শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

গল্প * নিমাইচন্দ্র সাহা



জীবনের অপার আনন্দে উদ্ভাসিত গল্পকার নিমাইচন্দ্র সাহা-র কলম। বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো দোলনায় কী ভাবে এক বনের বুলবুল পাখি এসে বাসা বাঁধল এবং লেখক-এর মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীর দিনটিতেই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ধরা দিল এক চরম সত্য,তা এই ছোট গল্পটির প্রতিপাদ্য।   


গল্প নয় 

নিমাইচন্দ্র সাহা


আজ ২৭শে এপ্রিল ২০২১সাল। আজ উড়ে গেল পাখি। কোন পাখি? না, একটা বুলবুল পাখির বাচ্চা। ঠিক একমাস আগে, ২৬শে, মার্চ লক্ষ করি একটা বুলবুল পাখি আমাদের দক্ষিণের বারান্দায় লম্বা লম্বা শুকনো দূর্বা-ঘাস মুখে করে এনে রাখছে। কিন্তু বার বার পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। দূর্বা-ঘাস কোথায় রাখার চেষ্টা? বারান্দায় একটা দোলনা আছে। দু' দিকে ঝুলছে লোহার শিকল। ফুট-দুয়েক উঁচুতে কাঠের পাটাতনের উপর বসার জায়গা করা। বারান্দায় ছাদের মাঝখানে দোলনার ওপরে একটা লোহার 'S' ঝোলানো আছে। একটা ছোট্ট পাখা লাগাবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তা আর লাগানো হয়ে ওঠে নি। লোহার ঐ 'S' টার উপরেই শুকনো দূর্বা-ঘাস এক একটা করে বারবার এনে রাখছে বুলবুল পাখিটা বাসা তৈরি করার জন্য, আর তা বারবার পড়ে যাচ্ছে নীচে। কদিন ধরে দেখছি, আর ভাবছি - ' ' ' কি বোকা পাখি টা।' ঘাটে শুয়ে জানলা দিয়ে দেখছি আর ভাবছি, - পাখি তুই কি সত্যি ই এতো বোকা? না, এটা তোর লোক- দেখানো 'বোকা-সাজা'।

শুধুই ছলনার আশ্রয় ?পক্ষী-বিশারদ সেলিম আলী, যার বিখ্যাত বই 'The Fall of a sparrow ' বেঁচে থাকলে তাকে শুধোতাম -'বুলবুল পাখি কি সত্যিই এত বোকা হয়?' কিন্তু তা যখন আর হবার   নয়, নিজেই মাথা ঘামাতে থাকি আপন মনে। একদিন, দু'দিন,তিনদিন গেল। কেবল দেখে যাচ্ছি পাখি টার চেষ্টা আর অধ্যাবসয়। ও যেন নেপোলিয়ান কে হারাবার যুদ্ধে অবতীর্ণ!


 বুঝতে পারি পাখি আমাকে বোকা বানিয়ে ফেলেছে এবং সুপরিকল্পিত ভাবেই। তাই এই পঁচাত্তরের যুবা কে , নিচুতলা থেকে ভারী কাঠের মইটা টেনে দোতলায় তুলতে বাধ্য করলো। সঙ্গে আনি খানিকটা লোহার সরু তার , তাই দিয়েই 'S' টার চারধার জড়িয়ে দিলাম ভালো করে। শুধুই খানিকটা তার পেঁচিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা! একটু  পরেই দেখি,শুরু হয়ে গেছে, পাখি টার খড়-কুট নিয়ে আসা।অবিরাম উৎসাহ ভরে ছোটাছুটি ....। হঠাৎ ই আবিষ্কার করি - ওর চালাকির কাছে একটা মানুষ হয়েও, কেমন হেরে গেলাম! ভাবতে থাকি - আমাদের সকলের মনের মধ্যেও এক একটা পাখি বাস করে। সে আমাদের ভাবায়, কাঁদায় আবার আনন্দ দিয়ে মুখে হাসিও ফোঁটায়। আর তার সাথেই চলে আমাদের আজীবনের আলাপন। না হলে, লালন সাঁই- গোঁসাই কেমন করে গাইতে পারেন -' খাঁচার ভিতর অচিন-পাখি ক্যমনে আসে যায়!' কিন্তু সে পাখি যে ধরা-ছোঁয়ারও বাইরে ! সাত-সকালেই ছোট্ট একটা বুলবুল-পাখি আমায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে  দিয়ে গেল। তুমি যতই যত্ন-আত্তি করো,বাসা বানিয়ে দাও একদিন ও ঠিক তোমায় ফাঁকি দিয়ে ,বাসা ছেড়ে, মায়ের সঙ্গে উড়ে পালাবে। তুমি আর তার নাগাল পাবে না। বুলবুল-পাখি নিয়ে পাশ্চাত্যের কবিরা বিখ্যাত সব কবিতা লিখে গেছেন। আমাদের এই বুলবুল পাখি কে ইংরেজিতে বলা হয়- Indian Nightingale.


 গত প্রায় একমাস ধরে একটা পাখি তার ছানা নিয়ে আমার সাথে একই ছাদের তলায় বসত করে গেল।মাত্র দু'দিনের মধ্যে বানিয়ে ফেলেছিল সুন্দর ও নিপুণ- ভাবে বোনা বাসা। গিন্নি আমায় বল্লে তার দিয়ে বাসা যখন বানিয়েই দিলে,আর একটু বড়ো করেই বানাতে পারতে। ঐ টুকু বাসায় পাখি ডিম পাড়বে, ডিমে তা দেবে, ডিম ফুটে ছানা বের হবে, তারাও আবার একটু একটু করে বড়ো হবে , তখন কে কোথায় থাকবে  বল দেখি! এই যা: তাই তো এতো কথা তো আগে কখনো ভাবিনি । মনে মনে ভাবলাম, একেই বলে মায়েদের সাংসারিক বুদ্ধি। মা- বুলবুলের সঙ্গে বিশ্বের মাতৃ-জাতিকে আর একবার গড় করি মনে মনে।

সন্ধ্যায় গিন্নি বল্লে, সেই সকাল থেকে সবকিছু ভুলে পাখির বাচ্চা নিয়ে কোথায় ডুবে আছো? আজ যে ২৭শে এপ্রিল মার প্রয়ান- দিবস! বড়ো মেয়ে সঞ্চিতা এই মাত্র মনে করিয়ে দিলে -এই সন্ধ্যায়! মনে করিয়ে দিলে বটে, কিন্তু আমরা যে প্রিয়-জনের মৃত্যু কে কখনও ভুলে থাকতে চাই নে। একমাত্র এই দুঃখটাকেই যত্নে মনের মণিকোঠায় স্মৃতি-রূপে ধরে রাখতে চাই। 'The sorrow for dead is the only sorrow which we refuse to divorce'.

 এক মা বুলবুলের, তার ছানা নিয়ে ভোরের নরম আলোয়, উন্মুক্ত-আকাশ উড়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দ, যদি আর একজনের মাতৃ-বিয়োগের বিরহ-ব্যাথা সারাটা দিনের জন্যে ভুলিয়ে রাখতে পারে, তাহলে বোধ করি কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না। নবারুণের সোনালী রশ্মি-বেয়ে যে আনন্দ-ধারা ছুটে যায় এক নতুন দেশে, সে যে সব দোষ-গুনের উর্দ্ধে। সে যে উর্দ্ধলোকের এক অপার্থিব দেশ।

 দেখি, সন্ধ্যার পর, মায়ের ছবি টেবিলে সাজানো সদ্যফোঁটা একরাশ বেলফুল দিয়ে। সবার অলক্ষ্যে করজোড়ে মাকে প্রণাম করি। অনাবিল-আনন্দ যে মৃত্যুকেও জয় করে নিতে পারে, আজ সন্ধ্যায়  তা আর একবার উপলব্ধি করলাম। সদ্যফোঁটা বেলফুলের সৌরভ ,কোন এক সূক্ষ-পথ ধরে, মনটাকে  মৃত্যু-লোকের উর্দ্ধে এক অমৃত-লোকে উত্তরণ করে দিল ! কতক্ষণ জানি না এই আনন্দে বিভোর হয়ে ছিলাম।

 পার্থিব দু,টি আঁখি আপনা হতেই কখন, কিছুক্ষণের জন্য মুদে আসে....। অন্তরে শুনতে পাই টুং টুং একতারার  মৃদু-স্বর । তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কে যেন গুনগুন করে গেয়ে চলেছে - ' খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, ক্যমনে আসে যায় .....।


                                                    .................................



 নিমাইচন্দ্র সাহা-র আঁকা কয়েকটি অসামান্য ছবি








1 টি মন্তব্য: