শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

ভ্রমণকাহিনি * মাধুরী দাশগুপ্ত



নায়াগ্রা ফলস। জগতবিখ্যাত জলপ্রপাত। বিচিত্র এর অবস্থান। নায়াগ্রা নদীতে মূলত দুটো জলপ্রপাতের মিলিত নাম নায়াগ্রা ফলস। নায়াগ্রা নদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার অন্টারিওর মধ্যে সীমা নির্দেশ করছে। আর নায়াগ্রা ফলস আমেরিকার সীমান্তে কিছু অংশ এবং অধিকাংশটাই কানাডার সীমান্তে পড়ছে । ভ্রমণপিপাসুদের কাছে নায়াগ্রার তীব্র আকর্ষণ এর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে। সেই সৌন্দর্যে স্নাত হবার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা আমাদের শোনাচ্ছেন লেখিকা মাধুরী দাশগুপ্ত।


নায়াগ্রা ফলসে হারালো যে-দিনটা


মাধুরী দাশগুপ্ত



বইয়ে পড়েছি, লোকমুখেও শুনেছি নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কথা। সেটা যে কোনোদিন স্বচক্ষে দেখব, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। সে সুযোগ সত্যিই জীবনে এল, আমার ছোট মেয়ে ডাম্পির কল্যানে। ও যদি পিএইচডি করতে আমেরিকায় না আসত , তাহলে হয়তো কোনোদিনই স্বপ্ন পূরণ হতো না। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত। স্বদেশের মাটিতে অনেক ঘুরেছি, আসমুদ্রহিমাচল থেকে কন্যাকুমারী। সেটা সম্ভব হয়েছে আমার এলপিসি আর আমার স্বামী রেলের যে পাশ পান,তার দৌলতে। তা নাহলে দু'দুটো মেয়ের ভালো স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে, সংসারের  দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পূর্ণ করে,ঘোরা সম্ভব হতো না। মেয়েদের ভালো এডুকেশন দেবো, ভালোভাবে রাখবো,ওদের ভবিষ্যতে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা সুপ্রশস্ত করবো, তখন শুধু সেই স্বপ্ন। নিজের শখ আল্লাদ সবকিছুর টুঁটি চেপে রেখেছিলাম।



ইউএসএ-তে এসে, আমাদের প্রথম দর্শনীয় স্থান দেখা নায়াগ্রা ফলস। চিরন্তন-ডাম্পি আমার ছোট মেয়ে জামাই, ওরা আগে থেকেই হোটেল বুক করে রেখেছিল। মুন্নু-দিব্যেন্দু আমার বড় মেয়ে জামাই, ওরা সব কিছু তৎপরতার সঙ্গে গুছিয়ে নিল। পথে আমাদের কি কি লাগবে, ওখানে হোটেলে ব্রেকফাস্ট কি হবে তার ব্যবস্থা এইসব। বড় একটা গাড়িতে আমাদের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হল আমাদের যাত্রা। চালক চিরন্তন নিজেই। খুব ভালো ড্রাইভ করে চিরন্তন। আজকের ওয়েদারও আমাদের অনুকূলে। সকালের দিকে একটু মেঘলা হলেও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হল আকাশ।


ছুটে চললো আমাদের গাড়ি। আমাদের সাথে সাথে চলতে থাকল মেঘ মুক্ত আকাশ, চারপাশের সবুজ বনানী, উন্মুক্ত প্রান্তর, আর প্রশস্ত ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা।কোথাও এতটুকু ধুলো-ময়লা নেই। রাস্তার চারপাশে শুধু সবুজের মেলা। দু'পাশের গাছপালার পাতার রং ঘন সবুজ। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো শিল্পীর আঁকা অপরূপ ক্যানভাস। কোনো গাছে কোনো  মরা বা শুকনো পাতা নেই। প্রাণের স্পন্দনে তারা সতেজ।সিমলা,কুলু,মানালি,কৈলাস,কিন্নর অমরনাথের পাহাড়ি রাস্তা দেখেছি। কিন্তু এ  পাহাড়ি রাস্তার সাথে তার যেন একটু অমিল পেলাম আমি। উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তায় অনেক গেছি। উঁচু থেকে নিচু, বা  নিচু থেকে উঁচুতে যখন গাড়ি ছোটে, কেমন যেন গা গুলায়... প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চারপাশে থাকা সত্বেও মনে হয় চোখটা বন্ধ রাখলে শরীরের অস্বস্তিটা কম হবে। কিন্তু এখানকার পাহাড়ি রাস্তা যেন দক্ষ কারিগরের নিপুন হাতে গড়া। কোনো কষ্ট নেই পথ চলতে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় অনেক কিছু বুদ্ধি মিস করলাম। ইউ এস এ-তে এখন মানে এই সময় কাকে বলে সামার,মানে গরমকাল। তাই এত সবুজের সমারোহ।ভাবলে অবাক লাগে আবার দু-এক মাসের শেষের শুরু হয়ে যাবে পাতাঝরা। রাস্তার দু'পাশের এই সমস্ত সবুজ গাছপালা হয়ে যাবে পাতা পল্লবহীন, চলতি বাংলায় আমরা যাকে বলি 'নেড়া '।  বরফে ঢেকে যাবে চারধার। প্রকৃতির কী অপরূপ খেলা এখানকার আবহাওয়ার।


নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে দেখে শুধু অনুভব করছি এ কোন সৌন্দর্যের জগতে এলাম। আকাশ কখনো মনে হচ্ছে দূরে বহুদূরে, কখনো মনে হচ্ছে এই বুঝি মাটির সাথে কোলাকুলি করছে। চারপাশে বাড়িঘর তেমন খুব একটা চোখে পড়ছে না।শুধু বড় বড় চওড়া রাস্তা।আর চারপাশের সবুজ বনানী। মাঝে মাঝে তির বেগে ছুটে চলেছে কিছু কিছু প্রাইভেট গাড়ি। চিরন্তন গাড়ি চালাচ্ছে মনে হচ্ছে একশো কিমি বেগে। আমরা সবাই আজ আনন্দে আত্মহারা। মাঝে মাঝে দিব্যেন্দু চেঁচিয়ে বলছে, ' মা ও দিকটা দেখো, কী সুন্দর! '


ডাম্পি-চিরন্তন আগে থেকেই বাফেলোতে আমাদের জন্য হোটেল বুক করে রেখেছিল। আমাদের আজকের গন্তব্যস্থল সেই হোটেল। প্রায় সাত ঘণ্টার পথ। অলরেডি আমরা অতিক্রম করে ফেলেছি অনেকটা। দুপুরে একটা রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করা ছাড়া দাড়াইনি কোথাও। চাষবাসের জমি রয়েছে কিছু। চাষবাস হয়তো হয় কিছু। তাদেরই বাড়িঘর ছড়ানো-ছিটানো এখানে-ওখানে। আর চোখে পড়ছে শুধু কবরস্থান। গাড়ি ছুটে চলেছে তির বেগে। আর কুট্টুস, মুন্নুর ছেলে, নানা রকমের মজা করে চলেছে গাড়ির ভেতর। কবরস্থান দেখলেই  চিৎকার করে বলছে, ' দিনান,আবার.... ' খুব মজা লাগছে ওর। আমি বলেই ফেললাম, ' জনমানবের চিহ্ন তো তেমন দেখছি না,তবে কি বড় বড় শহরের লোকজন মারা গেলে সাহেবরা এখানে নিয়ে আসে কবর দিতে?' সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। এইভাবে হাসির গল্প আর আনন্দে পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা নামল।পাহাড়ি রাস্তা,চিরন্তন গাড়ি স্লো করল। গ্রিল হোয়াট ক্যানস স্টেট পার্ক এর সামনে। এখানে একটা সুন্দর ফলস আছে। নামলাম আমরা গাড়ী থেকে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তা উপেক্ষা করেই আমরা এগোলাম। তখনও অন্ধকার ঘন হয়ে আসে নি। এখানে বেশ লোকজনের দেখা মিলল। কিছু কিছু বাড়িঘর সামনের দিকে দেখা যাচ্ছে। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। আলো ঝলমল করছে। আমরা এগোচ্ছি পেছনের দিকে একটা সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে উপরে উঠছে আমরা। বড় পাহাড় একটা। পাহাড় কেটে কেটে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ভেতরটা আধ অন্ধকার। টিমটিম করে লাইট জ্বলছে। অপূর্ব শোভা! শত ধারায় উপচে পড়ছে জলপ্রপাত। স্বচ্ছ নির্মল জল! পাহাড়ি ঝরনা অনেক দেখেছি। এক এক জায়গায় এক এক রকম। কিন্তু এই পাহাড়ের গা দিয়ে বেরিয়ে আসা বিভিন্ন ঝরনাধারা যেন আলাদা,একটু অন্য ধরনের। চোখ ভরে যাচ্ছে। মন যেন আনন্দে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে আমরা উঠে এসেছি অনেকটা। দূরে আরো উপরে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট ঝুলন্ত ব্রিজ। দিব্যেন্দু, চিরন্তনের ইচ্ছে ব্রীজে ওঠার। ওখানটা নাকি আরো সুন্দর।আমি বারণ করলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে।পাহাড়ের গুহাগুলোয় অন্ধকার গভীর হচ্ছে।


আবার চলা শুরু। এবার চোখে পড়ছে বড় বড় সুন্দর সুন্দর বাড়ি। সামনে লন বাগান। ভারি সুন্দর লাগছে দেখতে। এবার কিন্তু সবারই পেটে টান পড়েছে। দিব্যেন্দু,চিরন্তন হোটেল রেস্তোরাঁ  খোঁজাখুঁজি শুরু করল। একটা ইটালিয়ান রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম আমরা। খুব সুন্দর।সুসজ্জিত। প্রথমে ইটালিয়ান সুপ্। সুপ্  আমার বরাবরই প্রিয়। ওরা সবাই খুব ভাল খেলো। কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগলো না। খেতে পারলাম না।চিরন্তন বলল, ' মা, তোমার খাওয়া হলো না।' কুট্টুস বলল,' সব দেশের খাওয়া তোমায় অভ্যেস করতে হবে, না হলে বেড়াবে কেমন করে?'


রাত প্রায় ন'টা তিরিশ। হোটেলে পৌঁছলাম আমরা। হোটেলে ঢুকে হোটেলটা দেখে মন ও পেট দুটোই ভরে গেল। আহা,কী সুন্দর বাড়িটা! হোটেল বললে ভুল হবে,যার বাড়ি,মানে ল্যান্ড লর্ড-এর ডেকোরেশন-এর প্রশংসা করতেই হয়। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে যেন সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।চিরন্তন ডাম্পিকে আমরা ধন্যবাদ জানালাম,এত সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য।


মুন্নু - দিব্যেন্দু ব্রেকফাস্টএর  চা-কফির জোগাড় করল। আগের দিন ওরা মার্কেট থেকে সব নিয়ে এসেছিল। কেক, ব্রেড, কলা. সব। আভিজাত্যের ছাপ বাড়ির প্রতিটি আসবাবপত্র এমনকি জলখাবার ইউটেনসিল-এর মধ্যেও। বাড়িটার পেছনে খোলা জায়গা। পাশাপাশি অনেক বাড়ি। সাজানো-গোছানো কাঠের। স্নান সেরে আমরা রওনা দিলাম সেই কল্পনার নায়াগ্রা ফলস দেখতে। এখান থেকে গাড়িতে কুড়ি পঁচিশ মিনিট লাগবে, চিরন্তন বলল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা চললাম।এখানে মানে ফলস-এর কাছাকাছি লোকজন খুব চোখে পড়ল। অনেক সাজানো-গোছানো হোটেল-রেস্টুরেন্ট। এখানটা একদম জমজমাট। কিন্তুশান্ত পরিবেশ। হই হট্টগোল, ধুলো-ময়লা দূষণ নেই। ফলসে ঢোকার আগে, বিশাল বিশাল মাঠ। গাড়ি পার্ক করার। গাড়ি পার্ক করে আমরা হাঁটতে থাকলাম। আমাদের দেশের কৃষ্ণচূড়া ফুলের মত এক রকম ফুল চোখে পড়ল,দারুন দেখতে।এছাড়া নাম না জানা কত ফুলের বাহার। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাসে, গাড়িতে টুরিস্ট আসছে। ওরা টিকিট কাটল ভেতরে ঢোকার। তারপর আমরা গুটি গুটি পায়ে জেটিতে গিয়ে উঠলাম।

বাপরে বাপ! কোন দিকে তাকাবো? ওপারে কানাডা। এপারে ইউ এস এ।কাঠফাটা রোদ অথচ ঠান্ডা হওয়া। জেটিতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখছি ফলস। মনে হচ্ছে হাজার হাজার বছরের জল প্রপাত আর শব্দতরঙ্গ লক্ষ লক্ষ ধারায়  পড়ছে নিচের  জলে....পুরোটাই দৃশ্যমান। এর সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার কলমে নেই। আমি মোহিত,কিছুটা আত্মস্থিতও বটে। এই অপার সৌন্দর্যের জন্যই হয়তো অনেকে একে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বলে থাকেন। ওপারে কানাডার শিপ যাত্রীদের গেরুয়া রঙের জ্যাকেট গায়ে, রেইনকোট-এর মত দেখতে। শিপটি একেবারে ফলসের সামনে গিয়ে আবার কূল ধরে কানাডার জেটিতে এসে পৌঁছাচ্ছে। ঠিক একইভাবে ইউএসএ'র জেটি থেকে নীল রংয়ের রেইনকোট পরে এপারের স্লিপে উঠলাম। এক সময় চলতে শুরু করল আমাদের শিপ।

অসংখ্য বড় বড় ঢেউ-এর ধাক্কা এসে  লাগছে শিপে। আর সেই জল এসে লাগছে  আমাদের চোখে মুখে রেইনকোটে। একসময় শিপ একদম ফলস-এর সামনে এসে গেল। কী অপূর্ব! কয়েক মুহুর্ত বাকরুদ্ধ সবাই। ভিজিয়ে দিল আমাদের কিছুটা,তারপরই  শিপটা টার্ন নিল। ওপারে কানাডার শিপের যাত্রীরা আমাদের হাত নেড়ে বাই বাই করল। আমরাও ওদের টা টা করলাম। আমরা ফিরে এলাম জেটিতে। পাড়ে এসে আমার মনে হলো কানাডার সাইড থেকে বেশি ভালো করে দেখা যায় নায়াগ্রা ফলস।


দুপুরের খাবার খেয়ে আবার এলাম।এবার নিচে নয়। নায়াগ্রা ফলসের উপর দিকে বিশাল বড় পার্ক। এবার আমরা উপরে। ওপারে কানাডার লোকজন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখানে সন্ধ্যা নামে দেরিতে। তাই এখন রোদ চারদিকে। এত বড় পার্ক সচরাচর চোখে পড়ে না। চারদিকে নানা বর্ণের নানা রকম ফুল ও গাছের বাহার। এপাশ-ওপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছি।ওই উপর থেকে এসে পড়া ক্ষিপ্ত জলরাশি তীব্রগতিতে নেমে আসছে নিচে। তারপর ততোধিক ক্ষিপ্র গতিতে সাদা ফেনায় ফেনায় ভরিয়ে দিয়ে কিছুটা জলের  ধোয়া ছড়িয়ে নিচের ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর চলে যাচ্ছে কোন অকূল  পারাবারে...নির্বাক হয়ে দেখে চলেছি  আমরা।




আস্তে আস্তে সূর্যের নরম সোনালী রোদ ঢেকে ফেলছে চারদিক। আর আমরা সবাই গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকলাম কার পার্কিংএর জায়গায়। উদ্দেশ আমাদের হোটেল বাফেলো... মনের মধ্যে একরাশ আনন্দের ঝরনা নিয়ে রাত ন'টা তিরিশে হোটেলে ফিরলাম। জীবনে কত দিন আসে যায়! যেদিন চলে যায়, সে আর ফিরে আসে না। কিন্তু আজকের দিনটি যেন আরো অনাগত বহুদিনের জন্ম  দিল মনে, অপার সৌন্দর্যে স্নান করিয়ে।


                               --------------------------------------------------------------------------

 

সম্প্রতি প্রকাশিত মাধুরী দাশগুপ্তের গল্পগ্রন্থ 






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন