" বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায় " লিখেছিলেন জীবনানন্দ । কবি দীপংকর রায়ের কবিতা স্বতন্ত্রভাবে , অতলস্পর্শী ভাবনার গভীরতায় স্পর্শ করে আমাদের চৈতন্যের নদী । দেশজ আটপৌরে শব্দের ব্যবহারে , বিরল পংক্তি বিন্যাসে এক মায়াময় ব্যতিক্রমী কবিতাজগৎ সৃষ্টি করেন তিনি । এখানে আমরা ধারাবাহিকভাবে পড়ছি তাঁর একটি কবিতা উপন্যাস । এবার অন্তিম পর্ব ।
কোথাকার অতিথি আমি ( মানস ভ্রমণ)
কোথায় স্বজনেরা
কেউ ডেকেছিল একদিন
তার স্বপ্নে --
একা একা ভেসে বেড়াই,
বলে দিতে পারে না কিছুই
এই জৈষ্ঠের রোদ
পথকে করি রাতের বাসর।
কোথাও স্বপ্ন-সুন্দরীদের দেখা নেই
ভেসে থাকা আছে
এক এক দিক থেকে
এক এক রকম আত্মজিজ্ঞাসা ----
নিজস্ব সুখ অসুখে আঁচড়ে ফেলছে নিজেই নিজের বুক ?
কেউ কাউকেই চেনে না।
সকাল-সন্ধ্যা নিজেরাই নিজেদের গুয়ে-মুতে মাখামাখি হয়
কাটা-ছেঁড়া করে কার প্রত্যাশাগুলি সমস্ত রাত?
মানুষ মানুষকে চেনে না !
অথচ মানুষ মানুষকে চিনতেই তো খোল-কর্তাল বাজায়,
তিলক মাখায় হরিনামে ----
হাত ধোয়ার জল কই
মুখ ধোয়ার ;
খানিকটা সাবধান হয়ে পথে পথে ঘুরতে যেয়েই
পথকে করেছি অচেনা ---
নিজেকে নিজে চিনতে পারি না কেন?
আজ ঈদের নমাজ
উৎসবের চাঁদই ঘোষনা দিল যেন, ঘরে থাকুন---
রাত শেষ করে, আবার মোনাজাতে, মানুষ মানুষকে একান্ত খুঁজে পাবে?
সে কথাতেই প্রশ্ন ফুলমিঁয়ার :
ধান কাটা শেষ করে
আজ তাই ঝাঁপিয়ে উঠল নবগঙ্গা ---- ?
তার ঈদ কী দিয়ে সম্পূর্ণ হবে যে ----
পঙ্গপাল আসছে নাকি ধেয়ে.....
করোনার চাইতে বড় !
এই কথা কওয়াকয়ি হয় হাটে-বাজারে, খেয়া নৌকোয় ;
বাতাস কাটি দুহাতে, মেঘে মেঘে চড়ে বেড়াই
পদ্মা, মেঘনা , যমুনা, ধলেস্বরী, ইছামতী, গড়াই
নাগর নদীর বাঁকে বাঁকে ;
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাই
যেন এক ফুঁয়ে ছুঁয়ে আসি সব
মন চাইলে হাঁটি, মন চাইলে গড়াই, ফসলের আলে আলে ...
পথের কোনায়, গাছের নিচেয় , নাহলে মগডালে --
কেউ নেই। সঙ্গে আছে শুধু ইচ্ছে-মুখের সারি--- !
যাকে খুশি ডাকি, যাকে খুশি নিয়ে যাই মনপাখির
ডানায় ভাসিয়ে---
কতকাল আগের এক রাত-ভোর স্মৃতিতে দোমড়াই,
হেসে হেসে কুটি কুটি হই ,
নিজেই নিজের বুকের ভেতর ?
কাঁদি না। কান্না যেন আসে না কিছুতেই ।
গোপন সে অভিসার
গতজন্মের কথোপকথন চলছে যেন এ জন্মের পথে পথে ?
হু হু হাওয়ায়, রোদেরা ছোটে যেন হাওয়াদের বুকে করে
কত দূরে যায়
মেঘেদের ছায়ায় ছায়ায় ?
একটি ফড়িংএর ডানা কাঁপে দেখি, ভাটফুলের ডগায়,
আঁশটেল বনে পথের ধুলো লেগে, এমনই আবহ করায় মনে ,
' এই পথ তুমি কীভাবে
রেখে গ্যাছো '.... ?
দ্যাখো দ্যাখো
একবার চোখ মেলে
চেয়ে দ্যাখো ---
কান্না ঘোরে হঠাৎ হাওয়ায়।
ঘোরে , মেঘের ছায়ায় ছায়ায় !
কাটা ফসলের ক্ষেতের উপর , সেই ছায়া নেমে আসে ----
মেঘ সরে যাওয়া হঠাৎ আলোদের সে যে কী
নাচনকোদন ;
সন্ধ্যা নামে, ঘর খুঁজি ----
খুঁজি, রাতের আশ্রয়.....
কার কাছে যাই
কোন দিকে ঘোরাই মাস্তুল
কেউ ডাকে না !
রাত ভেঙে পড়ে বাঁশ-জঙ্গলের মাথায়।
রাত ভেঙ্গে পড়ে পথের ওপাশে, শিশু-কড়াই , জারুল, অশ্বত্থ ,শিমুল
ইচ্ছেডানায় পাখা মেলে বসে পড়ে, অনেক রাতের
প্যাঁচারা;
বাদুরেরা ঠোঁটে ফেলে দেয়
রাতের খাবার ---
আত্মীয়রা কোথায়
পরিজন?
কে যে নিকট আত্মীয়, কে যে আমার প্রয়োজন -অপ্রয়োজনের সোহাগ কথা ?
কেউ সাড়া দেয় না। অজানা অচেনা গাছেরা পথ পাশে রাতের আশ্রয় দেয় ;
করোনা আতঙ্ক শিস দেয় মধ্যরাতের বাতাসে।
এখানে কি খানিকটা খার পাবো?
কীভাবে যে হাত ধুয়ে ফেলি , রাতের আহারের আগ ?
রাত ভোর হতে না হতে
গায়ে হাত রেখে ঘুম ভাঙিয়ে চলে গ্যালো প্যাঁচারা ,
বাদুরেরা ফেলে গ্যালো আধখাওয়া ফলের টুকরো ;
বুঝি , এই আমার আজকের আহার, এই আমার পাথেয় ---- ?
কোথাও পরিজন নেই। কোথাও আমন্ত্রণ আসে না ।
আতঙ্কে, নাকি সত্যি সত্যি এদেশে আর কেউ নেই আপনজন ?
কেন যে দিই না সাড়া
খন্দকার তো ডেকেছিল, 'ছায়ার খিদের জানলা খুলে..... '
কেন যে সাড়া দিই নি
কেন যে দাঁড়ায়নি সামনে
জবাব মেলেনি, নিজের কাছে নিজেই ------
ইচ্ছে-পতঙ্গের ডানায় শব্দ হয়েছিল খানিক, পেতেওছিলাম কোল
কেউ হাতটি দেয়নি গালে, মাথাটা রাখেনি, যেমন রেখেছিল কোনো এক কাল,
নিজস্ব প্রেরণায় -- নাকি প্রেরণার কাল বড়োই ক্ষণস্থায়ী ?
বুঝিনি ভাষা
এ জন্মে আর যেন বুঝে ওঠার সময় নেই ;
সময় কি মুহূর্তের রং ?
সময় কি এই আসে, এই যায়---জোয়ারের জলে?
নবগঙ্গা তুমিই বলো, এই সত্যটি কী দিয়ে গড়ো তুমি
ঢেউয়ে ঢেউয়ে...... ;
ঢেউয়ে ঢেউয়ে এমনই
নিস্তরঙ্গ সে--- ?
রোজ যারা হাটে-বাজারে তোলা দোকান চালায়
তাদের চোখে ঘুম নেই ।
শুয়ে-বসে কত আর চলে?
বাঁধা দোকানের একই হাল, মুদি-মশলা ছাড়া
কাঁচা বাজার চালায় যারা
তারাই শুধু ,আতঙ্ক নিয়েও
শহরে বাজারে যায়----
এ চিত্র দু'পারেই সমান ----
কোথাও আলুপটল পাঁচ
তো কোথাও পঞ্চাশ ;
কোথাও পচে , কোথাও আগলায় মানুষ ----
আবার এসব কিছুই নেই
কোথাও
কেউ কারো ধারে না ধার
গাছে গাছে, মেঘে মেঘে
বাতাস কেটে ভাবি, কোথায় একাত্তর, কোথায় জরুরী কাল----?
মুষ্টিবদ্ধ ; যারা এতকাল তুললো সোরগোল , তাদের সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ,
নিপাত যায়
আমি তাহলে কীসের কাব্য করে তোমাকে হারাই?
তুমি কি চালে-ডালে মুদি-মশলায় বেগুন-পটলে আজও রাখতে পেরেছ
সেই আমাদের ফুলে ফুলে ভেসে বেড়ানোর এক একটি মুহূর্ত ;----
পারোনি। পারোনি বলেই আমিও যাইনি তোমার গৃহে।
ডালে ডালে থমকে থেকেছি এমন রাতের অন্ধকারে,
বেপথ-বেভূঁই-- পাখপাখালির সঙ্গ করেছি এমন আতঙ্কের দিনে---;
যাবো কি যাবো না?
ঘুরতে পারবো কি আর
ঘোরান মুখে?
বাঁকানো ছায়ায় ফিরেছ যেমন, নিঃসঙ্গ আয়নায়--
আয়না বলেনি কথা
তুমিই বলিয়েছ তাকে
কীভাবে রেখেছে সে নিজেকে নিজের মতো ?
দ্বিতীয় ভাগে, তৃতীয় সত্তায় ?
ফেরা আমার হলো কি
ফেরাতে পারলে কি তুমি আমায় ?
তোমার মুখের ছায়ায় ভাঙতে ভাঙতে যে স্রোতের তলায় ডুবে গেলাম,
মাটি পাইনি, জল-শ্যাওলার গন্ধ নিয়ে পৃথিবীর
প্রথম প্রাণের গল্পে ঘুম এসেছিল খানিকটা ; ------
ঝিমে ঝিমে পার হলো কতো নাবিকের হাল ----
ডুবে ডুবে এসব সব দেখা হলো ; ভেসে গ্যালো কতো ময়ূরপঙ্খী -----
কতো যুদ্ধজাহাজ, কতো সভ্যতা এলো আর গ্যালো
তবুও তোমার মুখটি হলো না পুরোনো
আলো-বাতাশের এত কোলাহল, সবই তো নামলো নিচেয় ;
গান গেয়ে ফিরে গ্যালো কতো না উদাসী মন
সব দেখা হলো।
তবুও চিনতে পারিনি, বুঝতে পারিনি তুমি এসেছিলে না আসনি ?
ভুল ছায়ায় গুলতে গুলতে ফুরিয়ে ফেললাম সব জলছবি ?
খণ্ড আকাশের ছায়া ধরে আজও ডুবে আছি, অধরা জ্যোস্নার সেই চাঁদটিকে নিয়ে---?
তুমি কি আমার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিলে, প্রথম প্রাণের বিরহ---?
ঘুম এসেছিল খানিকটা!
স্বপ্নগুলো মরে যায় প্রতিদিন, চেয়ে চেয়ে দেখি----
যেভাবে একটু একটু করে দুহাতের শূন্যতার, সেও ভুল অর্থ করে ;
স্বপ্নদের লালিত্য এতটাই ধুসর ?
সবটুকুই সামর্থবানের সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতন ;
প্রতিটা সম্পর্কের গোড়ার সুতো এমনই জোড়া দেওয়া,
সবই ইঙ্গিতের কথোপকথন যেন ;
প্রকৃতকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় বুঝি?
হয়তো তাও ঠিক না, ভয়, সংশয়, অনিশ্চয়তা,
সবটা মিলেই এমনই এক কাণ্ড যা তোমাকে ভুল অর্থ বুঝতে বাধ্য করে ;
আমাদের বৌধিক সংসর্গগুলি ?
ঘুম এসেছিল খানিকটা...!
( অন্তিম পর্ব )

অসাধারণ! এমন এক অনুভূতি জারিত হলো যা প্রকাশের ভাষা নেই।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ বলব না শুধু। এই লেখা আমাকে মুগ্ধ করে। নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।
উত্তরমুছুনবাস্তব এবং মায়ার ফারাক যে কতখানি তা টের পাইয়ে দেয়।
অসাধারণ। অপূর্ব মায়াময় একটি যথার্থ দীর্ঘ কবিতা। হ্যাঁ আমি শব্দের এ-ই নিরুপম যাত্রকে দীর্ঘ কবিতা হিসেবেই গ্রহণ করলাম। কবিতা উপন্যাস বলে হয়তো নিতে পারলাম না। অবে গোলাপ যে নামে ডাকো গোলাপই...
উত্তরমুছুন