সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

তপন পাত্র




কবি তপন পাত্রের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আধুনিক সমাজ সভ্যতার স্খলনজনিত এক বেদনাবোধ, যা কবিকে ব্যথিত করে । আপাত সারল্যের ভেতর গভীর জীবনবোধ আমরা লক্ষ করি তাঁর কবিতায়।' একটি তার একতারার /এই তারও তো তার '



 কবিতাগুচ্ছ / তপন পাত্র 



 কিশোরীর  স্বপ্ন 


আমার বারো বছরের মেয়ের সাথে আজ 

প্রকৃতি নিয়ে কথা হচ্ছিল ।

সে বলছিল, বাবা আকাশের প্রকৃত রং কী ?


আমি চুপ করে থাকলাম ।


সে আমাকে বলল , ঘাসে ঘাসে আদিগন্ত মাঠ ঢেকে আছে ,

ঘাসের রং প্রকৃতপক্ষে কেমন , বাবা ?

আমি বললাম মেয়ে রে,  আমি সবুজ বলতে পারছি না ।

কারণ ---

 যেখানেই ঘাস , দু'হাতে সরালে দেখছি

 বিশেষভাবে বেঁধে ফেলে রাখা

                      মানুষের লাশ ।


আজ দিকে দিকে ঘাসের সর্বনাশ ।


আচ্ছা বাবা, নদীর রং কেমন ?


জলের সময় জলের মতো,

বালির সময় বালি ।

কিন্তু জলের ভিতরও ভেসে যাচ্ছে ... ,

বালি তুলতে গেলে বালির ভেতর থেকে 

বেরিয়ে আসছে লাশ ।


আজ আর নদীর কোনো আলাদা রঙ নেই ।


মেয়ে আমার আশৈশব কোলকাতায় থাকে ।

ধান গাছের সঙ্গে তার প্রকৃত কোন পরিচয় নেই ।

গম গাছের সাথেও নেই ।

সে খামার জানে না ।

গরুর গাড়ি চেনে না ।


আমাকে জিজ্ঞাসা করলো --- গরুর গাড়িতে 

কীভাবে ধান গাছ নিয়ে যাওয়া হয় ?

নিজেই প্রশ্নমাখা উত্তর দিল,

যেভাবে মৃত্যু শকটে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় 

সাদা কাপড়ে ঢাকা জীবন্ত লাশ ?


---এই প্রথম আমার মন খারাপ হয়ে গেল ।

আমার এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের 

যে মেয়ের জীবন নিয়ে গল্প করার কথা,

তার মনের ভিতরেও জিজ্ঞাসা চিহ্ন মৃতদেহ নিয়ে !


আমি যেই না একটু অন্যমনস্ক হয়েছি ,

আমাকে ফের প্রথম প্রশ্নটি

 ছুঁড়ে দিল মেয়ে ---

বাবা আকাশের প্রকৃত রং কী ?


আমি চোখ ছল্ ছল্ করে বললাম ,

মৃতদেহের প্রকৃত কোন রং নেই,

অন্তত থাকাটা ঠিক উচিত নয় ।



 ভাসান


মা,

আমি যেদিকে তাকাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি 

মেঘনা নারী

মেঘবর্ণ পুরুষ !


আমি আর পয়লা আশ্বিন ভাদু ভাসাতে 

যাবো না সুবর্ণরেখার সোনা জলে ।


আমি আর পৌষ সংক্রান্তিতে কংসাবতী 

যাবো না চৌঢল ভাসিয়ে দিতে  ।

 

এখন পৌষও নয়,

ভাদ্রও নয় ।

শ্রাবণ সাঁকরাতের মতো দশ দিক থেকে

ভেসে আসছে মনসা ভাসানের গান ।


মা,

আমি মেয়ে হয়ে নারী

চারদিকের সকল পুরুষও আজ নারী ।

এখনো যে যেখানে বেঁচে রয়ে গেছে

অনশ্বর আকাঙ্ক্ষায় সকলের হৃদয়ই আজ

নারীর হৃদয় ।


দ্যাখ দ্যাখ দ্যাখ

মা,

সবকটা পিপীলিকাই আজ ডানা মেলে ধীরে ধীরে

এগিয়ে যাচ্ছে মোমবাতিটির দিকে ...



  ছিন্ন

                    

সকল ছিন্নতাকে মূলধন করে ভাবলাম কিছুটা এগিয়ে যাবো


একটি তার একতারার 

এই তারও তো তাঁর


ভাবলে সমস্ত অহমিকা ফাটা আয়নার মতো ভেঙে পড়ে


 তাকিয়ে শুধু সেই শতচ্ছিন্ন ছিন্নতাকে দেখি ।



বাঁধন

                     

সামনে তিনটে নদী

তিনটে পাহাড় জুড়ে

একটি জলাধার নির্মাণ করেছো তুমি


যতদূর চোখ ততদূর জল

ভ্রমণবিলাসীরা নৌকা ভাসায়

শতরূপা নারীর নৌকাবিলাস


আমি বাঁধন পাড়ের নিচে আমার কুটির গড়েছি

আমি বর্ষা এলে প্রতিরাতেই ভেসে যাই অতলান্ত গভীরে ।



 ঘরেই মরবো

                     

দাঁড়ান ---

আমি বাড়িতে থাকি 

বাড়িতেই মরবো


ভাত না থাকলে 

কাকের কাছে মেগে খাবো , 

জল না থাকলে 

মেঘের কাছে হাত পাতবো ।


তোমরা গাড়িয়ে চাপিয়ে কসাইখানায় নিয়ে যাবে ।


সারা দুনিয়ায় এতো বাতাস 

আমার দুটো ফুটোয় যাতায়াতের জন্য 

তোমাদের ঘরে এক শিশি বাতাস নেই !!!

তোমরা তফাৎ যাও ।


আমি ঘরে থেকে এ যাত্রা ঘরেই মরবো ।


      

1 টি মন্তব্য: