হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্ণের ডাক
স্বপন চক্রবর্তী
১২ জুলাই, ১৯৯৭
আষাঢ়, ১৪০৪
" আজ সকালে উঠোনে বিস্কুটের টুকরো ছড়িয়ে দিতেই দেখলাম, আরো নতুন নতুন কয়েকজন উড়ে এলো ! একটা দোয়েল, দুটো শালিক। গোটা কয়েক চড়ুই আর একটা বুলবুল।-------"
পড়ছিলাম স্বপন চক্রবর্তীর 'হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্ণের ডাক' বইটি। পড়তে পড়তে মুগ্ধতা তৈরি হচ্ছিল ক্রমশ, যা সীমানা ছাড়ালো ৯০ পৃষ্ঠায় এসে উপরের এই বর্ণনাটিতে, পরিচিত কয়েকটা পাখির উল্লেখে ' কয়েকজন ' শব্দটি ব্যবহারের অনুষঙ্গে।
এবং এখানেই খুঁজে পেলাম বইটির নামকরণ এবং শিল্পী রাজীব মন্ডলকৃত প্রচ্ছদের তাৎপর্য। বইটি হাতে পেয়েছি কবেই। নাম এবং প্রচ্ছদ ভাবিয়েছে প্রথম দর্শনেই। কিন্তু এইখানে পৌঁছে যেন আবিষ্কারের আনন্দে শিহরিত হলাম। কালো কালিতে কাকের গায়ের রঙে রঙ মিলিয়ে কাকের হাঁ--করা ঠোঁটে, বাকি অংশ জুড়ে হেমন্তের আবহ দারুণ বেজেছে প্রচ্ছদচিত্রে। ব্যাক কভারে ডানামেলা কাকের উড়ন্ত ভঙ্গি উড়িয়ে নিয়ে গেছে লেখকের কল্পলোকে ---যে বিষয়টি তিনি ধরতে চেয়েছেন সমস্ত গ্রন্থ জুড়ে।
বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে, বইটির বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করি। স্বয়ং লেখক জানাচ্ছেন , " বাবার মৃত্যুর পরে পরেই সেই ১৯৯৫ সালের অন্তিম পর্ব থেকে কয়েকটি বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে যে সকল চকিত অনুভব --- যা হাহাকার থেকে, বিরহ থেকে, এমনকী শূন্যতাবোধ থেকে জেগে উঠেছিল, এবং যা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম --- মৃত্যুর সেই পঁচিশ বছর স্পর্শ করাকে কেন্দ্র করে সেই সকল বিচ্ছিন্ন রচনাগুলি সংকলিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলাম বাবার স্মৃতির উদ্দেশে। "
বস্তুত ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৫ থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর ২০০৪ পর্যন্ত, যখন যেভাবে,যে নির্দিষ্ট দিনটিতে পিতৃস্মৃতি লেখককে স্পর্শ করেছে, তা তিনি ডাইরির আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই নশ্বর জগতে প্রিয়জন বিয়োগব্যথা কার না আছে ? বাবা বা মায়ের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া ব্যথিত করে না কাকে ? কিন্তু সেই ব্যথার প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন রকম, যেমন লেখক স্বপন চক্রবর্তীতে।
গল্প নয় উপন্যাস নয়, ব্যক্তিগত এই স্মৃতিচারণা পড়তে পড়তে লেখকের কলমের মুন্সিয়ানায়, দেখার অন্তর্ভেদি দৃষ্টিভঙ্গিতে কতবার কতভাবে যে শিহরিত হয়েছি, জন্ম-মৃত্যুর ভেদরেখা ছুঁয়েছি যেন চকিতে, লেখকের ভাবনায় স্পৃষ্ট হয়ে, তার কোনো লেখাজোখা নেই।
কোনো রচনায় পাঠক যখন আত্মপ্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখেন, তখনই ভালোলাগার বোধে আচ্ছন্ন হয় মন। আলোচ্য বইটিতেও কোন কোন পাঠক সেই প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হতে দেখবেন, নিঃসন্দেহে। ' কোন কোন ' কথাটি লিখলাম এই কারণে, যে, সকলের চিন্তাভাবনার স্তর লেখকের মানসলোককে স্পর্শ করতে পারে না সব সময়।
লেখক এর সঙ্গে পাঠকের এই জারণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলে, একটা সময় পাঠক নিশ্চিত উপলব্ধি করবেন, কমল গাঙ্গুলির সঙ্গে মহাভারতের সভাপর্ব নিয়ে কিংবা বন্ধুর সঙ্গে মেঘনাদবধকাব্যের রুপাভাস নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছেন যিনি, যিনি সাতান্ন সালের দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনে স্ত্রীকে নিয়ে ভোট দিতে যাচ্ছেন বা যিনি উদাত্ত কণ্ঠে কখনো গাইছেন ' গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব' কখনো ' মন চলো নিজ নিকেতনে ' কিংবা মৃত্যুর পরে যাঁর জামার পকেটে পাওয়া যাচ্ছে ছটা চারমিনার সিগারেট, যাঁর সংগ্রহে রয়েছে বেণীমাধবের পঞ্জিকা, কালো রেক্সিনের ব্যাগ তাতে ফিউজ তার পুরনো হোল্ডার স্ক্রু ড্রাইভার প্লাস চশমার ফ্রেম আতসকাঁচ থার্মোমিটার--- ইত্যাদি সংসারের টুকিটাকি জিনিস,--- তিনি আসলে আমাদেরও পিতা।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি উপাদানে, প্রতিটি অণুতে পরমাণুতে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে -প্রশ্বাসে লেখক অনুভব করেন বাবার অস্তিত্ব, তা যে অত্যন্ত প্রকটভাবে, এমন নয়। বাবার মৃত্যু আসলে অনুপস্থিতির মধ্যে প্রবল উপস্থিতি, শিরায় শিরায় প্রতিটি কলা কোষে, লেখক অনুভব করেন। " কে এই কথা প্রচার করেছে, কে মিথ্যে রটিয়েছে, যে আমার বাবা মরে গেছে ? "
প্রিয় পাঠক, পরিশেষে আমি লেখকের ভাষা ব্যবহার, ভাবনার অতলস্পর্শী গভীরতা, সর্বোপরি দেখার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি কোন স্তরে পৌঁছেছে বইটিতে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি -------
১) বাবা, তুমি কোথায় আছো এখন পঞ্চভূতে? আলোতে?অগ্নিতে?ধূলিকণায়? তড়িতাধানে? তুমি কোথায় আছো? রূপান্তরে কী জানছো? কী জানলে এই পর্বlন্তরে? কে এসে তোমাকে নিয়ে গ্যালো হাত ধরে? পরমপিতা ? নাকি সে প্রেতের ইশারা?
২) মরণ কাকে বলে ?
এই যে জল- যমুনায় ভেসে যাচ্ছে অবিরল কালো স্রোত স্বপ্নে, অবচেতনে, এই যে তারকা দল নক্ষত্রসকল ঘুরপাক খাচ্ছে মহামন্ডলে এবং চির - নিঃশেষিত হয়ে চলেছে বেদনায়, দহনে --- মৃত্যু কি তার বিকল্প নাম ?
৩) চাঁদ স্থির / চাঁদ ভাসছে /চাঁদ উড়ে যাচ্ছে ফাল্গুন মাসের প্রতারক সন্ধ্যাবেলা চাঁদকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে আকাশে। মনে হয়েছিল চাঁদ খুব আহ্লাদে হাসছে। মনে হয়েছিল চাঁদকে খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। মনে হয়েছিল চাঁদ ভালোবাসছে আমাকে।
৪) বারান্দায় ইজিচেয়ারটা নেই--- সেই কবে থেকে ! প্রায় আড়াই বছর হবে। সেখানেও তুমি-- ওই অনুপস্থিতির মধ্যে। বাইরে উঠোনের রৌদ্রে মেলে দেয়া জামা- কাপড়ের মধ্যে একটিও ধুতি নেই, সাদা শার্ট নেই --- টুইল কাপড়ের। ওই না -থাকার মধ্যেই তুমি জেগে আছো।
৫) " ওই কদমগাছে সমস্ত বছর ধরে ফুল ফোটে"-- তুমিই প্রথম বলেছিলে। তোমার বিশ্বাস ছিল ওই কদমগাছটিতে শ্রীকৃষ্ণের একটি আশ্রয় আছে। তোমার সেই গভীর বিশ্বাসে কোনোদিন আঘাত করিনি। কোনোদিন সংশয় প্রকাশ করে তর্ক জুড়িনি।
এমনই আরো, অজস্র...প্রিয় পাঠক বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি।

স্বপনদার বই নিয়ে আপনার এই আন্তরিক আলোচনা আমাকে মুগ্ধ করলো। ওঁনার বাবাকে স্মরণ করে যে সকল লাইন উনি লিখে ফেলেছেন সেগুলোর সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে তুললো। আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই। ভালো থাকুন সবসময়।
উত্তরমুছুন