তিনি ' আজকাল ' দৈনিক পত্রিকার লেখক। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তিনি নাট্যকার , অভিনেতা এবং পরিচালক। কিন্তু এগুলি তার মুখ্য পরিচয় নয়। তাঁর মতো শক্তিশালী একজন লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি অখ্যাতজনের লেখাও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন এবং উৎসাহিত করেন লেখার আনন্দে লিখে যেতে । যেমন সম্প্রতি তিনি পড়লেন দেবাশিস সাহার ' দু'এক কণা শৈশব ' বইটি। পাঠকের জন্য এখানে রইল, সেই পাঠ প্রতিক্রিয়া -----
কী ভালোই না হত,যদি আমাদের প্রত্যেকের হাতে এক-একখানা নিজস্ব আলাদা ইতিহাস বই থাকত!পড়তে পারতাম...।পড়াতে পারতাম...।
নিজের-নিজের ছোট-বড় চড়াই-উৎরাইভরা জীবনের বৃত্তান্ত দিয়ে গাঁথা।
বুকের ভেতর তো থাকেই সে বই।...বয়েও চলি আজীবন। অনেকেই।
কী ভালোই না হত,শুধু সে বই যদি ছেপেও নেওয়া যেত।পড়ানো যেত...পড়াতাম তখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে।
যেমন দেবাশিস সাহা করেছে।করতে পেরেছে।আগলে রেখে গোটা একটা বাড়িভরা স্মৃতি।
এখন তো দূরে-দূরে বাঁচতে-বাঁচতে পরিবারও ভেঙেচুরে দূরের সমাজ।সেখানে উল্টোপথে এই প্রতি হাতে এক-একখানা করে ইতিহাস বই তো সমাজটাকে গেঁথে ফেলতে পারত একটা পরিবারে।মিলের চিন্হ খুঁজে-খুঁজে।শঙ্খ ঘোষ থাকলে যাকে হয়ত বলতেন 'সমন্বয়ের বাস্তব'।
হ্যাঁ,বিশ্বাস করি সব প্রতিষ্ঠানের বাইরে এসে,মানুষের বুকের ভেতরে গড়া এই নিজস্ব ইতিহাস বইগুলো এতখানিই আঠালো,মায়াবি,মানুষি।যতবার লেখা হয়...পড়া হয়।
এমন বিশ্বাসের ভিতকে শক্ত ক'রে আরেকবার গড়ে দিল দেবাশিস সাহার লেখা 'দু এক কণা শৈশব'।দেবাশিস সাহা স্থির করেই জল বাইতে নেমেছেন যে তিনি এই লেখার নির্দিষ্ট কোনও আকার-প্রকার দেবেন না।ছাঁচ গড়বেন না।যতটা আকার,যতটা ছাঁচ পেলে একটা লেখা কোনও না কোনও একটা সংজ্ঞা পায়।উপন্যাস...আখ্যান...গল্প...স্মৃতিকথা...রম্যরচনা...এমন সব।না সে ঘরের দরজা ভেজিয়ে রেখেছেন দেবাশিস।এতে তাঁর লেখা বেশ স্বাধীন একখানা জমিজিরেত পেয়েছে তো বটেই,লেখাখানা পাঠক পড়তেও পারছে বেশ খেলিয়ে।মনকে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে।
টুকরো-টুকরো সব স্মৃতির অধ্যায়।ছোট-বড় নানা মাপে।
তার ভেতর আবার নিয়ম-রীতি ভেঙে ঢুকে পড়ছে 'আমার বাবা','আমার মা','আমার দাদা','আমার কাকা'জাতীয় টুকরো-টুকরো ছবিসহ সচিত্র পরিচিতির অ্যালবাম!এক অন্যরকম 'পার্সোনাল টাচ'!একটা নতুন 'ফর্ম'এর ইশারা যেন!!যেন লেখার কাজ এক একখানা ছবিকে পরিচিতি দেওয়া।
আমার দেবাশিসবাবুর ডাকে পাঠানো এ'বইখানা পড়তে বেশ একটু দেরিই হয়ে গেল!দুই বছরের দুই লকডাউনের মাঝে পাঠানো বই পড়তে লাগলাম তখন,যখন সাম্প্রতিকতম লকডাউনের দীর্ঘ বন্দিদশা গড়িয়ে দীর্ঘতর হওয়ার বাঁকে।
খোলা মাঠঘাটে,নদীবিলে ছড়ানো-খেলানো এ আখ্যান হয়ত তাই আরও মায়া,আরও নরম-মন বয়ে আনল আমার জন্য।হয়ত সেদিক থেকে আমি ঠিক সময়েই এই বইয়ের ডাক-মোড়ক খুললাম।ফলে ক্ষমা চাইছি না।
দেবাশিস সাহা।এক ভাঙা ভূগোলের ভেতর দিয়ে যাওয়া জীবনের যাত্রি।দুই দেশের মধ্যে বিভাজিত তাঁর শৈশব-কৈশোর।যা মেলালে তবে তাঁর নিজের ইতিহাস গড়ে ওঠে।তাঁর স্মৃতি,তাঁর অস্তিত্ব।
এই যুক্তবঙ্গের স্মৃতিই তো অখণ্ড বাঙালি সত্তার মহাফেজখানা।কারা যেন এই তো অতি-সম্প্রতি সেসব আবার কাড়তে/ভোলাতে-গোলাতে এসেছিল।এখনও বেশি দূর যায় নি তারা,যেতে পারে নি।গল্পের ইতিহাসে ঘেরা এ'বইখানি তাদের মুখ বা পশ্চাৎদেশ টিপ ক'রে সজোরে ছুঁড়ে মারার।
পেছনে পড়ে থাকা সেসব গল্পের ভেতর থাকা অনেক অজানা তথ্য।যাদের ঝিনুকের ভেতর মুক্তো বলে মনে হয় পড়তে বসলে।যেমন,লাল হয়ে যাওয়া নারকেল টিপে তেল বের করা।যেমন,কলসি ঝুলিয়ে ঘোড়দৌড়।যেমন,কচুপাতা আর নারকেলগাছের মাথার অংশ দিয়ে কালিপুজোর বাজি বানানো।কিংবা,সেই পেঁপেগাছের ফাঁপা ডালের ভেতর ঝোপ থেকে ধরা জোনাকির ঝাঁক পুরে প্রাকৃতিক টর্চ বানানোর চেষ্টা করা কান্নাভেজা নষ্ট-গল্প।
আর,সীমান্ত ডিঙোনোর সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া বিবরণ তো যেন ঋত্বিক ঘটকের 'সূবর্ণরেখা'!রাত জুড়ে দু'পায়ে ভিজে জলের ছলাৎছল শব্দ!'কুয়ো ভ্যাদিস ডোমিনি'?
ছেলেবেলার সব গল্পের গায়েই কি অমন ভারি করে মায়ার ভিজে মাখন লাগানো থাকে?
কুয়াশার হিম প'ড়ে থাকে গদ্যের গায়ে?
বড়দের ইতিহাস বই পড়তে গেলে তো কই তা পাই না তো!সেখানে শুধুই তেলের শিশি ভেঙে দেবার উল্লাস!
তাই আসুন,এইসব বই দিয়ে ছাতিমতলায় সিলেবাস গড়ি।
নাঃ।সত্যিই দেবাশিস সাহার বইয়ের মোড়ক ঠিক সময়েই খুলেছি।
বড় উপশম দিচ্ছে।যাদুঘেরা এক নিজস্ব ভূগোলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।যে দেশে এখন অর্ধশতাব্দীর নিঃসঙ্গতা।
বইটি প্রকাশ করেছে 'চিন্তা'।
জমিয়ে লিখে চলুন দেবাশিস।স্মৃতিতে ডুব দিন বারবার। আমাদের জন্য। স্বাগত।
আমাদের সাহিত্য-পড়া কবে এতটা সাবালক হবে যে এই মুক্ত-আখ্যানকে সে আসন্ন-উপন্যাসের ভূমিকা হিসাবে পড়তে শিখবে?
আমাদের ইতিহাস-পড়া কবে এত সমর্থ হবে যে এইসব ব্যক্তিগত স্মৃতিকে সে ক্ষমতার দরবারি-খাতার বাইরে এসে চুর্ণ-ইতিহাস হিসাবেই পড়তে শিখবে?
কবে?
এবং কবে??


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন