" বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় " লিখেছিলেন জীবনানন্দ । কবি দীপংকর রায়ের কবিতা স্বতন্ত্রভাবে , অতলস্পর্শী ভাবনার গভীরতায় স্পর্শ করে আমাদের চৈতন্যের নদী । দেশজ আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে , বিরল পংক্তি বিন্যাসে এক মায়াময় ব্যতিক্রমী কবিতাজগৎ সৃষ্টি করেন তিনি । এখানে আমরা ধারাবাহিকভাবে পড়ছি তাঁর একটি কবিতা উপন্যাস ।
কোথাকার অতিথি আমি ( মানস ভ্রমণ)
পরবর্তী পর্ব
নিয়ম ভেঙেছিলাম। রওনা হয়েছিলাম কজনে । তারপর একা।
একদম একা?
তা তো না ! তা হয় না।
এই যে এসেছি, অনেক একাকে ভেঙে।
ভাঙতে ভাঙতেই মিশে গেলাম সেই স্রোতে ।---
বয়ে যাওয়া তো থাকবেই। থাকবে বিশ্রাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?
ঘুম যেন ভুলিয়ে দিয়েছিল কোনটি আমার দেশ।
পথে পথে, নদীতে ,
বাতাসে বাতাস ভেঙে, এক এক জায়গায় একটুখানি ,'
কে যেন জানলা খুলে ডাকতে থাকলো: ওহে, এদিকে এসো , এইখানে...
দোষ হবে না তো?
হাত ধুয়ে ফেল সাবানজলে, ----- তোমার কোনো বন্ধন নেই ।
ওই তো আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। ঈদের চাঁদ।
তুমি দেখবে না, তা কি হয়?
কবেকার জোছনা খন্দকার বলেছিল যেন।
কোন সে অতীত?
জন্মান্তরের ওপার থেকে ডাক এসেছিল জানলা মেলিয়ে ।
সাড়া না দিয়ে কি পারি?
কীভাবে যেন চলে যাই -----
ইফতারের সন্ধ্যা। মোয়াজ্জিনের ডাক শেষ হলো।
তথাপি গোল হয়ে বসে পড়তেই হলো ,------
এক আকাশ তারায় তারায়, খুব কাছাকাছি বিনিময় করতেই হলো,কুশল ----
করোনা, সে কোন বস্তু ----বলছিল, মোকসেদ ,সিরাজুল...
তির তির করে বইছিল নবগঙ্গা। ফাল্গুনের হাওয়া-রোদে সে যে কী বর্ণময় দেখাচ্ছিল তাকে! কতো কথা তাকে ঘিরে। ওই তো, স্কুল থেকে একগাদা বই-খাতা বগলদাবায় ফিরছি। ওই তো, হাট থেকে ফিরছি দ্রুত পায়ে। কেন, না, খেয়া যদি চলে যায়, সন্ধ্যা যদি হাজারি মন্ডলের বাগান পার হবার আগেই নেমে আসে!
ওই তো, সার দিয়ে দাঁড়িয়ে, জরাসন্ধ, শীতলা, কালী । মাটির তৈরি নয়? সন্ধ্যা হলে ,অশ্বত্থ তলায় ওরা জীবন্ত চেয়ে থাকে যেন। কতো তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাবো এই পথটুকু। বাবুঘাটের কাছে এসে, ছুট লাগাই এক নিঃশ্বাসে। যেন দমবন্ধ ছুট লাগালে আর কোনো ভয় নেই। এক নিঃশ্বাসে পার হয়ে যাবো আইশোদাদের বাড়ি।
সব তো সেদিনের কথা!
আজ কেন জানি মনে হয় , সত্যিই কি, সত্যিই কি এইসব কোনোদিন ছিলো?
নবগঙ্গা ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাসে ।
খাড়া পাউড়ি ভেঙে দমকা বাতাসেরাও যেন চায় পিছন ফিরে।
আমি কার ঘাটে ফিরে চাই?
কদমফুল ঝরিয়ে মালোপাড়ার ভাঙন জানান দেয়, জল-শ্যওলারা সুকুমার মাঝির ভেসাল- জালে চুচড়ো মাছেদের সঙ্গে ভেসে জিলকোতে থাকে।
আমি কি আজও দাঁড়িয়ে আছি খালুই নিয়ে , বাঁশজঙ্গল নিচু হওয়া সেই
মালোপাড়ার ঘাটে?
কোথায়, কেউ নেই ।
সুকুমার মালো নেই । বৈদ্যমাঝিও নেই ।
কদম গাছটা আছে আজ ও, কালো জলে ছায়া ফেলে।
2 .
এখানে কারো মুখে মাক্স নেই।
পুলিশ এলে কোমোড়ের গামছা পেচায় মুখে।
ফুলমিঁয়া বলছিল, ' কীসব শুনতিছিরে ভাই, চারদিকি এতো মানুষ মরতিছে কিসের জন্যি ? করুনা না করোনা, কী কয় জানি--- কী এক রোগের বালাই আলো, কওদেহিনি কনে যাই? মাঠে-ঘাটে কনে পাই সাবান-পানি , তাই কও তো একবার---? '
আমি ভাই ওসব বুঝিনে,নবগঙ্গায় গোসল করি। কলের পানিতে হাত ধুয়ে ইফতার যাই। সিয়েরিতে রাত-ভোর হলি, ওজু করে নমাজ আদায়ে দাঁড়াই। '
পল্লীতে করোনা পথ পাইনি। যা কিছু শহরে।
এদের বিদেশ- বিভুঁই নেই। খিদে পেলে গোগ্রাসে খায়। মাঠে -ঘাটে ধান কাটে। মনের আনন্দে গায় জারি-সারী। সুরেরও ধার ধারে না। যা আসে তাই। নিজেরাই কথা বসায় আপন ছন্দ-সুরে।
তাই, করোনা এখানে পথ পাইনি। সে যেন বড়ো নদীর ওপারের ঢেউ উতরে এগোতে পারেনি ।
এত বাতাসে ভেঙে যায় তার লালারসের পথ---- ?
যা কিছু নদী ঝাঁপিয়ে এগোয়, তা যেন আকাশের ----
কেউ হয়তো গামছা পেঁচিয়ে শহর থেকে ফিরলে ,ফুলমিঁয়া বলে, আমি ভাই এহনো যাইনি কোথাও। যদি লাগেই তো ম্যানাগাইডা রইছে তো , তার মুহির টোনাডাই গলায়ে নিতি হয় তো নিবানে, তারপর না হলি পাকখাবানেই মলনের খুঁটোয়!
গ্রাম থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আসে পঙ্কজ শহরে। দাশেদের সেল্সম্যন। সেও শহরে আসার সময় লাগিয়ে নেয় ভাজকরা রুমাল মুখে। তারপর অনভ্যাসে ঝুলিয়ে দেয় গলায়। দাশ বলে, এই পঙ্কজ, মুখোশ লাগা, না হলি কিন্তু মেলেটারি দেখলি দিবেনে দোয়ানের ঝাপ ফেলায়েই হয় তো।
স্বপন মুদির দোকান সেরে ইদানিং স্থানে যায়। সাবান ঘসে ।
ফুলমিঁয়ার সাবান নদীর মাটি। তাই খানিক মাথায় শরীরে ঘসে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নবগঙ্গায়।
আমি পড়েছি বড়ো ঝামেলায়। সেই যে বর্ডার পেরিয়ে বাশেঁর নিচে দিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম, তারপর এদিক ওদিক সকলকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে , এখন একা। সবাইকেই এক ফুঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি ওপারে।
ভাবলাম, এমন সুযোগ তো আর হবে না, যদি করোনার তাড়নায় খানিকটা অনেকদিন পরে কাটিয়ে যেতে পারি এই দেশটায় ।
কতোদিন খন্দকার- লিলি- পপি-ডলি-মলিদের দেখিনি!
এই সুযোগে সকলের কাছেই একবার ঘুরে আসবো।
এক একজনের ঠিকানা এক এক দিকে।
সময় সুযোগ পেলে ,হাওয়া বাতাসেই ভেতরের ডানা জোড়া মেলবো । হাওয়া বাতাসেই ঘুরবো।
এখন আউসএর কাল। ধান কাটা চলছে। কাটা ধানগাছের মোথায় জোছনার গড়াগড়ি। কী যে বর্নময় !
শুনশান বাতাসে রাত শেষ ভোরের গন্ধ। খানিকটা জড়িয়ে যায় গায়। ফোনে গালাগাল খাই। কাদের যেন লৌকিকতা নষ্ট হলো। গীতা না উর্মি শ্রাবণী না লাবণি, কতো সব নাম-ধাম তাদের! কারো যেন ঘুম নেই এই আহম্মকের জন্যে।
কারা যেন কতো মাছ কিনে পরিজন-কথা শোনায় : এক কেজি মাছ পনেরো শো, কেউ নদীর আড় কেনে পাঁচ হাজারে ।
কার কাছে যাই?
কার ঘর এখন আমার!
লঞ্চে পার হই পদ্মা। আরিচায় শিশু কিশোর -কিশোরীদের জলবিহার দেখি।
কতকাল আগে, কোনো এক রাতের জোছনায়, লঞ্চে মধ্যরাত্তির পার করে কার যেন অপেক্ষা ছিল, কার যেন অপেক্ষার ভোর বুকে আগলে বসে থাকা--- তারপর ,শিউলিফুলে বদল হয়েছিল এক আকাশ নক্ষত্র- পথ !
মহাসংগমের সেই রাত কতকাল পেছনে পেছনে ছোটেনি এমন !
আজ ভরা সংসার তার । আমিই কেবল ঘুরে মরি এ ডাল থেকে সে ডাল ?
কোন বাংলার রিক্তহাতে কেউ যেন বাড়িয়ে ধরেছিল এক খন্ড মোম। সেই আলোয় কোন মুগ্ধতা প্রকাশ পায় আজ?
আমি কি কারো উৎসর্গেই সাড়া দিতে পারি?
আতঙ্ক বাড়ে দু' দিকেই। এক দিকেও নিশ্চিন্ত নয় কেউ। মৃত্যুমিছিল বাড়ে। এখানে দশ তো ওখানে পঞ্চাশ। কেউ কারো পরিজনকেও চিনতে যায় না শ্মশানে। গোরস্থান নেই! ফাঁকা জায়গা পেলেই বেলচায় ছুঁড়ে দেয় মৃত শরীরটাকে।
শুধু দেখছি ফুলমিঁয়ার চিন্তাকে ছুঁতে পারে না করোনার তাড়না, সে মহাসুখে ধানগাছের গোড়ায় মারে পোচ।
কোন দিকে যাই?
লম্বা পথে এমন কোনো পথ নেই, যেখান দিয়ে যেতে পারি, একজনেরও সংসার চিনতে।
নগরের ঘুম নেই। কেউ ঘুমায় না যেন। ঈদ আসে। আসে ষষ্টির জামাই ডাক: আমি কি কারো আপ্যায়নের দাম দিতে পেরেছি ?
এক এক জনের এক এক ব্যঞ্জন গিলে, সেই যে
পথে পথে ভেসে বেড়াচ্ছি, সেও তো কম দিন হলো না!
আড়াইমাস কেটে গেল প্রেমে , অপ্রেমে ----
ভিডিওকল আসে, এক এক দিক থেকে ।
রাতের আকাশে এক এক দিকে প্যাঁচা হয়ে ঘুরি। কাউকেই দেখাতে পারি না মুখ।
তুমি কি চেন , তুমি কি চিনতে পেরেছ আমায়?
সুখ ও সম্ভোগে বসিয়েছ আড়াআড়ি ঘুম চোখ। আমারই ছায়ায় আমারই নকল! একটা অঙ্কও শেষপর্যন্ত মেলাতে দাও নি । তবু হাতে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম এক একটি স্থলপদ্ম ।
প্যাঁচা হয়ে প্যাঁচার চোখের কোনে যে মাঠের খুঁদকুড়ো খুঁজি, তা কি প্রকৃত আদার ?
ক্ষুধার্ত আমি। বহু খিদে নিয়ে এক একটি গৃহ কোণে, এক এক ধরণের লৌকিকতায় নীল হয়ে ,পথে পথে ঘুরি একা। নিতান্ত একাকী নিজেই নিজের ছায়াকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে, পুনরায় পথ ভাঙি।
( ধারাবাহিক )
সময়ের স্বর বেজে উঠলো।
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অনেক বাংলাদেশী শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলো দারুন লাগছে।"
উত্তরমুছুনএদের বিদেশ- বিভুঁই নেই। খিদে পেলে গোগ্রাসে খায়। মাঠে -ঘাটে ধান কাটে। মনের আনন্দে গায় জারি-সারী। সুরেরও ধার ধারে না। যা আসে তাই। নিজেরাই কথা বসায় আপন ছন্দ-সুরে। " অংশটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই লেখা দৈনন্দিন জীবনের কথা, বেদনার কথা তুলে ধরেছে।