ধুলোর সিংহাসন
পর্ব -- তিন
বৈশাখ মাস। এ বছর এখনও পর্যন্ত কালবৈশাখী চোখ রাঙায়নি। গত বুধবার দুপুরে এক ঝলক রুদ্র রূপ দেখিয়েছে মাত্র। সারা আকাশ কালো করে মেঘ শানিয়েছিল। রাতের অন্ধকার যেন ঢেকে ফেলল দুপুরের গাল চিবুক । দেখতে দেখতে উঠল ঝড়ো হাওয়া। হওয়ার দাপটে শুকনো পাতা আর ধুলোবালির প্রবল ঘূর্ণি। নিমেষে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল মেঘপুঞ্জ ।
আজও পশ্চিম আকাশ কালো করে মেঘ শানিয়েছে। দুই এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। অশোক প্রায় দৌড় লাগাচ্ছিল কোচিং-এর উদ্দেশে । পিছন থেকে জামা টেনে ধরল অলি, ' ছাতা নিলে না?' হাঁক পাড়ল, ' উপমা, চট করে বাবাইকে একটা ছাতা দে তো মা ।'
’ আরে ছাতা লাগবে না, এইটুকু তো রাস্তা, একদৌড়ে পৌঁছে যাব।'
' না না, ছাতা নিয়ে যাও, হঠাৎ করে আরও জোরে বৃষ্টি পড়লে কী করবে । ভিজে জামা কাপড়ে কোচিং-এ এতক্ষণ থাকবে কী করে।' উপমা দৌড়ে এসে বাবার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দেয়। দৌড় লাগায় অশোক। ছাত্র-ছাত্রীরা এতক্ষণে বোধ হয় তুমুল হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই কমপ্লেন করে ' অশোক তোমার ছাত্র -ছাত্রীদের একটু কন্ট্রোল করো। ' সবচেয়ে অসুবিধে দীপক ঘোষের। দীপক ঘোষ লোকাল থানার ওসি। যখন তখন পাড়ার যাকে তাকে পুলিশি মেজাজ দেখান। অশোককেও ছাড়েন না। রোজই প্রায় ডেকে হুমকির সুরে নালিশ করবেন ' অশোক, তোমার ছাত্রদের চিল্লামিল্লির জ্বালায় আমার ছেলেটার পড়াশুনো লাটে উঠতে বসেছে। এভাবে তো চলতে পারে না,একটা কিছু ব্যবস্থা করো, নাহলে ----'পরোক্ষ শাসানিটা হজম করে নেয় অশোক। মনে মনে ভাবে,ছেলে কতটা মেধাবী তা তো আমি জানি। আগে তো আমার কাছেই পড়ত।এইটেই দুবার ডাব্বা। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালায় অশোক।
বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ অশোকের কোচিং। সুভাষ পার্ক থেকে একটু এগিয়ে। বড় রাস্তার গায়েই। এটাই অশোকদের পৈত্রিক ভিটে। তিন কাঠা জমির উপর চার চালা টিনের বাড়ি। মাঝখানে তিন ইঞ্চি ইটের গাঁথনি ঘরটাকে দুভাগে ভাগ করেছে। পশ্চিম দিকটাতে মেজদা সুধীর থাকে ফ্যামিলি নিয়ে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওর মুদি দোকান। বড় রাস্তার পাশে হওয়ায় দোকানটা চলেও ভালো। পার্টিশনের পুব দিকটাতে থাকত অশোক।.ফ্ল্যাট কিনল তো এই সেদিন। বছরখানেকও হয়নি। এই বাড়িতে,এই ছোট্ট ঘরটাতেই কেটেছে অশোকের ছেলেবেলা থেকে প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়া অবধি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। অশোকের বিয়ে, উপমার জন্মও এই ভিটেতেই। কত স্মৃতি জড়িয়ে এই মাটির সঙ্গে। অশোক তখনও স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি, ওর বাবা মারা যান। বাবার স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। পাঁচ ভাইবোনকে প্রতিপালন করে সঞ্চয় বিশেষ কিছুই রেখে যেতে পারেননি,এই ভিটেটুকু ছাড়া। কিন্তু আবছা মনে পড়ে অশোকের, দাদা দিদিদের বাবা মাঝে মাঝেই বলতেন, ' অভাব-অনটন যতই থাকুক, সবসময় সত্য পথে চলবে। আর এই কথাটা মনে রাখবে সব সময়, ' সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। ' কথাটা কার জানো? বলে গলাটা একটু গম্ভীর করে নিজেই উত্তর দিতেন, ' স্বামী বিবেকানন্দের।'
অশোকদের জমিটা লম্বাটে ধরনের। চওড়ায় কুড়ি আর লম্বায় একশো আট ফুট। তবে জমিটা বড় রাস্তার গায়ে হওয়ায় বাজারদর অনেক। তা কাঠা প্রতি কুড়ি পঁচিশ লাখ তো হবেই । অশোকের বাবা জমিটা কিনেছিলেন উনিশশো সাতান্ন সালে পাঁচশো টাকা দিয়ে। পুরনো দলিলে দেখেছে অশোক। টিনের বাড়িটাও সেই সময়কার। বাবা-ই তৈরি করেছিলেন। এত বছরের ঝড় জল রোদ-বৃষ্টি সহ্য করে বাড়িটা আজ প্রায় জরাজীর্ণ। বিশেষ করে টিনের চালে জায়গায় জায়গায় জং ধরে হাঁ হয়ে আছে। প্রতিবছরই কালবৈশাখী শাসায়, বর্ষার জল মাস্তানি দেখায়। নিরুপায় অশোক টিনের ফুটো দিয়ে যে সব জায়গায় জল পড়ে, পিচচট লাগিয়ে কোনওরকমে মেরামতির চেষ্টা করে।
নিজের টিউশন নির্ভর জীবিকা, সরকারি চাকুরে বড়দা নির্মাল্য বোসের অন্যত্র বাড়ি করে চলে যাওয়ার পর, ওদের দুই ভাইয়ের পক্ষে এখানে বাড়ি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালসের যা দাম। বাড়ির এই জীর্ণদশা দেখে অশোক দু-একবার বাড়িটা প্রমোটিং-এও দেওয়ার চেষ্টা করেছে। পাড়ার অনেকেই অশোককে ভালবাসে ওর শান্ত স্বভাবের জন্য। একসময় ও পাড়ার সুভাষ সংঘের সেক্রেটারিও ছিল। ওই ক্লাবেরই ছেলে দুলাল আর মানিক। ওরা জমি-বাড়ির দালালি করে। ওরাই একবার, তা বছর দশেক আগে তো হবেই, এক প্রোমোটারের সঙ্গে অশোকের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। প্রোমোটার জানতে চেয়েছিল, মনে পড়ে অশোকের ' আপনাদের ডিমান্ড কী? ' অশোক দাদাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানিয়েছিল, তিন ভাই আর ছোট বোন লীনার জন্য টু বেড রুমের চারটে ফ্ল্যাট আর পাঁচ লাখ টাকা। বড় বোন অপর্ণা পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ নেবে না, আগেই জানিয়েছিল। আসলে অপর্ণা চেয়েছিল বাবার কেনা জমিতে দীর্ঘ চল্লিশ বছরের দৈন্যদশা ঘুচে সেখানে একটা বড় কিছু ডেভলপমেন্ট হোক। অশোকও তাই চেয়েছিল। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না ' কপালে না থাকলে ঘি ঠক ঠকালে হবে কী ' শেষ পর্যন্ত সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। জমির মাপজোক করে প্রোমোটারের আর্কিটেক্ট জানাল, চওড়ায় ছোট হওয়ায় এ জমিতে প্রমোটিং সম্ভব নয়। ফ্ল্যাট করা যাবে না তা নয়, কিন্তু প্রায় কোটি টাকা ইনভেস্ট করে আমাদের লাভ বিশেষ কিছুই থাকবে না। কথাটা শুনে কী যে খারাপ লেগেছিল অশোকের, আজও মনে পড়ে।
টিনের চার চালা বাড়িটার সামনে বেশ খানিকটা উঠোন ছেড়ে এই জমিরই ঠিক মাঝখানে একটা বড় বেড়ার ঘর, উপরে টালি, মধ্যিখানে বেড়ার পার্টিশান। ও পাশে ছেলেকে নিয়ে থাকে বিধবা বোন লীনা। এপাশে অশোকের কোচিং। ঘরটা বেশ বড়সড়। একসঙ্গে পঁচিশ-তিরিশ জন বসতে পারে। পুবমুখো একটা প্লাস্টিকের চেয়ার। তার সামনে একটা ছোট টেবিল। টেবিলটার বাঁ দিকে বেড়া ঘেঁষে একটা ছোট কাঠের আলমারি। টেবিলের উপর ডাঁই করা গাদাগুচ্ছের খাতা বইপত্তর চক ডাস্টার আর একটা শক্তপোক্ত বেতের লাঠি। টেবিল চেয়ারের উল্টো দিকে বেড়ার দেয়াল ঘেঁষে একটা হোয়াইট বোর্ড । বেড়ায় গোঁজা একটা হোয়াইট বোর্ড মার্কার। আর টেবিলটার সামনে আড়াই ফুট উঁচু তিন ফুট চওড়া বেশ বড়সড় একটা টেবিল। বড় টেবিলটার দু'পাশে দুটো বেঞ্চ। তাতে দুদিকে পাঁচ পাঁচ দশজন বসতে পারে। আর অশোকের টেবিলের সোজাসুজি উল্টোদিকে আরও একটা ছোট বেঞ্চ পাতা। ওই বেঞ্চটাতেও গাদাগাদি করে তিন জন বসে। ছাত্র-ছাত্রী বেশি হলে মেঝেতে বসে পড়ে মাদুর পেতে। এতে অবশ্য ওদের কোনও অভিযোগ অনুযোগ নেই ।বরং নীচে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তাতে খানিকটা স্যরের আড়ালে থাকা যায় ।
কোচিং-এ ঢোকার মুখে দরজার উপর একটা বড় ব্যানার ঝোলানো । অশোকের কোচিং-এর বিজ্ঞাপন। বড় বড় করে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে ----
তপোবন কোচিং সেন্টার
এখানে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি (সকল বিষয়)
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি (কলা বিভাগ)
এবং
বিএ পাস ও অনার্স (ইতিহাস ও বাংলা)
যত্নসহকারে পড়ানো হয়
* ছোটদের জন্য আঁকা এবং আবৃত্তি শেখানোর ব্যবস্থা আছে *
যোগাযোগ : অশোক বোস
ফোন নম্বর ---- ৯৯০৩২৫৭৫৬৬
ঠিক এইরকমই আরও দু'তিনটে ব্যানার টাঙানো আছে বড় রাস্তার এ -মাথায় ও -মাথায়।
বৃষ্টি আর বিশেষ পড়ছে না। ছাতা বন্ধ করে অশোক। প্রায় পৌঁছে গেছে। খানিকটা দূর থেকে চোখে পড়ে কোচিং-এর মুখটাতে পায়েল শুভ অতনু শংকর রিম্পা... বিএ ক্লাসের প্রায় জনা দশেক ছাত্র-ছাত্রী হাসি-ঠাট্টাতে মশগুল।
অশোককে দেখেই ওরা দৌড় লাগাল। কোচিং-এ ঢুকে যে যার জায়গায় বসে পড়ল। অশোকও প্রায় ওদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঢুকল । হাত ঘড়িটার দিকে তাকায় এক ঝলক ৫-৩৫ মি। ভেতরে ভেতরে আঁতকে ওঠে অশোক। এই ব্যাচটা হওয়ার কথা ছিল পাঁচটা থেকে সাতটা। ইতিমধ্যেই ৩৫ মিনিট লেট। তারপর আসবে ক্লাস টুয়েলভ, সাতটা থেকে ন'টা। পরেরটা ক্লাস টেন, ন'টা থেকে সাড়ে দশটা। প্রতিটি ব্যাচ থেকে দশ পনের মিনিট কাটছাঁট করে সাড়ে দশটার মধ্যে রোজ পড়ানো শেষ করে । আজ ইতিমধ্যেই ৩৫ মিনিট লেট। প্ল্যান কষতে থাকে অশোক মনে মনে, কী করে এই সময়টাকে মেকআপ দেওয়া যায়। বাড়ি গিয়ে আবার উপমাকে নিয়ে বসতে হবে। মে-র ২০ তারিখ থেকে ওর থার্ড ইয়ার ফাইনাল।
শারীরিক ধকল যতই হোক, বাড়ি ফিরে ওকে গল্পচ্ছলে পল সায়েন্স, হিস্ট্রির দু' একটা চ্যাপ্টার বোঝাতেই হবে । সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্টটা ওর তত ভালো হয়নি। থার্ড ইয়ারে চাপটা একটু কম। এবার একটু খেটে খুটে ৬০% এর উপর নম্বর তুলতে পারলে ,এভারেজে হয়ত ৫০% মার্কস থাকবে। ৬০% এর কম হলে না পাবে রেগুলারে এম এতে চান্স, না পারবে বিএড করতে।
আর দেরি না করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় অশোক, ' আচ্ছা, পায়েল শুভ...আজ কী পড়া আছে যেন আমাদের ?'
' স্যর আজ কোনও পড়া নেই ' ওদের চটজলদি উত্তর।
'সে কী ! পড়া নেই কেন? মনে করো, আমার কিন্তু ঠিক মনে আছে। '
' না স্যর , আজ নোটস লেখাবেন বলেছিলেন।'
' কোন চ্যাপ্টার ?'
' সুলতানি প্রিয়র্ড, মেডিয়াভেল ইন্ডিয়া থেকে।' মেডিয়াভেল ইন্ডিয়া,সুলতানি প্রিয়র্ড? সেটা তো গত শুক্রবারের ক্লাসেই কমপ্লিট হয়ে গেছে।'
সবাই চুপ।
' আচ্ছা শর্মিষ্ঠা,তুমি বলতো আজ কী পড়া? শর্মিষ্ঠা একমনে মুখ গুঁজে নোটসের খাতার পাতা উল্টাচ্ছিল। সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ' সত্যি কথাটা বলে দিই? ' কারও উত্তর দেওয়ার আগেই অশোক বলল, ' হ্যাঁ বলো, সেটা শোনার জন্যই তো তোমাকে প্রশ্নটা করলাম। '
' স্যর আজ সুলতানি প্রিয়র্ড এগজাম নেওয়ার কথা ছিল, আর যে যা-ই নম্বর পাক না কেন,খাতা সই করিয়ে আনতে হবে ,বলেছিলেন।' সবাই শর্মিষ্ঠার দিকে চোখ বড় বড় করে শাসাতে থাকে দাঁত কিড়মিড় করে, ' দাঁড়া তোর হচ্ছে, কী প্ল্যান করলাম, আর ও কী বলছে।' সমস্বরে রাগতভাবে বলল পায়েল, রিম্পা।
' তোমরা শর্মিষ্ঠাকে শাসাচ্ছ কেন, ও তো সত্যি কথাই বলছে।'
' না স্যর ,আমরা প্ল্যান করেছিলাম...'
' কী, কী প্ল্যান করেছিলে তোমরা, বলো। '
' স্যর আজ আমরা পরীক্ষা দেব না, কারও ঠিকঠাক প্রিপারেশন হয়নি।'
' কেন, হয়নি কেন? '
' কী বড় বড় উত্তর স্যর, এক একটা চার পাঁচ পৃষ্ঠা '
' এক একটা প্রশ্নে কুড়ি নম্বর করে থাকে, উত্তরটা বড় হবে না ? তোমরা কি এখন নাইন টেনে পড়? '
' তা-ও স্যর, একটা সুযোগ দিন, সামনের ক্লাসে ঠিক পরীক্ষা দেব।'
শর্মিষ্ঠা ছাড়া আর কারোরই পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে নেই, বুঝতে পারে অশোক। ' ঠিক আছে একটা সুযোগ দিলাম, কিন্তু আর এরকম করবে না। ফাইনাল পরীক্ষার দিন তোমাদের প্রিপারেশন হয়নি বলে কি সি ইউ পরীক্ষা পিছিয়ে দেবে, বলো?
'না স্যর।'
' তবে? '
' আর হবে না স্যর।'
' ঠিক আছে, সবাই খাতা বার করো।
' কী করাবেন স্যার?'
' এমনি একটা উত্তর লিখতে দেব। খাতা সই করাতে হবে না। কিন্তু নম্বর দেব।'
' ওকে স্যার,ওকে ' সবাই ভীষণ খুশি।
ঘড়িটার দিকে আর একবার তাকিয়ে, অশোক মনে মনে হিসেব কষে, এখন ছ'টা। আধঘণ্টা সময় দেবে ওদের, মিনিট পনেরোর মধ্যে খাতা দেখে সাতটার মধ্যে ছেড়ে দেবে। তাহলে লেট হওয়ার সময়টা মেকআপ হয়ে যাবে। পরের দুটো ব্যাচ আজ দু'ঘণ্টা করে না পড়িয়ে, দেড় ঘন্টা দেড় ঘন্টা পড়াবে। তাহলে বাড়ি গিয়ে উপমাকে নিয়ে একটু বসতে পারবে।
' বলুন স্যর, প্রশ্নটা ? '
' সবাই রেডি তো ? '
' হ্যাঁ স্যার। '
' বেশ লেখ, আলাউদ্দিন খিলজির সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা..'
' বাবাই ! ' উপমার গলা। তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা শেষ করে অশোক, ' নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জানো সংক্ষেপে লেখ, ' একটু থেমে, ' হয়েছে সবার ?'
' হ্যাঁ স্যর। '
' শুরু করো, টাইম কিন্তু আধঘন্টা।'
' স্যার ,এত বড় উত্তর আর আধঘন্টা টাইম,হবে?' শর্মিষ্ঠা প্রশ্ন তোলে।
' যা হয়, এই সময়ের মধ্যেই আজ লিখতে হবে, শর্মিষ্ঠা ' বলতে বলতে বাইরে বেরোয় অশোক। উপমা দাঁড়িয়ে। পাশের ফ্ল্যাটের এক পুচকে রনিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অশোক রনির গালটা টিপে আদর করতে করতে বলে, 'পড়া বাদ দিয়ে তুই এলি ?'
' মা পাঠাল তো ' বলেই প্লাস্টিকে মোড়া একটা স্টিলের গ্লাস অশোকের হাতে দিয়ে বলল, ' তোমার চা। ' ও আচ্ছা, দে, রনিকে নিয়ে এসেছিস, ওর মা জানে তো ?'
' হ্যাঁ ওর মা-ই তো বলল, যা উপমাদিদির সঙ্গে ও একা একা যাবে, একটুখানি তো পথ,এখুনি চলে আসবি।'
' বাবাই, আমরা আসছি ' বাড়ির দিকে পা বাড়ায় ওরা।
'শোন মা। '
' হ্যাঁ বলো। '
' টিভি দেখবি না, মোবাইল ঘাটবি না, বাড়িতে গিয়েই একমনে পড়তে বসবি কিন্তু, আর ক'টা দিন বাদেই তো ফাইনাল পরীক্ষা।'
' হ্যাঁ রে, বাবা, জানি তো। '
' ঠিক আছে আমি বাড়ি গিয়ে পল সায়েন্সের দু'টো উত্তর ধরব কিন্তু। '
' কোন দুটো ?'
এর মধ্যে ভুলে গেলি? পরশুদিন তো বুঝিয়ে দিলাম...ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আর জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা।'
' ও আচ্ছা, মনে পড়েছে মনে পড়েছে। আসছি।'
'এস, মনে থাকে যেন।'
' হ্যাঁ থাকবে।'
ওরা চলে যায়। অশোক টেবিলে গিয়ে বসে। ফিসফাস শব্দ। পায়েল খোঁচাচ্ছে শর্মিষ্ঠাকে 'একটু বল না, প্রথম পয়েন্টটা যেন কী ছিল? '
' কী করে বলব, স্যর বসে আছে না?' বিরক্ত শর্মিষ্ঠা।
অশোকের গলা গম্ভীর হয়, ' কথা বলো না, তাহলে কিন্তু খাতা নিয়ে নেব।'
সবাই চুপ।
' বাবাই একটু শোনো ' ফের উপমার গলা ! এই তো বাড়ি গেল।
' কী রে , ফিরে এলি?'
' বাবার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে উপমা, ' মা বলেছে, ফেরার সময় দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল নিয়ে যেতে।'
' আচ্ছা তোমরা যাও।'
টেবিলে গিয়ে চুপচাপ বসে অশোক। হাত একেবারেই খালি। মানিব্যাগে দশটা টাকা পড়ে আছে। দু'দিন আগেই ফ্ল্যাটের ই এম আই কেটেছে। আজ মাসের ১২ তারিখ। যা মাইনে পেয়েছিল কুড়িয়ে কাচিয়ে ই এম আই-টা দেওয়া হয়েছে। এখনও মাসকাবারি বাজার কিছুই হয়নি। হাতে একটু পয়সা নেই। এ টি এম থেকে তুলবে, তারও উপায় নেই। ব্যাংকে হাজার টাকা মতো পড়ে আছে। ওর থেকে তুললেই ব্যালেন্স ফলের জন্য ফাইন কাটবে। শেষমেশ ধারেই নিতে হবে, মেজদার দোকান থেকে। অবশ্য যদি আজ কেউ মাইনে দেয় আলাদা কথা। এখনও পর্যন্ত এরা কেউই তো দিল না।
অশোক এত লাজুক,মুখ চোরা কাউকে মুখ ফুটে মাইনে চাওয়ার কথা বলতে পারে না। পনেরো কুড়ি তারিখ হয়ে যায়, অনেকেই মাইনে দেওয়ার নাম করে না। কারও কারও দু'মাস তিন মাস বাকি পড়ে যায়। তবু চায় না। অবশ্য অনেকেই একসাথে টাকাটা দিয়ে দেয়। কেউ কেউ আবার দিচ্ছি দেব করে পাঁচ-ছ মাস কাটিয়ে দেয়। এই যেমন তাপস বণিক, বি এ থার্ড ইয়ার। ওর বাবা একদিন ফোন করে বলল, ' স্যর মাইনেটা বাকি পড়ে যাচ্ছে, কিছু মনে করবেন না, কোম্পানির অবস্থা ভালো না। উইথআউট পে হয়ে যাচ্ছি। পেলে আপনাকে ঠিক একবারে সব দিয়ে আসব। একটু কনসিডার করবেন স্যর।' বলল, কিন্তু ছ'মাস কাটলে দেখা গেল তাপস আর পড়তে আসছে না। বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করতে ওরা বলল, ' স্যর তাপস কোচিং ছেড়ে দিয়েছে ও রায় কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। এই সময়টা অশোকের বুকটা ধক করে ওঠে।
এসব ক্ষেত্রে অলি বলে, ' তুমি এক মাস দু'মাস থাকতে চাও না কেন ? তাহলে তো ছ'মাসের টাকা আর পরিশ্রমটা জলে যায় না। অলি হয়তো ঠিকই বলে। কিন্তু অশোক তা পারে না। আসলে ওর পেশাটা তো অন্য ব্যবসার মতো নয় ঠিক। জামার কলার ধরে বলবে, '১০ তারিখের মধ্যে টাকা না দিলে দেখে নেব। ' আবার কোনও কোনও গার্জিয়ান ছেলে-মেয়ের মাইনে দিতে এসে বলবে, ' স্যর টাকাটা গুনে নিন।' অশোক আজ পর্যন্ত কোনওদিন কোনও ছাত্র-ছাত্রী বা গার্জিয়ানদের সামনে গুনে গুনে টাকা পকেটে ঢোকায়নি। যেমন দেয় তেমনি পকেটে রাখা থাকে । পরে আড়ালে গুনে দেখে ঠিক আছে কি না।
' স্যর হয়ে গেছে ' পায়েল খাতা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
'এর মধ্যে হয়ে গেল ?'
' না স্যর, পুরোটা পারিনি।' ঠিক আছে দিয়ে দাও। খাতাটা হাতে নিতে নিতে ভাবে, পায়েল এ মাসের মাইনেটা এখনও দেয়নি। ও তো এত দেরি করে না। আজ কী দেবে, কে জানে ! মুখে বলে, ' বাড়িতে পড়ো কিন্তু, পরদিন যেন এরকম না হয়, তাহলে বাবাকে ----'
' না স্যর না স্যর ,বাবাকে ফোন করতে হবে না, পড়ব, পরদিন ঠিক পড়ব। তাহলে আজ যাই স্যার ? '
' বাবা'কে ফোন করার উদ্দেশ্য পড়াশুনার কথা জানানো নয়, বাবার কথা বললে যদি পায়েলের মনে পড়ে মাইনেটা দেওয়ার কথা। বাড়ি থেকে টাকা দিয়ে দিলেও ওরা অনেক সময় দিতে দেরি করে। নানা ফন্দি-ফিকির আঁটে। নতুন কলেজে যাচ্ছে তো ! কেউ কেউ আবার এক-দু'মাসের টাকা বেমালুম হজম করে ফেলে। অশোক মনে করালে দিব্যি অস্বীকার করে, বলে, ' স্যর আমি তো দিয়ে দিয়েছি। ' এ যে কত বড় জলজ্যান্ত মিথ্যে তা অশোকের চেয়ে আর কেউ জানে না। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারে না মুখ ফুটে । গার্জিয়ানকেও জানায় না। জানালে হিতে বিপরীত হয়। গার্জিয়ানরা ওদের বকাঝকা করে। পরিণামে দু-চারজন কোচিংই ছেড়ে দেয়। তার চেয়ে এক দু' মাসের ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করে অশোক।
' যাই স্যর ' অশোক অন্যমনস্ক দেখে অধৈর্য পায়েল।
' একটু বসো না , সবাই খাতা জমা দিক, একসাথে যাবে।' বাবা টাকাটা দিয়ে থাকলে ততক্ষণে যদি পায়েলের মনে পড়ে।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে হিসাবের খাতাটা বার করে অশোক দুই হাতে আড়াল করে দেখতে থাকে, হ্যাঁ এইতো বিয়ে ফার্স্ট ইয়ারের পনেরো জনের নাম পরপর লেখা। বারোজনের ক্লিয়ার।পায়েল, সুমিত শংকর তিনজন এখনও বাকি। তিন জনের একজনও যদি দেয়,তাহলে ....
আর যদি না দেয়, তাহলে পরের দু'টো ব্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শেষমেশ কারও কাছ থেকেই যদি কিছু না পাওয়া যায় তাহলে ধারেই নিতে হবে, ভাবে অশোক। অলি ধারে খাওয়া একদম পছন্দ করে না। ওর মত, থাকলে খাব,না থাকলে খাব না । অলির যুক্তি ,ধারে খেলে বেশি খাওয়া হয়, তাছাড়া দোকানদারেরও জল মেশানোর সুযোগ থাকে । সব সময় কি আর পাই টু পাই হিসাব মনে রাখা সম্ভব ,যতই হিসাবের খাতা থাকুক না কেন।
' হয়ে গেছে স্যার ' প্রায় সবাই খাতা হাতে উঠে দাঁড়ায়। শর্মিষ্ঠা আর অতনু তখনও লিখে চলেছে। ' ওরা পন্ডিত হবে, ফার্স্ট ক্লাস পাবে ভাই ! ' পাশ থেকে ফোড়ন কাটে রিম্পা, শঙ্কু।
লিখুক না তোমাদের কী ক্ষতি? এখনও মিনিট পাঁচেক সময় আছে। তোমরা খাতা জমা দিয়ে বাইরে দাঁড়াও।
' খাতা আজ দেখবেন না স্যর? '
' না খাতা পরদিন দেখব, দুটো একসাথে গার্জিয়ানকে দিয়ে সই করিয়ে আনবে।'
' না স্যর হবে না,আপনি বললেন যে আজকেরটা সই করাতে হবে না।'
' ও বলেছি বুঝি! ' অশোক মুচকি হাসে। ছাত্র -ছাত্রীদের সঙ্গে ওর সহজ সম্পর্ক। ' আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। '
' থ্যাঙ্ক ইউ স্যর ' দুদ্দাড় করে বেরিয়ে পড়ে ওরা সবাই।
সাতটা বাজতে পঁচিশ। টুয়েলভের ব্যাচ আসবে সাতটায়। হাতে এখনও পঁচিশ মিনিট সময়। কোথায় ভেবেছিল এই ব্যাচটা শেষ করতে লেট হয়ে যাবে। সেখানে কী কায়দায় ম্যানেজ করল। উল্টে পঁচিশ মিনিট আগেই শেষ করল ক্লাসটা। বলা যায় খানিকটা ফাঁকিই দিল আজ। আগে এরকম করত না অশোক। ঘড়ি ধরে ও কোনদিনই পড়ায় নি। এতটাই তনময় হয়ে পড়াত কখন দু'ঘণ্টা কেটে যেত, বুঝতেই পারত না। গার্জিয়ানরা এসে অপেক্ষা করত। ছাত্ররা উসখুস করত ছুটির জন্য। কিন্তু অশোক পড়িয়েই চলেছে। আসলে অশোক পড়াতে ভালোবাসত। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা বন্ধুর মত। আর ওর অমায়িক ব্যবহারের জন্য এই অঞ্চলে তপোবন কোচিং সেন্টার এবং অশোক স্যরকে সবাই এক ডাকে চেনে। ভালোও বাসে। তাই ওর কোচিংয়ে সব সময়ই ছাত্র-ছাত্রী গমগম করে। করবে নাই-বা কেন, ছাত্র-ছাত্রীদের মনের কথা অশোক পড়তে পারে। শীতের সময় সময় বছরে একবার ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে ট্যুরে যায়। পঁচিশে বৈশাখ ,শিক্ষক দিবস ,স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে সাড়ম্বরে। নাচ-গান নাটক...সরস্বতী পুজোয় টেন , টুয়েলভ এবং থার্ড ইয়ারের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান... সবকিছু মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। মনে হয় ছোটখাট একটা স্কুল যেন। এই প্রতিষ্ঠা অবশ্য একদিনে হয়নি, পঁচিশ বছরের পরিশ্রমের ফসল। মনে পড়ে আগে সকালে দু'টো , বিকেলে তিনটে মোট পাঁচটা ব্যাচ পড়িয়ে এসেছে বরাবর। এমনকী শনি-রবিবারও। এই দু'দিনে বরং আরও বেশি ক্লাস নিতে হত, কারণ স্কুল-কলেজ ছুটি থাকত।
কোচিংয়ে এত মনোনিবেশ দেখে ওর একসময়কার মদের ঠেকের বন্ধুরা প্রায়ই টিটকিরি দিত, ' কী রে, কোচিং আর বউয়ের আঁচলের তলা পেয়ে পুরনো বন্ধুদের ভুলে গেলি?' অশোক এসব কথা গায়ে মাখত না। মৃদু হেসে পাশ কাটাত সব। ওর তখন একটাই ধ্যান-জ্ঞান সংসারে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আনতে হবে, উপমাকে মানুষ করতে হবে। আর বেচারা অলি! অশোককে ভালোবেসে কী কষ্টের পথটাই না বেছে নিয়েছে, সে কথাটাও কাজ করত অশোকের মাথায়, সব সময।
পাড়ার বড়রাও কেউ কেউ অনেক সময় বিদ্রুপ করত, ' কী রে, অশোক দিনরাত এত ছাত্র পড়াস, কোন দিন পাগল হয়ে যাবি। ' এ কথারও যথারীতি কোনও উত্তর দিত না অশোক। কেউ যদি কোনও কাজ ভালোবেসে করে, তাহলে সেই কাজ করে সে কোনোদিন পাগল হয়ে যায় না। এই বিশ্বাস ওর ছিল। আজও আছে। কিন্তু শরীরটাই ইদানীং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সুগার প্রেসার ধরেছে অনেকদিনই। প্রোস্টেটের সমস্যাও নাজেহাল করে তুলেছে। তাই ইদানীং দু'একটা ব্যাচ পড়ালেই মাথা ঝিমঝিম করে। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। মনে হয় শুয়ে পড়ি। বিশ্রাম নিই। কবে যে উপমার কিছু একটা হবে !
' স্যর আমাদের হয়ে গেছে।' উঠে দাঁড়ায় শর্মিষ্ঠা ,অতনু।
'ও আচ্ছা আচ্ছা, তোমরা টেবিলে রেখে চলে যাও।'
' টা-টা স্যর ' বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ওরা।
' হ্যাঁ, টা-টা।'
পরের ক্লাস শুরু হতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি। ঘর একেবারে ফাঁকা। কী করা যায় ! টেবিলেই রাখা ছিল এবং কথা, প্রিয় বসুন্ধরা, মিরুজিন, ভাষানগর প্রভৃতি কয়েকটা লিটিল ম্যাগাজিন। মিরুজিন-এর পাতা উল্টাতে থাকল অশোক। চোখ আটকে গেল তুষার চৌধুরীর একটা কবিতায় ------
পত্রমর্মরের দেশে
তুষার চৌধুরী
১ .
মধুরে প্রবেশ করি ,মূর্ছা যাই পাপড়ির কান্তারে
বহু দূর হেঁটে দেখি অসীম অঞ্চল পড়ে আছে
নগ্ন রাত,কালো ও জমাট রক্তনদী
এ কোন সুড়ঙ্গে এসে খুলেছি পোশাক
শতাব্দীর ইঁদুরেরা ছেড়ে গেছে পুরোনো আস্তানা
অতীতের ক্রুদ্ধ যুবাঅথৈ ফুলের গর্ভে ঘুমিয়ে পড়েছে
পত্রমর্মরের দেশে প্রকৃত জলের মতো অশ্রু ঝরে পড়ে
চিতায় প্রবেশ করি ,হিম চিতা ,অগ্নি বেহদিশ
মনে হয় কবে যেন টিউনিসে খেয়েছি হাশিশ
প্রাচীন প্রেমিকা আজ প্রবীণা ঘুগুর মতো
দূরে কোন অশনাক্ত বৃক্ষে বসে খসায় পালক
মুখের ওপর মৃত্যু চোখ মেলে ঝুঁকে আছে যেন স্তনবৃন্তের গোলক
বেঁচে আছি টের পাই ,সোঁদা গন্ধ জেগে ওঠে রাতে
গুটিকয় মৎসবৃহন্নলা ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে নিরালা সৈকতে
...................
কবিতাটা পড়তে পড়তে কোন জগতে চলে যায় যেন অশোক। মেঘ কেটে গেলেও এখনও দমকা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে। নারকেলগাছ সুপারিগাছগুলো দুলছে হাওয়ায়। চোখে পড়ছে কোচিং-এর জানলা দিয়ে। হাওয়ার ভিতরে এইরকম দিনে কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পায় অশোক। হাওয়ার সাথে সাথে মনটা যেন উড়ে যায় কোথায়, কোন সুদূরে... সেখানে কেউ নেই.. কিছু নেই...অনন্ত শূন্যের ভেতর কে যেন দু'হাত বাড়িয়ে কেবলই ডাকে, ডেকে চলে। সে কি কবিতার রহস্যময় মায়াজড়ানো ডাক ? জন্ম-মৃত্যুর ওপারের বহুদূর ? সে কি আত্মার প্রতিরূপ কেউ ? নাকি সে বুকের ভেতর ওড়া হোমাপাখি ? সারাক্ষণ ছায়া ফেলে চেতনায়-অবচেতনায় ? অশোক ঠিক জানে না। কেবল টের পায় , ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে মাথা পেতে শুয়ে আছে সেই ডাক।