বিশ্ব সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। গল্প , কবিতা , উপন্যাস --- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিহার। কবিতা ও উপন্যাসের উপর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে রাহুলের | এ সংখ্যায় রইলো প্রয়াত কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে একদা তাঁর নেওয়া একটি মনোজ্ঞ সাক্ষাৎকার |
কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
প্র। আপনার ছেলেবেলার কথা কিছু বলুন।
উ। আমার ছেলেবেলা কেটেছে বরিশালের আমতলীতে। পাশ দিয়ে বয়ে যেত উদ্দাম, বিশাল নদী, পায়রা। সারাদিন নৌকো চলতো নদীতে। কাছেই সুন্দরবন। দেখেছি প্রচণ্ড ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ভেসে চলেছে ভয়ংকর, বিষধর মস্ত সাপ। নানা ধরনের বিষাক্ত সাপের দংশনে মানুষের করুণ মৃত্যু ছেলেবেলায় দেখেছি। সারা শ্রাবণ মাসটা বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল পাঠের ছবি আমার কাছে এক অদৃশ্য পৃথিবীর দরজা খুলে দিত। লখিন্দর-বেহুলার করুণ-কাহিনী যেন সত্য হয়ে উঠতো আমার কাছে। যুদ্ধের সময় আমার জন্ম। অনটনের শেষ ছিল না। মা খুব দুঃখী ছিলেন। মারা গেলেন হঠাৎই। একটি সন্তান হয়েছিল। ভোরে উঠে দেখি, কী কষট পাচ্ছেন তিনি! পাঁচ-সাত জনে ধরে রাখতে পারছে না। উঠোনে অনেক মানুষ। মাকে ধরে তোলা হলো চৌকিতে। তারপর মা যন্ত্রণায় বেঁকে গিয়ে স্থির হলেন। মায়ের চোখ দু'টো বেশ বড় আর টানা ছিল। ঢেকে দেওয়া হলো তুলসীপাতা দিয়ে। মায়ের মৃত্যুর দিন খুব বৃষটি পড়ছিলো, তার মধ্যেই শবযাত্রা। এক মাথা দীর্ঘ চুল মাটি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, আমার মনে আছে। মনে আছে, মায়ের মৃত্যু নিয়েই জীবনে প্রথম কবিতা লিখেছিলাম। তবে তার চেয়েও বেশি ঝোঁক ছিল, মাটির পুতুল, ঠাকুর বানানো, ছবি আঁকা, এই সবে। সেই ছেলেবেলায় মায়ের মৃত্যুই আমাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়।
প্র। কলকাতায় এলেন কবে?
উ। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আমাকে মাসির বাড়ি রেখে এলেন। তখন দেশভাগ হয়ে গেছে। শিয়ালদা স্টেশনে মানুষের পর মানুষ। রান্নাবান্না, বাথরুম, দুগর্চন্ধ, মাছি। অতি অল্প বয়সে মাসি বিধবা হয়েছেন শিশুপুত্র নিয়ে। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেলেন। খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, নিজে না খেয়ে ছেলেমেয়েদের টাকা পাঠাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্কুলে ফ্রি-তে পড়ার ব্যবস্থা না হলে হয়তো পড়াশুনাই বন্ধ হয়ে যেত সে সময়। একদিন জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর খবর পেলাম। তখন তো আর জীবনানন্দকে নিয়ে আজকের এই উন্মাদনা ছিল না। একটা বিশেষ সংখ্যা বার করলাম জীবনানন্দকে নিয়ে। একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম, সেখানেই প্রথম ধুতি-পাঞ্জাবি পরা দিনেশ দাসকে দেখি। ১৯৫৭ সাল থেকে 'কবিপত্র' প্রকাশ করার কথা ভাবলাম। সঙ্গী মৃণাল দত্ত। মনে আছে, সঞ্জয় ভট্টাচাযের্চর মনোহরপুকুরের ফ্ল্যাটে গেছিলাম কবিতা চাইতে। উনি তখন উন্মাদপ্রায়, ক্ষুর নিয়ে আক্রমণ করলেন।
প্র। আপনি বারবার নিজের দীর্ঘ কবিতা-জীবনকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করতে চেয়েছেন। প্রথম পর্বটি নিয়ে কিছু বলুন।
উ। আমি কবিতাকে আত্মহনন এবং আত্মউন্মোচন বলে ভাবি। সেই ষাটের দশকে আমি খুঁজছিলাম এমন পথ, যা আমাকে বিশ্বাসে নয়, বোধে পৌঁছে দেবে। মনে হচ্ছিলো, কবিতায় যেন বড় বেশি চালাকি, চাতুযর্চ আর ছদ্ম-দার্শনিকতা চলছে। আমাকে পথ খুঁজে নিতে হবে। এবং এই খুঁজতে গিয়ে আমি 'শিল্পের শাশ্বত লোক' অনুসন্ধান করতে লাগলাম। আমি ঈষোপনিষদের 'কবয়ো ক্রান্তদশীর্চ' কথাটিতে বিশ্বাস করি। অথর্চাৎ কবি হবেন একজন দ্রষ্টা, প্রজ্ঞাবান, বোধতাড়িত মানুষ। কবির অনুভব তাৎক্ষণিক নয়, সেই অনুভবের মধ্যে প্রাচীন জ্ঞান, সভ্যতার সারাৎসার, বহু অভিজ্ঞতার নির্যাস ধরা থাকবে। আমি শিল্পের শাশ্বতলোক বলতে একেই বোঝাতে চেয়েছি।
১৯৬১ সালে টানা ছ'মাস ধরে লিখেছিলাম একটি শোক-কবিতা। নাম দিয়েছিলাম, 'শবযাত্রা'। শুরু হলো আমার কবিতা লেখার প্রথম । এই পর্বে আমি মৃত্যুর দারা আক্রান্ত ছিলাম, মৃত্যুবোধে গ্রস্ত থাকতাম। ছেলেবেলাটা কেটেছে অসংখ্য মৃত্যুর সঙ্গে ঘর করে। সাত বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু থেকে শুরু। বরিশালের নিত্য পাড়ভাঙা নদীর পাড়ে বাড়ি, কিছু দূরে শ্মশান। বাল্যবন্ধু, খেলার সঙ্গীদের মৃত্যু, পরিচিত মানুষের মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে বিষাদগ্রস্ত করেছে। আর তারপরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের স্রোত চোখের সামনে দেখেছি। কলকাতায় এসে একটির পর একটি বাসস্থানে শিকড় গাড়তে চাওয়ার চেষটা ও বিফলতা। দারিদ্র্য, অপমান, নিত্য অসহায়তা। এই পর্বের কবিতাকে আমি বলি, 'বিষাদ পর্ব ', ছবির ভাষায়, 'নীল পর্ব '। গভীর বিষাদের মধ্যে তখন আমার একমাত্র আশ্রয় কবিতা। এই পবের্চর কবিতায় মিথ বা পুরাণ-প্রতিমাকে আশ্রয় করে চিরদিনের বিষাদ-গ্রস্ত আত্মার সঙ্গে সম্পক খুঁজেছি আমি।
সেই সময়ে যখন দীর্ঘ চেতনা-প্রবাহ আশ্রিত আঙ্গিক ব্যবহার করেছি, তখনই আবার আবেগের সংহতিও চেয়েছি সনেট রচনায়। 'অসীমার প্রতি সনেটগুচ্ছ'র বিষয় যদি হয় প্রেম ও বিষাদ, তেমনই 'হেমন্তের সনেট' কবিতা, প্রেম, বিষাদ ও মৃত্যু, এই চারটি পবে বিভক্ত। বিষন্ন আত্মার উন্মোচন, ব্যক্তিচেতনার হাহাকার, বোধ ও বেদনাই ছিল এইসব সনেটের বিষয়। সেই সময় বারবার পড়েছি মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল, কোরাণ। আমার খোঁজার দিকটা ছিল দেশের লোক-ইতিহাস, পুরাণ, ইতিহাস, লোকজীবনাশ্রিত সাহিত্য। আসলে ঐতিহ্য ও বতর্চমানের মধ্যে আমি সেতুবন্ধন করতে চাইছিলাম। 'আগুনের বাসিন্দা'য় পুরাণ এলো সমকাল ও অতীতের সেতু রচনার প্রয়োজনে। এই প্রথম আমি ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে ব্যক্তবিশ্বের পথে যাওয়ার চেষটা করলাম। এই বইতে আমি মহাভারত, বুদ্ধজাতক, ওল্ড টেস্টামেন্টের নানা পুরাণচরিত্র ও অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছি। নিজের ভয়ংকার অসহায়তার স্বরূপ খুঁজে পেলাম মহাভারতের অভিমন্যু,কর্ণ প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে।
প্র। এবার দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে কিছু বলুন।
উ। এই পবের আমি নাম দিয়েছি, 'আত্মদশর্চন পর্ব ', ছবির ভাষায়, 'লাল পর্ব '। ১৯৬৭ সালে আমি স্কুলে পড়াই। মনে হতে লাগলো, আমার চারপাশে জীনযাত্রায় কোথাও কিছু ঘটছে, খুবই অস্থিরতা অনুভব করতে পারছি, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। তরুণদের মধ্যে দ্রোহাত্মক মন জেগে উঠছে। সমাজ, রাষট্র, ব্যক্তি, সমাজের নানা নিয়ম-কানুনের আওতায় মানুষের বেঁচে থাকার লাঞ্ছনার কোনও শেষ নেই! 'কোরাণ' পড়তে গিয়েই পেয়ে গেছিলাম ঈশ্বর-দ্রোহী ইবলিশের চরিত্রটি। মনে হলো, সামাজিক প্রতিষঠানগুলো মানুষের অগ্রগতিকে, স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করছে, খবর্চ করছে, তাই মানুষ তার সাধনালব্ধ মানবিক মূল্যবোধকে ব্যবহার করতে পারছে না। ইবলিশের ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা ও স্বপ্ন চাই আজকের তরুণ ও যুবকদের, যদি তারা কিছু নির্মাণ করতে চায়।
'ইবলিশের আত্মদশর্চন' সেই কবিতা যেখানে রুচির প্রথাগত দিকটা বর্জন করে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনকে উপেক্ষা করে, ব্যক্তির বিদ্রোহ-ঘোষণা ধবংসকামী নৈরাজ্য নিয়ে ধরা দিলো। কি নিয়ে কবিতা লিখবো আর কি নিয়ে লিখবো না এরকম কোনো বাধানিষেধই তুলে দিলাম, আর যে কোনও বিষয় যেমন কবিতার শরীরের অন্তভুর্চক্ত করলাম, তেমনই যে কোনও শব্দ তার কাঁড়া-আকাঁড়া চেহারা নিয়ে ব্যবহার করলাম! ইবলিশের নৈরাজ্যবাদ শেষপযর্চন্ত এক নিস্পৃহ অনস্তিত্ব বোধে পৌঁছলো, আর এর প্রেক্ষাপটে ছিল সত্তর দশকের একদল আদশর্চবাদী, আত্মত্যাগী তরুণ-তরুণীর মৃত্যুর অজস্রতা। এরই ফসল, 'অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সংক্রান্ত' বইটির কবিতাগুলি।
প্র। আর তৃতীয় পর্ব ?
উ। এই পর্বে শুরু 'বিযুক্তির স্বেদরক্ত' থেকে। এই দীঘ কবিতার বিষয়টি পেয়েছিলাম, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে। এই কবিতার বিষয়, মানুষের শ্রম-বিযুক্তি, আবহমান সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের আধুনিক স্বাথর্চসবর্চস্বতা ও নিঃসঙ্গতার কারণকেই খোঁজা হয়েছে এই কবিতায়। এরপর পশু-পক্ষীদের প্রতীক করে লিখলাম, 'পশুপক্ষী সিরিজ'। সাধারণ মানুষের জীবনের বহুমাত্রিক বন্দীত্ব ও অসহায়তা, দুঃখবেদনার কথাই ওই কবিতাগুলির বিষয়। 'দ্রোহহীন আমার দিনগুলি' গ্রন্থে স্মৃতিবাহিত হয়ে এলো শৈশব, কৈশোর, জীবনের গোড়ার দিকের নানা ঘটনা ও কাহিনি। 'অলকের্চর উপাখ্যান' নামে দীঘর্চ কবিতায় লিখেছি মানুষের শুদ্ধিকরণের কথা, আর 'ভারবাহীদের গান' নামের দীঘর্চ কবিতায় ঈষৎ তিযর্চকভাবে এই সমাজের অসঙ্গতি, মানুষের খবর্চতা আর অত্যাচারীর নৃশংসতা ও ষড়যন্ত্রের কথা উঠে এসেছে।
এভাবে আমি আত্মক্ষরণ ও খননে বিশ্বাস করে বারবার পথ খুঁজেছি। আমি মনে করি, কবিতার ইতিহাস যেমন আঙ্গিকের ইতিহাস, তেমনই চেতনা-উন্মোচনেরও ইতিহাস। কবিতার বিষয় একমাত্র হতে পারে, মানুষ। মানুষই বিগ্রহ। মমতায়, স্নেহে, কারুণ্যে দ্রব হতে থাকেন একজন কবি আর মানুষকে দেখেন বেদনাদীণ, অসম্পূণ সত্তার প্রতীক হিসাবে। ভালোমন্দে, পাপে-পূণ্যে সমগ্র হয়ে ওঠে মানুষ। তাঁর দেখা এই মানুষকেই। মানুষের উত্থানপতনসঙ্কুল খণ্ডিত জীবনের সূক্ষ, অতিসূক্ষ অনুভূতির ইতিহাসই শিল্পের ইতিহাস। তাৎমযর্চময় খোঁজই শিল্প, অবশ্যই অন্তজর্চগতের।
প্র। আপনার মতে, দীর্ঘ কবিতা কী? কখন এবং কীভাবে গড়ে ওঠে কবিতা?
উ। আমার মনে হয়, কবিকে হতে হবে উৎকৃষট এক চিত্তের অধিকারী। আবহমান ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় অবগাহন করেছে, সমবেত মানুষের সাধনার সারাৎসার আত্মসাৎ করেছে, এরকম ঋদ্ধ, গ্রহণোন্মুখ, সংশয়ী, সংবেদনশীল চিত্তের চেতনার সারাৎসারই কবিতা, যে চেতনায় থাকে প্রজ্ঞার স্বচ্ছ আবরণ। তাঁর প্রয়োজন অভিজ্ঞতার সংহতির। তাবৎ অভিজ্ঞতার ভাস্কয আজকের কবিতা, বহুসুরের জটিল আলাপ, বিচিত্র উপলব্ধির এ্যালকেমি, মৌহূতিক উপলব্ধির নিমির্তিমাত্র নয়।
তিনিই কবি, যিনি জীবনমন্থন করে বিষ ও অমৃত দুই-ই তোলেন এবং পান করেন নিবির্চশেষে। তিনি বিদ্রোহী, আর তার দ্রোহ জীবনকে যারা বাড়তে দেয় না, যারা সুস্থ শিশুকে হাঁড়ির মধ্যে রেখে পঙ্গু করে দেয়, মানসিকভাবে তাকে ভিখারি বানিয়ে দেয়, তাদের বিরুদ্ধে। যদিও কবির কাজ জগৎকে অনুভব করা, বদলানো তার কাজ নয়। দণ্ডিত হয়ে জীবনের শোভা দেখে যাওয়াই কবির নিয়তি। কোনো সমাধান তিনি দিতে পারেন না। সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারেন সাধু ও গণৎকার। কবি সাধু নন, গণৎকার নন। তিনি শুধু সবার হয়ে ব্যথিত হন। মানুষের ব্যথিত আত্মাকে মেলে ধরেন সকলের কাছে। তিনি ত্রাতা নন, ভোক্তা। দুঃখ-বিষাদের ভোক্তা। মানুষ কবির কাছে সমবেদনার ভাষাকে বুঝতে চায়।
আর কবিও হাত বাড়িয়ে রাখেন মানুষের দিকে। তাতে কখনও অমৃত ওঠে, কখনও বিষ। এখানে নৈতিক-অনৈতিক কিছু নেই। এখানে যা আছে তা হলো, মানুষের সমগ্র সাধনার অজির্চত সম্পদ। ইতিহাসবোধ খুব পরিস্কারভাবেই থাকা উচিত একজন কবির। অরিজিনাল হতে হলে ঐতিহ্যের স্বীকরণ খুব জরুরি। ঐতিহ্য থেকেও নিতে হবে, সমকাল থেকেও। জীবনকে বহুকৌণিক আলো ফেলে দেখতে হবে। তিনি একদিকে হবেন দারুণভাবে জীবনাসক্ত, অন্যদিকে তার মধ্যে থাকবে সন্ন্যাসীর মতো উদাসীনতা।
মনে রাখতে হবে, অতৃপ্তি থেকেই শিল্পের জন্ম, বোধের তাড়নায় শিল্পের সমস্ত আয়োজন, কোনও অজ্ঞাত মুহূতের্চ দীঘর্চদিনের যন্ত্রণাক্ত উপলব্ধির বিস্ফোরণ ঘটে, কিন্তু এই বিস্ফোরণ ধবংসাত্মক নয়, বরং দীঘর্চদিনের রক্তক্ষরণের বিন্দু বিন্দু রক্ত জমে গোলাপ হয়ে ফোটে বলেই তা হয়ে ওঠে শিল্প। প্রকৃত কবির সৃষটি প্রক্রিয়াটা ব্যাপক অনুপ্রেরণার ফসল, দীঘর্চদিনের গ্রস্ত থাকার পরিণতি।
প্র। আপনি দীর্ঘ কবিতা লেখার দিকে এত আকৃষট হলেন কেন?
উ। দ্যাখো, লিরিক একটিমাত্র মুডকে সংহতিতে বাধে। কিন্তু মানুষের মন একমুখিন নয় কখনও, তার চেতনার স্তরেও থাকে নিশ্চেতনার, নিজ্ঞার্চনের আলো-অন্ধকারের খেলা। মিশ্র জটিল চৈতন্যের প্রকাশ কবিতার কাছে দাবি করা হয় যদি, তবে যোগ্য মাধ্যম অবশ্যই দীঘর্চ কবিতা। একটানা দুঃখ-কষটে পরিপূণর্চ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিপ্রবাহকে খণ্ড কবিতায় ধরে রাখা যায় না। বহুব্যাপ্ত জীবনচেতনাকে একটি সংক্ষিপ্ত কবিতায় প্রকাশ করা অসম্ভব। চাই এমন একটা মাধ্যম যেখানে চেতনাপ্রবাহের সূত্রে গ্রথিত ধবংসাত্মক ও গঠনমূলক তাবৎ চৈতন্য, অনুভব ও অভিজ্ঞতাকে কখনও সোচ্চারভাবে, কখনও গভীর সংবেদনায় ডুবে গিয়ে প্রকাশ করা যায়। জীবনানন্দ একেই বলেছেন, 'মহাকবিতা'। সমস্যা হলো, ইদানিংকালের বাংলা সাহিত্যে দীঘর্চ কবিতা লেখার যে রেওয়াজ, তার অধিকাংশ লিরিকের দীঘার্চয়ত একটা চেহারামাত্র। তা কখনই একমাত্রিকতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, তাতে ব্যাপক ও বহুস্তরীয় চিন্তা ও চেতনার আভাসও থাকে না।
প্র। এই 'তাবৎ চৈতন্য' কে ধরতে চাওয়ারই প্রয়াস হয়তো, পাবলো নেরুদার 'ক্যান্টো জেনারেল', নাজিম হিকমতের, 'হিউম্যান ল্যাণ্ডস্কেপস ফ্রম মাই কানট্রি', মাহমুদ দারউইশের, 'জানার্চল অফ অ্যান অডির্চনারি গ্রিফ' বা পিয়ের পাওলো প্যাসোলিনির, 'দি অ্যাসেজ অফ গ্রামশ্চি'র মতো মহাকবিতা? নিকোস কাজানথজাকিসের, 'ওডিসিঃ আ মডার্চনর্চ সিকুয়াল'কে বোধহয় মহাকাব্য বলাই ভালো!
উ। ঠিক তাই।
প্র। আপনি কবিতায় এত মিথের ব্যবহার করেন কেন?
উ। কবিতায় মিথ বা পুরাণ-কাঠামোকে আশ্রয় করে অনেকসময় সমসময়ের মানুষের বিভ্রান্তি, বিষাদগ্রস্ত চেতনাকে উন্মোচন করা যায়। মিথ হলো কাব্য-প্রতিমার কাঠামো, সে এলিয়ে পড়তে দেয় না, কল্পনার অবাধ উৎসারকে সংযত করে। যদি ওই প্রত্ন-প্রতিমার মধ্যে থাকে অনন্ত-সম্ভাবনা, তবে তা বিশেষ একটি যুগের সীমা-চৌহদ্দী ছাড়িয়ে যুগান্তরের মানুষের কাছে বেদনার ও উৎসাহের উৎস ও প্রেরণা হয়ে ওঠে। আমাদের লৌকিক কাব্য, পুরাণ, মহাকাব্যগুলি ভারতীয় জীবনে কখনই অতীতের গালগল্প হয়ে টিঁকে নেই, তাদের আছে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সজীব অস্তিত্ব। তারা সব যুগের রাষট্রবিপ্লব, ধমর্চেতনা, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে গ্রথিত থেকে নতুন নতুন অথর্চ-সম্বন্ধ সৃষটি করে এসেছে। মিথগুলিকে ও তাদের কোনও চরিত্রই তাই আমার কাছে অতীতের বলে মনে হয় না। এলিয়ট বলেছিলেন, 'কেউ যদি অন্য যুগের গভীরে সত্যই প্রবেশ করতে পারে, তাহলে সে তো নিজের যুগের মধ্যেই প্রবেশ করছে।' এই কারণেই ইউরোপের কিংবদন্তী চরিত্র মেফিস্তোফেলিস, গ্যয়তের কাছে একালের জীবসত্যকে তুলে ধরার পক্ষে উপযুক্ত চরিত্র বলে মনে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরাণ-প্রতিমাকে শুধুই 'আকির্চটাইপাল প্যাটান'র্চ হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছি। মিথের মধ্যে কোন জীবনবীক্ষা লুকিয়ে আছে, আসল কথা সেটাই।
আরও বলার কথা এই যে, কবির দৃষটি খণ্ডকালের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, তাঁর দৃষটি প্রসারিত সেই ধূসর অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। ফলে তাঁর কবিতায় খণ্ডকাল, সমকালও অখণ্ড কালচেতনায় লীন হয়ে যায়। এই যাওয়াতেই তার শিল্পের সিদ্ধি। জীবনানন্দ একেই বলেছেন, 'ইতিহাসযান।'
প্র। আপনি বারবার স্বভাবকবিতাকে আক্রমণ করেছেন। কেন?
উ। ইদানীংকালের পাঠকের একাংশ মনে করেন, স্বভাবের মধ্যে কবিত্ব যার অফুরন্ত, যার কবিতার উৎসে সবসময় থাকে স্বতঃস্ফূতর্চ আবেগ এবং সেই আবেগের মোক্ষণ ঘটে সরলরেখায়, তিনিই কবি। অনুভূতিকে উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যেতে তাদের অনীহা প্রকাশ পায়। আমার মতে, এদের মনোজগৎ অগভীর দিঘির মতন, দেখাটাও উপরিতলের। একজন প্রকৃত স্রষটাকে শুধু স্বভাব দারা চালিত হলে চলে না। তাঁর অজর্চন চলতে থাকে আমৃত্যু। যে পারে না স্বভাবকে শাসনে বাঁধতে, তাঁর কবিতা শৃঙ্খলাহীন অবাধ, উন্মুক্ত উচ্চারণ মাত্র। যেখানে কবির উচ্চারণের মধ্যে লঘুতা প্রকাশ পায়, বিষয় নিবার্চনে তুচ্ছ ঘটনা প্রধান হয়ে ওঠে, যে কবিতায় শব্দ কোনও সুদূরবাহী তাৎপযের্চ জলে ওঠে না, গভীর উপলব্ধির চাপে সংযত নিমার্চণ পায় না, যা মিলবিন্যাস ও শব্দব্যবহারের চাতুযের্চ উপরিতলে রয়ে যায়, তা-ই হালকা কবিতা। তারুণ্য যখন স্থির, কোনো প্রাজ্ঞ উপলব্ধি আয়ত্ত করতে অক্ষম, সেখানে এই লঘুচালের কবিতাই লেখা হতে থাকে। স্বভাবোক্তিকে কবিতার চূড়িদার পরিয়ে বাবু সাজিয়ে জাতে তোলার অশিক্ষা এদেশে বাহবা পায় অনায়াসেই। সহজপাচ্য লঘু পদ্যের কবিয়ালেরা মেধাহীন, অনুভূতিহীন শব্দচচার্চর যান্ত্রিক অভ্যেস থেকে ভুরি ভুরি পদ্যের জন্ম দেয়। দেশের মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে এই আত্মসবর্চস্ব ব্যক্তিত্ববাদের কী গুরুত্ব থাকতে পারে?
প্র। আপনার কথা শুনে চেশোয়াভ মিলোলঝের সেই লাইন দু'টো মনে পড়ছে, 'কি হবে কবিতা লিখে/ যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষকে' (ওয়াট ইজ পোয়েট্রি উইচ ডাজ নট সেভ/ নেশনস অর পিপলস?, কবিতার নাম, 'ডেডিকেশন', কাব্যগ্রন্থের নাম, 'রেসকিউ', ১৯৪৫)।
উ। ঠিকই। আর মানুষের সীমাহীন দুদর্চশার কারণ তো মানুষই। অন্ধ, মেধাহীন, অনুভূতিহীন একদল মানুষ। চিরকাল এরাই তো রয়েছে সমস্ত ক্ষমতা দখল করে! কবিকে তো এই বাস্তবতা উপেক্ষা করলে চলে না...
প্র। 'কবিপত্র' হঠাৎ প্রকাশ করতে গেলেন কেন? এই পত্রিকার গোড়ার দিনগুলোর কথা যদি বলেন।
উ। সে ছিল এক উন্মাদনার সময়। কবিতা আর কবিতাই তখন জীবন! আমি স্বাধীন, স্বতন্ত্র একটা কবিতার ভূমি খুঁজছিলাম। কোনো গোষঠীর পতাকাতলে দাঁড়াবো না, নিজের ভাষা খুঁজবো, নিজের মতন লিখবো, আর তা প্রকাশ করার জন্য চাই নিজের কাগজ। দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতা আমার মধ্যে এক দৃঢ় প্রত্যয় এনে দিয়েছিল। আমি আমার জীবনকেই কবিতার জন্য দিতে চেয়েছি, প্রাতিষঠানিক আশ্রয় নেওয়ার মানসিকতাই হয়নি কোনওদিন। সেই সময় পত্রিকার জন্য লেখা জোগাড় করতে কখনও প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে যাচ্ছি, কখনও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পুকুর পাড়ের ঘরে মশারি তুলে ঘুম ভাঙাচ্ছি বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তকে ঘুম থেকে তুলে কবিতা চাইছি। প্রণবেন্দুদা নিজেও কখনও চলে আসতেন, এক-দু'বার মেরিয়ানকে নিয়ে, বেশিরভাগ সময় একাই। শিশিরকুমার দাশের হালতুর বাড়িতে গেছিলাম ধানক্ষেত পেরিয়ে। অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে শিশিরদা লেখাপড়া করেন ছাত্রজীবনে। কবিপত্র প্রথম বেরোয়, ১৯৫৭ সালের ২৫ বৈশাখ। উপস্থিত ছিলেন, আলোক সরকার, উৎলকুমার বসু প্রমুখ। কিছুদিন পরে প্রায় ঘোরের মধ্যেই লিখে ফেলি আমার প্রথম দীঘর্চকবিতা, 'শবযাত্রা'। ছ-মাস ধরে একটু একটু করে লিখি। বিষ্ণু দে আর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন আমাদের খুব আপনজন। আর ছিলেন অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, পূণের্চন্দু পত্রী। কী পরিশ্রমীই না ছিলেন পূণের্চন্দু! আমার প্রথম বই 'দপর্চণে অনেক মুখ' যখন বেরোয়, তিনি অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও খুব মনে পড়ে, ছোট্টখাট্টো মানুষ, ভিতরে অপরিসীম তেজ।
প্র। 'কবিপত্র'র সোনালি যুগের কথা যদি বলেন।
উ। ১৯৬৭ সালে 'কবিপত্র' নতুনভাবে বেরুলো। সেইসময় তো অনেক তরুণ, জেদি, মেধাবী কবি-লেখকের ভিড়। এদের মধ্যে ছিল, অনন্য রায়, তুষার চৌধুরী, সুবিমল মিশ্র, চণ্ডী মণ্ডল, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, অমর মিত্র, রমানাথ রায়, শৈবাল মিত্র, প্রভাত চৌধুরী, উজ্জল সিংহ, শচীন দাস। কবি মণীন্দ্র রায় একটি চিঠি দিয়ে অনন্যকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, 'ওকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি, কবিতা লিখছে, সাহায্য করো।' অনন্যর, ডাক নাম বাপ্পা, তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স, টকটকে ফসার্চ গায়ের রং, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে, চোখে কবি হওয়ার স্বপ্ন। শান্ত রসের কবিতা পছন্দ করতো না, নিজেও ছিল উগ্র, বলিষঠ, প্রতিবাদী স্বভাবের। তখন দীঘর্চ কবিতা লিখছে, 'দৃষটি অনুভূতি ইত্যাকার প্রবাহ'। তখন আমি কলেজে পড়াই। প্রায়দিনই কলেজ থেকে ফিরে অপেক্ষা করতাম বাপ্পার জন্য। এলেই সান্ধ্যভ্রমণে লেকে যেতাম। নিজর্চনে হাঁটতে হাঁটতে কবিতা নিয়ে কতো আলোচনা হতো আমাদের। তুষার যখন বি কম ক্লাসে পড়ছে, তখনই আমার সঙ্গে পরিচয়। ওর স্বভাব ছিল আন্তরিকতার মাধুযের্চ উজ্জল। যেমন সুন্দর, সুপুরুষ চেহারা, তেমনই কবিতা পড়লেই বোঝা যেত তুষার চৌধুরী লিখছে, এমনই নিজস্বতা ছিল! রমানাথ রায়ের লেখার বৈশিষট্য ছিল সবার চেয়ে আলাদা। সুবিমল মিশ্র তখন থাকতেন চেতলার দুগর্চাপুর ব্রিজের ডান দিকের গলিতে একটি ছোট্ট ঘরে, চারপাশে বই আর বই। ওর 'হারান মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া ও সোনার গান্ধীমূতি'র্চ তো কবিপত্রে ছাপা হওয়ার পর হইচই পড়ে গেছিল। সঞ্জয়, আমি যখন ঈশ্বর গাঙ্গুলি লেনে থাকি, তখন থেকেই আমাদের সঙ্গী। চেতলা বয়েজে পড়ার সময়ই ও আমার কাছে বাংলা পড়তে আসে। স্কুল ছাড়ার পর থেকেই অসম্ভব মেধাবী ও পাণ্ডিত্যপূণর্চ গদ্য লিখতে শুরু করে। বিদেশি সাহিত্যের ভক্ত, বইয়ের সংগ্রহও অনেক। ওই আমাকে বতর্চমান ঠিকানার প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়ির খোঁজ দিয়েছিল। সত্তরের দশকে এলো অমর মিত্র। কোন সুদূর গ্রামে সে চাকরি করে। শনিবারের আড্ডায় তাঁর আসা চাই প্রতাপাদিত্য রোডে। ওঁর গল্প সবাইকে ডেকে ডেকে পড়িয়েছি একসময়। তবে সবচেয়ে ভালো সংগঠক ছিল, প্রভাত চৌধুরী। অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে ওর সঙ্গে। প্রভাতের সঙ্গেই অনেক রাত ধরে কবিগান শোনার অভিজ্ঞতা। প্রত্যন্ত গ্রাম ও মানুষ দেখার সুযোগ, এক থালা উঁচু মাপের ভাত আর এক হাতা ডাল পেলে যারা খুশি হয় কত! শৈবাল মিত্র ছিলেন নকশাল আন্দোলনের অন্যতম হোতা। আমার বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা চলে আসতেন শৈবাল। ছুটির দিন সকালেও। তারপর আড্ডা আর বেরুনো। অত্যন্ত সিরিয়াস গল্প-উপন্যাস লিখছেন। মঞ্জুষ দাশগুপ্তের কথাও খুব মনে হয়। কী সুন্দর মানুষ ছিল মঞ্জুষ! কবিতা নিয়ে কত আলোচনা হতো আমাদের। আমার পারিবারিক জীবন এবং সাহিত্যজীবন আলাদা নয়। আমার আত্মীয়পরিজন বলতে এই তরুণ লেখক-কবি। এতো অভাব, এতো শ্রম, তবু মানুষের সঙ্গ আমাকে দারুণ আনন্দ দিতো। তারপর একসময় ভাবলাম, শিল্পীদের সঙ্গে সম্পকর্চ গড়ে তুলবো। আমরা তো কেউ আলাদা নই। শিল্প সংখ্যায় সে সময়ের প্রায় সমস্ত প্রধান শিল্পীকে একত্রিত করেছিলাম আমরা।
প্র। আপনি জীবনে নানা ধরনের সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছেন...
উ। হ্যাঁ, নানারকম। প্রথম যুক্ত হয়েছিলাম ধবংসকালীন কবিতা আন্দোলনের সঙ্গে। তখন মনে হতো, কবিতা লিখতে এসে শুচিবায়ু ঝেড়ে ফেলতে হবে। নিবির্চারে যে কোনও শব্দ গ্রহণ করতে হবে। বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও পরিবেশকে দিতে হবে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব। সাজানো-গোছানো ব্যক্তিগত বিষয়ই কবিতা হবে না, বিষয় হিসাবে উঠে আসবে সামগ্রিক জীবনের চলমান অভিজ্ঞতা, অনুভবের চেতনাপ্রবাহ। কবিতার বিশুদ্ধতা রক্ষা জিনিসটাই অবাস্তব, অবান্তর ভাবনা। কবিতা একইসঙ্গে মুক্ত, আবার ঐতিহ্যের অংশও বটে। তাকে মানুষের জীবনযাপনের সমগ্র সুন্দর ও ক্লেদের অমোঘ প্রকাশ হয়ে উঠতে হবে। একটি অনুভব বা ভাবনা মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়, তার সঙ্গে অতীত, বতর্চমান ও ভবিষ্যৎ, খণ্ডখণ্ড ঘটনা ও কিংবদন্তী, ছেঁড়াখোঁড়া স্মৃতির অংশ, উদ্ধৃতি ও চলচ্ছবি, বোধ ও মেধা যুক্ত হয়ে যায় অবিচ্ছিন্নভাবে। কবিতা হবে কখনও দাশর্চনিক, কখনও বেদনায় উত্তাল, কখনও বিষন্নতায় নীরব। 'ধবংসকালীন' কথাটির মধ্য দিয়ে এইসব বৈশিষট্যকেই আমরা বোঝাতে চেয়েছিলাম। আমার 'ইবলিশের আত্মদশর্চণ'-এর পাশাপাশি প্রভাত চৌধুরী লিখেছিল, 'আমি মেফিস্টোফেলিস', কাননকুমার ভৌমিক, 'খলিউল্লার জবানবন্দী' আর অঞ্জন কর, 'জ্যোৎস্নায় ছেঁড়া চন্দ্রালোকে।' আমাদের মধ্যে একমাত্র গদ্যলেখক তখন চণ্ডী মণ্ডল। অসামান্য গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। সম্পূণর্চ নতুন রীতিতে লিখতে শুরু করল সে। এরকমই একটা আন্দোলন ছিল, 'থাডর্চ লিটারেচার' আন্দোলন। যে গল্প বা উপন্যাস শুধু ডান দিকের কথা বলে, শুধু যৌনতা আর সাধারণ, মামুলি জীবন, তা হলো ফাস্টর্চ লিটারেচার। যে সাহিত্য শুধু বিপ্লবের কথা বলে, পরিস্কার খোলা চোখে দুনিয়াকে দেখে না, তা সেকেণ্ড লিটারেচার। আর যা ডান-বা বিচার না করে নিবির্চারে জীবনের কথা তুলে ধরে, সেটাই থাডর্চ লিটারেচার। আমরা এই ভাবনাকে তুলে ধরে সেই সময় ম্যানিফেস্টো বার করেছিলাম। সেইসময় আমি এমন ভঙ্গিতে কবিতা লিখতে শুরু করলাম যেখানে আমার লেখাকে পাঠক নিজের বলে ভাববে। মানে, আমাদের কবিতা পড়ে যেন যে কেউ মনে করতে পারেন, এ লেখাটা তারই লেখার কথা, কিভাবে যেন অন্য কেউ লিখে ফেলেছে। অথার্চৎ, পাঠকের সঙ্গে কবির সম্পকর্চ হবে সহমমীর্চর, দূরত্বের নয়। ভাষা হবে পুরোপুরি উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পবজির্চত। এই ভাবনার নাম দিয়েছিলাম, প্রয়োগবাদী কবিতা বা অ্যাপ্লায়েড পোয়েট্রি। তবে সব কিছুর পরও মনে হয়, বাইরের পৃথিবীর নানারকমের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে লেখকের স্বাধীনসত্তাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। পাঁচজনে মিলে একটা পত্রিকা করা যায়, ভাবতে হয় একা একা...


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন