প্রেমিক হতে পারিনি কোনোদিন
খোলা চুল, কপালে কালো টিপ ও আলতা পায়ে লাল শাড়ি পরা অসম্ভব সুন্দর দেখতে এক মেয়ে। অপ্সরা বললেও ভুল হবে না। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছে আমার দিকে...আমি গণেশ। গ্রামের ছন্নছাড়া অথচ সকল গ্রামবাসীর বিপদে পাশে দাঁড়ানো এক প্রতিবাদী যুবক। ওর নাম স্নেহা। ঠিক জানি না এটা ভালোবাসা কী না! তবে সে এক ফোঁটাও চোখের আড়াল হলে মনের মধ্যে খরা অনুভব করি। যেন কতদিন বৃষ্টি হয়নি এই আকাশে!
সালটা ১৯৪৭। সবে সবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত - নিপীড়িত দেশগুলো স্বাধীনতার উজ্জ্বল আলো গায়ে মাখছে। ভারতও সবে স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছে। এর পূর্বে বর্গীর দল বাবা-কাকাদের চাষ করা জমির অর্ধেকের বেশি রাজস্ব হিসেবে কেড়ে নিতো। ব্রিটিশের সাদা চামড়ার একদল গুণ্ডাবাহিনী আমাদের মা - বোনদের সম্মানে আঘাত করতো। মামলা করা হলে উল্টে আমাদেরই মুখে নোংরা ফেলা হতো প্রকাশ্যে।
দেশে তখন বহু সমস্যা। সদ্য প্রধানমন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করেছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। তাঁর অদম্য প্রয়াস সত্বেও দাঙ্গা, হানাহানি, উদ্বাস্তুগত সমস্যা মিটছে না কিছুতেই। তিনি কী প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভে এসব করিয়েছেন? কংগ্রেসেই কী তবে দাঙ্গা লাগিয়েছে? আর. এস. এস. এসবের মূল উৎস? নাকি মুসলিম গোষ্ঠী? এ ধরনের প্রশ্ন আমার মতো দেশের প্রত্যেক সাধারণ যুবকদের ভাবিত করে তুলছে। শুধু উত্তর মিলছে না কিছুর।
এসব ভাবতে ভাবতেই গ্রাম থেকে বাবা - মা'র হাত ধরে রওনা দিলাম শহুরে রাস্তায়। ঘুরতে যাচ্ছি না। আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মহামেডানরা। মা'র চোখে জল দেখে জিজ্ঞেস করলাম --মা, কাঁদছ কেন! আমরা তো এদেশেই থাকছি, এদেশ থেকে তো অন্য কোথাও যাচ্ছি না! মা বললেন, ত্রিশটা বছর যে গ্রামটাকে আগলে ধরে রেখেছি, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালবাসা রয়েছে, তাকে ছেড়ে যাওয়া হলেও ভুলে ফেলা যায় না বাবা। জন্মভূমির প্রতি মানুষের টান চিরকালের। জন্মভূমির কথা শুনে আমি ভাবছি দুই বাংলার মধ্যবর্তী গ্রামগুলোর মানুষের কথা, পাঞ্জাব কাশ্মীরের মানুষের কথা; যারা একদেশ থেকে গলা ধাক্কা খেয়ে অন্য দেশে গিয়ে পড়েছে অথচ যে দেশ ধাক্কা দিচ্ছে সে দেশই জন্মও দিয়েছে। ভাবছি এদের এ সংঘর্ষ ইতিহাসে লেখা হবে না! এই ভয়ানক দৃশ্য ইতিহাস গড়বে না!
এসব ভাবলেও সবথেকে যেটা বেশি ভাবছিলাম, যার কথা আমাকে ব্যাকুল করে তুলছিল, সে তো স্নেহা। ভাবছি তার চোখ, চুল, কালো টিপ, লাল শাড়ি এসবের কথা। ভাবছি ওদেরও হয়তো এভাবেই তাড়িয়ে দিয়েছে মুসলমানদের দল। তার সাথে যদি একবার দেখা হত...
অসহায় হয়ে বুকে পাথর চেপে হেঁটে চলেছি কলকাতা শহরের রাস্তায়। একটাই প্রার্থনা, হে ঈশ্বর ,আমার দেশ আজ হিংসার সম্মুখীন তাকে বাঁচাও ,হে ঈশ্বর তাকে বাঁচাও।
রাস্তার ধারের এক দোকান থেকে রেডিওর আওয়াজ ভেসে উঠছে কানে। এক বৃদ্ধ বলছেন " দেশ তব শানত হোগা জব লোগ শানত হোঙ্গে।" আন্দাজ করলাম ইনিই বোধহয় মহাত্মা গান্ধী। যাইহোক ,আমরা তিন রাত তিন দিন হাঁটার পর অবশেষে কলকাতা শহরে গিয়ে পৌঁছলাম। বাবার এক বন্ধুর দৌলতে থাকার জন্য একটা ঘরও পাওয়া গেলো। কিন্তু খাবার! খাবার আসবে কথা থেকে! কারখানা বন্ধ হয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। শ্রমিকের অবস্থাও একেবারে নাজেহাল। চারিদিকে শুধু ধর্ম নিয়ে ভাগাভাগি। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণদের।
এরকম ভাবে চলতে থাকে সব। বছর পার হয়। শুধু সমস্যা যেতে চায় না কিছুতেই। দেশ তখন মহাত্মা কে হারিয়েছে। আরো হারিয়েছে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া বহু সৈনিকদের। পাকিস্তানের কবল থেকে বাঁচতে বহু ধর্মপ্রাণ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা দলে দলে জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে ভারতে। অনুরূপ ভারত থেকেও একই ভাবে মুসলিমরা গিয়ে ঠেকছে পাকিস্তানে ও পূর্ব বাংলা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে। কেউ চাকরি ছেড়ে, কেউ জন্মভূমি ছেড়ে, কেউ আবার প্রেম! অজস্র ভাবনা নিয়ে একে অপরের কাঁধে ভর করে ভেঙে পড়ছে অনায়াসে। ভাবছে হয়তো পরাধীন থাকলে এভাবে মারা যেত না কেউই। এভাবে দেশ মাকে দু টুকরো হতে হতো না কখনোই।
খবরের কাগজ বিক্রিতে সেরকম আয় হতো না বলে নতুন একটা কাজ খুঁজতে বেরোলাম। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই জানি। কোনো কাজকে কোনদিন ছোট মনে করিনি আমি। রাস্তায় রাস্তায় একে ওকে বলতে লাগলাম কাজ দেবে গো কাজ.. দরজায় দরজায় গিয়ে বলতে লাগলাম নিজের এবং গ্রামের দুঃখের কথা। আশ্বাস দিয়েছে অনেকেই কিন্তু কেউ কাজ দিয়ে চায় নি। আমার কাকুতি মিনতির আওয়াজ শুনে দরজা খুলে এক মহিলা বাইরে বেরিয়ে এলো। ওমা কি দেখি আমি! সেই খোলা চুল, কালো টিপ, লাল শাড়ি পরা সেই মেয়ে। স্নেহা। তফাৎ কেবল সিঁথিতে সিঁদুরের। স্নেহা আমার দিকে মুখ ঘোরাতেই আমি ' প্রণাম দিদিমণি ' বলে দৌঁড় দিলাম রাস্তার দিকে...
কিছুক্ষণের জন্য দেশের বর্তমান করুন অবস্থার থেকেও আমার মনের অবস্থা অনেক বেশি অসহায় ও একা হয়ে পড়েছিল। তবে খুশি হচ্ছিলাম এই ভেবে যে মেয়েটা ভালো আছে, বেঁচে আছে।
কয়েক টাকা পকেটে থাকায় এক দোকান থেকে তামাক নিয়ে তা টানতে টানতে চায়ের দোকানে বসে থাকা চারজন ব্যক্তির দেখা পাই। দেশ - বিদেশ - স্বাধীন - নেতা এভাবেই বলেছে যেন কিছু। কথাগুলো স্পষ্ট শোনার কৌতূহলের ফলে আমি তাদের পাশে গিয়ে বসলাম। ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল গান্ধীজির কথায় পাকিস্তানকে দেশের এতো পরিমাণ অর্থ দেওয়া নাকি ঠিক হয়নি! অন্য একজন এর জবাবে গান্ধীজি অহিংসার প্রতীক, তিনি নাকি কোনদিনও হিংসার সাথে আপোষ করেননি। আর পাকিস্তানকে অর্থ না দিলে তারা নাকি হিংসার পথ অবলম্বন করত এসব। মাথা নাড়ালো বাকি দুজনও।
বল্লভভাই প্যাটেল তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন। কাশ্মীর, জুনাগর, হায়দ্রাবাদ সহ ছোট বড়ো ছ- শয়ের বেশি দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকরন নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এমনিভাবে বছর কাটতে থাকে । শান্ত হতে থাকে শহর। রচিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান। আইন প্রণীত হয় সুস্থভাবে। বিচার ব্যবস্থাও গঠিত হয় নিজ ধাঁচে। স্বাধীনতার প্রকৃত হাওয়া দেশবাসী অনুভব করে। আমিও দেশের সাথে সাথে নিজেকেও গঠন করি নিজের মত করে। আমি আজ ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক। আমি ছাত্রছাত্রীদের পুঁথিগত শিক্ষার সাথে সাথে মানুষ হওয়ার শিক্ষাও দিই। ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ পড়াই। শুধু ভাল প্রেমিক হতে পারিনি কোনদিন।



খুব ভালো হয়েছে ভাই...👏👏
উত্তরমুছুনFabulous bro..
উত্তরমুছুনBhalobasa nish bhai
উত্তরমুছুনDewar moto ar kichui nai..tor choto bekar bondhu
Ek kothai osadharan..
উত্তরমুছুন