সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

গল্প * ঈপ্সিতা রায়

 



বাঁধন

ঈপ্সিতা রায় 


সকাল ৭টায় অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো অনিমেষের। আজ আর অ্যালার্ম বন্ধ করে আরো ১০ মিনিটের ন্যাপ নেওয়ার সময় নেই। মিনিস্ট্রি থেকে একজন অফিসার আসবেন অফিস ইন্সপেকশনে আর তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে অনিমেষের ওপর। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিল সে। অফিসের গাড়ি গেটে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যেই বড়োবাবু ২বার ফোন করে তাড়া দিয়েছেন। এয়ারপোর্ট যেতে বড়জোড় ১ ঘণ্টা লাগবে। ভদ্রলোকের ফ্লাইট ১০ টায় পৌঁছবে। এত আগে থেকে গিয়ে বসে থাকার কি আছে কে জানে, মনে মনে বিরক্ত হলো অনিমেষ। এই দাসত্বের অভ্যেসটা গেলো না আমাদের। সকালে ট্রাফিক ছিল না খুব একটা, এয়ারপোর্ট পৌঁছল ৮ টা নাগাদ। এখনও অনেকটা সময় বাকি। হেডফোন-টা কানে গুঁজে একটা গান চালিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে শুরু করলো। এভাবে ঘণ্টা খানেক কাটলো। বড্ড খিদে পাচ্ছে, সকালে তাড়াহুড়োতে খেয়ে বেরোতে পারেনি। মনে পড়লো ব্যাগে একটা বিস্কিট এর প্যাকেট রাখা আছে। বের করে একটা বিস্কিট মুখে পুরলো, হটাৎ মা-এর মুখ টা মনে পড়ে গেলো। ছোটবেলায় কখনও রাতে  ঘুম ভেঙে গেলে খুব খিদে পেয়ে যেত বলে মা বালিশের পাশে সব সময় বিস্কিটের প্যাকেট রেখে দিত। বাড়ি থেকে এত দূরে চাকরি করতে এসে শুরুতে খুব সমস্যা হতো, বাজার করা, রান্না করা, বাসন মাজা সংসারের এই সমস্ত কাজ করতে খুব বিরক্ত লাগতো, বাড়িতে মা কখনও কিছু করতে দেয়নি। দেখতে দেখতে ৩ বছর কেটে গেলো, এখন আর খুব একটা সমস্যা হয়না- কথায় আছে 'মানুষ অভ্যাসের দাস'। ঘড়ি দেখল অনিমেষ ১০ টা বাজতে ১০, আর কিছুক্ষণ এর ব্যাপার। ১০ টার কিছু পরেই ভদ্রলোক পৌঁছলেন, অনিমেষ এগিয়ে গেলো। গুড মর্নিং স্যার বলতেই ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। গাড়িতে উঠে অফিস যাওয়ার সময় অনেক গল্প করলেন, ভদ্রলোক বেশ ডাউন টু আর্থ। অফিসে পৌঁছতে ১১.৪০ বেজে গেল। অফিসে পৌঁছে অনিমেষের দায়িত্ব অনেকটা শেষ, বড়োবাবু ভদ্রলোককে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে চা জলখাবারের পর্ব শেষ হলে ইন্সপেকশন শুরু হবে। অনিমেষ সোজা ক্যান্টিনে চলে গেলো,একবার ইন্সপেকশন শুরু হলে আর সময় পাবেনা খাওয়ার। লাঞ্চ করে নিজের ঘরে এসে একটা ফাইল খুলে বসলো। ইন্সপেকশন শুরু হলো ১ টা নাগাদ। শেষ হতে ৬.৩০ টা বেজে গেলো। সব কিছু গুটিয়ে ঘরে ফিরতে ৯ টা। ফোন টা চার্জে বসাতে গিয়ে দেখলো মা-এর ৩ টে মিসড কল। সারাদিন কাজের মধ্যে মা কে কল করার কথা একদম মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। মা কে কল করলো, ওপাশ থেকে মা এর গলা - 'ঠিক আছিস বাবা ?এতবার ফোন করলাম ধরলি-নে! কাজের চাপ ছিল তাই ফোন দেখতে সময় পাইনি, আরো দু চার কথা বলার পর মা বললো- আজ দশমী, এই বার পুজোতেও ছুটি পেলিনে- মা কাঁদছে। এখানে আসার পর একবারও পুজোতে ছুটি পায়নি অনিমেষ। আজ-যে দশমী পুজো শেষ হয়ে গেছে সেটাই মাথায় ছিল না। কলেজের লাস্ট ইয়ায়ে বাবার হঠাৎ লাং-ক্যান্সার ধরা পড়ে - লাস্ট স্টেজ। তারপর ৯ মাস বেঁচে ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে অনিমেষের ওপর। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়াতে জমানো টাকা পয়সা বলে কিছু ছিল না। ৩ ভাই বোনের মধ্যে অনিমেষ বড়, ভাই ফার্স্ট ইয়ার আর বোন মাধ্যমিক দেবে। সারাদিন টিউশন পড়িয়ে রাতে কম্পিটিটিভ এর পড়াশুনা করতো। তখন মনে হতো একটা চাকরি-ই সব সমস্যার সমাধান, শুধু একটা চাকরি- যে কোনো চাকরি হোক, যেখানে পোস্টিং হোক চলে যাবো।   ৩ বছর আগে যখন চাকরিটা পেয়েছিল তখন মনে হয়েছিল জীবনে সবকিছু পেয়ে গেছে সে। চাকরিটা 'সব সমস্যার' সমাধান করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু 'অনেক সমস্যার' সমাধান করেছে । চাকরিটা জয়েন করার পরে এখন মনে হয় জীবনে আরো অনেক কিছু আছে যেগুলো বাকি থেকে গেল। হঠাৎ ফোনে টুং করে একটা নোটিফিকেশন এলো -  স্যালারী ক্রেডিটের মেসেজ; বোনের পরীক্ষার ফিস, ভাইয়ের সেকেন্ড ইয়ারের বই, মা এর ওষুধ আর সংসারের খরচা- 'অনেক সমস্যার' সমাধান। নাহ্ অনেক রাত হলো ঘুমোতে হবে কাল আবার অফিস। 

শত কষ্টের মাঝেও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা দায়িত্ব নিতে জানে - হাসিমুখে....











***************************************************************                                      



ঈপ্সিতা রায়

জন্ম ১৯৯৫, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়।  কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের স্নাতক। বর্তমানে রাজ্য সরকারের আধিকারিক। শৈশব থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক এবং তারই ফলশ্রুতিতে লেখালেখির শুরু। সাহিত্যের জগতে সদ্যাগতা।                            

1 টি মন্তব্য:

  1. অনিমেষের মতো অনেক মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত ছেলে মেয়ে আছে। তাদের অনুভূতি তোমার লেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
    A commendable piece of writing that reflects deep insight !

    উত্তরমুছুন