সম্প্রতি কবি রামচন্দ্র প্রামাণিক -এর' কালপক্ক 'নাটকটি পড়ে দেখলেন কবি -ঔপন্যাসিক বিশ্বনাথ পাল। তাঁর পাঠ-প্রতিক্রিয়া পাঠককে এই অভিনব নাটকটি সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে, নিঃসন্দেহে। নাটকের গভীরে প্রবেশ করে তার নির্যাসটুকু তুলে এনেছেন বিশ্বনাথ।
কালপক্ক * ভিন্ন জিজ্ঞাসার আকর
বিশ্বনাথ পাল
সদ্য পড়লাম কবি রামচন্দ্র প্রামাণিকের রচিত চতুর্থ নাটক ‘কালপক্ব’। ‘বাংলা ভাষায় নিবেদিতপ্রাণ লেখকের কাছে নাটক একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।’— মনে করেন এই কবি। ইতিমধ্যে তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত চারটি নাটকের মধ্যে (বদ্ধোহস্মি, তুঘলক, দেবল এবং কালপক্ব) ‘দেবল’ বাদে বাকি তিনটি আমার পড়া। গ্রিক নাটকের আঙ্গিকের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত রামচন্দ্রের নাটকেও তিনটি ইউনিটি বজায় থাকে—ইউনিটি অব টাইম, ইউনিটি অব প্লেস এবং ইউনিটি অব অ্যাকশন। তাঁর নাটকও গ্রিক নাটকের মতো অপরিবর্তিত ঘটনাস্থলে ২৪ ঘণ্টার সময়কালে বিস্তৃত।
মহাভারতের যুদ্ধের ১৮তম বা শেষ দিন দুপুরে কুরুক্ষেত্রের কাছাকাছি বনে এক বনবাসীর কুটির প্রাঙ্গণে ‘কালপক্ব’ নাটকের শুরু এবং রাতে শেষ। মহাযুদ্ধের রথীমহারথীরা নয়, বনবাসী প্রান্তিক মানুষ, ভাগ্যান্বেষী ব্রাহ্মণ, রণক্ষেত্র ছেড়ে পালানো সারথি প্রভৃতি এই নাটকের কুশীলব। রাজারাজড়াদের জীবনের তুমুল ঘটনার অভিঘাত কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে পড়ে, তা-ই এই নাটকের বিষয়বস্তু। এই নাটক পড়তে পড়তে মহাভারতের এক ভিন্ন ব্যাখ্যাও উঠে আসে। এই নাটক প্রশ্ন করতে শেখায়। শত্রুকে হত্যা করা হচ্ছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। অথচ হত্যা মানে হল ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি যে প্রাণ তার বিনাশ। এটা কি ধর্ম হতে পারে?
বারণাবতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কীভাবে সায় দেন ঘুমন্ত নিষাদ-পরিবারকে পুড়িয়ে মারায়? তা কি শুধু এই কারণে যে মৃত পাঁচ ভাই ও মায়ের পোড়া শরীর দেখে পাণ্ডবরাই মরেছে ভাববে শত্রুপক্ষ? ঘুমন্ত আশ্রিতকে পুড়িয়ে মারা কি অপরাধ নয়?
নতুন রাজধানী বসানোর জন্য খাণ্ডববন যখন পোড়ানো হয়, তখন বন্যপ্রাণী বা অনার্য বনবাসীদের কথা ভাবা হয় না। এও যেন এক উচ্ছেদের গল্প। বহুজাতিক পুঁজির কাছে যেমন আদিবাসীরা তাদের জল, জঙ্গল, জমি সুরক্ষিত রাখতে পারে না—তাই। কিন্তু যে যুদ্ধের জন্য এত আয়োজন, সেই যুদ্ধশেষে বিজয়ীপক্ষেও পাণ্ডবরা এবং কৃষ্ণ সাত্যকি বাদে আর তো কেউ বেঁচে থাকে না। নাটক শেষ হচ্ছে—‘হতপুত্র নির্বান্ধব সহায়হীন স্থবির যুধিষ্ঠিরের জন্য রাজ্য আর কোন কাজে লাগবে?’—এই সংলাপে। মহাকালকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না, মহাকালের প্রেক্ষিতে মহাযুদ্ধের অর্থহীনতা যেন এই নাটকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রিয় পাঠক, এই নাটক পড়ে আপনার নাটকপাঠের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করুন।
নাটক# কালপক্ব।। রামচন্দ্র প্রামাণিক
প্রকাশক।। ঋতাক্ষর


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন