা আবার নতুন দেহ ধারণ করে । মনে পড়ছে স্নানের পর ঠাকুরঘরে বসে মা গীতা পাঠ করত ----
বাসাংসি জির্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি
সংযাতি নবানি দেহী ।।
অর্থাৎ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে । তা করুক, আমার কিন্তু এই দেহটা কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করছে না । পঞ্চাশ বছরের কত ঘটনা এই দেহকে ঘিরে ---- সব, সব এক এক করে আয়নার মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অলির সঙ্গে আমার প্রেমের দিনগুলো। বেলুড় দক্ষিণেশ্বর বিড়লা তারামণ্ডল মিউজিয়াম ভিক্টোরিয়া চষে ফেলা। একাডেমিতে নাটক দেখা ,প্রিয়া বা আইনক্স-এ সিনেমা দেখা এসি হলে, হাতে হাত ঠোঁটে ঠোঁট, উষ্ণ আলিঙ্গন। তারপর একদিন যদিদং হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব.. উপমার জন্ম..ওর বড় হওয়া..স্কুল- কলেজ যাওয়া..একমাত্র বোনটার চোখের সামনে অকালে বিধবা হওয়া, কোলে দু'বছরের নীলু..মায়ের মৃত্যু.. আরও আরও কত কত ঘটনা...
সত্যি, আমার মুক্তি চাই না, মোক্ষ চাই না, এ দেহ ছেড়ে আমি কোথায়ও যাব না । " বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় | " অলি এখনও খবরটা পেল না । পেলে যে কী করবে ! ওর কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে । এবার কী করে সংসার চালাবে অলি ! ঘরের কাজ ছাড়া ও তো আর কোন কাজও জানে না । ঘরের কাজ আর মেয়ের স্কুল কোচিং করে করেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর । জমানোও তো বিশেষ কিছু নেই । লাখ তিনেক টাকার এন এস সি, কে ভি পি আছে, সেগুলো ম্যাচিওর হতে এখনো বছর দুয়েক । একটা এল আই সি অবশ্য আছে, সেটা তো অলির নামে । আমার নামে যেটা ছিল, সেটা গত বছরই ম্যাচিওর করে গেছে । ডেথ বেনিফিট এখন তো আর পাবে না। ইস ! মৃত্যুটা যদি এক বছর আগে হত । উপমা কি কলেজ থেকে ফিরল ? বড়দি বলছিল না, কার সঙ্গে বাইকে করে আসছে। ছেলেটাকে বড়দি যখন চিনতে পারেনি, তাহলে বয় ফ্রেন্ড টয় ফ্রেন্ড জুটিয়েছে নাকি। অলিও তো সেরকম কিছু বলেনি। ও-ও কি কিছু আঁচ করতে পারেনি ? সামনে বিয়ে ফাইনাল, এখন যদি এইসব করে বেড়ায়, রেজাল্ট ভালো হবে কি করে ? আর রেজাল্ট ভালো না হলে রেগুলারে এম এ-তে চান্স পাবে না । এমফিল-পিএইচডি তো পরের কথা ! এমনিতেই তো সংসারে ভাড়ে মা ভবানী, একটা চাকরি বাকরি যোগাড় করতে না পারলে চলবে কী করে ?
এক্ষুনি আমাকে এই দেহ ছেড়ে গেলে চলবে না। কতকগুলো কথা ওলিকে বলা হয়নি। বলতেই হবে | আলমারির লকারে একেবারে ভেতরের দিকে দশটা পাঁচশো টাকার নোট রাখা আছে। সেদিনই শিবমের বাবা দিয়ে গেছে,এক হাজার টাকা করে ছেলের পাঁচ মাসের মাইনে, একেবারে। অলিকে বলিনি কথাটা । টাকাটা রেখে দিয়েছিলাম এমার্জেন্সি পারপাস, কখন কী দরকারে লাগে। আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেও তো ইনস্ট্যান্ট কিছু টাকা লাগবে। ওই টাকা থেকে ম্যানেজ হয়ে যাবে। শ্রাদ্ধ শান্তি লোক খাওয়ানোর ব্যাপার ট্যাপার তো পরে। কিছুদিন সময় পেয়ে যাবে। ব্যাংকেও হাজার দশেক টাকা আছে। ওটা তুলে নিতে পারবে। অসুবিধে হবে না, কারণ আমাদের জয়েন্ট একাউন্ট। কিন্তু আর একটা কথা, যেটা অলিকে বলতেই হবে, লকারে যেখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে ,তার ঠিক নীচে একটা ফাইলের মধ্যে দুটো মহামূল্যবান জিনিস রাখা আছে। জরুরি কাগজপত্র কোথায় কী থাকে, এসব নিয়ে ও কোনোদিন মাথা ঘামায় নি | টাকা পয়সার ব্যাপারেও ভীষণ নিস্পৃহ | রান্না বান্না , ঘর সংসার আর মেয়ের পড়াশুনো এই ওর জগৎ | এর বাইরে কোনোদিন বেরোতে চায়নি ও | এবার যে কী করবে !
কিন্তু আমাকে তো বলে যেতে হবে ,সেই দুটো জিনিসের একটা হল -- আমাদের পৈত্রিক ভিটে , যে তিন কাঠা জমির উপর, তার অরিজিনাল দলিল আছে ওই ফাইলটার মধ্যে । না, দলিলটা আমার কাছে রেখেছি পৈতৃক সম্পত্তিতে কারো প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নয়। আসলে ওই দলিলের ইতিহাস আমাকে ভীষণ টানে। ১৯৫৭ সালে ৫০০ টাকার বিনিময়ে বাবা এই জমিটা কিনেছিল। ১৯৫৭ সাল ! মানে স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর পর | তখন আমি কোথায় ? জন্মই হয়নি আমার | কী রোমাঞ্চ লাগে এইসব ভাবতে | দলিলটাতে বাবার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। নির্জন অবসরে কখনো-সখনো দলিলটা বুকের উপর রেখে আমি বাবার হাতের সেই স্পর্শ অনুভব করি। মনে হয় বাবার রক্ত ঘাম অশ্রু আমার বুকে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে | মাঝে একবার জমিটা প্রমোটিং-এ দেওয়ার কথা চলছিল, কিন্তু উপমার ফাইনাল পরীক্ষা আর আমার কোচিং ওই জমিতে আছে বলে আমি রাজি হইনি। অলি-উপমা কি পারবে আমার অবর্তমানে প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিতে? মেজদা-বৌদি যা সিয়ানা ! তারপর প্রোমোটারই বা কোন চাল চালবে ঠিক আছে , দলিলের কথাটা অলিকে জানিয়ে যেতেই হবে। ভবিষ্যতে দলিলটা অনেক কাজে লাগবে।
আর একটা জিনিস রয়েছে ওই দলিলেরই ঠিক নিচে। ফ্ল্যাট কেনার সময় ব্যাংকের সঙ্গে আমার যে এগ্রিমেন্ট হয়েছিল, তাতে একটা ইনসুরেন্স করা হয়েছিল, যার জন্য ব্যাংক আটষট্টি হাজার টাকা এককালীন নিয়েছিল। শর্ত লোন চলাকালীন যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার উত্তরাধিকারী যারা, তাদের কাউকেই লোনের বোঝা বইতে হবে না। ভালোই হলো ওই কাগজটা হাতে পেলে , অলি অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা রিলিফ পাবে। ও শুধু উপমার পড়াশোনার দিকটাতেই নজর দিতে পারবে।
ওই ডাক্তার আসছে, এবার মনে হচ্ছে ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখবে। সিস্টারকে বলছে" বিয়াল্লিশ নম্বর ওয়ার্ডের পনেরো নম্বর বেডের ডেড বডিটার ওনারকে জানিয়েছেন?"
" হ্যাঁ, স্যার।"
"এক্ষুনি ডেকে পাঠান। বডি হ্যান্ড ওভার করে দিন |"
"হ্যাঁ স্যার,আসছে বলল।"
" ওকে " ডাক্তার কেস হিস্ট্রি দেখে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে শুরু করল।
উপমা, অলি তোমরা এখনো এসে পৌঁছলে না? ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে শুরু করেছে। আমার নামের বানানটা মিলিয়ে নিলে না, আধার কার্ডে যেমন আছে "Ashoke Bose." একটা s বা e তাড়াহুড়োয় ডাক্তার লিখতে ভুল করলে, তোমাদের পস্তাতে হবে। ব্যাংকে বা পোস্ট অফিসে আমার সামান্য যেটুকু টাকা আছে, পেতে কালঘাম ছুটে যাবে। অলি, তুমি তো একা মেয়েকে নিয়ে কোর্ট-কাছারি করতে পারবে না | আমাকে ছাড়া কোথাও তো এক পা নড়োনি কখনো | "
চারপাশটা অন্ধকার করে আসছে মনে হয় | পুবদিকের আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে | ঝড়-বৃষ্টি নামবে হয়তো | বৈশাখ মাস | কালবৈশাখী উঠল বলে ! বলতে বলতে ধুলো উড়িয়ে এলোপাথাড়ি হাওয়ার ঘূর্ণি,সঙ্গে মুহুর্মুহু বাজ পড়ার কড়কড় শব্দ | অলি উপমা এই বুঝি আটকে পড়ল রাস্তায় | ওরা পৌঁছতে পৌঁছতে আমার বডি পৌঁছে যাবে লাশঘরে | অলি আর তোমার সঙ্গে দেখা হল না | অতগুলো দুর্গন্ধযুক্ত লাশের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না | এবার আমি দেহ ছেড়ে জল স্থল অন্তরীক্ষ চিরে অনেক অনেক দূরে পাড়ি দেব ,কোথায় কোন নিরুদ্দেশে ,খুঁজব আমার আমিকে ....ওই শুনতে পাচ্ছি আত্মার ভেতর বারবার ডানা ঝাপটাচ্ছে হোমা পাখি ....
" মা, বাবা আজ পড়াতে যাবে না ? "
"যাবে তো, ও ঘরে ঘুমাচ্ছিল, দেখ তো উঠেছে কি না, না উঠলে ডেকে দে, এক্ষুনি ছাত্ররা চলে আসবে ডাকতে। পাঁচটা বাজে প্রায়। "
" ডাকছি " অশোকের ঘরে ঢুকেই উপমা মৃদু নাসাগর্জন শুনতে পেল। দেখল অঘোর ঘুমে বাবা। মাথার পাশে উল্টে রাখা জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ প্রথম খন্ড। বইটা উপমা হাতে নিয়ে দেখল, মহাপৃথিবীর " আট বছর আগের একদিন " কবিতাটা খোলা রয়েছে। তার মানে বাবা এই কবিতাটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কবিতাটা বাবার অন্যতম প্রিয় কবিতা, উপমা জানে। শুধু এটাই বা কেন ছোটবেলা থেকে কত কবিতায় না শুনেছে বাবার মুখে। মনে পড়ে উপমার, ছোটবেলায় বাবা যখন "বোধ " কবিতার " মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয় শান্তি নয় কোন এক বোধ কাজ করে " এই পর্যন্ত বলত উপমা সাথে সাথে বলে উঠত " আমি চলি সাথে সাথে সেও চলে আসে আমি থামি সাথে সাথে সেও থেমে যায় থেমে যায়। ”
আর দেরি করা ঠিক হবে না, মা বকা লাগাবে। উপমা তাড়াতাড়ি করে অশোকের কানের কাছে মুখ রেখে ডাকল " বাবা, ও বাবা, ওঠো পড়াতে যাবে না ?"
ধীরে ধীরে চোখ মেলল অশোক। যেন কোন অলীক স্বপ্নের জগত থেকে প্রত্যাবর্তন করল বাস্তবের মাটিতে।
" হ্যাঁ যাবো তো, ক'টা বাজে রে ?"
"পাঁচটা "
" আগে ডাকিস নি কেন ? আজ বিএ ফার্স্ট ইয়ারের হিস্ট্রি অনার্স ক্লাস আছে। কত দূর থেকে ওরা আসে। "
" তোমার হুশ থাকে না ?"
অলি বাবা- মেয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়াল " দুপুরে কেউ এমন নাক ডেকে মাঝরাতের মতো ঘুমায় ?"
" আর কথা বাড়িয়ো না তো,চা-টা বসাও। " বলতে বলতে জামা -প্যান্ট পরে নেয় অশোক।
"এখন আর চা খেতে হবে না, আগে যাও, আমি উপমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। "
ডোর বেলটা বেজে উঠে। দৌড়ে দরজা খোলে অলি। কোচিং-এর কয়েকজন ছাত্র -- পায়েল রিয়া শুভ ওরা সবাই এসে হাজির। " ম্যাম,স্যার আজ পড়াবে না?"
" হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়াবে তো, যাচ্ছে তোমরা যাও একটু বোসো গিয়ে। "
" চল, চল স্যার আসছে, স্যার আসছে " বলতে বলতে ওরা ছুটল।