সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

সম্পাদকীয় * স্বরবর্ণ / ২


" ১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে এক দিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়,কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা,পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ, মধ্যে মধ্যে উচ্চ নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পলাইয়াছে  ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় দাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে,ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে,  দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে, অধ্যাপকে টোল  বন্ধ করিয়াছে, শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না।রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না, বৃক্ষে পক্ষী দেখি না, গোচারণে গরু দেখি না, কেবল  শ্মশানে শৃগাল কুক্কুর। এক বৃহৎ অট্টালিকা---- তাহার বড় বড় ছড়ওয়ালা থাম দূর হইতে দেখা যায় --- সেই গৃহারণ্যমধ্যে শৈলশিখরবৎ শোভা পাইতেছিল। শোভাই বা কি, তাহার দ্বার রুদ্ধ, গৃহ মনুষ্যসমাগমশূন্য, শব্দহীন বায়ুপ্রবেশের পক্ষেও বিঘ্নময়। তাহার অভ্যন্তরে ঘরের ভিতরে মধ্যাহ্নে অন্ধকার, অন্ধকারে নিশীথফুল্লকুসুমযুগলবৎ এক দম্পতি বসিয়া ভাবিতেছে। তাহাদের সম্মুখে মন্বন্তর। ”


 অনেকটা পিছন ঘুরে পাতা উল্টাচ্ছি  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ' আনন্দমঠ 'উপন্যাসের। ইংরেজদের নিষ্ঠুর শাসন-শোষণ আর প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় সেবার বাংলার ভাগ্যাকাশে ঘনিয়ে এসেছিল দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। সেটা ১৭৭০ সাল,১১৭৬ বঙ্গাব্দ। আর এটা ২০২১ সাল, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ------


 দেশের  শ্মশানচুল্লিগুলিতে চব্বিশ ঘন্টা দাউ দাউ চিতাগ্নি, গঙ্গায় ভেসে আসা অগুন্তি লাশ, হাসপাতালগুলিতে শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু অক্সিজেনের হাহাকার, রেমডিসিভির কালোবাজারী, ফ্লো মিটারের আকাল, অপ্রতুল ভ্যাকসিনেশন----- যদিও প্রেক্ষাপট আলাদা, তবু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামি হয়ে আছড়ে  পড়ার প্রেক্ষিতে মনে পড়ল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা' আনন্দমঠ ' উপন্যাসের  এই হৃদয়বিদারক বর্ণনা। যদিও সেটা ছিল মন্বন্তর । এটা মহামারী। দুইয়ের প্রেক্ষিত আলাদা, কিন্তু সংহারমূর্তি এক।


 অতীতে বারংবার এরকম মন্বন্তর, মহামারীর  সাক্ষী হয়েছে এ দেশ। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে ইংরেজ শাসনকালে ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯২, ১৮৯৭, ১৯৪৩ বা তেরোশো পঞ্চাশের মন্বন্তর কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। এবার একটু ব্যতিক্রম। এবার এসেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস, যার বিষাক্ত ছোবলে শুধু আমাদের দেশে নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে মৃত্যু-মিছিল।


 এই ক্রান্তিকালে শিল্প সাহিত্যের ভূমিকা কী, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। শিল্প-সাহিত্যে দেশ কাল সমাজাত্মার  প্রতিফলন ঘটে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। যত খরা,বন্যা ,মহামারী যত অসূয়া, রিরংসাজাত  অবক্ষয় থেকে সূক্ষ্ম সুকুমার মানবিকবোধ  জাগিয়ে তুলে শিল্প-সাহিত্য আমাদের বাঁচতে শেখায়, দেখায় উত্তরণের পথ। কিন্তু কবি শিল্পী তো সমাজ সংস্কারক নন, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ নন। তিনি শব্দের কারিগর। অসি নয়, মসি তার তরবারি। তাই তাঁর প্রতিবাদ ভাষা পায় এভাবে " ক্রন্দনরতা জননীর পাশে /এখন যদি না-থাকি /কেন তবে লেখা, কেন তবে গান গাওয়া /কেন তবে আঁকা আঁকি? " ( মৃদুল দাশগুপ্ত ) ক্রন্দনরতা জননীর পাশে সদা জাগ্রত থাকুক কবি শিল্পীর কলম, কারণ আজ ' মানুষ বড় কাঁদছে। ' সেই কান্না ভাষা পাক কবির কলমে, শিল্পীর তুলিতে। 


ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রত্যক্ষদর্শী গোপাল হালদার একদা লিখেছিলেন, "....যদি আমি এই সময়টার ঘটনাকে উত্থাপন করে যাই তাহলে, পরবর্তীকালে যদি কোন বঙ্কিম দেশে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি তা অবলম্বন করে সেই তথ্য সংগ্রহ করে হয়তো কোন নতুন আনন্দমঠ লিখতে পারবেন....।" তাঁর অনুমান বিফলে যায়নি । পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী সব শিল্প-সাহিত্য। এ প্রসঙ্গে আমরা অবশ্যই মনে করতে পারি বিজন ভট্টাচার্যের ' নবান্ন ' কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' অশনি সংকেত '।

 

" মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘনঘন বন্যার/ আঘাতে  আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল /এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল " (সুকান্ত ভট্টাচার্য ) মন্বন্তর নয়, মারী ও মড়কে ছিন্নভিন্ন আজ দেশনৌকার পাল। লক ডাউনে কর্মহীন লক্ষ লক্ষ মানুষ, করোনাকে রুখতে গিয়ে সোশ্যাল ডিসটেন্স-এ  মানবিক মূল্যবোধ। প্রতি মুহূর্তে ঘটতে দেখছি মানবিকতার স্খলন । অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে মানুষের ' দিনগুলি রাতগুলি '। তার উপর আবার ধেয়ে এল কালান্তক ঘূর্ণঝড় -- ইয়াস | লণ্ডভণ্ড হল লক্ষ লক্ষ মানুষের সামান্যতম আশ্রয়টুকু | তবু আমরা আশাবাদী এই সমস্ত মেঘ একদিন ঠিক কেটে যাবে  ... " the boat is sinking still I see sunrise... "

 

                                                                  দেবাশিস সাহা 

                                                              সম্পাদক ----- স্বরবর্ণ ,

২টি মন্তব্য:

  1. খুব সুন্দর হয়েছে আপনার সম্পাদকীয়। বর্তমান সময়কালের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়েছে সম্পাদকীয়তে। শুধু তাই নয়, যে সকল সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী এবং অন্যান্য মাধ্যমের শিল্পী রয়েছেন তাদের শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্যের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এই সম্পাদকীয়তে। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার কথাও। তাই এই সম্পাদকীয় সর্বোত্তম হয়েছে বলেই মনে হয়েছে আমার।

    উত্তরমুছুন