কবিতাগুচ্ছ * মনোজ বাগ
সাদা রঙের সত্য
অজস্র রাস্তা একে অন্যতে মিশে আছে ।
অজস্র রাস্তা একে অন্যকে ছাড়িয়ে মিলিয়ে গেছে দূর দূরান্তে ..
প্রতিটি রাস্তা জুড়েই আছে প্রকৃতি , মানুষ ।
বিবিক্ততায় , বৈচিত্র্যে মানুষও প্রকৃতির চেয়ে কম কিছু নয় ।
জানি ,
সব জেনেও সবুজ সবুজ রঙগুলিকেই আমরা তারুণ্যের
প্রতীক রূপেই জানি ।
আর তরুন তরুন প্রাণগুলিকে তুলনা করি যা কিছু সজীব
সবুজ তাদের সঙ্গে ।
ধূসর বর্ণদের , তোবড়ানো , কোঁকড়ানো , দোমড়ানো ,
মোচড়ানোদের ,
খসে খসে পড়া নোনা লাগা দেওয়ালের পলেস্তরাদের ,
আমরা জানি বিগত সময়ের প্রতিচ্ছবি রূপে ।
কুঁড়িগুলিকে শৈশবের উপমায় ধরি যত্রতত্র ,
উদ্ভিন্ন কিশলয়গুলিকে ,
দীর্ঘ রাস্তাগুলিকে , আমরা দীর্ঘ সময় বা দীর্ঘ জীবনের
রূপকে দেখি
খর্বাকৃতি রাস্তাগুলির প্রসঙ্গ এনে আমরা ছোট ছোট গন্তব্য বা
স্বল্পায়ু জীবনের ধারণা দিই ।
যদিও সবাই আছি সেই সবটা নিয়েই যার পর আর কিছু নেই !
এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সবটাই আমাদের সবার ,
এর সবটাই সবার ।
যে অখন্ডের গোটাটাই আমার ।
সেই অখন্ডের গোটাটাই তোমারও ।
একটা গোটা ব্রহ্মান্ড আমার যতটা
ঠিক ততটাই তোমারও ।
এর কোন ভাগাভাগি হয় না ।
তাই ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্নই এখানে নেই ।
যাঁরা এ সত্যটি জানেন,
সমস্ত রকমের অধিকার বোধ থেকে
নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তাঁরা মনে-প্রাণে মহাপ্রকৃতির সঙ্গে
একাত্ম থাকার অভ্যাস করেন নিরন্তর ধ্যান সাধনায় ।
ধ্যান একাত্ম হবার উপায় ।
সাধনা যা পরম ভাবে সত্য , সদা সর্বদা তার সঙ্গে একাত্ম
থাকার অভ্যাস --
যারা এই সহজ সত্যটি জানেন না
তারা একে অন্যেরটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে , মারামারি
করেই জীবন অতিবাহিত করেন ,
যত দিন তারা বাঁচেন ।
মায়েদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে
সে সব দিনও ছিল যখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন
মা-রা ।
আর অনিবার্য যা যা ঘটার সবই ঘটে যেত তাঁদের চোখের
সামনেই ।
মা-রা চুপ থাকতেন ।
মা-রা চোখ বন্ধ রেখে থাকতেন বশংবদ ।
পালকের মতো হালকা মা-রা তখন সামান্য সামান্য ফুঁয়েই
ঝড়ের এঁটো পাতার মতো গিয়ে পড়তেন এর ওর বাকুলে ,
দাওয়ায় ।
অপারকের মতো , পঙ্গু-অথর্বের মতো মা-রা
বোবা সেজে থাকতেন মুখ বন্ধ রেখে ।
কালা সাজতেন কিছুই না শোনার ভান করে ।
মা-রা তখন দুহাত ভর্তি করে চুড়ি পড়ে সখী সখী ভাবে
মনোরঞ্জন করতেন আসমুদ্রহিমাচলের ।
সে সব দিন আজ বিগত ।
এখন মা-রা ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন ।
পাড়া পড়শির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালিশি করেন এর ওর কৃতকর্মের ।
জীবনের মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ে বচসা জোড়েন ।
দরবার বসান নিজের ঘরের দোরগোড়াতেই ।
নতুন মা-রা যখন এ সব করেন,
পুরোনা দিনের মা-রা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখে উৎফুল্লিত হন ।
এমনটাও হয় !
রাত থাকতেই উঠে এখনও সব মায়েরাই দেখেন
ঝুজকো বেলার আলো ঠিক কতটা ফুটবো ফুটবো করছে ।
দেখেন , ঘুমে অচেতন আলুথালু তাদের নালায়েক সব
আত্মজ আত্মজারা জেগে ওঠা থেকে আরো কতটা দূরে ...
বায়স
হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরছে তৃষ্ণার্ত বায়স ।
জলসত্র চায় ।
বিশ্বময় এত যে ফুটো কলসীর ছড়াছড়ি -
আনাচে কানাচে এত যে ভাঙা তোবড়ানো জাগ জালা হাড়িখুড়ি ,
গড়াগড়ি যাওয়া যত্রতত্র এত যে অজস্র নুড়ি পাথর ...
নিজস্ব দুটি ডানায় ভেসে থেকে
বহু দূর দূর দৃষ্টি মেলে
তৃষ্ণার্ত বায়স তবুও খুঁজে ফিরছে জলসত্র ।
একটি দুটি কানা কড়ি হাতের তালুবন্দী রেখে কেউ কেউ এই
দৃশ্যই সাগ্রহে দেখছি ।
ধরা আছি
বস্তুত একটি ফ্রেমেই ধরা আছি -
মিলে মিশে আছি একটি পটেই ।
পায়ের তলার মাটি লালে লাল , সবুজে সবুজ
কোথাও ধূসর ...
দুধের সরের মতো স্তরে স্তরে জমা টেকনোটিক প্লেট ।
উপরিভাগটা ভাগ হয়ে আছে ভূখন্ডে , স্থলে-জলে ।
নিচে গনগনাচ্ছে ফুটন্ত লাভা ।
সবটাই রাখা আছে বিরাট যে শূন্যে -
বহুদূর থেকে দেখলে এর কিছুই চোখে পড়ে না ।
খুব কাছে এসে খুঁটিয়ে দেখলেও
দেখা হয় না ,
বোঝাও যায় না , সবটা...
শিশা
দর্পনে ফুটে আছে মুখ ...
ঝুঁকে পড়ে দেখছি ,
দেখছি ও মুখ আমারই ।
এ দেখলে , এর ।
ও দেখলে , ওর ।
যেই এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ছে ঐ দর্পনে -
সেই দেখছে ঐ মুখ আসলে তারই ।
যখন কেউই গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে না ঐ দর্পনে ,
তখন ফুটেও উঠছে না কারো মুখই ।
তখন কাজল দীঘির কাজল কালো জলের মতো থমথমে
একটা অন্ধকার
ভর করে আছে নিছকই জড় ঐ এক টুকরো শিশায় ।
*********************************************************************************************
পেশায় ব্যবসাজীবী । কবিতা বেঁচে থাকার রসদ ; অনিবার্য এক ইন্ধনও । প্রিয় কবিতার গ্রন্থ : গীতা , ঈশোপনিষদ , গীতবিতান , আমিই মাটি , আমিই আকাশ (সুজিত সরকার) । কবিতা প্রিয় বিষয় হলেও সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই টানে । সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতিও প্রবল আকর্ষণ আছে । ভালো লাগে ভাবতে : আপাত যা কিছু -- এই সবই এক পরম সত্যেরই প্রকাশ ।



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন