সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

গল্প * প্রদীপ কুমার দে

 



লক্ষ্মী অলক্ষ্মী 
প্রদীপ কুমার দে


নাম তার গনা। স্কুলে সে গনশা। ভাল নাম গনশা দাস। আমাদের কাছে সে গনা'ই। পড়াশুনায় তার মন নেই। পড়তে তার ভালই লাগে না। শিক্ষকেরা বোঝায়, মারে, শেষে বাড়িতে রিপোর্ট করে কিন্তু গনা তাতে কিছু ভাবে না। সে নিজেই নিজের অভিভাবক। বন্ধুরা ওকে বোঝালেও  ও কিন্তু  সব বুঝেও ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকত।
মাঝেমধ্যে রিএক্ট করে বলত,
--  তোরা নিজের চড়কায় তেল দিলে ভাল হয়।

সত্যিই বন্ধুরা কেমন যেন সবাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত  হয়ে পড়লেও দিনের পর দিন গনা সেই একই রকমই রয়ে গেল। কোন হোলদোল নেই যেন ওর।

গনার মুড ছিল অন্যখানে। সেটা পরে দেখেছে সকলে। প্রথমে কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে পড়তো। ছবি আঁকতো। সবাই মাঝে মাঝে ওর আঁকার প্রশংসা করতে বাধ্য হত। আসলে ও পড়াশোনা না করতে পারলেও ছবি আঁকতো বেশ যত্ন নিয়েই আর ভালবেসে।

একদিন স্কুলে দেখা গেল গনা নেই। ও কিন্তু স্কুলে এসেছিল । যা হোক স্কুলের বাইরে একটা ফাঁকা মাঠে ওকে পাওয়া গেল। ও ছবি আঁকছে আর সামনে একজন বয়স্ক মহিলা তার সম্ভবত নাতনীকে নিয়ে পোজ দিচ্ছে। 

গনার বয়স তখন চৌদ্দ বছর আর ছোট্ট মেয়েটির বয়স বড় জোর আট বছর হবে। গনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । সে এঁকে চলেছে তার তুলিরটান।
মেয়েটিকে দেখতে একেবারে মা লক্ষ্মী। আট বছরের এল মেয়ের হাসি আর আদল এত মিষ্টি যে  
সহজেই মনে নাড়া দেয় এক মায়ের মুখ।

গনা সেই আট বছর বয়সী মেয়েটির আদল এতোটাই সুন্দর করে তার চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল যে সেই ছবিটি এক জীবন্ত পটে ফুটে উঠেছিল। সবাই দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিল। 

কেউ কেউ বলেছিল,
" মেয়েটি সাক্ষাত মা লক্ষ্মী " 

আবার অনেকে বলেছিল,
" গনা ' র হাতের এলেম আছে "

সে যাই হোক সবচেয়ে বড় কথা হল স্থানীয় এক ধনীপুত্রের বাবা মহার্ঘ মূল্যে সেই ছবিটি কিনে নেয়।

দুটি লাভ হয়। এক গনার অর্থ আর সুনাম প্রাপ্তি ঘটে আর দুই মেয়েটির কপাল ফিরে যায়। আসলে ওই মেয়েটিকে ওই ধনী ব্যবসায়ী তার পুত্রবধূ করে নেওয়ার পথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।

এরপর গনা কর্মসূত্রে জাহাজ কোম্পানির কাজে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং সমুদ্রে পাড়ি দেয়। বহুবছর গনা ওই কাজে বাইরে ছিল। চুক্তির মেয়াদ শেষে বাড়ি ফেরে। ততক্ষণে গনার বয়স ষাটের ঘরে পৌঁছে গেছে। অবসর কালে গনার আবার পুরানো নেশা মনে আসে। আবার তুলি কাগজে নিজেকে জড়িয়ে  ফেলে।  দৃশ্য খুঁজে ছবি আঁকে। ভালো মন্দ বিষয় খোঁজে। খোঁজাখুঁজি তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে চলে নিরন্তর।

একদিন পুকুরপাড়ে এক ক্রন্দনরতা নারীকে দেখতে পায়। অসহায় কুৎসিত নারীটি পুকুর সংলগ্ন সিঁড়িতে সাদা থান পড়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে একটি হাত সিড়ির চাতালে রেখে অন্য হাতটি গালে দিয়ে কাঁদছিল। মহিলার মুখে কালো অভিসম্পাত।  দৃশ্যটি বড় করুণ। বিষন্নতার আর কষ্টের এক প্রেক্ষাপট। গনার মনে দাগ কাটে।  হাতের আঙুল গুলো নিশপিশ করে ওঠে, দূরে বসে কাগজে তুলি দিয়ে সেই ছবিটি এঁকে ফেলেন রঙের জাদু আর মনের মাধুরী মিশিয়ে। 

গনা বর্তমানে বেশকিছু ছবি এঁকেছিল। এ ছবিটি ছিল তাদের মধ্যে অনন্য কিন্তু এক বেদনার বার্তা বহন করছিল। 

অনেকে বলেছিল,
" মহিলাটি স্বামীহন্তা অলক্ষ্মী "

এও বলেছিল, 
" গনার আঁকার দোষ "

এক যুবক সেই ছবিটি কিনে নেয়। কিছুদিন বাদে খবর আসে ওই মহিলার আত্মঘাতী মৃত্যু সংবাদ।

এরপর সেই যুবকটি স্থানীয় স্কুলবাড়িতে এক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে গনাকে আমন্ত্রণ করে।  

গনা উপস্থিত হয় যথাসময়ে। অনেক শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছিল। গনা সব ছবি ঘুরেফিরে দেখছিল। দুটি পাশাপাশি ছবি দেখে গনা চমকে ওঠে, লেখা ছিল,
" অতীত আর বর্তমান "
শিল্পী - গনশা দাশ
বিষয় - লক্ষ্মী থেকে অলক্ষ্মী
একটি নারীর জীবনের সামগ্রিক মূল্যায়ন। 

গুঞ্জন ওঠে,:
গনার চোদ্দো বছর বয়সের সেই আঁকা আট বছরের সেই লক্ষ্মীমন্ত বালিকাই  আজ গনার ষাট বছর বয়সে আঁকা, এই চুয়ান্ন বছর বয়সের অভিশপ্ত বিধবারই রুপান্তর। সময়ের ব্যবধানে এক চরম পরিণতি। 

ততক্ষণে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে,
--  আমার দাদুর কেনা ছবি আর আমার কেনা ছবিটি আমার মায়েরই। শিল্পী তার নিখুঁত চিত্রাঙ্কনের মধ্যে দিয়ে অতীত আর বর্তমানের সেতুবন্ধন করেছেন, উনি জানেন না উনি কি দারুণ মিলকরণ করে ফেলেছেন তার নিজের অজ্ঞাতেই। আমরা ওনার কাজের মূল্যায়ন করে আজ ওনাকে ......

গনা তখন হারিয়ে যাচ্ছে অতীতে, কোন কিছু তার কানে প্রবেশ করছে না, সময়কে ধরতেই, স্মৃতির পথ ধরে পিছনপানে চলেছে যে সে  ......


****************************************************************************************************************





                      প্রদীপ কুমার দে


প্রদীপ দে বা পুরোনাম প্রদীপ কুমার দে, নামে কি আসে যায়, কর্মেই জীবনের পরিচয় যদিও নাম একটা লাগে সারাজীবনের স্বাক্ষী হিসাবেই, জন্ম যেভাবেই হোক হিসাব মিলিয়ে দেওয়াই ছিল যার কর্মজীবনের অঙ্গীকার, যেখানে অন্যের হিসাব মিলাতে গিয়ে নিজের হিসাব অগুছালো হয়ে যায়, তাতেও জীবনযুদ্ধে খামতি আসে না, টগবগিয়ে ছুটে চলে তার মনের সাধ আর ইচ্ছেগুলো।

পিতা ছিলেন শিল্পী মানুষ স্বর্গীয় বনমালী দে আর মাতা তাঁরই সহযোগী স্বর্গীয়া মীরা দে।
মধ্যকলকাতার বইপাড়ায় যার জন্ম তার হাতে কলম উঠে আসবে এতে আর চিন্তার অবকাশ কোথায়? হাজারো প্রতিকূলতা কাটিয়ে অসম লড়াই চালিয়ে আজও কলমকে মনের মাধুরী মিশিয়ে জাগ্রত রাখার আপ্রান প্রয়াস যে জারি রেখেছি তার অকাট্য প্রমান আমার স্বরচিত আটটি গ্রন্থ প্রকাশের পর প্রাপ্ত আনন্দ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন