সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

প্রভাত ভট্টাচার্য * ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী

 

 


রহস্যময় প্রাণী

প্রভাত ভট্টাচার্য 

পর্ব-২


একটু তৈরি হয়ে নিয়ে ঘোড়সওয়ার আবার রওনা দিল। ঘোড়াটাও বিশ্রাম পেয়ে এখন বেশ তরতাজা। খাবারদাবার সঙ্গেই ছিল। দুজনেই খেয়ে নিয়েছে। এবারে চলার পালা। 

     রোদ বাড়ছে। ঘোড়া চলছেই। অবশেষে তারা এসে থামল এক অরণ্যের সীমানায়। সেখানে রয়েছে একটা কাঠের বাড়ি। ছোট্ট দোতলা বাড়ি । অশ্বারোহী অবতরণ করল সেখানে । তারপর ঘোড়াটার পিঠে আলতো করে চাপড় মারল।  সে আশেপাশে ঘুরে ঘাস খেতে লাগল। তারপর দরজায় করাঘাত করল আগন্তুক। 

     খানিক অপেক্ষার পর দরজা খুলে গেল। একজন স্বাগত জানাল আগন্তুককে। 

    ভেতরে আসুন। 

    চেয়ারে বসল আগন্তুক। 

    একটু কফি করে নিয়ে আসি। 

    হ্যাঁ , তাহলে মন্দ হয় না। 

     ঘরে আসবাবপত্রের বিশেষ বাহুল্য নেই। চেয়ার টেবিল আর একটা ছোট খাট। 

    দু হাতে কফির কাপ নিয়ে প্রবেশ করল সেই লোকটি। 

    তারপর দুজনে কফি পান করতে করতে কথা বলতে লাগল। 

    এই জঙ্গলের ধারে থাকতে ভালো লাগে?

   হ্যাঁ , আমি নির্জনতা ভালোবাসি। এখান ছেড়ে কোথাও গিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। 

     আমিও নির্জনতা ভালোবাসি, তবে এতটা নয়। যাক,  এবারে কাজের কথায় আসা যাক। আমার নাম সুরজিত। 

   আমার নাম বিজন। 

   বলতে বলতেই ঘোড়াটার আর্তনাদ শোনা গেল। 

   দুজনে বেরিয়ে এল। সুরজিতের হাতে বন্দুক। 

    একটা বিশাল অবয়ব জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। খানিকটা মানুষের মত দেখতে,  কিন্ত কোন মানুষই অত বড় হতে পারে না। 

    ঘোড়াটা বেশ ভয় পেয়েছে। 

    বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বিজন বলল,  এটা কি  ? 

    বুঝতে পারছি না। কদিন ধরেই একে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে । 

   ভয়ঙ্কর কিছু  বলেই তো মনে হচ্ছে। 

   হতে পারে । চলুন,  ভেতরে যাওয়া যাক। 

   ঘোড়াটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বিজন আবার এসে বসল ভেতরে ।












************************************"**************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, রাজবাড়িতে রক্তপাত , ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর  তিনটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস - দশভুজা, কাগজের মানুষ ও মায়াবী গ্রাম। এছাড়াও তাঁর আর একটি মনভোলানো সৃষ্টি 'গুহা মানবের ডায়েরি'  






উপন্যাস * সুদীপ ঘোষাল




জীবনহাটের কড়চা 

সুদীপ ঘোষাল 


দ্বিতীয় পর্ব 


তারপর বাড়ি গিয়ে দুপুরে স্নান, খাওয়া সারা হলে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটের সময়। আবার দোকান খােলে। এইভাবে বেশ চলে যায় দিনগুলাে। মাধবের বয়স বেড়ে যাটের দরজায় কড়া নাড়ে।মাধব গান জানে। তাই মন খারাপ হলেই সে গান করে। খরিদ্দারও আনন্দ পায়। সকলেই তাকে ভালােবাসে।

নবগ্রাম  গ্রামের আর সেনপাড়া গ্রামের অনেক গরীব মানুষ দুপুরে খেতে যায়। কোনো পয়সা লাগে না। ওখানে বাবু, ভবরঞ্জন মাস্টারমশাই, আদিত্য কবিয়াল, সহ বিবেকানন্দ ডাক্তারবাবু, তাপসদা, জয়দেবদা, ভবদা, বিকাশদা, পল্লবদা, অনিলদা, প্রবীন আলােকদা, প্রলয়, দিলীপ দা ও আরও অনেকে ভবা পাগলার ভক্তরা ভবা পাগলা সেবা দেখাশােনা করেন। প্রত্যেক দিন প্রায় পাঁচশাে অভুক্ত লােক ওখানে খাওয়া দাওয়া করেন। সবাই খায় কিন্তু কার টাকায় এই ব্যবস্থা কেউ জানে না। জানে শুধুমাত্র কমিটির লােকজন। আজ রিপাের্টার এসেছেন। কমিটির লােকের কাছে জানতে চাইছেন, কার টাকায় এই সেবাশ্রম চলে বলুন তাে?সেক্রেটারি প্রবীরদা বললেন, মাধবদার টাকায় এই সেবাশ্রম চলে। তিনি চপ ও মুড়ি বিক্রি করেন। | রিপাের্টার যখন মাধবের চপের দোকানে গেলেন সে তখন চা দিতে দিতে গান ধরেছে, ও মন সওদাগর বিদেশে বাণিজ্যে এসে কেন বাধিস বসতঘর, দেশের মানুষ দেশে ফিরে চল | রিপাের্টার প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, কবি অসীম সরকারের গান। খুব ভালাে করেন তাে আপনি। আপনি এতবড় সমাজ সেবক। সামান্য চপের দোকান থেকে আয় করে আপনি এই অসম্ভব কাজ কী করে করলেন। মাধব বলল, কোনাে কাজই, ইচ্ছা থাকলে, অসম্ভব নয়। শুধু প্রয়ােজন অদম্য ইচ্ছা শক্তি। আমি তিল তিল সঞ্চয়ে তাল করেছি। নিজের খরচ কম করে অর্থ বাঁচিয়েছি তিরিশ বছর। আমি যা সঞ্চয় করেছি আর লােকের কাছে পাওয়া অর্থ একত্র করে, আমি এই আশ্রম গড়ে তুলেছি। আমার জীবনের স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমি আজ খুব খুশি। কত মানুষ আমাকে এই কাজে সাহায্য করেন তার ইয়ত্তা নেই। রােজ আমার কাছে অনেক অনেক টাকা আসে সাহায্যবাবদ। সব টাকা ওই আশ্রমের নামেই সঞ্চিত হয়। আমার কিছুই নয়। সব মানুষের। ভববাবু, কুমারবাবুর মতাে কত লােক যে টাকা পয়সা দান করেন তার ইয়ত্তা নেই।এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে তার চোখে অশ্রুধারা। আনন্দের অশ্রু। জীবনের সবকিছু সকলের জন্য উজাড় করে নিঃস্ব হওয়ার আনন্দ একমাত্র দাতারাহ অন্তরে অনুভব করেন, সাংবাদিক গম্ভীর হয়ে বললেন। এতকিছু করেও মাধব কিন্তু নির্বিকার। এই  সেবাশ্রমের কাজ সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ুক। আর  স্বপ্ন দেখে ভারতমাতার সমস্ত সম্তান গরম ভাত খাচ্ছে পেট ভরে। শত শত সমাজ কর্মী এগিয়ে।সবুুজ ধানক্ষেতের ঢেউয়ে ফুটে উঠেছে ভারতের মানচিত্র। মাধব লাবাসে। সে দেখতে পায়, তরুণদের হাতে লাঙলের বোঁটা। তারা চাষআসছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। সব স্বপ্ন দেখতে ভালােবাসে। সে একদিন এসে বলল, মাধবদা তােমাকে নিউ আপনজন ক্লাব’ পুরস্কৃত করবে। রঞ্জন একদিন এসে বল সয়ে বলল, কেন রে, কী করেছি আমি। আমি এখনও কিছু করিনি। তবে, সে গম্ভীর হয়ে বলল, কেন কিসের জন্য?  সে বলে, এ কথার কোনাে উত্তর হয় না, দাদা। কারণ সবাই জানে তুমি কী করেছে। ক্লাবের ছেলেরা এলে মাধব তাদের বলল, তােরা আমার সঙ্গে থাকিস তা হলেই হবে। মানুষের ভালাে করাই হােক আমাদের জীবনের ব্রত। সকলকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের সাহায্য নিয়ে গােবিন্দ পাশের গ্রামে গড়ে তুলল আর একটি সেবাশ্রম। তার নামও দিল ভবা পাগলা সেবাশ্রম। এমনি করে সদিচ্ছার জোরে দশটি আশ্রম আজ চলছে মাধবের দয়ায়। মানুষ আজ জাতিবিদ্বেষ ভুলে গিয়ে মানুষের সেবায় নিয়ােজিত। পরশ পাথরের পরশে আজ অনেক তরুণ দীক্ষা নিয়েছে মানব সেবার ব্রতে।। বাংলার সরকার সেবা মনােভাবের স্বীকৃতি স্বরূপ মাধবকে সম্মানিত করতে চায়। আনন্দ সংবাদটা সবাই মাধবকে জানাতে গিয়ে জানতে পারল, সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে রাস্তায়। অসংখ্য, আরও অনেক অভাবী মানুষের পাশে তার হৃদয় কুসুম ফোটানাের আশায়।


তৃতীয় পর্ব 


জুতো পরতে হবে সারা অঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে তবে গিয়ে বাইরে বেরোতে হবে বাড়ি থেকে আসার পর সেসব সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে তাদের সাবান দিয়ে ধুয়ে বালতিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে তারপর নতুন কাপড় পরিধান করে এমনকি সবজিগুলো কেউ ধুয়ে নিতে পারলে ভালো হয়।

কিন্তু এত কিছু তো করা যায় না মানুষ তো অলসের জাতি তাই বলে থাক অত কিছু হবেনা আর ওইখানেই তো গন্ডগোল ওইখান থেকেই ছিদ্রপথে করোনাভাইরাস হাসতে হাসতে ঢুকে যায় আর ঢুকে গিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবী। 

অংশুমান আর মিলন বাবু জানলায় দুটো বাড়ি পাশাপাশি থাকে তারা জানলা দিয়ে কথাবার্তা বলছে মিলন বাবু তার বক্তব্য রাখছেন যে কিছু লোক আছে যারা বেপরোয়া হয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের রোগের ভয় নেই কিন্তু অজান্তেই তাদের অজান্তেই বের হতো তাদের শরীরে প্রবেশ করেছে। মিলন বাবু জানলা দিয়ে বলছেন, করোনা ভাইরাসের জেরে বিশ্বদুুয়োর বন্ধ। লকডাউন শুরু হল বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে। দোকান, বাজার, হাট স্কুল, কলেজ সব বন্ধ।তবু মিলনবাবু দোকানে গেলেন একবার। তিনি বলেন, আমার কিছু হবে না',।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা  বলছেন এই ভাবনাটাই করোনাকে, বিশ্ব মহামারীতে, পরিণত করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও এ দেশে বাজার-ঘাটে সেই দৃশ্য খুব কমই দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার একটি ঘটনা রীতিমতো আশঙ্কার সৃষ্টি করতে পারে। লকডাউন চলাকালীন মাত্র একবারের জন্য দোকানে গিয়েই করোনা আক্রান্ত হলেন এক ব্যক্তি। অথচ তিনি মাস্ক, গ্লাভস সমস্ত কিছুই পরে গিয়েছিলেন। 


মিলনবাবু  জানিয়েছেন, তিনি লকডাউন সম্পূর্ণই মেনে চলছিলেন। কিন্তু ঘরে খাবার শেষ হতেই তাঁকে যেতে হয়েছিল দোকানে। তাও একটি দোকানেই গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন পর থেকেই শরীর খারাপ হতে থাকে। জ্বর, শরীরে অসহ্য ব্যথা। এরপরই প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর করোনা টেস্ট হয়। সেখানেই তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। 

মার্কিন এক যুবককে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া হসপিটালে ভরতি করা হয়েছে। ৩১ বছর বয়সী সেই যুবকের নাম বেনজি হা। 


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাস ছড়ায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখলেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির ড্রপলেট অন্য কারও নাক, মুখ, চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই ভাল মাস্ক, চশমা পরাটা আবশ্যক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেনজির ক্ষেত্রেও সেভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি। 


এই কোভিদ নাইনটিন বা করোনা রোগ আসার আগে অংশ মানে জীবন ছিল সহজ সরল তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতো নিজের কাজ করতো টিউশনি পড়াতে কোনো বাধা ছিলনা কিন্তু করোনাভাইরাস আসার আগে আসার পরে আর উন্মুক্ত পরিবেশে ঘোরাফেরা করা যায়না তার আগের ঘটনা এখন কিছুটা আমরা বর্ণনা করছি। জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে? লকডাউনের আগে অংশুমানের মনে হত, স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? সজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে কিছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস। 


***********************************************

আগামী পর্বে 

************************************************



 সুদীপ ঘোষাল 

সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প  দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব  বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ  ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত


উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




 

[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * দশ


বিশ্বনাথ পাল


পনেরো

একদিন মৌমিতাকে বললাম, আমি দুটো ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছি।

বলল, ক্লার্কের?

আমি কোনও উত্তর দিলাম না। জানলার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। বড়লোকদের এই এক সমস্যা। গরিব মানুষকে ছোট নজরে দেখা। আরশোলা, টিকটিকি মনে করা। আমার বাবার টাকা ছিল না, বন্ধ কারখানার শ্রমিক হিসেবে তার বহু বছর কেটেছে জীবনের। ঠাকুর বানানো ছিল বলে কোনওদিন না খেয়ে থাকতে হয়নি। গরিব বাবার ছেলে হয়ে ক্লার্কের চাকরির ইন্টারভিউ ছাড়া আর কীসের ডাক পাব আমি? অফিসার হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। যদিও দুটো ইন্টারভিউয়ের একটা ক্লার্কের হলেও আরেকটা অফিসারের ছিল। নন গেজেটেড গ্রুপ বি অফিসারের। পিএসসি মিসসেলেনিয়াসের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল। একদিন দুপুরে সাইবার কাফেতে গিয়ে পিএসসি ওয়েবসাইট খুলেছিলাম। তালিকায় নিজের নামটা দেখে যে কী আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি। বাড়িতে মা ও দিদিকে বলেছি। আর এখন মৌমিতাকে বললাম। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারভিউ। প্রায় আড়াই মাস সময় হাতে আছে। হাইকোর্টের ইন্টারভিউ ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ। বাবা মারা গেছে সেপ্টেম্বরে। তার আড়াই মাসের মধ্যেই দুটো চাকরির ইন্টারভিঊয়ের খবর পাই।

বাবা মারা যাওয়ার সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন মৌমিতা ফোন করেছিল। ও সাধারণত আমাকে ফোন করে না। সেদিন কেন করেছিল আজও জানা হয়নি। বাবার মৃত্যুর  খবর শুনে বলল, আচ্ছা রাখছি, কাজ মিটে গেলে আসিস।

আজ এসেছি। সোফায় বসেছি।কাকিমা কাচের সেন্টার টেবিলে চা-বিস্কুট দিয়ে গেছেন। বাবার অসুস্থতা নিয়েও খোঁজখবর নিলেন। আমার উল্টো দিকে মোউমিতা বসে। হাল্কা গল্পের মাঝে আমার চাকরি সংক্রান্ত খবরের যে প্রতিক্রিয়া পেলাম তাতে আর বেশিক্ষণ বসে থাকার ইচ্ছে হল না। কেমন যেন তেতো হয়ে গেল মনটা। বড়লোকদের মধ্যে আন্তরিকতার বড় অভাব। তারা টাকাকেই অন্তর দিয়ে ভালবাসে।

ইউনিভার্সিটিতে একবার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিতর্কের বিষয় ছিল—মানি ইজ দ্য মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট থিং ইন লাইফ। মৌমিতা নাম দিয়েছিল। বিষয়ের পক্ষে বলে বেশ ছড়িয়েছিল মনে পড়ে গেল। ওর যুক্তি ধোপে টেকেনি। শ্রোতারা হেসেছিল। বিপক্ষের বক্তা অনির্বাণ বলেছিল, টাকা যদি জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিস হোত, তবে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা এত বাড়ত না। মানুষ টাকার অভাবে সংসার করত না, বংশবিস্তার করত না। যুক্তিতে মৌমিতা হারলেও বেশ বোঝা গিয়েছিল টাকাকে ও বেশ বড় করে দেখে। অথচ এই মৌমিতারই একটি কথায় আমার ওকে বস্তুবাদী মনে হয়নি, মুগ্ধতার জন্ম হয়েছিল। আমাকে বলেছিল, দ্যাখ, তুই একটা বিশাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে গেলি এটা তোকে ঠিক মানাবে না। মোটামুটি কম টাকাপয়সা থাকবে, যাতে লোকের কাছে হাত পাততে না হয়। যাইহোক, স্ববিরোধই মানুষের চরিত্রধর্ম। কারও কম থাকে, কারও বেশি—কিন্তু থাকে।

আজ এত বছর বাদে নিজেকেও লেন্সের নীচে ফেলে দেখি। মানুষ বিশুদ্ধ ভাববাদী বা বিশুদ্ধ বস্তুবাদী হয় না। দুইয়ের মিশেল হয়। তবে যার মধ্যে যে ভাগ বেশি থাকে তাকে সেই ভাগেই দাগিয়ে দেওয়া হয়।

আর দু-একটা আলগা কথাবার্তার পর চা দ্রুত শেষ করে বললাম, আজ উঠি।

মৌমিতা বলল, এত তাড়াতাড়ি! এই তো এলি?

না, একটা কাজ মনে পড়ে গেল।

আমার সঙ্গে মৌমিতা নীচে নেমে এল। বোধহয় দরজা বন্ধ করতে, আমাকে এগিয়ে দিতে নয়। তবে এর আগে বার কয়েক এগিয়ে দিয়েছেও। উঠোনের বাঁধানো পথ পেরিয়ে গ্রিলের গেট পর্যন্ত, আর আমি মনে মনে আপ্লুত হয়েছি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি ভেবে।

মৌমিতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে গেলাম দীপাঞ্জনদার বাড়ি। খবর পেয়েছিলাম আগেই যে দীপুদা ফিরেছে। দীপুদাকে দিলাম, আমার ইন্টারভিউ প্রাপ্তির খবর।

দীপুদা বলল, সত্য, মিসসেলেনিয়াসের ইন্টারভিউয়ের আরও আড়াই মাস আছে। এই আড়াই মাস তুই জানপ্রাণ লড়িয়ে পরিশ্রম কর। আর তোর পক্ষে যা করা সম্ভব কর।

বললাম, মানে? কী বলতে চাইছ?

আমি বলতে চাইছি কোনও কোচিং সেন্টারে এই আড়াই মাসের জন্য ভর্তি হয়ে যা। সেখানে তোকে ইন্টারভিউয়ের জন্য তৈরি করে দেবে। ওরা মক ইন্টারভিউ নেবে। আর শুধু ইন্টারভিউয়ের জন্য খুব বেশি টাকাও হয়তো লাগবে না। তুই শিগগির গিয়ে কথা বল। টাকাটা যদি তোর পক্ষে অ্যাফোর্ডাবল হয়, তবে ভর্তি হয়ে যা। পরে যেন আফশোস করতে না হয়। মনে রাখবি ইন্টারভিউ কিন্তু তোর জ্ঞানের পরীক্ষা শুধু নয়, তোর পার্সোনালিটির পরীক্ষা, তোর অ্যাটিটিউডের পরীক্ষা। তুই জানিস এটা ওরা জানে, না হলে লেখা পরীক্ষায় পাশ করতিস না।

রাইসে মনে হয় অনেক টাকা নেবে। হালদারে গিয়ে খোঁজ নেব?

হ্যাঁ যা, দেরি করিস না। কারণ ইন্টারভিউয়ে যারা ডাক পেয়েছে অনেকই কিন্তু কোচিং নেবে, বা অলরেডি নেয়। দেরি করলে সিট ফিল্ড উপ হয়ে যেতে পারে।

দীপুসদার মুখে অ্যাটিটিউডের কথা শুনে আমার সুদীপের একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমি ডবলু বিসি এস দিচ্ছি শুনে সুদপ নাকি বাবাইকে বলে ছিল ওর হবে না। ওর অ্যাটিটিউডে প্রবলেম আছে। যদি মিসসেলেনিয়াস ক্লিয়ার করতে পারি, তবে কি আমার অ্যাটিটিউডের সমস্যা দূর হয়েছে বলা যাবে? সুদীপকে মিথ্যে প্রমাণ করা যাবে? যদিও এটা বিসিএস নয়। গ্রুপ বি অফিসারের চাকরি। তাও? কী জানি।

পরদিন ছুটলাম জেমস হিকি সরণি বা ডেকার্স লেন। হালদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন নামে কোচিং সেন্টারে। এটা সেই কোচিং যেখানে এমএসসি পার্ট ওয়ান দেব কি দেব না দোলাচল নিয়ে ডবলু বি সিএসের কোচিঙের খোঁজ নিটে এসেছিলাম একবার।

একটা ঘরে টেবিলের ওপারে বসে থাকা রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম। আর জানতে জাইলাম কোর্স ফি ক্ত।

ভদ্রমহিলা বললেন, কোর্স ফি এক হাজার টাকা। পুরো টাকাটাই ভর্তির সময় পেমেন্ট করতে হবে। সপ্তাহে একটা করে ক্লাস। দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে। বলে ভদ্রমহিলা আমার দিকে ফর্মটা এগিয়ে দিলেন।

ছবি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি আর টাকাটাও আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব। তাই সঙ্গে সঙ্গে ফর্ম পূরণ করে এক হাজার টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। ফর্মের নীচে দেখি একটি ঘোষণা যে আমি অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিইনি এবং আমি চাকরি পেলে আমার ছবি এই সংস্থার বিজ্ঞাপনের প্রচারে ব্যাবহার করা হতে পারে। ঘোষণার নীচে আমাকে সই করতে হল।


ষোলো

হাইকোর্টে লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের একটি ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। বাড়িতে চিঠি এসেছে। সামনের মঙ্গলবার ইন্টারভিউ। মাস ছয়েক আগে পরীক্ষা হয়েছিল। পরীক্ষাটা দিতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ফর্মও পূরণ করেছিলাম এক বন্ধুর সৌজন্যে। ইউনিভার্সিটির বন্ধু অতনুর সঙ্গে এমএসসি পাশ করে বেরনোর পরেও যোগাযোগ ছিল। ও আমাকে বেশ পছন্দ করত। ওর মা হাইকোর্টে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে হাইকোর্টে কখন লোক নেওয়া হবে তার খবরাখবর অতনু ভাল জানত। বিজ্ঞাপনটা কোনও এক দৈনিকে বেরিয়েছে, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। অতনুই আমার নজরে আনে এবং ও নিজের আবেদনের ফর্ম পূরণ করার পাশাপাশি আমাকেও একরকম বাধ্যই করে ফর্ম পূরণ করতে। আমার লক্ষ্যের মধ্যে হাইকোর্ট ছিল না। কিন্তু ও বলল, হাইকোর্টের চাকরি খুব ভাল চাকরি, প্রচুর ছুটি। ও আরও বলল, পরীক্ষাটা কিন্তু এক-দেড় বছর পরে হবে। পরীক্ষার মাস খানেক আগে বাড়ির ঠিকানায় অ্যাডমিট কার্ড যাবে।

অতনুকে অবশ্য এই পরীক্ষায় বসার জন্য এক-দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই স্কুল সার্ভিসের মাধ্যমে ও স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে।

তো, অতনুর কথার সত্যতা প্রমাণ করে আবেদন করার এক-দেড় বছর পরে এবং পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে অ্যাডমিট কার্ড এল বাড়িতে। কিন্তু হাইকোর্টের  জন্য আলাদা করে তো পড়াশোনা করিনি। পড়েছি যা তা মূলত পিএসসি-র কথা মাথায়  রেখে। হাইকোর্টের পরীক্ষা তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের। তিনটি পেপার—অঙ্ক, সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজি, প্রতিটি একশো নম্বরের। তিনটি বিষয়ের খাতা ও প্রশ্নপত্র একই সঙ্গে হলে দিয়ে দেওয়া হবে এবং তিন ঘণ্টা পরে কালেক্ট করা হবে। এটা প্রিলিমিনারি নয়, মেইন। পাশ করলে ইন্টারভিউ।  

ফলে মনে হল তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের পরীক্ষা দেওয়া কি মুখের কথা? তা-ও আবার কোনও প্রস্তুতি ছাড়া। ঠিক করলাম যাব না পরীক্ষা দিতে। বাড়িতে সিদ্ধান্তের কথা জানাতেই মা আবার জানাল দিদিকে। দিদির পাড়াতেই বিয়ে হয়েছে।

দিদি এসে বলল, না, পরীক্ষাটা তুই দিবি। পরীক্ষা দিবি না কেন! তোর তো পিএসসি-র পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়াই আছে। এই পড়াতেই দেখবি তোর পরীক্ষা ভাল হবে।

আমার দিদি বেশ আশাবাদী। দিদি নিজের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে এখন কষ্ট করছে। বিয়েটা কালীঘাটে হয়েছে। বিমলদা মাতাল। সংসারে কোনও কিছুরই খবর রাখে না বললে চলে। কালীঘাটে বিয়ে হয়ে এক হিসেবে ভালই হয়েছে, টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে দেওয়া বাবার পক্ষে সম্ভব হত না। আমি একটা চাকরি পেলে আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক মর্যাদা বাড়বে। 

দিদির মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু কাজে দিল না। দিদি বলল, দেখিস, তোর এই পরীক্ষাতেই হয়তো চাকরি হয়ে যাবে।

মূলত দিদির জোরাজুরিতেই সিদ্ধান্ত বদলালাম। যাব পরীক্ষা দিতে। যা থাকে কপালে। হারানোর তো কিছু নেই।

সিট পড়েছিল মৌলানা আজাদ কলেজে। পরীক্ষার দিন রবিবার, অর্থাৎ সকালে মেট্রো চলবে না। পরীক্ষার দিন ভোরবেলা থেকেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। বর্ষাকাল। বৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কাঁধে ব্যাগ, মাথায় ছাতা ও বৃষ্টি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম। মা ভেবেছিল হয়তো বৃষ্টির অজুহাতে যাব না পরীক্ষা দিতে। বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রায় হাঁটুজল। যাইহোক একটা রিক্সা পেলাম। বাঁশদ্রোণী থেকে বাসও পেলাম। প্রথমে এসপ্লানেড, তারপর সেখান থেকে বাস বদল করে গেলাম ওয়েলিংটন মোড়ে। দু-এক জনকে জিজ্ঞেস করে কলেজ খুঁজে পেতে সমস্যা হল না। দশটা থেকে পরীক্ষা, আমি ন’টা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছি। পৌনে দশটা নাগাদ জানা গেল বৃষ্টির জন্য পরীক্ষা দু’ঘন্টা পরে শুরু হবে, অর্থাৎ দশটার বদলে বারোটায়। কারণ বৃষ্টিতে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক এসে পৌঁছতে পারেননি। হাইকোর্টের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত ভেনুতেই এই ব্যবস্থা।

পরীক্ষা মোটামুটি ভালই হল। অঙ্কে বারোটা প্রশ্নের মধ্যে যেকোনও দশটা করতে বলা ছিল। দশটাই করেছি। মনে হল সব ক’টা অঙ্কই সঠিক করেছি। জিকেও আমার জানার মধ্যেই ছিল। যেহেতু তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের পরীক্ষা তাই প্রশ্ন পিছু বরাদ্দ নম্বর বেশি ছিল। ইংরাজিটা বেশ শক্ত মনে হল। ৫০ নম্বরের একটা প্রবন্ধ আর ৫০ নম্বরের প্রেসি। প্রবন্ধ ছিল রেনি ডে ও ইয়োর এইম ইন লাইফ—যেকোনও একটি। লিখলাম আমার জীবনের লক্ষ্য—খুব সাধারণ, একটি সরকারি চাকরি পেয়ে বেকারত্ব ঘোচানো। প্রেসির বহু শব্দের অর্থ জানা ছিল না, তা-ও আন্দাজ করে লিখে এলাম।

এই পরীক্ষাতেই পাশ করার ফলে ইন্টারভিউয়ের চিঠি এসেছে বাড়িতে। ভাবলাম, দিদির কথা ফলতে চলেছে কিনা কে জানে।

মঙ্গলবার দিন হাইকোর্টে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর আমার ডাক পড়ল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখি উঁচু বেদীর উপর দু’জন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের চোখের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। এবার ধেয়ে এল প্রশ্নবাণ, লেখাপড়া কদ্দূর?

প্রশ্নের মধ্যে বেশ একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।

বললাম, ইকনমিক্সে এমএস সি পাস।

ভদ্রলোক আঁতকে উথলেন, অ্যাঁ! এমএস সি পাস করে এখানে ক্লার্কের কাজ করবেন?

এর কোনও উত্তর হয়? মুহূর্তের বিরতির পর তিনিই আবার বললেন, কোন ইউনিভার্সিটি?

বললাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

হায়ার সেকেন্ডারিতে ইংরেজিতে কত নম্বর ছিল?

বললাম, ৫৮।

বাবা কী করেন?

বলতেই পারতাম বাবা ঠাকুর বানাতেন বা বাবা একটা কারখানায় কাজ করতেন। তার বদলে বললাম, বাবা তো এই সেপ্টেম্বরে মারা গেলেন।

বললেন, যাও, ইন্টারভিউ হয়ে গেছে।

মাত্র দেড়-দু’মিনিটেই ইন্টারভিউ খতম।

মাস দুই পরে রেজাল্ট বেরোল। খবর পেয়ে একদিন গেলাম, হাইকোর্টের দেয়ালে টাঙানো সাফল্যের তালিকা দেখতে। আঁতিপাতি করে খুঁজেও তালিকায় কোথাও আমার নামের হদিস মিলল না। ২৩৮ জনকে ডেকেছিল ইন্টারভিউতে, তারমধ্যে ৮৮ জন সফল। মন খারাপ হয়ে গেল। ইন্টারভিউতে পড়াশোনা সংক্রান্ত কিছু জিজ্ঞেস করা হলে যদি না পারতাম, একটা কথা ছিল। কিন্তু সেসব তো হয়নি। তবে কি কাদের নেবে আগে থাকতে স্থির করাই ছিল? পরীক্ষা-টরীক্ষা সব লোক-দেখানো নাটক? তখনও তো জানি না যে বাঙালের হাইকোর্ট দেখার আরও বাকি আছে।


*********************************************************************


উপন্যাস * দীপংকর রায়

       


['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৭  

দীপংকর রায়


আস্তে আস্তে কীরকম ভাবে যেন অতিমাত্রায় জড়িয়ে যাচ্ছি গোরুবাছুরের জগতের সঙ্গে । বিশনি ভাই কয়েকদিন এদিক ওদিকে কাটিয়ে ফিরে এসেছে আবার । তাতে একটুখানি হালকা লাগলেও কেন যেন খুব একটা হালকাও হতে পারছি না । এই মুহুর্তে যা উপার্জন তাতে টানাটানি থাকে । কেন যে বেহিসাবের খাতায় চলে যাচ্ছে সব দিকটা ! যদিও সেটা বোঝার উপায় খুব একটা কঠিন তো নয় , গোরু বাছুরের আহারাদির জন্যে দানা-ভুসি-বিচালির যা মূল্য , তারপর লোকজনের মাস মাহিনা , কাজের দিদিরও তো একটা মাস মাহিনা আছে ; ভাই-এর পড়াশোনার খরচ , এই সবকিছু মিলে মোটামুটি একটা বড় সংসারই বলা চলে আমাদের । এছাড়া বিষয়টা এবারে আরো ধরা পড়েছে , কালো গরুটিকে বারকয় নানা ভাবে চেষ্টা করেও সে পূনরায় গাভিন হবার কোনো লক্ষণই দেখাচ্ছে না । সেও যে দুধ দেয় দুবেলা মিলে এখন , তাতে তার খোরাকির খরচও ওঠে না । এর পর লাল গরুটির বাচ্চা সুরভীকেও পালন করা । সেও তো পরিণত হয়ে উঠেছে ! ইতিমধ্যে তাকে দিয়ে তার মাকে দুধ দুইবার সময় আর পানানো হয় না । জটাভাই দুহাতে সরষের তেল ডলে নিয়ে পানান দেয় তার । 

        বিষয়টা এরকমই দাঁড়াচ্ছে , সকলের উপদেশ এবং অনুযোগও , ব্যবসায়িক ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটিই কথা —- “ কালো গরুটিকে আর চেষ্টা না করে ওকে এবারে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দাও ।” 

       বিয়ে দিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো ওকে বিক্রি করে দেওয়া । কিন্তু এক্ষেত্রে মুশকিলটা হচ্ছে সেখানেই, মাও চাইছে না ওকে বিক্রি করতে কারণ, এখন এই অবস্থায় বিক্রি করলে তার সঠিক মূল্য কেউই দেবে না । তাও খরিদ্দার তো সেই কসাই । কয়েকজন ইতিমধ্যে পুষবার নাম করে দেখাদেখি করে গেছে । আদতে তারা সকলে একই । সামনে কুরবানী,  ঈদের একটা বাজার আছে । একবার দড়ি খুলতে পারলেই তারপর নেপালগঞ্জ ঠাকুর পুকুর বা বাকড়ার হাঁটে কিম্বা ডায়মন্ড হারবার , যে কোনো অঞ্চলে হাত বদল হয়ে চলে যাবে সে । অথচ মুখে বলছে, “ আমাদের অঞ্চলে প্রচুর ঘাস জঙ্গল , তাই খেয়েই ফুরোতে পারবে না মা । আমরা তো এরকম ঠাট গরুই কিনি মা । ভালো জাতের গরু খুঁজি এই জন্যেই তো, আর এটা তো পিওর হলেস্টান গরু, ও ছাড়া খেলেই দেখবেন গভনা হয়ে যাবে । আমাগের জমা ধানের কুড়ো, গমের কুড়ো খেয়েই ফুরতি পারবে না । প্রকৃতির ভেতরে ওরে ছাইড়ে দিতে হবে । তালেই দেখবেন ও গভনা হয়ে গেছে । তা মা , কী কলেন কন ? একটু ভাইবে চিন্তে কবেন‌ না হয় কদিন পরেই । তা হলে আজ চলি তাহলে ? দুইদিন পরেই না হয় নেবোখানে, ভাবে দেখেন কী করবেন ।” 

      আধাবয়সি মানুষটা কি মিথ্যে কথা বলছে ? না ওঁর বাড়ি সত্যি সত্যিই মফস্বলের কোথাও ? হয়ত বাকড়া হাট না হলে পৈলানের দিকে । যা হয় হোক গে , কিন্তু মা এবং আমার কারোরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না । কিছুতেই মন সায় দিচ্ছে না । মাকে বলি, আচ্ছা দেখি না আরো কিছুদিন । তারপর যা হয় একটা কিছু ভাবা যাবেনে না হয় ।

       একটা ছুটির দিন দিদিরা এলো । অশোকদার সঙ্গে এই বিষয়টা আলোচনা করতেই সে বললো , ও কত টাকার দানাভুসি খায় বল তো ? তুই ওসব বাদ দিয়ে ওকে ভালো ডাক্তার দেখা । ওর ওষুধপত্র ডাক্তার খরচ যা লাগে আমাকে জানাস । এতদিন ওর দুধ খাওয়া হলো আর এখন ওকে শেষে কিনা কসাইএর হাতে বিক্রি করতে হবে ! শোন , তোর কোনো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই । আমি আছি , তুই চেষ্টা কর । 

      কেন জানি না ভেতরটায় কীরকম একটা ঢেউ খেলে যাওয়া অনুভব করলাম । সেটা কীসের ? আনন্দের ? নাকি ভরসার ! গলাটা ভার হয়ে গেল । চোখমুখের উপর কেমন যেন একটা তরঙ্গ খেলে গেল। অশোকদা কি দেখতে পেল সেটা ? নাকি পেল না !

      সকালবেলা আটটা-নটার দিকে যখন ওদের স্নান টান করিয়ে পাশের খোলা মাঠে বেঁধে দেওয়া হয় একটুখানি হাঁটাচলা করার জন্যে বা ঘাস জঙ্গল যা একটু আধটু পায় খুঁটে-খেটে খাবে, এই ভেবে । সে হয়ত বাড়ির পাশের মাঠে , না হলে স্কুলের মাঠের ভেতর । সেখানে ওরা লম্বা দড়িতে বাঁধা থাকে বাঁশের খুটোয় । তখন যদি বেঁধে দেওয়ার সময় কালো গরুটি কাছে পায় তো সে আমাকে জিভ দিয়ে চেটে দিতে চায় । তাকিয়ে থাকে করুণ ভাবে যেন আমার মুখের দিকে । যদি আমি ওদের থেকে খানিকটা দূরে থাকি , তখন মনে হয় কিছু যেন বলতে চায়  আমায় । আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করি সে সব কিছুক্ষণ । ও যেন বলে , আর একটু চেষ্টা করেই দেখ না কেন আমায় । একটু ডাক্তার-বদ্দি করেই দেখ না কেন ; তারপর না হয় একটা ভালো জাতের ষাঁড়ের কাছে নিয়ে যেও আমায় । হলেও তো হতে পারি সন্তানসম্ভবা !

       কখনও কখনও মনে হয় , ওরা মনেহয় আমাদের কথাবার্তা সবটাই বোঝে । এই যে ওকে নিয়ে আমাদের একটা মানসিক টানাপোড়েন চলছে , সেগুলি সবই যেন সেও বোঝে ।

      এ ছাড়া এই যে ওকে নানা অছিলায় দেখতে যারা আসা যাওয়া করছে রোজ, ওর সামনে দাঁড়াচ্ছে‌,অহেতুক ওর গলায় মাথায় হাত‌ বুলিয়ে দিচ্ছে । এ কথা সে কথা বলতে বলতে কেউ কেউ ওর দুবেলার দুধের পরিমাপ করছে । কিম্বা হয়ত ফিসফিসিয়ে দুধের বদলে ওর এইমুহুর্তে শরীরের ওজন নিয়েও কিছু বলাবলি করছে । আর এইসব ইঙ্গিত, কথা বলাবলি , ও হয়ত খানিকটা খানিকটা আঁচ করতে পারেও এখন । আর পারে বলেই আমাকে দেখলে আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে । ও হয়ত বুঝোতে চায়, আমরা মানুষজনের ঐ সব ছলনা বুঝতে পেরেছি না পারিনি

    ওকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারি না আমিও , যে শোন , আমরা যখন তোর দুধ খেয়েছি , তখন তোকে কসাইয়ের হাতে তুলে দেবো না কোনোভাবেই ।

      অশোকদাও তো বললো , ওর দুধ খেয়ে যখন মানুষ হলো  আমাদের ছেলেটা , তখন ওকে যতদিনই লাগুক চেষ্টা করতে হবে‌, কীভাবে স্বাভাবিক করে ওঠা যায় ওকে । ট্রিটমেন্ট শুরু করে দে তো তুই , দেখি কী হয় ।

     নিউটালিগঞ্জে একজন পশুবিশেষজ্ঞ আছেন শুনেছি । এর আগে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের নারানদা এসেছিলেন যখন কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা নিয়ে তিনিও  বলেছিলেন এই ডাক্তার বাবুর কথা । এ ছাড়া জটা ভাইও সন্ধান দিয়েছিলো তাঁর ।

       সময় করে একদিন তাঁর ওখানে যেয়ে উপস্থিত হলাম‌। কিন্তু এমা , এ কী , এ যে ডাক্তারির থেকেও অডাক্তারি বেশি ! টাকাপয়সার চাহিদা যেমন নেই , সেটা যেমন একটা আশ্চর্যজনক বিষয় ,  তেমন আর একটি জিনিসও দেখলাম ,  রাজত্বের মানুষ তাঁকে ঘিরে একেবারে গোল হয়ে বসে আছে । নানা গল্পগাছা চলছে সেখানে । আমাকে তিনি ঘরে ঢুকতে দেখে ইশারা করে বসতে বললেন‌ একটি খালি চেয়ার দেখিয়ে । 

    এর পর দেখতে পেলাম উনি স্বাভাবিক ভাবে যেন হাঁটাচলা ঠিক মতো করতে পারেন না । একটি হাত-লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে লাগে ওঁকে । লাঠি না নিয়েও দেখলাম একবার দেয়াল ধরে ধরে একটু ঝুঁকে , দুলে দুলে চলতে হলো যেন ওঁকে । 

        সবটাই বসে বসে দেখছিলাম  । ইতিমধ্যে একটি কথাও হয়নি তাঁর সঙ্গে । খানিকক্ষণ গেলে ভিড়টি একটু হালকা হলে উনি আমার‌ সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন । শুরুটাও করলেন অতি সাধারণ কথায় । জিজ্ঞাসা করলেন , আমাদের বাড়িটি ঠিক কোথায় । আমার বাড়িতে কে কে আছে । গরু বাছুরের দেখাশোনা কে করে । নিজেই নাকি গোয়ালা রাখা আছে । ইতিমধ্যে গরুটিকে কতবার পাল ধরানো হয়েছে । আমি অন্য কোনো কিছু করি কিনা । নাকি গরুর পরিচর্যাতেই শুধু ব্যস্ত থাকি ।

       প্রথম প্রথম একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম । মনে মনে ভাবছিলাম , এ কি গরুর চিকিৎসা করবে‌ , নাকি আমার চিকিৎসা করবে ! এ যেন আমারই চিকিৎসা করতে চাইছে আগে ।অদ্ভুত বিষয় যেন সবটাই । যাইহোক তার প্রশ্নের উত্তর একে একে সমস্তটাই খানিকটা খানিকটা করে বলবার চেষ্টা করলাম । শেষপর্যন্ত নিজের কাজের কথার বিষয়ে বলতে যেয়ে বললাম , আমার বিশেষ কোনো কাজ নেই ।সমস্ত দিন গরু বাছুরের দেখাশোনা আর তার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলে একটু বাড়তি সময় বই পড়েই কাটাই । একটুআধটু লেখালিখি করি , এই যা ।

          শুনে উনি যেন একটুখানি হাসলেন মিচকি মিচকি। তারপরেই বললেন , কী বইপত্র পড়ছেন এখন ? 

         একটুখানি আড়াল রক্ষা করেই বললাম , সেরকম কিছুই না । যা পাই সেটাই পড়ি । ভালোলাগলে কন্টিনিউ করি না লাগলে রেখে দি । আর একটা ধরি ।

        উনি বললেন , সেটাও যদি না ভালো লাগে , তখন ? তার ও পরেরটা তো ?

         — না , ঠিক যেমন করে বললাম তেমনটা না হয়ত , খুব সহজে যে ছাড়ি না , দুই একদিন তারপরেও দেখি । কারণটি খোঁজার চেষ্টা করি । ভাবি , কেন ভালোলাগছে না ! উত্তর পেলাম তো ভালো , আর না পেলাম তো , তাহলে আর কীইবা করার ! ছেড়ে দি তখন ।

        —-- কী লিখতে ভালোবাসেন আপনি ? 

         —--  কবিতা ।

          —-- পড়াবেন তো একদিন । আচ্ছা , সে তো হলো , আমি গেলে লোকজন একটুখানি সহযোগিতা করতে পারবে তো , ধরে-করে দিয়ে ?  

      —--- হ্যাঁ হ্যাঁ , সেটা পারবে তো  ঠিকই —- 

       —-- এইজন্য বললাম , দেখছেন তো , আমি আর পাঁচ জন মানুষের মতো তো স্বাভাবিক নয়, তাই । যদিও আমার সঙ্গে যে  ছেলেটি থাকে সে অনেকটাই সাপোর্ট দিতে পারবে যে সেটা যেমন ঠিক, তবুও যদি লাগে ! গরুটি যদি একটু দুষ্টু হয় তাহলে । তা না হলে , শান্ত হলে তো কথাই নেই কোনো । তাই বলছি ,শান্ত , নাকি রাগি ?

         —-- না না খুবই শান্ত ।

          —-- ঠিক আছে , কথাটা বলা এইজন্যই ওষুধটষুধ লাগলে তো দিতে হবে । তবে আমি কিন্তু তারপরে আপনার কবিতা শুনে তবে আসবো । আর ওটিই আমাদের হবে নতুন সম্পর্কের কথা । ঠিক আছে , আজ তাহলে এই পর্যন্তই কথা থাকলো ? সামনের রবিবার সকালের দিকে আমি যাবো আপনাদের বাড়িতে ।

         খানিকটা হতবাক হবার মতোনই অবস্থা । গরুর চিকিৎসা করাতে এসে এ দেখি কবিতা পাগলের খোঁজ পাওয়া ! কবিতা লিখলে তাহলে সমাদরও জোটে এতোটা ? অথচ সেই কথাটা বলতেই তো আমি সংকোচ বোধ করি সবসময়ই ! এই যদি না বলতাম, তাহলে কি এই মানুষটি এতটা গুরুত্ব দিত ?

     অন্তরাল থেকে কে যেন কিছু একটা  বললো যেন !

     সত্যি সত্যিই কি লেখালিখির জন্যে সমাদর পাওয়া যায় কোথাও? যদিও শরৎচন্দ্র পড়ছি শুধু শুনলে উনি কি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন! কারণ  শরৎচন্দ্রে থেমে আছি‌ এটা জানলে কোথাও কি বিশেষ কদর পাওয়া যায় এখনও ?

     এই প্রসঙ্গে শংকরের কথাটিই তো প্রতিমুহূর্তে মনে পড়ে বিশেষ ভাবে : এটা পড়তে হবে , ওটা পড়তে হবে … । 

      তাই তো মনে মনে ভাবি , এই বয়সে কত খোঁজ ওদের কাছে! অথচ আমি তো কিছুই জানি না । এখনো যেটুকু শুনে শুনে খুঁজে ফেরা …..! এই জন্যেই তো ডাক্তারবাবু কে কী পড়ছি কথাটিতে পরিস্কার করে সেরকম কিছুই বলতে পারলাম না । একটু অন্য ভাবে , কায়দা করে ঘুরিয়ে বলেছি খানিকটা শুধুই ।

        ভেতরে কোথাও একটা যেন দুটি বিষয় নিয়েই জোর পেলাম খানিকটা । 

       কালিকে মনে মনে বললাম যেন ফিরে আসতে আসতে

 — তাহলে তোকে আর কসাইয়ের হাতে দিতে হবে না রে কালি । মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায়ই এসেছি তাহলে , বুঝল ? নিশ্চয়ই একটা কোনো গতি করে দিতে পারবেন এই ডাক্তারবাবু । দেখি না কেন তোকে পূর্ণ জীবন ফিরিয়ে দিতে কত দিন লাগে ।

        রবিবার দিনই ডাক্তারবাবু এলেন । নিজে হাতে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলে দিলেন , চিন্তার কিছু নেই রায় বাবু । ওকে চিকিৎসা করলেই আশাকরছি ও ইনসিমেশন কমপ্লিট করে ধরে নিতে পারবে। এখন আপনার পরিচর্যার উপর আর একটুখানি ওষুধপত্র ব্যবহার ঠিকঠাক করতে পারলেই ও ধরে নেবে । তবে অবশ্যই ষাঁড়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে । আর ওষুধ দেখি কী আপনাকে দিয়ে দিতে পারি , বাকিটা একটু কষ্ট করে কিনে নেবেন আপনি । তবে আশা করছি অনেকটাই দিয়ে দিতে পারবো আমিই আপনাকে । 

      বললাম , ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু । বুঝতেই পারছেন , একটি গরুর উপর তিনটি কে চালাতে হচ্ছে । আসলে ওকে ঠিক ছাড়ানোর ইচ্ছাটা আমাদের কারোই নেই । 

       ডাক্তারবাবুকে তার ফিস্এর কথা জিজ্ঞাসা করাতে বললেন‌, ঐ রিক্সাওয়ালার ভাড়াটি দিলেই হয়ে যাবে । আমি তো সরকারি বেতন পাই কিছু একটা । ওঁ হ্যাঁ , আগামীকাল সন্ধ্যাবেলায় একবার আসবেন কিন্তু । দেখি হসপিটাল থেকে কী পাওয়া যেতে পারে । এরপর বাকি ওষুধগুলি আপনি একটু কষ্ট করে নিয়ে নেবেন মুর এভিনিউএর ওষুধের দোকান থেকে । এদিকে অন্য কোথায়ও পাবেন না । 

       ডাক্তারবাবু চলে গেলে তার উপস্থিতি আমার ভেতরে নানাভাবে এক অন্য অনুভবের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নানা বর্ণে বিচরণ করালো । 

       পরে বেশ কিছুদিন গেলে জানতে পেরেছিলাম এই মানুষটির কথা । তার কতটা অবদান সমাজের প্রতি । এই যে তিনি আজ বিকলাঙ্গ , সে কিন্তু তার জন্মসূত্রে পাওয়া নয় ! বা কঠিন কোনো অসুখবিসুখের জন্যেও নয় ! একাত্তরে নকশাল সিপি এম এর ভুল আক্রমণের শিকার এই মানুষটি । যদিও পরে অবশ্য আক্রমণকারীরাই জানতে পেরে তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে নিজেরাই ছুটোছুটি করে তাকে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । তাই না হলে এই মানুষটিকে আজ  আর আমরা এভাবে দেখতে পেতাম না  হয়ত । সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সেই  পরোপকারী মানুষটির নাম জিঞ্জিরশেখর সেন শর্মা ।












*****************************************************************************

আগামী পর্বে 

******************************************************************************

মুক্তগদ্য * জয়িতা ভট্টাচার্য




মুখবন্ধ

জয়িতা ভট্টাচার্য 


অভিসার কাল শেষে বিরহের কালবেলা এলো।লেখা আসছে না।কলম শুকিয়ে কাঠ।মন মরুভূমি।সুচিত্রা শেষ করতে পারেন না উপন্যাস। খসখস করে পাতা উড়ে যায়।স্বপ্ন দেখেন আধখোলা বই উড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে।হ্যামলিনের বাঁশি শোনা যায় সমস্ত চিন্তা সূত্র চলে যাচ্ছে সরোবরে। অন্ধ মায়া জড়িয়ে ধরেছে বিরাট এনাকোণ্ডার মতো।গিলে নিচ্ছে সমস্ত নতুন শব্দ। সুচিত্রার মনে নেই কিছু।শনশন হাওয়ার রাতে নিঃসীম বসে আছেন।কে যেন এক নারী সপসপে গায়ে শরীর ছুঁয়ে চলে গেল।কে যেন!চমকে তাকান।শুনশান জাতীয় সড়কের মতো জীবন পড়ে আছে।খসখসে পাতার কথারা।একজন আগুন্তুক।সাধু কি?দাড়ি গোঁফের আড়ালে তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখ।একটা অস্পষ্ট ঘর।মলিন নিয়ন আলো।একটা সরু তক্তপোষে এক পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।সুচিত্রা দেখলেন জীর্ণ সেই শরীর যেন কুহক।কোথা থেকে এসেছিলেন কেউ কখনও জানতে পারল না।ফকির বাবা,লোকে বলত।তারপর হঠাৎ অন্তর্ধান।উধাও হয়ে গেলেন।কেউ কেউ বলত খুব সৌভাগ্যবান কেউ কেউ দেখা পেয়েছে কখনও তাঁর।ফকির বাবা।কিছু আশ্চর্য কথা তিনি বলেছিলেন।গোপন। অদ্ভুত।অলৌকিক নয়।

সব ভুলে যাওয়াকে আগের দিনে বলত বেব্ভুল।এখন কী যেন বলে...।স্মৃতিরা ভীষণ চঞ্চল উচ্ছল হলে কি স্কিজোফ্রেনিক ?মনে জলছবি!।এমন রাত।একা সুচিত্রার কোলে দুধের শিশু।মাসকয়েক বয়স।দেরশো বছরের পুরোনো চারমহলা প্রাসাদ।ভঙ্গুর।রান্নাঘর কলতলা গেলে শশুর-শাশুড়ি এসে পাহারা দিত।দুছর আগের টাটকা মৃত দুজন।সুচিত্রার সঙ্গে জীবন আর মৃত্যু বাসন্তি আর রূপনারায়ণ হয়ে মিশে একাকার।একথা ঠিক সুচিত্রা তাঁদের উপস্থিতি,তাঁদের অদৃশ্য ঘেরাটোপে নিরাপদ ছিলেন তাঁর জীবন্ত স্বামীর চেয়ে বেশি আশ্বস্ত।

কী লিখবেন সুচিত্রা।এই বিস্মরণের অধিকাংশ সত্য অথবা সত্যের আবরণে প্রাচীন কোনো মিথ্যার কথা...সবই ছাপা হবে সুচিত্রা জানেন আজ তিনি যেখানে প্রতিষ্ঠিত,সব ছাপা হবে যা লিখবেন।কিন্তু সুচিত্রা জানেন এসব লেখা,লেখা নয়।জীবনে যা কিছু হবে যা হয়েছে সব পূর্ব হতেই লেখা আছে।নতুন কিছুই লেখার সাধ্য নেই। গাঢ় উপন্যাসের মতো রাত।দিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাত। ডিলিট ডিলিট ডিলিট। আটকে আছে কার্সর।মোছে না ছবিটা।নার্সিংহোমের বাথরুমে ঢুকে মেঝেতে কোনায় পড়ে আছে তোবড়ানো রক্তমাখা মাংসপিণ্ড, মৃত তাঁরই সদ্য প্রসবিত কন্যা।তাঁরই সামনে দিয়ে তাকে নিয়ে গেল কাপড়ে মুড়ে হিন্দু সৎকার সমিতি।তিনি প্রস্তর মূর্তির মতো একঠায় বসে।পৃথিবী স্তব্ধ এবং সমাপ্ত সেদিনও ভেবেছেন।তারপর,সংস্পর্শহীন সম্পর্কহীন অধ্যায়ের ভেতর এক পড়ন্ত দুপুর।মুহূর্তের জৈবিক তন্ত্রের মতো...কাশী বিশ্বনাথের গলিতে কাঁচের চুড়ি,মণিকর্নিকাঘাটে আগুন চির প্রজ্জল। কল্পকাহিনির মতো সুচিত্রার কোল জুড়ে পুত্র এসেছে,আলো এসেছে আচমকা আটমাস পর।আর আজ এই পশ্চিম অবকাশে লাল সূর্যের আলো এসেছে তাঁর শরীরময়।সারা জীবন শেষে আশ্চর্য প্রণয়।শেষবার জীবন বলেছে"যা লিখেছ সব ভুল।অন্ধকারে আলোর উৎস।দ্যাখো সেই অতিবৃদ্ধ ফকির তোমাকে দিয়ে যাচ্ছে সান্তা ক্লজের গিফ্ট।"প্রণয় এসে পূর্ণ করে দিচ্ছে আজীবনের তৃষ্ণা।এক আশ্চর্য যাদুকর গোধূলির আলো মেখে এসেছে সে।সেই কৃষ্ণ সেই ঈশ্বর,সেই প্রেমিক ।জীবন কখন কোন বাঁক নেবে? কোন কলম লিখবে সেই রূপকথা।জীবনের পঁয়তাল্লিশটা বসন্ত পুষ্পহীন থেকে যাবার পর এসেছে প্রার্থিত পুরুষ।অবেলা বলে কিছুই কি হয় দিনমানে?অনন্ত আলোকরেখা দেখছেন সুচিত্রা।স্থির নিথর স্মিত মুখ।মানুষটার কষ্ট হবে।তবু এই বিরহ দেবে মহামিলনের ডাক।

এখন উপন্যাসের পরিশিষ্ট শুধু লিখবেন সুচিত্রা।

আনন্দ যাত্রা অনন্ত যাত্রা।পুব জানলা দিয়ে উষার

প্রথম কিরণ চুমো খেয়ে যায় নয়ন উন্মিলিত  সুচিত্রার মুখে।












*******************************************************************




জয়িতা ভট্টাচার্য 

কলকাতা নিবাসী সাহিত্যিক জয়িতা ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষক। অল্প বয়স থেকে লেখালিখি। প্রধানত মানবাধিকার বিষয়ক বুলেটিন ও খবরের কাগজে লিখতেন। প্রথম প্রেম কবিতা। এযাবৎ চারটি কবিতার বই,একটি গল্পের বই ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত। লিখেছেন অসংখ্য সংকলনে। এছাড়াও নিয়মিত  প্রবন্ধ, ও অনুবাদ কবিতা লেখেন বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত পত্রিকায়। পেয়েছেন সরকারি ও সাহিত্য গোষ্ঠীর নানা সম্মান।বইমেলায় প্রকাশিত জয়িতা ভট্টাচার্যের দুটি বই----  






গল্প * ঈপ্সিতা রায়

 



বাঁধন

ঈপ্সিতা রায় 


সকাল ৭টায় অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো অনিমেষের। আজ আর অ্যালার্ম বন্ধ করে আরো ১০ মিনিটের ন্যাপ নেওয়ার সময় নেই। মিনিস্ট্রি থেকে একজন অফিসার আসবেন অফিস ইন্সপেকশনে আর তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে অনিমেষের ওপর। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিল সে। অফিসের গাড়ি গেটে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যেই বড়োবাবু ২বার ফোন করে তাড়া দিয়েছেন। এয়ারপোর্ট যেতে বড়জোড় ১ ঘণ্টা লাগবে। ভদ্রলোকের ফ্লাইট ১০ টায় পৌঁছবে। এত আগে থেকে গিয়ে বসে থাকার কি আছে কে জানে, মনে মনে বিরক্ত হলো অনিমেষ। এই দাসত্বের অভ্যেসটা গেলো না আমাদের। সকালে ট্রাফিক ছিল না খুব একটা, এয়ারপোর্ট পৌঁছল ৮ টা নাগাদ। এখনও অনেকটা সময় বাকি। হেডফোন-টা কানে গুঁজে একটা গান চালিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে শুরু করলো। এভাবে ঘণ্টা খানেক কাটলো। বড্ড খিদে পাচ্ছে, সকালে তাড়াহুড়োতে খেয়ে বেরোতে পারেনি। মনে পড়লো ব্যাগে একটা বিস্কিট এর প্যাকেট রাখা আছে। বের করে একটা বিস্কিট মুখে পুরলো, হটাৎ মা-এর মুখ টা মনে পড়ে গেলো। ছোটবেলায় কখনও রাতে  ঘুম ভেঙে গেলে খুব খিদে পেয়ে যেত বলে মা বালিশের পাশে সব সময় বিস্কিটের প্যাকেট রেখে দিত। বাড়ি থেকে এত দূরে চাকরি করতে এসে শুরুতে খুব সমস্যা হতো, বাজার করা, রান্না করা, বাসন মাজা সংসারের এই সমস্ত কাজ করতে খুব বিরক্ত লাগতো, বাড়িতে মা কখনও কিছু করতে দেয়নি। দেখতে দেখতে ৩ বছর কেটে গেলো, এখন আর খুব একটা সমস্যা হয়না- কথায় আছে 'মানুষ অভ্যাসের দাস'। ঘড়ি দেখল অনিমেষ ১০ টা বাজতে ১০, আর কিছুক্ষণ এর ব্যাপার। ১০ টার কিছু পরেই ভদ্রলোক পৌঁছলেন, অনিমেষ এগিয়ে গেলো। গুড মর্নিং স্যার বলতেই ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। গাড়িতে উঠে অফিস যাওয়ার সময় অনেক গল্প করলেন, ভদ্রলোক বেশ ডাউন টু আর্থ। অফিসে পৌঁছতে ১১.৪০ বেজে গেল। অফিসে পৌঁছে অনিমেষের দায়িত্ব অনেকটা শেষ, বড়োবাবু ভদ্রলোককে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে চা জলখাবারের পর্ব শেষ হলে ইন্সপেকশন শুরু হবে। অনিমেষ সোজা ক্যান্টিনে চলে গেলো,একবার ইন্সপেকশন শুরু হলে আর সময় পাবেনা খাওয়ার। লাঞ্চ করে নিজের ঘরে এসে একটা ফাইল খুলে বসলো। ইন্সপেকশন শুরু হলো ১ টা নাগাদ। শেষ হতে ৬.৩০ টা বেজে গেলো। সব কিছু গুটিয়ে ঘরে ফিরতে ৯ টা। ফোন টা চার্জে বসাতে গিয়ে দেখলো মা-এর ৩ টে মিসড কল। সারাদিন কাজের মধ্যে মা কে কল করার কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। মা কে কল করলো, ওপাশ থেকে মা এর গলা - 'ঠিক আছিস বাবা ?এতবার ফোন করলাম ধরলি-নে! কাজের চাপ ছিল তাই ফোন দেখতে সময় পাইনি, আরো দু চার কথা বলার পর মা বললো- আজ দশমী, এই বার পুজোতেও ছুটি পেলিনে- মা কাঁদছে। এখানে আসার পর একবারও পুজোতে ছুটি পায়নি অনিমেষ। আজ-যে দশমী পুজো শেষ হয়ে গেছে সেটাই মাথায় ছিল না। কলেজের লাস্ট ইয়ায়ে বাবার হঠাৎ লাং-ক্যান্সার ধরা পড়ে - লাস্ট স্টেজ। তারপর ৯ মাস বেঁচে ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে অনিমেষের ওপর। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়াতে জমানো টাকা পয়সা বলে কিছু ছিল না। ৩ ভাই বোনের মধ্যে অনিমেষ বড়, ভাই ফার্স্ট ইয়ার আর বোন মাধ্যমিক দেবে। সারাদিন টিউশন পড়িয়ে রাতে কম্পিটিটিভ এর পড়াশুনা করতো। তখন মনে হতো একটা চাকরি-ই সব সমস্যার সমাধান, শুধু একটা চাকরি- যে কোনো চাকরি হোক, যেখানে পোস্টিং হোক চলে যাবো।   ৩ বছর আগে যখন চাকরিটা পেয়েছিল তখন মনে হয়েছিল জীবনে সবকিছু পেয়ে গেছে সে। চাকরিটা 'সব সমস্যার' সমাধান করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু 'অনেক সমস্যার' সমাধান করেছে । চাকরিটা জয়েন করার পরে এখন মনে হয় জীবনে আরো অনেক কিছু আছে যেগুলো বাকি থেকে গেল। হঠাৎ ফোনে টুং করে একটা নোটিফিকেশন এলো -  স্যালারী ক্রেডিটের মেসেজ; বোনের পরীক্ষার ফিস, ভাইয়ের সেকেন্ড ইয়ারের বই, মা এর ওষুধ আর সংসারের খরচা- 'অনেক সমস্যার' সমাধান। নাহ্ অনেক রাত হলো ঘুমোতে হবে কাল আবার অফিস। 

শত কষ্টের মাঝেও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা দায়িত্ব নিতে জানে - হাসিমুখে....











***************************************************************                                      



ঈপ্সিতা রায়

জন্ম ১৯৯৫, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়।  কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের স্নাতক। বর্তমানে রাজ্য সরকারের আধিকারিক। শৈশব থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক এবং তারই ফলশ্রুতিতে লেখালেখির শুরু। সাহিত্যের জগতে সদ্যাগতা।                            

গল্প * প্রদীপ কুমার দে

 



লক্ষ্মী অলক্ষ্মী 
প্রদীপ কুমার দে


নাম তার গনা। স্কুলে সে গনশা। ভাল নাম গনশা দাস। আমাদের কাছে সে গনা'ই। পড়াশুনায় তার মন নেই। পড়তে তার ভালই লাগে না। শিক্ষকেরা বোঝায়, মারে, শেষে বাড়িতে রিপোর্ট করে কিন্তু গনা তাতে কিছু ভাবে না। সে নিজেই নিজের অভিভাবক। বন্ধুরা ওকে বোঝালেও  ও কিন্তু  সব বুঝেও ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকত।
মাঝেমধ্যে রিএক্ট করে বলত,
--  তোরা নিজের চড়কায় তেল দিলে ভাল হয়।

সত্যিই বন্ধুরা কেমন যেন সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত  হয়ে পড়লেও দিনের পর দিন গনা সেই একই রকমই রয়ে গেল। কোন হোলদোল নেই যেন ওর।

গনার মুড ছিল অন্যখানে। সেটা পরে দেখেছে সকলে। প্রথমে কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে পড়তো। ছবি আঁকতো। সবাই মাঝে মাঝে ওর আঁকার প্রশংসা করতে বাধ্য হত। আসলে ও পড়াশোনা না করতে পারলেও ছবি আঁকতো বেশ যত্ন নিয়েই আর ভালবেসে।

একদিন স্কুলে দেখা গেল গনা নেই। ও কিন্তু স্কুলে এসেছিল । যা হোক স্কুলের বাইরে একটা ফাঁকা মাঠে ওকে পাওয়া গেল। ও ছবি আঁকছে আর সামনে একজন বয়স্ক মহিলা তার সম্ভবত নাতনীকে নিয়ে পোজ দিচ্ছে। 

গনার বয়স তখন চৌদ্দ বছর আর ছোট্ট মেয়েটির বয়স বড় জোর আট বছর হবে। গনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । সে এঁকে চলেছে তার তুলিরটান।
মেয়েটিকে দেখতে একেবারে মা লক্ষ্মী। আট বছরের এল মেয়ের হাসি আর আদল এত মিষ্টি যে  
সহজেই মনে নাড়া দেয় এক মায়ের মুখ।

গনা সেই আট বছর বয়সী মেয়েটির আদল এতোটাই সুন্দর করে তার চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল যে সেই ছবিটি এক জীবন্ত পটে ফুটে উঠেছিল। সবাই দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিল। 

কেউ কেউ বলেছিল,
" মেয়েটি সাক্ষাত মা লক্ষ্মী " 

আবার অনেকে বলেছিল,
" গনা ' র হাতের এলেম আছে "

সে যাই হোক সবচেয়ে বড় কথা হল স্থানীয় এক ধনীপুত্রের বাবা মহার্ঘ মূল্যে সেই ছবিটি কিনে নেয়।

দুটি লাভ হয়। এক গনার অর্থ আর সুনাম প্রাপ্তি ঘটে আর দুই মেয়েটির কপাল ফিরে যায়। আসলে ওই মেয়েটিকে ওই ধনী ব্যবসায়ী তার পুত্রবধূ করে নেওয়ার পথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।

এরপর গনা কর্মসূত্রে জাহাজ কোম্পানির কাজে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং সমুদ্রে পাড়ি দেয়। বহুবছর গনা ওই কাজে বাইরে ছিল। চুক্তির মেয়াদ শেষে বাড়ি ফেরে। ততক্ষণে গনার বয়স ষাটের ঘরে পৌঁছে গেছে। অবসর কালে গনার আবার পুরানো নেশা মনে আসে। আবার তুলি কাগজে নিজেকে জড়িয়ে  ফেলে।  দৃশ্য খুঁজে ছবি আঁকে। ভালো মন্দ বিষয় খোঁজে। খোঁজাখুঁজি তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে চলে নিরন্তর।

একদিন পুকুরপাড়ে এক ক্রন্দনরতা নারীকে দেখতে পায়। অসহায় কুৎসিত নারীটি পুকুর সংলগ্ন সিঁড়িতে সাদা থান পড়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে একটি হাত সিড়ির চাতালে রেখে অন্য হাতটি গালে দিয়ে কাঁদছিল। মহিলার মুখে কালো অভিসম্পাত।  দৃশ্যটি বড় করুণ। বিষন্নতার আর কষ্টের এক প্রেক্ষাপট। গনার মনে দাগ কাটে।  হাতের আঙুল গুলো নিশপিশ করে ওঠে, দূরে বসে কাগজে তুলি দিয়ে সেই ছবিটি এঁকে ফেলেন রঙের জাদু আর মনের মাধুরী মিশিয়ে। 

গনা বর্তমানে বেশকিছু ছবি এঁকেছিল। এ ছবিটি ছিল তাদের মধ্যে অনন্য কিন্তু এক বেদনার বার্তা বহন করছিল। 

অনেকে বলেছিল,
" মহিলাটি স্বামীহন্তা অলক্ষ্মী "

এও বলেছিল, 
" গনার আঁকার দোষ "

এক যুবক সেই ছবিটি কিনে নেয়। কিছুদিন বাদে খবর আসে ওই মহিলার আত্মঘাতী মৃত্যু সংবাদ।

এরপর সেই যুবকটি স্থানীয় স্কুলবাড়িতে এক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে গনাকে আমন্ত্রণ করে।  

গনা উপস্থিত হয় যথাসময়ে। অনেক শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল। গনা সব ছবি ঘুরেফিরে দেখছিল। দুটি পাশাপাশি ছবি দেখে গনা চমকে ওঠে, লেখা ছিল,
" অতীত আর বর্তমান "
শিল্পী - গনশা দাশ
বিষয় - লক্ষ্মী থেকে অলক্ষ্মী
একটি নারীর জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। 

গুঞ্জন ওঠে,:
গনার চোদ্দো বছর বয়সের সেই আঁকা আট বছরের সেই লক্ষ্মীমন্ত বালিকাই  আজ গনার ষাট বছর বয়সে আঁকা, এই চুয়ান্ন বছর বয়সের অভিশপ্ত বিধবারই রুপান্তর। সময়ের ব্যবধানে এক চরম পরিণতি। 

ততক্ষণে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে,
--  আমার দাদুর কেনা ছবি আর আমার কেনা ছবিটি আমার মায়েরই। শিল্পী তার নিখুঁত চিত্রাঙ্কনের মধ্যে দিয়ে অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধন করেছেন, উনি জানেন না উনি কি দারুণ মিলকরণ করে ফেলেছেন তার নিজের অজ্ঞাতেই। আমরা ওনার কাজের মূল্যায়ন করে আজ ওনাকে ......

গনা তখন হারিয়ে যাচ্ছে অতীতে, কোন কিছু তার কানে প্রবেশ করছে না, সময়কে ধরতেই, স্মৃতির পথ ধরে পিছনপানে চলেছে যে সে  ......


****************************************************************************************************************





                      প্রদীপ কুমার দে


প্রদীপ দে বা পুরোনাম প্রদীপ কুমার দে, নামে কি আসে যায়, কর্মেই জীবনের পরিচয় যদিও নাম একটা লাগে সারাজীবনের স্বাক্ষী হিসাবেই, জন্ম যেভাবেই হোক হিসাব মিলিয়ে দেওয়াই ছিল যার কর্মজীবনের অঙ্গীকার, যেখানে অন্যের হিসাব মিলাতে গিয়ে নিজের হিসাব অগুছালো হয়ে যায়, তাতেও জীবনযুদ্ধে খামতি আসে না, টগবগিয়ে ছুটে চলে তার মনের সাধ আর ইচ্ছেগুলো।

পিতা ছিলেন শিল্পী মানুষ স্বর্গীয় বনমালী দে আর মাতা তাঁরই সহযোগী স্বর্গীয়া মীরা দে।
মধ্যকলকাতার বইপাড়ায় যার জন্ম তার হাতে কলম উঠে আসবে এতে আর চিন্তার অবকাশ কোথায়? হাজারো প্রতিকূলতা কাটিয়ে অসম লড়াই চালিয়ে আজও কলমকে মনের মাধুরী মিশিয়ে জাগ্রত রাখার আপ্রান প্রয়াস যে জারি রেখেছি তার অকাট্য প্রমান আমার স্বরচিত আটটি গ্রন্থ প্রকাশের পর প্রাপ্ত আনন্দ।


গুচ্ছ কবিতা * রিজভী হাসনাত





রিজভী হাসনাত * কবিতাগুচ্ছ 


পূর্বাভাস 


স্যাটেলাইট  কত দুর্যোগের আগাম খবর জানিয়ে দেয়
কবে নাগাদ আঘাত হানবে
কতখানি গতিতে ল্যান্ডফল হবে ইত্যাদি ইত্যাদি 
অতচ তুমি যে আচমকা চলে যাবে
কথা বলা বন্ধ করে দিবে 
সোসাল মিডিয়াতে ব্লক করে দিবে
সে ব্যাপারে কিছুই বলে নি
বললে হয়ত
এতটা ভয়ানকভাবে লন্ডভন্ড হতাম না


অপেক্ষা 


মেঘ করেছে চোখের কোণে,
তোমার আশায় বীজ বুনে। 



শোন...!


একবার দেখে যাও এসে
কতখানি মলিন হয়েছে 
দেহ 
কতগুলো দাগ পড়েছে চোখের নিচে
একবার দেখে যাও এসে।
শুধু একবার।


নোটিফিকেশন!


কত নোটিফিকেশন আসে ফোনে
কত স্মৃতি, কত পোস্ট আর ছবি ফিরে আসে
হঠাৎ যদি তোমার ফিরে আসার একটা নোটিফিকেশন আসত৷! 






















এ তুমি কেমন তুমি! 


খুব সকালে
ঝাড়ুদার এসে রাস্তা পরিষ্কার করে 
এদিক সেদিক 
পড়ে থাকা ঝরা পাতাকে 
একসাথে জড়ো করে রাখে
অন্তরে ঠাঁই না দিলে
অন্তত জড়ো করে রাখতে পারতে
হঠাৎ বাতাসে যে উড়িয়ে দিলে
এ তুমি কেমন তুমি।




আকাঙ্খা 


বিল আর নদী পরস্পর মিলে যায়
ঘন বর্ষায়
তুমি আমি মিলতে পারিনা ক্যান?
বারবার বর্ষা আসতে পারে না আমাদের সম্পর্কে।





************************************************************************




রিজভী হাসনাত 


 পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সম্পন্ন করেছেন  স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সম্পাদনা করছেন আলোকছটা( নান্দনিক কবিতাপত্র)  নামে একটি কবিতার ছোট কাগজ। লিখে চলেছেন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বিভিন্ন ম্যাগাজিন,পত্রিকা এবং ছোট কাগজে। 



গুচ্ছ কবিতা * অর্ণব সামন্ত

 



কবিতাগুচ্ছ * অর্ণব সামন্ত


পূরবীর বুকে ভৈরবী 

সন্ধ্যের সেঁজুতি জ্বালার আগে যদি 

আচমকা কোনো সকালের মুখ হানা দেয় 

আয়না তখন মুখ দ্যাখে একা একা 

দ্যাখে গহীনে গহীনে তার কত গাঙ ও আগুন 

নীলাভ অন্ধকারে নক্ষত্রদের ছড়াছড়ি 

নক্ষত্রের ফুলজন্ম ঝরে পড়ে পথপ্রান্তে , মাটিতে 

দেরাজ থেকে টেনে বার করে সেই জাদুবাস্তবতা 

আগুন খুঁটিয়ে দ্যাখে আর ভাবে 

পরম সভ্যতা চরম অসভ্যতার সেই সব যৌবন দিনরাত্রিগুলি 

স্মৃতির বকুল হয়ে তারা বিলীন হয়েছে অন্য ছায়াপথে 

শুধু সৌরভ এখনও যেন নাকে লেগে আছে 

সুর মিয়া মল্লারে কাঁপাচ্ছে চারপাশ 

ও আকাক্ষা তুই হৃদয়ে আন উচ্ছ্বাস 

বাঁধভাঙা সে নিয়মে অন্য নিয়মের চাষবাস 

স্মৃতি যেন মোমবাতি আগুন দরজায় কড়া নাড়ে ভবিষ্যৎ আঙুল 

বর্তমান দ্বিধাগ্রস্ত তাকে নেবে না ফেরাবে একেবারে 

মণি নিবদ্ধ মণিকর্ণিকায় শ্মশানের চিতাগ্নি ছুঁয়ে জাগে 

পূরবীর বুকে জাগে ভৈরবী আরেক বার পেতে চায় জীবনের স্বাদ !



কর্কটক্রান্তি 

কর্কটক্রান্তির দুপুরে বৃশ্চিক দংশন করে 

আয় কবুতর আয় জড়ানো আদরে আদরে 

ভগ্নাংশ নিদ্রায় ভগ্নাংশ জাগরণে 

তন্দ্রাঘোরে তন্দ্রাহরণী দ্রাঘিমাংশকে দ্রাঘিমা করে

আয়ু পোড়ে আয়ু পোড়ে তবু উজ্জীবিত শিখা 

মধ্যদিনে মধ্যগগন স্পর্শ করে অবাধ্য অসহ্য দহনে 

চর্বচূষ্যলেহ্যপেয় কোষে কোষে ক্ষুধা মেটায় 

স্নায়ুতে স্নায়ুতে ঝঙ্কার ওঠে , বিদ্যুচ্চমকের ঝাঁকুনি 

স্বাতীনক্ষত্রের জল পড়ে গা'য় , জল যেতে চায় জলের গভীরে 

কিছুই অসম্ভব নয় আর সপ্তভুবন পদতলে মূর্চ্ছাপ্রবণ 

সমাধির থেকে উঠে আসে দুপুর একা একা 

তোর লাবণ্যের ঢেউয়ে ঢেউয়ে , তোর রূপের অরূপে 






            







দুপুরে , রাতের চাঁদ 

শঙ্খটি বাজায় দুপুরে , রাতের চাঁদকে পেয়ে

শঙ্খটি নম্রনত , শঙ্খটি সোচ্চার 

দুলে দুলে ওঠা ঢেউ সফেন জীবনের 

যাপন স্বর্ণ কুটুরিতে রাখে , ভ্রমর ফুলের বনে 

অকস্মাৎ হড়পা উজান আসে উজিয়ে সুর 

সুর ভাঙে তাল ভাঙে কথা ভাঙে 

তবু সেই ভাঙনের অভূতপূর্ব নির্মাণ রাখো 

মন্থনে মন্থনে গরল অমৃত ফোয়ারা

লক্ষ্মী বাহু টেনে নেয় অলক্ষ্মীর ঝাঁপিতে 

ভূমিকম্প অগ্ন্যুৎপাত লাভা উদ্গীরণ 

স্বর্গসুখ স্বর্গসুখ নরক গুলজার 

আর কত জন্ম পরে একান্ত আমার 

শঙ্খ বাদ্যে যুদ্ধ শুরু ক্ষেত্রে ধর্ম কর্ম 

দমকা হাওয়ায় হারজিৎ সমান সমান 

হত হওয়া কালগুলি সম্মুখে তোমার 

চেখে দ্যাখো চর্বচূষ্যলেহ্যপেয় সম্ভার 

স্নায়ুমেদমজ্জায় লেখো আলো আলো আলো 

শঙ্খটি বাজায় পূরবী কি শান্তি কি শান্তি 

সুধার ভাঙা বাক্যে ভাঙা গানে ভাঙা কবিতায় 

লেখো লেখো লেখো তাকে রাখো হৃদিমধ্যে 

কখন হয়েছে সমুদ্র ভাসান ডিঙি মাঝি জানে না 

তুলে রাখো দেরাজে সুখ , গতজন্ম , পরজন্ম 

ভ্রমর ও হলুদ ফুলের দিনরাত্রি মহাকাব্য রচুক ... !



তিশানের নারী 

তিশানের নারীর মতন বিকেল আসে 

বাস্তুভিটের ঝাউবনে , প্রান্তরের সবুজ ঘাসে 

বায়বীয় নারী হয়ে ইছামতী উড়াল দিলেই

ভাঙা চালে ভাঙা ঘরে এসে হাজির কিশোরীজোছনা 

রোদ্দুরের ক্রোধ বাড়ে স্রোতস্বিনী প্রশমিত করে 

ফল্গুস্রোতে চুবিয়ে রাখে বেদম ভালোবাসা

অলৌকিক জলযানে চলে যায় জলের গহীনগভীরে 

নিমজ্জনে নিমজ্জনে ডুবুরি তুলে আনে অমল ভাসান

আশ্লেষ আবেশের দ্বিপদের তরকারি দিয়ে 

শিউলি সাদা ভাত বাড়ে নারীমাতৃক সভ্যতা তীরে 

সমুদ্র শুকিয়েছে তার তবু জীবন্ত ভিসুভিয়াস 

মগ্নমুগ্ধ করে রাখে লাভার মতন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জড়িয়ে 

বহমান জীবনে লাবণ্য ফুরালেও আগুন থাকাটা জরুরী 

সেই টেনে নেয় মাধ্যাকর্ষণে , সেই দেয় মুক্তিবেগের ডানা 

সেজানের সাত স্তর খুঁড়ে খুঁড়ে রেমব্রান্টের আলো 

কথ্য সর্বনামে ডাকে হৃদয়ের ঈশ্বরী দরজা খুলে 

ব্যালকনিতে জ্যোৎস্না নামে আড়ি নয় ভাব করতে এসে 

দেরাজে রেখেছে সুখ পরজন্মের জাতককে নিয়ে 

রামধনু কেশে তার সৃজনের বৃষ্টি বিন্দু বিন্দু লেগে 

তখনি জেনেছে সর্বনাশের পরবর্তী সর্বপ্রাপ্তির অমৃতযোগ 



  **************************************************************************************    


 অর্ণব সামন্ত 

ইংরাজী ভাষার ছাত্র। ইংরাজীতে এম. এ ; বি . এড ।উনিশশো তিয়াত্তর সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসন্তীতে জন্মালেও স্কুল জীবনের পর থেকে শহরতলীতে আবাস । শিক্ষকতা পেশা , নেশা কবিতা লেখা । এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ , ৪টি - গোলাপ এবং , ঝরা সময়ের উপকথা , পারমিতা , বামাক্ষী । পেশাগত সময় বাদে গান শোনা , বইপড়া , ফোটোগ্রাফি , কবিতা লেখাকেই জীবন যাপনের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন।                                                   

গুচ্ছ কবিতা * মনোজ বাগ




কবিতাগুচ্ছ * মনোজ বাগ

 

সাদা রঙের সত্য 

অজস্র রাস্তা একে অন্যতে মিশে আছে ।

অজস্র রাস্তা একে অন্যকে ছাড়িয়ে মিলিয়ে গেছে দূর দূরান্তে ..

প্রতিটি রাস্তা জুড়েই আছে প্রকৃতি , মানুষ ।

বিবিক্ততায় , বৈচিত্র্যে মানুষও প্রকৃতির চেয়ে কম কিছু নয় ।

জানি , 

সব জেনেও সবুজ সবুজ রঙগুলিকেই আমরা তারুণ্যের 

প্রতীক রূপেই জানি ।

আর তরুন তরুন প্রাণগুলিকে তুলনা করি যা কিছু সজীব 

সবুজ তাদের সঙ্গে ।


ধূসর বর্ণদের , তোবড়ানো , কোঁকড়ানো , দোমড়ানো , 

মোচড়ানোদের ,

খসে খসে পড়া নোনা লাগা দেওয়ালের পলেস্তরাদের ,

আমরা জানি বিগত সময়ের প্রতিচ্ছবি রূপে ।


কুঁড়িগুলিকে শৈশবের উপমায় ধরি যত্রতত্র , 

উদ্ভিন্ন কিশলয়গুলিকে ,

দীর্ঘ রাস্তাগুলিকে , আমরা দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ জীবনের 

রূপকে দেখি

খর্বাকৃতি রাস্তাগুলির প্রসঙ্গ এনে আমরা ছোট ছোট গন্তব্য বা 

স্বল্পায়ু জীবনের ধারণা দিই । 


যদিও সবাই আছি সেই সবটা নিয়েই যার পর আর কিছু নেই !

এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সবটাই আমাদের সবার , 

এর সবটাই সবার ।


যে অখন্ডের গোটাটাই আমার ।

সেই অখন্ডের গোটাটাই তোমারও ।

একটা গোটা ব্রহ্মান্ড আমার যতটা 

ঠিক ততটাই তোমারও । 

এর কোন ভাগাভাগি হয় না । 

তাই ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্নই এখানে নেই ।


যাঁরা এ সত্যটি জানেন,  

সমস্ত রকমের অধিকার বোধ থেকে 

নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তাঁরা মনে-প্রাণে মহাপ্রকৃতির সঙ্গে 

একাত্ম থাকার অভ্যাস করেন নিরন্তর ধ্যান সাধনায় ।


ধ্যান একাত্ম হবার উপায় ।

সাধনা যা পরম ভাবে সত্য , সদা সর্বদা তার সঙ্গে একাত্ম 

থাকার অভ্যাস --

যারা এই সহজ সত্যটি জানেন না 

তারা একে অন্যেরটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে ,  মারামারি 

করেই জীবন অতিবাহিত করেন ,

যত দিন তারা বাঁচেন ।



মায়েদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে


সে সব দিনও ছিল যখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন 

মা-রা ।

আর অনিবার্য যা যা ঘটার সবই ঘটে যেত তাঁদের চোখের 

সামনেই ।

মা-রা চুপ থাকতেন ।

মা-রা চোখ বন্ধ রেখে থাকতেন বশংবদ । 

পালকের মতো হালকা মা-রা তখন সামান্য সামান্য ফুঁয়েই 

ঝড়ের এঁটো পাতার মতো গিয়ে পড়তেন এর ওর বাকুলে , 

দাওয়ায় । 


অপারকের মতো , পঙ্গু-অথর্বের মতো মা-রা 

বোবা সেজে থাকতেন মুখ বন্ধ রেখে ।

কালা সাজতেন কিছুই না শোনার ভান করে । 

মা-রা তখন দুহাত ভর্তি করে চুড়ি পড়ে সখী সখী ভাবে 

মনোরঞ্জন করতেন আসমুদ্রহিমাচলের ।


সে সব দিন আজ বিগত ।


এখন মা-রা ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন ।

পাড়া পড়শির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালিশি করেন এর ওর কৃতকর্মের । 

জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ে বচসা জোড়েন ।

দরবার বসান নিজের ঘরের দোরগোড়াতেই ।


নতুন মা-রা যখন এ সব করেন, 

পুরোনা দিনের মা-রা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখে উৎফুল্লিত হন ।

এমনটাও হয় !


রাত থাকতেই উঠে এখনও সব মায়েরাই দেখেন 

ঝুজকো বেলার আলো ঠিক কতটা ফুটবো ফুটবো করছে ।

দেখেন , ঘুমে অচেতন আলুথালু তাদের নালায়েক সব 

আত্মজ আত্মজারা জেগে ওঠা থেকে আরো কতটা দূরে ...



বায়স

হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরছে তৃষ্ণার্ত বায়স ।

জলসত্র চায় ।


বিশ্বময় এত যে ফুটো কলসীর ছড়াছড়ি -

আনাচে কানাচে এত যে ভাঙা তোবড়ানো জাগ জালা হাড়িখুড়ি ,

গড়াগড়ি যাওয়া যত্রতত্র এত যে অজস্র নুড়ি পাথর ...


নিজস্ব দুটি ডানায় ভেসে থেকে 

বহু দূর দূর দৃষ্টি মেলে 

তৃষ্ণার্ত বায়স তবুও খুঁজে ফিরছে জলসত্র ।


একটি দুটি কানা কড়ি হাতের তালুবন্দী রেখে কেউ কেউ এই 

দৃশ্যই সাগ্রহে দেখছি ।


ধরা আছি 

বস্তুত একটি ফ্রেমেই ধরা আছি -

মিলে মিশে আছি একটি পটেই ।


পায়ের তলার মাটি লালে লাল , সবুজে সবুজ 

কোথাও ধূসর ...


দুধের সরের মতো স্তরে স্তরে জমা টেকনোটিক প্লেট ।

উপরিভাগটা ভাগ হয়ে আছে ভূখন্ডে , স্থলে-জলে ।

নিচে গনগনাচ্ছে ফুটন্ত লাভা ।

সবটাই রাখা আছে বিরাট যে শূন্যে -

বহুদূর থেকে দেখলে এর কিছুই চোখে পড়ে না ।


খুব কাছে এসে খুঁটিয়ে দেখলেও 

দেখা হয় না ,

বোঝাও যায় না , সবটা...


শিশা

দর্পনে ফুটে আছে মুখ ...

ঝুঁকে পড়ে দেখছি , 

দেখছি ও মুখ আমারই ।


এ দেখলে , এর ।

ও দেখলে , ওর ।

যেই এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ছে ঐ দর্পনে -

সেই দেখছে ঐ মুখ আসলে তারই ।


যখন কেউই গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে না ঐ দর্পনে ,

তখন ফুটেও উঠছে না কারো মুখই । 


তখন কাজল দীঘির কাজল কালো জলের মতো থমথমে 

একটা অন্ধকার 

ভর করে আছে নিছকই জড় ঐ এক টুকরো শিশায় ।




*********************************************************************************************



মনোজ বাগ

পেশায় ব্যবসাজীবী । কবিতা বেঁচে থাকার রসদ ; অনিবার্য এক ইন্ধনও । প্রিয় কবিতার গ্রন্থ : গীতা , ঈশোপনিষদ , গীতবিতান , আমিই মাটি , আমিই আকাশ (সুজিত সরকার) । কবিতা প্রিয় বিষয় হলেও সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই টানে । সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতিও প্রবল আকর্ষণ আছে । ভালো লাগে ভাবতে : আপাত যা কিছু -- এই সবই এক পরম সত্যেরই প্রকাশ ।