সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

দীপঙ্কর বাগচী

 




এ সময়ের একজন অগ্রগণ্য লেখক। তাঁর নিরলস সাহিত্যচর্চা আমাদের সমৃদ্ধ করে। গদ্য ও কবিতা -- সব মিলিয়ে দীপঙ্কর এ পর্যন্ত দশটিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। স্বরবর্ণে আমরা পড়ব সদ্য প্রয়াত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা,তাঁর একটি অসামান্য গদ্যরচনা।





বুধুয়ার পাখি ও কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত



" মানুষ যে আত্মিক, এই কথাটা বোঝার জন্য আগে তার জৈবিক হওয়া প্রয়োজন। আগে সে ধূলায় হামাগুড়ি দেবে, তারপর তো নিউটনের মতো বিশ্ব পাড়ি দেবে। তাই শরীর হলো গতির প্রথম শর্ত, ইন্দ্রিয় হল পূর্ণতার প্রথম সোপান। "
                                                                            ----  শিলার



 সম্প্রতি এই বিশ্বজোড়া করোনার অতিমারীর কালে প্রয়াত হয়েছেন বাংলার বহু বিশিষ্ট কবি ও শিল্পীরা, বয়সের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই। আন্তর্জাতিক মননের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পণ্ডিত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত মারা গেলেন। এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষতি সাহিত্য কাব্য পাঠকের কাছে।


অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে গেলে উপরে উল্লিখিত কবি দার্শনিক  শিলারের কথাটি বহুভাবে বর্ণিল হয়ে ওঠে। কীটস ও তার পূর্বে শেকসপীয়র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ইন্দ্রিয় সংবেদনার কথা বলেছেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে ইন্দ্রিয় সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অলোকরঞ্জন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ যৌবনবাউল থেকে যে ইন্দ্রিয় সংবেদনার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন ,তা এক কথায় অনবদ্য।



   কারণ আমরা কখনওই দেহ নামক ঝড় বস্তুটিকে নিরপেক্ষ রেখে অন্তরজীবনের আধ্যাত্মিকতার গান গাইতে পারি কি না ,তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একথা ঘোষিতভাবে পৃথিবীর শেষ রোচিষ্ণু (Romantic) W. B. Yeats -এর ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।



   দলগতভাবে গত শতকের ৫০-এর দশকের প্রধান কবিরা প্রায় কেউই নিরালম্ব উদাসীনতার চর্চা করতে পারেন নি। পারেন নি তথাকথিত আধ্যাত্মিক কবির শিরোপা বহন করতে। যদিও আধ্যাত্মিকতা বলতে আমরা ' অন্তরজীবন'কে বুঝে থাকি। আধ্যাত্মিকতা কোন ' ঈশ্বরমুখীনতা ' নয়, আবার ' ঈশ্বর' নিরপেক্ষতাও নয়। অন্তরজীবনের এই গান আমরা অলোকরঞ্জনের  লেখায় প্রথম জীবনে দারুণভাবে লক্ষ করি, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে, পরবর্তী জীবনে শিলার কথিত নিউটনের মতো বিশ্ব পাড়ি দিতে গিয়ে তিনি পথ হারিয়ে ভঙ্গি সর্বস্ব হয়ে উঠেছিলেন, এমনকি বাংলার নিজস্ব শিকড়টিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এটি এক বড় ট্র্যাজেডি। আদ্যন্ত কবি এই অসাধারণ পন্ডিত দার্শনিক বোধের পরিসরে নিঃসন্দেহে বিশ্বপাড়ি দিলেন। দুটি অর্থেই তা ঘটেছিল। শরীরীভাবেও তিনি বিদেশে পড়ালেন, জার্মানির নাগরিক হলেন আবার দার্শনিক মননের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অমিয়ো চক্রবর্তীর মতোই  বিশ্বমনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন, কিন্তু কবিতায় হানস গেয়র্গ গাদামার -এর মতো দার্শনিকের ' হারমেনেটিরস ' তাঁর  হজম হলো না। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের  ঐতিহাসিক,রাষ্ট্রদার্শনিক বা সাহিত্যতাত্ত্বিক থিওডোর আর্ডেণে|র 'এসথেটিক থিয়োরী'।



  এই প্রথম জীবনের জন্য কবিতার পাণ্ডিত্য দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন আন্তর্জাতিক শিল্প দার্শনিকতার বাইরের অংশটিকে, কিন্তু নিজের দেশের সঙ্গে সংযোগ সত্ত্বেও সে অর্থে দেশের মাটির সঙ্গে ইন্দ্রিয় সংবেদনার আত্মীয়তা- সেটি হারালেন অতি নির্মমভাবে। কাব্যলক্ষী তাঁকে  ধরা দিলেন না, এ এক বড় সত্য নিদারুণ যন্ত্রণা, তিনি কি তা বোঝেন নি!! নিশ্চিত বুঝেছিলেন --- বলেই বারবার ক্ষণকালের কাব্যমুহূর্তকে চিরকালের কাব্যমুহূর্তের মুকুরে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ তিনিই তো তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যৌবনবাউলে'র বিভাব কবিতায় উচ্চারিত মন্ত্র নাকি অন্য কবিতা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন ---


একটি মাত্র রাখাল যাক, এ মাঠ একলা পড়ে থাক 
নীরবে, আমি এ মাটি ছাড়বো না
ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর
ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়বো না


   অর্থাৎ যে দায়বদ্ধতা তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করলেন ,পাঠকের মননকে নতি স্বীকার করিয়ে টেনে আনলেন তাঁর কবিতার কাছে, তা সত্য সত্যই এক দুর্লভ শক্তির অধিকারী কবির পক্ষেই সম্ভব। এখানে দুটি ঘটনা তিনি যুগপৎ ঘটান, 'ছন্দ'কে মধ্যবর্তী রেখে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন কবিতাকে কখনও অলোকরঞ্জন ছেড়ে যাবেন না। ছন্দময় এ জগৎ, মৃত্যুর ঘরও আসলে ছন্দে নির্মিত হয়তো-বা।
আর তারপর এই গ্রন্থের কবিতা ' বুধুয়ার পাখি ' আমাদের যে ইন্দ্রিয় সংবেদনা ও বিশ্বচেতনার সঙ্গে যুক্ত করল তা আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত ও দিব্য উন্মাদে রূপান্তরিত করে।


বুধুয়ার পাখি


জানো এটা কার বাড়ি? শহুরে বাবুরা ছিল কাল,
ভীষণ শ্যাওলা এসে আজ তার জানলা দেয়াল 
ঢেকে গেছে, যেন ওর ভয়ানক বেড়ে গেছে দেনা,
তাই কোনো পাখিও বসে না!
এর চেয়ে আমাদের কুঁড়েঘর ঢের ভালো, ঢের
দলে - দলে নীল পাখি নিকোনো নরম উঠোনের 
ধান খায়, ধান খেয়ে যাবে-- বুধুয়া অবাক হয়ে ভাবে।
এবার রিখিয়া ছেড়ে বারুডির মাঠে 
বুধুয়া অবাক  হয়ে হাঁটে, 
দেহাতি পথের নাম ভুলে
হঠাৎ পাহাড়ে উঠে পাহাড়ের মত মুখ তুলে 
ভাবে, ওটা কার বাড়ি, কার কত নীল,
আমার ঘরের চেয়ে আরো ভালো,আরো 
নিকোনো উঠোন তার, পাখিবসা বিরাট পাঁচিল!
ওখানে আমিও যাব, কে আমায় নিয়ে যেতে পারো?

এইভাবে প্রতিদিন বুধুয়ার ডাকে 
কানায় কানায় আলো কাখের কলসে ভরা থাকে,
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে, কেউ তার দিদি, কেউ মাসি,
রুপোলি ডানায় যারা নিয়ে যায় বুধুয়ার হাসি।।



   ভাবা যায়! কিভাবে ক্ষণকাল-এর বুধুয়ার ডাক চিরকালের ডাকে পরিণত হল। মানবাত্মার বুধুয়া আর যে কোনো একটি দেহাতি গ্রামের ছোট্ট বুধুয়া, ইন্দ্রিয় সংবেদনার অখিল মায়ায় আবদ্ধ হলো। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পদাবলী সাহিত্যের জ্ঞানদাসের সেই অপূর্ব কবিতাটি, যার ভাবের ভিতরে ঠিক এই ক্ষণকালের চিরকালে পর্যবসিত হবার কথা বুনে উঠেছে।



" রজনী শাওন ঘন 
ঘন দেয়া গরজন 
রিমিঝিমি শব্দে বরিষে 
পালঙ্কে শয়ন রঙ্গে
বিগলিত  চির অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে "



   একটি বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণের  রাত কিভাবে চিরদিনের শ্রাবণ রাতের কুহকে রূপান্তরিত হলো। এইখানেই ভক্তি বা ঈশ্বর চেতনার আগে ইন্দ্রিয়চেতনার নিশ্চিত অভিজ্ঞানটি মুদ্রিত হল। সকল বুদ্ধি, আধুনিক সংশয়কে পেরিয়ে  গিয়ে মানুষের প্রধান ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে প্রকৃতি ও চরাচরকে অনুভব করার স্থাপত্য বুনে উঠলো ।



 ' বুধুয়ার পাখি ' বস্তুত অলোকরঞ্জনের মননে,ভাবে ও গভীরতায় ঠিক সেই ব্যঞ্জনা তৈরি করল,যার ফলে দেহাতি বুধুয়ার ভাবনা যেন সেই সরলতা প্রাপ্ত হল, যা উয়িলিয়াম ব্লেক কিংবা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের অমলের কথা মনে পড়িয়ে দিলো। মানুষ যে প্রকৃতির বাইরের নয় তারই একটি 'অলটার ইগো' তা যেন পুনরায় বুধুয়ার  সরল চাওয়ার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেল ----



"এইভাবে প্রতিদিন বুধুয়ার  ডাকে 
কানায় কানায় আলো পথের কলসে ভরা থাকে, 
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে, কেউ তার দিদি কেউ মাসি
রুপোলি ডানায় যারা নিয়ে যায় বুধুয়ার হাসি"



   যৌবন বাউল, রক্তাক্ত ঝরোখা, নিষিদ্ধ কোজাগরী পেরিয়ে তাঁর রথ যখন অতি অল্প বয়সেই মধ্যগগনে তখন থেকেই শুরু হল এই কবির অন্য এক রূপান্তর। সাহিত্যের অধ্যাপক, ভারত তত্ত্ববিদ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ক্রমেই আরও বহু লিখলেন তাঁর দীর্ঘ জীবনে। তাঁর দর্শন পরবর্তী জিজ্ঞাসু ও পাঠক আর তরুণ কবিদের মনোভূমি গঠনে সাহায্য করল ঠিকই, এমনকি তিনি আন্তর্জাতিক কাব্যভাষা লিরিকের মূর্ছনায় প্রকাশ করলেন এও সত্য --কিন্তু হারিয়ে ফেললেন তাঁর গভীর নির্মাণকে।



  কবি গ্লোবাল হতে গিয়ে লোকালের সংবেদনাকে হারালেন। প্রচুর লোকাল বা স্থানীয়ে়র উপস্থিতি, বিশ্বজোড়া সংবাদ তাঁর কবিতায় উঠে এলো, কিন্তু তা হারিয়ে ফেলল ' আত্মিক ইন্দ্রিয়সংবেদন ' আর এখানেই এই মহৎ কবি হয়ে উঠলেন একজন শুধুমাত্র পন্ডিত, অনন্য রসবোধের নাগরিক কবি --- আর হারালেন স্থানীয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা তাঁর সরল আদিম আত্মাটিকে।


 এ - এক মহতি বিনষ্টি।

            



দীপঙ্কর বাগচী-র কবিতার বই 

Saranga * জাদুকর * অন্ধফেরিওলা * জলতরঙ্গ *
মহাকাল ও ইশারা * ত্রহস্পর্শ * ছাতারপাখি একা 
প্রভৃতি


গদ্য গ্রন্থ :  কবির বিশ্ব * আধুনিকতা পালাবদল কল্লোল যুগ * 
দেখা * Modernity and Social Crisis in Bengali Poetry 1920--1950 *
এছাড়াও বহু ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ নানা journal এ
প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন