' বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা--' লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ, তাঁদের উদ্দেশে ' পান্ডুলিপি ভাষ্য,টীকা,কালি আর কলমের পর ' যাঁরা 'বসে আছে সিংহাসনে ' আসলে তাঁরা তো কবি নন, কী করে বুঝবেন, সৃষ্টির মুহূর্তে কবির অন্ত:সমুদ্রের বিচলন।যেমন বুঝলেন তরুণ কবি সব্যসাচী মজুমদার দুই অগ্রজ কবির গহীন গভীরে ডুবে। সম্প্রতি তিনি পড়লেন কবি চন্দন রায়- এর 'পরিশুদ্ধ কাঙাল ' এবং কবি দিলীপ চন্দ-এর ' অলৌকিক নক্ষত্রলোক ' বই দুটি। রইল সেই পাঠআবিষ্কারমালা -----
তৃতীয় সমগ্রের কবিতারা
সব্যসাচী মজুমদার
একটা পাঠ্য যখন আপনার সামনে উপস্থিত,আপনি কীভাবে কতরকম ভাবে তাকে দেখেন---এই প্রশ্নগুলোর কোনও অস্তিত্বই থাকে না।মূল্যমান হারায় আপনার সচেতন। কবিতা পড়ার সময়ে একমাত্র নির্জ্ঞানই থাকে সক্রিয় আর প্রকৌশলের প্রত্নপ্রতিমা অতিক্রম করে যদি না হৃদিনৈঃশব্দ আপনার অসহায় স্পর্শ করে,সে পাঠ্যের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আমার কাছে নেই।মস্তিষ্কবৃত্তি বাংলা কবিতার বিস্তর বিস্তৃত নমুনা প্রদর্শন করলেও তা আলোড়িত করেছে কী পাঠক সমগ্রকে? বিবিধ আন্দোলনের উত্তর এ প্রশ্নের নিষ্পাদক হতে পারে।যাই হোক কবিতার কাছে অসহায়তাকে চাওয়ার অক্ষমতা থেকেই পড়ে ফেললাম'পরিশুদ্ধ কাঙাল'।
বাংলা কবিতার একটি পরিচিত নাম চন্দন রায়ের সাম্প্রতিকতম কাব্যটি মোট বিয়াল্লিশটি কবিতায় নির্মিত।কবির ষষ্ঠতম কাব্য একটা উদাসীন রঙের বিন্যাস।অযত্নলালিত সে রঙের দেহে খড়ি উঠছে, চুল অবিন্যস্ত।ফুটপাতের গন্ধ,টক ভাতের গন্ধ,গ্রিসের দাগ,কাদার ছিটে,তুমুল নদীর হু হু বাতাস রয়েছে সে রঙের নির্মাণে।বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় করে,আর্কেটাইপ ভেঙে চন্দন বলেন,"আচমকা গুণ্ঠনের চিক ভেঙে সুবর্ণরেখার/জন্ম হয়, অনুভবে মায়া, বয়সে বিচ্ছিন্ন সুখ/চাঁদের কাছে জমা হয়,প্রকৃত শান্ত অগ্নিরূপ,/মাটি ভেঙে ভেঙে প্রেম,নিমেষে বুঝতে পারে/হাজার হাজার বর্ষাকালের আত্মগোপন সুর।"(একা অন্ধকার ঘিরে)।কবির সুফিয়ানা চলতে থাকে জনপরিচিতির বিবিধ প্রান্তে,"এইসব পাথরের কাছে,এইসব তুলনামূলক/সকলের নিঃশ্বাস সকলের কাছে,কিছুটা লোকালয়--/দেখা হয়,দেখা হয় না,জল পড়ে,জলের কথা হোক/কত শব্দ খেলা করে,কত শব্দ নিতান্ত পালক..."
আসলে বাংলা কবিতা অদ্ভুত ভাবে টেক্সট আর অল্টার টেক্সটের জন্ম একই সঙ্গে দেয়। একটা প্রশ্ন আর একটা প্রতিপ্রশ্নের জন্য আরও পাঠগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। সূত্র ধরে আসে ব্যক্তি লেখক ও পাঠকের দ্বন্দ্বজাত রসোদগার।এ গ্রন্থ আসলে একটা অল্টার,"আর যখন যেখানে উন্মাদিনী ছন্দ তোলপাড়/সেখানে কৃষ্ঞের কথা,কত সালে জন্মেছে বিজ্ঞানী/সেসব নিয়ে গান বাঁধবার মৃতঘোড়া দেখেছি/এরপর তোমাদের ঘরে ছেলেপুলে ঠিকঠাক/ আছে কিনা জানা হলে হাসপাতালের মধ্যে চারা/লাগিয়ে দিয়েই বেশ্যাবাড়ি,খাকি ছয়লাপ ভোঁ ভোঁ"। (হাসপাতাল)আমার টেক্সট হিসেবে মনে পড়ে গেল জয় গোস্বামী প্রণীত পারমাণবিক বিস্ফোরণ বিরোধী কবিতাটি।
চন্দন রায় হচ্ছেন সেই পর্যায়ের কবি,যাঁদের কাছে টপিক লুপ্ত হয়ে ধরা দেয় একটা ধারণা।যে ধারণা আমাদের অসমান পৃথিবীর স্বননে লিপ্ত হয়ে থাকে চিরবধি।অসমান স্পন্দ আর আততি হয়ে ওঠে তার বাহক,"পাখিরা বসেছে। ঘুমখোলো,ঘুমখোলো পাড়ায় পাড়ায়/ঊরুজল জলঊরু গাছ ছুঁয়ে কী কাণ্ড বাঁধিয়েছে দেখ/একদিকে উড়ে যায় একদিকে ফিরে আসে খুদে খুদে /শিশির সাঁতার, পাতার ওপরে চুপিসাড়ে পাখি তার /ডানা দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে,দাও দাও আরো ঘন ভোর/পায়ে মুখ রেখে এত ভোরে শয্যায় রেখেছে যাকে"।(পাখিরা বসেছে)।
এমন কোনও লেখাই পাবেন না, যেখানে বিষয়গত বিখ্যাতির ওপর উপস্থাপন নির্ভর করেছে। একটা নির্দিষ্ট বক্তব্য অবশ্যই কেন্দ্রগ কিন্তু প্রোপাগান্ডা নয় ।ইমপ্রেশন তৈরি করে। একটা জায়মান কারবালা দেখে দেখে নিষণ্ন মানুষের একান্ত ইচ্ছে উপ্ত রয়েছে রচনাগুলির একান্ত ঘরানায়,"টের পাই আমার মাথার পিছনে হু হু বাতাস,লাল মাটি, নদীর কিনার,ব্যক্তিগত এক-একটা করে দেয়াল ভাঙে/আর আমার সমস্ত সংখ্যাতত্ত্ব মুছে গিয়ে বাতাস সাঁতরে চলে যায় উদাসী /রাখাল,সেই প্রথম এবং বোধহয় সেই শেষ আমি জঙ্গলের চাঁদের সঙ্গে /পরিশুদ্ধ/কাঙালের মতো জাতীয় সঙ্গীত গাইতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম..."(পরিশুদ্ধ কাঙাল)
উদাসীনতা গ্রন্থের নিষণ্নকে আস্তে আস্তে রং দেয়।ঈষৎ ছাইয়ের গায়ে লাগতে থাকে বিবিধ গুয়াশ। একটা দোমড়ানো কোলাজ তৈরি করতে করতে চন্দন হঠাৎ দীর্ঘস্থায়ী রেজারেকশনে বিশ্বাস করে ফেলেন,"যেতেই হবে,কখন যাবো/সেইটুকুই তোমার কাছে/জানতে চেয়ে জানলা খোলা/মাটি খামচে লুকিয়ে খোঁজা/ভরা বর্ষা, সীতার মতো/কখন যাবো/কখন যাবো/দারুন একা অন্ধকারে..."(কখন যাবো)।
চন্দন রায় এগ্রন্থে প্রচলিত তিন ছন্দ নির্ভর হননি।প্রণিধানের মতো সমস্ত ছন্দ প্রত্যক্ষ মুছে অপ্রত্যক্ষ গদ্যে লিপ্ত হয়।প্রতিটা লেখাই এই যোগে সংযুক্ত হয়ে যায় একটিই জার্নালে।ভাষা ব্যবহারের জটিলতা অথবা বিবিধ প্রকৌশল ব্যতিরেকে কবি বলে গেছেন একটি সময়খণ্ডের প্রেক্ষিতে তাঁর জায়মান,"
"শব্দের আড়ালে মেঘের কিছু শব্দ আছে/মেঘ যে সব নিয়ে/অনেকগুলো বাড়ির উঠোনে, মাটির গভীরে/এবং বাতাসের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান আলাপচারিতায়/শব্দের প্রকৃত অর্থ/সেই শব্দের ভিতরেই খুঁজে নিতে বলে"।(শব্দের আড়ালে)
জায়মান কবিতার এই গ্রন্থ আপনার পাঠ আদৃত হোক।এ আলোচনা সার্থকতা পাবে।
আপনি বুঝতে পারছেন যে কবিতা কৌশল মোচন করে কেবল মুগ্ধ হতে চেয়েছে, দিলীপ বাবু তাকেই লিখেছেন,"আকাশে ঝকঝকে চাঁদ উঠলে /গোল হয়ে বসে চুটি ধরায় /মানুষের দেবতারা।/বারোমাসে তেরো পার্বণের /কোনও এক পরবের দিন/ফুলের মতো স্নেহ নিয়ে/মানুষের মাসি ডাকে:/দিলীপ আমাদের ঘরে/খাত্যে যাবি।(নিমন্ত্রণ)। লক্ষ্য করুন, মানুষ হয়ে ওঠার বাসনায় কী দারুণ অরণ্য ঘনিয়ে আসে। মানুষ হতে চাওয়াও কী!কোনও চাওয়া রইল কী! কেবল নির্মোহ 'চালগুড়ি রঙা বাছুরটির' ছুটোছুটি ছাড়া!
এখানেই প্রসঙ্গ পায় বাংলা কবিতার নৈঃশব্দ। একটা একটা করে দৃশ্য শূন্যতার ওপর তৈরি করে শূন্যেই মিশিয়ে দিচ্ছেন কবি।আর দূরাবহে কাফি বেজে চলেছে নিয়ত,"গাছের সঙ্গে আমার নিজের বাঁধাবাঁধি /তুমি কি জানো,/গাছের নিকট আমার কান্নাকাটি/ছাতিম পাতায় দুঃখ বেদনা রেখে/আমি কোথাও যাবো না।"(ছাতিম পাতায় দুঃখ বেদনা)
দিলীপ বাবু সত্তরে লেখা শুরু করেন।যে দশক বিবিধ বাঁকে গতিমান। সেই বক্র পথেই নির্মল হালদারের যে স্বচ্ছ স্বর শোনা গেল,তা রণিত দিলীপ চন্দের রচনাতেও।নির্মোহ অবভাস রচনা করে যান,"সরষে খেতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করব/সরষে খেতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করব/জীবন কত সুন্দর।/শূন্যে এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেল।"(জীবনের প্রসারতা)
মাত্র দুই ফর্মার বইয়ের ভেতরে রয়ে যায় এক স্বভাব কবির নিবিড় চরিত্র। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়,সারাৎসারকে লিখে ফেলাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। সমস্ত দৃশ্য কবিতার উপাদান তাঁর কাছে।যেমন বাংলা কবিতার অহং আনন্দ বাগচী রয়ে গেলেন এ কাব্যে অনিশ্বরতায়,"নির্জন বাসস্টপ---/আপনি একা একা দাঁড়িয়ে দেখছেন,/জীর্ণ সেগুন কাঠের মুখ।/হয়তো বা ভাবছেন রঙ্গমঞ্চে ভুলে যাওয়া/সংলাপের জন্য হা-পিত্যেশ।"(তর্পণ)এই তো কবিতার বিশুদ্ধ অন্বয়।
দিলীপ চন্দ রচিত পুস্তিকাটির সংগ্রাহক হতে হবে, কেননা এ পুস্তিকা আসলে একটি আরণ্যক।
পরিশুদ্ধ কাঙাল: চন্দন রায়: লেখার কালি: একশো টাকা:প্রচ্ছদ: অপরূপ উকিল
অলৌকিক নক্ষত্রলোক: দিলীপ চন্দ:আদম: চল্লিশ টাকা:প্রচ্ছদ:প্রদীপ দত্ত



ভালো লাগল লেখাটা
উত্তরমুছুন