যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তরুণ গবেষক এবং প্রতিশ্রুতিমান লেখক অলোক । ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ । তাঁর শক্তিশালী কলম ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনেছে অমর স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। স্বাধীনতা দিবসের পুন্যলগ্নে সেই মহীয়সী নারীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য ।
উনিশ শতকের বিদ্রোহিণী স্বাধীনতা সংগ্রামী- মাতঙ্গিনী হাজরা
অলোক কোরা
গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
তাঁর বাপ-ঠাকুরদা আর স্বামী-শ্বশুরের ভিটেয় গিয়ে দেখা যাবে, অগোছালো ছবির মতো দুটো গ্রাম। হোগলা আর আলিনান। একটু যত্ন নিলেই পুন্যতীর্থের মতো পর্যটক টানত তমলুকের এই দুটো জায়গা।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গান্ধীবুড়ির আত্মবলিদানের পর ৭৯ বছর কাটলেও তাঁকে নিয়ে সে ভাবে চর্চা বা কোনও সংগ্রহশালা তৈরি হল না, বর্তমান প্রজন্ম, সাধারণের কাছে তিনি শুধুই স্বাধীনতা শহিদ। বিশেষ দিনে স্মরণের পর বেমালুম ভুলেই যাওয়া হয় তাঁকে।
অবাক লাগলেও একথা সত্যি, ১৯৭৭ সালের আগে কলকাতায় কোনও মহিলার মূর্তি ছিল না। সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন মাতঙ্গিনী হাজরা, তাঁর মূর্তিই হয় শহরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম কোনও মহিলার মূর্তি। শুধু মূর্তি, স্তম্ভ তৈরি করলে মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না।
মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার অন্তর্গত হোগলা গ্রামে ১৮৭০ সালে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তাঁর জন্মসাল নিয়ে নানান মতান্তর রয়েছে। পিতা ঠাকুরদাস মাইতি ও মাতা ভগবতী দেবী। দরিদ্র পরিবারের কন্যা বাল্যকাল থেকে প্রথাগত শিক্ষার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। আলিনান গ্রামের ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে অল্প বয়েসেই বিবাহ হয়। ভাগ্যের এক নিষ্ঠুর পরিহাস, নিঃসন্তান অবস্থায় ১৮ বছর বয়েসেই বিধবা হন মাতঙ্গিনী দেবী। এই অবস্থায় কিছুদিন পিতৃগৃহে কাটানোর পর স্বামীর গৃহে ফিরে আসেন তিনি। কুলগুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে ধার্মিক ভাবে জীবনযাপন শুরু করেন। তমলুকের রামকৃষ্ণ মিশনের একটা প্রভাব পড়ে ছিল মাতঙ্গিনী দেবীর জীবনে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই তাঁকে বিপ্লবের পথে নিয়ে এসেছিল। সারা ভারতবর্ষে তখন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে সারা দেশ উত্তাল। দিকে দিকে নারী শক্তির জাগরণ ঘটে চলেছে। কেবলমাত্র সংসার প্রতিপালন নয়, দেশের মুক্তির জন্যও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। মাতঙ্গিনী দেবীও বসে থাকেননি। দেশের মুক্তির টানে, আপন হৃদয়ের তাগিদে আন্দোলনে সামিল হলেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাতঙ্গিনী হাজরা। ১৯৩১ সালে তাদের বাড়ির সম্মুখে তাদের নিজেদের জায়গাতে একটা স্বেছাসেবক শিবির স্থাপিত হয়। ১৯৩২ সালের ২৬শে জানুয়ারি স্থানীয় কর্মীরা একটি শোভাযাত্রা বের করে। মাতঙ্গিনী দেবী শঙ্খধ্বনি দিতে দিতে সেই শোভাযাত্রাতে অংশগ্রহন করেন। এভাবেই এক শুভদিনে, শুভক্ষণে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সংকল্প পাঠ করেন তিনি।
মাহাত্মার আদর্শে সারা দেশ জুড়ে অহিংসা পথে স্বাধীনতার স্বপ্নে দিকে দিকে মানুষ আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। মাতঙ্গিনী দেবী ছিলেন মহাত্মার পূজারি, তাঁর দেখানো পথের অনুসারী। ‘গান্ধীবুড়ি’ নামেই তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করলেন। একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল এই সময়ে। মাতঙ্গিনী দেবী বাতের রোগের কারণে আফিম খেতেন। গান্ধীজীর আদর্শ গ্রহণের পর তিনি আফিম সেবন বন্ধ করে দিলেন। যখন বাতের রোগে কষ্ট পেতেন, তখন তিন বার গান্ধীজীর নাম উচ্চারণ করে জল পান করতেন, নিমেষেই তাঁর এই বাতের কষ্ট চলে যেত। গান্ধীজীর প্রতি এমনই ছিল মাতঙ্গিনী দেবীর ভক্তি, প্রেম, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। আলিনান লবণ কেন্দ্রে লবণ প্রস্তুত করে তিনি আইন অমান্য করেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে অনেকটা দূর হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে পথিমধ্যে ছেড়ে দেয়। তমলুক থানার চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। তমলুক শহরের গভর্নর বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও বিচারস্বরূপ তাঁকে ছয় মাস বহরমপুরের জেলে বন্দী জীবন কাটাতে হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে মাতঙ্গিনী দেবী কঠোরভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সমস্ত কাজে যুক্ত থাকতেন। ১৯৩৩ সালে তমলুক কংগ্রেস কমিটি অবৈধ থাকাকালিন একটা সম্মেলন করলে, পুলিশ লাঠিচার্জ করে সম্মেলন ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য মাতঙ্গিনী দেবী বারো মাইল পথ পায়ে হেঁটে সম্মেলনে সামিল হন। ১৯৩৯ সালে মেদিনীপুর জেলা মহিলা কংগ্রেস সম্মেলনে তিনি প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও কংগ্রেসের কাজে নিযুক্ত স্বেছাসেবকদের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকত। দরিদ্রের প্রতি তাঁর ওপার স্নেহ ছিল। পাড়ায় কেউ অভুক্ত রয়েছে জানতে পারলে তিনি তক্ষুনি তাঁর খাবারের ব্যাবস্থা করতেন। গ্রামে, সমাজে কেউ অসুস্থ হলে তিনি নিজের জীবন তুচ্ছ করে ওপরের সেবাতে ঝাঁপিয়ে পরতেন। সকলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও স্নেহ ছিল সমান। গ্রামের লোকেরা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গান্ধিবুড়ি বলে সম্বোধন করতেন।
১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গৃহিত হয়। ব্রিটিশ সরকার বেশ কিছু নেতাদেরকে প্রেপ্তার করেন। সারা ভারতের মতো মেদনীপুরও আন্দোলনে বিভীষিকার রূপ ধারণ করে। অসংখ্য সভা ও শোভাযাত্রা ব্রিটিশদের বিরুধ্যে সংগ্রাম করতে শুরু করে। তমলুক মেদিনীপুরের একটি মহকুমা। এখানে আন্দোলনকারী ছাত্ররা বহু স্কুল বন্ধ করে রেখেছে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে সরকার স্থায়ী ও তাৎক্ষনিক ভাবে বেড়ে ওঠা শিবিরগুলিকে ধ্বংস করতে শুরু করে। জনগণ আরও বেশি করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। আন্দোলনকারী কর্মীবর্গ স্থির করে ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারা থানা, সরকারি অফিস ও কোর্ট তারা দখল করবেন। এক লক্ষের মতো জনগণ এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। ২৮ শে সেপ্টেম্বর রাত থেকে সরকার বিরোধী তান্ডবলীলা চলতে থাকে। বড় বড় গাছ কেটে তমলুকে প্রবেশের প্রধান রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৭ মাইল লম্বা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের লাইন কেটে যোগাযোগ বন্ধ করা হয়। ডুবিয়ে দেয়া হয় খেয়া পারাপারের নৌকা। ২৯ শে সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী সাত দিন ধরে ধ্বংস করা হয়েছিল দুটি থানা, তেরোটি ডাকঘর, নয়টি ইউনিয়ন বোর্ড অফিস, চারতি ডাকবাংলো, মহিষাদল রাজ এস্টেটের তেরোটি অফিস প্রভৃতি।
১৯৪২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর ছিল জাতীর জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। পাঁচদিক থেকে পাঁচটি শোভাযাত্রা তমলুকের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। প্রচুর মহিলা ছিল এই শোভাযাত্রাগুলিতে। উত্তর দিক থেকে আসা বিপুল বাহিনীর মধ্যে ছিলেন ৭২ বছর বর্ষীয়া বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। বিদ্রোহীদল তমলুক দেওয়ানি আদালতের কাছাকাছি হতেই রক্ষী পুলিশ বাহিনী গুলির বন্যা বইয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে মাতঙ্গিনী দেবী তাঁর করনীয় কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। জাতীয় পতকা নিয়ে ফিরে তাকালেন, সারা শরীর জুড়ে বীরাঙ্গনার তেজদিপ্ত প্রতিভা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। সাথীদের দিকে জয়ধ্বনির সুরে বললেন- করব না হয় মরব, হয় জয় না হয় মৃত্যু, তোমরা ফিরে গিয়ে কি জবাব দেবে? পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। পেছনে তার পাঁচ হাজার নরনারী। পুলিশের গুলি এসে বিদ্ধ করল শরীর। লুটিয়ে পড়লেন না। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে গর্জে উঠলেন। একটা গুলি এসে তার কপাল ভেদ করে বেরিয়ে গেল। এরপরেও বারংবার তার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। কংগ্রেসের পতাকাটি মুঠোর মধ্যে শক্ত করে উঁচিয়ে ধরে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভাইদের বুকে গুলিবিদ্ধ কর না, তোমার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান কর- জীবনের শেষ মন্ত্রধ্বনি উচ্চারণ করে স্বাধীনতার রক্তে নিজেকে সিক্ত করে, জাতীর মেরুদণ্ড শক্ত করে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন এই বিরাঙ্গনা মহীয়সী।
সূত্রঃ
১ .স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের নারী, কমলা দাসগুপ্ত, বসুধারা প্রকাশন, আশ্বিন ১৩৬৭।
২https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%80_%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A6%BE
৩ "স্মরণ করেই ভুলে যাওয়া, একলা আঁধারে গান্ধীবুড়ি"। EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০২০।
৪ "কলকাতার পথেঘাটে ভারতের মহীয়সীরা, দেখে নিন ছবিতে"। Indian Express Bangla। সংগ্রহের তারিখ ২ জুলাই ২০২০।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন