শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

শারদীয়া স্বরবর্ণ * ২০২১



 শারদীয়া " স্বরবর্ণে"র প্রস্তুতি চলছে। এই সংখ্যার জন্য যাঁরা লেখা পাঠাচ্ছেন বা পাঠাবেন ( ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে) তাঁদের কাছে অনুরোধ, লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি , সংক্ষিপ্ত পরিচিতি (যেমন  ঠিকানা, ফোন নম্বর , প্রকাশিত গ্রন্থ ( থাকলে )  পাঠাবেন। কবিতার ক্ষেত্রে , অন্তত দুটি কবিতা পাঠান। আমরা একজন কবি বা লেখকের সৃষ্টিকাজকে সামগ্রিকভাবে ছুঁতে চাই।

লেখা পাঠাবেন নিচের ইমেইল বা হোয়াটস্যাপ নম্বরে -----

debasishsaha610@gmail.com

8777891532


শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

প্রিয় কবি লেখক ও পাঠকদের প্রতি

 

  স্বরবর্ণ *   




* পুজো সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হবে আগামী ১৫ অক্টোবর  ২০২১ 

* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা (গল্প কবিতা প্রবন্ধ বা ভ্রমণ কাহিনি ) ১৫ সেপ্টেম্বর  ২০২১- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট । 

* কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন   

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠিয়ে দিন। 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর বেরো  আগে থেকে লেখা পাঠান পরিকল্পনার সুবিধার জন্য  লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 

* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  



* * স্বরবর্ণ --  ৩   সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও অগোচরেই হয়তো কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেল । আপনারা হাত ধরলে সেসব আমরা অচিরেই পেরিয়ে যাব **

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

 শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  







         




দীপংকর রায়   

কবিতার বই  *  অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

* আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 


কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 




 

আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ





মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 


শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

    কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি

 

+9



শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি

স্বামী বিবেকানন্দ


৩) সর্বাত্মানুভূতি [ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে এক দিবস অদ্বৈত বিজ্ঞানের জীব-ব্রহ্মের ঐক্য সূচক অনেক কথা বলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র ঐসকল কথা মনোনিবেশ পূর্বক শ্রবণ করিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না এবং ঠাকুরের কথা সমাপ্ত হইলে হাজরা মহাশয়ের নিকট উপবিষ্ট হইয়া পুনরায় ওই সকল কথার আলোচনা পূর্বক বলিতে লাগিলেন, 'উহা কি কখনও হইতে পারে? ঘটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর। যাহা-কিছু দেখিতেছ এবং আমরা সকলে ঈশ্বর?' হাজরা মহাশয়ও নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগদান করিয়া ঐরূপ ব্যঙ্গ করায় উভয়ের মধ্যে হাস্যের রোল উঠিল। নরেন্দ্রকে হাসিতে শুনিয়া ঠাকুর বাহিরে আসিলেন এবং 'তোরা কি বলছিস রে?' বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিকটে আসিয়া নরেন্দ্রকে স্পর্শ করিয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন।] ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভূত স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল। স্তম্ভিত হইয়া সত্য সত্যই দেখিতে লাগিলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছুই আর নাই। ঐরূপ দেখিয়াও কিন্তু নীরব রহিলাম, ভাবিলাম, -দেখি কতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ভাব থাকে। কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছুমাত্র কমিল‌ না। বাড়িতে ফিরিলাম, সেখানেও তাহাই -যাহা-কিছু দেখিতে লাগিলাম, সে সকলই তিনি। এইরূপ বোধ হইতে লাগিল। খাইতে বসিলাম, দেখি অন্ন, থালা, যিনি পরিবেশন করিতেছেন, সেই সকলই এবং আমি নিজেও তিনি ভিন্ন অন্য কেহ নহে। দুই-এক গ্রাস খাইয়াই স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম। 'বসে আছিস কেন রে, খা না!' মা'র ঐরূপ কথায় হুঁশ হওয়ায় আবার খাইতে আরম্ভ করিলাম। ঐরূপে খাইতে, শুইতে, কলেজ যাইতে, সবসময়ই ঐরূপ দেখিতে লাগিলাম এবং সর্বদা কেমন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া রহিলাম। রাস্তায় চলিয়াছি, গাড়ি আসিতেছে দেখিতেছি, কিন্তু অন্য সময়ের ন্যায় উহা ঘাড়ে আসিয়া পড়িবার ভয়ে সড়িবার প্রবৃত্তি হইত না! মনে হইত, 'উহাও যাহা, আমিও তাহাই।' হস্ত-পদ এই সময়ে সর্বদা আসাড় হইয়া থাকিত এবং আহার করিয়া কিছুমাত্র তৃপ্তি হইত না। মনে হইত যেন অপর কেহ খাইতেছে। খাইতে খাইতে সময়ে সময়ে শুইয়া পড়িতাম এবং কিছুক্ষণ পরে উঠিয়া আবার খাইতে থাকিতাম। এক একদিন ঐরূপে অনেক অধিক খাইয়া ফেলিতাম। কিন্তু তাহার জন্য কোনরূপ অসুখ হইত না! মা ভয় পাইয়া বলিতেন, 'তোর দেখছি ভিতরে ভিতরে একটা ভীষণ অসুখ হয়েছে।' কখন কখনও বলিতেন, 'ও আর বাঁচবে না।' যখন পূর্বোক্ত আচ্ছন্ন ভাবটা একটু কমিয়া যাইত, তখন জগৎটাকে স্বপ্ন বলিয়া মনে হইত! হেদুয়া (আজাদহিন্দ বাগ) পুষ্করিণীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া উহার চতুষ্পার্শ্বে লৌহ রেলে মাথা ঠুকিয়া দেখিতাম, যাহা দেখিতেছি তাহা স্বপ্নের রেল অথবা সত্যকার! হস্ত-পদের অসাড়তার জন্য মনে হইত, পক্ষাঘাত হইবে না তো? অবশেষে যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন ভাবিলাম, উহাই অদ্বৈত বিজ্ঞানের আভাস! তবে তো শাস্ত্রে ঐ বিষয়ে যাহা কিছু লেখা আছে তা মিথ্যা নহে। তদবধি অদ্বৈততত্ত্বের উপরে আর কখনও সন্দিহান হইতে পারি নাই।

৪)
দক্ষিণেশ্বরের আনন্দময় দিনগুলি

ঠাকুরের নিকট কি আনন্দেই দিন কাটিত, তাহা অপরকে বুঝানো দুষ্কর। খেলা, রঙ্গরস প্রভৃতি সামান্য দৈনন্দিন ব্যাপার-সকলের মধ্য দিয়ে তিনি কীভাবে নিরন্তর উচ্চ শিক্ষা প্রদানপূর্বক আমাদিগের অজ্ঞাতসারে আমাদিগের আধ্যাত্বিক জীবন গঠন করিয়া দিয়াছিলেন, তাহা এখন ভাবিয়া বিস্ময়ের অবধি থাকে না। বালককে শিখাইবার কালে শক্তিশালী মল্ল যেরূপে আপনাকে সংযত রাখিয়া তদনুরূপ শক্তিমাত্র প্রকাশপূর্বক কখন তাহাকে যেন অশেষ আয়াসে পরাভূত করিয়া এবং কখনও বা তাহার নিকটে স্বয়ং পরাভূত হইয়া তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় জন্মাইয়া দেয়। আমাদিগের সহিত ব্যবহারে ঠাকুর এইকালে অনেক সময়ে সেইরূপ ভাব অবলম্বন করিতেন। আমাদিগের প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার বীজ ফুল-ফুলায়িত হইয়া কালে যে আকার ধারণ করিবে, তাহা তখন হইতে ভাবমুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমাদিগকে প্রশংসা করিতেন, উৎসাহিত করিতেন এবং বাসনা-বিশেষে আবদ্ধ হইয়া পাছে আমরা জীবনের ঐরূপ সফলতা হারাইয়া বসি, তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতার সহিত আমাদিগের প্রতি আচরণ লক্ষ্য করিয়া উপদেশ প্রদানে আমাদিগকে সংযত রাখিতেন। কিন্তু তিনি যে ঐরূপে তন্ন-তন্ন করিয়া লক্ষ্য-পূর্বক আমাদিগকে নিত্য নিয়মিত করিতেছেন, একথা আমরা কিছুমাত্র জানিতে পারিতাম না। উহাই ছিল তাঁহার শিক্ষা-প্রদান এবং জীবন-গঠন করিয়া দিবার অপূর্ব কৌশল। ধ্যান-ধারণা কালে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া মন অধিকতর একাগ্র হওয়ার অবলম্বন পাইতেছে না অনুভব করিয়া তাঁহাকে কি কর্তব্য জিজ্ঞাসা করিলে তিনি ঐরূপ স্থলে কিরূপ করিয়াছিলেন তাহা আমাদিগকে জানাইয়া ঐ বিষয়ে নানা কৌশল বলিয়া দিতেন। আমার স্মরণ হয়, শেষ-রাত্রিতে ধ্যান করিতে বসিয়া আলমবাজারে অবস্থিত চটের কলের বাঁশির শব্দে মন লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িত। তাঁহাকে এই কথা বলায় তিনি ওই বাঁশির শব্দতেই মন একাগ্র করিতে বলিয়াছিলেন এবং সেইরূপ করিয়া বিশেষ ফল পাইয়াছিলাম। আর এক সময়ে ধ্যান করিবার কালে শরীর ভুলিয়া মনকে লক্ষ্যে সমাহিত করিবার পথে বিশেষ বাধা অনুভব করিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি বেদান্তে উক্ত সমাধি-সাধনকালে শ্রীমৎ তোতাপুরীর দ্বারা ভ্রূ-মধ্যে একাগ্র করিতে যেইভাবে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, সেই কথার উল্লেখপূর্বক নিজের নখাগ্র দ্বারা আমার ভ্রূ-মধ্যে তীব্র আঘাত করিয়া বলিয়াছিলেন, 'ঐ বেদনার উপর মনকে একাগ্র কর।' ফলে দেখিয়েছিলাম, ঐরূপে আঘাতজনিত বেদনার অনুভবটা যতক্ষণ ইচ্ছা সমভাবে মনে ধারণ করিয়া রাখিতে পারা যায় এবং ঐকালে শরীরের অপর কোন অংশে মন বিক্ষিপ্ত হওয়া দূরে থাকুক, -ঐ সকলের অস্তিত্বের কথা এককালে ভুলিয়া যাওয়া যায়। ঠাকুরের সাধনার স্থল, নির্জন পঞ্চবটীতল আমাদিগের ধ্যান-ধারণা করিবার বিশেষ উপযোগী স্থান ছিল। শুদ্ধ ধ্যান-ধারণা কেন, ক্রীড়া-কৌতুকেও আমরা অনেক সময় ওই স্থানে অতিবাহিত করিতাম। ঐ সকল সময়েও ঠাকুর আমাদিগের সহিত যথাসম্ভব যোগদান করিয়া আমাদিগের আনন্দবর্ধন করিতেন। আমরা তথায় দৌড়াদৌড়ি করিতাম, গাছে চড়িতাম, দৃঢ় রজ্জুর লম্বমান মাধবীলতার আবেষ্টনে বসিয়া দোল খাইতাম, এবং কখন কখনও আপনারা রন্ধন আদি করিয়া ঐস্থলে চড়ুইভাতি করিতাম। চড়ুইভাতির প্রথম দিনে আমি স্বহস্তে পাক করিয়াছি দেখিয়া ঠাকুর স্বয়ং ওই অন্ন-ব্যঞ্জনাদি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণেতর বর্ণের হস্তপক্ক অন্ন গ্রহণ করিতে পারেন না জানিয়া আমি তাঁহার নিমিত্ত ঠাকুরবাড়ির প্রসাদী অন্নের বন্দোবস্ত করিতেছিলাম। কিন্তু তিনি ঐরূপ করিতে নিষেধ করিয়া বলিয়াছিলেন, 'তোর মত শুদ্ধসত্ত্ব গুণীর হাতে ভাত খেলে কোন দোষ হবে না।' আমি উহা দিতে বারংবার আপত্তি করলেও তিনি আমার কথা না শুনিয়া, আমার হস্ত-পক্ক অন্ন সেইদিন গ্রহণ করিয়াছিলেন।

৫)
ঠাকুর আমাকে মা জগদম্বার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন (১)
[১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দের প্রথমভাগে নরেন্দ্রের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত হৃদরোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁহার শরীর ইতিপূর্বে অবসন্ন হইয়াছিল। নরেন্দ্রনাথ অনুসন্ধানে বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহাদিগের সাংসারিক অবস্থা শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পিতা কিছু রাখিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, আয়ের অপেক্ষা নিত্য অধিক ব্যয় করিয়া কিছু ঋণ রাখিয়া গিয়াছেন; আত্মীয়বর্গ এখন সময় বুঝিয়া শত্রুতাসাধনে এবং বসতবাটি হইতে পর্যন্ত তাঁহাদিগের উচ্ছেদ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছে। তাঁহারা মামলা করিলেও হারিয়া গিয়াছিল। কিন্তু পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষ-সদস্যরূপে নরেন্দ্র মাতা ও ভ্রাতাদিগের ভরণপোষণের দায়িত্বের সন্মুখীন হইলেন। ইতিপূর্বে তাঁহাকে কোনপ্রকার বিপদে পড়িতে হয় নাই। এই কালের আলোচনা করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন :-] মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিসে অফিসে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কিন্তু সর্বত্রই বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত এই প্রথম পরিচয় বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল -দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুইদিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই-একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল; তন্মধ্যে একজন বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গাহিয়াছিল- 'বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মঃনিশ্বাস পবনে' ইত্যাদি। শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় সে যেন গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হইয়া ক্ষোভে, নিরাশায়, অভিমানে, বলিয়া উঠিয়াছিলাম, 'নে, নে, চুপ কর। ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব যাহাদিগকে কখনও সহ্য করিতে হয় নাই, টানা-পাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকটে এইরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে। আমারও একদিন লাগিত। কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।' আমার এইরূপ কথায় উক্ত বন্ধু বোধহয় নিতান্ত ক্ষুন্ন হইয়াছিল -দারিদ্র্যের কিরূপ কঠোর পেষণে মুখ হইতে ঐ কথা নির্গত হইয়াছিল তাহা সে বুঝবে কেমনে? প্রাতঃকালে উঠিয়া, গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম গৃহে সকলের আহার্য নাই এবং হাতে পয়সা নাই, সেদিন মাতাকে 'আমার নিমন্ত্রণ আছে' বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে, ঘরে-বাহিরে কাহারও নিকটে ঐ কথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না। ধনী বন্ধুদের অনেকেই পূর্বের ন্যায় আমাকে তাহাদিগের গৃহে বা উদ্যানে লইয়া যাইয়া সঙ্গীতাদি দ্বারা তাহাদিগের আনন্দ বর্ধনে অনুরোধ করিত। এড়াইতে না পারিয়া মধ্যে মধ্যে তাহাদিগের সহিত গমনপূর্বক তাহাদিগের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইতাম। কিন্তু অন্তরের কথা তাহাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে প্রবৃত্তি হইত না -তাহারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয়ে জানিতে কখনও সচেষ্ট হয় নাই। তাহাদিগের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখন কখনও বলিত, 'তোকে আজ এত বিষণ্ন ও দুর্বল দেখাইতেছে কেন, বল দেখি?' একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্রমধ্যে মাতাকে সময় সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা






ধুলোর সিংহাসন 

পর্ব -- তিন 


বৈশাখ মাস। এ বছর এখনও পর্যন্ত কালবৈশাখী চোখ রাঙায়নি। গত বুধবার দুপুরে এক ঝলক রুদ্র রূপ দেখিয়েছে মাত্র। সারা আকাশ কালো করে মেঘ শানিয়েছিল। রাতের অন্ধকার যেন ঢেকে ফেলল দুপুরের গাল চিবুক । দেখতে দেখতে উঠল ঝড়ো হাওয়া। হওয়ার দাপটে  শুকনো পাতা আর ধুলোবালির প্রবল ঘূর্ণি। নিমেষে কোথায়  উড়িয়ে নিয়ে গেল মেঘপুঞ্জ  ।


    আজও পশ্চিম আকাশ কালো করে মেঘ শানিয়েছে। দুই এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। অশোক প্রায় দৌড় লাগাচ্ছিল কোচিং-এর উদ্দেশে । পিছন থেকে জামা টেনে ধরল অলি, ' ছাতা নিলে না?'  হাঁক পাড়ল, ' উপমা, চট করে বাবাইকে একটা ছাতা দে তো মা ।'


   ’ আরে ছাতা লাগবে না, এইটুকু তো রাস্তা, একদৌড়ে পৌঁছে যাব।'


      ' না না, ছাতা নিয়ে যাও, হঠাৎ করে আরও  জোরে বৃষ্টি পড়লে কী করবে । ভিজে জামা কাপড়ে কোচিং-এ এতক্ষণ থাকবে কী করে।' উপমা দৌড়ে এসে বাবার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দেয়। দৌড় লাগায় অশোক। ছাত্র-ছাত্রীরা এতক্ষণে বোধ হয় তুমুল হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই কমপ্লেন করে ' অশোক তোমার ছাত্র -ছাত্রীদের একটু কন্ট্রোল করো। ' সবচেয়ে অসুবিধে দীপক ঘোষের। দীপক ঘোষ লোকাল থানার ওসি। যখন তখন পাড়ার যাকে তাকে পুলিশি মেজাজ দেখান। অশোককেও ছাড়েন না। রোজই প্রায় ডেকে হুমকির সুরে নালিশ করবেন ' অশোক, তোমার ছাত্রদের চিল্লামিল্লির জ্বালায় আমার ছেলেটার পড়াশুনো লাটে উঠতে বসেছে। এভাবে তো চলতে পারে না,একটা কিছু ব্যবস্থা করো, নাহলে ----'পরোক্ষ শাসানিটা হজম করে নেয় অশোক। মনে মনে ভাবে,ছেলে কতটা মেধাবী তা তো আমি জানি। আগে তো আমার কাছেই পড়ত।এইটেই দুবার ডাব্বা। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালায় অশোক।


     বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ অশোকের কোচিং। সুভাষ পার্ক থেকে একটু এগিয়ে। বড় রাস্তার গায়েই। এটাই অশোকদের পৈত্রিক ভিটে। তিন কাঠা জমির উপর চার চালা টিনের বাড়ি। মাঝখানে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথনি ঘরটাকে দুভাগে ভাগ করেছে। পশ্চিম দিকটাতে মেজদা সুধীর থাকে ফ্যামিলি নিয়ে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওর মুদি দোকান। বড় রাস্তার পাশে হওয়ায় দোকানটা চলেও ভালো। পার্টিশনের পুব দিকটাতে থাকত অশোক।.ফ্ল্যাট কিনল তো এই সেদিন। বছরখানেকও হয়নি। এই বাড়িতে,এই ছোট্ট ঘরটাতেই কেটেছে অশোকের ছেলেবেলা থেকে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়া অবধি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। অশোকের বিয়ে, উপমার জন্মও এই ভিটেতেই। কত স্মৃতি জড়িয়ে এই মাটির সঙ্গে। অশোক তখনও স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি, ওর বাবা মারা যান। বাবার স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। পাঁচ ভাইবোনকে প্রতিপালন করে সঞ্চয় বিশেষ কিছুই রেখে যেতে পারেননি,এই ভিটেটুকু ছাড়া। কিন্তু আবছা মনে পড়ে অশোকের, দাদা দিদিদের বাবা মাঝে মাঝেই  বলতেন, ' অভাব-অনটন যতই থাকুক, সবসময় সত্য পথে চলবে। আর এই কথাটা মনে রাখবে সব সময়, ' সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। ' কথাটা কার জানো? বলে গলাটা একটু গম্ভীর করে নিজেই উত্তর দিতেন, ' স্বামী বিবেকানন্দের।'



     অশোকদের জমিটা লম্বাটে ধরনের। চওড়ায়  কুড়ি আর লম্বায় একশো আট ফুট। তবে জমিটা বড় রাস্তার গায়ে হওয়ায় বাজারদর অনেক। তা কাঠা প্রতি কুড়ি পঁচিশ লাখ তো হবেই । অশোকের বাবা  জমিটা কিনেছিলেন উনিশশো সাতান্ন সালে পাঁচশো টাকা দিয়ে। পুরনো দলিলে দেখেছে অশোক। টিনের বাড়িটাও সেই সময়কার। বাবা-ই তৈরি করেছিলেন। এত বছরের ঝড় জল রোদ-বৃষ্টি সহ্য করে বাড়িটা আজ প্রায় জরাজীর্ণ। বিশেষ করে টিনের চালে জায়গায় জায়গায় জং ধরে হাঁ হয়ে আছে। প্রতিবছরই কালবৈশাখী শাসায়, বর্ষার জল মাস্তানি দেখায়। নিরুপায় অশোক  টিনের  ফুটো দিয়ে যে সব জায়গায় জল পড়ে, পিচচট  লাগিয়ে কোনওরকমে মেরামতির চেষ্টা করে।



     নিজের টিউশন নির্ভর জীবিকা, সরকারি চাকুরে বড়দা নির্মাল্য বোসের  অন্যত্র বাড়ি করে চলে যাওয়ার পর, ওদের দুই ভাইয়ের পক্ষে এখানে বাড়ি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালসের যা দাম। বাড়ির এই জীর্ণদশা দেখে অশোক দু-একবার বাড়িটা প্রমোটিং-এও দেওয়ার চেষ্টা করেছে। পাড়ার  অনেকেই অশোককে ভালবাসে ওর শান্ত স্বভাবের জন্য। একসময় ও পাড়ার সুভাষ সংঘের  সেক্রেটারিও ছিল। ওই ক্লাবেরই ছেলে দুলাল আর মানিক। ওরা জমি-বাড়ির দালালি করে। ওরাই একবার, তা বছর দশেক আগে তো হবেই, এক প্রোমোটারের সঙ্গে অশোকের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। প্রোমোটার জানতে চেয়েছিল, মনে পড়ে অশোকের ' আপনাদের ডিমান্ড কী? ' অশোক দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানিয়েছিল, তিন ভাই আর ছোট বোন লীনার জন্য টু বেড রুমের চারটে ফ্ল্যাট আর পাঁচ লাখ টাকা। বড় বোন অপর্ণা পৈত্রিক  সম্পত্তির ভাগ নেবে না, আগেই জানিয়েছিল। আসলে অপর্ণা চেয়েছিল বাবার কেনা জমিতে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের দৈন্যদশা ঘুচে সেখানে একটা বড় কিছু ডেভলপমেন্ট হোক। অশোকও তাই চেয়েছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না ' কপালে না থাকলে ঘি ঠক ঠকালে হবে কী ' শেষ পর্যন্ত সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। জমির মাপজোক করে প্রোমোটারের আর্কিটেক্ট জানাল, চওড়ায় ছোট হওয়ায় এ জমিতে প্রমোটিং সম্ভব নয়। ফ্ল্যাট করা যাবে না তা নয়, কিন্তু প্রায় কোটি টাকা ইনভেস্ট করে আমাদের লাভ বিশেষ কিছুই থাকবে না। কথাটা শুনে কী যে খারাপ লেগেছিল অশোকের, আজও মনে পড়ে।



     টিনের চার চালা বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা উঠোন ছেড়ে এই জমিরই  ঠিক মাঝখানে একটা বড় বেড়ার ঘর, উপরে টালি, মধ্যিখানে বেড়ার পার্টিশান। ও পাশে  ছেলেকে নিয়ে থাকে বিধবা বোন লীনা। এপাশে  অশোকের কোচিং। ঘরটা বেশ বড়সড়। একসঙ্গে পঁচিশ-তিরিশ  জন বসতে পারে। পুবমুখো একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। তার সামনে একটা ছোট টেবিল। টেবিলটার বাঁ দিকে বেড়া ঘেঁষে একটা ছোট কাঠের আলমারি। টেবিলের উপর ডাঁই করা গাদাগুচ্ছের খাতা বইপত্তর চক ডাস্টার আর একটা শক্তপোক্ত বেতের লাঠি। টেবিল চেয়ারের উল্টো দিকে বেড়ার দেয়াল ঘেঁষে একটা হোয়াইট বোর্ড । বেড়ায় গোঁজা একটা হোয়াইট বোর্ড মার্কার। আর টেবিলটার সামনে আড়াই ফুট উঁচু তিন ফুট চওড়া বেশ বড়সড় একটা টেবিল। বড় টেবিলটার দু'পাশে দুটো বেঞ্চ। তাতে  দুদিকে পাঁচ পাঁচ দশজন বসতে পারে। আর অশোকের টেবিলের সোজাসুজি উল্টোদিকে আরও একটা ছোট বেঞ্চ পাতা। ওই বেঞ্চটাতেও গাদাগাদি করে তিন জন বসে। ছাত্র-ছাত্রী বেশি হলে মেঝেতে বসে পড়ে মাদুর পেতে। এতে অবশ্য  ওদের কোনও অভিযোগ অনুযোগ নেই ।বরং নীচে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তাতে খানিকটা স্যরের আড়ালে থাকা যায় ।



    কোচিং-এ ঢোকার মুখে দরজার উপর একটা বড় ব্যানার ঝোলানো । অশোকের কোচিং-এর বিজ্ঞাপন। বড় বড় করে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে ----



                                  তপোবন কোচিং সেন্টার

                       এখানে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি (সকল বিষয়)

                             একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি (কলা বিভাগ)    

                                                      এবং

                            বিএ পাস ও অনার্স (ইতিহাস ও বাংলা)                        

                                       যত্নসহকারে পড়ানো হয়

             * ছোটদের জন্য আঁকা এবং আবৃত্তি শেখানোর ব্যবস্থা আছে *

                                      যোগাযোগ : অশোক বোস

                                  ফোন নম্বর ---- ৯৯০৩২৫৭৫৬৬



       ঠিক এইরকমই আরও দু'তিনটে ব্যানার টাঙানো আছে বড় রাস্তার এ -মাথায় ও -মাথায়।


      বৃষ্টি আর বিশেষ পড়ছে না। ছাতা বন্ধ করে অশোক। প্রায় পৌঁছে গেছে। খানিকটা দূর থেকে চোখে পড়ে কোচিং-এর মুখটাতে পায়েল শুভ অতনু শংকর রিম্পা... বিএ ক্লাসের প্রায় জনা দশেক ছাত্র-ছাত্রী হাসি-ঠাট্টাতে মশগুল।


      অশোককে দেখেই ওরা দৌড় লাগাল। কোচিং-এ ঢুকে যে যার জায়গায় বসে পড়ল। অশোকও প্রায় ওদের সঙ্গে সঙ্গেই  ঘরে ঢুকল । হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় এক ঝলক ৫-৩৫ মি। ভেতরে ভেতরে আঁতকে ওঠে অশোক। এই ব্যাচটা হওয়ার কথা ছিল পাঁচটা থেকে সাতটা। ইতিমধ্যেই ৩৫ মিনিট লেট। তারপর আসবে ক্লাস টুয়েলভ, সাতটা থেকে ন'টা। পরেরটা ক্লাস টেন, ন'টা থেকে সাড়ে দশটা। প্রতিটি ব্যাচ থেকে দশ পনের মিনিট কাটছাঁট করে সাড়ে দশটার মধ্যে রোজ পড়ানো শেষ করে । আজ ইতিমধ্যেই ৩৫ মিনিট লেট। প্ল্যান কষতে  থাকে অশোক মনে মনে, কী করে এই সময়টাকে  মেকআপ দেওয়া যায়। বাড়ি গিয়ে আবার উপমাকে নিয়ে বসতে হবে। মে-র ২০ তারিখ থেকে ওর থার্ড ইয়ার ফাইনাল। 


      শারীরিক ধকল যতই হোক, বাড়ি ফিরে ওকে  গল্পচ্ছলে পল সায়েন্স, হিস্ট্রির দু' একটা চ্যাপ্টার বোঝাতেই হবে । সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্টটা ওর তত ভালো হয়নি। থার্ড ইয়ারে চাপটা একটু কম। এবার একটু খেটে খুটে ৬০% এর উপর নম্বর তুলতে পারলে ,এভারেজে হয়ত ৫০% মার্কস থাকবে। ৬০% এর  কম হলে না পাবে রেগুলারে এম এতে চান্স, না পারবে বিএড করতে।


     আর দেরি না করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অশোক, ' আচ্ছা, পায়েল শুভ...আজ কী পড়া আছে যেন আমাদের ?'

    ' স্যর আজ কোনও পড়া নেই ' ওদের চটজলদি উত্তর।

   'সে কী ! পড়া নেই কেন? মনে করো, আমার কিন্তু ঠিক মনে আছে। '

   ' না স্যর , আজ নোটস লেখাবেন বলেছিলেন।'  

   ' কোন চ্যাপ্টার ?'

    ' সুলতানি প্রিয়র্ড, মেডিয়াভেল ইন্ডিয়া থেকে।' মেডিয়াভেল ইন্ডিয়া,সুলতানি প্রিয়র্ড? সেটা তো গত শুক্রবারের ক্লাসেই কমপ্লিট হয়ে গেছে।' 

সবাই চুপ।

  ' আচ্ছা শর্মিষ্ঠা,তুমি বলতো আজ কী পড়া? শর্মিষ্ঠা একমনে মুখ গুঁজে নোটসের খাতার  পাতা উল্টাচ্ছিল। সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ' সত্যি কথাটা বলে দিই? ' কারও উত্তর দেওয়ার আগেই অশোক বলল, ' হ্যাঁ বলো, সেটা শোনার জন্যই তো তোমাকে প্রশ্নটা করলাম। '


  ' স্যর আজ সুলতানি প্রিয়র্ড এগজাম  নেওয়ার কথা ছিল, আর যে যা-ই নম্বর পাক না কেন,খাতা সই করিয়ে আনতে হবে ,বলেছিলেন।' সবাই শর্মিষ্ঠার দিকে চোখ বড় বড় করে শাসাতে থাকে দাঁত কিড়মিড় করে, ' দাঁড়া তোর হচ্ছে, কী প্ল্যান করলাম, আর ও কী বলছে।' সমস্বরে রাগতভাবে বলল পায়েল, রিম্পা।

  ' তোমরা শর্মিষ্ঠাকে শাসাচ্ছ কেন, ও তো সত্যি কথাই বলছে।'

' না স্যর ,আমরা প্ল্যান করেছিলাম...'

 ' কী, কী  প্ল্যান করেছিলে তোমরা, বলো। '

 ' স্যর আজ আমরা পরীক্ষা দেব না, কারও  ঠিকঠাক প্রিপারেশন হয়নি।'

 ' কেন, হয়নি কেন? '

 ' কী বড় বড় উত্তর স্যর, এক একটা চার পাঁচ পৃষ্ঠা '

  ' এক একটা প্রশ্নে কুড়ি নম্বর করে থাকে, উত্তরটা বড় হবে না ? তোমরা কি এখন নাইন টেনে পড়? ' 

  ' তা-ও স্যর, একটা সুযোগ দিন, সামনের ক্লাসে ঠিক পরীক্ষা দেব।'


    শর্মিষ্ঠা ছাড়া আর কারোরই পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে নেই, বুঝতে পারে অশোক। ' ঠিক আছে একটা সুযোগ দিলাম, কিন্তু আর এরকম করবে না। ফাইনাল পরীক্ষার দিন তোমাদের প্রিপারেশন হয়নি বলে কি সি ইউ পরীক্ষা পিছিয়ে দেবে, বলো?

     'না স্যর।'

    ' তবে? '

    ' আর হবে না স্যর।'

    ' ঠিক আছে, সবাই খাতা বার করো।

    ' কী করাবেন স্যার?'

    ' এমনি একটা উত্তর লিখতে দেব। খাতা সই করাতে হবে না। কিন্তু নম্বর দেব।'

    ' ওকে স্যার,ওকে ' সবাই ভীষণ খুশি।


      ঘড়িটার দিকে আর একবার তাকিয়ে, অশোক মনে মনে হিসেব কষে, এখন ছ'টা। আধঘণ্টা সময় দেবে ওদের, মিনিট পনেরোর মধ্যে খাতা দেখে সাতটার মধ্যে ছেড়ে দেবে। তাহলে লেট হওয়ার সময়টা মেকআপ হয়ে যাবে। পরের দুটো ব্যাচ আজ দু'ঘণ্টা করে না পড়িয়ে, দেড় ঘন্টা দেড় ঘন্টা পড়াবে। তাহলে বাড়ি গিয়ে উপমাকে নিয়ে একটু বসতে পারবে।

   ' বলুন স্যর, প্রশ্নটা ? '

   ' সবাই রেডি তো ? '

   ' হ্যাঁ স্যার। '

   ' বেশ লেখ, আলাউদ্দিন খিলজির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা..'


    ' বাবাই ! ' উপমার গলা। তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা শেষ করে অশোক, ' নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জানো সংক্ষেপে লেখ, ' একটু থেমে, ' হয়েছে সবার ?'

   ' হ্যাঁ স্যর। '

   ' শুরু করো, টাইম কিন্তু আধঘন্টা।'

   ' স্যার ,এত বড় উত্তর আর আধঘন্টা টাইম,হবে?' শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন তোলে।

    ' যা হয়, এই সময়ের মধ্যেই আজ লিখতে হবে, শর্মিষ্ঠা ' বলতে বলতে বাইরে বেরোয় অশোক। উপমা দাঁড়িয়ে। পাশের ফ্ল্যাটের এক পুচকে  রনিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অশোক রনির গালটা টিপে আদর করতে করতে বলে, 'পড়া বাদ দিয়ে তুই এলি ?'

   ' মা পাঠাল তো ' বলেই প্লাস্টিকে মোড়া একটা স্টিলের গ্লাস অশোকের হাতে দিয়ে বলল, ' তোমার চা।     ' ও আচ্ছা, দে, রনিকে নিয়ে এসেছিস, ওর মা জানে তো ?'

   ' হ্যাঁ ওর মা-ই তো বলল, যা উপমাদিদির সঙ্গে ও একা একা যাবে, একটুখানি তো পথ,এখুনি চলে আসবি।'

  ' বাবাই, আমরা আসছি ' বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ওরা।

   'শোন মা। '

   ' হ্যাঁ বলো। '

   ' টিভি দেখবি না, মোবাইল ঘাটবি না, বাড়িতে গিয়েই একমনে পড়তে বসবি কিন্তু, আর ক'টা দিন বাদেই তো ফাইনাল পরীক্ষা।'

  ' হ্যাঁ রে, বাবা, জানি তো। '

  ' ঠিক আছে আমি বাড়ি গিয়ে পল সায়েন্সের দু'টো উত্তর ধরব কিন্তু। '

  ' কোন দুটো ?'

    এর মধ্যে ভুলে গেলি? পরশুদিন তো বুঝিয়ে দিলাম...ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আর জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা।'

' ও আচ্ছা, মনে পড়েছে মনে পড়েছে। আসছি।' 

   'এস, মনে থাকে যেন।'

  ' হ্যাঁ থাকবে।'


    ওরা চলে যায়। অশোক টেবিলে গিয়ে বসে। ফিসফাস শব্দ। পায়েল খোঁচাচ্ছে শর্মিষ্ঠাকে 'একটু বল না, প্রথম পয়েন্টটা যেন কী ছিল? '

  ' কী করে বলব, স্যর বসে আছে না?' বিরক্ত শর্মিষ্ঠা।

   অশোকের গলা গম্ভীর হয়, ' কথা বলো না, তাহলে কিন্তু খাতা নিয়ে নেব।'

   সবাই চুপ।


 ' বাবাই একটু শোনো ' ফের উপমার গলা ! এই তো বাড়ি গেল।

' কী রে , ফিরে এলি?'

' বাবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে উপমা, ' মা বলেছে, ফেরার সময় দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল নিয়ে যেতে।'

 ' আচ্ছা তোমরা যাও।'


     টেবিলে গিয়ে চুপচাপ বসে অশোক। হাত একেবারেই খালি। মানিব্যাগে দশটা টাকা পড়ে আছে। দু'দিন আগেই  ফ্ল্যাটের ই এম আই কেটেছে। আজ মাসের ১২ তারিখ। যা মাইনে পেয়েছিল কুড়িয়ে কাচিয়ে ই এম আই-টা দেওয়া হয়েছে। এখনও মাসকাবারি বাজার কিছুই হয়নি। হাতে একটু পয়সা নেই। এ টি এম থেকে তুলবে, তারও উপায় নেই। ব্যাংকে হাজার টাকা মতো পড়ে আছে। ওর থেকে তুললেই ব্যালেন্স ফলের জন্য ফাইন কাটবে। শেষমেশ ধারেই নিতে হবে, মেজদার দোকান থেকে। অবশ্য যদি আজ কেউ মাইনে দেয় আলাদা কথা। এখনও পর্যন্ত এরা কেউই তো দিল না।


     অশোক এত লাজুক,মুখ চোরা কাউকে মুখ ফুটে মাইনে চাওয়ার কথা বলতে পারে না। পনেরো কুড়ি তারিখ হয়ে যায়, অনেকেই মাইনে দেওয়ার নাম করে না। কারও কারও দু'মাস তিন মাস বাকি পড়ে যায়। তবু চায় না। অবশ্য অনেকেই একসাথে টাকাটা দিয়ে দেয়। কেউ কেউ আবার দিচ্ছি দেব করে পাঁচ-ছ মাস কাটিয়ে দেয়। এই যেমন তাপস বণিক, বি এ থার্ড ইয়ার। ওর বাবা একদিন ফোন করে বলল, ' স্যর মাইনেটা বাকি পড়ে যাচ্ছে, কিছু মনে করবেন না, কোম্পানির অবস্থা ভালো না। উইথআউট পে হয়ে যাচ্ছি। পেলে আপনাকে ঠিক একবারে সব দিয়ে আসব। একটু কনসিডার করবেন স্যর।' বলল, কিন্তু ছ'মাস কাটলে দেখা গেল তাপস আর পড়তে আসছে না। বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করতে ওরা বলল, ' স্যর তাপস কোচিং ছেড়ে দিয়েছে ও রায় কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। এই সময়টা অশোকের বুকটা ধক করে ওঠে।


    এসব ক্ষেত্রে অলি বলে, ' তুমি এক মাস দু'মাস থাকতে চাও না কেন ? তাহলে তো ছ'মাসের টাকা আর পরিশ্রমটা জলে যায় না। অলি  হয়তো ঠিকই বলে। কিন্তু অশোক তা পারে না। আসলে ওর পেশাটা তো অন্য ব্যবসার মতো নয় ঠিক। জামার কলার ধরে বলবে, '১০ তারিখের মধ্যে টাকা না দিলে দেখে নেব। ' আবার কোনও কোনও গার্জিয়ান ছেলে-মেয়ের মাইনে দিতে এসে বলবে, ' স্যর টাকাটা গুনে নিন।' অশোক আজ পর্যন্ত কোনওদিন কোনও  ছাত্র-ছাত্রী বা গার্জিয়ানদের সামনে গুনে গুনে টাকা পকেটে ঢোকায়নি। যেমন দেয় তেমনি পকেটে রাখা থাকে । পরে আড়ালে গুনে দেখে ঠিক আছে কি না।


   ' স্যর হয়ে গেছে ' পায়েল খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

   'এর মধ্যে হয়ে গেল ?'

   ' না স্যর, পুরোটা পারিনি।' ঠিক আছে দিয়ে দাও। খাতাটা হাতে নিতে নিতে ভাবে, পায়েল এ মাসের মাইনেটা  এখনও দেয়নি। ও তো এত দেরি করে না। আজ কী দেবে, কে জানে ! মুখে বলে, ' বাড়িতে পড়ো  কিন্তু, পরদিন যেন এরকম না হয়, তাহলে বাবাকে ----'


  ' না স্যর না স্যর ,বাবাকে ফোন করতে হবে না, পড়ব, পরদিন ঠিক পড়ব। তাহলে আজ যাই স্যার ? '


    ' বাবা'কে ফোন করার  উদ্দেশ্য পড়াশুনার কথা জানানো নয়, বাবার কথা বললে যদি পায়েলের মনে পড়ে মাইনেটা দেওয়ার কথা। বাড়ি থেকে টাকা দিয়ে দিলেও ওরা অনেক সময় দিতে দেরি করে। নানা ফন্দি-ফিকির আঁটে। নতুন কলেজে যাচ্ছে তো ! কেউ কেউ আবার এক-দু'মাসের টাকা বেমালুম হজম করে ফেলে। অশোক মনে করালে দিব্যি অস্বীকার করে, বলে, ' স্যর আমি তো দিয়ে দিয়েছি। ' এ যে কত বড় জলজ্যান্ত মিথ্যে তা অশোকের চেয়ে আর কেউ জানে না। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারে না মুখ ফুটে । গার্জিয়ানকেও জানায় না। জানালে হিতে বিপরীত হয়। গার্জিয়ানরা ওদের বকাঝকা করে। পরিণামে দু-চারজন কোচিংই  ছেড়ে দেয়। তার চেয়ে এক দু' মাসের ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করে অশোক।

   ' যাই স্যর  ' অশোক অন্যমনস্ক দেখে অধৈর্য পায়েল।

   ' একটু বসো না , সবাই খাতা জমা দিক, একসাথে যাবে।' বাবা টাকাটা দিয়ে থাকলে ততক্ষণে যদি পায়েলের মনে পড়ে।


    টেবিলের ড্রয়ার থেকে হিসাবের খাতাটা বার করে অশোক দুই হাতে আড়াল করে দেখতে থাকে, হ্যাঁ এইতো বিয়ে ফার্স্ট ইয়ারের পনেরো  জনের নাম পরপর লেখা। বারোজনের  ক্লিয়ার।পায়েল, সুমিত শংকর তিনজন এখনও বাকি। তিন জনের একজনও যদি দেয়,তাহলে ....


   আর  যদি না দেয়, তাহলে পরের দু'টো ব্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শেষমেশ কারও কাছ থেকেই যদি কিছু না পাওয়া যায় তাহলে ধারেই নিতে হবে, ভাবে অশোক। অলি ধারে খাওয়া একদম পছন্দ করে না। ওর মত, থাকলে খাব,না থাকলে খাব না । অলির যুক্তি ,ধারে খেলে বেশি খাওয়া হয়, তাছাড়া দোকানদারেরও জল মেশানোর সুযোগ থাকে । সব সময় কি আর পাই টু পাই হিসাব মনে রাখা সম্ভব ,যতই হিসাবের খাতা থাকুক না কেন।


   ' হয়ে গেছে স্যার ' প্রায় সবাই খাতা হাতে উঠে দাঁড়ায়। শর্মিষ্ঠা আর অতনু তখনও লিখে চলেছে। ' ওরা পন্ডিত হবে, ফার্স্ট ক্লাস পাবে ভাই ! '  পাশ থেকে ফোড়ন  কাটে রিম্পা, শঙ্কু।

    লিখুক না তোমাদের কী ক্ষতি? এখনও মিনিট পাঁচেক সময় আছে। তোমরা খাতা জমা দিয়ে বাইরে দাঁড়াও।

   ' খাতা  আজ দেখবেন না স্যর? '

   ' না খাতা পরদিন দেখব, দুটো একসাথে গার্জিয়ানকে দিয়ে সই করিয়ে আনবে।'

   ' না স্যর হবে না,আপনি বললেন যে আজকেরটা সই করাতে হবে না।'

   ' ও বলেছি বুঝি! ' অশোক মুচকি হাসে। ছাত্র -ছাত্রীদের সঙ্গে ওর সহজ সম্পর্ক। ' আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। '

   ' থ্যাঙ্ক ইউ স্যর ' দুদ্দাড় করে বেরিয়ে পড়ে ওরা সবাই।


        সাতটা বাজতে পঁচিশ। টুয়েলভের  ব্যাচ আসবে সাতটায়। হাতে এখনও পঁচিশ মিনিট সময়। কোথায় ভেবেছিল এই ব্যাচটা শেষ করতে লেট হয়ে যাবে। সেখানে কী কায়দায় ম্যানেজ করল। উল্টে পঁচিশ মিনিট আগেই শেষ করল ক্লাসটা। বলা যায় খানিকটা ফাঁকিই দিল আজ। আগে এরকম করত না অশোক। ঘড়ি ধরে ও কোনদিনই পড়ায় নি। এতটাই তনময় হয়ে পড়াত কখন দু'ঘণ্টা কেটে যেত, বুঝতেই পারত না। গার্জিয়ানরা এসে অপেক্ষা করত। ছাত্ররা  উসখুস করত ছুটির জন্য। কিন্তু  অশোক পড়িয়েই  চলেছে। আসলে অশোক পড়াতে ভালোবাসত। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা বন্ধুর মত। আর ওর অমায়িক ব্যবহারের জন্য এই অঞ্চলে তপোবন কোচিং সেন্টার এবং অশোক স্যরকে সবাই এক ডাকে চেনে। ভালোও বাসে। তাই ওর কোচিংয়ে সব সময়ই ছাত্র-ছাত্রী গমগম করে। করবে নাই-বা কেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মনের কথা অশোক পড়তে পারে। শীতের সময় সময় বছরে একবার ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে ট্যুরে যায়। পঁচিশে বৈশাখ ,শিক্ষক দিবস ,স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে সাড়ম্বরে। নাচ-গান নাটক...সরস্বতী পুজোয় টেন , টুয়েলভ এবং থার্ড ইয়ারের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান... সবকিছু মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। মনে হয় ছোটখাট একটা স্কুল যেন। এই প্রতিষ্ঠা অবশ্য একদিনে হয়নি, পঁচিশ বছরের পরিশ্রমের ফসল। মনে পড়ে আগে সকালে দু'টো , বিকেলে তিনটে মোট পাঁচটা ব্যাচ পড়িয়ে এসেছে বরাবর। এমনকী  শনি-রবিবারও। এই দু'দিনে বরং আরও বেশি ক্লাস নিতে হত, কারণ স্কুল-কলেজ ছুটি থাকত।


      কোচিংয়ে এত মনোনিবেশ দেখে ওর একসময়কার মদের ঠেকের  বন্ধুরা প্রায়ই টিটকিরি দিত, ' কী রে, কোচিং আর বউয়ের আঁচলের তলা পেয়ে পুরনো বন্ধুদের ভুলে গেলি?' অশোক এসব কথা গায়ে মাখত না। মৃদু হেসে পাশ কাটাত সব। ওর তখন একটাই ধ্যান-জ্ঞান সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য  আনতে হবে, উপমাকে মানুষ করতে হবে। আর বেচারা অলি! অশোককে ভালোবেসে কী কষ্টের পথটাই না  বেছে নিয়েছে, সে কথাটাও কাজ করত অশোকের মাথায়, সব সময।


      পাড়ার বড়রাও কেউ কেউ অনেক সময় বিদ্রুপ করত, ' কী রে, অশোক  দিনরাত এত ছাত্র পড়াস, কোন দিন পাগল হয়ে যাবি। ' এ কথারও  যথারীতি কোনও  উত্তর দিত না অশোক। কেউ যদি কোনও  কাজ ভালোবেসে করে, তাহলে সেই কাজ করে সে কোনোদিন পাগল হয়ে যায় না। এই বিশ্বাস ওর ছিল। আজও আছে। কিন্তু শরীরটাই  ইদানীং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সুগার প্রেসার ধরেছে অনেকদিনই। প্রোস্টেটের সমস্যাও নাজেহাল করে তুলেছে। তাই ইদানীং  দু'একটা ব্যাচ পড়ালেই মাথা ঝিমঝিম করে। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। মনে হয় শুয়ে পড়ি। বিশ্রাম নিই। কবে যে উপমার কিছু একটা হবে !


   ' স্যর আমাদের হয়ে গেছে।' উঠে দাঁড়ায় শর্মিষ্ঠা ,অতনু।

   'ও আচ্ছা আচ্ছা, তোমরা টেবিলে রেখে চলে যাও।'

   ' টা-টা স্যর ' বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ওরা।   

    ' হ্যাঁ, টা-টা।'


    পরের ক্লাস শুরু হতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি। ঘর একেবারে ফাঁকা। কী করা যায় !  টেবিলেই  রাখা ছিল  এবং কথা, প্রিয় বসুন্ধরা, মিরুজিন, ভাষানগর প্রভৃতি কয়েকটা লিটিল ম্যাগাজিন।  মিরুজিন-এর পাতা উল্টাতে থাকল অশোক।  চোখ আটকে গেল তুষার চৌধুরীর একটা কবিতায় ------


পত্রমর্মরের দেশে 

তুষার চৌধুরী 


১ .

মধুরে প্রবেশ করি ,মূর্ছা যাই পাপড়ির কান্তারে 

বহু দূর হেঁটে দেখি অসীম অঞ্চল পড়ে আছে 

নগ্ন রাত,কালো ও জমাট রক্তনদী 

এ কোন সুড়ঙ্গে এসে খুলেছি পোশাক 

শতাব্দীর ইঁদুরেরা ছেড়ে গেছে পুরোনো আস্তানা 

অতীতের ক্রুদ্ধ যুবাঅথৈ ফুলের গর্ভে ঘুমিয়ে পড়েছে 

পত্রমর্মরের দেশে প্রকৃত জলের মতো অশ্রু ঝরে পড়ে 


চিতায় প্রবেশ করি ,হিম চিতা ,অগ্নি বেহদিশ

মনে হয় কবে যেন টিউনিসে খেয়েছি হাশিশ 

প্রাচীন প্রেমিকা আজ প্রবীণা ঘুগুর মতো 

          দূরে কোন অশনাক্ত বৃক্ষে বসে খসায় পালক 

মুখের ওপর মৃত্যু চোখ মেলে ঝুঁকে আছে যেন স্তনবৃন্তের গোলক 

বেঁচে আছি টের পাই ,সোঁদা গন্ধ জেগে ওঠে রাতে 

গুটিকয় মৎসবৃহন্নলা ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে নিরালা সৈকতে 

...................


      কবিতাটা পড়তে পড়তে কোন জগতে চলে যায় যেন অশোক। মেঘ কেটে গেলেও এখনও  দমকা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে। নারকেলগাছ  সুপারিগাছগুলো দুলছে হাওয়ায়। চোখে পড়ছে কোচিং-এর জানলা দিয়ে। হাওয়ার ভিতরে এইরকম দিনে কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পায় অশোক। হাওয়ার সাথে সাথে মনটা যেন উড়ে যায় কোথায়, কোন সুদূরে... সেখানে কেউ নেই.. কিছু নেই...অনন্ত শূন্যের ভেতর কে যেন দু'হাত বাড়িয়ে কেবলই ডাকে, ডেকে চলে। সে কি কবিতার রহস্যময় মায়াজড়ানো ডাক ? জন্ম-মৃত্যুর ওপারের বহুদূর ? সে কি আত্মার প্রতিরূপ কেউ ? নাকি সে বুকের ভেতর ওড়া হোমাপাখি ? সারাক্ষণ ছায়া ফেলে চেতনায়-অবচেতনায় ? অশোক ঠিক জানে না। কেবল টের পায় , ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে মাথা পেতে শুয়ে আছে সেই ডাক।

কবিতা উপন্যাস * দীপংকর রায়



 " বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল  ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় " লিখেছিলেন জীবনানন্দ । কবি দীপংকর রায়ের  কবিতা স্বতন্ত্রভাবে , অতলস্পর্শী ভাবনার গভীরতায় স্পর্শ করে  আমাদের চৈতন্যের নদী । দেশজ  আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে , বিরল পংক্তি বিন্যাসে এক মায়াময় ব্যতিক্রমী কবিতাজগৎ সৃষ্টি করেন তিনি । এখানে আমরা ধারাবাহিকভাবে পড়ছি তাঁর একটি কবিতা উপন্যাস । এবার অন্তিম পর্ব ।



কোথাকার অতিথি আমি ( মানস ভ্রমণ) 


কোথায় স্বজনেরা 

কেউ ডেকেছিল একদিন 

                  তার স্বপ্নে --

একা একা ভেসে বেড়াই, 

বলে দিতে পারে না কিছুই 

        এই জৈষ্ঠের রোদ 


পথকে করি রাতের বাসর। 

কোথাও স্বপ্ন-সুন্দরীদের দেখা নেই 

ভেসে থাকা আছে 

এক এক দিক থেকে 

এক এক রকম আত্মজিজ্ঞাসা ----

নিজস্ব সুখ অসুখে আঁচড়ে ফেলছে নিজেই নিজের বুক ?

কেউ কাউকেই চেনে না। 


সকাল-সন্ধ্যা নিজেরাই নিজেদের গুয়ে-মুতে মাখামাখি হয় 

কাটা-ছেঁড়া করে কার প্রত্যাশাগুলি সমস্ত রাত? 

মানুষ মানুষকে চেনে না !

অথচ মানুষ মানুষকে চিনতেই তো খোল-কর্তাল বাজায়, 

তিলক মাখায় হরিনামে ----


হাত ধোয়ার জল কই

মুখ ধোয়ার ;

খানিকটা সাবধান হয়ে পথে পথে ঘুরতে যেয়েই 

পথকে করেছি অচেনা ---

নিজেকে নিজে চিনতে পারি না কেন? 


আজ ঈদের নমাজ 

উৎসবের চাঁদই ঘোষনা দিল যেন, ঘরে থাকুন---

রাত শেষ করে, আবার মোনাজাতে, মানুষ মানুষকে একান্ত খুঁজে পাবে? 

সে কথাতেই প্রশ্ন ফুলমিঁয়ার :

ধান কাটা শেষ করে 

আজ তাই ঝাঁপিয়ে উঠল নবগঙ্গা ----  ?

তার ঈদ কী দিয়ে সম্পূর্ণ হবে যে ----

পঙ্গপাল আসছে নাকি ধেয়ে..... 

করোনার চাইতে বড় !

এই কথা কওয়াকয়ি হয় হাটে-বাজারে, খেয়া নৌকোয় ; 


বাতাস কাটি দুহাতে, মেঘে মেঘে চড়ে বেড়াই 

পদ্মা, মেঘনা , যমুনা, ধলেস্বরী, ইছামতী, গড়াই 

নাগর নদীর বাঁকে বাঁকে ;

যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাই

যেন এক ফুঁয়ে ছুঁয়ে আসি সব 

                                 

মন চাইলে হাঁটি, মন চাইলে গড়াই, ফসলের আলে আলে ...

পথের কোনায়, গাছের নিচেয় , নাহলে মগডালে --

কেউ নেই। সঙ্গে আছে শুধু ইচ্ছে-মুখের সারি--- ! 

যাকে খুশি ডাকি,  যাকে খুশি নিয়ে যাই মনপাখির 

             ডানায় ভাসিয়ে---

কতকাল আগের এক রাত-ভোর স্মৃতিতে দোমড়াই, 

হেসে হেসে  কুটি কুটি হই ,

নিজেই নিজের বুকের ভেতর ?

কাঁদি না। কান্না যেন আসে না কিছুতেই ।


গোপন সে অভিসার 

গতজন্মের কথোপকথন চলছে যেন এ জন্মের পথে পথে  ?

হু হু হাওয়ায়, রোদেরা ছোটে যেন হাওয়াদের বুকে করে 

কত দূরে যায়  

মেঘেদের ছায়ায় ছায়ায় ?


একটি ফড়িংএর ডানা কাঁপে দেখি, ভাটফুলের ডগায়,

আঁশটেল বনে পথের ধুলো লেগে, এমনই আবহ করায় মনে ,

 ' এই পথ তুমি কীভাবে 

            রেখে গ্যাছো '.... ?


দ্যাখো দ্যাখো 

একবার চোখ মেলে 

            চেয়ে দ্যাখো ---


কান্না ঘোরে হঠাৎ হাওয়ায়। 

ঘোরে , মেঘের ছায়ায় ছায়ায়  !

কাটা ফসলের ক্ষেতের উপর , সেই ছায়া নেমে আসে ----

মেঘ সরে যাওয়া হঠাৎ আলোদের সে যে কী 

            নাচনকোদন ;

সন্ধ্যা নামে, ঘর খুঁজি ----

খুঁজি, রাতের আশ্রয়.....


কার কাছে যাই 

কোন দিকে ঘোরাই মাস্তুল

কেউ ডাকে না !



রাত ভেঙে পড়ে  বাঁশ-জঙ্গলের মাথায়। 

রাত ভেঙ্গে পড়ে পথের ওপাশে, শিশু-কড়াই , জারুল, অশ্বত্থ ,শিমুল 

ইচ্ছেডানায় পাখা মেলে বসে পড়ে, অনেক রাতের 

                       প্যাঁচারা; 

বাদুরেরা ঠোঁটে ফেলে দেয় 

             রাতের খাবার ---


আত্মীয়রা কোথায় 

পরিজন? 

কে যে নিকট আত্মীয়, কে যে আমার প্রয়োজন -অপ্রয়োজনের সোহাগ কথা  ?

কেউ সাড়া দেয় না। অজানা অচেনা গাছেরা  পথ পাশে রাতের আশ্রয় দেয় ;


করোনা আতঙ্ক শিস দেয় মধ্যরাতের বাতাসে। 

এখানে কি খানিকটা খার পাবো? 

কীভাবে যে হাত ধুয়ে ফেলি , রাতের আহারের আগ  ?

রাত ভোর হতে না হতে 

গায়ে হাত রেখে ঘুম ভাঙিয়ে চলে গ্যালো প্যাঁচারা ,

বাদুরেরা ফেলে গ্যালো আধখাওয়া ফলের টুকরো ;

বুঝি , এই আমার আজকের আহার, এই আমার পাথেয় ---- ?


কোথাও পরিজন নেই। কোথাও আমন্ত্রণ আসে না  ।

আতঙ্কে,  নাকি সত্যি সত্যি এদেশে আর কেউ নেই আপনজন  ?

কেন যে দিই না সাড়া 

খন্দকার তো ডেকেছিল, 'ছায়ার খিদের জানলা খুলে..... '

কেন যে সাড়া দিই নি 

কেন যে দাঁড়ায়নি সামনে 


জবাব মেলেনি,  নিজের কাছে নিজেই ------

ইচ্ছে-পতঙ্গের ডানায় শব্দ হয়েছিল খানিক, পেতেওছিলাম কোল 

কেউ হাতটি দেয়নি গালে, মাথাটা রাখেনি, যেমন রেখেছিল কোনো এক কাল,

নিজস্ব প্রেরণায় -- নাকি প্রেরণার কাল বড়োই ক্ষণস্থায়ী  ? 

বুঝিনি ভাষা 

এ জন্মে আর যেন বুঝে ওঠার সময় নেই ;


সময় কি মুহূর্তের রং ?

সময় কি এই আসে, এই যায়---জোয়ারের জলে? 

নবগঙ্গা তুমিই বলো, এই সত্যটি কী দিয়ে গড়ো তুমি  

ঢেউয়ে ঢেউয়ে...... ;

ঢেউয়ে ঢেউয়ে এমনই 

                        নিস্তরঙ্গ সে--- ? 


রোজ যারা হাটে-বাজারে তোলা দোকান চালায় 

তাদের চোখে ঘুম নেই ।

শুয়ে-বসে কত আর চলে? 

বাঁধা দোকানের একই হাল, মুদি-মশলা ছাড়া 

কাঁচা বাজার চালায় যারা 

তারাই শুধু ,আতঙ্ক নিয়েও 

 শহরে বাজারে যায়----


এ চিত্র দু'পারেই সমান ----

কোথাও আলুপটল পাঁচ

তো কোথাও পঞ্চাশ ; 

কোথাও পচে ,  কোথাও আগলায় মানুষ ----

আবার এসব কিছুই নেই 

                কোথাও 

কেউ কারো ধারে না ধার 


গাছে গাছে, মেঘে মেঘে 

বাতাস কেটে ভাবি, কোথায় একাত্তর, কোথায় জরুরী কাল----? 

মুষ্টিবদ্ধ ;  যারা এতকাল তুললো সোরগোল , তাদের সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র , 

নিপাত যায় 

আমি তাহলে কীসের কাব্য করে তোমাকে হারাই? 

তুমি কি চালে-ডালে মুদি-মশলায় বেগুন-পটলে আজও রাখতে পেরেছ

সেই আমাদের ফুলে ফুলে ভেসে বেড়ানোর এক একটি মুহূর্ত ;----

পারোনি। পারোনি বলেই আমিও যাইনি তোমার গৃহে।

ডালে ডালে থমকে থেকেছি এমন রাতের অন্ধকারে,

বেপথ-বেভূঁই--  পাখপাখালির সঙ্গ করেছি এমন আতঙ্কের দিনে---;


যাবো কি যাবো না? 

ঘুরতে পারবো কি আর 

           ঘোরান মুখে? 

বাঁকানো ছায়ায় ফিরেছ যেমন,  নিঃসঙ্গ আয়নায়--

আয়না বলেনি কথা 

তুমিই বলিয়েছ তাকে 

কীভাবে রেখেছে সে নিজেকে নিজের মতো ?

দ্বিতীয় ভাগে, তৃতীয় সত্তায় ?


ফেরা আমার হলো কি 

ফেরাতে পারলে কি তুমি আমায় ?

তোমার মুখের ছায়ায় ভাঙতে ভাঙতে যে স্রোতের তলায় ডুবে গেলাম,

মাটি পাইনি, জল-শ্যাওলার গন্ধ নিয়ে পৃথিবীর

প্রথম প্রাণের গল্পে ঘুম এসেছিল খানিকটা ; ------ 

ঝিমে ঝিমে পার হলো কতো নাবিকের হাল ----

ডুবে ডুবে এসব সব দেখা হলো ;  ভেসে গ্যালো কতো ময়ূরপঙ্খী -----

কতো  যুদ্ধজাহাজ, কতো সভ্যতা এলো আর গ্যালো 

তবুও তোমার মুখটি হলো না পুরোনো 

আলো-বাতাশের এত কোলাহল, সবই তো নামলো নিচেয় ;

গান গেয়ে ফিরে গ্যালো কতো না উদাসী মন 

সব দেখা হলো। 


তবুও চিনতে পারিনি, বুঝতে পারিনি তুমি এসেছিলে না আসনি ?

ভুল ছায়ায় গুলতে গুলতে ফুরিয়ে ফেললাম সব জলছবি  ?

খণ্ড আকাশের ছায়া ধরে আজও ডুবে আছি, অধরা জ্যোস্নার সেই চাঁদটিকে নিয়ে---? 

তুমি কি আমার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিলে, প্রথম প্রাণের বিরহ---?

ঘুম এসেছিল খানিকটা! 


স্বপ্নগুলো মরে যায় প্রতিদিন, চেয়ে চেয়ে দেখি----

যেভাবে একটু একটু করে  দুহাতের শূন্যতার, সেও ভুল অর্থ করে ;

স্বপ্নদের লালিত্য এতটাই ধুসর  ?

সবটুকুই সামর্থবানের সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতন ; 


প্রতিটা সম্পর্কের গোড়ার সুতো এমনই জোড়া দেওয়া,

সবই ইঙ্গিতের কথোপকথন যেন ; 

প্রকৃতকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় বুঝি? 


হয়তো তাও ঠিক না, ভয়, সংশয়, অনিশ্চয়তা,

সবটা মিলেই এমনই এক কাণ্ড যা তোমাকে ভুল অর্থ বুঝতে বাধ্য করে ;

আমাদের বৌধিক সংসর্গগুলি ?


ঘুম এসেছিল খানিকটা...!


                                                        ( অন্তিম পর্ব )



প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * প্রেমেন্দ্র মিত্র


এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ /৩   সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন  প্রেমেন্দ্র মিত্র   |






 



মুখ

প্রেমেন্দ্র মিত্র


একটা মুখ কাঁদায় হয়ে শীতের রাতে পথে অনাথ শিশু,

মেলায় বাজিকরের খেলায় একটা মুখ মুখোস পরে হাসায়। 

খেয়ার নায়ে ওপারে যেতে কবে যে কোন ভিড়ে 

একটা মুখ এক নিমেষে অকূল স্রোতে ভাসায়!

কার সে মুখ কার? জানে কি তারা - ছিটোন অন্ধকার


সে মুখ যারা দেখেনি তারা জানে না জ্বালা নিদান যার নেই। 

শীতের দিনে পোহায় রোদ উঠোনে বসে আরামে কাঁথা গায়,

ঝুমকোলতা দেয়ালে তোলে,মরাই রাখে ভরে,

ফল কি ফুল পাড়তে শুধু নাগাল ডাল নামায়। 

হোক সে মুখ যার,

অনিদ রাতে কাঁপে না  অন্ধকার।


সে মুখ যার পড়েছে চোখে ঘরে-ই থাকে যায় না সে-ও বনে,

বসত করে পাঁচিল ঘিরে, হিসেব করে পুঁজি যা আছে ভাঙায়। 

তবুও কোন হতাশ হওয়া একটা ছেঁড়া ছায়া 

তারার ছুঁচে সেলাই করে রাত্রি জুড়ে টাঙায়।

কার সে ছায়া, কার?

প্রাণেশ্বরী পরমা যন্ত্রণার।।



গল্প * নিমাইচন্দ্র সাহা



জীবনের অপার আনন্দে উদ্ভাসিত গল্পকার নিমাইচন্দ্র সাহা-র কলম। বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো দোলনায় কী ভাবে এক বনের বুলবুল পাখি এসে বাসা বাঁধল এবং লেখক-এর মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীর দিনটিতেই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ধরা দিল এক চরম সত্য,তা এই ছোট গল্পটির প্রতিপাদ্য।   


গল্প নয় 

নিমাইচন্দ্র সাহা


আজ ২৭শে এপ্রিল ২০২১সাল। আজ উড়ে গেল পাখি। কোন পাখি? না, একটা বুলবুল পাখির বাচ্চা। ঠিক একমাস আগে, ২৬শে, মার্চ লক্ষ করি একটা বুলবুল পাখি আমাদের দক্ষিণের বারান্দায় লম্বা লম্বা শুকনো দূর্বা-ঘাস মুখে করে এনে রাখছে। কিন্তু বার বার পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। দূর্বা-ঘাস কোথায় রাখার চেষ্টা? বারান্দায় একটা দোলনা আছে। দু' দিকে ঝুলছে লোহার শিকল। ফুট-দুয়েক উঁচুতে কাঠের পাটাতনের উপর বসার জায়গা করা। বারান্দায় ছাদের মাঝখানে দোলনার ওপরে একটা লোহার 'S' ঝোলানো আছে। একটা ছোট্ট পাখা লাগাবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা আর লাগানো হয়ে ওঠে নি। লোহার ঐ 'S' টার উপরেই শুকনো দূর্বা-ঘাস এক একটা করে বারবার এনে রাখছে বুলবুল পাখিটা বাসা তৈরি করার জন্য, আর তা বারবার পড়ে যাচ্ছে নীচে। কদিন ধরে দেখছি, আর ভাবছি - ' ' ' কি বোকা পাখি টা।' ঘাটে শুয়ে জানলা দিয়ে দেখছি আর ভাবছি, - পাখি তুই কি সত্যি ই এতো বোকা? না, এটা তোর লোক- দেখানো 'বোকা-সাজা'।

শুধুই ছলনার আশ্রয় ?পক্ষী-বিশারদ সেলিম আলী, যার বিখ্যাত বই 'The Fall of a sparrow ' বেঁচে থাকলে তাকে শুধোতাম -'বুলবুল পাখি কি সত্যিই এত বোকা হয়?' কিন্তু তা যখন আর হবার   নয়, নিজেই মাথা ঘামাতে থাকি আপন মনে। একদিন, দু'দিন,তিনদিন গেল। কেবল দেখে যাচ্ছি পাখি টার চেষ্টা আর অধ্যাবসয়। ও যেন নেপোলিয়ান কে হারাবার যুদ্ধে অবতীর্ণ!


 বুঝতে পারি পাখি আমাকে বোকা বানিয়ে ফেলেছে এবং সুপরিকল্পিত ভাবেই। তাই এই পঁচাত্তরের যুবা কে , নিচুতলা থেকে ভারী কাঠের মইটা টেনে দোতলায় তুলতে বাধ্য করলো। সঙ্গে আনি খানিকটা লোহার সরু তার , তাই দিয়েই 'S' টার চারধার জড়িয়ে দিলাম ভালো করে। শুধুই খানিকটা তার পেঁচিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা! একটু  পরেই দেখি,শুরু হয়ে গেছে, পাখি টার খড়-কুট নিয়ে আসা।অবিরাম উৎসাহ ভরে ছোটাছুটি ....। হঠাৎ ই আবিষ্কার করি - ওর চালাকির কাছে একটা মানুষ হয়েও, কেমন হেরে গেলাম! ভাবতে থাকি - আমাদের সকলের মনের মধ্যেও এক একটা পাখি বাস করে। সে আমাদের ভাবায়, কাঁদায় আবার আনন্দ দিয়ে মুখে হাসিও ফোঁটায়। আর তার সাথেই চলে আমাদের আজীবনের আলাপন। না হলে, লালন সাঁই- গোঁসাই কেমন করে গাইতে পারেন -' খাঁচার ভিতর অচিন-পাখি ক্যমনে আসে যায়!' কিন্তু সে পাখি যে ধরা-ছোঁয়ারও বাইরে ! সাত-সকালেই ছোট্ট একটা বুলবুল-পাখি আমায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে  দিয়ে গেল। তুমি যতই যত্ন-আত্তি করো,বাসা বানিয়ে দাও একদিন ও ঠিক তোমায় ফাঁকি দিয়ে ,বাসা ছেড়ে, মায়ের সঙ্গে উড়ে পালাবে। তুমি আর তার নাগাল পাবে না। বুলবুল-পাখি নিয়ে পাশ্চাত্যের কবিরা বিখ্যাত সব কবিতা লিখে গেছেন। আমাদের এই বুলবুল পাখি কে ইংরেজিতে বলা হয়- Indian Nightingale.


 গত প্রায় একমাস ধরে একটা পাখি তার ছানা নিয়ে আমার সাথে একই ছাদের তলায় বসত করে গেল।মাত্র দু'দিনের মধ্যে বানিয়ে ফেলেছিল সুন্দর ও নিপুণ- ভাবে বোনা বাসা। গিন্নি আমায় বল্লে তার দিয়ে বাসা যখন বানিয়েই দিলে,আর একটু বড়ো করেই বানাতে পারতে। ঐ টুকু বাসায় পাখি ডিম পাড়বে, ডিমে তা দেবে, ডিম ফুটে ছানা বের হবে, তারাও আবার একটু একটু করে বড়ো হবে , তখন কে কোথায় থাকবে  বল দেখি! এই যা: তাই তো এতো কথা তো আগে কখনো ভাবিনি । মনে মনে ভাবলাম, একেই বলে মায়েদের সাংসারিক বুদ্ধি। মা- বুলবুলের সঙ্গে বিশ্বের মাতৃ-জাতিকে আর একবার গড় করি মনে মনে।

সন্ধ্যায় গিন্নি বল্লে, সেই সকাল থেকে সবকিছু ভুলে পাখির বাচ্চা নিয়ে কোথায় ডুবে আছো? আজ যে ২৭শে এপ্রিল মার প্রয়ান- দিবস! বড়ো মেয়ে সঞ্চিতা এই মাত্র মনে করিয়ে দিলে -এই সন্ধ্যায়! মনে করিয়ে দিলে বটে, কিন্তু আমরা যে প্রিয়-জনের মৃত্যু কে কখনও ভুলে থাকতে চাই নে। একমাত্র এই দুঃখটাকেই যত্নে মনের মণিকোঠায় স্মৃতি-রূপে ধরে রাখতে চাই। 'The sorrow for dead is the only sorrow which we refuse to divorce'.

 এক মা বুলবুলের, তার ছানা নিয়ে ভোরের নরম আলোয়, উন্মুক্ত-আকাশ উড়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দ, যদি আর একজনের মাতৃ-বিয়োগের বিরহ-ব্যাথা সারাটা দিনের জন্যে ভুলিয়ে রাখতে পারে, তাহলে বোধ করি কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না। নবারুণের সোনালী রশ্মি-বেয়ে যে আনন্দ-ধারা ছুটে যায় এক নতুন দেশে, সে যে সব দোষ-গুনের উর্দ্ধে। সে যে উর্দ্ধলোকের এক অপার্থিব দেশ।

 দেখি, সন্ধ্যার পর, মায়ের ছবি টেবিলে সাজানো সদ্যফোঁটা একরাশ বেলফুল দিয়ে। সবার অলক্ষ্যে করজোড়ে মাকে প্রণাম করি। অনাবিল-আনন্দ যে মৃত্যুকেও জয় করে নিতে পারে, আজ সন্ধ্যায়  তা আর একবার উপলব্ধি করলাম। সদ্যফোঁটা বেলফুলের সৌরভ ,কোন এক সূক্ষ-পথ ধরে, মনটাকে  মৃত্যু-লোকের উর্দ্ধে এক অমৃত-লোকে উত্তরণ করে দিল ! কতক্ষণ জানি না এই আনন্দে বিভোর হয়ে ছিলাম।

 পার্থিব দু,টি আঁখি আপনা হতেই কখন, কিছুক্ষণের জন্য মুদে আসে....। অন্তরে শুনতে পাই টুং টুং একতারার  মৃদু-স্বর । তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কে যেন গুনগুন করে গেয়ে চলেছে - ' খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, ক্যমনে আসে যায় .....।


                                                    .................................



 নিমাইচন্দ্র সাহা-র আঁকা কয়েকটি অসামান্য ছবি