প্রবন্ধ সাহিত্যে সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় এককথায় অনন্য, অসাধারণ । গভীর অধ্যয়ন এবং সৃষ্টিশীলতা তাঁর রচনায় পরতে পরতে গেঁথে থাকে । অ্লোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত"আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাস"গ্রন্থে সত্তর দশকের কবিতা' তাকে পরিচিতি দিয়েছে।১৯৯৫ সালে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর তাকে সাহিত্যে সিনিয়র ফেলো হিসেবে মনোনীত করে।সম্প্রতি তিনি পড়লেন কবি দীপংকর রায়ের ' হাঁটছি তোমার মাঝে শতধারা ' বইটি। এখানে রইল সেই পাঠ প্রতিক্রিয়া ----
শ্রীচরণেষু মা-কে
সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়
আটের দশকের প্রথম দিকে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে ভীমসেন যোশীর গান শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই প্রথম ভীমসেন যোশীর গান শোনার অভিজ্ঞতা। মনে পড়ছে ভোর চারটের একটু পরে গাইতে উঠেছিলেন। যখন শেষ করলেন তখন সকাল হয়ে গেছে । তিনি আপন মনে গেয়ে চলেছেন " যো ভজে হরি কো সদা " ঐ একটি ভজন কতক্ষণ ধরে গেয়েছিলেন তা মনে পড়ে না। বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়েও যেতে পারছি না। গান কোনদিন এইভাবে ধরে রাখতে পারে অনুভব করিনি মনে আছে, সেদিন নজরুল মঞ্চ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলাম। প্রায় সমতুল অভিজ্ঞতা হল দীপংকর রায়ের "হাঁটছি তোমার মাঝে শতধারা " কাব্য-উপন্যাস পড়তে গিয়ে।
২
সমতুল অভিজ্ঞতা বলতে কি বোঝাতে চাইছি সেটা একটু বিশদে বলা প্রয়োজন। দীপংকর রায়ের কাব্য উপন্যাস তো আগেও পেয়েছি আমরা। যার শেষতমটি " আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী, আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ"। কিন্ত এই কাব্য উপন্যাসটি তাঁর প্রয়াত মাতৃদেবী অঞ্জলি রায়ের স্মৃতিতে রচিত । শুধু তাই নয়, র মাতৃদবীর প্রয়াণের দিন থেকে একবৎসর পূর্ণ হবার দিনই এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই এই গ্রন্থটির পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মা-কে ঘিরে তাঁর নিভৃত স্মৃতিচর্যা, তাঁর আত্মকথনের বর্ণমালা। কিন্ত এমন একটি গ্রন্থ পাঠ কালীন সময়ে পাঠক হিসেবে আমাদের মনোজগতের সংবেদনার জানালা দরজাগুলি কখন যে ধীরে ধীরে খুলে যায় তা আমরা টের পাই না। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এই সময়পর্ব জুড় লেখা এই কাব্য উপন্যাসটি যা প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর যাপিত জীবনের স্বরলিপি - তা ক্রমশই আমাদের সংবেদনার সমস্ত প্রস্বরকে গভীর আততিতে সম্মোহিত করে দেয়। আর এই ক্ষেত্রেই আমার ভীমসেন যোশীর গানের কথা মনে পড়ে যায়।
৩
গ্রন্থটির প্রচ্ছদটি দীপংকর রায়ের মা'র সূচীশিল্পের আলোকচিত্র দিয়ে প্রস্তত করা হয়েছে। আরো বিশদে বললে বলা যায় তাঁর স্বহস্তে বোনা একটা শাড়ির আচলের ছবি। যে মুহূর্তে এই রূপকল্পটি আমাদের মনে আসে তখনই আমরা অনুভব করতে পারি এই কাব্য উপন্যাসটির ভিতরের আখরগুলিকে।
আঠেরটি পর্বে বিন্যস্ত এই স্মৃতি নির্মাল্য। একেবারে শুরুতেই দীপংকর জানিয়েছেন : সকলের থেকে সকলেই আমরা বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমনি এক আতঙ্কে আবারও গৃহবন্দী, অসহায়, নির্লিপ্ত - লুকোনো দার্শনিকতা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি কেন যে, তা জানি না।" কবির এই আত্মস্বীকারোক্তির আলোয় গ্রন্থটি পাঠ করলে কবির ঈপ্সিত ভাবনাবলয়কে স্পর্শ করা সহজ হবে।
৪
কাব্য উপন্যাসটির শুরু হয় এইভাবে : " মা, মাগো, / জানতাম না সম্পর্কে গভীর ছলনা লুকানো, / আমরা নিজের ভেতরে নিজেই অসহায়। / কোনটা আমার, কোনটা সকলের, কোনটি ঘিরে অসম্পূর্ণ বৃত্ত / তা কি জানি ? / এই যে এ ওর সন্ততি, এ ওর সন্তানের সন্তান / ভেতরে যে বহমান স্রোত - তাতেই পূর্ণ বাধন ! "
একেবারে শুরুতে যে লুকোনো দার্শনিকতা কথা উচ্চারণ করেছিলেন দীপংকর, কবিতায় তার রূপান্তরণ ঘটে এইভাবে। একটু পরেই তাঁর উচ্চারণ : "নাড়ি ছিড়ে একদিন যাকে এনেছিলে স্রোতের ভেতর সাতার শেখাতে / সে কী করে ভুলতে পারে , তার জঠরবাসের দিনগুলি....?"
তাঁর এই বাকপ্রতিমা বিশেষ থেকে নির্বিশেষ হয়ে যায়। পাঠক হিসেবে আমরাও তাঁর অনুভূতিমালার শরিক হয়ে উঠি। আর একটি অসামান্য রূপকল্প উপস্থাপিত করেছেন তিনি যা একইসঙ্গে তাঁর অন্তর্গত যন্ত্রণা ও বেদনাবোধের স্মারক : "ভাবলাম, এই তো, এই তো তুমি, - মা, তুমি কাক হয়ে গেলে কীভাবে ? / কীভাবেই বা সে কথা মেনে নিই, তাই বলো ?"
আমাদের শাস্ত্রীয় বিধিমতে প্রয়াণ পরবর্তী অশৌচ পালনকালীন দিনগুলিতে যে আচরণীয় রীতি প্রচলিত আছে তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কবি। অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে নিজস্ব কাব্যভাষায় তাঁর এই আত্মজিজ্ঞাসার কথা বাঙ্ময় করেছেন তিনি। তাঁর এই আত্মমন্থনের সংবেদনা আমাদেরও গভীরভাবে স্পর্শ করে।
৫
চতুর্থ পর্বের শুরু হয় এই ভাবে : "রোদেরা ডাকছে, সামনে কার্তিক মাস / আলোয়, ধূলোয়, ছাতিমে / ঝরা কদম-রেণু ; " এইরকম লিরিক্যাল আবহের ভিতরে তিনি লেখেন এক কঠোর বাস্তবতার কথা :
"মনে পড়ে , শেষের সেদিন..../ অসহায় হাসপাতালের দুয়ার জুড়ে চেয়েছিলাম যেভাবে..../ কই, কী হলো, কী বললো ডাক্তার ? / ডাক্তার কই, শুধুই প্যারামিটার / পারদ নামে না একটুও - / চলো ফিরে যাই, মানুষ বাঁচে না এখানে / অর্থ বাচে ? / জীবনের দাম নেই। বাঁচার মূল্য বিচার্য হয় কেবলই টাকায় - "
জীবন আর শিল্পের জলবিভাজিকাটুকু সরিয়ে এমনই উচ্চারণ করতে পারেন কবি। তুলনায় সবচেয়ে স্বল্পদৈর্ঘের পঞ্চম পর্বটি কাব্যগুণের হিরন্ময় বিভায় আবৃত।
সপ্তম পর্বের মাঝখানে প্রকাশিত হয়েছে কবির নিজস্ব ভুবন :
"আন্দোলিত ছুটেছি তবু / গাছগাছালি - মাঠ - গঞ্জ - প্রান্তিক স্টেশন . / জামরুল-মেহগনি সরছে আগে-পেছনে, ছুটছে শিশু-কড়াই / একটার পর একটা মফস্বল ঘুরছে বাতাসে / দেশকে দেশের মতো পাইনি কোনদিনও / তবু তাকেই ভেবেছি ; / তাহলে কি প্রবাসে ছিলাম ? / বস্তুত কোথাও আমার দেশ নেই। সকল দেশেই আমার ঘর ! " একথা একজন কবির পক্ষেই বলা সম্ভব।
এই পর্বেই একটি গভীর সংবেদী উজ্জ্বল প্রতিমার চিত্র আমাদের বিস্মিত করে : "মেঝের চিড়খাওয়া দাগের মধ্যে তোমার মুখের কারুকার্যে ঝিমুচ্ছি আমি "
৬
বিরানব্বই পৃষ্ঠাব্যাপী তাঁর রচিত আখরগুলি আমাদের প্রায় ঘোরলাগা এক অনুভবের আবর্তে ঘিরে রাখে যা বহু দূর দিকচক্রবালের অক্ষরেখাকে অতিক্রম করে ছড়িয়ে যায়।


আলোচনাটা খুব সুন্দর হয়েছে। বইয়ের পুরো অংশ না পড়লেও প্রায় অধিকাংশই পড়া হয়েছে আমার। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মাকে হারিয়ে পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি তার প্রতিফলন ছত্রে ছত্রে রয়েছে। রয়েছে মায়ের প্রতি অশেষ স্নেহ ভালোবাসা এবং টানের অভিব্যক্তি। এক কথায় দীপংকদার এই লেখা অনন্য এবং অদ্বিতীয় বলে মনে হয় আমার।
উত্তরমুছুনএই আলোচনা থেকেও সেই ইঙ্গিতই খুঁজে পাচ্ছি ছত্রে ছত্রে।