+9
শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি
স্বামী বিবেকানন্দ
৩)
সর্বাত্মানুভূতি
[ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে এক দিবস অদ্বৈত বিজ্ঞানের জীব-ব্রহ্মের ঐক্য সূচক অনেক কথা বলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র ঐসকল কথা মনোনিবেশ পূর্বক শ্রবণ করিয়াও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না এবং ঠাকুরের কথা সমাপ্ত হইলে হাজরা মহাশয়ের নিকট উপবিষ্ট হইয়া পুনরায় ওই সকল কথার আলোচনা পূর্বক বলিতে লাগিলেন, 'উহা কি কখনও হইতে পারে? ঘটিটা ঈশ্বর, বাটিটা ঈশ্বর। যাহা-কিছু দেখিতেছ এবং আমরা সকলে ঈশ্বর?' হাজরা মহাশয়ও নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগদান করিয়া ঐরূপ ব্যঙ্গ করায় উভয়ের মধ্যে হাস্যের রোল উঠিল। নরেন্দ্রকে হাসিতে শুনিয়া ঠাকুর বাহিরে আসিলেন এবং 'তোরা কি বলছিস রে?' বলিয়া হাসিতে হাসিতে নিকটে আসিয়া নরেন্দ্রকে স্পর্শ করিয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন।]
ঠাকুরের ঐদিনকার অদ্ভূত স্পর্শে মুহূর্তমধ্যে ভাবান্তর উপস্থিত হইল। স্তম্ভিত হইয়া সত্য সত্যই দেখিতে লাগিলাম, ঈশ্বর ভিন্ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কিছুই আর নাই। ঐরূপ দেখিয়াও কিন্তু নীরব রহিলাম, ভাবিলাম, -দেখি কতক্ষণ পর্যন্ত ঐ ভাব থাকে। কিন্তু সেই ঘোর সেদিন কিছুমাত্র কমিল না। বাড়িতে ফিরিলাম, সেখানেও তাহাই -যাহা-কিছু দেখিতে লাগিলাম, সে সকলই তিনি। এইরূপ বোধ হইতে লাগিল। খাইতে বসিলাম, দেখি অন্ন, থালা, যিনি পরিবেশন করিতেছেন, সেই সকলই এবং আমি নিজেও তিনি ভিন্ন অন্য কেহ নহে। দুই-এক গ্রাস খাইয়াই স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম। 'বসে আছিস কেন রে, খা না!' মা'র ঐরূপ কথায় হুঁশ হওয়ায় আবার খাইতে আরম্ভ করিলাম। ঐরূপে খাইতে, শুইতে, কলেজ যাইতে, সবসময়ই ঐরূপ দেখিতে লাগিলাম এবং সর্বদা কেমন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া রহিলাম। রাস্তায় চলিয়াছি, গাড়ি আসিতেছে দেখিতেছি, কিন্তু অন্য সময়ের ন্যায় উহা ঘাড়ে আসিয়া পড়িবার ভয়ে সড়িবার প্রবৃত্তি হইত না! মনে হইত, 'উহাও যাহা, আমিও তাহাই।' হস্ত-পদ এই সময়ে সর্বদা আসাড় হইয়া থাকিত এবং আহার করিয়া কিছুমাত্র তৃপ্তি হইত না। মনে হইত যেন অপর কেহ খাইতেছে। খাইতে খাইতে সময়ে সময়ে শুইয়া পড়িতাম এবং কিছুক্ষণ পরে উঠিয়া আবার খাইতে থাকিতাম। এক একদিন ঐরূপে অনেক অধিক খাইয়া ফেলিতাম। কিন্তু তাহার জন্য কোনরূপ অসুখ হইত না! মা ভয় পাইয়া বলিতেন, 'তোর দেখছি ভিতরে ভিতরে একটা ভীষণ অসুখ হয়েছে।' কখন কখনও বলিতেন, 'ও আর বাঁচবে না।'
যখন পূর্বোক্ত আচ্ছন্ন ভাবটা একটু কমিয়া যাইত, তখন জগৎটাকে স্বপ্ন বলিয়া মনে হইত! হেদুয়া (আজাদহিন্দ বাগ) পুষ্করিণীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া উহার চতুষ্পার্শ্বে লৌহ রেলে মাথা ঠুকিয়া দেখিতাম, যাহা দেখিতেছি তাহা স্বপ্নের রেল অথবা সত্যকার! হস্ত-পদের অসাড়তার জন্য মনে হইত, পক্ষাঘাত হইবে না তো? অবশেষে যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন ভাবিলাম, উহাই অদ্বৈত বিজ্ঞানের আভাস! তবে তো শাস্ত্রে ঐ বিষয়ে যাহা কিছু লেখা আছে তা মিথ্যা নহে। তদবধি অদ্বৈততত্ত্বের উপরে আর কখনও সন্দিহান হইতে পারি নাই।
৪)
দক্ষিণেশ্বরের আনন্দময় দিনগুলি
ঠাকুরের নিকট কি আনন্দেই দিন কাটিত, তাহা অপরকে বুঝানো দুষ্কর। খেলা, রঙ্গরস প্রভৃতি সামান্য দৈনন্দিন ব্যাপার-সকলের মধ্য দিয়ে তিনি কীভাবে নিরন্তর উচ্চ শিক্ষা প্রদানপূর্বক আমাদিগের অজ্ঞাতসারে আমাদিগের আধ্যাত্বিক জীবন গঠন করিয়া দিয়াছিলেন, তাহা এখন ভাবিয়া বিস্ময়ের অবধি থাকে না। বালককে শিখাইবার কালে শক্তিশালী মল্ল যেরূপে আপনাকে সংযত রাখিয়া তদনুরূপ শক্তিমাত্র প্রকাশপূর্বক কখন তাহাকে যেন অশেষ আয়াসে পরাভূত করিয়া এবং কখনও বা তাহার নিকটে স্বয়ং পরাভূত হইয়া তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় জন্মাইয়া দেয়। আমাদিগের সহিত ব্যবহারে ঠাকুর এইকালে অনেক সময়ে সেইরূপ ভাব অবলম্বন করিতেন। আমাদিগের প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার বীজ ফুল-ফুলায়িত হইয়া কালে যে আকার ধারণ করিবে, তাহা তখন হইতে ভাবমুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমাদিগকে প্রশংসা করিতেন, উৎসাহিত করিতেন এবং বাসনা-বিশেষে আবদ্ধ হইয়া পাছে আমরা জীবনের ঐরূপ সফলতা হারাইয়া বসি, তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতার সহিত আমাদিগের প্রতি আচরণ লক্ষ্য করিয়া উপদেশ প্রদানে আমাদিগকে সংযত রাখিতেন। কিন্তু তিনি যে ঐরূপে তন্ন-তন্ন করিয়া লক্ষ্য-পূর্বক আমাদিগকে নিত্য নিয়মিত করিতেছেন, একথা আমরা কিছুমাত্র জানিতে পারিতাম না। উহাই ছিল তাঁহার শিক্ষা-প্রদান এবং জীবন-গঠন করিয়া দিবার অপূর্ব কৌশল।
ধ্যান-ধারণা কালে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া মন অধিকতর একাগ্র হওয়ার অবলম্বন পাইতেছে না অনুভব করিয়া তাঁহাকে কি কর্তব্য জিজ্ঞাসা করিলে তিনি ঐরূপ স্থলে কিরূপ করিয়াছিলেন তাহা আমাদিগকে জানাইয়া ঐ বিষয়ে নানা কৌশল বলিয়া দিতেন। আমার স্মরণ হয়, শেষ-রাত্রিতে ধ্যান করিতে বসিয়া আলমবাজারে অবস্থিত চটের কলের বাঁশির শব্দে মন লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িত। তাঁহাকে এই কথা বলায় তিনি ওই বাঁশির শব্দতেই মন একাগ্র করিতে বলিয়াছিলেন এবং সেইরূপ করিয়া বিশেষ ফল পাইয়াছিলাম।
আর এক সময়ে ধ্যান করিবার কালে শরীর ভুলিয়া মনকে লক্ষ্যে সমাহিত করিবার পথে বিশেষ বাধা অনুভব করিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে তিনি বেদান্তে উক্ত সমাধি-সাধনকালে শ্রীমৎ তোতাপুরীর দ্বারা ভ্রূ-মধ্যে একাগ্র করিতে যেইভাবে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, সেই কথার উল্লেখপূর্বক নিজের নখাগ্র দ্বারা আমার ভ্রূ-মধ্যে তীব্র আঘাত করিয়া বলিয়াছিলেন, 'ঐ বেদনার উপর মনকে একাগ্র কর।' ফলে দেখিয়েছিলাম, ঐরূপে আঘাতজনিত বেদনার অনুভবটা যতক্ষণ ইচ্ছা সমভাবে মনে ধারণ করিয়া রাখিতে পারা যায় এবং ঐকালে শরীরের অপর কোন অংশে মন বিক্ষিপ্ত হওয়া দূরে থাকুক, -ঐ সকলের অস্তিত্বের কথা এককালে ভুলিয়া যাওয়া যায়। ঠাকুরের সাধনার স্থল, নির্জন পঞ্চবটীতল আমাদিগের ধ্যান-ধারণা করিবার বিশেষ উপযোগী স্থান ছিল।
শুদ্ধ ধ্যান-ধারণা কেন, ক্রীড়া-কৌতুকেও আমরা অনেক সময় ওই স্থানে অতিবাহিত করিতাম। ঐ সকল সময়েও ঠাকুর আমাদিগের সহিত যথাসম্ভব যোগদান করিয়া আমাদিগের আনন্দবর্ধন করিতেন। আমরা তথায় দৌড়াদৌড়ি করিতাম, গাছে চড়িতাম, দৃঢ় রজ্জুর লম্বমান মাধবীলতার আবেষ্টনে বসিয়া দোল খাইতাম, এবং কখন কখনও আপনারা রন্ধন আদি করিয়া ঐস্থলে চড়ুইভাতি করিতাম। চড়ুইভাতির প্রথম দিনে আমি স্বহস্তে পাক করিয়াছি দেখিয়া ঠাকুর স্বয়ং ওই অন্ন-ব্যঞ্জনাদি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণেতর বর্ণের হস্তপক্ক অন্ন গ্রহণ করিতে পারেন না জানিয়া আমি তাঁহার নিমিত্ত ঠাকুরবাড়ির প্রসাদী অন্নের বন্দোবস্ত করিতেছিলাম। কিন্তু তিনি ঐরূপ করিতে নিষেধ করিয়া বলিয়াছিলেন, 'তোর মত শুদ্ধসত্ত্ব গুণীর হাতে ভাত খেলে কোন দোষ হবে না।' আমি উহা দিতে বারংবার আপত্তি করলেও তিনি আমার কথা না শুনিয়া, আমার হস্ত-পক্ক অন্ন সেইদিন গ্রহণ করিয়াছিলেন।
৫)
ঠাকুর আমাকে মা জগদম্বার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন (১)
[১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দের প্রথমভাগে নরেন্দ্রের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত হৃদরোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁহার শরীর ইতিপূর্বে অবসন্ন হইয়াছিল। নরেন্দ্রনাথ অনুসন্ধানে বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহাদিগের সাংসারিক অবস্থা শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পিতা কিছু রাখিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, আয়ের অপেক্ষা নিত্য অধিক ব্যয় করিয়া কিছু ঋণ রাখিয়া গিয়াছেন; আত্মীয়বর্গ এখন সময় বুঝিয়া শত্রুতাসাধনে এবং বসতবাটি হইতে পর্যন্ত তাঁহাদিগের উচ্ছেদ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছে। তাঁহারা মামলা করিলেও হারিয়া গিয়াছিল। কিন্তু পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষ-সদস্যরূপে নরেন্দ্র মাতা ও ভ্রাতাদিগের ভরণপোষণের দায়িত্বের সন্মুখীন হইলেন। ইতিপূর্বে তাঁহাকে কোনপ্রকার বিপদে পড়িতে হয় নাই। এই কালের আলোচনা করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন :-]
মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিসে অফিসে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কিন্তু সর্বত্রই বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত এই প্রথম পরিচয় বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল -দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুইদিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই-একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল; তন্মধ্যে একজন বোধহয় আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গাহিয়াছিল-
'বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মঃনিশ্বাস পবনে' ইত্যাদি। শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় সে যেন গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হইয়া ক্ষোভে, নিরাশায়, অভিমানে, বলিয়া উঠিয়াছিলাম, 'নে, নে, চুপ কর। ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব যাহাদিগকে কখনও সহ্য করিতে হয় নাই, টানা-পাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকটে এইরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে। আমারও একদিন লাগিত। কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।'
আমার এইরূপ কথায় উক্ত বন্ধু বোধহয় নিতান্ত ক্ষুন্ন হইয়াছিল -দারিদ্র্যের কিরূপ কঠোর পেষণে মুখ হইতে ঐ কথা নির্গত হইয়াছিল তাহা সে বুঝবে কেমনে? প্রাতঃকালে উঠিয়া, গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম গৃহে সকলের আহার্য নাই এবং হাতে পয়সা নাই, সেদিন মাতাকে 'আমার নিমন্ত্রণ আছে' বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে, ঘরে-বাহিরে কাহারও নিকটে ঐ কথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না। ধনী বন্ধুদের অনেকেই পূর্বের ন্যায় আমাকে তাহাদিগের গৃহে বা উদ্যানে লইয়া যাইয়া সঙ্গীতাদি দ্বারা তাহাদিগের আনন্দ বর্ধনে অনুরোধ করিত। এড়াইতে না পারিয়া মধ্যে মধ্যে তাহাদিগের সহিত গমনপূর্বক তাহাদিগের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইতাম। কিন্তু অন্তরের কথা তাহাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে প্রবৃত্তি হইত না -তাহারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয়ে জানিতে কখনও সচেষ্ট হয় নাই। তাহাদিগের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখন কখনও বলিত, 'তোকে আজ এত বিষণ্ন ও দুর্বল দেখাইতেছে কেন, বল দেখি?' একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্রমধ্যে মাতাকে সময় সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন