সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




 

[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * দশ


বিশ্বনাথ পাল


পনেরো

একদিন মৌমিতাকে বললাম, আমি দুটো ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছি।

বলল, ক্লার্কের?

আমি কোনও উত্তর দিলাম না। জানলার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। বড়লোকদের এই এক সমস্যা। গরিব মানুষকে ছোট নজরে দেখা। আরশোলা, টিকটিকি মনে করা। আমার বাবার টাকা ছিল না, বন্ধ কারখানার শ্রমিক হিসেবে তার বহু বছর কেটেছে জীবনের। ঠাকুর বানানো ছিল বলে কোনওদিন না খেয়ে থাকতে হয়নি। গরিব বাবার ছেলে হয়ে ক্লার্কের চাকরির ইন্টারভিউ ছাড়া আর কীসের ডাক পাব আমি? অফিসার হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। যদিও দুটো ইন্টারভিউয়ের একটা ক্লার্কের হলেও আরেকটা অফিসারের ছিল। নন গেজেটেড গ্রুপ বি অফিসারের। পিএসসি মিসসেলেনিয়াসের লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল। একদিন দুপুরে সাইবার কাফেতে গিয়ে পিএসসি ওয়েবসাইট খুলেছিলাম। তালিকায় নিজের নামটা দেখে যে কী আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি। বাড়িতে মা ও দিদিকে বলেছি। আর এখন মৌমিতাকে বললাম। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্টারভিউ। প্রায় আড়াই মাস সময় হাতে আছে। হাইকোর্টের ইন্টারভিউ ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ। বাবা মারা গেছে সেপ্টেম্বরে। তার আড়াই মাসের মধ্যেই দুটো চাকরির ইন্টারভিঊয়ের খবর পাই।

বাবা মারা যাওয়ার সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন মৌমিতা ফোন করেছিল। ও সাধারণত আমাকে ফোন করে না। সেদিন কেন করেছিল আজও জানা হয়নি। বাবার মৃত্যুর  খবর শুনে বলল, আচ্ছা রাখছি, কাজ মিটে গেলে আসিস।

আজ এসেছি। সোফায় বসেছি।কাকিমা কাচের সেন্টার টেবিলে চা-বিস্কুট দিয়ে গেছেন। বাবার অসুস্থতা নিয়েও খোঁজখবর নিলেন। আমার উল্টো দিকে মোউমিতা বসে। হাল্কা গল্পের মাঝে আমার চাকরি সংক্রান্ত খবরের যে প্রতিক্রিয়া পেলাম তাতে আর বেশিক্ষণ বসে থাকার ইচ্ছে হল না। কেমন যেন তেতো হয়ে গেল মনটা। বড়লোকদের মধ্যে আন্তরিকতার বড় অভাব। তারা টাকাকেই অন্তর দিয়ে ভালবাসে।

ইউনিভার্সিটিতে একবার সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিতর্কের বিষয় ছিল—মানি ইজ দ্য মোস্ট ইমপর্ট্যান্ট থিং ইন লাইফ। মৌমিতা নাম দিয়েছিল। বিষয়ের পক্ষে বলে বেশ ছড়িয়েছিল মনে পড়ে গেল। ওর যুক্তি ধোপে টেকেনি। শ্রোতারা হেসেছিল। বিপক্ষের বক্তা অনির্বাণ বলেছিল, টাকা যদি জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিস হোত, তবে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা এত বাড়ত না। মানুষ টাকার অভাবে সংসার করত না, বংশবিস্তার করত না। যুক্তিতে মৌমিতা হারলেও বেশ বোঝা গিয়েছিল টাকাকে ও বেশ বড় করে দেখে। অথচ এই মৌমিতারই একটি কথায় আমার ওকে বস্তুবাদী মনে হয়নি, মুগ্ধতার জন্ম হয়েছিল। আমাকে বলেছিল, দ্যাখ, তুই একটা বিশাল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে গেলি এটা তোকে ঠিক মানাবে না। মোটামুটি কম টাকাপয়সা থাকবে, যাতে লোকের কাছে হাত পাততে না হয়। যাইহোক, স্ববিরোধই মানুষের চরিত্রধর্ম। কারও কম থাকে, কারও বেশি—কিন্তু থাকে।

আজ এত বছর বাদে নিজেকেও লেন্সের নীচে ফেলে দেখি। মানুষ বিশুদ্ধ ভাববাদী বা বিশুদ্ধ বস্তুবাদী হয় না। দুইয়ের মিশেল হয়। তবে যার মধ্যে যে ভাগ বেশি থাকে তাকে সেই ভাগেই দাগিয়ে দেওয়া হয়।

আর দু-একটা আলগা কথাবার্তার পর চা দ্রুত শেষ করে বললাম, আজ উঠি।

মৌমিতা বলল, এত তাড়াতাড়ি! এই তো এলি?

না, একটা কাজ মনে পড়ে গেল।

আমার সঙ্গে মৌমিতা নীচে নেমে এল। বোধহয় দরজা বন্ধ করতে, আমাকে এগিয়ে দিতে নয়। তবে এর আগে বার কয়েক এগিয়ে দিয়েছেও। উঠোনের বাঁধানো পথ পেরিয়ে গ্রিলের গেট পর্যন্ত, আর আমি মনে মনে আপ্লুত হয়েছি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি ভেবে।

মৌমিতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে গেলাম দীপাঞ্জনদার বাড়ি। খবর পেয়েছিলাম আগেই যে দীপুদা ফিরেছে। দীপুদাকে দিলাম, আমার ইন্টারভিউ প্রাপ্তির খবর।

দীপুদা বলল, সত্য, মিসসেলেনিয়াসের ইন্টারভিউয়ের আরও আড়াই মাস আছে। এই আড়াই মাস তুই জানপ্রাণ লড়িয়ে পরিশ্রম কর। আর তোর পক্ষে যা করা সম্ভব কর।

বললাম, মানে? কী বলতে চাইছ?

আমি বলতে চাইছি কোনও কোচিং সেন্টারে এই আড়াই মাসের জন্য ভর্তি হয়ে যা। সেখানে তোকে ইন্টারভিউয়ের জন্য তৈরি করে দেবে। ওরা মক ইন্টারভিউ নেবে। আর শুধু ইন্টারভিউয়ের জন্য খুব বেশি টাকাও হয়তো লাগবে না। তুই শিগগির গিয়ে কথা বল। টাকাটা যদি তোর পক্ষে অ্যাফোর্ডাবল হয়, তবে ভর্তি হয়ে যা। পরে যেন আফশোস করতে না হয়। মনে রাখবি ইন্টারভিউ কিন্তু তোর জ্ঞানের পরীক্ষা শুধু নয়, তোর পার্সোনালিটির পরীক্ষা, তোর অ্যাটিটিউডের পরীক্ষা। তুই জানিস এটা ওরা জানে, না হলে লেখা পরীক্ষায় পাশ করতিস না।

রাইসে মনে হয় অনেক টাকা নেবে। হালদারে গিয়ে খোঁজ নেব?

হ্যাঁ যা, দেরি করিস না। কারণ ইন্টারভিউয়ে যারা ডাক পেয়েছে অনেকই কিন্তু কোচিং নেবে, বা অলরেডি নেয়। দেরি করলে সিট ফিল্ড উপ হয়ে যেতে পারে।

দীপুসদার মুখে অ্যাটিটিউডের কথা শুনে আমার সুদীপের একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমি ডবলু বিসি এস দিচ্ছি শুনে সুদপ নাকি বাবাইকে বলে ছিল ওর হবে না। ওর অ্যাটিটিউডে প্রবলেম আছে। যদি মিসসেলেনিয়াস ক্লিয়ার করতে পারি, তবে কি আমার অ্যাটিটিউডের সমস্যা দূর হয়েছে বলা যাবে? সুদীপকে মিথ্যে প্রমাণ করা যাবে? যদিও এটা বিসিএস নয়। গ্রুপ বি অফিসারের চাকরি। তাও? কী জানি।

পরদিন ছুটলাম জেমস হিকি সরণি বা ডেকার্স লেন। হালদার কলেজ অব ফারদার এডুকেশন নামে কোচিং সেন্টারে। এটা সেই কোচিং যেখানে এমএসসি পার্ট ওয়ান দেব কি দেব না দোলাচল নিয়ে ডবলু বি সিএসের কোচিঙের খোঁজ নিটে এসেছিলাম একবার।

একটা ঘরে টেবিলের ওপারে বসে থাকা রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বললাম। আর জানতে জাইলাম কোর্স ফি ক্ত।

ভদ্রমহিলা বললেন, কোর্স ফি এক হাজার টাকা। পুরো টাকাটাই ভর্তির সময় পেমেন্ট করতে হবে। সপ্তাহে একটা করে ক্লাস। দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি লাগবে। বলে ভদ্রমহিলা আমার দিকে ফর্মটা এগিয়ে দিলেন।

ছবি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি আর টাকাটাও আমার পক্ষে মেটানো সম্ভব। তাই সঙ্গে সঙ্গে ফর্ম পূরণ করে এক হাজার টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। ফর্মের নীচে দেখি একটি ঘোষণা যে আমি অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিইনি এবং আমি চাকরি পেলে আমার ছবি এই সংস্থার বিজ্ঞাপনের প্রচারে ব্যাবহার করা হতে পারে। ঘোষণার নীচে আমাকে সই করতে হল।


ষোলো

হাইকোর্টে লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের একটি ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। বাড়িতে চিঠি এসেছে। সামনের মঙ্গলবার ইন্টারভিউ। মাস ছয়েক আগে পরীক্ষা হয়েছিল। পরীক্ষাটা দিতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ফর্মও পূরণ করেছিলাম এক বন্ধুর সৌজন্যে। ইউনিভার্সিটির বন্ধু অতনুর সঙ্গে এমএসসি পাশ করে বেরনোর পরেও যোগাযোগ ছিল। ও আমাকে বেশ পছন্দ করত। ওর মা হাইকোর্টে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে হাইকোর্টে কখন লোক নেওয়া হবে তার খবরাখবর অতনু ভাল জানত। বিজ্ঞাপনটা কোনও এক দৈনিকে বেরিয়েছে, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। অতনুই আমার নজরে আনে এবং ও নিজের আবেদনের ফর্ম পূরণ করার পাশাপাশি আমাকেও একরকম বাধ্যই করে ফর্ম পূরণ করতে। আমার লক্ষ্যের মধ্যে হাইকোর্ট ছিল না। কিন্তু ও বলল, হাইকোর্টের চাকরি খুব ভাল চাকরি, প্রচুর ছুটি। ও আরও বলল, পরীক্ষাটা কিন্তু এক-দেড় বছর পরে হবে। পরীক্ষার মাস খানেক আগে বাড়ির ঠিকানায় অ্যাডমিট কার্ড যাবে।

অতনুকে অবশ্য এই পরীক্ষায় বসার জন্য এক-দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই স্কুল সার্ভিসের মাধ্যমে ও স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে।

তো, অতনুর কথার সত্যতা প্রমাণ করে আবেদন করার এক-দেড় বছর পরে এবং পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে অ্যাডমিট কার্ড এল বাড়িতে। কিন্তু হাইকোর্টের  জন্য আলাদা করে তো পড়াশোনা করিনি। পড়েছি যা তা মূলত পিএসসি-র কথা মাথায়  রেখে। হাইকোর্টের পরীক্ষা তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের। তিনটি পেপার—অঙ্ক, সাধারণ জ্ঞান ও ইংরেজি, প্রতিটি একশো নম্বরের। তিনটি বিষয়ের খাতা ও প্রশ্নপত্র একই সঙ্গে হলে দিয়ে দেওয়া হবে এবং তিন ঘণ্টা পরে কালেক্ট করা হবে। এটা প্রিলিমিনারি নয়, মেইন। পাশ করলে ইন্টারভিউ।  

ফলে মনে হল তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের পরীক্ষা দেওয়া কি মুখের কথা? তা-ও আবার কোনও প্রস্তুতি ছাড়া। ঠিক করলাম যাব না পরীক্ষা দিতে। বাড়িতে সিদ্ধান্তের কথা জানাতেই মা আবার জানাল দিদিকে। দিদির পাড়াতেই বিয়ে হয়েছে।

দিদি এসে বলল, না, পরীক্ষাটা তুই দিবি। পরীক্ষা দিবি না কেন! তোর তো পিএসসি-র পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়াই আছে। এই পড়াতেই দেখবি তোর পরীক্ষা ভাল হবে।

আমার দিদি বেশ আশাবাদী। দিদি নিজের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে এখন কষ্ট করছে। বিয়েটা কালীঘাটে হয়েছে। বিমলদা মাতাল। সংসারে কোনও কিছুরই খবর রাখে না বললে চলে। কালীঘাটে বিয়ে হয়ে এক হিসেবে ভালই হয়েছে, টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে দেওয়া বাবার পক্ষে সম্ভব হত না। আমি একটা চাকরি পেলে আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক মর্যাদা বাড়বে। 

দিদির মতামতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু কাজে দিল না। দিদি বলল, দেখিস, তোর এই পরীক্ষাতেই হয়তো চাকরি হয়ে যাবে।

মূলত দিদির জোরাজুরিতেই সিদ্ধান্ত বদলালাম। যাব পরীক্ষা দিতে। যা থাকে কপালে। হারানোর তো কিছু নেই।

সিট পড়েছিল মৌলানা আজাদ কলেজে। পরীক্ষার দিন রবিবার, অর্থাৎ সকালে মেট্রো চলবে না। পরীক্ষার দিন ভোরবেলা থেকেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। বর্ষাকাল। বৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কাঁধে ব্যাগ, মাথায় ছাতা ও বৃষ্টি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম। মা ভেবেছিল হয়তো বৃষ্টির অজুহাতে যাব না পরীক্ষা দিতে। বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রায় হাঁটুজল। যাইহোক একটা রিক্সা পেলাম। বাঁশদ্রোণী থেকে বাসও পেলাম। প্রথমে এসপ্লানেড, তারপর সেখান থেকে বাস বদল করে গেলাম ওয়েলিংটন মোড়ে। দু-এক জনকে জিজ্ঞেস করে কলেজ খুঁজে পেতে সমস্যা হল না। দশটা থেকে পরীক্ষা, আমি ন’টা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছি। পৌনে দশটা নাগাদ জানা গেল বৃষ্টির জন্য পরীক্ষা দু’ঘন্টা পরে শুরু হবে, অর্থাৎ দশটার বদলে বারোটায়। কারণ বৃষ্টিতে কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক এসে পৌঁছতে পারেননি। হাইকোর্টের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত ভেনুতেই এই ব্যবস্থা।

পরীক্ষা মোটামুটি ভালই হল। অঙ্কে বারোটা প্রশ্নের মধ্যে যেকোনও দশটা করতে বলা ছিল। দশটাই করেছি। মনে হল সব ক’টা অঙ্কই সঠিক করেছি। জিকেও আমার জানার মধ্যেই ছিল। যেহেতু তিন ঘণ্টায় তিনশো নম্বরের পরীক্ষা তাই প্রশ্ন পিছু বরাদ্দ নম্বর বেশি ছিল। ইংরাজিটা বেশ শক্ত মনে হল। ৫০ নম্বরের একটা প্রবন্ধ আর ৫০ নম্বরের প্রেসি। প্রবন্ধ ছিল রেনি ডে ও ইয়োর এইম ইন লাইফ—যেকোনও একটি। লিখলাম আমার জীবনের লক্ষ্য—খুব সাধারণ, একটি সরকারি চাকরি পেয়ে বেকারত্ব ঘোচানো। প্রেসির বহু শব্দের অর্থ জানা ছিল না, তা-ও আন্দাজ করে লিখে এলাম।

এই পরীক্ষাতেই পাশ করার ফলে ইন্টারভিউয়ের চিঠি এসেছে বাড়িতে। ভাবলাম, দিদির কথা ফলতে চলেছে কিনা কে জানে।

মঙ্গলবার দিন হাইকোর্টে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর আমার ডাক পড়ল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখি উঁচু বেদীর উপর দু’জন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের চোখের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। এবার ধেয়ে এল প্রশ্নবাণ, লেখাপড়া কদ্দূর?

প্রশ্নের মধ্যে বেশ একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।

বললাম, ইকনমিক্সে এমএস সি পাস।

ভদ্রলোক আঁতকে উথলেন, অ্যাঁ! এমএস সি পাস করে এখানে ক্লার্কের কাজ করবেন?

এর কোনও উত্তর হয়? মুহূর্তের বিরতির পর তিনিই আবার বললেন, কোন ইউনিভার্সিটি?

বললাম, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

হায়ার সেকেন্ডারিতে ইংরেজিতে কত নম্বর ছিল?

বললাম, ৫৮।

বাবা কী করেন?

বলতেই পারতাম বাবা ঠাকুর বানাতেন বা বাবা একটা কারখানায় কাজ করতেন। তার বদলে বললাম, বাবা তো এই সেপ্টেম্বরে মারা গেলেন।

বললেন, যাও, ইন্টারভিউ হয়ে গেছে।

মাত্র দেড়-দু’মিনিটেই ইন্টারভিউ খতম।

মাস দুই পরে রেজাল্ট বেরোল। খবর পেয়ে একদিন গেলাম, হাইকোর্টের দেয়ালে টাঙানো সাফল্যের তালিকা দেখতে। আঁতিপাতি করে খুঁজেও তালিকায় কোথাও আমার নামের হদিস মিলল না। ২৩৮ জনকে ডেকেছিল ইন্টারভিউতে, তারমধ্যে ৮৮ জন সফল। মন খারাপ হয়ে গেল। ইন্টারভিউতে পড়াশোনা সংক্রান্ত কিছু জিজ্ঞেস করা হলে যদি না পারতাম, একটা কথা ছিল। কিন্তু সেসব তো হয়নি। তবে কি কাদের নেবে আগে থাকতে স্থির করাই ছিল? পরীক্ষা-টরীক্ষা সব লোক-দেখানো নাটক? তখনও তো জানি না যে বাঙালের হাইকোর্ট দেখার আরও বাকি আছে।


*********************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন