এ সময়ের একজন অগ্রগণ্য লেখক সম্রাট মুখোপাধ্যায়। সমাজ শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে বড় গুণ। ' হ য ব র ল ' এবং ' ডমরু চরিত ' " বাংলা উপন্যাসের প্রবল শরৎ- রবীন্দ্রকালে , মানিক- বিভূতি- তারাশংকরপথে প্রবেশের আগে, কার্যত এই দুই আখ্যান ছিল দু'খানি প্রবল বিদ্রোহের তোপধ্বনি।" শক্তিশালী গদ্যে অনন্য রচনাশৈলী দিয়ে যুক্তি পরম্পরায় লেখক 'লঘু সাহিত্যের কোটা ' থেকে উদ্ধার করে এই বই দু'টির মহত্ত্ব প্রতিপন্ন করেছেন।
নভেল চিনতেও মনের স্বাধীনতা লাগে
সম্রাট মুখোপাধ্যায়
স্বাধীনতা দিবস এলেই স্বাধীনতার কথা ওঠে। আর স্বাধীনতার কথা এলেই আমার দু'খানি বইয়ের কথা আজ মনে পড়ে। বারবার। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তো অনেকরকম। দু'টি বই। যে দু'টি বই-ই লেখা হয়েছে ১৯২০'র আশেপাশে।
'হযবরল' আর 'ডমরু চরিত'।
এই দু'টি বইকে সাধারণভাবে লঘুসাহিত্যের কোটায় ফেলে দেওয়া হয়! শিশুসাহিত্য আর রম্যসাহিত্যের ঘরে! ডমরু বড়জোর ঘনাদার অতীত।
তা,এহ বাহ্য!
আমি কিন্তু আজ এই বই দু'টিকে উপন্যাস হিসেবেই পড়ি। বাংলা উপন্যাসের প্রবল শরৎ-রবীন্দ্রকালে, মানিক-বিভূতি-তারাশংকরপথে প্রবেশের আগে, কার্যত এই দুই আখ্যান ছিল দু'খানি প্রবল বিদ্রোহের তোপধ্বনি।বঙ্কিমের মহিমমান 'গ্র্যান্ড ন্যারেশান'খচিত মহাকাব্যপ্রতীম উপন্যাস-মডেলটির প্রতি। যে মডেল থেকে রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র,এমনকি তারাশংকরও বেরোতে পারেন নি। মানিকে ছটফটানি ছিল। বিভূতিতে অন্যপথের ইশারা ছিল। জীবনানন্দতে নির্জনে গিয়ে বসে-পড়া ছিল। জীবনের নির্জনতায়। কিন্তু সেই সবটাই ছিল,মনে রাখতে হবে, ইউরোপিয় লেখালেখির কোনও-না-কোনও ছাঁচে। বা,প্রভাবে। কিংবা মুদ্রাদোষে।
কিন্তু সেখানে বিকল্প-কল্পনার উড়াল ছিল না। অন্য কোনও নতুন মৌলিক পথের প্রতিষ্ঠা ছিল না। ইউরোপের নভেল-ভূখণ্ডে রাখলেই, তা যে ঘুরে-ফিরে আসলে বঙ্কিমের উত্তরসূরীই বনে যাওয়া হবে,এই সারকথা স্বীকারের 'ব্যালেন্স শিট'টি ছিল না।
ফলে আমাদের বাংলা উপন্যাসের প্রতিষ্ঠিত ভূবনে বহুদিন,বহুদূর পর্যন্ত দু'টি কলোনি থাবা- বিস্তার করে দাঁড়িয়েই থাকল। তার একটি ইউরোপ-প্রত্যাগত ভাবনা এবং নভেল-আদলের ছায়া। অন্যটি বঙ্কিম প্রবর্তিত মহাকাব্যিক 'গাম্ভীর্য'এর ছায়া(একটু লঘু শোনালেও বলি,যেন 'হাউসকোট' গায়ে চিরকেলে বাংলা সিনেমার বাবা কমল মিত্তির!)
এই ধরনের লেখা-পড়ায় মহাকাব্য 'নভেল' বলে বিবেচিত হল। কিন্তু 'হতভাগ্য' মঙ্গলকাব্য 'নভেল'এর জাতে উঠল না! উঠলে 'হিউমার' মূখ্য রসের মর্যাদা পেত। এই ধরনের পড়ালেখায় বরং স্বদেশের নিজস্ব 'তর-তরিকা'কে আগে অনুবাদ ক'রে নিতে হল ইউরোপীয় 'ফর্ম'এর ভাষায়।এই অনুমোদনের শিলমোহর-খোঁজা, আদতে আর একবার চিনিয়ে দিল আমাদের ঔপনিবেশিক অতীতকে।তার প্রতি শর্তহীন (ও অর্থহীন) আনুগত্যকে।
অথচ, এই দুই আখ্যানে যথাক্রমে স্বল্পে এবং দীর্ঘে, কল্পনার কাঙ্খিত মৌলিক উড়ানটা ছিল। উপনিবেশের ইতিহাস ও উপনিবেশের সমকাল সম্পর্কে বিধ্বংসী-প্রত্যাখ্যানটাও ছিল।
আর ছিল 'নায়ক ' ভাবনায় ভাঙচুর। লক্ষ্য করবেন,একটি আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু এক বালক। অন্যটির এক বৃদ্ধ। এবং কেউই নিয়ম মেনে 'ধীরোদাত্ত' নয়।
' হ য ব র ল 'তে ঐ ছেলের চোখে লাগানো আছে এক আয়না, যাতে চারপাশের নিয়মতান্ত্রিক জগত প্রতিফলিত হচ্ছে উলটোভাবে। আর ধরা পড়ে যাচ্ছে তাদের অসঙ্গতি। গণিত থেকে সাহিত্য, পুলিশি থেকে সালিশি ব্যবস্থা... 'একাডেমিশিয়া ' তথা রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতি সে কী প্রবল শ্লেষের উল্লাস! হ্যাঁ,শুধু 'শ্লেষ' নয়,শ্লেষের উল্লাস। 'কার্নিভাল অব অপ্রেসড'। ঐ'টুকু,মাত্রই ঐ'টুকু একটা লেখায় কতখানি ক'রে জমি ধরা!
তা,উপন্যাসের মহত্বও কি কাকেশ্বর কুচকুচের ফিতেয় মেপে তার দৈর্ঘ্য নিরূপণ ক'রে স্থির করতে হবে না কি ? অথচ সেই ভুলই আমাদের গতর-ভারি উপন্যাসের মান্য ইতিহাস বইগুলো করল ! 'হ য ব র ল'র জন্য আজও তাই তত্রাচ 'নো এন্ট্রি বোর্ড' ঝুলছে।
আজও!
আর এরই পাশে ' ডমরু-চরিত '। আঃ সে' তো যেন এই 'গরীব' বাঙালির পল্লীবাংলার নিজস্ব এক 'মেফিস্টোফিলিস'!
এক বৃদ্ধ। যে লোভী, হিংসুক, কামুক এবং মিথ্যেবাদী। একগাদা অপকর্মে গাঁথা তার ব্যক্তিগত ইতিহাস। সেইসব কেচ্ছা-কাহিনীকে ঢাকতেই সে গড়ে তোলে এক-একখানি গপ্পো। তাকে সামাল দিতেই আবার আর একখানি গপ্পো। হয়তো তাকে লম্বা করে টেনে বড় করতে আরেকখানি। এ যেন অন্য আর এক ' আরব্য রজনী'। পাপের সুড়ঙ্গ- কাহিনী। কিন্তু সে 'পাপ' পাল্টা মূল্যবোধের সুরভিতে ঢাকা।
'পাল্টা মূল্যবোধ'। সাহিত্যের জন্য এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। চেনা সমাজ-রাষ্ট্রের 'কোড'গুলোর ভেতর সাহিত্যের নিজস্ব গোপন সুড়ঙ্গ। নিজস্ব অন্তর্ঘাত। অথবা নিজস্ব মুক্তি ।
উপনিবেশ আর বাঙালির বড় অর্থের নিজস্ব 'পল্লীসমাজ'এ তার আগের দেড়শো বছরে,অভ্যন্তরীণ নানা রসায়নে তৈরি হওয়া যে সমস্ত প্রতিপত্তিশালী 'কোড'গুলি, তাকে এভাবেই তছনছ করে দিয়েছিল এই দুই 'ত্যাঁদোড়' অর্বাচীন আখ্যান।
সমালোচনা দিয়ে। 'রিয়েলিটি ' ভাঙা কল্পনা দিয়ে। যুক্তির পাল্টা প্রতিযুক্তিকে মুখোমুখি বসিয়ে দিয়ে। এবং দুবারই 'কমেডি'র আবরণে। আদ্যন্ত কৃষ্ণ-কৌতুকে। সেই যে 'কমেডি'ই আসলে একটি নিখুঁত 'ক্লোজ আপ'।
আর হয়ত এই 'কৌতুক'ই সর্বনাশটা ঘটিয়েছে। গম্ভীরমুখে 'নভেল ' পড়া অফিস যাত্রীরা, বা সেই অফিস-ফেরতা পাঠককূল আর দুপুরের নিদ্রা-পূর্ববর্তী 'রোমান্স- বিলাসিনী' পাঠিকাগণ (এমন উপমার জন্য দায়ি সেই ধূর্জটিপ্রসাদ,আমি নই ) কোনদিনই এই দুই বইকে উপন্যাসের কোঠায় ফেলেননি। একটি শিশুপাঠ্য হয়ে থেকেছে! অন্যটি লঘুপাঠ্য ও ক্রম বিলুপ্ত!
অথচ,হায়,এর বছর পঞ্চাশ-ষাট পার হতে না হতেই বঙ্গ-সমাজে 'ম্যাজিক রিয়ালিজম' নিয়ে কত না স্তুতি! কত না বিস্ময়! সেই পথে ক্রমশ মার্কেজ...বোর্হেস....বোলানো... তথা সমগ্র লাতিন আমেরিকা ঐ সমাগত বাঙালি পাঠকের পাঠসূচিতে! অধুনা তো অন্য ভূখণ্ডের মুরাকামিও!
অথচ, বললে আর্তনাদের মতো শোনায় এই দুই বইয়ের শতবর্ষ নীরবে পার হয়ে যায়! অ-বিচার,তা শুধু আমাদের আখ্যান পড়ার বোধে, নভেল-চেনার আকাঙ্খায় কোনও স্বাধীন-চেতনা নেই ব'লে। সেখানে ইউরোপ'ই আজও আমাদের পড়ার জমিতে 'নীলের দাদন' ছড়িয়ে চলেছে !



অসামান্য বিশ্লেষণ। বঙ্কিমী চলন থেকে সামান্য বিচ্যুত হয়ে বাঙালি পাঠক যদি কালীপ্রসন্ন সিংহ কিংবা ত্রৈলোক্য মুখোপাধ্যায়-এর পথ খানিকটাও অনুসরণ করত তা জলে ম্য্যজিক রিয়েলিজম এ-র জন্য আমাদের সৈয়দ মুজতবা সিরাজের অলীক মানুষ অবধি হয়তো অপেক্ষা করতে হতো না। প্রবন্ধকার মহাশয়ের জন্য রইল অসীম শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন