সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

প্রিয় কবি, লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

  

স্বরবর্ণ -- ২   সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও অগোচরেই হয়তো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেল । আপনারা হাত ধরলে সেসব আমরা অচিরেই পেরিয়ে যাব


স্বরবর্ণ ---  

প্রকাশিত হবে আগামী ১৫ আগস্ট ২০২১। এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা (গল্প কবিতা প্রবন্ধ বা ভ্রমণ কাহিনি ) ৩০ জুলাই  - এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । শব্দসীমা অনির্দিষ্ট | লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠিয়ে দিন। "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর বেরোবে | আগে থেকে লেখা পাঠান | পরিকল্পনার সুবিধার জন্য | লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে |

হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  












         




দীপংকর রায়   

কবিতার বই  *  অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

* আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 


কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 




 

আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ





মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 



শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি






 শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি


 রামলাল চট্টোপাধ্যায়


( ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যম অগ্রজ রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন  রামলাল চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুর তাকে  ' রামনেলো ' বলে ডাকতেন।  বেলুড় মঠের সকলের কাছে তিনি ' রামলাল দাদা ' নামে পরিচিত ছিলেন। রামেশ্বরের দেহত্যাগের পর তিনি দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর পূজক পদে নিযুক্ত হন এবং আজীবন সেই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে তিনি অনেকবার গান শুনিয়েছেন। ঠাকুর কাশীপুরে ' কল্পতরু দিবসে ' অনেকের সঙ্গে রামলালকেও কৃপা করেন। )

১)


আশ মিটিয়ে দেখা


মার মন্দিরে যদি কেউ চোখ বন্ধ করে ধ্যান করত, তা দেখে ঠাকুর তাকে বলতেন, 'এখানে আবার ওসব কেন গো? সাক্ষাৎ মা চিন্ময়ী বিরাজ করছেন, আশ মিটিয়ে দেখে নাও। ওসব বাইরে চলে, যেখানে অনুভূতি হবে না, এখানে ওসব করো না। মনে কর, তুমি তোমার আপন মার কাছে গেছ মাকে দেখতে, তুমি কি চোখ বন্ধ করে মার কাছে বসবে, না মালা জপতে বসবে?'


ঠাকুরের নাম করে নৃত্য


     'জয় গোবিন্দ, জয় গোপাল, কেশব মাধব দীন দয়াল। হরে মুরারে গোবিন্দ, বসু-দেবকী নন্দন গোবিন্দ। হরে নারায়ণ গোবিন্দ হে। হরে কৃষ্ণ বাসুদেব।' ঠাকুর সকাল ও সন্ধ্যায় এইটি বলে কখনও কখনও নৃত্য করতেন। 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।' 'রাম রাঘব রাম রাঘব, রাম রাঘব পাহি মাং। কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব, কৃষ্ণ কেশব রক্ষ মাং।'


শ্রীরাম ও জপের বর্ণনা


     ঠাকুর বলতেন, 'রা শব্দে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বোঝায় আর ম শব্দে ভগবান অর্থাৎ রাজা -যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রাজা -তিনি রাম। আর করজপের বিষয়ে বলতেন, 'আঙুলের পর্বতে ঠেকবে না এবং নখে স্পর্শ হবে না। আঙুল ফাঁক থাকলে জপের ফল বেরিয়ে যায়। কর্ম সেরে বসি, আর শত্রু মেরে হাসি।' আবার বলতেন, 'অষ্টমী, চতুর্দশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও সংক্রান্তি এই পঞ্চপর্ব কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ উভয়ে যদি শনি ও মঙ্গলবার পড়ে তো বিশেষ প্রশস্ত হয়।'


নাম মাহাত্ম্য


     ঠাকুর বলতেন, 'ভগবানের লীলা খেলা, মায়া এসব বোঝবার জো নেই। যেটা সম্ভব, সেটা তাঁর ইচ্ছায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে; আবার যেটা অসম্ভব, সেটা তাঁর ইচ্ছায় সম্ভব হয়ে যাচ্ছে।' ঈশান মুখুজ্যেকে ঠাকুর বলেছিলেন, 'আচ্ছা ঈশান, রেলে রেলে ঠোকাঠুকি হয়ে কত লোক বেঁচে গেল, আবার কত লোক মরে গেল। তা এর থেকে বোঝা গেল, যারা দুর্গা বলে যাত্রা করেছিল তারাই বেঁচে গেল। আর যারা দুর্গা বলে যাত্রা করেনি তারাই মরে গেল। একজনের কপালে লেখা ছিল পায়ে ফাল ফুটে ঢুকে যাবে। সে দুর্গা বলে পথে যাচ্ছে, এমন সময় তার পায়ে কুশ ফুটে গেল। এ থেকে বোঝা গেল যে ঐ দুর্গানামের গুণে অল্পের মধ্যে কেটে গেল কি বল?' ঈশান বললে, 'আজ্ঞে হ্যাঁ।'


          

২)


আগে ভোজন কর


     ঠাকুর উপবাসের সম্বন্ধে বলতেন, 'মার পায়ের বিল্বপত্র ভক্ষণ করে কিংবা মায়ের প্রসাদী দ্রব্য খেয়ে কিছু খেলে দোষ থাকে না।' 'যদি ঠিক ঠিক বোধ হয়, তবে তো ফল হবে। আবার পেট চুঁই চুঁই করছে, তাতে কি আর ধর্মকর্ম চলে? একে কলিকাল, অন্নগত প্রাণ, অল্প আয়ু। উপবাস করে ওসব করা চলে না, তাতে ঠিক ঠিক মন বসে না। তাই আগে কিছু খেয়ে নিতে হয়।'


দক্ষিণেশ্বরের দিনগুলো


     ঠাকুর সোমবার চুল কাটতেন। ঠাকুরের চর্ম অত্যন্ত কোমল ছিল, তাই ক্ষুর দিয়ে তাঁর দাড়ি কামানো যেত না; নাপিত তাঁর দাড়ি ছেঁটে দিত।

     ‎ হৃদয়দাদা ঠাকুরের খুব সেবা করেছেন। ঠাকুর বলতেন, 'এমন সেবা বাপ-মাও করতে পারে না।' আবার খুব যন্ত্রণাও দিয়েছেন শুনি। দাদা বলেন, 'হ্যাঁ সে সব ঝগড়া দেখবার ছিল।'

     ‎ যখন ঠাকুর হৃদয়দাদার উপরে রেগে যেতেন তখন তিনি দাদাকে যা তা গালাগালি দিতেন। হৃদয়দাদা সে সময়ে চুপ করে থাকত আর মধ্যে মধ্যে ঠাকুরকে বলত, 'আঃ, কি কর মামা, ওসব কথা কি বলতে আছে, আমি যে তোমার ভাগনা।' ঠাকুর সামনে যা পেতেন -ঝাঁটা জুতো সপাসপ করে লাগিয়ে দিতেন। এই সব ব্যাপার দেখে আমি ভাবতুম, এইবার বুঝি দুজনে ছাড়াছাড়ি-আড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু তা হতনা, পরক্ষণেই আবার দুজনের ভালবাসা, কথা, ইয়ার্কি চলত। আবার হৃদয়দাদা যখন ঠাকুরকে কিছু বলতেন তখন তিনি চুপ করে শুনতেন।

     ‎ এই ঘরে (যে ঘরে ঠাকুর থাকতেন) কত নাচগান, কথা, রঙ্গরস হয়েছে। ঠাকুর এমনই রঙ্গরস রহস্য করতেন যে হেসে নাড়ি বেদনা হতো। তিনি ভক্তদের বলতেন, 'হ্যাঁগা, আমি এ সব জানি, শুনেছি, দেখেছি, তাই বলছি, তাতে কি দোষ হবে?' ভক্তেরা বলতেন, 'না, না, আপনি বলুন বেশ ভাল লাগছে।'


কলকাতার ভক্তি


     ঠাকুর আমায় গাইতে বললেন -'তার তারিণী', কিন্তু আমি ভাই একঘর লোক দেখে লজ্জায় আছি। এই দেখে ঠাকুর বললেন, 'শালা লজ্জা করছিস! ঘৃণা লজ্জা ভয় তিন থাকতে নয়। লোককে দেখে তোর লজ্জা! লোক না পোক!' তিনি আরও বলেছিলেন, 'যখন যে কোন দেব দেবীর গান গাইবি, আগে চোখের সামনে তাঁকে দাঁড় করাবি, তাঁকে শুনাচ্ছিস মনে করে তন্ময় হয়ে গাইবি। লোককে শুনাচ্ছিস কখনও ভাববি না, তাহলে লজ্জা আসবেনি।'

     ‎ 'কলকাতার লোকেরা ভক্তি করতেও যেমন, অভক্তি করতেও তেমনি। আমায় কেউ কেউ বলে বাবুর লাল-পেড়ে কাপড় পরা, পায়ে বার্নিশ করা চটি-জুতো, তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসা, এসব না হলে চলে না। গঙ্গার জল সকালে দেখলুম বেশ ভরপুর রয়েছে, আবার দেখি না কমে গেছে। এসব লোকেদেরও কিরকম জানিস, ঠিক জোয়ার ভাটার মতন। কত শালা কত কি বলে, ও শালাদের ভাল কথায় আর মন্দ কথায়ও ঘৃণা করি। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ আছে ভক্তিমান বিশ্বাসী, তাদের আর ওসব হবেনি। তারা যাকে ভক্তি করবে বা বিশ্বাস করবে, তাদের আর ভুল হবেনি।'




প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

 

এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ / ২ সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন  কবি  কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় |



ধুলো 



ধানের রঙের  মতো হেমন্তের রৌদ্র ভরা বিকেল 

এতো আলো এতো আকাশ এতো প্রাণ 

সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একটি ফলের মতো মনে হয়। 

সবচেয়ে অবাক লাগে যখন মনে করি

 আমি বেঁচে আছি আমি দেখছি আমি ভালোবাসছি।

অবাক লাগে ভাবতে :একদিন এদের আমি দেখিনি 

একদিন এদের আমি দেখব না 

এতো আলো এতো আকাশ এতো প্রাণ 

ধানের রঙের মতো হেমন্তের রৌদ্র ভরা বিকেল ।


একদিন আমি এদের পাবো না 

কিন্তু একদিন যে এদের পাবার আনন্দ 

আমার মনের মধ্যে বিন্দু বিন্দু সঞ্চিত হয়েছিল 

তাদের রেখে গেলুম, ছড়িয়ে দিলুম 

গ্রামের সোনালি ধুলোর পথে।

তামাটে পায়ের ফাটা চামড়ার চাপ 

 এই আনন্দকে জীর্ণ করুক।

শিশু খেলা করুক এই ধুলোয়,

মাঠের ফসলের আর হেমন্তের শিশিরের গন্ধ

ছড়িয়ে পড়ুক এই সোনালি পৃথিবীতে ---

বাংলাদেশের এই আশ্চর্য ধুলোয়।


হেমন্তের এই আলোর বন্যাময় শান্ত বাংলাদেশের গ্রাম 

যত দূর দেখা যায় সোনার ফসল 

মাঠের উপর স্তরের মতো নুইয়ে পড়েছে

 শান্ত নির্বাক সূর্যের উষ্ণ কোমল স্পর্শ  

 একটু ঠান্ডা বাতাস বইলো 

বাঁশবন শিরশির করছে 

একটা ফড়িং  লাফিয়ে চোরকাঁটার বনে অদৃশ্য হলো 

আকাশে শঙ্খচিল ---

হঠাৎ দূরের মাঠ চিরে  কালো মালগাড়ি চলে গেল 


হেমন্তের পরিপূর্ণ পড়ন্ত বেলায় 

কী নিরর্থক ভাবা : একদিন ছিলুম,

একদিন থাকবো না।


দেবাশিস সাহা

 





স্বপন চক্রবর্তী অন্তরালবর্তী , নিভৃতচারী এক নিরলস সাহিত্য সাধক | গল্প ,উপন্যাস ,স্বপ্ন সংকলন , চিঠি সংকলন এবং অন্যান্য রচনা --- সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনি পঁচিশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন | সম্প্রতি তাঁর একটি গ্রন্থ পাঠ করলেন ' স্বরবর্ণ ' সম্পাদক | 


হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্ণের ডাক


স্বপন চক্রবর্তী



১২ জুলাই, ১৯৯৭

আষাঢ়, ১৪০৪


" আজ সকালে উঠোনে বিস্কুটের টুকরো ছড়িয়ে দিতেই দেখলাম, আরো নতুন নতুন কয়েকজন উড়ে এলো ! একটা দোয়েল, দুটো শালিক। গোটা কয়েক চড়ুই আর একটা বুলবুল।-------"


পড়ছিলাম স্বপন চক্রবর্তীর 'হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্ণের ডাক' বইটি। পড়তে পড়তে মুগ্ধতা তৈরি হচ্ছিল ক্রমশ, যা সীমানা ছাড়ালো ৯০ পৃষ্ঠায় এসে উপরের এই বর্ণনাটিতে, পরিচিত কয়েকটা পাখির উল্লেখে ' কয়েকজন ' শব্দটি  ব্যবহারের অনুষঙ্গে।


এবং এখানেই খুঁজে পেলাম বইটির নামকরণ  এবং শিল্পী রাজীব মন্ডলকৃত প্রচ্ছদের তাৎপর্য। বইটি হাতে পেয়েছি কবেই। নাম এবং প্রচ্ছদ ভাবিয়েছে প্রথম দর্শনেই। কিন্তু এইখানে পৌঁছে যেন আবিষ্কারের আনন্দে শিহরিত হলাম। কালো কালিতে কাকের গায়ের রঙে রঙ মিলিয়ে কাকের হাঁ--করা ঠোঁটে, বাকি অংশ জুড়ে হেমন্তের আবহ  দারুণ বেজেছে প্রচ্ছদচিত্রে। ব্যাক কভারে ডানামেলা কাকের উড়ন্ত ভঙ্গি  উড়িয়ে নিয়ে গেছে লেখকের কল্পলোকে ---যে বিষয়টি তিনি ধরতে চেয়েছেন সমস্ত গ্রন্থ জুড়ে।


বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে, বইটির বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করি। স্বয়ং লেখক  জানাচ্ছেন , " বাবার মৃত্যুর পরে পরেই সেই ১৯৯৫ সালের অন্তিম পর্ব থেকে কয়েকটি বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে যে সকল চকিত অনুভব --- যা হাহাকার থেকে, বিরহ থেকে, এমনকী শূন্যতাবোধ থেকে জেগে উঠেছিল, এবং যা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম --- মৃত্যুর সেই পঁচিশ বছর স্পর্শ করাকে কেন্দ্র করে সেই সকল বিচ্ছিন্ন রচনাগুলি সংকলিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলাম বাবার স্মৃতির উদ্দেশে। "


 বস্তুত ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর ২০০৪ পর্যন্ত, যখন যেভাবে,যে নির্দিষ্ট দিনটিতে পিতৃস্মৃতি লেখককে স্পর্শ করেছে, তা তিনি ডাইরির আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই নশ্বর জগতে প্রিয়জন বিয়োগব্যথা কার না আছে ? বাবা বা মায়ের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া ব্যথিত করে না কাকে ? কিন্তু সেই ব্যথার প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন রকম, যেমন লেখক স্বপন চক্রবর্তীতে।


গল্প নয় উপন্যাস নয়, ব্যক্তিগত এই স্মৃতিচারণা পড়তে পড়তে লেখকের কলমের মুন্সিয়ানায়, দেখার অন্তর্ভেদি দৃষ্টিভঙ্গিতে কতবার কতভাবে যে শিহরিত হয়েছি, জন্ম-মৃত্যুর ভেদরেখা ছুঁয়েছি যেন চকিতে, লেখকের ভাবনায় স্পৃষ্ট হয়ে, তার কোনো লেখাজোখা নেই।


কোনো  রচনায় পাঠক যখন আত্মপ্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখেন, তখনই ভালোলাগার বোধে আচ্ছন্ন হয় মন। আলোচ্য বইটিতেও কোন কোন পাঠক সেই প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হতে দেখবেন, নিঃসন্দেহে। ' কোন কোন ' কথাটি লিখলাম এই কারণে, যে, সকলের চিন্তাভাবনার স্তর  লেখকের মানসলোককে স্পর্শ করতে পারে না সব সময়।


লেখক এর সঙ্গে পাঠকের এই জারণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলে, একটা সময় পাঠক নিশ্চিত উপলব্ধি করবেন, কমল গাঙ্গুলির সঙ্গে মহাভারতের সভাপর্ব নিয়ে কিংবা বন্ধুর সঙ্গে মেঘনাদবধকাব্যের রুপাভাস নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছেন যিনি, যিনি সাতান্ন সালের দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনে স্ত্রীকে নিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছেন বা যিনি উদাত্ত কণ্ঠে কখনো গাইছেন ' গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব' কখনো  ' মন চলো নিজ নিকেতনে '  কিংবা মৃত্যুর পরে যাঁর জামার পকেটে পাওয়া যাচ্ছে ছটা চারমিনার সিগারেট, যাঁর সংগ্রহে রয়েছে বেণীমাধবের পঞ্জিকা, কালো রেক্সিনের ব্যাগ তাতে ফিউজ তার পুরনো হোল্ডার স্ক্রু ড্রাইভার প্লাস চশমার ফ্রেম আতসকাঁচ থার্মোমিটার--- ইত্যাদি  সংসারের টুকিটাকি জিনিস,--- তিনি আসলে আমাদেরও পিতা।


বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি উপাদানে, প্রতিটি অণুতে পরমাণুতে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে -প্রশ্বাসে লেখক অনুভব করেন বাবার অস্তিত্ব, তা যে অত্যন্ত প্রকটভাবে, এমন নয়। বাবার মৃত্যু আসলে অনুপস্থিতির মধ্যে প্রবল উপস্থিতি, শিরায় শিরায় প্রতিটি কলা কোষে, লেখক অনুভব করেন। " কে এই কথা প্রচার করেছে, কে মিথ্যে রটিয়েছে, যে আমার বাবা মরে গেছে ? "


প্রিয় পাঠক, পরিশেষে আমি লেখকের ভাষা ব্যবহার, ভাবনার অতলস্পর্শী গভীরতা, সর্বোপরি দেখার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি কোন স্তরে পৌঁছেছে বইটিতে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি -------



১) বাবা, তুমি কোথায় আছো এখন পঞ্চভূতে? আলোতে?অগ্নিতে?ধূলিকণায়? তড়িতাধানে? তুমি কোথায় আছো? রূপান্তরে কী জানছো? কী জানলে এই পর্বlন্তরে? কে এসে তোমাকে নিয়ে গ্যালো হাত ধরে? পরমপিতা ? নাকি সে প্রেতের ইশারা? 


২) মরণ কাকে বলে ?

এই যে জল- যমুনায় ভেসে যাচ্ছে অবিরল কালো স্রোত স্বপ্নে, অবচেতনে, এই যে তারকা দল নক্ষত্রসকল ঘুরপাক খাচ্ছে মহামন্ডলে  এবং চির - নিঃশেষিত হয়ে চলেছে বেদনায়, দহনে --- মৃত্যু কি তার বিকল্প নাম ?


৩) চাঁদ স্থির / চাঁদ ভাসছে /চাঁদ উড়ে যাচ্ছে ফাল্গুন মাসের প্রতারক সন্ধ্যাবেলা চাঁদকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে আকাশে। মনে হয়েছিল চাঁদ খুব আহ্লাদে হাসছে। মনে হয়েছিল চাঁদকে খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। মনে হয়েছিল চাঁদ ভালোবাসছে আমাকে।


৪) বারান্দায় ইজিচেয়ারটা নেই--- সেই কবে থেকে ! প্রায় আড়াই বছর হবে। সেখানেও তুমি-- ওই অনুপস্থিতির মধ্যে। বাইরে উঠোনের রৌদ্রে মেলে দেয়া জামা- কাপড়ের মধ্যে একটিও  ধুতি নেই, সাদা শার্ট নেই --- টুইল কাপড়ের। ওই না -থাকার মধ্যেই  তুমি জেগে আছো।


৫) " ওই কদমগাছে সমস্ত বছর ধরে ফুল ফোটে"-- তুমিই প্রথম বলেছিলে। তোমার বিশ্বাস ছিল ওই কদমগাছটিতে শ্রীকৃষ্ণের একটি আশ্রয় আছে। তোমার সেই গভীর বিশ্বাসে কোনোদিন আঘাত করিনি। কোনোদিন সংশয় প্রকাশ করে তর্ক জুড়িনি।


এমনই আরো, অজস্র...প্রিয় পাঠক বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি।



পাঠ-প্রতিক্রিয়া * সম্রাট মুখোপাধ্যায়



 তিনি ' আজকাল ' দৈনিক পত্রিকার লেখক। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি নাট্যকার , অভিনেতা এবং পরিচালক। কিন্তু এগুলি তার মুখ্য পরিচয় নয়। তাঁর মতো শক্তিশালী একজন লেখকের  সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি অখ্যাতজনের লেখাও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন এবং উৎসাহিত করেন লেখার আনন্দে লিখে যেতে । যেমন সম্প্রতি তিনি পড়লেন দেবাশিস সাহার ' দু'এক কণা শৈশব ' বইটি। পাঠকের জন্য এখানে রইল, সেই পাঠ প্রতিক্রিয়া -----



কী ভালোই না হত,যদি আমাদের প্রত্যেকের হাতে এক-একখানা নিজস্ব আলাদা ইতিহাস বই থাকত!পড়তে পারতাম...।পড়াতে পারতাম...।

নিজের-নিজের ছোট-বড় চড়াই-উৎরাইভরা জীবনের বৃত্তান্ত দিয়ে গাঁথা।

বুকের ভেতর তো থাকেই সে বই।...বয়েও চলি আজীবন। অনেকেই।

কী ভালোই না হত,শুধু সে বই যদি ছেপেও নেওয়া যেত।পড়ানো যেত...পড়াতাম তখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে।

যেমন দেবাশিস সাহা করেছে।করতে পেরেছে।আগলে রেখে গোটা একটা বাড়িভরা স্মৃতি। 

এখন তো দূরে-দূরে বাঁচতে-বাঁচতে পরিবারও ভেঙেচুরে দূরের সমাজ।সেখানে উল্টোপথে এই প্রতি হাতে এক-একখানা করে ইতিহাস বই তো সমাজটাকে গেঁথে ফেলতে পারত একটা পরিবারে।মিলের চিন্হ খুঁজে-খুঁজে।শঙ্খ ঘোষ থাকলে যাকে হয়ত বলতেন 'সমন্বয়ের বাস্তব'।

হ্যাঁ,বিশ্বাস করি সব প্রতিষ্ঠানের বাইরে এসে,মানুষের বুকের ভেতরে গড়া এই নিজস্ব ইতিহাস বইগুলো এতখানিই আঠালো,মায়াবি,মানুষি।যতবার লেখা হয়...পড়া হয়।


এমন বিশ্বাসের ভিতকে শক্ত ক'রে আরেকবার গড়ে দিল দেবাশিস সাহার লেখা 'দু এক কণা শৈশব'।দেবাশিস সাহা স্থির করেই জল বাইতে নেমেছেন যে তিনি এই লেখার নির্দিষ্ট কোনও আকার-প্রকার দেবেন না।ছাঁচ গড়বেন না।যতটা আকার,যতটা ছাঁচ পেলে একটা লেখা কোনও না কোনও একটা সংজ্ঞা পায়।উপন্যাস...আখ্যান...গল্প...স্মৃতিকথা...রম্যরচনা...এমন সব।না সে ঘরের দরজা ভেজিয়ে রেখেছেন দেবাশিস।এতে তাঁর লেখা বেশ স্বাধীন একখানা জমিজিরেত পেয়েছে তো বটেই,লেখাখানা পাঠক পড়তেও পারছে বেশ খেলিয়ে।মনকে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে।

টুকরো-টুকরো সব স্মৃতির অধ্যায়।ছোট-বড় নানা মাপে।  

তার ভেতর আবার নিয়ম-রীতি ভেঙে ঢুকে পড়ছে 'আমার বাবা','আমার মা','আমার দাদা','আমার কাকা'জাতীয় টুকরো-টুকরো ছবিসহ সচিত্র পরিচিতির অ্যালবাম!এক অন্যরকম 'পার্সোনাল টাচ'!একটা নতুন 'ফর্ম'এর ইশারা যেন!!যেন লেখার কাজ এক একখানা ছবিকে পরিচিতি দেওয়া।


আমার দেবাশিসবাবুর ডাকে পাঠানো এ'বইখানা পড়তে বেশ একটু দেরিই হয়ে গেল!দুই বছরের দুই লকডাউনের মাঝে পাঠানো বই পড়তে লাগলাম তখন,যখন সাম্প্রতিকতম লকডাউনের দীর্ঘ বন্দিদশা গড়িয়ে দীর্ঘতর হওয়ার বাঁকে।

খোলা মাঠঘাটে,নদীবিলে ছড়ানো-খেলানো এ আখ্যান হয়ত তাই আরও মায়া,আরও নরম-মন বয়ে আনল আমার জন্য।হয়ত সেদিক থেকে আমি ঠিক সময়েই এই বইয়ের ডাক-মোড়ক খুললাম।ফলে ক্ষমা চাইছি না।


দেবাশিস সাহা।এক ভাঙা ভূগোলের ভেতর দিয়ে যাওয়া জীবনের যাত্রি।দুই দেশের মধ্যে বিভাজিত তাঁর শৈশব-কৈশোর।যা মেলালে তবে তাঁর নিজের ইতিহাস গড়ে ওঠে।তাঁর স্মৃতি,তাঁর অস্তিত্ব।

এই যুক্তবঙ্গের স্মৃতিই তো অখণ্ড বাঙালি সত্তার মহাফেজখানা।কারা যেন এই তো অতি-সম্প্রতি সেসব আবার কাড়তে/ভোলাতে-গোলাতে এসেছিল।এখনও বেশি দূর যায় নি তারা,যেতে পারে নি।গল্পের ইতিহাসে ঘেরা এ'বইখানি তাদের মুখ বা পশ্চাৎদেশ টিপ ক'রে সজোরে ছুঁড়ে মারার।

পেছনে পড়ে থাকা সেসব গল্পের ভেতর থাকা অনেক অজানা তথ্য।যাদের ঝিনুকের ভেতর মুক্তো বলে মনে হয় পড়তে বসলে।যেমন,লাল হয়ে যাওয়া নারকেল টিপে তেল বের করা।যেমন,কলসি ঝুলিয়ে ঘোড়দৌড়।যেমন,কচুপাতা আর নারকেলগাছের মাথার অংশ দিয়ে কালিপুজোর বাজি বানানো।কিংবা,সেই পেঁপেগাছের ফাঁপা ডালের ভেতর ঝোপ থেকে ধরা জোনাকির ঝাঁক পুরে প্রাকৃতিক টর্চ বানানোর চেষ্টা করা কান্নাভেজা নষ্ট-গল্প।

আর,সীমান্ত ডিঙোনোর সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া বিবরণ তো যেন ঋত্বিক ঘটকের 'সূবর্ণরেখা'!রাত জুড়ে দু'পায়ে ভিজে জলের ছলাৎছল শব্দ!'কুয়ো ভ্যাদিস ডোমিনি'?

ছেলেবেলার সব গল্পের গায়েই কি অমন ভারি করে মায়ার ভিজে মাখন লাগানো থাকে?

কুয়াশার হিম প'ড়ে থাকে গদ্যের গায়ে?

বড়দের ইতিহাস বই পড়তে গেলে তো কই তা পাই না তো!সেখানে শুধুই তেলের শিশি ভেঙে দেবার উল্লাস!

তাই আসুন,এইসব বই দিয়ে ছাতিমতলায় সিলেবাস গড়ি। 


নাঃ।সত্যিই দেবাশিস সাহার বইয়ের মোড়ক ঠিক সময়েই খুলেছি।

বড় উপশম দিচ্ছে।যাদুঘেরা এক নিজস্ব ভূগোলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।যে দেশে এখন অর্ধশতাব্দীর নিঃসঙ্গতা।


বইটি প্রকাশ করেছে 'চিন্তা'।

জমিয়ে লিখে চলুন দেবাশিস।স্মৃতিতে ডুব দিন বারবার। আমাদের জন্য। স্বাগত।


আমাদের সাহিত্য-পড়া কবে এতটা সাবালক হবে যে এই মুক্ত-আখ্যানকে সে আসন্ন-উপন্যাসের ভূমিকা হিসাবে পড়তে শিখবে?

আমাদের ইতিহাস-পড়া কবে এত সমর্থ হবে যে এইসব ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সে ক্ষমতার দরবারি-খাতার বাইরে এসে চুর্ণ-ইতিহাস হিসাবেই পড়তে শিখবে?

কবে?

এবং কবে??




উপন্যাস * দেবাশিস সাহা


ধুলোর সিংহাসন

দেবাশিস সাহা 


দুই


একটু আগে আমি মারা গেছি । ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, ঘন্টা চারেক বাদে ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন। কিন্তু আমার দেহ থেকে আত্মা যে নির্গত হয়ে গেছে, তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমার আর কোন শরীর খারাপ নেই। সুগার নেই, প্রেসার নেই, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যা নেই। আগে ব্যাচের পর ব্যাচ ছাত্র পড়াতে পড়াতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যেত, যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়ত, কিন্তু এখন আমার আর কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই । এখন আমি সব ব্যথা, সব জ্বালা যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে । এখন আমি আত্মা । আমাকে কোনো রোগ শোক হতাশা গ্লানি কারো ক্ষমতা নেই, স্পর্শ করতে পারে। এই জন্যই বুঝি আমার দাদু আমার নাম রেখেছিলেন অশোক, অর্থাৎ যে কি না সব শোকের ঊর্ধ্বে। কী দূরদৃষ্টি ছিল দাদুর ! ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি, দাদু খুব তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয়, দাদু নাকি বলতেন, আমার অশোকদাদা হবে হোমা পাখির মতো। শালিক চড়ুই টুনটুনি শ্যামা দোয়েল কোয়েল বসন্তবৌরি মাছরাঙা বাবুই --- কত রকমের পাখির নাম শুনেছি । কিন্তু হোমা পাখি কী, কেমন দেখতে, কোনওদিন শুনিনি। অনেক পরে হোমা পাখির নাম জানতে পেরেছি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত পড়তে গিয়ে। মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গিয়ে হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামে একবার হোমা পাখির একটা জীবাশ্ম দেখেছিলাম।


  হোমা পাখির গল্প বলে শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্রনাথ, যিনি পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ বলে ভুবনবিখ্যাত  হয়েছেন, সেইরকম  বিশেষ কিছু ভক্তদের স্বভাব বোঝাতে চাইতেন, অঢেল প্রাচুর্য থাকতেও ,যাঁরা সংসারের প্রতি নিরাসক্ত, যাঁরা ঈশ্বরকোটির মানুষ। সংসারের পাঁক যাদের স্পর্শ করতে পারে না। সংসারের সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে যাঁদের মন সবসময় হোমা পাখির মতো ঊর্ধ্বগামী হয়।


 বেদেও হোমা পাখির উল্লেখ আছে। পুরান অনুসারে হোমা এক বিচিত্র পাখি। আকাশ ছেড়ে এই পাখি কখনও নিচে নামে না। আকাশ-মহাকাশ চিরে কেবলই ওড়ে, উড়তে থাকে। উঁচু থেকে আরো উঁচুর  দিকে। উড়তে উড়তেই এদের ঘর-সংসার। উড়তে উড়তেই এদের জন্ম - মৃত্যু। হোমাপাখি যখন ডিম পাড়ে, অনেক উঁচু থেকে সেই ডিম পড়তে থাকে। একদিন দু'দিন না, দিনের পর দিন । এইভাবে পড়তে পড়তেই  ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং সদ্যোজাত হোমা যখন পড়তে পড়তে একেবারে পৃথিবীর কাছে চলে আসে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে শিশু হোমা ফের আকাশের দিকে উড়তে শুরু করে, মা পাখির উদ্দেশে ।


  দাদুর ইচ্ছের কথাটা বাবা আমাকে বলেছিলেন সেই কোন ছোটবেলায়, কিন্তু সেই থেকে আমার বুকের মধ্যে কোথায় যেন হোমা পাখি উড়ে বেড়ায়। আমি তাকে যতই ধরতে যাই, সে ততই উপরে উঠে যায়। এই যে এখন আমি মরে গেছি, তবুও মনে হচ্ছে আমার আত্মার কাছাকাছি কোথায় যেন পাখিটা উড়ছে। তার ডানার ঝাপট আমি স্পষ্ট  শুনতে পাচ্ছি।  কোন সুদূর মহাকাশে তার জীবন। অথচ সারাক্ষণ তার ছায়া পড়ে আমার রক্তে,শিরা উপশিরায় ধমনীতে চোখের তারায় । পরিষ্কার দেখতে পাই না কোথায় আমার ভাতের থালা, জলের গ্লাস, জামা- গেঞ্জি , সানগ্লাস ,মানিব্যাগ । মাঝে মাঝে অলি -উপমার মুখটাও ঝাপসা মনে হয়। মনে হয় ওরাও যেন হোমা পাখি হয়ে দূর আরও দূর আকাশে উড়ে যাচ্ছে । আমি যতই ওদের ধরতে যাচ্ছি, ওরা ততই উপরে উঠে যাচ্ছে। আর আমি ধপাস করে পড়ছি এই পৃথিবীর শক্ত মাটির বুকে।



   কিন্তু আমি হোমা পাখি হব কী করে , আমার যে আসক্তি ষোল আনা। রসগোল্লা দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে, পকেটের পয়সা নেই, কিন্তু  হালফ্যাশনের জামাপ্যান্ট চোখে পড়লেই কিনতে ইচ্ছে হয়। সুন্দরী মেয়ে দেখলে চোখ শাসন মানে না,জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় | ব্যাংক লোন করে যা হোক তা হোক করে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি বটে, কিন্তু  এখনো সাজানো-গোছানো বাকি। খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল ---এসব ফার্নিচার কিছুই কেনা হয়নি। বইগুলো ডাই করে রাখা রয়েছে একটা ঘরে। ড্রয়িং রুমটাতে ওয়াল আলমারি বানাতে হবে। নাহলে দামি দামি বইগুলো পোকায় কাটবে । বন্ধুদের বাড়িতে গেলে কত সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের ওয়াল আলমারি,বইয়ের তাক দেখতে পাই। আর তাতে উঁকি দেন রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবনানন্দ দাশ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-এর মতো কত যে বিচিত্র লেখক আর বিচিত্র সৃষ্টির সম্ভার।



    আর সেখানে কিনা আমার বইগুলোর কিছু গড়াগড়ি খায় নড়বড়ে পায়া টেবিলটার উপর, নয়তো কিছু খাটের তলায় ইটের ওপর খবরের কাগজ পেতে তার ওপর স্তুপ করে রাখা ,আবার কিছু আদ্যিকালের  কাঁচভাঙা শোকেসটার ভেতর। বন্ধুদের মতো অত বিচিত্র বইয়ের সম্ভারও অবশ্য আমার নেই। বিয়ের আগে টিউশনির পয়সা বাঁচিয়ে কেনা কিছু বই আর বিয়ের পরে মাঝেমধ্যে দুই-একটা করে করে কেনা পছন্দের কিছু বই। কত বই এখনো কেনা বাকি। উপমা একটা চাকরি-বাকরি পেলে, সংসারের বোঝাটা একটু হালকা হলে, তখন মনের মতো সব বই কিনব। লিস্ট তো কবে থেকেই তৈরি করে রেখেছি। কত বই এখনো পড়া বাকি। বন্ধুদের কাছে চেয়ে বই পড়তে মন চায় না। কারো কাছ থেকে বই চাওয়ার কথা মনে হলেই,একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। 



    একবার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর আলমারিতে দস্তয়েভস্কির ' ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট' বইটা দেখে পড়ার খুব লোভ হয়েছিল, আবদারের সুরে বলেছিলাম, ক'দিনের জন্য বইটা দে না। মুখের উপর সে  বলে দিয়েছিল, অশোক কিছু মনে করিস না ভাই, জানিস তো কেউ বই চাইলে আমার উত্তম কুমারের সিনেমার একটা ডায়ালগ মনে পড়ে যায় " বই আর বউ ঘরের বার হলে আর ফেরত আসে না। " মুখের উপরে কথাটা বলে দিয়ে খুব হেসেছিলো বন্ধুটা। কথাটা শুনে  লজ্জায় একেবারে  কুঁকড়ে গিয়েছিলাম । তার মানে পরোক্ষে ও আমাকে চৌর্যবৃত্তি অবলম্বনের ইঙ্গিত করল। করুক। এমন সব অপমান কত সহ্য করতে হয়েছে এই পঞ্চাশ বছরে। এবার তো একটা ফ্ল্যাট হল নিজের। ড্রয়িং রুমটার তিন দিকের দেয়াল জুড়ে সুন্দর করে বই রাখার আলমারি বানাব।



   তাছাড়া দেখতে দেখতে উপমাও তো বড় হয়ে গেল। একমাত্র মেয়েটার বিয়ে থা-র কথাও তো ভাবতে হবে | অলি মাঝে মাঝেই বলে,এখন থেকেই অল্প অল্প করে গয়না গাটি বানাতে শুরু করো, সোনার যা দাম ,একবারে পারবে হাতে কানে গলার গয়না বানাতে | ওর ঠাম্মার যা গয়না -গাটি ছিল ,তার কিছুই তো তুমি পাওনি | অলি ঠিকই বলে ,মা-র সোনা -গয়না যা যতটুকু ছিল, সব দাদা -বৌদিরাই ভাগাভাগি করে নিয়েছিল | ওসব যে কোনোদিন আমার কোনো কাজে লাগতে পারে ,মাথাতেই আসেনি তখন | আসার কথাও নয়,তখন আমি খুবই ছোট, বৈষয়িক জ্ঞান সেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি | আমি অবশ্য অলিকে বোঝাই ,মেয়েকে বিয়ে দেব একথা ভেব না ,মেয়ে বিয়ে করবে ওর মনের মতো যোগ্য ছেলেকে ,সেটাই ভাবো,তাছাড়া আগে নিজের পায়ে তো দাঁড়াক |  বিয়ে -টিয়ে এখুনি কী ,কুসুমিতার মতো একটা কিছু হোক | সংসারের এত সব চিন্তা ভাবনা , মুক্তি মোক্ষ চাওয়ার আমার কি সময় আছে ? তবুও কেন যে হোমা পাখি আমার সর্বাঙ্গে ছায়া ফেলে আমার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয় !



  তবে,এবার মনে হয় ,পাখিটাকে ধরতে পারব, আমার তো আর শরীর নেই বন্ধন নেই | এবার আমি আকাশ - মহাকাশ চিরে খালি উড়ব, জীবন-মৃত্যু তোলপাড় করে জানব আমার অস্তিত্ব, কে আমি।কী জন্য এই পৃথিবীতে আসা আমার ? শুধুই কী জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়না ? ' প্রবৃত্তির অবিচ্ছেদ্য কারাগারে চিরন্তন বন্দি করি / রচেছো আমায় নির্মম নির্মাতা মম ' বুদ্ধদেব বসুর মতো মেনে নেব ? নাকি হোমা পাখির মতো আকাশ-মহাকাশ তোলপাড় করে খুঁজবো আমার অস্তিত্ব ,কে আমি ? কে ??



  কিন্তু সে সব খোঁজাখুঁজি পরে হবে,এক্ষুনি হয়তো ডাক্তার এসে খসখস করে আমার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবে। যাক,তার আগে যে কথাটা বলছিলাম বলে নিই, আমার  দাদু খুব তত্ত্ব জ্ঞানী ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত তো বটেই, বেদ-পুরাণ -উপনিষদ গীতা ভগবত সব খুব সহজে ব্যাখ্যা করতে পারতেন । আমার মায়ের উপর এই গুনটা অনেকটাই  বর্তেছিল। দেহ -মন -আত্মা  ছোটবেলায় এইসব ধারণা মা-ই আমাকে দিয়েছিলেন। পরে বড় হয়ে গল্প কবিতা উপন্যাসের  পাশাপাশি বেদ উপনিষদ ভগবত গীতা-ও কিছু কিছু পড়েছি। গীতার শ্লোকের মর্মার্থ এখন আমি নিজের জীবন দিয়ে বেশ মিলিয়ে নিতে পারছি।


ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন
নায়ং  ভূত্বা  ভবিতা বা ন ভূয়: ।
অজো নিত্য : শাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।



 আত্মার কখনো জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না অথবা পুনঃ পুনঃ তার উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না । তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চির নবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনো বিনষ্ট হয় না।



   সত্যিই তো, ওই যে হাসপাতালের টেবিলে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, ওটা তো জাস্ট আমার দেহ, ছেঁড়া পোশাক,যা কিনা সাদা কাপড়ে ঢাকা। নাকে তুলো, মুখ বন্ধ, বাঁদিকের গাল বেয়ে একটু গ্যাঁজলা বেরিয়েছে। দুপুরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যে-ডেড বডিটা দেখেছিলাম, সেটার থেকে সামান্য আলাদা। সেটার মুখটা ছিল বেশ খানিকটা হাঁ -করা, আর আমার বডিটার মুখ বন্ধ , কিন্তু চোখের মনি দুটো যেন ঠিকরে  বেরিয়ে আসতে  চাইছে ।



 একটু আগে অবশ্য একজন নার্স এসে চোখের পাতাদুটো ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে গেল, তা-ও মনে হচ্ছে, আমি প্রাণপণ তাকাতে চাইছি। আমার আত্মা কি তবে চোখ দিয়ে নর্গত হল ? আমি কি আবার মনুষ্য জন্ম পাব, না মনুষ্যেতর ? এই মুহূর্তে ওসব নিয়ে অবশ্য আমার মাথাব্যথা নেই। খালি মনে হচ্ছে কত কী দেখার বাকি ছিল এখনো ! সবে তো আমি পঞ্চাশ  পেরিয়েছি । কতজনে দিব্যি আশি পঁচাশি পার করে দিচ্ছে। আমার কি এটা মরার বয়স হল ! বিয়ের পর গত পঁচিশ বৎসর কোচিং ছেড়ে একটা পা-ও কোথাও সেরকম বেরোতে পারিনি। লন্ডন প্যারিস দূরে থাক, কুলু-মানালি, দার্জিলিং-সিমলা, রাজস্থান, কন্যাকুমারী কোথাও যাওয়া হয়নি। বিভূতিভূষণ বলেছেন না ---অচেনার আনন্দকে পাইতে হইলে পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে তাহার মানে নাই ! আমি যেখানে আর কখনো যাই নাই, আজ নতুন পা দিলাম, যে নদীর জলের নতুন স্নান করলাম, যে গ্রামের হাওয়ায় শরীর জুড়াইল, আমার আগে সেখানে কেহ আসিয়াছিল কিনা, তাহাতে আমার কী  আসে যায় ? আমার অনুভূতিতে তাহা যে অনাবিষ্কৃত দেশ। আজ সর্বপ্রথম মন বুদ্ধি হৃদয় দিয়া নবীনতাকে আস্বাদ করিলাম যে ! সেই হিসাবে আমিও একজন দেশ আবিষ্কারক ।



  কিন্তু তাই-বা হল কোথায়, বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়া কি নিদেনপক্ষে সুন্দরবন সাগরদ্বীপ ফ্রেজারগঞ্জ ধারে কাছে কোথাও অচেনার আনন্দ বুক ভরে টেনে নেওয়ার মতো অবসর-ও পাইনি জীবনে। তবে,হ্যাঁ, কোচিং থেকে ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে ওয়ানডে ট্যুরের প্রায় সবকটা স্পট ঘুরেছি। পুজালী সবুজদ্বীপ পিয়ালী নেচার পার্ক আটান্নগেট বুরুল হাট রায়চক বনগাঁ ফরেস্ট ইত্যাদি অনেক জায়গাতেই গেছি। কিন্তু সে তো ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দ দিতে, তাদের মন রক্ষা করতে। শীতের সময় বছরে একবার করে যেতেই হয়। পুরো কোচিং বায়না ধরে | সেটা কি একটা ঘোরা। হাজার রকম দায়িত্ব সামলাও। লাক্সারি বাস ভাড়া করা থেকে শুরু করে ক্যাটারিং এর লোকজন ঠিক করা, ছাত্র-ছাত্রীদের সামলানো,কে কোথায় চোখের আড়াল হল, হাজার রকম ঝক্কি । সবসময়ই একটা টেনশন কাজ করে। ষাট-সত্তর  জনের টিম, কোথাও কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটলে, তার দায় এসে পড়বে ঘাড়ে। এত টেনশন মাথায়  নিয়ে কি ' অচেনার আনন্দ ' খোঁজা যায়! দূরে কোথাও নির্জনে ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই ভয় হত, পাঁচ সাত দিনের জন্য যদি বেরোই, কটা ছাত্র যদি কোচিং ছেড়ে দেয়, তাহলে  খাব কী ,মেয়ের স্কুলের মাইনেই বা দেব কী করে।  ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। মাসে মোটা মাইনে। একবার যদি দিতে ফেল করো, পরের মাসে ফাইন দিয়ে ডবল মাইনে গুনতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা বছরে দু'বার মোটা অংকের ডোনেশন গুনতে হয়। একবার নতুন ক্লাসে ওঠার সময় আর একবার পুজোর আগে। |



  এমনিতে ছাত্র-ছাত্রীরা যত কামাই করুক তাতে দোষ নেই। আজ মাসি বাড়ি, কাল পিসি বাড়ি তো পরশু অন্নপ্রাশন কি জন্মদিন লেগেই আছে। সে বেলায় দোষ নেই। কিন্তু স্যার যদি দু'দিন ছুটি দিয়ে কোথাও  যায়, তো গার্জিয়ানদের মুখ ভার। " এ সময়ে ছুটি দিলেন স্যার ! সামনেই  ইউনিট টেস্ট, জানেনই তো আপনার কাছে ছাড়া বাড়িতে বিন্দুমাত্র বই নিয়ে বসে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে গেম খেলা নয়তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা।” ইচ্ছে করে মুখের উপর বলে দি --- এত ছোট বয়সে মোবাইল কিনে দেন কেন ? কিন্তু পারিনা, প্রভু বলে কথা, যদি প্রেস্টিজে লাগে, গেল দুটো টিউশনি। শুধু কি দুটো ? একজন গেলে সঙ্গে চার পাঁচজন নিয়ে যায়। আর চার পাঁচজন কোচিং ছেড়ে  চলে যাওয়া মানে দু' আড়াই হাজার টাকা ইনকাম কমে যাওয়া। থাক বাবা, বেড়াতে গিয়ে কাজ নেই। এই ভয়ে কোচিং ছেড়ে কোথাও যেতে পারি না | কত নেমন্তন্ন ক্যানসেল করি | আত্মীয় স্বজনদের বাড়িও যাওয়া হয়না কতকাল | কোচিং-এর জানলা দিয়ে যতটা আকাশ বাতাস বৃষ্টি ,যতটা  অচেনার আনন্দ নেওয়া যায়, তাই নিই প্রাণ ভরে । আর মনে মনে রবীন্দ্রনাথে সান্ত্বনা খুঁজি  ----


বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে 
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে 
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
                     দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু 
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া 
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া 
একটি ধানের শীষের উপরে
                      একটি শিশির বিন্দু।



    মনে পড়ছে, দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া বলতে একবার পুরি দু'বার দিঘা একবার বেনারস ও মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেছি, তাও অলির সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে । তা যাক, সব যাওয়া-যাইর আজ শেষ। ওই তো পড়ে আছে আমার দেহ নিঃসাড়, নিষ্পন্দ । এখন আমি যাকিছু দেখছি আত্মার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার দেহটার দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, এই দেহের ভেতর আমি পঞ্চাশ বছর বাস করে এলাম ! একটু বাদেই শ্মশানে নিয়ে এই দেহটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে আসবে আমারই বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় পরিজন । এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি " খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। " দেহরূপ খাঁচার ভেতর দিয়ে অচিন পাখি অর্থাৎ আত্মা বার বার আসে যায়। দেহ পুড়ে ছাই হয়, কিন্তু আত্মা আবার নতুন দেহ ধারণ করে । মনে পড়ছে স্নানের পর ঠাকুরঘরে বসে মা গীতা পাঠ করত ----


বাসাংসি জির্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি   
সংযাতি নবানি দেহী ।।


অর্থাৎ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে । তা করুক, আমার কিন্তু এই দেহটা কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করছে না । পঞ্চাশ বছরের কত ঘটনা এই দেহকে ঘিরে ---- সব, সব এক এক করে আয়নার মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অলির সঙ্গে আমার প্রেমের দিনগুলো। বেলুড় দক্ষিণেশ্বর বিড়লা তারামণ্ডল মিউজিয়াম ভিক্টোরিয়া চষে ফেলা।  একাডেমিতে নাটক দেখা ,প্রিয়া বা আইনক্স-এ সিনেমা দেখা এসি হলে, হাতে হাত ঠোঁটে ঠোঁট, উষ্ণ আলিঙ্গন। তারপর একদিন যদিদং  হৃদয়ং মম তদিদং হৃদয়ং তব..  উপমার জন্ম..ওর বড় হওয়া..স্কুল- কলেজ যাওয়া..একমাত্র বোনটার চোখের সামনে অকালে বিধবা হওয়া, কোলে দু'বছরের নীলু..মায়ের মৃত্যু.. আরও আরও কত কত ঘটনা...



     সত্যি, আমার মুক্তি চাই না, মোক্ষ চাই না, এ দেহ ছেড়ে আমি কোথায়ও যাব না । " বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় | " অলি এখনও খবরটা পেল না । পেলে যে কী করবে ! ওর কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে । এবার কী করে সংসার চালাবে অলি ! ঘরের কাজ ছাড়া ও তো আর কোন কাজও জানে না । ঘরের কাজ আর মেয়ের স্কুল কোচিং করে করেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর । জমানোও তো বিশেষ কিছু নেই । লাখ তিনেক টাকার এন এস সি, কে ভি পি আছে, সেগুলো ম্যাচিওর হতে এখনো বছর দুয়েক । একটা এল আই সি অবশ্য আছে, সেটা তো অলির নামে । আমার নামে যেটা ছিল, সেটা গত বছরই ম্যাচিওর করে গেছে । ডেথ বেনিফিট এখন তো আর পাবে না। ইস ! মৃত্যুটা যদি এক বছর আগে হত । উপমা কি কলেজ থেকে ফিরল ? বড়দি বলছিল না, কার সঙ্গে বাইকে করে আসছে। ছেলেটাকে বড়দি  যখন চিনতে পারেনি, তাহলে বয় ফ্রেন্ড টয় ফ্রেন্ড জুটিয়েছে নাকি। অলিও তো সেরকম কিছু বলেনি। ও-ও কি কিছু আঁচ করতে পারেনি ? সামনে বিয়ে ফাইনাল, এখন যদি এইসব করে বেড়ায়, রেজাল্ট ভালো হবে কি করে ? আর রেজাল্ট ভালো না হলে রেগুলারে এম এ-তে চান্স পাবে না । এমফিল-পিএইচডি তো পরের কথা ! এমনিতেই তো সংসারে ভাড়ে  মা ভবানী, একটা চাকরি বাকরি যোগাড় করতে না পারলে চলবে কী করে ?




   এক্ষুনি আমাকে এই দেহ ছেড়ে গেলে চলবে না। কতকগুলো কথা ওলিকে বলা হয়নি। বলতেই হবে | আলমারির লকারে একেবারে ভেতরের দিকে দশটা পাঁচশো টাকার নোট রাখা আছে। সেদিনই শিবমের বাবা দিয়ে গেছে,এক হাজার টাকা করে ছেলের পাঁচ মাসের মাইনে, একেবারে। অলিকে বলিনি কথাটা । টাকাটা রেখে দিয়েছিলাম এমার্জেন্সি পারপাস, কখন কী দরকারে লাগে। আমার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেও তো ইনস্ট্যান্ট কিছু টাকা লাগবে। ওই টাকা থেকে ম্যানেজ হয়ে যাবে।  শ্রাদ্ধ শান্তি লোক খাওয়ানোর ব্যাপার ট্যাপার তো পরে। কিছুদিন সময় পেয়ে যাবে। ব্যাংকেও হাজার দশেক টাকা আছে। ওটা তুলে নিতে পারবে। অসুবিধে হবে না, কারণ আমাদের জয়েন্ট একাউন্ট। কিন্তু আর একটা কথা, যেটা অলিকে বলতেই হবে, লকারে যেখানে পাঁচ হাজার  টাকা আছে ,তার ঠিক নীচে একটা ফাইলের মধ্যে দুটো মহামূল্যবান জিনিস রাখা আছে। জরুরি কাগজপত্র কোথায় কী থাকে, এসব নিয়ে ও কোনোদিন মাথা ঘামায় নি | টাকা পয়সার ব্যাপারেও ভীষণ নিস্পৃহ | রান্না বান্না , ঘর সংসার আর মেয়ের পড়াশুনো এই ওর জগৎ | এর বাইরে কোনোদিন বেরোতে চায়নি ও | এবার যে কী করবে !  




   কিন্তু আমাকে তো বলে যেতে হবে ,সেই দুটো জিনিসের একটা হল -- আমাদের পৈত্রিক ভিটে , যে তিন কাঠা জমির উপর, তার অরিজিনাল দলিল আছে ওই ফাইলটার মধ্যে । না, দলিলটা আমার কাছে রেখেছি পৈতৃক সম্পত্তিতে কারো প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে নয়। আসলে ওই দলিলের  ইতিহাস আমাকে ভীষণ টানে। ১৯৫৭ সালে ৫০০ টাকার বিনিময়ে বাবা এই জমিটা কিনেছিল। ১৯৫৭ সাল ! মানে স্বাধীনতার ঠিক দশ বছর পর | তখন আমি কোথায় ? জন্মই হয়নি আমার | কী রোমাঞ্চ লাগে এইসব ভাবতে | দলিলটাতে বাবার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। নির্জন অবসরে কখনো-সখনো দলিলটা বুকের উপর রেখে আমি বাবার হাতের সেই স্পর্শ অনুভব করি। মনে হয় বাবার রক্ত ঘাম অশ্রু আমার বুকে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে | মাঝে একবার জমিটা  প্রমোটিং-এ  দেওয়ার কথা চলছিল, কিন্তু উপমার ফাইনাল পরীক্ষা আর আমার কোচিং ওই জমিতে আছে বলে আমি রাজি হইনি। অলি-উপমা কি পারবে আমার অবর্তমানে প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিতে? মেজদা-বৌদি যা সিয়ানা ! তারপর প্রোমোটারই বা কোন চাল চালবে ঠিক আছে , দলিলের কথাটা অলিকে জানিয়ে যেতেই হবে। ভবিষ্যতে দলিলটা অনেক কাজে লাগবে। 




    আর একটা জিনিস রয়েছে ওই দলিলেরই ঠিক নিচে। ফ্ল্যাট কেনার সময় ব্যাংকের সঙ্গে আমার যে এগ্রিমেন্ট হয়েছিল, তাতে একটা ইনসুরেন্স  করা হয়েছিল, যার জন্য ব্যাংক আটষট্টি হাজার টাকা এককালীন নিয়েছিল। শর্ত লোন চলাকালীন যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার উত্তরাধিকারী যারা, তাদের কাউকেই লোনের বোঝা বইতে হবে না। ভালোই হলো ওই কাগজটা হাতে পেলে , অলি অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা রিলিফ পাবে। ও শুধু উপমার পড়াশোনার দিকটাতেই নজর দিতে পারবে।



   ওই ডাক্তার আসছে, এবার মনে হচ্ছে ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখবে। সিস্টারকে বলছে" বিয়াল্লিশ নম্বর ওয়ার্ডের পনেরো নম্বর বেডের ডেড বডিটার ওনারকে  জানিয়েছেন?"
" হ্যাঁ, স্যার।"
 "এক্ষুনি ডেকে পাঠান। বডি হ্যান্ড ওভার করে দিন |"
 "হ্যাঁ স্যার,আসছে বলল।"
 " ওকে " ডাক্তার কেস হিস্ট্রি দেখে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে শুরু করল।



 উপমা, অলি তোমরা এখনো এসে পৌঁছলে না? ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে শুরু করেছে। আমার নামের বানানটা মিলিয়ে নিলে না, আধার কার্ডে যেমন আছে "Ashoke Bose." একটা s বা e তাড়াহুড়োয়  ডাক্তার লিখতে ভুল করলে, তোমাদের পস্তাতে হবে। ব্যাংকে বা পোস্ট অফিসে আমার সামান্য যেটুকু টাকা  আছে, পেতে কালঘাম ছুটে যাবে। অলি, তুমি তো একা মেয়েকে নিয়ে কোর্ট-কাছারি করতে পারবে না | আমাকে ছাড়া কোথাও তো এক পা নড়োনি কখনো  | "


 
  চারপাশটা অন্ধকার করে আসছে মনে হয় | পুবদিকের আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে | ঝড়-বৃষ্টি নামবে হয়তো | বৈশাখ মাস | কালবৈশাখী উঠল বলে ! বলতে বলতে ধুলো উড়িয়ে এলোপাথাড়ি হাওয়ার ঘূর্ণি,সঙ্গে মুহুর্মুহু বাজ পড়ার কড়কড় শব্দ | অলি উপমা এই বুঝি আটকে পড়ল রাস্তায় | ওরা পৌঁছতে পৌঁছতে আমার বডি পৌঁছে যাবে লাশঘরে | অলি আর তোমার সঙ্গে দেখা হল না | অতগুলো দুর্গন্ধযুক্ত লাশের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না | এবার আমি দেহ ছেড়ে জল স্থল অন্তরীক্ষ চিরে অনেক অনেক দূরে পাড়ি দেব ,কোথায় কোন নিরুদ্দেশে ,খুঁজব আমার আমিকে ....ওই শুনতে পাচ্ছি আত্মার ভেতর বারবার ডানা ঝাপটাচ্ছে হোমা পাখি .... 



  

" মা, বাবা আজ পড়াতে যাবে না ? "
 "যাবে তো, ও ঘরে ঘুমাচ্ছিল, দেখ তো উঠেছে কি না, না উঠলে ডেকে দে, এক্ষুনি ছাত্ররা চলে আসবে ডাকতে। পাঁচটা বাজে প্রায়। "



 " ডাকছি " অশোকের ঘরে ঢুকেই উপমা মৃদু নাসাগর্জন শুনতে পেল। দেখল অঘোর ঘুমে বাবা। মাথার পাশে উল্টে রাখা জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ প্রথম খন্ড। বইটা উপমা  হাতে নিয়ে দেখল, মহাপৃথিবীর " আট বছর আগের একদিন " কবিতাটা খোলা রয়েছে। তার মানে বাবা এই কবিতাটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কবিতাটা বাবার অন্যতম প্রিয় কবিতা, উপমা জানে। শুধু এটাই বা কেন ছোটবেলা থেকে কত কবিতায় না শুনেছে বাবার মুখে। মনে পড়ে উপমার, ছোটবেলায় বাবা যখন "বোধ " কবিতার " মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয় শান্তি নয় কোন এক বোধ কাজ করে " এই পর্যন্ত বলত  উপমা সাথে সাথে বলে উঠত " আমি চলি  সাথে সাথে সেও চলে আসে আমি থামি সাথে সাথে সেও থেমে যায় থেমে যায়। ”



 আর দেরি করা ঠিক হবে না, মা বকা লাগাবে। উপমা তাড়াতাড়ি করে অশোকের কানের কাছে মুখ রেখে ডাকল " বাবা, ও বাবা, ওঠো পড়াতে যাবে না ?"



 ধীরে ধীরে চোখ মেলল অশোক। যেন কোন অলীক স্বপ্নের  জগত থেকে প্রত্যাবর্তন করল বাস্তবের মাটিতে।

" হ্যাঁ যাবো তো, ক'টা বাজে রে ?"

"পাঁচটা "

" আগে ডাকিস নি কেন ? আজ বিএ ফার্স্ট ইয়ারের হিস্ট্রি অনার্স ক্লাস আছে। কত দূর থেকে ওরা আসে। "

" তোমার হুশ থাকে না ?"

অলি বাবা- মেয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়াল " দুপুরে কেউ এমন  নাক ডেকে মাঝরাতের মতো ঘুমায় ?"

 " আর কথা বাড়িয়ো না তো,চা-টা বসাও। " বলতে বলতে জামা -প্যান্ট পরে নেয় অশোক।


"এখন আর চা খেতে হবে না, আগে যাও, আমি উপমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। "


 ডোর বেলটা বেজে উঠে। দৌড়ে দরজা খোলে অলি। কোচিং-এর কয়েকজন ছাত্র -- পায়েল রিয়া শুভ ওরা সবাই এসে হাজির। " ম্যাম,স্যার আজ পড়াবে না?"


 " হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়াবে তো, যাচ্ছে তোমরা যাও একটু বোসো গিয়ে। "

" চল, চল স্যার আসছে, স্যার  আসছে " বলতে বলতে ওরা ছুটল।




 


 

কবিতা উপন্যাস * দীপংকর রায়




 " বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল  ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় " লিখেছিলেন জীবনানন্দ । কবি দীপংকর রায়ের  কবিতা স্বতন্ত্রভাবে , অতলস্পর্শী ভাবনার গভীরতায় স্পর্শ করে  আমাদের চৈতন্যের নদী । দেশজ  আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে , বিরল পংক্তি বিন্যাসে এক মায়াময় ব্যতিক্রমী কবিতাজগৎ সৃষ্টি করেন তিনি । এখানে আমরা ধারাবাহিকভাবে পড়ছি তাঁর একটি কবিতা উপন্যাস ।



কোথাকার অতিথি আমি ( মানস ভ্রমণ) 


পরবর্তী পর্ব 



নিয়ম ভেঙেছিলাম। রওনা হয়েছিলাম কজনে । তারপর একা। 

একদম একা? 

তা তো না  !  তা হয় না। 

এই যে এসেছি, অনেক একাকে ভেঙে। 

ভাঙতে ভাঙতেই মিশে গেলাম সেই স্রোতে ।---


বয়ে যাওয়া তো থাকবেই। থাকবে বিশ্রাম। 


ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? 

ঘুম যেন ভুলিয়ে দিয়েছিল কোনটি আমার দেশ। 

পথে পথে, নদীতে ,

বাতাসে বাতাস ভেঙে, এক এক জায়গায় একটুখানি ,'


কে যেন জানলা খুলে ডাকতে থাকলো: ওহে, এদিকে এসো , এইখানে...

দোষ হবে না তো? 

হাত ধুয়ে ফেল সাবানজলে, ----- তোমার কোনো বন্ধন নেই ।

ওই তো আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। ঈদের চাঁদ। 

তুমি দেখবে না, তা কি হয়? 


কবেকার জোছনা খন্দকার বলেছিল যেন। 

কোন সে অতীত? 

জন্মান্তরের ওপার থেকে ডাক এসেছিল জানলা মেলিয়ে ।


সাড়া না দিয়ে কি পারি? 

কীভাবে যেন চলে যাই -----


ইফতারের সন্ধ্যা। মোয়াজ্জিনের ডাক শেষ হলো। 

তথাপি গোল হয়ে বসে পড়তেই হলো ,------ 

এক আকাশ তারায় তারায়, খুব কাছাকাছি বিনিময় করতেই হলো,কুশল ----

করোনা, সে কোন বস্তু ----বলছিল, মোকসেদ ,সিরাজুল... 



তির তির করে বইছিল নবগঙ্গা। ফাল্গুনের হাওয়া-রোদে সে যে কী বর্ণময় দেখাচ্ছিল তাকে! কতো কথা তাকে ঘিরে। ওই তো, স্কুল থেকে একগাদা বই-খাতা বগলদাবায় ফিরছি। ওই তো, হাট থেকে ফিরছি দ্রুত পায়ে। কেন, না, খেয়া যদি চলে যায়, সন্ধ্যা যদি হাজারি মন্ডলের বাগান পার হবার আগেই নেমে আসে! 


ওই তো, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে, জরাসন্ধ, শীতলা, কালী । মাটির তৈরি নয়? সন্ধ্যা হলে ,অশ্বত্থ তলায় ওরা জীবন্ত চেয়ে থাকে যেন। কতো তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাবো এই পথটুকু। বাবুঘাটের কাছে এসে, ছুট লাগাই এক নিঃশ্বাসে। যেন দমবন্ধ ছুট লাগালে আর কোনো ভয় নেই। এক নিঃশ্বাসে পার হয়ে যাবো আইশোদাদের বাড়ি। 


সব তো সেদিনের কথা! 

আজ কেন জানি মনে হয় , সত্যিই কি, সত্যিই কি এইসব কোনোদিন ছিলো? 


নবগঙ্গা ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাসে ।
খাড়া পাউড়ি ভেঙে দমকা বাতাসেরাও যেন চায় পিছন ফিরে। 
আমি কার ঘাটে ফিরে চাই?



 কদমফুল ঝরিয়ে মালোপাড়ার ভাঙন জানান দেয়, জল-শ্যওলারা সুকুমার মাঝির ভেসাল- জালে চুচড়ো মাছেদের সঙ্গে ভেসে জিলকোতে থাকে। 


আমি কি আজও দাঁড়িয়ে আছি খালুই নিয়ে , বাঁশজঙ্গল নিচু হওয়া সেই 
মালোপাড়ার ঘাটে? 


কোথায়, কেউ নেই ।
সুকুমার মালো নেই । বৈদ্যমাঝিও নেই । 
কদম গাছটা আছে আজ ও, কালো জলে ছায়া ফেলে। 


 2 .

এখানে কারো মুখে মাক্স নেই। 
পুলিশ এলে কোমোড়ের গামছা পেচায় মুখে। 


ফুলমিঁয়া বলছিল, ' কীসব শুনতিছিরে ভাই, চারদিকি এতো মানুষ মরতিছে কিসের জন্যি ? করুনা না করোনা, কী কয় জানি--- কী এক রোগের বালাই আলো, কওদেহিনি কনে যাই? মাঠে-ঘাটে কনে পাই সাবান-পানি , তাই কও তো একবার---? ' 



আমি ভাই ওসব বুঝিনে,নবগঙ্গায় গোসল করি। কলের পানিতে হাত ধুয়ে ইফতার যাই। সিয়েরিতে রাত-ভোর হলি, ওজু করে নমাজ আদায়ে দাঁড়াই। ' 

পল্লীতে করোনা পথ পাইনি। যা কিছু শহরে। 


এদের বিদেশ- বিভুঁই নেই। খিদে পেলে গোগ্রাসে খায়। মাঠে -ঘাটে ধান কাটে। মনের আনন্দে গায় জারি-সারী। সুরেরও  ধার ধারে না। যা আসে তাই। নিজেরাই কথা বসায় আপন ছন্দ-সুরে। 


তাই, করোনা এখানে পথ পাইনি। সে যেন বড়ো নদীর ওপারের ঢেউ উতরে এগোতে পারেনি ।


এত বাতাসে ভেঙে যায় তার লালারসের পথ---- ?


 যা কিছু নদী ঝাঁপিয়ে এগোয়, তা যেন আকাশের ----


কেউ হয়তো গামছা পেঁচিয়ে শহর থেকে ফিরলে ,ফুলমিঁয়া বলে, আমি ভাই এহনো যাইনি কোথাও। যদি লাগেই তো ম্যানাগাইডা রইছে তো , তার মুহির টোনাডাই গলায়ে নিতি হয় তো নিবানে, তারপর না হলি পাকখাবানেই মলনের খুঁটোয়! 


গ্রাম থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আসে পঙ্কজ শহরে। দাশেদের সেল্সম্যন। সেও শহরে আসার সময় লাগিয়ে নেয় ভাজকরা রুমাল  মুখে। তারপর অনভ্যাসে ঝুলিয়ে দেয় গলায়। দাশ বলে, এই পঙ্কজ, মুখোশ লাগা, না হলি কিন্তু মেলেটারি দেখলি দিবেনে দোয়ানের ঝাপ ফেলায়েই হয় তো। 


স্বপন মুদির দোকান সেরে ইদানিং স্থানে যায়। সাবান ঘসে ।
ফুলমিঁয়ার সাবান নদীর মাটি। তাই খানিক মাথায় শরীরে ঘসে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নবগঙ্গায়। 


আমি পড়েছি বড়ো ঝামেলায়। সেই যে বর্ডার পেরিয়ে বাশেঁর নিচে দিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম, তারপর এদিক ওদিক সকলকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে , এখন একা। সবাইকেই এক ফুঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি ওপারে। 


ভাবলাম, এমন সুযোগ তো আর হবে না, যদি করোনার তাড়নায় খানিকটা অনেকদিন পরে কাটিয়ে যেতে পারি এই দেশটায় ।


কতোদিন খন্দকার- লিলি- পপি-ডলি-মলিদের দেখিনি! 
এই সুযোগে সকলের কাছেই একবার ঘুরে আসবো। 


এক একজনের ঠিকানা এক এক দিকে। 


সময় সুযোগ পেলে ,হাওয়া বাতাসেই  ভেতরের ডানা জোড়া মেলবো । হাওয়া বাতাসেই ঘুরবো।




এখন আউসএর কাল। ধান কাটা চলছে। কাটা ধানগাছের মোথায় জোছনার গড়াগড়ি। কী যে  বর্নময় !
শুনশান বাতাসে রাত শেষ ভোরের গন্ধ। খানিকটা জড়িয়ে যায় গায়। ফোনে গালাগাল খাই। কাদের যেন লৌকিকতা নষ্ট হলো। গীতা না উর্মি শ্রাবণী না লাবণি, কতো সব নাম-ধাম তাদের! কারো যেন ঘুম নেই এই আহম্মকের জন্যে। 

কারা যেন কতো মাছ কিনে পরিজন-কথা শোনায় : এক কেজি মাছ পনেরো শো, কেউ নদীর আড় কেনে পাঁচ হাজারে ।


কার কাছে যাই? 
কার ঘর এখন আমার! 


লঞ্চে পার হই পদ্মা। আরিচায় শিশু কিশোর -কিশোরীদের জলবিহার দেখি। 



কতকাল আগে, কোনো এক রাতের জোছনায়, লঞ্চে মধ্যরাত্তির পার করে কার যেন অপেক্ষা ছিল, কার যেন অপেক্ষার ভোর বুকে আগলে বসে থাকা--- তারপর ,শিউলিফুলে বদল হয়েছিল এক আকাশ নক্ষত্র- পথ !


মহাসংগমের সেই রাত কতকাল পেছনে পেছনে ছোটেনি এমন ! 
আজ ভরা সংসার তার । আমিই কেবল ঘুরে মরি এ ডাল থেকে সে ডাল ?


কোন বাংলার রিক্তহাতে কেউ যেন বাড়িয়ে ধরেছিল এক খন্ড মোম। সেই আলোয় কোন মুগ্ধতা প্রকাশ পায় আজ? 


আমি কি কারো উৎসর্গেই সাড়া দিতে পারি? 


আতঙ্ক বাড়ে দু' দিকেই। এক দিকেও নিশ্চিন্ত নয় কেউ। মৃত্যুমিছিল বাড়ে। এখানে দশ তো ওখানে পঞ্চাশ। কেউ কারো পরিজনকেও চিনতে যায় না শ্মশানে। গোরস্থান নেই! ফাঁকা জায়গা পেলেই বেলচায় ছুঁড়ে দেয় মৃত শরীরটাকে। 


শুধু দেখছি ফুলমিঁয়ার  চিন্তাকে ছুঁতে পারে না করোনার  তাড়না, সে মহাসুখে ধানগাছের গোড়ায় মারে পোচ। 


কোন দিকে যাই? 


লম্বা পথে এমন কোনো পথ নেই, যেখান দিয়ে যেতে পারি, একজনেরও সংসার চিনতে। 


নগরের ঘুম নেই। কেউ ঘুমায় না যেন। ঈদ আসে। আসে ষষ্টির জামাই ডাক: আমি কি কারো আপ্যায়নের দাম দিতে পেরেছি ?



এক এক জনের এক এক ব্যঞ্জন গিলে, সেই যে 
পথে পথে ভেসে বেড়াচ্ছি, সেও তো কম দিন হলো না! 


আড়াইমাস কেটে গেল প্রেমে , অপ্রেমে ----


ভিডিওকল  আসে, এক এক দিক থেকে ।


রাতের আকাশে এক এক দিকে প্যাঁচা হয়ে ঘুরি। কাউকেই দেখাতে পারি না মুখ। 


তুমি কি চেন ,  তুমি কি চিনতে পেরেছ আমায়? 


সুখ ও সম্ভোগে বসিয়েছ আড়াআড়ি ঘুম চোখ। আমারই ছায়ায় আমারই নকল! একটা অঙ্কও শেষপর্যন্ত মেলাতে দাও নি । তবু হাতে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম এক একটি স্থলপদ্ম ।


প্যাঁচা হয়ে প্যাঁচার চোখের কোনে যে মাঠের খুঁদকুড়ো খুঁজি, তা কি প্রকৃত আদার ?


ক্ষুধার্ত আমি। বহু খিদে নিয়ে এক একটি  গৃহ কোণে, এক এক ধরণের লৌকিকতায় নীল হয়ে ,পথে পথে ঘুরি একা। নিতান্ত একাকী নিজেই নিজের ছায়াকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে, পুনরায় পথ ভাঙি।




                                                                       ( ধারাবাহিক ) 


গনেশ চন্দ্র পাঠক




 ইতিহাসের ছাত্র গণেশ চন্দ্র পাঠক। স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পূর্ণ করছেন সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাসের আয়নায় কল্পনার চোখে ফিরে দেখছেন স্বাধীনতা উত্তর এক উদভ্রান্ত যুবকের কাহিনি।



 প্রেমিক হতে পারিনি কোনোদিন


খোলা চুল, কপালে কালো টিপ ও আলতা পায়ে লাল শাড়ি পরা অসম্ভব সুন্দর দেখতে এক মেয়ে। অপ্সরা বললেও ভুল হবে না। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছে আমার দিকে...আমি গণেশ। গ্রামের ছন্নছাড়া অথচ সকল গ্রামবাসীর বিপদে পাশে দাঁড়ানো এক প্রতিবাদী যুবক। ওর নাম স্নেহা। ঠিক জানি না এটা ভালোবাসা কী না! তবে সে এক ফোঁটাও চোখের আড়াল হলে মনের মধ্যে খরা অনুভব করি। যেন কতদিন বৃষ্টি হয়নি এই আকাশে!


সালটা ১৯৪৭। সবে সবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত - নিপীড়িত দেশগুলো স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলো গায়ে মাখছে। ভারতও সবে স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছে। এর পূর্বে বর্গীর দল বাবা-কাকাদের চাষ করা জমির অর্ধেকের বেশি রাজস্ব হিসেবে কেড়ে নিতো। ব্রিটিশের সাদা চামড়ার একদল গুণ্ডাবাহিনী আমাদের মা - বোনদের সম্মানে আঘাত করতো। মামলা করা হলে উল্টে আমাদেরই মুখে নোংরা ফেলা হতো প্রকাশ্যে।


আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি। আজ বাবা-কাকাদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকাংশ কেউ কেড়ে নেয় না। মা - বোনদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে দেশ। এরকমই এক আনন্দের দিনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমটা ভেঙে গেল! বাইরে থেকে ভীত গলায় কেউ যেন বলছে " গণেশ পালিয়ে যা এখান থেকে", বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা বাবার গলা। কিন্তু কেন পালিয়ে যেতে বলছে, সেটাই স্পষ্ট করতে পারছিলাম না। মগজে ঢুকছিল না কিছুই। হঠাৎই দেখি, সাদা পাজামা পাঞ্জাবী ও মাথায় টুপি পরা কিছু লোক আমার দিকে তেড়ে আসছে লাঠি নিয়ে। আমি আশ্চর্যভাবে তাকিয়ে রয়েছি লোকগুলোর দিকে,দেখি এদের মধ্যে প্রায় অনেকেই আমার পরিচিত। গ্রামেই থাকা মুসলমান পাড়ায়। তাদের মধ্যে একজন আমার পিঠে লাঠির এক ঘা বসিয়ে দিলো। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আনমনে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করলাম ---আমাকে মারছো কেন? উত্তরে চিল্লিয়ে সাবির দা বলে উঠলে " তোরা ব্রাহ্মণের জাত, তোরা হিন্দু, তোদের এলাকায় ঠাঁই হবে না। ভাগ এখান থেকে কাফেরের দল।" বলে আর এক ঘা বসিয়ে দিলে মাথায়। এবার তালু ফেটে অঝরে রক্ত পড়ছে মাটিতে। রক্তের লাল রং চোখে পড়তেই মনে পড়ে আসিফ চাচার কথা; তিনি বলতেন " হিন্দু মুসলমান আমরাই তৈরি করেছি, আসলে সবার রক্তই তো লাল।" আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি আঘাতগুলো থেকে। তবু ঠোঁটের কোণায় একটা মৃদু হাসি নিয়ে আসিফ চাচাকে যেন বলতে ইচ্ছে করছিল,-- রক্ত সবার লাল হলেও মানুষ সবাই হতে পারে না আসিফ চাচা, মানুষ সবাই হতে পারে না।


দেশে তখন বহু সমস্যা। সদ্য প্রধানমন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। তাঁর অদম্য প্রয়াস সত্বেও দাঙ্গা, হানাহানি, উদ্বাস্তুগত সমস্যা মিটছে না কিছুতেই। তিনি কী প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভে এসব করিয়েছেন? কংগ্রেসেই কী তবে দাঙ্গা লাগিয়েছে? আর. এস. এস. এসবের মূল উৎস? নাকি মুসলিম গোষ্ঠী? এ ধরনের প্রশ্ন আমার মতো দেশের প্রত্যেক সাধারণ যুবকদের ভাবিত করে তুলছে। শুধু উত্তর মিলছে না কিছুর। 


এসব ভাবতে ভাবতেই গ্রাম থেকে বাবা - মা'র হাত ধরে রওনা দিলাম শহুরে রাস্তায়। ঘুরতে যাচ্ছি না। আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মহামেডানরা। মা'র চোখে জল দেখে জিজ্ঞেস করলাম --মা, কাঁদছ কেন! আমরা তো এদেশেই থাকছি, এদেশ থেকে তো অন্য কোথাও যাচ্ছি না! মা বললেন, ত্রিশটা বছর যে গ্রামটাকে আগলে ধরে রেখেছি, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালবাসা রয়েছে, তাকে ছেড়ে যাওয়া হলেও ভুলে ফেলা যায় না বাবা। জন্মভূমির প্রতি মানুষের টান চিরকালের। জন্মভূমির কথা শুনে আমি ভাবছি দুই বাংলার মধ্যবর্তী গ্রামগুলোর মানুষের কথা, পাঞ্জাব কাশ্মীরের মানুষের কথা; যারা একদেশ থেকে গলা ধাক্কা খেয়ে অন্য দেশে গিয়ে পড়েছে অথচ যে দেশ ধাক্কা দিচ্ছে সে দেশই জন্মও দিয়েছে। ভাবছি এদের এ সংঘর্ষ ইতিহাসে লেখা হবে না! এই ভয়ানক দৃশ্য ইতিহাস গড়বে না!


এসব ভাবলেও সবথেকে যেটা বেশি ভাবছিলাম, যার কথা আমাকে ব্যাকুল করে তুলছিল, সে তো স্নেহা। ভাবছি তার চোখ, চুল, কালো টিপ, লাল শাড়ি এসবের কথা। ভাবছি ওদেরও হয়তো এভাবেই তাড়িয়ে দিয়েছে মুসলমানদের দল। তার সাথে যদি একবার দেখা হত...


এমন সময় দেখি রাস্তার মাঝে এক পাঞ্জাবী টুপি পরা ছেলেকে চারজন পাগড়ি মাথায় তিলক পরা লোক বিচ্ছিরিভাবে লাঠি চার্জ করছে। সেই মুসলমান ভাই চিৎকার করে বলছে" আমি হিন্দুস্থানী, আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি ভারতকে ভালোবাসি, আমায় মারবেন না"। লোকগুলো এসব কথার মানে  না বুঝে শুধুমাত্র মুসলমান বলে তাকে মেরে চলেছে একইরকম ভাবে। আমি দৌঁড়ে যেতেই মা হাতটি ধরে বললেন " বাবা, তুই আমার একমাত্র সন্তান, যাস না, আমি তোকে হারাতে চাই না"। মুসলমান ভাইটাও তো কারো সন্তান, ওর মাও তো এরকম ভাবে! এসব বলতে বলতে আমি দৌঁড়ে ছেলেটার কাছে যাই। চিৎ হয়ে রাস্তার মাঝে পড়ে থাকা দেহটায় এখনো প্রাণ আছে। ধীর গতিতে কিছু যেন বলছে ছেলেটা। বলছে,-- ওর নাম রহিম ও এদেশেরই ছেলে। আমি বললাম কিছু হবে না তোমার, পাশেই হাসপাতাল, আমি নিয়ে যাব। রহিম আমার হাতটি দুহাত মিলে ধরে বলে উঠলো " না ভাই আমি আর বেশিক্ষন নেই, আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে; তবে তোমার এহেন পরিচয় আমার দেশের প্রতি হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে দিয়েছে, আমার দেশের সচ্ছ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছে, দেশ ভাইদের প্রতি ক্ষোভ, অভিমান মিটে গেছে নিমেষে। জয় হিন্দ। বন্দে মাতরম।" শেষ! মরে গেলো বেচারা। কপালে লাঠির আঘাতটা শেষ করে ফেললো তাকে। খুন হয়ে গেলো দেশের সন্তান দেশেরই আর চার দেশের সন্তানের কাছে।


অসহায় হয়ে বুকে পাথর চেপে হেঁটে চলেছি কলকাতা শহরের রাস্তায়। একটাই প্রার্থনা, হে ঈশ্বর ,আমার দেশ আজ হিংসার সম্মুখীন তাকে বাঁচাও ,হে ঈশ্বর তাকে বাঁচাও।


রাস্তার ধারের এক দোকান থেকে রেডিওর আওয়াজ ভেসে উঠছে কানে। এক বৃদ্ধ বলছেন " দেশ তব শানত হোগা জব লোগ শানত হোঙ্গে।" আন্দাজ করলাম ইনিই বোধহয় মহাত্মা গান্ধী। যাইহোক ,আমরা তিন রাত তিন দিন হাঁটার পর অবশেষে কলকাতা শহরে গিয়ে পৌঁছলাম। বাবার এক বন্ধুর দৌলতে থাকার জন্য একটা ঘরও পাওয়া গেলো। কিন্তু খাবার! খাবার আসবে কথা থেকে! কারখানা বন্ধ হয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। শ্রমিকের অবস্থাও একেবারে নাজেহাল। চারিদিকে শুধু ধর্ম নিয়ে ভাগাভাগি। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণদের।


এরকম ভাবে চলতে থাকে সব। বছর পার হয়। শুধু সমস্যা যেতে চায় না কিছুতেই। দেশ তখন মহাত্মা কে হারিয়েছে। আরো হারিয়েছে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া বহু সৈনিকদের। পাকিস্তানের কবল থেকে বাঁচতে বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা দলে দলে জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভারতে। অনুরূপ ভারত থেকেও একই ভাবে মুসলিমরা গিয়ে ঠেকছে পাকিস্তানে ও পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে। কেউ চাকরি ছেড়ে, কেউ জন্মভূমি ছেড়ে, কেউ আবার প্রেম! অজস্র ভাবনা নিয়ে একে অপরের কাঁধে ভর করে ভেঙে পড়ছে অনায়াসে। ভাবছে হয়তো পরাধীন থাকলে এভাবে মারা যেত না কেউই। এভাবে দেশ মাকে দু টুকরো হতে হতো না কখনোই। 


খবরের কাগজ বিক্রিতে সেরকম আয় হতো না বলে নতুন একটা কাজ খুঁজতে বেরোলাম। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই জানি। কোনো কাজকে কোনদিন ছোট মনে করিনি আমি। রাস্তায় রাস্তায় একে ওকে বলতে লাগলাম কাজ দেবে গো কাজ.. দরজায় দরজায় গিয়ে বলতে লাগলাম নিজের এবং গ্রামের দুঃখের কথা। আশ্বাস দিয়েছে অনেকেই কিন্তু কেউ কাজ দিয়ে চায় নি। আমার কাকুতি মিনতির আওয়াজ শুনে দরজা খুলে এক মহিলা বাইরে বেরিয়ে এলো। ওমা কি দেখি আমি! সেই খোলা চুল, কালো টিপ, লাল শাড়ি পরা সেই মেয়ে। স্নেহা। তফাৎ কেবল সিঁথিতে সিঁদুরের। স্নেহা আমার দিকে মুখ ঘোরাতেই আমি ' প্রণাম দিদিমণি ' বলে দৌঁড় দিলাম রাস্তার দিকে...


কিছুক্ষণের জন্য দেশের বর্তমান করুন অবস্থার থেকেও আমার মনের অবস্থা অনেক বেশি অসহায় ও একা হয়ে পড়েছিল। তবে খুশি হচ্ছিলাম এই ভেবে যে মেয়েটা ভালো আছে, বেঁচে আছে। 


কয়েক টাকা পকেটে থাকায় এক দোকান থেকে তামাক নিয়ে তা টানতে টানতে চায়ের দোকানে বসে থাকা চারজন ব্যক্তির দেখা পাই। দেশ - বিদেশ - স্বাধীন - নেতা এভাবেই বলেছে যেন কিছু। কথাগুলো স্পষ্ট শোনার কৌতূহলের ফলে আমি তাদের পাশে গিয়ে বসলাম। ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল গান্ধীজির কথায় পাকিস্তানকে দেশের এতো পরিমাণ অর্থ দেওয়া নাকি ঠিক হয়নি! অন্য একজন এর জবাবে গান্ধীজি অহিংসার প্রতীক, তিনি নাকি কোনদিনও হিংসার সাথে আপোষ করেননি। আর পাকিস্তানকে অর্থ না দিলে তারা নাকি হিংসার পথ অবলম্বন করত এসব। মাথা নাড়ালো বাকি দুজনও।


বল্লভভাই প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন। কাশ্মীর, জুনাগর, হায়দ্রাবাদ সহ ছোট বড়ো ছ- শয়ের বেশি দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকরন নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।


এমনিভাবে বছর কাটতে থাকে । শান্ত হতে থাকে শহর। রচিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান। আইন প্রণীত হয় সুস্থভাবে। বিচার ব্যবস্থাও গঠিত হয় নিজ ধাঁচে। স্বাধীনতার প্রকৃত হাওয়া দেশবাসী অনুভব করে। আমিও দেশের সাথে সাথে নিজেকেও গঠন করি নিজের মত করে। আমি আজ ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক। আমি ছাত্রছাত্রীদের পুঁথিগত শিক্ষার সাথে সাথে মানুষ হওয়ার শিক্ষাও দিই। ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পড়াই। শুধু ভাল প্রেমিক হতে পারিনি কোনদিন।




গল্প * বিশ্বনাথ পাল




প্রবহমান জীবনের সংগ্রামের প্রতিটি বাঁক , দ্বন্দ্ব-সংঘাত মুখর মানুষের জীবনের প্রতিটি ওঠাপড়া, নিসর্গের হাতছানি বিশ্বনাথের কলমে মূর্ত হয়ে ওঠে । যেমন কবিতায়, তেমনই গল্পে- উপন্যাসে। এখানে আমরা পড়ব একটি ভিন্ন স্বাদের গল্প, বিশ্বনাথের কলমে।




 ডাক

বিশ্বনাথ পাল


‘পোসান্তদা! খবর আছে।’ পিন্টুর মুখে খবরের কথা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠল প্রশান্ত।

পিন্টু ততক্ষণে দোকানের ভিতরে ঢুকে আর সকলের কান এড়ানো নিচু গলায় কিছু বলতেই আরও চনমনে প্রশান্ত রাজুকে বলল, ‘তুই দোকানটা সামলা, আমি আসছি।’

বছর পনেরোর রাজু প্রশান্তর দোকানে কাজ করে। 

অনেকদিন পর ডাক এল প্রশান্তর। অবশ্য খুব কম লোকই প্রশান্তকে প্রশান্ত বলে ডাকে। বেশির ভাগই বলে পোসান্ত। ঠিক যেমন অনেকে সিনেমার প্রসেনজিতকে বলে পোসেনজিত। ডাক না এলে হাত দুটো নিশপিশ করে। কাজকর্মে ভুল হয়ে যায়। তিনটেকে চারটে করে দিতে গিয়ে তিনটেই  দিয়ে ফেলে। দুটো দুধ, একটা চিনিছাড়া লিকার বানিয়ে দেওয়ার সময় তিনটেতেই চিনি দিয়ে দেয়। খরিদ্দার সামান্য বিরক্তি দেখায়। কিন্তু বেশি কিছু বলার সাহস দেখায় না। এ তল্লাটের মানুষ জানে তার মারকুটে মেজাজের কথা। পেশা তার চা বানানো হলেও নেশা মানুষ মারা। একটু ভুল হল, সেই সব মানুষ, যারা ধরা পড়ে। চুরি তো অনেকেই করে, এসডিও অফিসের সাহেবের ড্রাইভার— দূরত্বে জল মিশিয়ে তেল চুরি করে, মাংসের দোকানের কালু— ওজনে কম দেয়। কিন্তু তাদের গায়ে প্রশান্তর বিচারের হাত ওঠে না। শুধু যারা ধরা পড়ে কিংবা সন্দেহের বশে জনরোষের শিকার হয়, প্রশান্ত তাদের উদোম কেলিয়ে সুখ পায়। 


দুই


বছর বাইশ-তেইশের একটি রোগা ছেলেকে নির্মমভাবে মারা হচ্ছে। রাস্তার পাশে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে। ছেলেটাকে ঘিরে তৈরি হওয়া মারমুখি বৃত্ত। বৃত্তের ফাঁকে দু-এক জনের উৎসাহী হাতে ধরা মোবাইল ফোন।


ভিডিও হচ্ছে। হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হবে। প্রতিবাদও দেখা যেতে পারে। শুধু ছেলেটা তখন থাকবে কিনা সন্দেহ। সাইকেলটাকে একপাশে কোনওমতে রেখে ভিড় সাঁতরে একদম ছেলেটার সামনে পৌঁছে মারার কান্ডারী হয়ে গেল প্রশান্ত। এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে  লাগল ছেলেটার মুখে বুকে। কী তার অপরাধ— জানার ফুরসৎ হল না। প্রশান্তর একটা ঘুষিতে ছেলেটার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। কিন্তু উত্তেজিত মারমুখি ভিড়ের কোনও ভাবান্তর হল না।

হাত খোলা থাকলে ছেলেটা নিশ্চয়ই হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা করত। ভিড়ের গুঞ্জনে কান পাতলে বোঝা যাচ্ছে চোর সন্দেহে মারা হচ্ছে ছেলেটাকে। একটু আগেও ছেলেটা বার বার বলছিল সে চুরি করেনি, তাকে মিথ্যেই সন্দেহ করা হচ্ছে। সে এসেছিল তার মাসির বাড়িতে। দু’-তিনটে গ্রাম পরেই তাদের বাড়ি। কিন্তু মারের চোটে এখন আর কিছু বলছে না, কথা বলার শক্তিটুকুও যেন আর শরীরে অবশিষ্ট নেই। 

ইতিমধ্যে একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর মহিলা এসে হাজির। ছেলেটার মা। মারে উন্মত্ত জনতার হাতে পায়ে ধরছে, ‘ও বাবারা, আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। আর মেরো না, ও মরে যাবে। এবার তোমরা ছাড়ান দাও। ওকে হাসপাতালে পাঠাও।’ 

এই কথা শুনে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একজন ষণ্ডামার্কা চেহারার লোক। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হরেন মণ্ডল। বলল, ‘ছাড়ব? ঠিকাছে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আসো।’ 

‘ও বাবা, আমি গরিব মানুষ। পঞ্চাশ হাজার টাকা কোথায় পাব? ওকে ছেড়ে দাও। তোমাদের পায়ে ধরি। ও তোমাদের কিছু চুরি করেনি।’ 

হরেন মণ্ডল বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে, পঞ্চাশ না পারো, চল্লিশ দাও। ছেড়ে দিচ্ছে তোমার ছেলেকে।’ 

‘ও বাবা, আমি গরিব বিধবা। লোকের বাড়িতে কাজ করি আর ছেলেটাকে নিয়ে থাকি। চল্লিশ হাজার টাকা এক সঙ্গে চোখেও দেখিনি।’

ইতিমধ্যে কোনও একজন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ফোন গিয়েছিল থানায়। ফলে থানার বড়বাবু দু’জন কনস্টেবল নিয়ে হাজির ঘটনাস্থলে। তাঁকে দেখে জনতা মারায় বিরতি দিল। যেন বিজ্ঞাপনের বিরতি। বড়বাবুকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবার মার শুরু হবে।  

বড়বাবু বললেন, ‘ওকে এভাবে মারা হচ্ছে কেন?’

‘ও চুরি করেছে স্যার।’ হরেন মণ্ডল বলল।

‘চুরি করেছে! ও কার কী চুরি করেছে?’

এক জন বলল, ‘ও রতনদের গোরু চুরি করেছে।’

‘কে দেখেছে ওকে চুরি করতে?’

জনতা নীরব। কেউ চুরি করতে দেখেনি।

বড়বাবু বললেন, ‘রতন কে?’

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন তিরিশ বত্রিশ বছরের স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা ছেলে বেরিয়ে এল। তার কথার মর্মার্থ হল, তাদের গোরুটা সকাল থেকেই নিখোঁজ। আর দুপুর বেলায় এই ছেলেটাকে তাদের বাড়ির পাশের মাঠে সন্দেহজনকভাবে ঘুরতে দেখা যায়। তাই ও-ই নির্ঘাত গোরু চুরি করেছে।

বড়বাবু বললেন, ‘বাঃ, আইন তোমরা নিজেদের হাতে তুলে নিলে একজনকে চোর সন্দেহ করে? থানা পুলিশ আছে কী করতে? সরুন, সরুন সবাই! ছেলেটাকে এখুনি হাসপাতালে পাঠাতে হবে।’

ছেলেটা এর মধ্যে নেতিয়ে পড়েছে। গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা বলে শরীরটা দাঁড়িয়ে আছে, না হলে এতক্ষণ পড়ে যেত মাটিতে। মাথাটা ঘাড়ের এক পাশে ঝুলে পড়েছে।

বড়বাবু কনস্টেবল দু’জনের সাহায্যে দড়ির বাঁধন আলগা করে ছেলেটাকে জিপে তুললেন। ছেলেটার মা-ও গাড়িতে উঠল নিজের পরিচয় দিয়ে। 

প্রশান্তর মন খারাপ হয়ে গেল। ইস! আরও খানিকক্ষণ মারার আরাম নেওয়া যেত। এখনও হাত নিশপিশ করছে। বড়বাবু এই অসময়ে না এলেই ভাল হোত। 

মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা ছেলেটাকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন। বডি ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হল। বড়বাবু পুলিশে চাকরি করলেও শরীরে দয়ামায়া আছে। বাইশ-তেইশের একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা এত সহজে মিটে যাক চাইছিলেন না। তিনি ধারা ৩০২-এ অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করলেন।


ইতিমধ্যে সমাজ মাধ্যমে ছেলেটাকে মারের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল। অনেক ‘বুড়ো আঙুল’, ‘চোখের জল’-এর পাশাপাশি ‘আহা রে’ ‘কী নৃশংস’ ইত্যাদি মন্তব্যের বান ডাকল। কয়েকজন জানাল তারা ছেলেটিকে চিনত। তাদেরই পাড়ায় থাকত। আই টি আই পড়ছিল। 

কলকাতার সব ক’টা বড় কাগজেই একটি যুবকের চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর ছাপা হল। পুলিশের হাতেও পৌঁছল মারের ভিডিও। প্রশাসন নড়েচড়ে বসল। ভিডিও দেখে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হল। প্রশান্তকে এবং আরও দু-এক জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। হরেন মণ্ডল গা ঢাকা দিল।


তিন


‘ছেলেটাকে যখন মারছিলেন আপনার কী মনে হচ্ছিল?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ঐশীকে অবাক করে দিয়ে প্রশান্ত বলল, ‘আমার বেশ ভাল লাগছিল। কাউকে মারতে আমার ভালই লাগে।’ ঐশী চক্রবর্তী একজন নবীন সাংবাদিক। সে গণপিটুনির কারণ অনুসন্ধান করতে চাইছে। এই বিষয়ে একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন সে তাদের কাগজে প্রকাশ করতে চায়। কখনও মোবাইল চোর সন্দেহে, কখনও  গোরু চোর সন্দেহে, কখনও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অথবা স্রেফ সন্দেহের বশে একের পর এক নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা তাকে কিছুতেই স্বস্তি দেয় না। অথচ যারা সমাজের রাঘব-বোয়াল, যারা সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা লুট করে পালাচ্ছে, কেউ বিদেশে গিয়ে ফুর্তি করছে, কই তাদের টিকিও তো সাধারণ মানুষ ছুঁতে পারছে না। মানুষের এই নিষ্ঠুরতার কারণ কী? ক্ষমতা প্রদর্শন? প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাসহীনতা? প্রাণ বাঁচাতে অসহায়, নিরীহের আর্তনাদ, কান্না কি সে সময় কানে পৌঁছয় না? তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সবকিছু? চুরির বদনামটা উপলক্ষ্য? আসল উদ্দেশ্য মারা? 

ঐশী এসেছে প্রশান্তর সাক্ষাৎকার নিতে। এমনিতে হয়তো অনুমতি মিলত না, কিন্তু ঐশীর বড় মামা উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তা। সেই সূত্রে থানার বড়বাবুকে বুঝিয়ে রাজি করানো হয়ছে।

প্রশান্ত প্রথমে কথা বলতে রাজি হয়নি। কিন্তু ঐশীকে একঝলক দেখার পরে আর আপত্তি করেনি। হয়তো ভেবেছে হোক না মানুষ মেরে, তাও তো এটা একটা বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ।

ঐশীর অবশ্য মনে হয়েছিল প্রশান্ত দোষ স্বীকার করবে না। হয়তো রাজনৈতিক নেতাদের মতো বলবে ওইদিন সে ঘটনাস্থলেই ছিল না। মাসির বাড়ি গিয়েছিল। ঐশী বলল, ‘আপনি জানতেন ছেলেটা কী চুরি করেছিল?’  

‘না। তবে সবাই মারছিল যখন দোষী তো বটেই।’

‘আর এটা কখনও মনে হয় না যে আপনি শাস্তি দেওয়ার কে? কেউ অপরাধ করলে তার জন্য দেশের আইন আছে।’ 

ঐশীর এই কথাগুলো প্রশান্তর পছন্দ হল না, সে কঠিন চোখে তাকাতেই ঐশীর মনে হল এই লোকটার চোখেও এক অদ্ভুৎ নিষ্ঠুরতা খেলা করে। সে আর কথা না বাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেল।

প্রশান্তর মারার ইতিহাসের সপক্ষে স্থানীয় আরও কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলল ঐশী। সবাই বলল তার মারকুটে স্বভাবের কথা। কোথাও কাউকে ধরে যে কোনও কারণেই হোক মারার খবর যদি একবার প্রশান্তর কানে পৌঁছায়, তবে সে সেখানে হাজির হয়ে মারতে শুরু করবে সেই ধৃত হতভাগ্যকে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন যে নিশির ডাক যেমন লোকে এড়াতে পারে না, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যায়, কোনও হুঁস থাকে না, প্রশান্তও সেরকম, কাউকে মারার ডাক  সে উপেক্ষা করতে পারে। রাজুর অনুপস্থিতিতে দোকান বন্ধ করেও সে কতদিন ছুটে গেছে মারতে। কাউকে মারতে পারলে সে আর কিছুই চায় না। মেরে তার অসীম আনন্দলাভ। 

মারে নিহত হতভাগ্য ছেলেটির নাম পলাশ। রতনদের গোরু সে চুরি করেনি। গোরুটাকে পাশের গ্রাম থেকে পাওয়া গিয়েছে। ঐশী লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পলাশদের বাড়িও খুঁজে বের করে। ইচ্ছা ছিল পলাশের মায়ের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু মায়ের দেখা পায়নি সে বাড়িতে। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে সে পাগলের মতো হয়ে কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারল না। 


চার


তিন দিন বন্ধ থাকার পর আজ আবার দোকান খুলেছে রূপালী। সঙ্গে ডেকে নিয়েছে রাজুকেও। না হলে সে একা সামলাতে পারবে না। দোকান বন্ধ থাকায় রাজুও বেকার হয়ে  পড়েছিল।


প্রশান্তর দোকানের নিয়মিত খরিদ্দাররা আবার আসতে শুরু করেছে। দোকানে কান পাতলে অনেক রকম কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

একজন বলল, ‘চা বানিয়ে লোকে কত-কী হয়ে যাচ্ছে। আর পোসান্ত খুনি হয়ে গেল!’

আর একজন বলল, ‘আরে কাকা, এটাকে তুমি যদি খুন বলো, তবে তো ঠগ বাছতে গা উজার হয়ে যাবে। আমাদের সবাই কম বেশি এই দোষে দুষ্ট। সুযোগ পেলে আমরা কে মারি না বলো তো? আমাদের সবার মধ্যেই একটা করে পোসান্ত আছে।’

একজন বয়স্ক লোক রূপালীকে বলল, ‘তুমি বরং একবার এমএলএ  সাহেবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করো। তিনি পোসান্তকে হাজতবাস থেকে বাঁচালেও বাঁচাতে পারেন।’

রুপালী কথাটা শুনল। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, মায়ের কোল খালি করে নিহত ছেলেটার জন্যও তার মন কেমন করছে।

এমন সময় একটা বাইক এসে থামল দোকানের সামনে। বাইক আরোহীকে রূপালী চেনে। প্রভাষ সাউ। পার্টি করে। এমএলএ  সাহেবের ডান হাত। সে রূপালীকে লক্ষ্য করে বেশ উঁচু স্বরেই বলল, ‘তোমাকে এমএলএ সাহেব ডেকেছেন। রবিবার দিন যেয়ো।’  


পাঁচ


রবিবার সকালে এমএলএ  সাহেবের বাড়ির বসার ঘরে প্রচণ্ড ভিড়। মানুষজন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এসেছে। রূপালীও রাজুকে নিয়ে হাজির এখানে। আজ আর তারা দোকান খোলেনি। বেশ খানিক ক্ষণ পরে ঘরটা মোটামুটি ফাঁকা হলে রূপালীর ডাক পড়ল বলার। সে দাঁড়িয়ে সমস্যার কথা বলতেই এমএলএ  সাহেব তাকে থামিয়ে বললেন, ‘আমি সব শুনেছি। আর বলতে হবে না।’ দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘অনেক দিন ধরে রাজনীতি করছি। আমার প্রভাব খাটিয়ে প্রশান্তকে ছাড়াতে পারি। পুলিশ সব কেস তুলে নেবে। কিন্তু কেন করব বল? প্রশান্ত তো আমাদের পার্টির সদস্য নয়। তুই ওর সঙ্গে কথা বল। ও যদি আমাদের পার্টিতে নাম লেখায়, আমাদের হয়ে  কাজ করে, তাহলে ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করব। সামনেই ভোট। বিপক্ষকে শায়েস্তা করতে ওর মতো মারকুটে ছেলেরা দলের সম্পদ হবে।’

এই প্রস্তাবে রূপালী ভেবে পায় না কী বলবে।


দীপঙ্কর বাগচী

 




এ সময়ের একজন অগ্রগণ্য লেখক। তাঁর নিরলস সাহিত্যচর্চা আমাদের সমৃদ্ধ করে। গদ্য ও কবিতা -- সব মিলিয়ে দীপঙ্কর এ পর্যন্ত দশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। স্বরবর্ণে আমরা পড়ব সদ্য প্রয়াত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা,তাঁর একটি অসামান্য গদ্যরচনা।





বুধুয়ার পাখি ও কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত



" মানুষ যে আত্মিক, এই কথাটা বোঝার জন্য আগে তার জৈবিক হওয়া প্রয়োজন। আগে সে ধূলায় হামাগুড়ি দেবে, তারপর তো নিউটনের মতো বিশ্ব পাড়ি দেবে। তাই শরীর হলো গতির প্রথম শর্ত, ইন্দ্রিয় হল পূর্ণতার প্রথম সোপান। "
                                                                            ----  শিলার



 সম্প্রতি এই বিশ্বজোড়া করোনার অতিমারীর কালে প্রয়াত হয়েছেন বাংলার বহু বিশিষ্ট কবি ও শিল্পীরা, বয়সের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই। আন্তর্জাতিক মননের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পণ্ডিত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত মারা গেলেন। এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষতি সাহিত্য কাব্য পাঠকের কাছে।


অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে গেলে উপরে উল্লিখিত কবি দার্শনিক  শিলারের কথাটি বহুভাবে বর্ণিল হয়ে ওঠে। কীটস ও তার পূর্বে শেকসপীয়র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনার কথা বলেছেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে ইন্দ্রিয় সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অলোকরঞ্জন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ যৌবনবাউল থেকে যে ইন্দ্রিয় সংবেদনার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন ,তা এক কথায় অনবদ্য।



   কারণ আমরা কখনওই দেহ নামক ঝড় বস্তুটিকে নিরপেক্ষ রেখে অন্তরজীবনের আধ্যাত্মিকতার গান গাইতে পারি কি না ,তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একথা ঘোষিতভাবে পৃথিবীর শেষ রোচিষ্ণু (Romantic) W. B. Yeats -এর ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।



   দলগতভাবে গত শতকের ৫০-এর দশকের প্রধান কবিরা প্রায় কেউই নিরালম্ব উদাসীনতার চর্চা করতে পারেন নি। পারেন নি তথাকথিত আধ্যাত্মিক কবির শিরোপা বহন করতে। যদিও আধ্যাত্মিকতা বলতে আমরা ' অন্তরজীবন'কে বুঝে থাকি। আধ্যাত্মিকতা কোন ' ঈশ্বরমুখীনতা ' নয়, আবার ' ঈশ্বর' নিরপেক্ষতাও নয়। অন্তরজীবনের এই গান আমরা অলোকরঞ্জনের  লেখায় প্রথম জীবনে দারুণভাবে লক্ষ করি, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে, পরবর্তী জীবনে শিলার কথিত নিউটনের মতো বিশ্ব পাড়ি দিতে গিয়ে তিনি পথ হারিয়ে ভঙ্গি সর্বস্ব হয়ে উঠেছিলেন, এমনকি বাংলার নিজস্ব শিকড়টিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এটি এক বড় ট্র্যাজেডি। আদ্যন্ত কবি এই অসাধারণ পন্ডিত দার্শনিক বোধের পরিসরে নিঃসন্দেহে বিশ্বপাড়ি দিলেন। দুটি অর্থেই তা ঘটেছিল। শরীরীভাবেও তিনি বিদেশে পড়ালেন, জার্মানির নাগরিক হলেন আবার দার্শনিক মননের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অমিয়ো চক্রবর্তীর মতোই  বিশ্বমনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন, কিন্তু কবিতায় হানস গেয়র্গ গাদামার -এর মতো দার্শনিকের ' হারমেনেটিরস ' তাঁর  হজম হলো না। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের  ঐতিহাসিক,রাষ্ট্রদার্শনিক বা সাহিত্যতাত্ত্বিক থিওডোর আর্ডেণে|র 'এসথেটিক থিয়োরী'।



  এই প্রথম জীবনের জন্য কবিতার পাণ্ডিত্য দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্প দার্শনিকতার বাইরের অংশটিকে, কিন্তু নিজের দেশের সঙ্গে সংযোগ সত্ত্বেও সে অর্থে দেশের মাটির সঙ্গে ইন্দ্রিয় সংবেদনার আত্মীয়তা- সেটি হারালেন অতি নির্মমভাবে। কাব্যলক্ষী তাঁকে  ধরা দিলেন না, এ এক বড় সত্য নিদারুণ যন্ত্রণা, তিনি কি তা বোঝেন নি!! নিশ্চিত বুঝেছিলেন --- বলেই বারবার ক্ষণকালের কাব্যমুহূর্তকে চিরকালের কাব্যমুহূর্তের মুকুরে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ তিনিই তো তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যৌবনবাউলে'র বিভাব কবিতায় উচ্চারিত মন্ত্র নাকি অন্য কবিতা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন ---


একটি মাত্র রাখাল যাক, এ মাঠ একলা পড়ে থাক 
নীরবে, আমি এ মাটি ছাড়বো না
ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর
ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়বো না


   অর্থাৎ যে দায়বদ্ধতা তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করলেন ,পাঠকের মননকে নতি স্বীকার করিয়ে টেনে আনলেন তাঁর কবিতার কাছে, তা সত্য সত্যই এক দুর্লভ শক্তির অধিকারী কবির পক্ষেই সম্ভব। এখানে দুটি ঘটনা তিনি যুগপৎ ঘটান, 'ছন্দ'কে মধ্যবর্তী রেখে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন কবিতাকে কখনও অলোকরঞ্জন ছেড়ে যাবেন না। ছন্দময় এ জগৎ, মৃত্যুর ঘরও আসলে ছন্দে নির্মিত হয়তো-বা।
আর তারপর এই গ্রন্থের কবিতা ' বুধুয়ার পাখি ' আমাদের যে ইন্দ্রিয় সংবেদনা ও বিশ্বচেতনার সঙ্গে যুক্ত করল তা আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত ও দিব্য উন্মাদে রূপান্তরিত করে।


বুধুয়ার পাখি


জানো এটা কার বাড়ি? শহুরে বাবুরা ছিল কাল,
ভীষণ শ্যাওলা এসে আজ তার জানলা দেয়াল 
ঢেকে গেছে, যেন ওর ভয়ানক বেড়ে গেছে দেনা,
তাই কোনো পাখিও বসে না!
এর চেয়ে আমাদের কুঁড়েঘর ঢের ভালো, ঢের
দলে - দলে নীল পাখি নিকোনো নরম উঠোনের 
ধান খায়, ধান খেয়ে যাবে-- বুধুয়া অবাক হয়ে ভাবে।
এবার রিখিয়া ছেড়ে বারুডির মাঠে 
বুধুয়া অবাক  হয়ে হাঁটে, 
দেহাতি পথের নাম ভুলে
হঠাৎ পাহাড়ে উঠে পাহাড়ের মত মুখ তুলে 
ভাবে, ওটা কার বাড়ি, কার কত নীল,
আমার ঘরের চেয়ে আরো ভালো,আরো 
নিকোনো উঠোন তার, পাখিবসা বিরাট পাঁচিল!
ওখানে আমিও যাব, কে আমায় নিয়ে যেতে পারো?

এইভাবে প্রতিদিন বুধুয়ার ডাকে 
কানায় কানায় আলো কাখের কলসে ভরা থাকে,
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে, কেউ তার দিদি, কেউ মাসি,
রুপোলি ডানায় যারা নিয়ে যায় বুধুয়ার হাসি।।



   ভাবা যায়! কিভাবে ক্ষণকাল-এর বুধুয়ার ডাক চিরকালের ডাকে পরিণত হল। মানবাত্মার বুধুয়া আর যে কোনো একটি দেহাতি গ্রামের ছোট্ট বুধুয়া, ইন্দ্রিয় সংবেদনার অখিল মায়ায় আবদ্ধ হলো। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পদাবলী সাহিত্যের জ্ঞানদাসের সেই অপূর্ব কবিতাটি, যার ভাবের ভিতরে ঠিক এই ক্ষণকালের চিরকালে পর্যবসিত হবার কথা বুনে উঠেছে।



" রজনী শাওন ঘন 
ঘন দেয়া গরজন 
রিমিঝিমি শব্দে বরিষে 
পালঙ্কে শয়ন রঙ্গে
বিগলিত  চির অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে "



   একটি বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণের  রাত কিভাবে চিরদিনের শ্রাবণ রাতের কুহকে রূপান্তরিত হলো। এইখানেই ভক্তি বা ঈশ্বর চেতনার আগে ইন্দ্রিয়চেতনার নিশ্চিত অভিজ্ঞানটি মুদ্রিত হল। সকল বুদ্ধি, আধুনিক সংশয়কে পেরিয়ে  গিয়ে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে প্রকৃতি ও চরাচরকে অনুভব করার স্থাপত্য বুনে উঠলো ।



 ' বুধুয়ার পাখি ' বস্তুত অলোকরঞ্জনের মননে,ভাবে ও গভীরতায় ঠিক সেই ব্যঞ্জনা তৈরি করল,যার ফলে দেহাতি বুধুয়ার ভাবনা যেন সেই সরলতা প্রাপ্ত হল, যা উয়িলিয়াম ব্লেক কিংবা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের অমলের কথা মনে পড়িয়ে দিলো। মানুষ যে প্রকৃতির বাইরের নয় তারই একটি 'অলটার ইগো' তা যেন পুনরায় বুধুয়ার  সরল চাওয়ার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেল ----



"এইভাবে প্রতিদিন বুধুয়ার  ডাকে 
কানায় কানায় আলো পথের কলসে ভরা থাকে, 
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে, কেউ তার দিদি কেউ মাসি
রুপোলি ডানায় যারা নিয়ে যায় বুধুয়ার হাসি"



   যৌবন বাউল, রক্তাক্ত ঝরোখা, নিষিদ্ধ কোজাগরী পেরিয়ে তাঁর রথ যখন অতি অল্প বয়সেই মধ্যগগনে তখন থেকেই শুরু হল এই কবির অন্য এক রূপান্তর। সাহিত্যের অধ্যাপক, ভারত তত্ত্ববিদ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ক্রমেই আরও বহু লিখলেন তাঁর দীর্ঘ জীবনে। তাঁর দর্শন পরবর্তী জিজ্ঞাসু ও পাঠক আর তরুণ কবিদের মনোভূমি গঠনে সাহায্য করল ঠিকই, এমনকি তিনি আন্তর্জাতিক কাব্যভাষা লিরিকের মূর্ছনায় প্রকাশ করলেন এও সত্য --কিন্তু হারিয়ে ফেললেন তাঁর গভীর নির্মাণকে।



  কবি গ্লোবাল হতে গিয়ে লোকালের সংবেদনাকে হারালেন। প্রচুর লোকাল বা স্থানীয়ে়র উপস্থিতি, বিশ্বজোড়া সংবাদ তাঁর কবিতায় উঠে এলো, কিন্তু তা হারিয়ে ফেলল ' আত্মিক ইন্দ্রিয়সংবেদন ' আর এখানেই এই মহৎ কবি হয়ে উঠলেন একজন শুধুমাত্র পন্ডিত, অনন্য রসবোধের নাগরিক কবি --- আর হারালেন স্থানীয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা তাঁর সরল আদিম আত্মাটিকে।


 এ - এক মহতি বিনষ্টি।

            



দীপঙ্কর বাগচী-র কবিতার বই 

Saranga * জাদুকর * অন্ধফেরিওলা * জলতরঙ্গ *
মহাকাল ও ইশারা * ত্রহস্পর্শ * ছাতারপাখি একা 
প্রভৃতি


গদ্য গ্রন্থ :  কবির বিশ্ব * আধুনিকতা পালাবদল কল্লোল যুগ * 
দেখা * Modernity and Social Crisis in Bengali Poetry 1920--1950 *
এছাড়াও বহু ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ নানা journal এ
প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।