রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

উপন্যাস * সুদীপ ঘোষাল




জীবনহাটের কড়চা

সুদীপ ঘোষাল


পূর্ববর্ধমান জেলার দশ বারোটা গ্রাম নিয়ে নবগ্রাম অঞ্চল।এইস্থানে আমাদের জীবন কাটে হাসি কান্নায়, সুখেদুঃখে। গ্রামে থাকলেও আমরা মধ্যবয়সে জাপান গেছিলাম বন্ধুদলের সকলে একত্রে ।শেষ থেকেই শুরু করি গল্পটা। 

আমাদর ছোটবেলার  বন্ধু বিশু একবার  জাপান , ঘোরার  আবেদন করল বন্ধু কমিটিকে।  রমেন বললো, খরচ অনেক। আদৃজা বললো, এক একজনের বিমানে আসা যাওয়া হাজার হাজার টাকার ব্যাপার।  বিশু বললো, আমাদের বন্ধুদলের কোঅপরাটিভে অনেক টাকা জমেছে। পাঁচবছর কোথাও যাই নি আমরা।  এবার টাকাগুলো একটা দেশ ভ্রমণে খরচ হবে আর বাকিটা দান করা হবে, গরীবদের।বিশুর মুখের উপর আমরা কেউ কথা বলি না। তার কথাই ফাইনাল হলো। আদৃজা, রমেন, বিরাজুল,  বিশু ও আমি   দমদমে পৌঁছে গেলাম এক শুভদিন দেখে সকালবেলা।  অবশ্য আগে থেকে ভ্রমণ সংক্রান্ত ভিসা সমস্যা ও আনুষঙ্গিক আইনি কাজ মিটিয়ে নিয়েছে বিশু। বিশু লাগেজগুলো একসঙ্গে বিমানবন্দরে ট্রলারে চাপিয়ে পৌঁছে গেল ওয়েটিং রুমে। চেকিং পর্ব সেরে আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ গোপাল ভিন্ডার সঙ্গে দেখা। আমাদের রাজস্থানী বন্ধু। একসাথে আমরা মেসে ভাড়া থাকতাম কলকাতার আমহার্ষ্ট স্ট্রীটে। গলির ভেতরে ভাঙ্গাচোরা, স্যাঁতসেতে এক ভুতুড়ে বাড়িতে থাকতাম কয়েকজন বন্ধু। গোপাল বললো, ক্যায়সা হো তুমলোগ?

বিশু বললো, বড়িয়া ভাইয়া। আপলোগ ঠিক হো তো।গোপাল ভিন্ডা, আমাদের সকলকে কফি খাওয়ালো। কফি পানের পরে বিদায়পর্ব, বিমান ছাড়ার সময় হয়েছে। গোপাল এখানে কাজ করে। সে সবকিছু ঠিকমত বলে আমাদের অসুবিধা দূর করলো।বিমানে আদৃজা বিশুকে ভিসা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চাইলো। বিশু বললো,ভারতীয়দের ভিসা লাগে  ইউরোপীয় দেশগুলো ভ্রমণের ক্ষেত্রে। আশা করি সবদেশেরই হয়ত লাগে। ভিসা-মুক্ত বা আগমনের পর ৪৯ টি দেশে ভিসা প্রাপ্তির ভিত্তিতে বৈশ্বিকভাবে ভ্রমণ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভালো। ভারতীয়রা বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাড়ি জমায় বিশেষভাবে ইউরোপ-আমেরিকাতে, সেইজন্যে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা আছে। ৮ আগস্ট ২০১৭ তারিখ থেকে ভারতীয় টুরিস্ট এবং ব্যবসায়ীরা বা চিকিৎসা সেবা নিতে ইচ্ছুক মানুষরা রাশিয়াতে ভিসা ছাড়াই যেতে পারবে। ভারতীয় ভ্রমণকারীদের ভূটান এবং নেপাল ছাড়া অন্য রাষ্ট্রে ভ্রমণকালে অপরিশোধযোগ্য কাজে লিপ্ত হতে হলে একটা ভিসা বা কাজের স্বীকৃতিপত্র নিতে হয়।  রাজ্যের বাসিন্দা নয় এমন ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এইসব রাজ্যে ভ্রমণকালে ইনার লাইন পারমিট  নিতে হয়। আইএলপি অনলাইন বা এইসব রাজ্যের বিমানবন্দর সমূহ থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে।বিরাজুল বললো, এত খুঁটিনাটি আমরা জানতে পারি না কেন?  

বিশু বললো, জানতে হয় না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়। 

আমরা জাপানের টোকিও -র  চিবা বিমানবন্দরে নেমে একটা গাড়িতে করে খোঁজ নিয়ে চলে এলাম হোটেলে। বিশাল হোটেল তেমনই তার সুব্যবস্থা। রমেন বলল উদীয়মান সূর্যের দেশে আমরা এলাম। এ আমার কল্পনার বাইরে ছিলো। বিরাজুল ও আদৃজা বললো, খুব ঘুরবো কয়েকদিন। আমি বললাম, জাপান দেশের বিবরণ কিছু দিতে পারবি। আসার আগে পড়াশুনা করেছিস কিছু। বিরাজুল বললো, জানি অল্প। তবে বিশু আছে। ও একাই একশ। আমরা সকলে বললাম, তা বটে তা বটে। একদম হককথা কইছে বিরাজুল। বিশু বললো,   পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হল জাপান । এই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর, চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পূর্ব দিকে উত্তরে ওখোৎস্ক সাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব চীন সাগর ও তাইওয়ান পর্যন্ত প্রসারিত। যে কাঞ্জি অনুসারে জাপানের নামটি এসেছে, সেটির অর্থ "সূর্য উৎস"। জাপানকে প্রায়শই "উদীয়মান সূর্যের দেশ" বলে অভিহিত করা হয়।জাপান একটি যৌগিক আগ্নেয়গিরীয় দ্বীপমালা। এই দ্বীপমালাটি ৬,৮৫২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। জাপানের বৃহত্তম চারটি দ্বীপ হল হোনশু, হোক্কাইদো, ক্যুশু ও শিকোকু। এই চারটি দ্বীপ জাপানের মোট ভূখণ্ডের ৯৭% এলাকা নিয়ে গঠিত। জাপানের জনসংখ্যা ১২৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার হিসেবে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৯.১ মিলিয়ন। এই শহরটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার ২য় বৃহত্তম মূল শহর। টোকিও ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্য নিয়ে গঠিত বৃহত্তর টোকিও অঞ্চলের জনসংখ্যা ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি। এটি বিশ্বের বৃহত্তম মহানগরীয় অর্থনীতি।

আমি বললাম, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা সাগালিন দ্বীপের কথা বলেছিলেন। মনে আছে তোর বিশু। বিশু বললো, জাপানের সাগালিন এবং ওহোতস্ক সমুদ্র দ্বারা সাখালিনটি ধুয়ে ফেলা হয়, এটি জাপান থেকে লা পেরুজের তলদেশে তাতার তীর দ্বারা মহাদেশ থেকে পৃথক হয়। সাখালিনের মোট এলাকা 76 হাজার বর্গ কিমি। এবং ফর্ম, এটি একটি মাছ অনুরূপ, এশিয়ার তীরে বরাবর প্রসারিত। দ্বীপটির দক্ষিণে, পাহাড়গুলি আয়ত্ত করে, উত্তরের কাছে, তাদের নিম্নভূমি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, এবং শুধুমাত্র শ্মিট্ট উপদ্বীপে, সাখালিনের চূড়ান্ত উত্তর দিকটি হ'ল পাহাড়ের শিখরগুলি আবার দৃশ্যমান। যেমন একটি জটিল ত্রাণ, পাশাপাশি সমুদ্র এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত।সাখালিন বৃহত্তম রাশিয়ান দ্বীপ। জাপানীরা এই দ্বীপটি করাফুতোকে উপভোগ করে, যার অর্থ "ঈশ্বরের ভূমি মুখ।" দ্বীপটি 1643 সালে ডাচম্যান দে ভ্রিসের আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং দীর্ঘদিন ধরে, সাখালিনকে উপদ্বীপ বলে মনে করা হয়েছিল। সম্ভাব্য কারণ দ্বীপটি মূল ভূখন্ড থেকে পৃথক হওয়ার স্রোত শীতে ঠান্ডা হয়।জাপানের সাগালিন এবং ওহোতস্ক সমুদ্র দ্বারা সাখালিনটি ধুয়ে ফেলা হয়, এটি জাপান থেকে লা পেরুজের তলদেশে তাতার তীর দ্বারা মহাদেশ থেকে পৃথক হয়। সাখালিনের মোট এলাকা 76 হাজার বর্গ কিমি। এবং ফর্ম, এটি একটি মাছ অনুরূপ, এশিয়ার তীরে বরাবর প্রসারিত। দ্বীপটির দক্ষিণে, পাহাড়গুলি আয়ত্ত করে, উত্তরের কাছে, তাদের নিম্নভূমি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, এবং শুধুমাত্র শ্মিট্ট উপদ্বীপে, সাখালিনের চূড়ান্ত উত্তর দিকটি হ'ল পাহাড়ের শিখরগুলি আবার দৃশ্যমান। যেমন একটি জটিল ত্রাণ, পাশাপাশি সমুদ্র এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত।কারণ সাখালিন তাহা তার প্রজাতি বৈচিত্র্যের মধ্যে রাশিয়াতে সবচেয়ে ধনী। নিজের জন্য বিচারক - দ্বীপে প্রায় ২00 টি প্রজাতির গাছ ও ঝর্ণা বেড়ে যায়।সখালিনের প্রধান গাছটি জিমেইলিন লার্চ। অন্যান্য ধরনের গাছগুলি খুব কমই প্রতিনিধিত্ব করা হয়: পাতলা লেইড লার্চ, আইয়ানস্কি স্প্রুস, সখালিন ফির। হোয়াইট এবং পাথর birches, aspens, সুগন্ধি poplars, শিশির উইল, জাপানি elms, হলুদ ম্যাপেল, এবং alder hardwoods মধ্যে prevail।সাখালিন ফল এবং বেরিতে সমৃদ্ধ। চেরি, ক্যারাট, ব্লুবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি, রেডবেরি এবং ক্র্যানবেরি এখানে বেড়ে যায়। এবং দ্বীপের দক্ষিণে এক অনন্য প্রাকৃতিক সমন্বয় পালন করতে পারে: সাখাওয়ালীন বাঁশের ঝোপঝাড় দ্বারা বেষ্টিত একটি শঙ্কু বন। এই ধরনের ইউনিয়ন বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। বাঁশ, অবশ্যই, এখানে উচ্চ নয়, তবে এর ঝড় আসলে সবচেয়ে দুর্বল, যেহেতু ইলাস্টিক টুকরাগুলি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে আটকে থাকে এবং ছুরিগুলির মত তীক্ষ্ণ পাতাগুলি সহজে ত্বকে কাটাতে পারে।দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক বছরে সাখালিনের প্রাণীরা উল্লেখযোগ্যভাবে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। একবার দ্বীপে, ঘুর্ণিমান হরিণ চারপাশে লাফিয়ে পড়েছিল এবং বন্য ডোরা তাদের কান্না দিয়ে পার্শ্ববর্তী বনগুলিকে পড়েছিল। না যারা অন্য বা বাকি আছে। পরে এল্ক এবং লাল হরিণ বিনষ্ট হয়। শেষ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্ধমান বনজনিত কারণে, সযোগ্য এবং র্যাকুন কুকুর অদৃশ্য হয়ে যায়। পর্বত ভেড়া এবং নদী otters চিরতরে দ্বীপ ছেড়ে। এক স্টাফ নেকড়ে, একবার একবার সাখালিনে ভডিভিশগো, যাদুঘরে একাকী একাকী। সমুদ্রের নিকটবর্তী, উদ্ভিদ এবং প্রাণী বিশ্বের মৌলিকত্ব নির্ধারিত। আমাদের ক্যাপটেন  বিশু আরও বললেন, টোকিও বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলির একটি। এর আয়তন প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার। মূল শহরে প্রায় ৯০ লক্ষ লোকের বাস। বৃহত্তর টোকিও মহানগর এলাকাতে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ লোকের বাস, যা জাপানের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ; এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল বৃহত্তর মহানগর এলাকা।টোকিও থেকে বন্দরনগরী ইয়াকোহমা পর্যন্ত অঞ্চলটি অবিচ্ছিন্নভাবে জন-অধ্যুষিত বলে কিছু বিশেষজ্ঞ টোকিও ইয়োকোহামাকে একটিমাত্র মহানগর এলাকা হিসেবে গণ্য করেন, যার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লক্ষ। জাপান হচ্ছে একটি দ্বীপদেশ যা মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানকার মানুষ সবসময় প্রচুর সীফুড খাওয়ার সুবিধা গ্রহণ করেছে। এটি কিছু খাদ্যবিদদের মতামত যে জাপানি খাদ্য সর্বদা উপর নির্ভর করে প্রধানত শষ্যের উপর সাথে থাকে শাকসব্জি বা সামুদ্রিক আগাছা, দ্বিতীয়ত পাখিজাত মাংস এবং সামান্য পরিমাণ লাল মাংস। বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভের আগ থেকেই জাপানে মাংস গ্রহণের এই অনীহা ভাব ছিলো। ইদো যুগে ইয়োতসুশি বা চারপেয়ে জন্তু খাওয়া নিষিদ্ধ ছিলো। এই সত্ত্বেও জাপানে লাল মাংস ভোজন সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। গৃহপালিত পশুদের বিপরীতে বন্য খেলা খাওয়া মেনে নেওয়া হয়েছিলো। বিশেষ করে ফাঁদ পেতে খরগোশ শিকারের জন্য এমন শব্দ (ওয়া) ব্যবহার হতো যা সাধারণত একটি পাখির জন্য সংরক্ষিত শব্দ। সাধারণ খাদ্যদ্রব্যগুলির ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে জাপানী পরিবারের প্রক্রিয়াকৃত খাবারগুলি র ব্যবহার আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিয়োটো সবজি বা কিয়াইয়াই জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং বিভিন্ন ধরনের কিয়োটো সবজির ব্যবহার আবারো ফিরে আসছে। বিশুর কাছে জাপানের কথা শুনে আমাদের একটা মোটামুটি ধারণা হলো। টোকিও ঘোরার ব্যাবস্থা করলো বিরাজুল। সে গাড়ি ঠিক করে আসার পরে আমরা সকলে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে আমরা একজন গাইডকে পেয়েছি। তিনি একটু আধটু বাংলা জানেন। তিনি বললেন যা সেটি আমরা ভালো বাংলাতেই বলব।তিনি বললেন, মূল টোকিও শহরটি ২৩টি বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে গঠিত। জাপানের রাজকীয় প্রাসাদটি টোকিও শহরের হৃৎকেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাসাদটি পাথরের প্রাচীর, পরিখা ও প্রশস্ত বাগান দিয়ে পরিবেষ্টিত। রাজপ্রাসাদের পূর্ব-দিক সংলগ্ন বর্ণিল মারুনোউচি এলাকাটি জাপানি ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র। প্রাসাদের দক্ষিণে আছে কাসমিগাসেকি  এলাকাটি, যেখানে বহু জাতীয় পর্যায়ের সরকারী কার্যালয় অবস্থিত। তার পশ্চিমে রয়েছে নাকতোচো উঁচু এলাকা, যেখানে জাপানের জাতীয় দিয়েত বা সংসদ ভবনটি অধিষ্ঠিত। টোকিওতে কোনও কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা নেই। শহরটি অনেকগুলি গুচ্ছ গুচ্ছ শহুরে এলাকা নিয়ে গঠিত; এই এলাকাগুলি মূলত রেল স্টেশনগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, যেখানে দোকান, বিপণীবীথি, হোটেল, ব্যবসায়িক কার্যালয় ভবন এবং রেস্তোরাঁগুলি ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে অবস্থান করছে। এই গুচ্ছগুলির মাঝে মাঝে অপেক্ষাকৃত কম ভবনবিশিষ্ট অনাধুনিক এলাকাগুলি অবস্থিত, যদিও এগুলিতেও একই ধরনের ভবনের দেখা মেলে। টোকিওর ভবনগুলি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এখানে এখনও প্রাচীন জাপানি কাঠের বাড়ির দেখা মেলে, যদিও এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এছাড়া এখানে মেইজি পর্বে  নির্মিত অনেক পাথর ও ইটের তৈরি ভবন আছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে শহরে কংক্রিট ও ইস্পাত দিয়ে অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়। শহরকেন্দ্রের পূর্বভাগে অবস্থিত আলোয় ঝলমল করা গিনজা নামক কেনাকাটার এলাকাটি বিশ্বখ্যাত। রাজপ্রাসাদের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কান্দা এলাকাটিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, বইয়ের দোকান ও প্রকাশনী অবস্থিত। টোকিওর নগর-উদ্যানগুলি ইউরোপ-আমেরিকার মত বড় না হলেও সংখ্যায় প্রচুর এবং এগুলিতে প্রায়ই মনোরম সুদৃশ্য বাগান থাকে।টোকিও জাপানের প্রধানতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। টোকিও শহরে অত্যাধুনিক জীবনধারার সাথে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এখানে নিয়নের আলোয় উদ্ভাসিত গগনস্পর্শী অট্টালিকা যেমন আছে, তেমনই আছে ঐতিহাসিক সব মন্দির। সমৃদ্ধ মেইজি সিন্ত এর সুউচ্চ প্রবেশদ্বার এবং চারপাশ ঘিরে থাকা বৃক্ষশোভিত এলাকার জন্য পরিচিত।  টোকিও জাদুঘর জাপান ও এশিয়ার ধ্রুপদী শিল্পকলা ও ইতিহাস বর্ণনাকারী অনেক প্রদর্শনী আছে। একই এলাকাতে একটি বিজ্ঞান জাদুঘর, একটি চিড়িয়াখানা এবং দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকলা জাদুঘর অবস্থিত। রাজপ্রাসাদের আশেপাশেও বেশ কিছু বিজ্ঞান ও শিল্পকলা জাদুঘর আছে। এছাড়া শহর জুড়েই অন্যান্য আরও অনেক ধরনের জাদুঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  পুনর্নির্মিত  নাট্যমঞ্চ পরিদর্শন করা সম্ভব। টোকিওর নাট্যশালাগুলিতে নিয়মিতভাবে ঐতিহ্যবাহী কাবুকি নাটকের পাশাপাশি আধুনিক নাটক পরিবেশন করা হয়। এছাড়া ঐকতান, গীতিনাট্য, ইত্যাদি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যকলা সর্বদাই পরিবেশিত হয়। এদের মধ্যে বিশ্বববিদ্যালয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গাইড বললেন, এলাকার পুরাতন, সরু রাস্তাগুলি দিয়ে হাঁটলে দোকানপাট, -পরিহিতা নারী ও ৭ম শতকে নির্মিত  চোখে পড়বে। এর বিপরীতে  এলাকাতে গেলে উদ্দাম উচ্ছ্বল নৈশক্লাব ও  গান গাওয়ার বার দেখা যাবে। এলাকায় পাওয়া যাবে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির দোকানের সমাহার। মদ্যপান করার জন্য ইজিকায়া নামের ঘরোয়া জাপানি ধাঁচের পাবগুলি টোকিওর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শহরের কেন্দ্রের কাছে আছে  যেটি টুনা মাছের নিলামের জন্য বিখ্যাত। সুউচ্চ  নামক স্থাপনার শীর্ষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পর্যবেক্ষণ মঞ্চ থেকে গোটা টোকিও শহরের বিস্তৃত পরিদৃশ্য অবলোকন করা সম্ভব। টোকিওর খাবারের দোকানগুলি সবসময়ই জমজমাট থাকে।  ও  এলাকাতে গেলে হালের কিশোর-কিশোরীদের পোশাকশৈলী সম্বন্ধে ভাল ধারণা পাওয়া যায়।টোকিও জাপানের পরিবহনের প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবহন কেন্দ্র। বৈদ্যুতিক রেল, পাতালরেল, বাস ও মহাসড়কের এক ঘনসন্নিবিষ্ট জালিকা টোকিওর সেবায় নিয়োজিত। রেল সমগ্র জাপানের জন্য কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন।আমরা হিকারি এক্সপ্রেস নামে উচ্চগতিসম্পন্ন  রেলগাড়িতে চাপলাম।  এখান দিয়ে যাওয়া যায় টোকিও থেকে উত্তর জাপান অভিমুখী সমস্ত রেললাইনগুলি,' উয়েনো' এসে মিলেছে। অন্যদিকে  হনশু এবং টোকিওর পশ্চিমের শহরতলী থেকে আগত রেলগাড়িগুলির শেষ গন্তব্যস্থল  পর্যন্ত।  আমরা ঘুরছি আর গাইডের গল্প শুনছি,  কিছু বেসরকারী মালিকানাধীন বৈদ্যুতিক রেলপথ নগরে পরিবহন সেবা দান করে। টোকিওর, চিবা বন্দর শহরে অবস্থিত। অন্যদিকে টোকিও উপসাগরের কাছে অবস্থান আভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন সেবা প্রদান করে।টোকিও সারা বছরই ব্যস্ত থাকে। জানুয়ারির ১ তারিখে গ্রেগরিয়ান মতে নববর্ষ উদযাপন করা হয়; এসময় সমাধিমন্দিরগুলিতে অনেক তীর্থযাত্রীর ভিড় হয়। এপ্রিলে সারা টোকিও শহর জুড়ে চেরি পালিত হয়। মে মাসে  উৎসব পালিত হয়, যেখানে বহনযোগ্য সমাধির শোভাযাত্রা হয়। জুলাই মাসে সুমিদা নদীর আতশবাজি উৎসব হয়। আগস্ট মাসে ওবোন নামে একটি বৌদ্ধ ছুটির দিবসে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয়। একই মাসে উৎসবে কোয়েঞ্জি রেলস্টেশনের আশেপাশে শোভাযাত্রা-মিছিলের আয়োজন করা হয়।২০১৪ সালে  নামক পর্যটকদের সহায়তাকারী ওয়েবসাইটে "স্থানীয়দের সাহায্যদানকারী মনোভাব", "নৈশজীবন", "কেনাকাটা", "স্থানীয় গণপরিবহন" এবং "রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা"-র ক্ষেত্রে "শ্রেষ্ঠ সামগ্রিক অনুভূতি।  গাইড বয় আমাদের সাখালিনের বনভূমির কথাও শোনালেন। সাখালিনের বনভূমিগুলির বৈশিষ্টসূচক প্রতিনিধিরা প্রধান ভূখণ্ডের প্রাণী, চরিত্রগত ও দুধ চাষের দুধঃ এইগুলি অনেকগুলি ভেজাল এবং তরমুজ। দ্বীপের দক্ষিণে কলাম পাওয়া যায়। এই প্রাণী জাপান থেকে আনা হয়েছিল, কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ছোট।সাখালিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রবল শত্রু বাদামী ভালুক। এই দৈত্যগুলির বৃদ্ধি দুই মিটার এবং ওজন - 500 কেজি পর্যন্ত পৌঁছায়। লাল, ধূসর এবং রৌপ্য-কালো বনের মধ্যে অনেক লাল শিয়াল আছে। নদী প্লাবনভূমিতে সর্বত্র হরেস এবং গহ্বর পাওয়া যায়, আপনি নদী otters দেখতে পারেন। আমাদের গাইড আমাদের কৌতূহল দেখে হিমবাহ ও সাগালিন সম্পর্কে অনেক অজানা কথা বললেন। জাপান এসেছি বলে কি আর অন্য অজানা খবর শুনব না। হতেও তো পারে কোনদিন হিমবাহের সামনাসামনি হলাম। অতএব, "জানার কোন শেষ নাই "....কিন্তু সাখালিনের হরিণটি বেশিরভাগ পেঁচা দ্বারা পালিত হয়। বন্য দ্বীপ শুধুমাত্র উত্তর অংশে পাওয়া যায়।  এটি রেড বুক তালিকাভুক্ত করা হয়।হিমবাহ  হল বরফের বিরাট চলমান স্তুপ বা নদী। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে শীতকালে তুষার পড়ার হার গ্রীষ্মে গলনের হারের চেয়ে বেশি হলে পাহাড়ের উপরে তুষার জমতে শুরু করে এবং জমে শক্ত বরফে পরিণত হয়। এই বরফজমা এলাকাটিকে বরফক্ষেত্র বলে। যখন এই জমা বরফ নিজের ওজনের ভারে এবং মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরগতিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে, তখন তাকে হিমবাহ বলে। তবে জমা বরফ এত পুরু হয় এবং এর নিম্নগতি এতই ধীর যে তাকে স্থিরই মনে হয়।বিশু হিমবাহ সম্পর্কে কিছুকথা বললো, ভারতের উত্তরে পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালাতে অবস্থিত গ্রেট বালটোরা পৃথিবীর দীর্ঘতম হিমবাহ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় আটান্ন  কিলোমিটার। হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের কাছে রংবুক ও কাশৃঙ্গ হিমবাহ অবস্থিত। অস্ট্রিয়া-ইতালি সীমান্তে আল্পস পর্বতমালার সিমিলাউন হিমবাহে উনিশশো একানব্বই সালে একজন মানুষের অবিকৃত দেহের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় দেহটি প্রায় পাঁচহাজার বছর সেখানে সমাহিত হয়ে ছিল।হিমবাহ ও সাকালিনের বর্ণনা শুনে আমাদের আশ্চর্য অনুভূতি হল। 

পৃথিবী একটা ছোট গ্রহ। তার সব খবর জানা কঠিন। আর মহাকাশ বা ব্রম্ভান্ডের কথা বাদই দিলাম। অসীম এই মহাকাশ। কত বিচিত্র। তার কিছুই কি আমরা জানি?  নিজেকে খুব বোকা লাগে যখন জ্ঞানের অহংকারে মত্ত হয়ে আস্ফালন করি ডাঁহা আহাম্মকের মত।










***********************************************

আগামী পর্বে 

************************************************



 সুদীপ ঘোষাল 

সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প  দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব  বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ  ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত



উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল

 


 


[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * নয় 

বিশ্বনাথ পাল

  তেরো 

মাঝেমধ্যে গীতা পড়তাম। গীতা পড়ে মনে হত নিষ্কাম কর্মের সাধনাই মানুষের জীবনে উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। কর্মফল সম্পর্কে সন্দেহ আমাদের আন্তরিক কর্মপ্রচেষ্টা্র প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ‘কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়’ মনে রেখে কাজ করতে পারলে ফল মনে হয় ভালই হয়।

সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে পাগলের মতো সমস্ত পরীক্ষা টার্গেট করতাম না। আমার মূল লক্ষ্য ছিল পিএসসির তিনটি পরীক্ষা— ডবলুবিসিএস, মিসসেলেনিয়াস এবং ক্লার্কশিপ, এছাড়াও স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসতাম। এদের মধ্যে পিএসসির প্রথম দুটিতে  বসার ন্যূনতম যোগ্যতা গ্রাজুয়েট আর তৃতীয়টির ক্ষেত্রে মাধ্যমিক। স্কুলে তড়িৎস্যার ভৌতবিজ্ঞান পড়ানোর সময় কার্য পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন আমরা যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করি সেই পরিমাণে কার্য উৎপন্ন হয় না, কিছুটা ঘর্ষণজনিত কারণে ব্যয় হয়। স্যার উদাহরণ টেনে বলেন, মাধ্যমিকে তোরাও যদি স্টার পাওয়ার লক্ষ্য রেখে পরীক্ষায় বসিস, ফার্স্ট ডিভিশনটা নিশ্চিত হবে এইসব স্মরণ করে আমিও ভাবতাম, তালিকায় ডবলুবিসিএস থাকলেও তা যেন অনেকটা লক্ষ্যের সর্বোচ্চ মাত্রা বা প্রচ্ছন্ন লক্ষ্য। মূল লক্ষ্য অন্তত একটা কেরানির চাকরি নিশ্চিত করা। এমন উদাহরণও সহজলভ্য ছিল— মাস্টার ডিগ্রি আছে, পিএইচডি আছে, কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পাশ করে একটা ক্লার্কের চাকরিও পায়নি। ফলে কেরানির কাজ নিশ্চিত হলে কপালে থাকলে নিশ্চয়ই আরও উপরে ওঠার দরজা খুলে যাবে। আবার এমন ভাবনাও গ্রাস করত যে একদিন এত বড় হব যে আমার মাথা এভারেস্ট স্পর্শ করবে। আমাকে যারা ছোট করছে, অবজ্ঞা করছে, তারা ঘাড় বেঁকিয়ে দেখবে। আর আমার বর্তমান অবস্থান যেন খাদের গভীরে। অন্ধকারে মাথা ঝুঁকিয়ে নাগাল পাওয়া ভার। কোথাও এসব বলতাম না। তবে এই আত্মবিশ্বাসের চোরা স্রোত মাঝেমধ্যে কবিতায় চুঁইয়ে নামত।

এভারেস্টের কথা যখন উঠলই বলি, আমার চাকরি পাওয়ার প্রচেষ্টাকে মনে মনে মিশন এভারেস্ট  বলে কল্পনা করতাম। এভারেস্ট কেন? যে সময়ের কথা বলছি তখনও পর্যন্ত কোনও বাঙালি অভিযাত্রীর এভারেস্ট শৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড নেই। মানে সত্যব্রত দামের নাম  তখনও সাধারণ মানুষের অজানা। এভারেস্ট জয় বেশ ঝক্কির ব্যাপার। তার জন্য দিনের পর দিন অধ্যবশয়, অনুশীলন, পরিশ্রম, সাহস এবং আর্থিক আনুকূল্য লাগে। তাহলে এই আপাত অসম্ভব সম্ভব হতে পারে। হতে পারে, কারণ হবেই যে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, মাঝপথে কেউ তুষারঝড়ে প্রাণ হারিয়ে চিরতব্রে বরফের রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারে। অতএব এভারেস্ট জয়ের জন্য একজন অভিযাত্রীর অন্তরে যে নিষ্ঠা একাগ্রতা দরকার, পরিবেশের সঙ্গে লড়াইয়ের মানসিকতা দরকা্র আমার মধ্যেও তার আগমণ ঘটুক চাইতাম। আসলে এভারেস্ট জয় অনেক  বড় ব্যাপার, সরকারি চাকরির পাওয়ার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। কিন্তু আমার মতো সুখী অলস প্রকৃতির মানুষকে এই কল্পনা তাতাত। কিছুটা স্বস্তির হাওয়া বয়ে আনত গরিবের এভারেস্ট মিশনের পালে। এমনিতে সরকারি চাকরি খুব দুর্লভ একটা ব্যাপার। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় বসে কিন্তু শূন্যপদ হাতে গোনা। ফলে কার কপালে যে শিকে ছিঁড়বে, সেটা ভেবেই আর্ধেক পরীক্ষার্থী হতোদ্যম হয়ে পড়ে। আরও খেয়াল করে দেখলাম অনেকেই ভাগ্য পরীক্ষার জন্য বসে। আবার যতজন পরীক্ষার্থী ফর্ম পূরণ করে তার একাংশ পরীক্ষা হলে উপস্থিত হয় না। সুতরাং লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে আসলে আমার প্রতিযোগী নয়। আমার প্রতিযোগী বড় জোর কুড়ি-তিরিশ বা চল্লিশ হাজার ছেলেমেয়ে, যারা সরকারি চাকরিকে পাখির চোখ করে দিনরাত পড়াশোনা করছে। ভাগ্য পরীক্ষার থেকে পড়াশোনায় তাদের বিশ্বাস। তাদের অনেকের যেমন খাওয়া-পড়ার চিন্তা নেই, বাবা-মা উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, আবার একাংশ খুব কষ্ট  করে আমার মতো টিউশনির টাকায় পোষ্টাল অর্ডার কেনে। অনেকেই ভাল কোচিং ও কলকাতার উপযুক্ত পরিবেশের কারণে গ্রাম, মফসসল ছেড়ে মেসবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পড়াশোনা চালায়। বাবা মাসে মাসে টাকা পাঠায়। আমার অবশ্য রাতদিন খিল আটকে পড়াশোনা করার কোনও সুযোগ ছিল না। কারণ টিউশনি, স্কুলে পড়ানো। জীবন আগে। কিন্তু সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্নটাকে কিছু দিনের জন্য অনুধ্যানের বিষয় করতে চাইলাম। টিউশনি পড়াতে গেলেও সঙ্গে একটি প্রতিযোগিতা মূলক পড়ার ম্যাগাজিন রাখি। ছাত্রছাত্রী যে সময় উত্তর লেখে আমি ম্যাগাজিনে চোখ বুলাই। অধিভাবকরাও আমাকে এঅবস্থায় দেখে ফাঁকি মারছি ভাবত না। সাইকেল লিক হলে পর সারাইয়ের দোকানে সাইকেল জমা দিয়ে পাশের টুলে বসে যতক্ষণ না সারানো হয়, একটু পড়ে নিই। রোজ দুটি করে খবরের কাগজ রাখি—একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। সব পড়া হয় না, তবে অনেকটা পড়ি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর থেকে কোন প্রশ্ন সামনের পরীক্ষায় আসতে পারে তা আগাম আন্দাজ করে একটা বড় খাতায় তার পেপার কাটিং কেটে লাগাই আঠা দিয়ে। বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। কিন্তু ভাল লাগত। আর সরকারি চাকরির পরীক্ষার সে অর্থে কোনও সিলেবাস তো হয় না, একটা বিষয়ের আউট লাইন দেওয়া থাকে, তার মধ্যে সাম্প্রতিক ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে। আমার ভাল লাগত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর হালচালের খবর রাখতে। মাঝেমধ্যে পেপার কাটিঙের খাতা উল্টে পাল্টে দেখতাম। ফলে ছবিগুলিও স্মৃতিতে গেঁথে যেত। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কে বা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নাম কী—তা তাঁদের ছবি সমেত মনে পড়ে যেত। কিন্তু আমার চাকরির  প্রস্তুতি আমার বাবার মনে কোনও আশার সঞ্চার করেনি। বাবাকে বলতে শুনেছি, ও  পড়ে নাকি? রাত্রিবেলা একটু খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখে, এই যা। বাবা নিজে পড়তে পারত না এই আফশোস বাবার মধ্যে খেলে বেড়াত— অনুভব করতাম। বাবাও মাঝেসাঝে পেপার নেড়েচেড়ে ছবি দেখত। হয়তো এত কিছু পড়ার জগত অগোচরে থেকে যাওয়ার বেদনা জাগত। বাবা শুধু ছবির মতো নামটুকু সই করতে পারত। দেশভাগের পর যখন এদেশে এসে বা্বাকে স্কুলে ভর্তি করা হল, সহপাঠীদের   তুলনায় বাবার বয়স অনেকেটাই বেশি। দু-চার দিন পরে লজ্জায় আর স্কুলের পথই মাড়াল না। বড়দের শুভাকাঙ্খী শাসনেরও অভাব ছিল। মা লেখাপড়া জানে। ক্লাস ফোর পাশ।  তাতেই মা আমার প্রথম শিক্ষাদাত্রী। রান্নাঘরে ছোটবেলায় মা’র কাছে  চটের বস্তা পেতে পড়তে বসতাম। চাইলে মা কি বাবাকে একটু পড়াতে পারত না। আমার প্রস্তুতিতে বিশ্বাস না থাকলেও জীবনে একবার বাবার গর্বের কা্রণ হয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ি, সেখানে সপ্তাহে একদিন করে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ক্লাস নিতে আসতেন। বাবাকে সে খবর জানাতে বাবা রাষ্ট্র করতে বাকি রাখেনি, ও অর্থমন্ত্রীর কাছে পড়ে।

তো, যাইহোক, স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি তখন, আমাদের ক্লাসে পড়াতে এসেছিলেন দেবজ্যোতি স্যার নামে একজন ইংরেজির শিক্ষক। পদবি মনে নেই। ভীষণ শান্ত, সুদর্শন। কিন্তু যেন ব্যক্তিত্বের অভাব। বড্ড চুপচাপ। স্যার ক্লাসে ঢুকলে আমরাও তাঁর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে আমাদের হইচই, মাছের বাজারের চিৎকার জারি রাখতাম। স্যার অসহায়ের মতো তাকাতেন, ক্লাসে পায়চারি করতেন। একদিন স্যার অতিষ্ঠ হয়ে মুখ খুললেন। আমাদের মানসিক ভাবে উজ্জীবিত করার চেষ্টায়। স্যার সেদিন কী বলেছিলেন হুবহু মনে নেই। কিন্তু সেদিনের পর থেকে শ্রদ্ধায় স্যারের ক্লাসে আমাদের হইচই গণ্ডগোল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্যার বলেছিলেন কালাহাণ্ডির সেই মা-কে আপাত দৃষ্টিতে হয়তো ‘মা’ বলেই মনে হবে না, যে কিনা নিজের সন্তানকে বেচে দেয়। কিন্তু সেই মায়েরও মাতৃত্ব খুঁজতে গেলে যেতে হবে সেই মন্দিরে যেখানে সে মাথা কুটে বলছে, ঠাকুর, আমার সন্তান যেন খেয়ে পরে বেঁচে থাকে। স্যার বলেছিলেন পাশ করার জন্য সারা বছর পড়ার কোনও দরকার নেই। কিন্তু পরীক্ষার আগের একমাস এমন ভাবে পড়তে হবে যেন ঘুমের মধ্যেও পড়ার স্বপ্ন আসে, কোনও ফাঁকিবাজি রাখা চলবে না—আর তাতে এমন আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে যে যদি একজনও কেউ পাশ করে তবে আমি করব। স্যারের এই কথাগুলো মাঝেমধ্যেই মাথার ভিতর টেপ রেকর্ডের মতো বাজত, আমাকে উদ্বুদ্ধ করত। আমি সেই আত্মবিশ্বাসের সন্ধান মনে চালাতাম।

***

খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে একদিন একটি ছোট্ট প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেল। লিখেছে অরিন্দম চৌধুরির নতুন উপন্যাসের থিম—You should hope for the best and be prepared for the worst. বাহ! বেশ ভাল লাগল কথাটা। বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—সর্বোত্তম ভালর আশা করলেও সব থেকে খারাপটার জন্যও প্রস্তুত থেকো।  টুকে রাখলাম কথাটা। কোথাও কিছু ভাল লাগলে ডায়রিতে টুকে রাখতাম। কারও থেকে ধার নিয়ে পড়া বইয়ের ভাল লাগা পংক্তিও সেখানে স্থান পেত নিজের বই হলে তো দাগিয়ে পড়ি। কোনও পরীক্ষার জন্য নয়। নিজের জন্য। আমার ক্ষেত্রে এই রকম নীতি মেনে চলা যেতে পারে। গীতার নিস্কাম কর্মের বিকল্প হিসাবে। কাজ করে সম্পূর্ণ নিস্কাম হওয়া যেন অনেক সাধনার বিষয়। তার চেয়ে সব চেয়ে ভালটা চেয়ে প্রাণপণে খেটে গেলাম, কিন্তু খারাপ ফলের জন্যও মনকে প্রস্তুত রাখলাম। কারণ ফলাফল তো আমার হাতে নেই।

সুদীপের একটি কথা এক বন্ধুর মুখে শুনে বেশ খারাপ লাগল। একদিন বাবাই এসেছিল আমাদের বাড়িতে। আমার কেমন কী পড়াশোনা এগোচ্ছে খোঁজখবর নিতে। বাবাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা পরিচয় সুদীপের মাধ্যমেই। বাবাই নিজেও রাজ্যসিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিকে সুদীপদের বাড়িতে কেমিস্ট্রি পড়ার সময় বাবাইও আমাদের সঙ্গে পড়ত। বাবাই বলল, সোমনাথ , তোকে একটা কথা বলছি, তুই শোনার পর কিন্তু মন কারাপ করবি না, কেমন?

না, করব না, কী কথা বল?

সুদীপ তোর সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে একটা বাজে কথা বলেছে।

কী বাজে কথা সেটা তো বলবি?

বলেছে সত্যজিতের সরকারি চাকরি হবে কিনা সন্দেহ আছে, ওর অ্যাটিচ্যুডে প্রবলেম আছে।

বলেছিলাম বটে, কিন্তু মন খারাপ হল। তবে এতো আমার কাছে নতুন নয়, আমার প্রতি নিকট-দূরের মানুষরা প্রকাশ্যে বা গোপনে অনাস্থা জ্ঞাপন করবেন এটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছে। মানুষ সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয় না, সাফল্যকে দেয়। আমি যদি জীবনে কিছু করে এদেরকে ভুল প্রমাণ করতে পারি, সেটাই আমার সার্থকতা হবে। আমার মনে পড়ে গেল মাস তিনেক আগে বিবাহ-বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বন্ধুর বাড়িতে গেটটুগেদারে সুদীপের করা মন্তব্য। কথা প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে বলেছিল, সোমনাথ  যখন দাঁড়াবে, ওর আর দাঁড়াবে না।

কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের বিষ আমার বুকে জ্বালা ধরালেও চুপ করেই ছিলাম। কী বলতাম? ঝগড়া করতাম? দিন যদি আসে সবাই একদিন জবাব পেয়ে যাবে।

বাবাই নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেনি। কী লাভ বলে ওর। কিন্তু সুদীপকেও ক্ষমা করেই দিলাম। রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ে গেল। মৈত্রেয়ী দেবীকে চিঠিতে লিখছেন, ‘যদি বাহিরের কোনও ক্ষুদ্রতা তোমাকে পীড়ন করে থাকে তবে তার কাছে পরাভব স্বীকার করতে লজ্জাবোধ কোরো’ আরেক জায়গায় বলছেন, ‘যাদের মন অতিরিক্ত স্পর্শকাতর, তারা সবটা শোনে না, সবটা জানে না। সবাই তাদের এড়িয়ে চলে না, কাজ নেই। বন্ধুর বন্ধুত্ব তাদের প্রতি মঙ্গলদায়ক হয় না’ 

সুদীপও কাটাকল থেকে ইকনমিক্সে মাস্টার ডিগ্রি করার পর দিল্লির একটা ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে এমবিএ করে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়েছে। তবে অরিন্দমদা বলে যে সুদীপ যেখান থেকে এমবিএ করেছে, তা টাকার জোরে, ওকে কোনও এন্ট্রাস পরীক্ষা দিতে হয়নি। সে যাইহোক, বেকারত্ব কী সুদীপ জানে না, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কোনও সৌভাগ্য ছিনিয়ে নেওয়ার প্রকল্পে  আমার মতো ওকে নাম লেখাতে হয়নি। আর আমাদের দেশে টাকা থাকাও তো একটি যোগ্যতা। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলিজিবিলিটি কন্ডিশন। উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, সাদা চামড়া-কালো চামড়া, বুদ্ধিমান-বোকা এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একটি মাত্র শ্রেণিভেদই যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একদলের হাতে টাকা আছে, আরেক দলের হাতে নেই, ইংরেজিতে যাকে বলে Haves and Haves Not.

ফুটপাত থেকে না কলেজস্ট্রিটের কোনও দোকান থেকে কেনা একটা বই আমার মধ্যে বেশ ইতিবাচক মনোভাবের সঞ্চার করল। বইটির নাম—‘তুমিও জিতবে’। শিব খেরার লেখা ‘You Can Win’-এর বাংলা অনুবাদ। সারা বিশ্বেই বইটি আদৃত শুনেছি। বেশ খুঁটিয়ে দাগিয়ে বইটা পড়লাম। সহজে হতাশ না হওয়ার বেশ কিছু উদাহরণ আছে। তার একটি এরকম—একজন আচার বিক্রেতা আচারের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। এক হাজারটা বাড়ি ঘোরার পর প্রথম ক্রেতার সন্ধান পান। এই ভদ্রলোকটির আশাবাদকে স্যালুট করতেই হয়।

এইসব পড়ে আমারও বোধোদয় হল, সরকারি চাকরির পরীক্ষার পথ বেছেছি যখন পরীক্ষা দিয়ে যাব, যে যা-ই বলুক চাকরি পাওয়ার আগে বা বয়সের বেড়া টপকানোর আগে থেমে যাব না।

অবশ্য আমার পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টা যে সকলে ভাল চোখে দেখত তা নয়। তারা চাইত অন্যভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

একবার পাড়ারই একটি ছেলে পার্থ একটি পঞ্জি স্কিমে আমাকে সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে নামার প্রস্তাব দিল। শুনেই নাকচ করে দিলাম। ও বলল, এটা একটা ভাল রোজগারের পথ হত তোমার। কিছুই সেরকম করতে হত না। শুধু আরও কিছু লোককে হুইস্পারিং ক্যাম্পেন করে বুঝিয়ে এই ব্যবসায় নামাতে হত, যাতে চেনটা সচল থাকে। তারপর তোমার কাজ না করলেও চলত। চেনটা সচল থাকলেই কিছুদিন অন্তর অন্তর চেক পেতে। 

স্বভাবতই কাজ না করে চেক পাওয়ার গল্প আমার ভাল লাগেনি। ওর বক্তব্য অনুসারে সাড়ে সাত হাজার টাকার বিনিময়ে আমি প্রথমে পাব একটি হায়দ্রাবাদের পার্ল ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের একটি সিডি। তারপর এই দ্রব্যহীন ব্যবসায় নেমে কী মহতী উন্নতি অপেক্ষা করছে মানুষকে বুঝিয়ে শৃঙ্খলে যুক্ত করতে হবে।

আমি রাজি হলাম না দেখে পার্থ আমার প্রতি বেশ বিরক্ত হল। কিছুদিনের মধ্যে পার্থ একটি বাইক কিনল। শুনলাম এটা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নির্দেশেই ওকে কিনতে হয়েছে লোন নিয়ে। বুঝলাম ব্যবসায় যে প্রচুর আমদানি হচ্ছে তা মানুষকে বোঝানোর জন্য কিছু তো ঠাটবাটের দরকার। নাহলে লোকে আকৃষ্ট হবে কেন?

সাড়ে সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে পারাটাও আমার কাছে অসম্ভব ছিল হয়তো। কিন্তু সেজন্য আপশোশ হয়নি একফোঁটা। সহজে টাকা  কামানো তো আমার লক্ষ্য নয়। শুধু অর্থ নয়, অর্থের সঙ্গে চাই সম্মান। সরকারি চাকরি পাওয়ার যে প্রকল্পে নিয়োজিত হয়েছি, তাতে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু না করলে নয়, তা-ই করব। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত করার খেলায় মাতব না। সহজে পয়সা রোজগারের রাস্তায় পা বাড়াব না। ‘রাধারাণি’-র বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় নিজের সম্পর্কে বলাই যায়—‘উহারা দরিদ্র, কিন্তু লোভী নহে।’

 

চোদ্দ

 

এরই মধ্যে বাবা গুরুতর অসুস্থ হল। যমে-মানুষে টানাটানি। পার্কসার্কাসের চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে পড়ে থাকলাম দিন দশেক। হার্টের অসুখ। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। তারপর বাবা বাড়ি ফিরল। ধুমপান বন্ধে ডাক্তারবাবুর নির্দেশ উপেক্ষা করে বাবা বিড়ি খেত। আমাদের বারণ শুনত না। আমারও তখন ধুমপানের নেশা। এক বাড়ি থেকে অন্যবাড়ি পড়াতে যাওয়ার ফাঁকে সাইকেল দাঁড় করিয়ে সিগারেটে সুখটান দিতাম। কলেজে ভর্তি হয়েই এই নেশা ধরেছিল। বেশি খেতাম না। কিন্তু তাও দিনে  চার-পাঁচটা গোল্ড ক্লেক লাগত। প্যাকেট কিনলে বেশি খেতে ইচ্ছে করবে বলে দোকান থেকে একটা করে কিনে খেতাম। আর সে সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া সুবেশা রমণীদের দেখতাম। বুকটা হু-হু করত। মনে হত এই সিগারেটের ছাইয়ের মতোই জীবন ফুরিচ্ছে যাচ্ছে। কোনও নারীসঙ্গ-লাভের মতো সক্ষমতা কি এ-জীবনে অর্জন করতে পারব! বাড়িতে অনেক রাতে আমার বিড়ি নেশা পেয়ে বসত। আমার স্টক বাড়ন্ত হলে আলনায় ঝোলা বাবার পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে বিড়ি চুরি করে খেতাম।আজ মনে হয় ডাক্তারের বারণ অগ্রাহ্য করে বাবা যে বিড়ি খেত এতে আমারও যেন প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। বাবা বিড়ি খেত বলেই তো রাতে পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে আমিও বিড়ি পেতাম। কই এটা নিয়ে তো পরদিন হুলুস্থুলু  করিনি। চিত্তরঞ্জন থেকে বাবা ফেরত  আসে মে-র মাঝামাঝি। তারপর তিন-চার মাস বাবা ভাল ছিল। শরীর যে আবার খারাপ হতে পারে আশঙ্কা ছিলই। বাবাকে শ্যামাপদ  চৌধুরির  বাড়ির দুর্গা ঠাকুরটা বানাতে বারণ করলাম। প্রচন্ড ধকলের কাজ বাবার শরীর নিতে পারবে না মনে হয়েছিল। কিন্তু বাবা যখন কিছুতেই আমার বারণ মানতে রাজি হল না, এক কঠিন কথা আমার মুখে উচ্চারিত হল, তুমি যদি ঠাকুরটা বানাও আমার মরা মুখ দেখবে। মুহূর্তের অসতর্কতায় কত কঠিন কথাই তো আমাদের মুখ থেকে বেরোয়। বাবাও যে কতবার রাগের মাথায় আমাদের মুণ্ড কেটে গঙ্গায় ভাসাতে চেয়েছে! তো, আমার ওই কঠিন কথা শোনার পর কোনও সংবেদনশীল বাবা হলে নিশ্চয়ই দূর্গা ঠাকুরটা বানাত না। কিন্তু আমার বাবা তো কিছুতা গোঁয়ার গোবন্দ। সূক্ষ্মতার নিদারুণ অভাব। কিন্তু ভগবান বোধহয় পিতাকে ছেলের মরা মুখ দেখা থেকে রক্ষা করার জন্যই পিতার হাতে ঠাকুর বানাবার কাজ সম্পূর্ণ করলেন না। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তৃতীয়ার দিন রাত দশটা নাগাদ প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা শুরু হল বাবার। আমি ছিলাম এক বন্ধুর বাড়তে আড্ডারত। সাড়ে দশটা নাগাদ ফিরে দেখি বাবার অবস্থা সঙ্গীন। বড় ঘরের মেঝেতে বাবাকে শোয়ানো হয়েছে। কিন্তু বাবা স্থির থাকতে পারছে না। এপাশ ওপাশ করছে আর খালি ককাচ্ছে। ছুটলাম একটা ট্যাক্সি ডাকতে। আমার ভান্ডারে তখন মাত্র চারশো টাকা সম্বল। মাসের শেষলগ্ন। স্কুলের মাস ছয়েকের মাইনে বকেয়া। ট্যাক্সি ডাকতে গিয়ে মনে হল একটা অ্যাম্বুলেন্স হলেই ভাল হয়। অক্সিজন দিতে দিতে যদি বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ভাল হবে। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে এইচ এল সরকার রোডে লাইফলাইন নামে এক সংস্থায় গেলাম। ভাড়া জানলাম এগারোশো টাকা। কিন্তু পুরো টাকাটা আগাম পেমেন্ট না করলে অ্যাম্বুলেন্সে বাবার বিপর্যস্থ ফুসফুস অক্সিজেন পাবে না। ‘লাইফলাইন’-এর ভদ্রলোককে চারশো টাকা দিতে চাইলাম, বাকিটা পরে দেব বলি। কিন্তু কিছুতেই তিনি রাজি হলেন না। বরং কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় বেশ বিরক্ত হলেন।

উপায়ান্তর না দেখে ছুটলাম কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি। মোশারফ। স্কুলের বন্ধু। সরু গলি দিয়ে যাওয়ার সময় একটা কালো বিড়াল আমার রাস্তা কাটল। মা বলে কালো বিড়ালের রাস্তা কাটা খুব খারাপ লক্ষ্মণ। কিন্তু এখন অতশত ভাবার সময় নেই। একটা ট্যাক্সিতে করে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আশু কর্তব্য। যথেষ্ট টাকা নেই বলে অ্যাম্বুলেন্সের আশা ছেড়েছি। মোশারফকে বললাম, তোর কাছে কিছু টাকা থাকলে নিয়ে চল।

ও দু-হাজার টাকা নিয়ে বেরোল। রাত বারোটা নাগাদ ট্যাক্সি পেলাম। তারপর বাড়ি ফিরে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে বিস্তর ছোটাছুটির পর যখন হাসপাতালের বেডে বাবাকে শোয়ানো গেল ঘড়িতে তখন দেড়টা। ডাক্তারবাবু দেখে বললেন, প্রায় শেষ করে এনেছেন। ওষুধ লিখে দিলেন। আমি নীচের দোকান থেকে তা কিনে নিয়ে গেলাম। বোতলের জল গলায় ঢেলে বাবাকে ওষুধ খাওয়ালাম। কিন্তু খানিক ক্ষণের মধ্যেই বাবার চোখ উল্টে জিভ বেরিয়ে দেহ নিথর হয়ে গেল। বলাইদা, আমার জামাইবাবু বলল, সমু সব শেষ। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা।

চার ঘণ্টা না কাটলে বডি ফের পাওয়া যাবে না। নীচে নেমে আমি আর মোশারফ বসে বিড়ি খেলাম। জুতো পেতে বসে অপেক্ষা করতে থাকি রাত শেষ হওয়ার।  আমার জীবন থেকে ‘বাবা’-র যে চিরতরে বিদায় ঘটে গিয়েছে মালুম পেলাম না।

সকাল হলে পর বাবাকে চারতলা থেকে নামাতে বেশ বেগ পেতে হল। ওঠার সময় বাবার লিফট ব্যবহারের অনুমতি ছিল। ফলে কোনও অসুবিধা হয়নি। কিন্তু নামার সময় প্রাণহীন বাবার সে অনুমতি নেই। স্ট্রেচারে শায়িত বাবাকে আমি, মোশারফ, বলাইদা ও গৌতম, আমার জ্যাঠতুতো ভাই— চারজনে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগলাম। খালি ভয় করছিল এই বুঝি বাবা পড়ে গেল। বাবা যাতে না পড়ে যায় তাই মা কালীকেও ডাকলাম মনে মনে। যদিও স্ট্রেচারে শায়িত বাবা ছিল না, বাবার নিথর দেহ। পরে ভেবে অবাক হয়েছি এত সামান্য কারণে কেউ মাকালীকে ডাকে? বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তো ডাকতে পারতাম।

একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে বাবার বডি নিয়ে আসা হল বাড়িতে। উঠোনে বাবাকে শোয়ানো হল। পাড়ার বহু মানুষ এবং স্থানীয় ক্লাব থেকে বাবার মরদেহে ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হল। মাথার কাছে ধূপ জ্বালনো হল। দেখে মনে হল লেখাপড়া না জানা নিরীহ সাদামাটা মানুষটাকে লোকে পছন্দই করত। মা কেঁদেছিল কি? ভাল মনে নেই। কিছুক্ষণ পরে খই ও খুচরো ছড়াতে ছড়াতে ম্যাটাডোরে করে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হল গড়িয়া শ্মশানে। গড়িয়া শ্মশানে আমি আর প্রিয়ব্রত একবার এসেছিলাম বিনা কারণে। আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত শ্মশান-চত্বরে শ্রীমন্ত সওদাগরের প্রতিষ্ঠিত একটি মন্দির। দুপুরের খা খা রোদ্দুরে, নির্জনতায়  মন্দিরটি প্রথম বার দেখে বেশ গা ছমছম করেছিল নোনাধরা আটচালা মন্দিরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এক প্রাচিন বট। ভিতরে মা কালীর ছিন্নমস্তা রূপ। নিজেই নিজের রক্তপান করছে।

 

বাবার শরীরটা যখন ট্রলিতে শুইয়ে ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে ঢোকানো হল, তাকাতে পারিনি। মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম।

বাড়ি ফেরার পর যত সময় গড়াল, বাবার অভাব টের পেতে থাকি। মাথা কুটলেও আর বাবাকে দেখতে পাব না। জ্বলজ্যান্ত মানুষটা নেই হয়ে গেল, স্মৃতি হয়ে গেল। কেমন এক অদ্ভু ভয় জাগানো অনুভূতি টের পেলাম। মানুষের থাকা আর না-থাকার মধ্যে মৃত্যুর পার্থক্য।  ভয় পেতে লাগল মায়ের জন্য। মা যেন অনেক অনেক দিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে।

পরদিন খবর পেয়ে স্কুলের কয়েক জন শিক্ষক আমাদের বাড়িতে এলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার অমলেন্দুবাবু। আমার বকেয়া ছ’মাসের মাইনে দিলেন। সঙ্গে আরও এগারোশো টাকা। এই টাকাটা আমি নিতে চাইনি। কিন্তু অমলেন্দুবাবু বললেন যে এটা তাঁরা সবার ক্ষেত্রেই করে থাকেন। টিচাররা চাঁদা তুলে দেন।

আমার ভাল লাগছিল না। কিন্তু মায়ের কথায় নিতে হল।

বাবার কাজের টাকা জোগাড়ের চিন্তা ঘুচল। তবে মনে হল, ইস! স্কুলের টাকাটা যদি  ক’দিন আগে পাওয়া যেত তাহলে হয়তো বাবাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানো যেত।

মা-দিদির সঙ্গে আলোচনা করে বাবার কাজে কোনও রকম ত্রুটি রাখা হল না। পাশের ক্লাবের মন্ডপ নেওয়া হল। স্কুলের শিক্ষকদের একদিন গিয়ে নেমতন্ন করে এলাম। কয়েক জন স্যার এসেছিলেন। শ্যামাপদ চৌধুরির দুর্গা ঠাকুরের বাকি কাজ সম্পুর্ণ করল আমাদের এক আত্মীয়। আমার পিসতুতো দাদা, যে চাকরির পাশাপাশি ঠাকুরও বানাত পাড়াতেই।   

 

বাবার মৃত্যুতে মনে বেশ আঘাত পেলাম। আমার গরিব বাবা বাজারে একটা টাকাও দেনা রেখে যায়নি তাঁর ছেলের শোধ করার জন্য। মানুষটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ কী জানল না। সুখ কাকে বলে জানল না। ভাত-কাপড়ের চিন্তাতেই জীবন গেল। কোথাও বেড়াতে যায়নি। সমুদ্র কী, পাহাড় কী, অরণ্য কী জানা হল না মানুষটার। ক্ষোভে-দুঃখে আমার বুক টনটন করত। আমাকে ধনী হতে হবে। মাকে সুখে রাখতে হবে। বাবাকে পারিনি। মাকে যেন একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখাতে পারি।


 

*********************************************

 আগামী পর্বে 

*********************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়





['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৬

দীপংকর রায়


সত্যি সত্যিই সে যেন কিছু বলতে চেয়েও কেন যেন থেমে যাচ্ছে , হয়তো ভাবছে কিছু , ভাবছে হয়তো  এতকাল পরে আজ প্রথম দিন দেখা হলো আর ওকে এত কথা বলে দিয়ে এখনি এতটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে বসবো ? হয়তো এই সব কথা দিদি শুনবে , পিসিমা এলে সেও জেনে যাবে , হয়ত সকলেই জেনে যাবে সব কিছু , আর সেটা কি ঠিক হবে ?

       এমনই কিছু হয়ত সে ভাবছে। আর তাই বলতে গিয়েও বলতে পারছে না ।

       নেভিকাট কেনার পয়সা আমি আর কোথায় পাই ! তাই তার দেওয়া এত দামি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকে বলি —  ঠিক আছে , আজকে না হয় থাক ; আপনার ওহেনে যেদিন যাবানে সেদিনই না হয় শুনবানে । কিন্তু থায়েন কনে এহোনে ? সেডা আগে কন ?

       সে বলে , সে না হয় যাসেনে , … কিন্তু খানিকটা না কতি পারলেও তো হয় না ; ধর , হয়তো এমনই হলো , আর তোরে কিছু কতিই পারলাম না ! হয়ত তেমন সুযোগটাই হয়ত আর মিললো না ; তাহলি কী হবেনে ? সেডাই ভাবতিছি —

        এবারে থেমে গেলাম যেন ! সে এটা কি বলছে ? এমন কী হয়েছে যা সে বলতে চাইছে অথচ বলতে পারছে না  ? সে এতটাই বা অনিশ্চিত হয়েই বা পড়ছে কেন ? নিজের মধ্যে নিজেই এতটা অনিশ্চয়তায় ভুগছেই বা কেন যে ; আর তার হয়ত আমাকে কিছুই বলা সম্ভব হবে না হয়ত এমন কথাই বা বলছে কেন অমন ভাবে !

         তাকে যত দেখছি আজকে ততোই আমারও আশ্চর্য লাগছে । এ কি সেই কালিদাস মামা ! যে কিনা পিঁয়াজ রসুনের গন্ধও সহ্য করতে পারত না , আর আজ তাকেই কিনা দেখছি ধুমপান করতে ! আবার এমন সব কথা বলছেই বা কেন ? যে মানুষটি এতকালের সব স্মৃতি ভুলে, এমন ভাবে সব সম্পর্ককে ভুলে , নিজের ইচ্ছা মতো সংসার করেও একদিনের জন্যে হলেও আমাদের বাড়িমুখো হয়নি , যার এদেশে থেকে যাওয়ার প্রথম ঠিকানাটি পাওয়ার পেছনেও , কোনোরকম বিনিময় মূল্যও ছিলো না তো আমাদের সঙ্গে ! সেই মানুষটিকে এতদিন পরে পেলাম যখন তখন সে এসব কী বলছে এখন ? বলছে কিনা —- “শেষে যদি সময় আর না পাই ?” 

      সে কথা শুনে কার আর ভালো লাগে , সে যতোই দূরে থাক , তবুও একদিন তো খুব কাছেরই ছিলো — সে কথা ভুলি কী করে ?

      ইতিমধ্যে তাঁদের একটি কন্যা সন্তানও হয়েছে জেনেছি । এতদিনে তার বয়সও হয়ত দু-তিন বছরেরই হবে হয়ত ; তাহলে , এমন কীই বা হলো , যা সে বলতে যেয়েও বলতে পারছে না ! এছাড়া আজ তার সঙ্গে আমার এই দেখা হওয়া টাও তো আচমকাই , তাহলে ? সে তো আর আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যে এখানে দাঁড়িয়েছিল এমনটাও তো হতে পারে না ! তাহলে ?

     যদিও এর পরে একটুখানি ভূমিকা-সহ যা সে খানিকটা বললো, সে কথাগুলি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় । সে বললো , জানিস তো কথায় বলে না , গুরুজনের কথা মানতি হয় একটুখানি ; না মানলি , তার দশা এমনটাই হয়ে থাকে মনে  হয় ।

       বললাম , সে কথা কচ্ছেন ক্যান?

      সে তাতে বলে , সব বিশ্বাস হারায়ে , সেই জন্যিই তো এই কথাডা কচ্ছি ।

      — ঠিক বুঝতি পারলাম না ।

একটু পরিস্কার করে কন তো , কিডা আপনারে ঠগাচ্ছে ?

       —- সিডাই তো কতি চাচ্ছি তোরে , বিয়ের পর থেকেই বুঝতি পারতিছি ; অথচ এতকাল ঠিক ধরতি পারিনি জানিস ! এহোনে বিষয়ডা পরিষ্কার টের পাচ্ছি জানিস; কিন্তু এহানে , এই পরিস্থিতিতে কী করি ? মেয়েটার দিকিও নজর দেয় না জানিস । তার রোজকার টিফিনের পয়সাটাও মাইরে খাওয়ায় তার পেয়ারের লোকরে , সে কথাটা কারে কোই ক তো ?

        এই কথাটুকু শেষ করে সে আমার দুটি হাত খপ করে চেপে ধরে বলে , তোরা আমারে বাঁচা ; দিদিরে দেখা হলে কবো কবো করেও এতদিন কিছুই কতি পারিনি !  কী কবো তাঁরে ? কোন মুখিই বা তাঁর সামনে যাইয়ে দাঁড়াবো ? সে তো কতবার আকারে ইঙ্গিতে আমারে বারণ করিছিল ; আমি তো কারো কথাই শুনি নি । এহনে তো দেখতিছি , আমারেই না মাইরে ফ্যালে সে । 

      তার দুটি হাত আস্তে করে আমার হাতের ভেতর থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে আমিও তাকে বললাম , ভাববেন  না  , আপনি এতটা ভাইঙ্গে পড়বেন না —  তবে বিষয়টা সত্যিই সত্যিই খুব সঙ্কটের ; তবুও বলছি একেবারেই ভাইঙ্গে পড়বেন না । আচ্ছা , আমি কালকেই কয়েকজন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে করে নিয়ে আপনার ওখেনে যাচ্ছি । তবে আগে থেকে  কারুরে  কিছুই কবেন না যেন ; আমি যাবো এমন একটা ভাব নিয়ে , যেন হঠাৎ মনে পড়িছে তাই চলে গেছি । আমি কিছুই জানি না যেন ; হঠাৎ মনে হইছে তাই খোঁজখবর নিতি আইছি এমনই একটা ভাব দেখাবো , বুঝলেন । তারপর কথায়বার্তায় যা বুঝে নেবার , বা , যা বুঝিয়ে দেবার বুঝিয়ে দিয়ে আসবো ওদেরকে । জানবেন একটা কথাই শুধু , মনে রাখবেন এই কথাটাই , এখানে  আপনি একা নন কখনোই ।

       —- ঠিক আছে , তাহলে ঐ কথাই থাকলো তোর সঙ্গে । বিকেলের দিকে ঐ সময় আমি ঘরেতেই থাকি , কোচিং-এর ছেলেপেলেরাও থাকে দুই একজন হয়ত , তোরা আসিস ভালোই হবে তাহলে ।

       —- ঠিক আছে , সেই কথাই থাকলো তালি ? তা , সম্পর্কটা কার সঙ্গে ? সে কি এলাকার কেউ ?

       —- এলাকার কি কচ্ছিস তুই ? সে তো ঐ বাড়িরই বড় ছেলে ।

       —-- বাবা , সে কী !  আপনি জেনেবুঝে সেখানেই রইছেন …? এটা আবার কী কচ্ছেন ! এসব আমি তো কিছুই বুঝতি পারতিছিনে ?

        এবারে সে মুখটা একেবারে অন্ধকার করে বলে , সে কথা কি জানতাম আগে ? সেটা তো পরে হাতেনাতে ধরতি পারলাম । মারিছিও দুটোরেই একদিন । এর পর সে কি হাতে পায়ে ধরা ! বলে , সে নাকি ওর বন্ধু ছাড়া আর কিছুই না । এর পরে তাকে পড়াতে দেবার অনুরোধও করে । তাও দিছি , ও তো পড়ায়ও কোচিং-এ। 

        বলি , — সেটা আবার কী ?!

         তাঁর কথা যত জানছি ততোই অবাক না হয়ে পারছি না । তাঁর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি —  সত্যিই , এই মানুষটিকে নিয়ে যতোই ভাবছি , ততোই বিস্ময়ের শেষ থাকছে না আর । একি সেই মামা ? যে কিনা কোনো মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পেতো ! তাঁকেই কিনা দেখলাম শেষে প্রেম ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে , একেবারে বিয়ে করেই বসলো ভালোবেসেই ! এবং আজ আবার সেই প্রেমের পরিণতির কথা নিজেই বলতে বাধ্য হচ্ছে এমন করে ! যে কিনা  একবেলাও গীতা-ভাগবত না পাঠ করে  মুখে অন্নও তুলতো না ; এবং  এ কথাও জানি , আজও বিয়ে থা করেও , এখনো সেগুলি নিয়ম করে করে চলেছে নাকি সে । এর আগেও দেখেছি তার ঠাকুর দেবতার উপর অগাধ বিশ্বাস । সেই মানুষটিকে আজ তার বিবাহিত জীবন নিজেই নির্বাচন করে , সকলের থেকে  এরকম দূরে সরে থাকতে হলো কেন ?.... আর আজ এমন অবস্থা তাঁর সে নিজেই বলছে কিনা , “ আমাকে বাঁচা তোরা , … ওরা ভাবিছে , এখেনে আমার কেউ নেই । আমি একা । তাই যা খুশি তাই করতিছে ।  আর আমি নীরবে সেগুলো হজম করে যাচ্ছি ! কিছুই কতি পারবো না!...  টাকা পয়সা সবকিছুই এর মধ্যি গোল্লাইতে পাঠাইছে । বুঝতি পারিনি তা আগে , এহোনে তো কোনোকিছুই ভাবতি পারতিছি নে । কেবলই ভাবতিছি , এর সমাধান আমি করবো কীভাবে ? ওহেন থেকে সরেই বা আসি কোন ভাবে ? যেহেনেই যাবানে সেহেনেই তো ঐ বদমাসটা উপস্থিত হবেনে । এমন একটা জায়গা খুজতিছি , যেহেনে গেলি , ও আর না যাইয়ে উপস্থিত হতি পারে অন্ততো…..” 

        বেশ খানিকটা আশ্চর্যই হচ্ছিলাম । ভাবছিলাম , সত্যি সত্যিই মানুষটা তো খুবই ঝামেলায় পড়েছে। কিন্তু একে কোন পথ দিয়ে , কেমন ভাবে , কাকে ধরা করা করে , এর একটা সমাধানের পথ বের করতি  পারি , সেটাই ভাবতে লাগলাম ।

        কতকাল পরে তাঁর সঙ্গে দেখা আমার ! আর আজকেই কিনা শুনতে হলো সেই মানুষটি ভালো নেই!.... মনে পড়তে লাগলো একাত্তরের দিনগুলির কথা… । কত কথা বিনিময় করেছি এই মানুষটির সঙ্গেই তো ! খুব বেশিদিন আগের তো কথা নয় সে সব ! 

       যাক গে , এখন তো সেসব ভেবে লাভ নেই । এখন ভাবছি , কীভাবে , কোন পথে , এই মানুষটিকে এই সংকট থেকে খুব সহজভাবে বের করে আনা যায়, সেই কথাটিই । যা তার কথা শুনে মনে হলো , সে বেশ বড়সড় একটা ঝামেলাতেই আছে । কিন্তু কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারিই বা আমি ?       

       মামা চলে গেল দেখলাম ব্রীজ পেরিয়ে , নাকি , শান্তিনগরের পথে খেয়াল করতে পারিনি সেটাও । নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে গেছিলাম যেন । 

        আজকে মামার সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে , যা তার বর্তমান পরিস্থিতি , তার যতটা পারা যায় সবটাই মাকে এবং বাড়ির সকলকেই জানালাম ।  ছোটো ভাই শুনে জিজ্ঞাসা করলো , মামা এখন থাকে কোন জায়গাটায় ঠিক বল তো?

       বললাম যতটা শুনেছি সেটাই । সে তাতে বললো , প্রদীপ সংঘের কাছে তো ? ওঁ ,....চক্রবর্তীদের বাড়ি ওটা । 

          বললাম , হ্যাঁ সুধীর চক্রবর্তী না কি বললো একটা নাম । ঠিক মনে নেই । 

          সে তাতে বললো , ও আমার এক তুড়ির কাজ । যা দলবল আছে না ওখানে আমার , ওকে একেবারে বানিয়ে দিয়ে আসবো না , দেখিস ।  ও তুই ভাবিস না , যা তুই আগে দেখে আয় , তারপরে শুনেনি সবটা  , দেখি , ব্যাটা কতো বড়ো মাস্তান হয়েছে ? এইসব জোর জবরদস্তি ! 

         তাকে বুঝোবার চেষ্টা করলাম। বললাম , এসব তেমন নয় । ওভাবে কিছু করতি গেলি , হিতে বিপরীত হবেনে কিন্তু । এভাবে হুজ্জুতি করার বিষয় না এটা । প্রমাণ কী আছে কিছু ? যে তাঁকে তারা সকলে মিলে একেবারে টর্চার করতিছে ? শেষে উল্টো ঝামেলা বাইড়ে যাবেনে কলাম । তার চাইতে আগে দেখি বিষয়টা কি ? 


      কিন্তু সে যা হয় হবে পরে । কিন্তু একটা কথা ভাবতে যেয়ে সত্যিই আশ্চর্য হচ্ছি , এই যে মামা , আমাদের থেকে এতদিন এতটা দূরে রয়েছে , অথচ আজ তার বিপদের কথা শুনে ছোটো ভাইও কেমন করে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টাকে নিজের করে নিয়ে , এই যে সে যেমন করেই হোক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকলো , তাতে কি একবারও কেউ বুঝতে পারবে , সে যে আমাদের থেকে এতদিন এতটা দূরে সরে ছিল ? সে তো আদতে , বা সত্যি সত্যিই সে তো আমাদের প্রকৃতভাবে মায়ের আপন ভাই নয় !

         যদিও এই হিসেবটা কোনোদিনই আমাদের মাথায় ছিল না । এঁরা কেউই সে অর্থে আমাদের আপন মামা নয় । চিরকাল এটাই ভেবে এসেছি যে এরাই আমাদের আপন মামা । তাই ভাইয়ের এই আবেগের মূল্য অনেকটাই আন্তরিক যে , এ কথা আমিও আজ আরো একবার ভাবতে বাধ্য হলাম ।

       কিন্তু যা হয় , মানুষ যার যার আপন ছন্দ তালে এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকে , যে কারণে তাকে অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতে হলেও, তা যেন বেশিক্ষণ মাথায় ধরে রাখতেও দেয় না । সেটাও তার নিজের নানা সমস্যার কারণগুলিই হয়ত । তাই ,এ ক্ষেত্রে আমারও সেটাই ঘটলো দেখলাম যেন ।

      তবুও মনে মনে ভাবছি , মুহূর্তের ভাবাবেগের বসে সবকিছু যতটা সহজে ভাবা যায় , এরপর তাকে নিয়ে সময় সুযোগ করে , কতটা সেই স্পিটটাকে নিয়ে এগোনো সম্ভব হয় , সে কথাটিও যেন সবসময় ঠিকঠাক  করে বলবার মতোন নয় ।

      তাই , ঠিক করে তেমন মুহূর্ত আসতেও বেশ কিছুদিন সময় পেরিয়ে গেল । 

      যদিও তারপরে সত্যি সত্যিই একদিন ফোচন শঙ্কর ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়েই হাজির হলাম মামার ওখানে । 

        সেও আমাদের যাওয়াটাকে বেশ একটা নির্ভরতার বলেই মনে করলো যে , সে তার চোখ-মুখের দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা গেল । 

      তবে তার স্ত্রীটিকে কেন জানিনা যতটা রুঢ় হবে বলে ভেবেছিলাম , তা তো নয় ! বেশ মিষ্টভাষী । সে একেবারে আপ্যায়নের চূড়ান্ত দেখিয়ে ছাড়লো । সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথা বুঝিয়ে দিতেই হয়তো চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো , এই না হলে ভাগ্নে বলে ? এতকাল পরে মনে পড়লো মামা-মামীর কথা আজকে ?

       এসব না-বোঝার কোনো কারণ থাকে না । কেন সে এই কথাটি খানিকটা তির্যক ভঙ্গীমায় পরিবেশন করলো ; দুরকমের অর্থ করে যে সেটুকুও না-বোঝার নেই তো !

        এরপর মামার ওখান থেকে চলে আসার  আগে বা পরে , এমন কিছুই বুঝতে পারলাম না তো ! কোই  তেমন কিছু একটুও বুঝলাম না কেন?

         মামার মুখে শোনা কথার এমন কোনো সঠিকত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন চিহ্ন খাড়া হয়ে দাঁড়ালো যেন সামনে ; যা তাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যবহারিক আচরণের মধ্যে  ধরা পড়লো না কেন আমাদের চোখে ? যেন সবটাই সাভাবিক যেমন আর দশটা বিশটা পরিবারে আত্মীয়স্বজন এলে স্বামী স্ত্রী যেমন আচরণ দেখায় , এও যেন তেমনটাই । অথচ সেই সম্পর্কের ভেতরে মামার বর্ণনায় যে ভয়ঙ্কর রূপের কথা শুনেছিলাম , সেটা কোথায় ? 

       যা দেখলাম , তাতে তাকে অতি সাধারণ বলেই তো মনে হলো ! সত্যি সত্যিই কি , সে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে কখনো ? সত্যি সত্যিই কি এই মানুষটি তার ঐটুকু মেয়ের মুখের খাবার , তাকে না দিয়ে , সে তার বর্তমান প্রেমিকের মুখে তুলে দিতে পারে ? হাজার হলেও সেও তো তারই সন্তান ! সেও তার মা ! 

         তাকে তো দেখলাম , আরো  সে তার স্বামী-সন্তানকে-যেন বিশেষ ভাবে আগলাচ্ছে ! তাহলে কি সেটাও তার নিখুঁত অভিনয় ? 

        কোনো কিছুই ধরতে পারলাম না  । আরো দেখলাম সে বারবার করে বলতে লাগলো , ‘কেন এতদিন আমি আসিনি ।’.... সে ক্ষেত্রে দোষারোপ করতে থাকলো এই বলে, ‘....মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক কি এভাবে থাকে কখনো ? এর আগে কত কথাই তো শুনেছি , এই ভাগ্নেকে নিয়ে মামার কাছে ! ’

       আমাদের সকলেরই যেন সবটা গুলিয়ে যেতে লাগলো মামার মুখে শোনা কথার সঙ্গে তার স্ত্রীর এই সময়ের আচার আচরণের কথাবার্তার দিকে চেয়ে ;  সে যেন এ ক্ষেত্রে আমরা চলে আসার পরে আপন মনে বলছে , ‘ দিলাম তো গুলিয়ে ? আমাকে চেনা কি এতটাই সহজ চাঁদু ? ’

      এ ভাবনা যদিও নিতান্তই আমার  । নাও হতে পারে তো  এমনটা । হয়তো কালিদাস মামাকে নিতান্তই সন্দেহ বাতিকে পেয়ে বসেছে , তাই হয়তো সে এইসব নিয়ে এমন ভাবে ভাবছে সবটা ? যদিও সেটাও মেনে নিতে সত্যি সত্যিই পারি না । কারণ সেদিন তার চোখেমুখে যে আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছি , তা কি শুধুমাত্রই সন্দেহর বশে এমনটা একজন মানুষ তার স্ত্রীকে নিয়ে শুধু শুধুই ভাবতে পারে কখনও ? বিশ্বাস হয় না তেমন কিছু ও তো !

       যাইহোক , এই মহিলার , এই অতি সাধারণ আচার আচরণের ভেতরে কোথাও তো এমন কিছুই মনে হলো না , যা দিয়ে তাকে এতটা নিষ্ঠুর ভাবতে পারে কেউই ।আবার , এই মানুষটি কি তার সন্তানের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে , তার বর্তমান প্রেমিকের মুখে তুলে দিতে পারে ?  আরো সে তো দেখলাম  মামাকে বিশেষভাবেই আগলাচ্ছে যেন ; আরো আমরা এতদিন কেন তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ , যাওয়া আসা করিনি কেন , সে কথাটাই তুলে ধরতে থাকলো বেশ খানিকটা আকার ইঙ্গিতে যে , সেটাই তো দেখলাম ! মামাকে এমনভাবে সমাদর করতে থাকলো , যা দেখে আমাদেরও ভাবতে বাধ্য করতে লাগলো , সে কতটা অনুগত । সে-ই তো দেখলাম তাড়াতাড়ি আগ বাড়িয়ে কাউকে দোকানে পাঠিয়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া মিষ্টি আনিয়ে আমাদের প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন করতে লাগলো ! মামাকে হাত ধরে টানতে টানতে পেছনের ঘরে নিয়ে যেয়ে হয়তো জিজ্ঞাসাও করতে লাগলো , দেখো এইগুলি ঠিক আছে কিনা ?

        এর পর আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে চা পান করতে করতে নানা গল্পগাছাও ফেঁদে নিতে চাইলো দেখলাম ! শুনতে বাদ রাখলো না , আমাদের বাড়িটা ইস্কুলের ঠিক কোন দিকটায় ? মামা কোনোদিন তাকে নিয়ে যায়নি যে , সে অভিযোগটাও করতেও ছাড়ল না । এবং বললোও , ঠিক আছে , নিয়ে যায়নি তো কি , আমিই না হয় একদিন চলে যাবো ! 

     মামার ওখান থেকে যখন বাইরে এলাম তখন ফচন বললো , ঘরের পেছন দিক দিয়ে এসে যে ছেলেটি ঘরের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল , এই মালটাই কি সেই ছেলেটা ? একে তো এক ঠেলা মারলেই পড়ে যাবে রে ! দেখে তো মনে হলো একেবারে সাদামাটা , গোবেচারা ?

      সত্যিই তো , আমরা যখন গেলাম , তার একটু পরেই তো একজন ঘরের ভেতর দিয়ে পেছন দিক থেকে এসে সামনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ! তাহলে  সেই কি আমাদের আপ্যায়নের মিষ্টি, সিঙারা সব এনে দিলো ? হ্যাঁ , মামাকেও তো দেখলাম স্বাভাবিক কথাবার্তায় তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো একটু আগেই ! এবং পরের দিকে আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সেও তো পেছনের বেঞ্চিটাতে এসে চুপচাপ শুনতে লাগলো সবকিছুই বেশ সাধারণ ভাবেই !

কই , তার আচার ব্যবহারে কোথাও তো এমন কোনো ভিলেনিও ইঙ্গিত লক্ষ করতে পারিনি তো ! যেন একেবারেই গোবেচারা । ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানে না ! তাহলে ফোচন কীভাবে বুঝতে পারলো , এই ছেলেটিই সেই ছেলেটি , যে কালীদাস মামার জীবনটা তছনছ করে দিতে চাইছে ?!


       শঙ্কর বললো , অস্বাভাবিক কিছুই না । 

       বললাম , দ্যাখ , মামার কথা যদি ঠিক হয় , তাহলে বলতে হবে সত্যি সত্যিই হয়তো সে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, যা আমরা এইটুকু সময় এসে ঠিক বুঝতে পারছি না, বা হয়তো তার স্ত্রী বুঝতেও দিল না আমাদেরকে একটিবারের জন্যেও , এরকম স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে । তাহলে ধরে নিতে হবে , এসব একটা নিখুঁত অভিনয় এই সবটাই ?  

        আসলে এখানেই তো কেরামতিটা । নিজের স্বভাবকে অন্যের কাছে ধরা  পড়তে না দেওয়া। এখন কোনটা ঠিক , সে কথা আমরা একমুহুর্তের এইটুকু দেখায় , চট করে ধরতে পারবো না। তবে সত্যি হলে , সত্যিই খুব কঠিন ঝামেলা যে এসব , সেকথা বলতেই হবে । 

       সে তাতে বললো , ঠিক আছে আমরা আর একদিন এসেই দেখি না কেন , তাহলে খানিকটা অন্তত ধরে তো ফেলা যেতে পারে ? তবে কয়েক দিন পরে । এখনি নয় । কালিদাস মামাকে বলবি , এর পরের দিন আমরা গেলে আমাদের যেন বেশি গুরুত্ব না দেয় ,অত যত্নটত্ন করেন না যেন উনি । একটু চালাকি করতে হবে বুঝলি ?.... ঠিক আছে , এখন চল , যাওয়া যাক । আমার সঙ্গে যদি ইতিমধ্যে দেখা হয় মামার , তাহলে যা বলে দেবার বলে দেবো ওনাকে । চল , এখন যেদিকে যাবো বলে এর আগে মনে করেছিলাম , এখন সেইদিকে চল দেখি ।


       মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে এমন ভাবে শামুকের মতো গুটিয়ে যাই , তখন যেন নিজেকে নিয়েই  বিভ্রাটে পড়ি ; যা কাউকেই বুঝিয়ে বলে উঠতে পারি না । কেন যে এমন অবস্থা হয় আমার ? আশেপাশে যারা থাকে , যাঁদের ঘিরে এই বাড়ির সংসার , যাদের যাদের ঘিরে সমস্ত আবহটায় প্রতিদিন আমিও হাতমুখ ধুই , পায়খানা পেচ্ছাপ করি , খাইদাই , স্নান করি , ঘুমাই , …. সকলেই তো আমার মতো এমন সব অভ্যাসের সঙ্গে এই তথাকথিত সভ্য সমাজে এইসব কৃয়াকলাপ করেই তো বাঁচে ? তাঁরা সকলেই যেন এই প্রবাহমান অভ্যাসের মধ্যে থেকেও কোনো বিশেষ অনুভবের সংস্পর্শে এসে আমাকে নিয়ে বেশ একটা ধন্ধেই পড়ে যায় , ভাবে....এইটা কি করছে ও ? এগুলি কি ওর মানসিক বিকৃতি ?

      এর আগে আমার এইসব নানা ধরণের কাজবাজ নিয়ে কয়েকদিন দিদির বাড়িতে টের পেয়েছি কী সব কথাবার্তা বলাবলি চলছে ওদের সকলের মধ্যে যেন । সেখানে সকলেই রয়েছে ; সে মা দিদি অশোকদা আরো কেউ কেউও হয়তো হবে , কিন্তু শেষপর্যন্ত বিষয়টা বিশেষ বড় ধরণের গুরুত্ব পাইনি হয়তো । সেটাও যে কেন । তাও জানি না ঠিক মতো । 

     এরপর পুরো পরিস্থিতি ঘুরেও দাঁড়িয়েছে । তাঁদের সকলের চোখে আমি আবার আগের মতো স্বাভাবিক ও হয়ে গেছি কখন যেন ! কিন্তু আমি আমার নিজের ভেতর এই সবের স্বাভাবিক সমাধান আজও ঠিক মতো পাইনি । সেসব সব  একটার পর একটা এমনই ফাঁসে জড়িয়ে গেছে , শেষ পর্যন্ত সেসব আলগা হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছে ।

       এমনই এক তাড়নায় আক্রান্ত হয়ে একদিন ওদেশ ছেড়েছিলাম  কেন যে , সেকথা আমি ছাড়া আর কে জানে তার আসল কারণটা ?  কিছুতেই যেন আজও সে আমার পিছু ছাড়তে চায় না ! খানিকটা যেন একঘেয়েমিতেই ধরা পড়া ? সেই সব ধরণের একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকে একটা এমন অদ্ভুত আবেগপ্রবণতায় পেয়ে বসে কেন যে , সে কথা আর কাকে বলি ?

       সেই যে তখন প্রায় প্রতিদিনই তখন বর্ডার পেরোনো মানুষজনের যাতায়াতের রোমাঞ্চিত করা গল্পের প্রভাব এমন ভাবে আমাকে ঘিরে ধরেছিল , যে বিষয়ের বিশেষ   কারণটি আমি কাউকেই বুঝিয়ে বলে উঠতেই পারিনি কখনো । এমন কি , এমন যে অত্যন্ত কাছের মানুষ নতুন মামিমা , তাকেও বলতে পারিনি আমার সেই রোমাঞ্চিত হবার মূল কারণটা কী । কেনই বা তার জন্যে আমাকে চলে আসতে হলো । সেও কোনোদিন জানতে পারলো না সেই আসল রহস্যের কারণ । বেদনা জেগেছিল কল্যানীকে নিয়েও । সেই যে নৌকা থেকে নামিয়ে দিয়ে শেষ যেদিন ছিপ বড়শি হাতে করে , বৈঠা নিয়ে , নৌকাটিকে খুঁটিতে বেঁধে রাখার সময় তাকে যে দেখেছিলাম জুলজুল করে চেয়ে থাকতে আমার দিকে , ড্যাবড্যাব করে ; যেন সে টের পেয়েছিল এই হয়তো শেষবারের মতো আমার সঙ্গে তার মাছ ধরতে আসা । তবুও মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি সে । বলতে পারেনি এমন কথা : তোমার মনে পড়বে না তুমি যে এই সব ছেড়ে চলে যাচ্ছ যে ওদেশে ? কোথায় পাবে এমন নবগঙ্গাকে ? এই নৌকা ? কোথায় পাবে এমন জলশ্যাওলার গন্ধ মাখা এমন সব দিন ? যা তুমি এমন নিষ্ঠুর ভাবে ফেলে‌ চলে‌ যাচ্ছো ….? 


     যেন স্বাভাবিক এসব কিছুই । এমন একটা ভঙ্গিমা দেখিয়ে চলে‌ এসেছিলাম । সে যেন কতবার বলতে চেয়েছিল , এমন একটা দিন কি কোনোদিন তোমার জীবনে আসবে‌ না , যখন তোমার মনে হবে ফিরে যাই , ফিরে যাই আমি আমার সেই‌ পল্লী জীবনে আবার ?

       না , কোনোভাবে কেউ-ই প্রকাশ্যে এই সব অনুভবের একটি বর্ণও বিনিময় করেনি সেদিন । 

       না , বলে আসা হয়নি সেইভাবে নতুন মামিমাকেও কিছু । অথচ সেই কাইলে মামার সঙ্গেই তো ঐ দেশ ছেড়ে আসতে হলো একদিন খুব ভোরে ভোর উঠে ।

        সামান্য সেই আবেগ , সামান্য সেই মুগ্ধতাটুকুকে বুকের ভেতর পুষে , সেই যে নাওভাঙার মানুষজনগুলোকে যে সকাল বেলা হলে দ্রুত হেঁটে যেতে দেখতাম খেয়াঘাটমুখো হনহন করে….. আর সেই সব প্রতিদিন দেখেই না , কি এক আবেগে পেয়ে বসলো আমাকে , মনে হলো , এখনি , এখনি যদি ওদের সঙ্গে সঙ্গে এমন সকাল সকাল আমিও ওদেশে যাবার জন্যে এমন একটা দৃশ্য তৈরি করে রওনা হতে পারতাম ওদের মতো অমন ভাবে , তাহলে সেই সব পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে‌ কত কিছুর না অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হতো আমারও ! সেই আবেশটুকু শরীর মনে  লাগিয়ে , আবার না হয় একদিন ফিরে‌ আসতাম এদেশে । 

        শুধুই নিজের সেই  আবেগটুকুকেই গুরুত্ব দিলাম ? অথচ অন্য কারো কথা একবারের জন্যেও ভাবলাম না ?

          আমার এই ক্ষণকালীন একটা সিদ্ধান্ত , কীভাবে সামান্য একটুখানি অনুভবের ঘাড়ের উপর চড়ে , এমন ভাবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে চলে আসতে পারলো ? এবং সত্যি সত্যিই সেটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ? এর জন্যে একদিন না মস্ত বড় খেসারত দিতে হয় । এবং সত্যি সত্যি সে কথা কি ভেবেছিলাম একবারও ? একটিবারের জন্যে হলেও পিছনে ফিরে দেখেছিলাম কি? একটিবারের জন্যেও কারো বিষণ্ণ মুখটির জন্যে তাকিয়ে দেখেছিলাম কি , না ভেবেছিলাম ? আচ্ছা একবারও কি মনে হয়নি , এরা আমাকে ঘিরে কীভাবে এতগুলি দিন , এমন কত অভ্যাসের ভেতরে , নিজেদের স্নেহ ভালোবাসা রাগ অভিমান সব কিছু ঢেলে দিয়ে সেই যে আবৃত করে রেখেছিলো , তার কি কোনো মূল্যই সেদিন আমার কাছে ধরা পড়েনি ? 

       যদি ধরা নাই পড়ে থাকে, তাহলে

     আজ কেন সে সব এমন ভাবে মনে পড়াচ্ছে ? আর যখনই মনে পড়ছে , তখনই ভেতরটা কিরকম দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক কেবলই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে চাইছে ; কেন এমনটা হচ্ছে ? এখন আমি কোন পথে ঘুরে বেড়াই একা একা ? 


        সকালের প্রথম সূর্যকিরণ চোখেমুখে মাখতে যেয়ে যে পথটা প্রায়দিনই শংকর ওদের সঙ্গে হাঁটি সেই মাঠের দিকের পথ , হোগলা বন‌, রাণিয়ার তার , বাগদি পাড়ার সকাল , তারও ওপাশে বাচড়া ভর্তি জলাজমি , আবার কোথাও ধানগাছ বোঝাই বা তরিতরকারির ক্ষেতে পরিচর্যা করছে যে চাষি , তাদের সকলের সব কাজের আয়োজন দূর‌ থেকে দেখে কেন যে ভেতরটা হু হু করে ওঠে ! কত কিছুই না মনে পড়ে…. সে সব ঋতুর এক একটি অধ্যায়কে ওদেশের মতো করে ,বা  সে সব ভাবতে গেলেই বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই গ্রামখানিরই কথা ….. সেই — নবগঙ্গার কুয়াশামাখা ভোরের রূপটি,  কেবলই যেন মনে হয় ঐ তো লঞ্চ চলে আসছে জল কেটে কেটে  তীরের মতো হু হু করে…. মাস্তুলটি সামনে ভাসিয়ে,.... কেবলই যেন পাল তোলা টাবুরের ভেসে যাওয়া সারিবদ্ধ ছবির মতো সেইসব দৃশ্যের কথাই মনে পড়ে,  আর সেই সব দৃশ্যের মধ্যেই আমি এই সমস্ত মাঠ , ক্ষেত , বাচড়া জমি ,এই সব হোগলা বনের ভেতরে সেই গাঁখানিকেই প্রত্যক্ষ করি এমন ভাবে , আর তখন যে হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা ; তার কোনো প্রকাশ কারোর সঙ্গেই করে উঠতে পারি না একটুখানি একান্তে । কারণ এরা কেউই বুঝবে না সেই হাহাকারের কথা জানি । শংকর বাংলাদেশের কোনো কিছুই ভালো চোখে দেখে না । সেই বিষয়ে তার সব সময়েই একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করে সে , যা সে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন প্রকাশও করেছে । আর সে জন্যেই তার সঙ্গে আমিও নিয়মিত যেতে চাইনা  ওদিকটায়  বেশি । দত্তভিলা বাড়িটার মোড় পেরিয়েই থেমে যাই ; বলি , থাক না , আজ না হয় এইখান থেকেই সান রে নিই , সূর্যদেবের উজ্জ্বলতা মাখি শরীরে । চল , আজ আর মাঠের ওদিকে যাবো না । বাড়ি পৌঁছে তাড়াতাড়ি গোরুগুলিকে জাবনা দিতি হবেনে আবার । জটা ভাই এসে যাবে যে …;

       শংকর কখনোই ওদের পরিবারের রোজকার কোনো কথাই বলতে চায় না । যদিও আমাদের বাড়ির সকল কথা জানায় তার আগ্রহ আছে । অর্থাৎ সেরকম কোনো অনীহাও নেই । আমিও তাই প্রথম প্রথম এইসব বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিতাম । কিন্তু তারপরে ঐ যা হয় , ধরেও রাখতে পারতাম না সব সময় । কখনো কখনো কিছু কিছু বলেও ফেলতাম । এই হয় সমস্যা , কারো কারো চরিত্রের এই গেঁয়োমি যেতে চায় না যেন ; ওদের বিষয়ে এই জটিলতার কারণটারও একটা সহজ সমাধান এই রকমের করে রেখেছি , আর সেটাকেই মনে হয় বলে থাকে সকলে নাগরিকতা ! এই সরল মনে নিজের কথা না বলতে পারাকে আমি মনে করি , নাগরিক গোপনীয়তা । যাক যা আছে তা ওদের মতোই থাক । ওদের এই সব অবগুন্ঠনকে নাড়িয়ে আমার কী হবে ! ওরা যেভাবে ওদের স্বাভাবিকতাকে আড়াল করছে তেমনই করুকগে । সে সব দিয়ে আমার কী হবে ? ওরা ওদের গোপনীয়তা নিয়ে থাকুক । অথচ অদ্ভুত একটা বিষয় , ওর মা বাবার সঙ্গে সামান্য যেটুকু আলাপ বা দেখা সাক্ষাৎ হয় , তাতে যা অনুভব করেছি কথাবার্তা বলার পরে , তার সঙ্গে শুধু মাত্র  ওর ধরণটাই মেলেনি। বরঞ্চ মনে হয়েছে তাঁরা অনেক বেশি ওর থেকে খোলামেলা । আর যেটুকু তাঁরা আড়াল করেও কথাবার্তা বলতে চায় , অর্থাৎ তাঁদের স্বভাবের স্বাভাবিক গতিতে যেটুকু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেখা দেয় , তার পেছনে মনে হয় যেন কোথাও একটা কিছুর নিষেধ মানার ব্যাপার আছে কারোর ; হয়তো শংকরেরই নিষেধ রয়েছে তাতে ! আমাকে এইসব সামলেই চলতে অভ্যস্ত হতে হয় , খানিকটা জোর করেই । কখনো কখনো বিরোধিতা করি না যে তা না , করিও । কিন্তু কী করবো ! এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে এসবে কীরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি …. বুঝতে পারি নাগরিক জীবনের গন্ডীর মধ্যে চলে এসেছি যে …. !

       বেশ কদিন থেমে থাকার পর আজ আবার শ্রীকান্তের তৃতীয় খন্ডটি শেষ করবো বলে বসেছিলাম দুপুরের পরের দিকে । যেখানে শ্রীকান্ত এবং রাজলক্ষ্মীর কথপোকথন চলছে ,তারপর  একটি জায়গা পড়তে যেয়ে একটুখানি থমকে গেছিলাম । সেখানে শ্রীকান্ত কী বলে বর্ণনা করছে তার জীবনের অনুভবকে সে কথাগুলি আজ এতবছর পেরিয়ে এসেও এখনো কেন জানি না ভুলতে পারিনি আজও ….. “ অনতিকাল পরে কাছে বসিয়া আজ সে আমাকে যাহা খাওয়াইতে বসিল তাহা রোগীর পথ্য । কর্ম-বাটির গুরুপাক বস্তুর সহিত তাহার সম্মন্ধ ছিল না ; বুঝা গেল , আমার আসার পরেই সে স্বহস্তে প্রস্তুত করিয়াছে । তথাপি আসা পর্যন্ত তাহার আচরণ , তাহার কথা কহার ধরণে এমনই কি একটা অনুভব করিতেছিলাম যাহা শুধুই অপরিচিত নয় , অত্যন্ত নুতন । ইহাই খাওয়ানোর সময়ে একেবারে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল । অথচ কিসে এবং কেমন করিয়া যে সুস্পষ্ট হইল , কেহ জিজ্ঞাসা করিলে আমি অস্পষ্ট করিয়াও বুঝাইতে পারিতাম না । হয়ত এই কথাটাই প্রত্যুত্তরে বলিতাম যে , মানুষের অত্যন্ত ব্যথার অনুভূতির প্রকাশ ভাষা বোধ হয় আজও আবিষ্কৃত হয় নাই । রাজলক্ষ্মী খাওয়াইতে বসিল , কিন্তু খাওয়া না-খাওয়া লইয়া তাহার আগেকার দিনের সেই অভ্যস্ত জবরদস্তি ছিল না । ছিল ব্যাকুল অনুনয় । জোর নয় , ভিক্ষা । বাহিরের চক্ষে তাহা ধরা পড়ে না , পড়ে শুধু মানুষের নিভৃত হৃদয়ের অপলক চোখ দুটির দৃষ্টিতে ” …

      এই পর্যন্ত পড়ে আমি যেন তারপর আরএকটি পাতাও উল্টাতে পারিছিনা । থমকে পড়লাম এমনই এক অজানার সন্ধানে । মনে পড়তে লাগলো কোন সেই পল্লীপ্রকৃতির কোলে এমনই একজনের কথা মনে হতে লাগলো কেবলই । চলে আসার আগের দিন যে মাতৃস্নেহে সে আমাকে খাইয়েছিল নিজে হাতে রান্না করে , পরিবেশন করার সময় তার মুখের দিকে চেয়ে আমি যা দেখেছিলাম , তার অর্থ তো কোনোদিন এর আগে করতে চাইনি , বা ইচ্ছাও করেনি ! আজ শরৎবাবু  তার শ্রীকান্তের মুখ দিয়ে এ কী কথা বলে দিলেন ? . …. “ মানুষের অত্যন্ত ব্যথার অনুভুতি প্রকাশ করিবার ভাষা বোধহয় আজওআবিষ্কৃত হয় নাই ।” …..


***********************************************

 আগামী পর্বে 

**********************************************