সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

তোমায় খুঁজে ফিরি






 শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি


 রামলাল চট্টোপাধ্যায়


( ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যম অগ্রজ রামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন  রামলাল চট্টোপাধ্যায়। ঠাকুর তাকে  ' রামনেলো ' বলে ডাকতেন।  বেলুড় মঠের সকলের কাছে তিনি ' রামলাল দাদা ' নামে পরিচিত ছিলেন। রামেশ্বরের দেহত্যাগের পর তিনি দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর পূজক পদে নিযুক্ত হন এবং আজীবন সেই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুগায়ক ছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে তিনি অনেকবার গান শুনিয়েছেন। ঠাকুর কাশীপুরে ' কল্পতরু দিবসে ' অনেকের সঙ্গে রামলালকেও কৃপা করেন। )

১)


আশ মিটিয়ে দেখা


মার মন্দিরে যদি কেউ চোখ বন্ধ করে ধ্যান করত, তা দেখে ঠাকুর তাকে বলতেন, 'এখানে আবার ওসব কেন গো? সাক্ষাৎ মা চিন্ময়ী বিরাজ করছেন, আশ মিটিয়ে দেখে নাও। ওসব বাইরে চলে, যেখানে অনুভূতি হবে না, এখানে ওসব করো না। মনে কর, তুমি তোমার আপন মার কাছে গেছ মাকে দেখতে, তুমি কি চোখ বন্ধ করে মার কাছে বসবে, না মালা জপতে বসবে?'


ঠাকুরের নাম করে নৃত্য


     'জয় গোবিন্দ, জয় গোপাল, কেশব মাধব দীন দয়াল। হরে মুরারে গোবিন্দ, বসু-দেবকী নন্দন গোবিন্দ। হরে নারায়ণ গোবিন্দ হে। হরে কৃষ্ণ বাসুদেব।' ঠাকুর সকাল ও সন্ধ্যায় এইটি বলে কখনও কখনও নৃত্য করতেন। 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।' 'রাম রাঘব রাম রাঘব, রাম রাঘব পাহি মাং। কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব, কৃষ্ণ কেশব রক্ষ মাং।'


শ্রীরাম ও জপের বর্ণনা


     ঠাকুর বলতেন, 'রা শব্দে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বোঝায় আর ম শব্দে ভগবান অর্থাৎ রাজা -যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রাজা -তিনি রাম। আর করজপের বিষয়ে বলতেন, 'আঙুলের পর্বতে ঠেকবে না এবং নখে স্পর্শ হবে না। আঙুল ফাঁক থাকলে জপের ফল বেরিয়ে যায়। কর্ম সেরে বসি, আর শত্রু মেরে হাসি।' আবার বলতেন, 'অষ্টমী, চতুর্দশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও সংক্রান্তি এই পঞ্চপর্ব কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ উভয়ে যদি শনি ও মঙ্গলবার পড়ে তো বিশেষ প্রশস্ত হয়।'


নাম মাহাত্ম্য


     ঠাকুর বলতেন, 'ভগবানের লীলা খেলা, মায়া এসব বোঝবার জো নেই। যেটা সম্ভব, সেটা তাঁর ইচ্ছায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে; আবার যেটা অসম্ভব, সেটা তাঁর ইচ্ছায় সম্ভব হয়ে যাচ্ছে।' ঈশান মুখুজ্যেকে ঠাকুর বলেছিলেন, 'আচ্ছা ঈশান, রেলে রেলে ঠোকাঠুকি হয়ে কত লোক বেঁচে গেল, আবার কত লোক মরে গেল। তা এর থেকে বোঝা গেল, যারা দুর্গা বলে যাত্রা করেছিল তারাই বেঁচে গেল। আর যারা দুর্গা বলে যাত্রা করেনি তারাই মরে গেল। একজনের কপালে লেখা ছিল পায়ে ফাল ফুটে ঢুকে যাবে। সে দুর্গা বলে পথে যাচ্ছে, এমন সময় তার পায়ে কুশ ফুটে গেল। এ থেকে বোঝা গেল যে ঐ দুর্গানামের গুণে অল্পের মধ্যে কেটে গেল কি বল?' ঈশান বললে, 'আজ্ঞে হ্যাঁ।'


          

২)


আগে ভোজন কর


     ঠাকুর উপবাসের সম্বন্ধে বলতেন, 'মার পায়ের বিল্বপত্র ভক্ষণ করে কিংবা মায়ের প্রসাদী দ্রব্য খেয়ে কিছু খেলে দোষ থাকে না।' 'যদি ঠিক ঠিক বোধ হয়, তবে তো ফল হবে। আবার পেট চুঁই চুঁই করছে, তাতে কি আর ধর্মকর্ম চলে? একে কলিকাল, অন্নগত প্রাণ, অল্প আয়ু। উপবাস করে ওসব করা চলে না, তাতে ঠিক ঠিক মন বসে না। তাই আগে কিছু খেয়ে নিতে হয়।'


দক্ষিণেশ্বরের দিনগুলো


     ঠাকুর সোমবার চুল কাটতেন। ঠাকুরের চর্ম অত্যন্ত কোমল ছিল, তাই ক্ষুর দিয়ে তাঁর দাড়ি কামানো যেত না; নাপিত তাঁর দাড়ি ছেঁটে দিত।

     ‎ হৃদয়দাদা ঠাকুরের খুব সেবা করেছেন। ঠাকুর বলতেন, 'এমন সেবা বাপ-মাও করতে পারে না।' আবার খুব যন্ত্রণাও দিয়েছেন শুনি। দাদা বলেন, 'হ্যাঁ সে সব ঝগড়া দেখবার ছিল।'

     ‎ যখন ঠাকুর হৃদয়দাদার উপরে রেগে যেতেন তখন তিনি দাদাকে যা তা গালাগালি দিতেন। হৃদয়দাদা সে সময়ে চুপ করে থাকত আর মধ্যে মধ্যে ঠাকুরকে বলত, 'আঃ, কি কর মামা, ওসব কথা কি বলতে আছে, আমি যে তোমার ভাগনা।' ঠাকুর সামনে যা পেতেন -ঝাঁটা জুতো সপাসপ করে লাগিয়ে দিতেন। এই সব ব্যাপার দেখে আমি ভাবতুম, এইবার বুঝি দুজনে ছাড়াছাড়ি-আড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু তা হতনা, পরক্ষণেই আবার দুজনের ভালবাসা, কথা, ইয়ার্কি চলত। আবার হৃদয়দাদা যখন ঠাকুরকে কিছু বলতেন তখন তিনি চুপ করে শুনতেন।

     ‎ এই ঘরে (যে ঘরে ঠাকুর থাকতেন) কত নাচগান, কথা, রঙ্গরস হয়েছে। ঠাকুর এমনই রঙ্গরস রহস্য করতেন যে হেসে নাড়ি বেদনা হতো। তিনি ভক্তদের বলতেন, 'হ্যাঁগা, আমি এ সব জানি, শুনেছি, দেখেছি, তাই বলছি, তাতে কি দোষ হবে?' ভক্তেরা বলতেন, 'না, না, আপনি বলুন বেশ ভাল লাগছে।'


কলকাতার ভক্তি


     ঠাকুর আমায় গাইতে বললেন -'তার তারিণী', কিন্তু আমি ভাই একঘর লোক দেখে লজ্জায় আছি। এই দেখে ঠাকুর বললেন, 'শালা লজ্জা করছিস! ঘৃণা লজ্জা ভয় তিন থাকতে নয়। লোককে দেখে তোর লজ্জা! লোক না পোক!' তিনি আরও বলেছিলেন, 'যখন যে কোন দেব দেবীর গান গাইবি, আগে চোখের সামনে তাঁকে দাঁড় করাবি, তাঁকে শুনাচ্ছিস মনে করে তন্ময় হয়ে গাইবি। লোককে শুনাচ্ছিস কখনও ভাববি না, তাহলে লজ্জা আসবেনি।'

     ‎ 'কলকাতার লোকেরা ভক্তি করতেও যেমন, অভক্তি করতেও তেমনি। আমায় কেউ কেউ বলে বাবুর লাল-পেড়ে কাপড় পরা, পায়ে বার্নিশ করা চটি-জুতো, তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসা, এসব না হলে চলে না। গঙ্গার জল সকালে দেখলুম বেশ ভরপুর রয়েছে, আবার দেখি না কমে গেছে। এসব লোকেদেরও কিরকম জানিস, ঠিক জোয়ার ভাটার মতন। কত শালা কত কি বলে, ও শালাদের ভাল কথায় আর মন্দ কথায়ও ঘৃণা করি। তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ আছে ভক্তিমান বিশ্বাসী, তাদের আর ওসব হবেনি। তারা যাকে ভক্তি করবে বা বিশ্বাস করবে, তাদের আর ভুল হবেনি।'




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন