শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি
--- স্বামী বিবেকানন্দ
১)
শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার
শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি প্রথম দর্শন করি দক্ষিণেশ্বরে তাঁর নিজের ঘরে। সেইদিন আমি দুটি গান গেয়েছিলাম।
গান তো গাহিলাম, তাহার পরেই ঠাকুর সহসা উঠিয়া আমার হাত ধরিয়া তাঁহার ঘরের যে বারান্দা আছে, তথায় লইয়া যাইলেন। তখন শীতকাল। উত্তরের হাওয়া নিবারণের জন্য উক্ত বারান্দায় থামের অন্তরালগুলি ঝাঁপ দিয়া ঘেরা ছিল; সুতরাং তার ভিতরে ঢুকিয়ে ঘরের দরজাটি বন্ধ করিয়া দিলে ঘরের ভিতরের বা বাহিরের কোন লোককে দেখা যাইত না। বারান্দায় প্রবিষ্ট হইয়াই ঠাকুর ঘরের দরজাটি বন্ধ করায় ভাবিলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দিবেন। কিন্তু যাহা বলিলেন ও করিলেন তাহা একেবারে কল্পনাতীত। সহসা আমার হাত ধরিয়া দরদরিতধারে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন এবং পূর্ব পরিচিতের ন্যায় আমাকে পরম স্নেহে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, 'এতদিন পরে আসিতে হয়? আমি তোমার জন্য কিরূপে প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি তাহা একবারও ভাবিতে নাই? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনিতে শুনিতে আমার কান ঝলসিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে; প্রাণের কথা কাহাকেও বলিতে না পারিয়া আমার পেট ফুলিয়া রহিয়াছে।' -ইত্যাদি কত কথা বলেন ও রোদন করেন! পরক্ষণেই আবার আমার সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া দেবতার মত আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, 'জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ। জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীর ধারণ করিয়াছ।'
আমি তো তাঁহার ঐরূপ আচরণে একেবারে নির্বাক -স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম এ কাহাকে দেখিতে আসিয়াছি। এ তো একেবারে উন্মাদ -না হইলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি। আমাকে এইসব কথা বলা কেন? যাহা হউক, চুপ করিয়া রহিলাম। অদ্ভুত পাগল, যাহা ইচ্ছা বলিয়া যাইতে লাগিলেন। পরক্ষনে আমাকে তথায় থাকিতে বলিয়া তিনি গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং মাখন, মিছরি ও কতগুলি সন্দেশ আনিয়া আমাকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। আমি যত বলিতে লাগিলাম, 'আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি সঙ্গীদের সহিত ভাগ করিয়া খাই গিয়ে।' তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না। বলিলেন, 'উহারা খাইবে, এখন তুমি খাও।' বলিয়া সকলগুলি আমাকে খাওয়াইয়া তবে নিরস্ত হইলেন। পরে হাত ধরিয়া বলিলেন, 'বল, তুমি শীঘ্র একদিন আমার নিকটে একাকী আসিবে?' তাঁহার ঐরূপ একান্ত অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া অগত্যা 'আসিব' বলিলাম এবং তাঁহার সহিত গৃহমধ্যে প্রবেশপূর্বক সঙ্গীদের নিকটে উপস্থিত হইলাম।
বসিয়া তাঁহাকে লক্ষ করিতে লাগিলাম ও ভাবিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তাঁহার চালচলনে, কথাবার্তায় অপর সকলের সহিত আচরণে, উন্মাদের মতো কিছুই নাই। তাঁহার সদালাপ ও ভাবসমাধি দেখিয়া মনে হইল সত্যসত্যই ইনি ঈশ্বরার্থে সর্বত্যাগী এবং যাহা বলিয়াছেন তাহা স্বয়ং অনুষ্ঠান করিয়াছেন। তিনি অতি সহজ সরল ভাষায় উচ্চ আধ্যাত্মিক কথা বলিতেছিলেন। আমার মনে হইল, 'উনি হয়তো সত্যিই একজন উঁচুদরের সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ!' আমি তাঁহার দিকে আগাইয়া গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম, 'মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন?' তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, 'আমি ঈশ্বর দর্শন করেছি। ঠিক যেমন তোমাকে দেখছি; তবে এর চেয়েও আরো ঘনিষ্ঠরূপে।' তিনি আরও বলিয়া যাইতে লাগিলেন, 'ঈশ্বর দর্শন হয়, তাঁকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা বলা চলে। ঠিক যেমন আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু কে তা চায়? লোকে মাগ-ছেলের শোকে, বিষয়-আশয়ের দুঃখে, ঘটি ঘটি কাঁদে, ভগবানের জন্য কে তা করে? সরলভাবে ভগবানের জন্য কাঁদলে তিনি নিশ্চয়ই দেখা দেন।' উহাতে তখনই আমার প্রত্যয় জন্মিল। মনে হইল, তিনি অপর ধর্মপ্রচারক সকলের ন্যয় রূপক বা কল্পনার সাহায্য লইয়া ওই রুপ কথা বলিতেছেন না, সত্য সত্যই সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া এবং সম্পূর্ণ মনে ঈশ্বরকে ডাকিয়া যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাহাই বলিতেছেন। তখন তাঁহার ইতঃপূর্বের আচরণের সহিত ঐসকল কথার সামঞ্জস্য করিতে যাইয়া আমার দৃঢ়নিশ্চয় হইল, উনি একজন অর্ধোন্মাদ (monomaniac)। এইরূপ নিশ্চয় করিয়াও কিন্তু ইঁহার ঈশ্বরার্থে অদ্ভুত ত্যাগের মহিমা ভুলিতে পারিলাম না। আমি ভাবিলাম উন্মাদ হইলেও ঈশ্বরের জন্য ঐরূপ ত্যাগ জগতে বিরল ব্যক্তিই করিতে সক্ষম; উন্মাদ হইলেও এ ব্যক্তি মহাপবিত্র, এবং ওই জন্যই মানবহৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা, সন্মান পাইবার যথার্থ অধিকারী!' এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেইদিন তাঁহার চরণ বন্দনা করিয়া ও তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।
২)
দ্বিতীয় দর্শন
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি যে কলিকাতা হইতে এত অধিক দূরে তাহা ইতঃপূর্বে গাড়ি করিয়া একবার মাত্র যাইয়া বুঝিতে পারি নাই। যত যাই পথ যেন আর ফুরাইতে চাহে না। যাহা হউক, জিজ্ঞাসা করিতে করিতে কোনরূপে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিলাম এবং একেবারে ঠাকুরের গৃহে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, তিনি পূর্বের ন্যায় তাঁহার শয্যাপার্শে অবস্থিত ছোট্ট তক্তাপোশখানির উপর একাকী আপন মনে বসিয়া আছেন, -নিকটে কেহই নাই। আমাকে দেখিবামাত্র আহ্লাদে নিকটে ডাকিয়া তাঁহারই এক প্রান্তে বসাইলেন। বসিবার পরেই কিন্তু দেখিতে পাইলাম, তিনি যেন কেমন এক প্রকার ভাবে আবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন এবং অস্পষ্ট স্বরে আপনা-আপনি কি কি বলিতে বলিতে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করিয়া ধীরে ধীরে আমার দিকে সরিয়া আসিতেছেন। ভাবিলাম, পাগল পূর্বদিনের ন্যায় আবার কোনরূপ পাগলামি করিবে। এইরূপ ভাবিতে না ভাবিতেই তিনি সহসা নিকটে আসিয়া নিজ দক্ষিণপদ আমার অঙ্গে সংস্থাপন করিলেন এবং উহার স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে আমার এক অপূর্ব উপলব্ধি উপস্থিত হইল। চক্ষু চাহিয়া দেখিতে লাগিলাম, দেওয়ালগুলির সহিত গৃহের সমস্ত বস্তু বেগে ঘুরিতে ঘুরিতে কোথায় লীন হইয়া যাইতেছে এবং সমগ্র বিশ্বের সহিত আমার আমিত্ব যেন এক সর্বগ্রাসী মহাশূন্যে একাকার হইতে ছুটিয়া চলিয়াছে। তখন দারুণ আতঙ্কে অভিভূত হইয়া পড়িলাম, মনে হইল আমিত্বের নাশেই মরণ, আর সেই মরণ সম্মুখে, -অতি নিকটে। সামলাইতে না পারিয়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলাম, 'ওগো, তুমি আমার এ কি করলে, আমার যে বাপ-মা আছেন।' অদ্ভুত পাগল আমার ঐ কথা শুনিয়া খলখল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, এবং হস্ত দ্বারা আমার বক্ষ স্পর্শ করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন, 'তবে এখন থাক, একেবারে কাজ নেই, কালে হইবে।' আশ্চর্যের বিষয়, তিনি ঐরূপে স্পর্শ করিয়া ঐ কথা বলিবামাত্র আমার সেই অপূর্ব প্রত্যক্ষ এককালে অপনীত হইল; প্রকৃতিস্থ হইলাম। এবং ঘরের ভিতরের ও বাহিরের পদার্থ সকলকে পূর্বের ন্যায় অবস্থিত দেখিতে পাইলাম।
বলিতে এত বিলম্ব হইলেও ঘটনাটি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হইয়া গেল, এবং উহার দ্বারা মনে এক যুগান্তর উপস্থিত হইল। স্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, এটা কি হইল? দেখিলাম তো উহা এই অদ্ভুত পুরুষের প্রভাবে সহসা উপস্থিত হইয়া সহসা লয় হইল। পুস্তকে Mesmerism (মোহিনী ইচ্ছাশক্তি সঞ্চারণ) ও Hypnotism (সম্মোহন বিদ্যা) সম্বন্ধে পড়িয়াছিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, উহা কি ঐরূপ কিছু একটা? কিন্তু ঐরূপ সিদ্ধান্তে প্রাণ সায় দিল না। কারণ, দুর্বল মনের উপরই প্রভাব বিস্তার করিয়া প্রবল ইচ্ছাশক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তিগণ ঐ সকল অবস্থা আনয়ন করেন; কিন্তু আমি তো ঐরূপ নহি, বরং এতকাল পর্যন্ত বিশেষ বুদ্ধিমান এবং মানসিক বল-সম্পন্ন বলিয়া অহংকার করিয়া আসিতেছি। বিশিষ্ট গুণশালী পুরুষের সঙ্গলাভপূর্বক ইতর সাধারণে যেমন মোহিত এবং তাঁহার হস্তের ক্রীড়া-পুত্তলিকাস্বরূপ হইয়া পড়ে, আমি তো ইঁহাকে দেখিয়া সেইরূপ হই নাই; বরং প্রথম হইতেই ইঁহাকে অর্ধোন্মাদ বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছি। তবে আমার সহসা ঐরূপ হইবার কারণ কি? ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। সুতরাং দৃঢ়-সংকল্প করিলাম, অদ্ভুত পাগল নিজ প্রভাব বিস্তার করিয়া আর যেন কখনও ভবিষ্যতে আমার মনের উপর আধিপত্য লাভ পূর্বক ঐরূপ ভাবান্তর উপস্থিত করিতে না পারে।
আবার ভাবিতে লাগিলাম, ইচ্ছা মাত্রই এই পুরুষ যদি আমার ন্যায় প্রবল ইচ্ছাশক্তি-সম্পন্ন মনের দৃঢ় সংস্কারময় গঠন ঐ রূপে ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া কাদার তালের মতন করিয়া উহাকে আপন ভাবে ভাবিত করিতে পারেন, তবে ইঁহাকে পাগলই বা বলি কী রূপে? কিন্তু প্রথম দর্শনকালে যেরূপে সম্বোধন করিয়াছিলেন এবং যে সকল কথা বলিয়াছিলেন সেই সকলকে ইঁহার পাগলামির খেয়াল ভিন্ন সত্য বলিয়া কিরূপে মনে করিতে পারি? সুতরাং পূর্বোক্ত অদ্ভুত উপলব্ধির কারণ যেমন খুঁজিয়া পাইলাম না, শিশুর ন্যায় পবিত্র ও সরল এই পুরুষের সম্বন্ধেও কিছু একটা স্থির নিশ্চয় করিতে পারিলাম না। বুদ্ধির উন্মেষ হওয়া পর্যন্ত দর্শন, অনুসন্ধান ও যুক্তিতর্ক সহকারে প্রত্যেক বস্তু ও ব্যক্তি সম্বন্ধে একটা মতামত স্থির না করিয়া কখনও নিশ্চিন্ত হইতে পারি নাই। অদ্য সেই স্বভাবে দারুন আঘাত প্রাপ্ত হইয়া প্রাণে একটা যন্ত্রণা উপস্থিত হইল। ফলে মনে পুনরায় সংকল্পের উদয় হইল, যেরূপে পারি, এই অদ্ভুত পুরুষের স্বভাব ও শক্তির কথা যথাযথভাবে বুঝিতে হইবেই হইবে।
ঐরূপে নানা চিন্তা ও সংকল্পে সেদিন আমার সময় কাটিতে লাগিল। ঠাকুর কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনার পরে যেন এক ভিন্ন ব্যক্তি হইয়া গেলেন এবং পূর্ব দিবসের ন্যায় নানাভাবে আমাকে আদর-যত্ন করিয়া খাওয়াইতে এবং সকল বিষয়ে বহুকালের পরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করিতে লাগিলেন। অতি প্রিয় আত্মীয় বা সখাকে বহুকাল পরে নিকটে পাইলে লোকের যেরূপ হইয়া থাকে, আমার সহিত তিনি ঠিক সেইরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন। খাওয়াইয়া, কথা কহিয়া, তাঁহার যেন আর আশ মিটিতেছিল না। তাঁহার ঐরূপ ভালবাসা ও ব্যবহারও আমার স্বল্প চিন্তার কারণ হয় নাই। ক্রমে অপরাহ্ন অতীত প্রায় দেখিয়া আমি তাঁহার নিকটে সেদিনকার মত বিদায় যাচ্ঞা করিলাম। তিনি যেন তাহাতে বিশেষ ক্ষুণ্ন হইয়া 'আবার শীঘ্রই আসিবে বল' বলিয়া পূর্বের ন্যায় ধরিয়া বসিলেন।সুতরাং সেদিনও আমাকে পূর্বের ন্যায় আসিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে বাটিতে ফিরিতে হইয়াছিল।
( ক্রমশ )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন