শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

গল্প * রাহুল দাশগুপ্ত



বিশ্ব সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি তাঁর নখদর্পণে। গল্প , কবিতা , উপন্যাস --- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর  স্বচ্ছন্দ  বিহার। কবিতা ও উপন্যাসের উপর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে রাহুলের | তাঁর সুসম্পাদনায় ' চিন্তা ' সাময়িকপত্রটি ইতিমধ্যেই সাহিত্যমোদীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।' স্বরবর্ণে'র বর্তমান সংখ্যায় আমরা পড়ব রাহুল দাশগুপ্তের একটি ভিন্ন স্বাদের ছোটোগল্প| 



তিন নম্বর চিৎকার

রাহুল দাশগুপ্ত


মাঝরাতে আবার সেই ভয়ানক চিৎকার শুনে আমি জেগে উঠলাম। হোটেলের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। একটা সরু, ছোটো নদী। নদীর ওপারেই সেই বাংলোর মতো বাড়িটা। আগে বাড়িটা আলোয় ঝলমল করত। এখন অন্ধকারে ঢাকা। বাড়িটাকে ঘিরে আগে একটা খুব সুন্দর ফুলের বাগান ছিল। এখন সেখানে আগাছা আর ঝোপঝাড় ছাড়া কিছুই নেই। ওই বাড়িতেই একসময় আমার প্রেমিকা থাকত। তার নাম ছিল, বৃষ্টি। 

       জানলা দিয়ে বাড়িটার দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম। যেন একটা পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে বাড়ি। বহুদিন পর এই শহরে আমি ফিরেছি। এখানেই আমার জন্ম। এখানেই আমার শৈশব কেটেছে। এই শহরেই আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আমি ওই বাড়িটা তৈরি হতে দেখেছি। আগে ওখানে একটা ফাঁকা জমি ছিল। তারপর সেই জমিতে একটু একটু করে গজিয়ে উঠল ওই বাড়িটা। তখন কী দাপট ওই লোকটার! ওই লোকটা, মানে, মাঝরাতে যে অমন ভয়ানক চিৎকার করে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকত আমার প্রেমিকা। বৃষ্টির বয়স তখন দশ-বারোর বেশি নয়। এমনি এমনি শহরের এই জায়গাটা আমি বেছে নিইনি। বিশেষ করে এই হোটেল আর এই ঘরটা আমি নিয়েছি অনেক ভেবেচিন্তেই। 

      বৃষ্টি আর আমি প্রায় একসঙ্গেই বড়ো হয়েছি। আমরা দুজন একসঙ্গে মাঠে খেলতে যেতাম। ও খুব জোরে দৌড়তে পারত। আমি প্রাণপণে ছুটেও ওকে ধরতে পারতাম না। আমরা কিন্তু নিছক খেলার আনন্দেই খেলতাম। আমাদের মধ্যে কোনও রেষারেষি ছিল না। বৃষ্টির প্রতি আমার মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না ! ওরকম সুন্দরী মেয়ে আমি আগে কখনও দেখিনি। ওকে দেখে আমার ডানাকাটা পরী বলেই মনে হতো।

      বৃষ্টির মা আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। কিন্তু বৃষ্টির বাবার সঙ্গে বরাবরই আমার একটা দূরত্ব ছিল। আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইতাম। কিন্তু তিনি ছিলেন রাশভারি লোক। অসম্ভব আত্মবিশ্বাস আর দাপট ছিল তার। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারতেন। জীবনে যা কিছু পেয়েছেন, তার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে তাকে। গ্রামের ছেলে শহরে এসে, মেসবাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে, নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এই নিয়ে তার মধ্যে চাপা একটা গর্বও ছিল। তিনি আমাকে পাত্তা দেবেন কেন? আমাকে তিনি মানুষ বলেই মনে করতেন না, মশা-মাছির মতোই তুচ্ছজ্ঞান করতেন। এ নিয়ে আমার মনে গোপন দুঃখ ছিল। কিন্তু বৃষ্টি তা জানত না। যদিও বাবার সঙ্গে ওরও একটা দূরত্ব ছিল। আর তাই ওর বাবার সবকিছুই ওর কাছে খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হতো! 

     একদিন আমার এক বন্ধু বলল, বৃষ্টির ঠোটটা খুব সুন্দর, তাই না রে? আমার খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করে।

     সেদিন থেকে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। হঠাৎ যেন আমি বুঝতে পারলাম, বৃষ্টির শরীরটা খুব সুন্দর। কিন্তু সেই সৌন্দর্য আমার এতদিনের সৌন্দর্যের ধারণার থেকে আলাদা। এতদিন বৃষ্টির মুখটাকে আমার খুব সুন্দর বলে মনে হতো। ওর মনটাকেও। সেই প্রথম আমি ওর শরীরটাকেও খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। আমি খুব পেইন্টিংয়ের বই দেখতাম। সেইসব বইয়ে আঁকা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর থেকে ওর শরীরের প্রতি আমার আকর্ষণ আরও বেড়ে গেল।

     মনে মনে নিজেকে আমি প্রস্তুত করলাম। আবার সেই চিৎকারটা শোনা যাবে। মোট তিনবার। ইতিমধ্যেই দুবার হয়ে গেছে। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, এই শেষবারেরটা হবে সবচেয়ে ভয়ানক। ঠিক গত রাতের মতোই। বুক ফাটা একটা আর্তনাদ। এই আর্তনাদের সামনে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মনে হয়, যেন সহ্য করতে পারব না! শব্দের সেই নিদারুণ, নিষ্ঠুর আঘাতে সব যেন চোখের সামনে দুলতে থাকবে। তারপর ঝঝ আঘাতে ভেঙেচুড়ে যাবে সব। কিন্তু তৃতীয় এই চিৎকারটা হওয়ার আগেই একটা কাজ করলে হয় না? এখন আমার পক্ষে ঘুমনো অসম্ভব। কিন্তু কাজটাও তো নেহাৎ সহজ নয়!

       গত সন্ধ্যায় আমি এই শহরে পৌঁছেছিলাম। তারপর রাতে ওই চিৎকারটা টানা তিনবার শুনি। ভোরবেলা বেয়ারা চা নিয়ে এলে আমি জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কী?

      ওই এক বুড়ো লোক আছেন। বেয়াড়া আমাকে বহুদিনের পরিচিত সেই বাড়িটা দেখিয়ে বলে, ওই বাড়িতে থাকেন। একাই থাকেন। খুব দুঃখী মানুষ। রাতে ওইভাবে চিৎকার করেন। ঠিক তিনবার।

       আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেছিলাম। একটু পরে ব্রেক ফাস্ট খেতে নিচে নেমে এলাম। টোস্ট-ওমলেট-কফি খেতে খেতে দেখতে পেলাম কাঁচের দেওয়ালের বাইরে রাস্তা দিয়ে বৃষ্টির বাবা উদভ্রান্তের মতো হেঁটে যাচ্ছেন। খুব করুণ দেখাচ্ছে তাঁর মুখ। ব্যথা-যন্ত্রণায় ভেঙেচুড়ে যাওয়া একটা মুখ। আমি খাবার ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর দরজা ঠেলে ওর পিছু ধাওয়া করলাম।

       বৃষ্টিকে যখন আমি প্রথমবার চুমু খেতে চেয়েছিলাম ও কোনও বাধা দেয়নি। চুমু খাওয়ার পর অনেকক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম। বৃষ্টি শান্ত হয়ে আমার বুকে মাথা গুজে চুপ করে বসেছিল। ওদের বাড়িতে তখন কেউ ছিল না। ওর মা কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন। আর ওর বাবা গেছিলেন অফিসে। আমি জানতাম, বৃষ্টি আমাকে ভালোবাসে। আমাকে কোনও বাধা দেবে না। তাই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই ওকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। সুযোগ বুঝেই।

       হঠাৎ আমি বৃষ্টিকে বললাম, তোমার বাবা মেনে নেবেন তো? 

      কেন? ও থতমত খেয়ে জানতে চাইল।

       জানি না। বললাম। কেন জানি তোমার বাবাকে আমার খুব ভয় করে। দূর। বৃষ্টি উড়িয়ে দিয়েছিল। আমার বাবাকে সবাই ভয় করে। উনি ওরকমই। ওর যত গাম্ভীর্য সব বাইরে। আসল মানুষটাকে তো তুমি চেনো না...

        তবু আমি যেন ঠিক আশ্বস্ত হতে পারিনি। বৃষ্টির বাবাকে নিয়ে সবসময়ই আমার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। শুধু মনে হত, উনি সব জানেন। তবু আমাকে ঠিক যেন মানুষ বলেই গ্রাহ্য করেন না। তাহলে কী উনি আমাকে পছন্দ করেন না?

       আমি বৃষ্টির বাবার পিছু নিয়েছিলাম। তারপর একদম কাছে এসে কানের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে ডাকলাম, কাকু !

       উনি পিছন ফিরে তাকালেন। আর আমি চমকে উঠলাম। কী বেদনায় ভরা করুণ মুখ! এত করুণ মুখ আমি আগে কখনও দেখিনি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে, যেন কাঁদছেন। হয়তো একটু আগে সত্যিই উনি কাঁদছিলেন। এই মানুষটাকে একসময় আমি চিনতাম। কিন্তু এই বুড়ো মানুষটা একদম আলাদা লোক। ওর মধ্যে সেই আগের মানুষটাকে আমি কোথাও খুঁজে পেলাম না। 

      উনি খপ করে আমার হাতটা ধরলেন। তারপর বললেন, বৃষ্টি আর নেই বাবা! 

      শুনেছি, কাকু। আমি বললাম। কী হয়েছিল বৃষ্টির? 

       একদিন হঠাৎ এই শহর ছেড়ে আমি চলে গেছিলাম। আমার মামা চিঠি লিখে আমাকে তাঁদের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। মামা-মামী খুবই অবস্থাপন্ন। কিন্তু নিঃসন্তান। আমাকে তারা নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন। মামার মস্ত ব্যবসা, সেই ব্যবসা দেখভালের উপযুক্ত করে উনি তুলতে চান আমাকে। নিজের চোখে চোখে রেখে আমাকে হাতে ধরে কাজ শেখাতে চান। আমার বিধবা মা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। খুব কষ্ট করে গান শিখিয়ে উনি আমাকে মানুষ করেছিলেন। মায়ের কাছে গান শিখতে এসেছিল বৃষ্টি। তখনই আমাদের আলাপ। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মামার কাছে আমি চলে গেছিলাম।

      তারপর কেন জানি বৃষ্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ হঠাৎ-ই খুব কমে গেছিল। ও ওর মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমি আমার মতো। তারপর একসময় সেই ক্ষীণ যোগাযোগটুকুও আর ছিল না। পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আমরা। শুধু একবার খবর পেয়েছিলাম, বৃষ্টির মা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ওদের বাড়িতে তখন ফোনও করেছিলাম। কেউ ধরেনি। আমিও আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করিনি। মাঝেমধ্যে ওর কথা আমার মনে হতো ঠিকই। কিন্তু তখন আমার জীবনে নিত্য নতুন বান্ধবী জুটছে। জীবনটাও কাজের মধ্য দিয়ে আর হইচই করে বেশ কেটে যাচ্ছে। আমার শুধু মনে হতো, বৃষ্টি আমার জীবনের প্রথম প্রেমিকা। তার বেশি কিছু নয়। সব মানুষের জীবনেই এরকম সম্পর্ক থাকে। কিন্তু সেই সম্পর্ককে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তাকে নিয়ে বেশি ভাবারও কিছু নেই। আমি একটা নতুন জীবন পেয়েছি। সেখানে অতীতকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনও লাভ নেই।


      কাকু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি আর মুখের অভিব্যক্তি যেন ভোলার নয়। এই মানুষটাকে আমি এত ভয় পেতাম? এত সমীহ করতাম? কতবার আমি তার ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি সবসময় নিজের দুরত্ব বজায় রেখে গেছেন। আর আজ তিনিই যেন আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। 

    কাকু বললেন, একটা কর্পোরেট হাউসে বিরাট চাকরি পেয়েছিল বৃষ্টি। প্রচুর টাকা মাইনে। ভেবেছিলাম, জীবনে ও সুখী হবে। কিন্তু কিছুই হল না। হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে দিল মেয়েটা। 

     কেন? আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম। কিছু ঘটেছিল নাকি? 

       জানি না। কাকু বললেন। কিন্তু সেই যে চাকরি ছাড়ল, তারপর থেকে চাকরি পাওয়ার আর কোনও চেষ্টাই করল না। সবসময় ডিপ্রেশনে ভুগত। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকত আর ফ্যালফ্যাল করে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত।

        আমি বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। কাকু বলে চললেন, কত বুঝিয়েছি, কাউন্সেলিং করতে চেয়েছি, কিছুতেই রাজি হয়নি। সেই আমাকেই আবার বুড়ো বয়সে চাকরি করতে বাইরে যেতে হল। সে যে কী কষ্ট! তুমি তো জানোই, এই বুড়ো বয়সে পার্টি ধরা আর টার্গেটে পৌঁছনো কত কঠিন! সেই ভোরবেলা বেরিয়ে যেতাম আর রাতে ফিরতাম। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো, এ বাড়ি সে বাড়ি করতাম, লোক ধরে ধরে বোঝাতাম, কিন্তু চোখে আমার জল চলে আসত। সারাদিন হয়তো সেভাবে খাওয়াদাওয়াও জুটত না, শুধু রাস্তার দোকান থেকে  ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা খেয়ে যেতাম। সবাই আমাকে করুণা করতে শুরু করেছিল। সারাজীবন মাথা উঁচু করে বেঁচেছি, আর এই শেষ বয়সে করুণার পাত্র হয়ে গেলাম! ওই একটিমাত্র মেয়ের জন্য জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর ওই একটিমাত্র মেয়ে আমাকে পথে বসিয়ে দিল। তবু যদি মেয়েটা আমার বাঁচত... 

       আপনি কী কিছুই জানেন না কাকু?

        আমি শুধু জানি, ওর একজন বন্ধু জুটেছিল অফিসে। বিয়ের কথাও হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ও নিজেই সম্পর্কটাকে ভেঙে দেয়। অফিস ছেড়ে দেওয়ার পরও কতবার ছেলেটা ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে! কত বোঝাতে চেয়েছে! ওকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছে। ওর জন্য ব্যাগভর্তি উপহার এনেছে। কিন্তু ও ছেলেটাকে কিছুতেই এনটারটেইন করত না। বাইরের ঘরে বসিয়ে রাখত। আর ও চুপ করে বসে থাকত। ছেলেটা একতরফা কথা বলে যেত, ও কোনও জবাব দিত না। তারপর আস্তে আস্তে ছেলেটা আসা কমিয়ে দিতে শুরু করল। শেষে যা হওয়ার কথা তাই হল। একদমই আসা বন্ধ করে দিল। শুনেছিলাম, পরে সে বিয়েও করেছে। কিন্তু সেকথা শুনেও আমার মেয়ের কোনও রিঅ্যাকশনই হয়নি। খবরটা আমিই ওকে জানিয়েছিলাম। আর ও এমন ভাব দেখাল, যেন শুনতেই পায়নি...

        কথাটা শেষ করেই বৃষ্টির বাবা আর দাঁড়ালেন না। যেন আমাকে দেখতেই পাননি। নিজের সঙ্গেই নিজে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন। খুব তাড়াহুড়ো  করে অন্যমনস্কভাবে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু একটু গিয়েই আবার খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। বিস্ময় আর শোক মিশে গেছিল আমার সেই দৃষ্টিতে।

         কিন্তু সেই রাতে আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, তিন নম্বর চিৎকারটা করার আগেই আমি ওঁর কাছে পৌঁছে যাব। তারপর যা হবার হবে। আমি হোটেলের পিছনদিকে এলাম। ঘড়িতে দেখলাম, রাত বারোটা বাজে। নদীর ওপরে একটা কাঠের সেতু। সেই সেতু পেরিয়ে প্রায় বৃষ্টিদের বাড়ির মুখে পৌঁছে গেছি, দেখলাম, গেট খুলে উনি বেরিয়ে এলেন। তারপর নদীর ধার দিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি ওঁর পিছু নিলাম।

         উনি হাঁটছেন, আমিও ওঁর পিছন পিছন হাঁটছি। নদীর শান্ত জলের ওপর চাঁদের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে। দু'জনে যেন চুম্বন করছে একে অপরকে। উনি উদভ্রান্তের মতো হাঁটছিলেন।

         পরেই উনি ঘুরে দাঁড়াবেন। তারপর আবার নিজের বাড়ির দিকে ফিরবেন। নদীর ধারে বালির চর। সেই বালিতে নিজের পায়ের ছাপ মিলিয়ে মিলিয়ে উনি ফিরবেন। আর ঠিক বাড়ির সামনে পৌঁছেই ওই তৃতীয় চিৎকারটা করবেন। এই শহরের সবাই এসব কথা জানে।

        উনি সত্যিই ঘুরে দাঁড়ালেন। আর তখনই আমাকে দেখতে পেলেন। কিন্তু চিনতে পারলেন না। এতক্ষণ টেরই পাননি, ওর পিছনে একজন মানুষ হেঁটে আসছে। কিন্তু এবার চিনতে না পারলেও, নিজের চোখে তো মানুষটাকে দেখলেন।

      উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই জায়গাটা চিনে রাখো। এইখানে, ঠিক এইখানে, আমার মেয়ে নদীর জলে নেমে গেছিল...

      কিন্তু ও তো সাঁতার জানত না.. 

      কে তুমি? চমকে উঠলেন বৃদ্ধ। তুমি জানলে কী করে? 

      আমি? থতমত খেয়ে বললাম, আমি তো অনেক কিছুই জানি। আমি হলাম... 

       উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মেয়ে এখান থেকে আর উঠে আসেনি। ঠিক এই সময়। এখন ক'টা বাজে জানো? রাত ১২টা বেজে ২৭ মিনিট।

          আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। চাদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধ একেবারে নির্ভুল সময় বলেছেন। 

         তুমি কে? বৃদ্ধ আবার জানতে চাইলেন। তিনি আমার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এলেন। তারপর খুব কাছ থেকে আমার মুখের দিকে তাকালেন। বেশ কয়েক মুহূর্ত ওইভাবে তাকিয়েই রইলেন। 

          তারপর বললেন, ওঃ, তুমি! 

         একটু চুপ করে রইলেন। তারপর আবার বললেন, আগে আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু এখন জানি। আমার মেয়ে ডায়েরিতে সবই লিখে গেছে। ডায়েরিটা ও লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতই সহজ? আমি ঠিক খুঁজে বার করেছি। সব কথা লেখা আছে তাতে। সব কথা... 

         অদম্য কৌতূহল হচ্ছিল আমার। রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলাম, কী লেখা আছে তাতে? 

         তুমি জানো না? বৃদ্ধ ফুঁসতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বললেন, তাহলে তুমিই সেই? তুমিই ওকে...

          হঠাৎ বৃদ্ধ সেই বুকফাটা চিৎকার করে উঠলেন। তৃতীয়বারের মতো। তিনি কী আমাকে আক্রমণ করতে চাইছিলেন? ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আত্মরক্ষা করব বলে আমি নিজেই পিছিয়ে গেলাম। আর বৃদ্ধ আরও এগিয়ে আসতে গিয়ে কোনও অবলম্বন না পেয়ে মুখ থুবড়ে বালির ওপরে পড়ে গেলেন। 

         সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ চিৎকার!



রাহুল দাশগুপ্তের বই 


গল্প কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস মিলিয়ে রাহুল এ পর্যন্ত কুড়িটিরও বেশি বই লিখেছেন |
তাঁর কয়েকটি  ------

গল্প সংকলন 

গল্প সমগ্র (প্রথম খন্ড )
প্রভু ও তাঁর পৃথিবীতে এক দেবদূত 

কবিতা সংকলন 
শিরামুখ খুলে গেছে ক্ষতে  * প্রার্থনার স্পর্শে একা  * এক অবিরাম স্বীকারোক্তি 

উপন্যাস 

সার্টিফিকেট * বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ নেই * 
যখন কেউ হত্যাকারী হয়ে ওঠে  * একলা চলার পথ ইত্যাদি 

প্রবন্ধ সংকলন 

বাংলা উপন্যাসকোশ
উপন্যাসের মহাবিশ্ব 

সম্পাদনা গ্রন্থ 

বব ডিলান:কবিতায় ,গানে ,প্রতিবাদে



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন