সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

মুক্তগদ্য * জয়িতা ভট্টাচার্য




মুখবন্ধ

জয়িতা ভট্টাচার্য 


অভিসার কাল শেষে বিরহের কালবেলা এলো।লেখা আসছে না।কলম শুকিয়ে কাঠ।মন মরুভূমি।সুচিত্রা শেষ করতে পারেন না উপন্যাস। খসখস করে পাতা উড়ে যায়।স্বপ্ন দেখেন আধখোলা বই উড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে।হ্যামলিনের বাঁশি শোনা যায় সমস্ত চিন্তা সূত্র চলে যাচ্ছে সরোবরে। অন্ধ মায়া জড়িয়ে ধরেছে বিরাট এনাকোণ্ডার মতো।গিলে নিচ্ছে সমস্ত নতুন শব্দ। সুচিত্রার মনে নেই কিছু।শনশন হাওয়ার রাতে নিঃসীম বসে আছেন।কে যেন এক নারী সপসপে গায়ে শরীর ছুঁয়ে চলে গেল।কে যেন!চমকে তাকান।শুনশান জাতীয় সড়কের মতো জীবন পড়ে আছে।খসখসে পাতার কথারা।একজন আগুন্তুক।সাধু কি?দাড়ি গোঁফের আড়ালে তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখ।একটা অস্পষ্ট ঘর।মলিন নিয়ন আলো।একটা সরু তক্তপোষে এক পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।সুচিত্রা দেখলেন জীর্ণ সেই শরীর যেন কুহক।কোথা থেকে এসেছিলেন কেউ কখনও জানতে পারল না।ফকির বাবা,লোকে বলত।তারপর হঠাৎ অন্তর্ধান।উধাও হয়ে গেলেন।কেউ কেউ বলত খুব সৌভাগ্যবান কেউ কেউ দেখা পেয়েছে কখনও তাঁর।ফকির বাবা।কিছু আশ্চর্য কথা তিনি বলেছিলেন।গোপন। অদ্ভুত।অলৌকিক নয়।

সব ভুলে যাওয়াকে আগের দিনে বলত বেব্ভুল।এখন কী যেন বলে...।স্মৃতিরা ভীষণ চঞ্চল উচ্ছল হলে কি স্কিজোফ্রেনিক ?মনে জলছবি!।এমন রাত।একা সুচিত্রার কোলে দুধের শিশু।মাসকয়েক বয়স।দেরশো বছরের পুরোনো চারমহলা প্রাসাদ।ভঙ্গুর।রান্নাঘর কলতলা গেলে শশুর-শাশুড়ি এসে পাহারা দিত।দুছর আগের টাটকা মৃত দুজন।সুচিত্রার সঙ্গে জীবন আর মৃত্যু বাসন্তি আর রূপনারায়ণ হয়ে মিশে একাকার।একথা ঠিক সুচিত্রা তাঁদের উপস্থিতি,তাঁদের অদৃশ্য ঘেরাটোপে নিরাপদ ছিলেন তাঁর জীবন্ত স্বামীর চেয়ে বেশি আশ্বস্ত।

কী লিখবেন সুচিত্রা।এই বিস্মরণের অধিকাংশ সত্য অথবা সত্যের আবরণে প্রাচীন কোনো মিথ্যার কথা...সবই ছাপা হবে সুচিত্রা জানেন আজ তিনি যেখানে প্রতিষ্ঠিত,সব ছাপা হবে যা লিখবেন।কিন্তু সুচিত্রা জানেন এসব লেখা,লেখা নয়।জীবনে যা কিছু হবে যা হয়েছে সব পূর্ব হতেই লেখা আছে।নতুন কিছুই লেখার সাধ্য নেই। গাঢ় উপন্যাসের মতো রাত।দিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাত। ডিলিট ডিলিট ডিলিট। আটকে আছে কার্সর।মোছে না ছবিটা।নার্সিংহোমের বাথরুমে ঢুকে মেঝেতে কোনায় পড়ে আছে তোবড়ানো রক্তমাখা মাংসপিণ্ড, মৃত তাঁরই সদ্য প্রসবিত কন্যা।তাঁরই সামনে দিয়ে তাকে নিয়ে গেল কাপড়ে মুড়ে হিন্দু সৎকার সমিতি।তিনি প্রস্তর মূর্তির মতো একঠায় বসে।পৃথিবী স্তব্ধ এবং সমাপ্ত সেদিনও ভেবেছেন।তারপর,সংস্পর্শহীন সম্পর্কহীন অধ্যায়ের ভেতর এক পড়ন্ত দুপুর।মুহূর্তের জৈবিক তন্ত্রের মতো...কাশী বিশ্বনাথের গলিতে কাঁচের চুড়ি,মণিকর্নিকাঘাটে আগুন চির প্রজ্জল। কল্পকাহিনির মতো সুচিত্রার কোল জুড়ে পুত্র এসেছে,আলো এসেছে আচমকা আটমাস পর।আর আজ এই পশ্চিম অবকাশে লাল সূর্যের আলো এসেছে তাঁর শরীরময়।সারা জীবন শেষে আশ্চর্য প্রণয়।শেষবার জীবন বলেছে"যা লিখেছ সব ভুল।অন্ধকারে আলোর উৎস।দ্যাখো সেই অতিবৃদ্ধ ফকির তোমাকে দিয়ে যাচ্ছে সান্তা ক্লজের গিফ্ট।"প্রণয় এসে পূর্ণ করে দিচ্ছে আজীবনের তৃষ্ণা।এক আশ্চর্য যাদুকর গোধূলির আলো মেখে এসেছে সে।সেই কৃষ্ণ সেই ঈশ্বর,সেই প্রেমিক ।জীবন কখন কোন বাঁক নেবে? কোন কলম লিখবে সেই রূপকথা।জীবনের পঁয়তাল্লিশটা বসন্ত পুষ্পহীন থেকে যাবার পর এসেছে প্রার্থিত পুরুষ।অবেলা বলে কিছুই কি হয় দিনমানে?অনন্ত আলোকরেখা দেখছেন সুচিত্রা।স্থির নিথর স্মিত মুখ।মানুষটার কষ্ট হবে।তবু এই বিরহ দেবে মহামিলনের ডাক।

এখন উপন্যাসের পরিশিষ্ট শুধু লিখবেন সুচিত্রা।

আনন্দ যাত্রা অনন্ত যাত্রা।পুব জানলা দিয়ে উষার

প্রথম কিরণ চুমো খেয়ে যায় নয়ন উন্মিলিত  সুচিত্রার মুখে।












*******************************************************************




জয়িতা ভট্টাচার্য 

কলকাতা নিবাসী সাহিত্যিক জয়িতা ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষক। অল্প বয়স থেকে লেখালিখি। প্রধানত মানবাধিকার বিষয়ক বুলেটিন ও খবরের কাগজে লিখতেন। প্রথম প্রেম কবিতা। এযাবৎ চারটি কবিতার বই,একটি গল্পের বই ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত। লিখেছেন অসংখ্য সংকলনে। এছাড়াও নিয়মিত  প্রবন্ধ, ও অনুবাদ কবিতা লেখেন বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত পত্রিকায়। পেয়েছেন সরকারি ও সাহিত্য গোষ্ঠীর নানা সম্মান।বইমেলায় প্রকাশিত জয়িতা ভট্টাচার্যের দুটি বই----  






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন