সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

গুচ্ছ কবিতা * মনোজ বাগ




কবিতাগুচ্ছ * মনোজ বাগ

 

সাদা রঙের সত্য 

অজস্র রাস্তা একে অন্যতে মিশে আছে ।

অজস্র রাস্তা একে অন্যকে ছাড়িয়ে মিলিয়ে গেছে দূর দূরান্তে ..

প্রতিটি রাস্তা জুড়েই আছে প্রকৃতি , মানুষ ।

বিবিক্ততায় , বৈচিত্র্যে মানুষও প্রকৃতির চেয়ে কম কিছু নয় ।

জানি , 

সব জেনেও সবুজ সবুজ রঙগুলিকেই আমরা তারুণ্যের 

প্রতীক রূপেই জানি ।

আর তরুন তরুন প্রাণগুলিকে তুলনা করি যা কিছু সজীব 

সবুজ তাদের সঙ্গে ।


ধূসর বর্ণদের , তোবড়ানো , কোঁকড়ানো , দোমড়ানো , 

মোচড়ানোদের ,

খসে খসে পড়া নোনা লাগা দেওয়ালের পলেস্তরাদের ,

আমরা জানি বিগত সময়ের প্রতিচ্ছবি রূপে ।


কুঁড়িগুলিকে শৈশবের উপমায় ধরি যত্রতত্র , 

উদ্ভিন্ন কিশলয়গুলিকে ,

দীর্ঘ রাস্তাগুলিকে , আমরা দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ জীবনের 

রূপকে দেখি

খর্বাকৃতি রাস্তাগুলির প্রসঙ্গ এনে আমরা ছোট ছোট গন্তব্য বা 

স্বল্পায়ু জীবনের ধারণা দিই । 


যদিও সবাই আছি সেই সবটা নিয়েই যার পর আর কিছু নেই !

এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সবটাই আমাদের সবার , 

এর সবটাই সবার ।


যে অখন্ডের গোটাটাই আমার ।

সেই অখন্ডের গোটাটাই তোমারও ।

একটা গোটা ব্রহ্মান্ড আমার যতটা 

ঠিক ততটাই তোমারও । 

এর কোন ভাগাভাগি হয় না । 

তাই ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্নই এখানে নেই ।


যাঁরা এ সত্যটি জানেন,  

সমস্ত রকমের অধিকার বোধ থেকে 

নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তাঁরা মনে-প্রাণে মহাপ্রকৃতির সঙ্গে 

একাত্ম থাকার অভ্যাস করেন নিরন্তর ধ্যান সাধনায় ।


ধ্যান একাত্ম হবার উপায় ।

সাধনা যা পরম ভাবে সত্য , সদা সর্বদা তার সঙ্গে একাত্ম 

থাকার অভ্যাস --

যারা এই সহজ সত্যটি জানেন না 

তারা একে অন্যেরটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে ,  মারামারি 

করেই জীবন অতিবাহিত করেন ,

যত দিন তারা বাঁচেন ।



মায়েদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে


সে সব দিনও ছিল যখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন 

মা-রা ।

আর অনিবার্য যা যা ঘটার সবই ঘটে যেত তাঁদের চোখের 

সামনেই ।

মা-রা চুপ থাকতেন ।

মা-রা চোখ বন্ধ রেখে থাকতেন বশংবদ । 

পালকের মতো হালকা মা-রা তখন সামান্য সামান্য ফুঁয়েই 

ঝড়ের এঁটো পাতার মতো গিয়ে পড়তেন এর ওর বাকুলে , 

দাওয়ায় । 


অপারকের মতো , পঙ্গু-অথর্বের মতো মা-রা 

বোবা সেজে থাকতেন মুখ বন্ধ রেখে ।

কালা সাজতেন কিছুই না শোনার ভান করে । 

মা-রা তখন দুহাত ভর্তি করে চুড়ি পড়ে সখী সখী ভাবে 

মনোরঞ্জন করতেন আসমুদ্রহিমাচলের ।


সে সব দিন আজ বিগত ।


এখন মা-রা ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন ।

পাড়া পড়শির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালিশি করেন এর ওর কৃতকর্মের । 

জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ে বচসা জোড়েন ।

দরবার বসান নিজের ঘরের দোরগোড়াতেই ।


নতুন মা-রা যখন এ সব করেন, 

পুরোনা দিনের মা-রা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখে উৎফুল্লিত হন ।

এমনটাও হয় !


রাত থাকতেই উঠে এখনও সব মায়েরাই দেখেন 

ঝুজকো বেলার আলো ঠিক কতটা ফুটবো ফুটবো করছে ।

দেখেন , ঘুমে অচেতন আলুথালু তাদের নালায়েক সব 

আত্মজ আত্মজারা জেগে ওঠা থেকে আরো কতটা দূরে ...



বায়স

হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরছে তৃষ্ণার্ত বায়স ।

জলসত্র চায় ।


বিশ্বময় এত যে ফুটো কলসীর ছড়াছড়ি -

আনাচে কানাচে এত যে ভাঙা তোবড়ানো জাগ জালা হাড়িখুড়ি ,

গড়াগড়ি যাওয়া যত্রতত্র এত যে অজস্র নুড়ি পাথর ...


নিজস্ব দুটি ডানায় ভেসে থেকে 

বহু দূর দূর দৃষ্টি মেলে 

তৃষ্ণার্ত বায়স তবুও খুঁজে ফিরছে জলসত্র ।


একটি দুটি কানা কড়ি হাতের তালুবন্দী রেখে কেউ কেউ এই 

দৃশ্যই সাগ্রহে দেখছি ।


ধরা আছি 

বস্তুত একটি ফ্রেমেই ধরা আছি -

মিলে মিশে আছি একটি পটেই ।


পায়ের তলার মাটি লালে লাল , সবুজে সবুজ 

কোথাও ধূসর ...


দুধের সরের মতো স্তরে স্তরে জমা টেকনোটিক প্লেট ।

উপরিভাগটা ভাগ হয়ে আছে ভূখন্ডে , স্থলে-জলে ।

নিচে গনগনাচ্ছে ফুটন্ত লাভা ।

সবটাই রাখা আছে বিরাট যে শূন্যে -

বহুদূর থেকে দেখলে এর কিছুই চোখে পড়ে না ।


খুব কাছে এসে খুঁটিয়ে দেখলেও 

দেখা হয় না ,

বোঝাও যায় না , সবটা...


শিশা

দর্পনে ফুটে আছে মুখ ...

ঝুঁকে পড়ে দেখছি , 

দেখছি ও মুখ আমারই ।


এ দেখলে , এর ।

ও দেখলে , ওর ।

যেই এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ছে ঐ দর্পনে -

সেই দেখছে ঐ মুখ আসলে তারই ।


যখন কেউই গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে না ঐ দর্পনে ,

তখন ফুটেও উঠছে না কারো মুখই । 


তখন কাজল দীঘির কাজল কালো জলের মতো থমথমে 

একটা অন্ধকার 

ভর করে আছে নিছকই জড় ঐ এক টুকরো শিশায় ।




*********************************************************************************************



মনোজ বাগ

পেশায় ব্যবসাজীবী । কবিতা বেঁচে থাকার রসদ ; অনিবার্য এক ইন্ধনও । প্রিয় কবিতার গ্রন্থ : গীতা , ঈশোপনিষদ , গীতবিতান , আমিই মাটি , আমিই আকাশ (সুজিত সরকার) । কবিতা প্রিয় বিষয় হলেও সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই টানে । সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতিও প্রবল আকর্ষণ আছে । ভালো লাগে ভাবতে : আপাত যা কিছু -- এই সবই এক পরম সত্যেরই প্রকাশ ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন