শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

তপন পাত্র






মূলত কবি; কিন্তু কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাঁর কলম খুঁজে ফেরে আধুনিক নগর সভ্যতার অন্তরালে চাপা পড়া বাংলার লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ এক উজ্জ্বল জগত। বিশেষ করে মানভূম -পুরুলিয়ার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। ঋদ্ধ হই তাঁর অনুসন্ধানী কলমের আশ্চর্য ছোঁয়ায়। তেমনই একটি  রচনা এবার 'স্বরবর্ণে'----



রোহিনীর দিন বিচপুহ্ণা

তপন পাত্র 

   


পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রায় ১৩ জ্যৈষ্ঠ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন । এ দিন রোহিনী উৎসব। রোহিন পরব ,বীজপুহ্ণাহ্ , বিচপুহ্ণা।


    রোহিন পরব কী ? পুরুলিয়া তথা মানভূম তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলার এক কৃষি মহোৎসব । "রোহিনী" থেকে "রোহিন" । কে রোহিনী ? সহজ উত্তর --দক্ষ প্রজাপতির কন্যা , সোমদেবের স্ত্রী ,  বলভদ্রের জননী । বলভদ্র মানে হলধর,বলরাম । ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বড়ো ভাই । ভারতীয় লোকবিশ্বাস হলধর কৃষির দেবতা । হল ধারণ করেন যিনি , তিনিই তো হলধর । এই হলধরের জননী , নক্ষত্ররাণী  রোহিনী  আজ পৃথিবীর সবথেকে সন্নিকটে বিরাজ করেন । তাই এই শুভ দিনে বীজ ব্যপন করলে আমনের ফসল হবে ভালো , সীমান্ত বঙ্গবাসী এই ধারণা মনেপ্রাণে লালন করে আজও ।


  এমনিতেই তো পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় প্রবাদ আছে "চাষ নাই বাস টুরুই ব্যাঙের আশ" । একটানা কয়েকদিন বৃষ্টি ঝরতে থাকে যদি , তবে 'টুরুই' ডাকে ।  তবে এখানে চাষ । মেঘের প্রসন্ন দাক্ষিণ্যই আজও এখানে কৃষিকাজে অগতির গতি ।  কত কিছু এল গেল ,  কত নব নব ইতিহাস রচিত হলো , কিন্তু এই এলাকার কৃষির উত্তরণের স্বার্থে ছিটেফোঁটাও বন্দোবস্ত হল না আজও । অগত্যা প্রকৃতির প্রফুল্ল দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে , বহু আশায় বুক বেঁধে কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আজ নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেতের কোনে পূর্ব-প্রস্তুত মাটিতে প্রতীকী বীজ বোনে । আঞ্চলিক ভাষায় এর নাম "বিচপুহ্ণা" । 


    তবে এই বিচপুহ্ণার দিন সেই সমস্ত কৃষকেরা আর প্রতীকী বীজ ব্যপন করেন না , যাঁরা রোহিনীর কয়েক দিন আগেই "অক্ষয় তৃতীয়া" তিথিতে এই কর্ম সম্পাদন করে থাকেন । অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিও এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবনে একটি পবিত্র দিন । এদিন অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমন ধান চাষের শুভ সূচনা করেন "বিচপুহ্ণা"র মধ্য দিয়ে । মানভূমবাসীর ধারণা বা লৌকিক বিশ্বাস , এই শুভদিনে কৃষিকর্ম আরম্ভ করলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে না , ফসল অক্ষত থাকবে । "অক্ষয়" শব্দটির আভিধানিক অর্থ "যার ক্ষয় নাই" । বৈদিক বিশ্বাস অনুসারেও এই তিথিতে কোন শুভ কাজ আরম্ভ করলে তা অক্ষয় হয় , অক্ষত থাকে । ধরিত্রী মাতা কে ঊর্বরা , বসুন্ধরাকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা করার জন্য ভগীরথ এই দিনে স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন বলেই ধারণা ।


     প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মানভূম তথা সমগ্র পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় একদা কৃষি নববর্ষের শুরু হতো পয়লা মাঘ । এই অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে মাঘ মাস এখনো নববর্ষের প্রথম মাস । অসাঁওতাল কৃষিনির্ভর সভ্যতায় সময়ের সাথে সাথে নববর্ষের প্রথম মাস মাঘ মাস থেকে বৈশাখে পরিবর্তিত হয়েছে । কিন্তু এখনও এখানে কৃষি জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম কানুন পয়লা মাঘকেই কৃষি নববর্ষের সূচনা মাস ব'লে ইঙ্গিত করে । যেমন এই দিন  চাষী তার কোনো নির্দিষ্ট জমিতে "আড়াই পাক" লাঙ্গল চালিয়ে বৎসরের প্রথম হালচালন অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করে । তুলনামূলকভাবে সম্ভ্রান্ত কৃষকের কৃষিকাজের সহযোগী মানব সম্পদ কামিন , মুনিষ ,  বাগাল  ভে"তার বাৎসরিক স্থায়ী কর্ম সম্পাদনের শেষদিন পৌষ সংক্রান্তি আর পুনর্বহালের সূচনা দিন পয়লা মাঘ । কাজেই শুধুমাত্র রোহিণীর দিন নয় , অক্ষয় তৃতীয়া এবং পয়লা মাঘ অর্থাৎ "আখিয়ান যাত্রা" বা "আ'খান যাত্রা"র দিনটিও কৃষি কর্মের সূচনা সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ।


   

 যাইহোক রোহিনীর আগের দিন বারোই জ্যৈষ্ঠ-ই পরবের সূচনা হয়ে যায় । কথায় আছে ,"বার দিনে বারনি , আর তের  দিনে রোহিনী ।" বারনি অর্থাৎ বার । যে কোনো মাঙ্গলিক ব্রত, উপবাসের আগের দিনকে বার বলা হয় । এই দিনটি নিজেকে বা নিজেদের শুচি করে তোলার দিন । নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেবার দিন । বারই জ্যৈষ্ঠর পর তেরই জ্যৈষ্ঠ পবিত্র রোহিনীর দিন । এ দিন ঘর-সংসারের মহিলারা সকাল সকাল নিজেদের উঠোনে গোবরের ছঁচ দেয় ,  খড়িমাটির আলপনা আঁকে । অংকন করে  মা লক্ষ্মীর কাল্পনিক পদচিহ্ন । একটু বেলার দিকে , কোনো কোনো এলাকায় বিকেলের দিকে  একটি নির্দিষ্ট চাষজমি থেকে কৃষাণী নিজে অথবা বাড়ির "কামিন বউ" ন'বার  বাঁশের ঠে'কাঝুড়িতে করে মাটি এনে রাখে গৃহের তুলসী মঞ্চের পাশে কিংবা গোয়াল ঘরে গরুর দনের কাছে । এর নাম "রোহিন মাটি" ।  যখন মাটি আনতে যায় তখন বাঁশের ঝুড়িটিতে তেল-সিঁদুরের তিনটি, পাঁচটি অথবা নয়টি তিলক রেখা টেনে দেওয়া হয় আর  একখন্ড লৌহ রাখা হয় । প্রাচীন বুড়ো বুড়িদের মতো আজও এলাকাবাসীর বিশ্বাস তাহলে ঝুড়িতে কেউ কুনজর দিতে পারবে না । মাটি আনার সময় গ্রামের বা পাড়ার বালক-বালিকারা সারা মুখে কালি-ঝুলি রং মেখে সং সেজে ছড়া কেটে, গান গেয়ে মাটি বাহিকাদের হাসানোর ও কথা বলার চেষ্টা করে । কিম্ভুতকিমাকার আকৃতির  বাঁদর, ভালুক সেজে নাচ করে । রীতি আছে, এ সময় তাদের হাসতে নেই, তাই হাসানোর জন্য এই প্রয়াস । এই প্রয়াস আনন্দ-স্ফুর্তি-বিনোদন ছাড়া কিছু নয় । যারা মাটি আনে তাদের স্নানের জন্য থাকে ঝাঁঝালো সর্ষের তেল,  সুগন্ধি  সাবান আর কেশ প্রসাধনের জন্য ফুলাম তেল ;  আয়েশ ক'রে খাবার জন্য মহুল ফুলের পাগ আর  আতপ চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সরু চকলি পিঠে ও মিঠে পায়েশের ব্যবস্থা ।


     এদিন যে সমস্ত গানগুলো গাওয়া হয় , সেগুলো এখন প্রায় লুপ্ত । এখনো দু-চারটি গান শোনা যায় , তবে সেগুলোর টুসু গান ও বাঁদর নাচের গানের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে । সময়ের স্রোতে সেগুলো এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে , যে বোঝাই যায়না এগুলো রোহিনীর গান না অন্য কোন লোকগান । কারণ এই গানগুলি চিরকাল মুখে মুখে ফিরেছে, এগুলোর কোনো নির্দিষ্ট লেখক লেখিকা নেই আর লিখিত, মুদ্রিত রূপও নেই ।

        

             যেমন --

 ১. মসি দড় দড় দড় গো  কাওয়াই জুনহার খা'ছে ।

 আগু ধারে ক্ষেদতে  গেলে পেছু বাটে যা'ছে।।


২. ই ডাঙ্গায় উ ডাঙ্গায় পিয়াল পা'কে'ছে ।

 যা'সনা বুড়ি পিয়াল খা'তে শিয়াল খে'পেছে।।


 ৩. সাগ রাঁ'ধতে ব'লেছিলি কোচু রাঁ'দেছে ।

  সুয়াদে  সুয়াদে বহু খাঁইয়ে ফেলেছে।।


৪.আম ধরে থপা থপা তেঁতুল ধরে বাঁকা ।

 নামল দেশে দে'খে আলি রাঁঢ়ির হাতে শাঁকা।।


৫. আঢ়ে আঢ়ে যায় ভালুক ভুকু কুঢ়ে খায় ।

  কাল শ্যামকে দেখে ভালুক লঢ়াই লা'গে যায়।।


      উল্লিখিত তৃতীয় গানটি বাঁদর নাচের গান বলেই অধিক পরিচিত । এদিন বালক-বালিকারা বাঁদর সেজেও নাচানাচি করে , সেই সূত্রে গানটি এসে রোহিনী গানের সম্ভারে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় ।রোহিনীর গানের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত গানটি হল ---

 "ছেল্ বাঁদরি ছেল্ ছেল্ ছেল্ ,

 আৎনা পাতের দশনা, তোর হিলো কানের সোনা ।

 দনায় দনায় মেল খাঁইয়েছে ,

 লিবো কানের সোনা ।

 ছেল্ ছেল্ ছেল্ ।"

   

      রোহিনীর পরই কেতকী নক্ষত্রের অবস্থান । ঠিকমতো বৃষ্টি হলে রোহিনীর পর কেতকী বতরে  , স্থানীয় ভাষায় "কেতকালি বতরে" আমনের চারা ফেলার কাজ চলতে থাকে । ধানের ঝুড়িতে বা বস্তায় অল্প রোহিন মাটি সহ বীজ যায় মাঠে। বিশ্বাস তাহলে রোগপোকার তাণ্ডব আসবে না । 


      এ দিন প্রত্যুষে ঘরের চারদিকে গোবরের রেখা টানে মেয়েরা ।  রাবণ আড়ালের লক্ষণ রেখার মতো সরীসৃপ ঠেকানোর রোহিণীরেখা । নিয়ম করে খাওয়া হয় "রোহিনী ফল" ‌। অন্য নাম "আষা'ঢ়া ফল" বা "কে'লাকটরা" । সবুজবর্ণা অতীব তেঁতো স্বাদের ফল । মানুষের বিশ্বাস এটি সাপে কাটা রোগীর এবং চর্ম রোগের প্রতিরোধক  আয়ুর্বেদ । এমনকি হঠাৎ কাটাছেঁড়া হলে মানুষ রোহিন মাটি গুঁড়ো করেই ক্ষতস্থানে লাগাতো একদিন , এখনো দিব্যি লাগিয়ে থাকে কেউ কেউ । তাইতো মহর্ষি সুশ্রুত এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায়  'রোহিণী ' মানে 'নিরাময় কারী', 'রোহিণী ' মানে 'ত্বকীয় উপসর্গের নিরাময়'। 


      আবার "রোহিণীদান" বলেও একটি শব্দবন্ধ আছে। আছে "গৌরীদান" । "কন্যাদান" । "অষ্টম বর্ষ ভবেৎ গৌরী, নববর্ষাতু রোহিণী "। আট বছরের মেয়েকে পাত্রস্থ করার রীতি "গৌরীদান" । নয় বছরে বালিকার বিবাহ দান "রোহিনীদান" । আর দশ থেকে বারো হলে "কন্যাদান" । গৌরীদানে পিতা-মাতার স্বর্গলোক বাস  । রোহিনী দানে বৈকুণ্ঠ লাভ ‌। আর কন্যাদান উৎকৃষ্টতম ‌। এতে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি । 


      আমাদের যাবতীয় কৃষি সংস্কারের সাথে উৎপাদন ধারণার নিবিড় সংযোগ । এদেশে কুমারীরা ৮ - ৯ থেকে ১২ বছরের মধ্যে রজস্বলা হয় । ধীরে ধীরে রতিসুখাকাঙ্ক্ষা জাগে । যার পবিত্র দিকটি হল সৃজন ,  সৃষ্টি । মেয়েরা বারো মাসে তেরো বার ঋতুমতী হয় । সম্ভবত সেখান থেকেই উঠে এসেছে "বারো মাসে তেরো পরব "-এর মত জীবন্ত প্রবাদ । উৎপাদন জীবনের শ্রেষ্ঠ মহোৎসব । 

 

   

    এই রোহিনী মহোৎসবের দিন গ্রামীণ ছেলেছোকরারা রং মেখে সং সাজে ।  ঢাক ঢোল মাদল কাড়া-নাকড়া বাজিয়ে ছড়া কেটে গান গেয়ে নেচে বেড়ায় গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় । অনেকেই ব্যাখ্যা করে থাকেন এটাই নাকি পুরুলিয়ার ছো নাচের আদি উৎস । সে যাই হোক, এই গানগুলির সাথে কোথা থেকে যেন ভেসে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কৃষিপ্রেমিক রবি ঠাকুরের সৃজন সংগীত  --"আমরা চাষ করি আনন্দে..."

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন