['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১৬
দীপংকর রায়

সত্যি সত্যিই সে যেন কিছু বলতে চেয়েও কেন যেন থেমে যাচ্ছে , হয়তো ভাবছে কিছু , ভাবছে হয়তো এতকাল পরে আজ প্রথম দিন দেখা হলো আর ওকে এত কথা বলে দিয়ে এখনি এতটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে বসবো ? হয়তো এই সব কথা দিদি শুনবে , পিসিমা এলে সেও জেনে যাবে , হয়ত সকলেই জেনে যাবে সব কিছু , আর সেটা কি ঠিক হবে ?
এমনই কিছু হয়ত সে ভাবছে। আর তাই বলতে গিয়েও বলতে পারছে না ।
নেভিকাট কেনার পয়সা আমি আর কোথায় পাই ! তাই তার দেওয়া এত দামি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকে বলি — ঠিক আছে , আজকে না হয় থাক ; আপনার ওহেনে যেদিন যাবানে সেদিনই না হয় শুনবানে । কিন্তু থায়েন কনে এহোনে ? সেডা আগে কন ?
সে বলে , সে না হয় যাসেনে , … কিন্তু খানিকটা না কতি পারলেও তো হয় না ; ধর , হয়তো এমনই হলো , আর তোরে কিছু কতিই পারলাম না ! হয়ত তেমন সুযোগটাই হয়ত আর মিললো না ; তাহলি কী হবেনে ? সেডাই ভাবতিছি —
এবারে থেমে গেলাম যেন ! সে এটা কি বলছে ? এমন কী হয়েছে যা সে বলতে চাইছে অথচ বলতে পারছে না ? সে এতটাই বা অনিশ্চিত হয়েই বা পড়ছে কেন ? নিজের মধ্যে নিজেই এতটা অনিশ্চয়তায় ভুগছেই বা কেন যে ; আর তার হয়ত আমাকে কিছুই বলা সম্ভব হবে না হয়ত এমন কথাই বা বলছে কেন অমন ভাবে !
তাকে যত দেখছি আজকে ততোই আমারও আশ্চর্য লাগছে । এ কি সেই কালিদাস মামা ! যে কিনা পিঁয়াজ রসুনের গন্ধও সহ্য করতে পারত না , আর আজ তাকেই কিনা দেখছি ধুমপান করতে ! আবার এমন সব কথা বলছেই বা কেন ? যে মানুষটি এতকালের সব স্মৃতি ভুলে, এমন ভাবে সব সম্পর্ককে ভুলে , নিজের ইচ্ছা মতো সংসার করেও একদিনের জন্যে হলেও আমাদের বাড়িমুখো হয়নি , যার এদেশে থেকে যাওয়ার প্রথম ঠিকানাটি পাওয়ার পেছনেও , কোনোরকম বিনিময় মূল্যও ছিলো না তো আমাদের সঙ্গে ! সেই মানুষটিকে এতদিন পরে পেলাম যখন তখন সে এসব কী বলছে এখন ? বলছে কিনা —- “শেষে যদি সময় আর না পাই ?”
সে কথা শুনে কার আর ভালো লাগে , সে যতোই দূরে থাক , তবুও একদিন তো খুব কাছেরই ছিলো — সে কথা ভুলি কী করে ?
ইতিমধ্যে তাঁদের একটি কন্যা সন্তানও হয়েছে জেনেছি । এতদিনে তার বয়সও হয়ত দু-তিন বছরেরই হবে হয়ত ; তাহলে , এমন কীই বা হলো , যা সে বলতে যেয়েও বলতে পারছে না ! এছাড়া আজ তার সঙ্গে আমার এই দেখা হওয়া টাও তো আচমকাই , তাহলে ? সে তো আর আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যে এখানে দাঁড়িয়েছিল এমনটাও তো হতে পারে না ! তাহলে ?
যদিও এর পরে একটুখানি ভূমিকা-সহ যা সে খানিকটা বললো, সে কথাগুলি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় । সে বললো , জানিস তো কথায় বলে না , গুরুজনের কথা মানতি হয় একটুখানি ; না মানলি , তার দশা এমনটাই হয়ে থাকে মনে হয় ।
বললাম , সে কথা কচ্ছেন ক্যান?
সে তাতে বলে , সব বিশ্বাস হারায়ে , সেই জন্যিই তো এই কথাডা কচ্ছি ।
— ঠিক বুঝতি পারলাম না ।
একটু পরিস্কার করে কন তো , কিডা আপনারে ঠগাচ্ছে ?
—- সিডাই তো কতি চাচ্ছি তোরে , বিয়ের পর থেকেই বুঝতি পারতিছি ; অথচ এতকাল ঠিক ধরতি পারিনি জানিস ! এহোনে বিষয়ডা পরিষ্কার টের পাচ্ছি জানিস; কিন্তু এহানে , এই পরিস্থিতিতে কী করি ? মেয়েটার দিকিও নজর দেয় না জানিস । তার রোজকার টিফিনের পয়সাটাও মাইরে খাওয়ায় তার পেয়ারের লোকরে , সে কথাটা কারে কোই ক তো ?
এই কথাটুকু শেষ করে সে আমার দুটি হাত খপ করে চেপে ধরে বলে , তোরা আমারে বাঁচা ; দিদিরে দেখা হলে কবো কবো করেও এতদিন কিছুই কতি পারিনি ! কী কবো তাঁরে ? কোন মুখিই বা তাঁর সামনে যাইয়ে দাঁড়াবো ? সে তো কতবার আকারে ইঙ্গিতে আমারে বারণ করিছিল ; আমি তো কারো কথাই শুনি নি । এহনে তো দেখতিছি , আমারেই না মাইরে ফ্যালে সে ।
তার দুটি হাত আস্তে করে আমার হাতের ভেতর থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে আমিও তাকে বললাম , ভাববেন না , আপনি এতটা ভাইঙ্গে পড়বেন না — তবে বিষয়টা সত্যিই সত্যিই খুব সঙ্কটের ; তবুও বলছি একেবারেই ভাইঙ্গে পড়বেন না । আচ্ছা , আমি কালকেই কয়েকজন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে করে নিয়ে আপনার ওখেনে যাচ্ছি । তবে আগে থেকে কারুরে কিছুই কবেন না যেন ; আমি যাবো এমন একটা ভাব নিয়ে , যেন হঠাৎ মনে পড়িছে তাই চলে গেছি । আমি কিছুই জানি না যেন ; হঠাৎ মনে হইছে তাই খোঁজখবর নিতি আইছি এমনই একটা ভাব দেখাবো , বুঝলেন । তারপর কথায়বার্তায় যা বুঝে নেবার , বা , যা বুঝিয়ে দেবার বুঝিয়ে দিয়ে আসবো ওদেরকে । জানবেন একটা কথাই শুধু , মনে রাখবেন এই কথাটাই , এখানে আপনি একা নন কখনোই ।
—- ঠিক আছে , তাহলে ঐ কথাই থাকলো তোর সঙ্গে । বিকেলের দিকে ঐ সময় আমি ঘরেতেই থাকি , কোচিং-এর ছেলেপেলেরাও থাকে দুই একজন হয়ত , তোরা আসিস ভালোই হবে তাহলে ।
—- ঠিক আছে , সেই কথাই থাকলো তালি ? তা , সম্পর্কটা কার সঙ্গে ? সে কি এলাকার কেউ ?
—- এলাকার কি কচ্ছিস তুই ? সে তো ঐ বাড়িরই বড় ছেলে ।
—-- বাবা , সে কী ! আপনি জেনেবুঝে সেখানেই রইছেন …? এটা আবার কী কচ্ছেন ! এসব আমি তো কিছুই বুঝতি পারতিছিনে ?
এবারে সে মুখটা একেবারে অন্ধকার করে বলে , সে কথা কি জানতাম আগে ? সেটা তো পরে হাতেনাতে ধরতি পারলাম । মারিছিও দুটোরেই একদিন । এর পর সে কি হাতে পায়ে ধরা ! বলে , সে নাকি ওর বন্ধু ছাড়া আর কিছুই না । এর পরে তাকে পড়াতে দেবার অনুরোধও করে । তাও দিছি , ও তো পড়ায়ও কোচিং-এ।
বলি , — সেটা আবার কী ?!
তাঁর কথা যত জানছি ততোই অবাক না হয়ে পারছি না । তাঁর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি — সত্যিই , এই মানুষটিকে নিয়ে যতোই ভাবছি , ততোই বিস্ময়ের শেষ থাকছে না আর । একি সেই মামা ? যে কিনা কোনো মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পেতো ! তাঁকেই কিনা দেখলাম শেষে প্রেম ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে , একেবারে বিয়ে করেই বসলো ভালোবেসেই ! এবং আজ আবার সেই প্রেমের পরিণতির কথা নিজেই বলতে বাধ্য হচ্ছে এমন করে ! যে কিনা একবেলাও গীতা-ভাগবত না পাঠ করে মুখে অন্নও তুলতো না ; এবং এ কথাও জানি , আজও বিয়ে থা করেও , এখনো সেগুলি নিয়ম করে করে চলেছে নাকি সে । এর আগেও দেখেছি তার ঠাকুর দেবতার উপর অগাধ বিশ্বাস । সেই মানুষটিকে আজ তার বিবাহিত জীবন নিজেই নির্বাচন করে , সকলের থেকে এরকম দূরে সরে থাকতে হলো কেন ?.... আর আজ এমন অবস্থা তাঁর সে নিজেই বলছে কিনা , “ আমাকে বাঁচা তোরা , … ওরা ভাবিছে , এখেনে আমার কেউ নেই । আমি একা । তাই যা খুশি তাই করতিছে । আর আমি নীরবে সেগুলো হজম করে যাচ্ছি ! কিছুই কতি পারবো না!... টাকা পয়সা সবকিছুই এর মধ্যি গোল্লাইতে পাঠাইছে । বুঝতি পারিনি তা আগে , এহোনে তো কোনোকিছুই ভাবতি পারতিছি নে । কেবলই ভাবতিছি , এর সমাধান আমি করবো কীভাবে ? ওহেন থেকে সরেই বা আসি কোন ভাবে ? যেহেনেই যাবানে সেহেনেই তো ঐ বদমাসটা উপস্থিত হবেনে । এমন একটা জায়গা খুজতিছি , যেহেনে গেলি , ও আর না যাইয়ে উপস্থিত হতি পারে অন্ততো…..”
বেশ খানিকটা আশ্চর্যই হচ্ছিলাম । ভাবছিলাম , সত্যি সত্যিই মানুষটা তো খুবই ঝামেলায় পড়েছে। কিন্তু একে কোন পথ দিয়ে , কেমন ভাবে , কাকে ধরা করা করে , এর একটা সমাধানের পথ বের করতি পারি , সেটাই ভাবতে লাগলাম ।
কতকাল পরে তাঁর সঙ্গে দেখা আমার ! আর আজকেই কিনা শুনতে হলো সেই মানুষটি ভালো নেই!.... মনে পড়তে লাগলো একাত্তরের দিনগুলির কথা… । কত কথা বিনিময় করেছি এই মানুষটির সঙ্গেই তো ! খুব বেশিদিন আগের তো কথা নয় সে সব !
যাক গে , এখন তো সেসব ভেবে লাভ নেই । এখন ভাবছি , কীভাবে , কোন পথে , এই মানুষটিকে এই সংকট থেকে খুব সহজভাবে বের করে আনা যায়, সেই কথাটিই । যা তার কথা শুনে মনে হলো , সে বেশ বড়সড় একটা ঝামেলাতেই আছে । কিন্তু কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারিই বা আমি ?
মামা চলে গেল দেখলাম ব্রীজ পেরিয়ে , নাকি , শান্তিনগরের পথে খেয়াল করতে পারিনি সেটাও । নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে গেছিলাম যেন ।
আজকে মামার সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে , যা তার বর্তমান পরিস্থিতি , তার যতটা পারা যায় সবটাই মাকে এবং বাড়ির সকলকেই জানালাম । ছোটো ভাই শুনে জিজ্ঞাসা করলো , মামা এখন থাকে কোন জায়গাটায় ঠিক বল তো?
বললাম যতটা শুনেছি সেটাই । সে তাতে বললো , প্রদীপ সংঘের কাছে তো ? ওঁ ,....চক্রবর্তীদের বাড়ি ওটা ।
বললাম , হ্যাঁ সুধীর চক্রবর্তী না কি বললো একটা নাম । ঠিক মনে নেই ।
সে তাতে বললো , ও আমার এক তুড়ির কাজ । যা দলবল আছে না ওখানে আমার , ওকে একেবারে বানিয়ে দিয়ে আসবো না , দেখিস । ও তুই ভাবিস না , যা তুই আগে দেখে আয় , তারপরে শুনেনি সবটা , দেখি , ব্যাটা কতো বড়ো মাস্তান হয়েছে ? এইসব জোর জবরদস্তি !
তাকে বুঝোবার চেষ্টা করলাম। বললাম , এসব তেমন নয় । ওভাবে কিছু করতি গেলি , হিতে বিপরীত হবেনে কিন্তু । এভাবে হুজ্জুতি করার বিষয় না এটা । প্রমাণ কী আছে কিছু ? যে তাঁকে তারা সকলে মিলে একেবারে টর্চার করতিছে ? শেষে উল্টো ঝামেলা বাইড়ে যাবেনে কলাম । তার চাইতে আগে দেখি বিষয়টা কি ?
কিন্তু সে যা হয় হবে পরে । কিন্তু একটা কথা ভাবতে যেয়ে সত্যিই আশ্চর্য হচ্ছি , এই যে মামা , আমাদের থেকে এতদিন এতটা দূরে রয়েছে , অথচ আজ তার বিপদের কথা শুনে ছোটো ভাইও কেমন করে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টাকে নিজের করে নিয়ে , এই যে সে যেমন করেই হোক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকলো , তাতে কি একবারও কেউ বুঝতে পারবে , সে যে আমাদের থেকে এতদিন এতটা দূরে সরে ছিল ? সে তো আদতে , বা সত্যি সত্যিই সে তো আমাদের প্রকৃতভাবে মায়ের আপন ভাই নয় !
যদিও এই হিসেবটা কোনোদিনই আমাদের মাথায় ছিল না । এঁরা কেউই সে অর্থে আমাদের আপন মামা নয় । চিরকাল এটাই ভেবে এসেছি যে এরাই আমাদের আপন মামা । তাই ভাইয়ের এই আবেগের মূল্য অনেকটাই আন্তরিক যে , এ কথা আমিও আজ আরো একবার ভাবতে বাধ্য হলাম ।
কিন্তু যা হয় , মানুষ যার যার আপন ছন্দ তালে এতটাই বিহ্বল হয়ে থাকে , যে কারণে তাকে অন্যের সমস্যা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতে হলেও, তা যেন বেশিক্ষণ মাথায় ধরে রাখতেও দেয় না । সেটাও তার নিজের নানা সমস্যার কারণগুলিই হয়ত । তাই ,এ ক্ষেত্রে আমারও সেটাই ঘটলো দেখলাম যেন ।
তবুও মনে মনে ভাবছি , মুহূর্তের ভাবাবেগের বসে সবকিছু যতটা সহজে ভাবা যায় , এরপর তাকে নিয়ে সময় সুযোগ করে , কতটা সেই স্পিটটাকে নিয়ে এগোনো সম্ভব হয় , সে কথাটিও যেন সবসময় ঠিকঠাক করে বলবার মতোন নয় ।
তাই , ঠিক করে তেমন মুহূর্ত আসতেও বেশ কিছুদিন সময় পেরিয়ে গেল ।
যদিও তারপরে সত্যি সত্যিই একদিন ফোচন শঙ্কর ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়েই হাজির হলাম মামার ওখানে ।
সেও আমাদের যাওয়াটাকে বেশ একটা নির্ভরতার বলেই মনে করলো যে , সে তার চোখ-মুখের দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা গেল ।
তবে তার স্ত্রীটিকে কেন জানিনা যতটা রুঢ় হবে বলে ভেবেছিলাম , তা তো নয় ! বেশ মিষ্টভাষী । সে একেবারে আপ্যায়নের চূড়ান্ত দেখিয়ে ছাড়লো । সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথা বুঝিয়ে দিতেই হয়তো চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো , এই না হলে ভাগ্নে বলে ? এতকাল পরে মনে পড়লো মামা-মামীর কথা আজকে ?
এসব না-বোঝার কোনো কারণ থাকে না । কেন সে এই কথাটি খানিকটা তির্যক ভঙ্গীমায় পরিবেশন করলো ; দুরকমের অর্থ করে যে সেটুকুও না-বোঝার নেই তো !
এরপর মামার ওখান থেকে চলে আসার আগে বা পরে , এমন কিছুই বুঝতে পারলাম না তো ! কোই তেমন কিছু একটুও বুঝলাম না কেন?
মামার মুখে শোনা কথার এমন কোনো সঠিকত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন চিহ্ন খাড়া হয়ে দাঁড়ালো যেন সামনে ; যা তাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যবহারিক আচরণের মধ্যে ধরা পড়লো না কেন আমাদের চোখে ? যেন সবটাই সাভাবিক যেমন আর দশটা বিশটা পরিবারে আত্মীয়স্বজন এলে স্বামী স্ত্রী যেমন আচরণ দেখায় , এও যেন তেমনটাই । অথচ সেই সম্পর্কের ভেতরে মামার বর্ণনায় যে ভয়ঙ্কর রূপের কথা শুনেছিলাম , সেটা কোথায় ?
যা দেখলাম , তাতে তাকে অতি সাধারণ বলেই তো মনে হলো ! সত্যি সত্যিই কি , সে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে কখনো ? সত্যি সত্যিই কি এই মানুষটি তার ঐটুকু মেয়ের মুখের খাবার , তাকে না দিয়ে , সে তার বর্তমান প্রেমিকের মুখে তুলে দিতে পারে ? হাজার হলেও সেও তো তারই সন্তান ! সেও তার মা !
তাকে তো দেখলাম , আরো সে তার স্বামী-সন্তানকে-যেন বিশেষ ভাবে আগলাচ্ছে ! তাহলে কি সেটাও তার নিখুঁত অভিনয় ?
কোনো কিছুই ধরতে পারলাম না । আরো দেখলাম সে বারবার করে বলতে লাগলো , ‘কেন এতদিন আমি আসিনি ।’.... সে ক্ষেত্রে দোষারোপ করতে থাকলো এই বলে, ‘....মামা-ভাগ্নের সম্পর্ক কি এভাবে থাকে কখনো ? এর আগে কত কথাই তো শুনেছি , এই ভাগ্নেকে নিয়ে মামার কাছে ! ’
আমাদের সকলেরই যেন সবটা গুলিয়ে যেতে লাগলো মামার মুখে শোনা কথার সঙ্গে তার স্ত্রীর এই সময়ের আচার আচরণের কথাবার্তার দিকে চেয়ে ; সে যেন এ ক্ষেত্রে আমরা চলে আসার পরে আপন মনে বলছে , ‘ দিলাম তো গুলিয়ে ? আমাকে চেনা কি এতটাই সহজ চাঁদু ? ’
এ ভাবনা যদিও নিতান্তই আমার । নাও হতে পারে তো এমনটা । হয়তো কালিদাস মামাকে নিতান্তই সন্দেহ বাতিকে পেয়ে বসেছে , তাই হয়তো সে এইসব নিয়ে এমন ভাবে ভাবছে সবটা ? যদিও সেটাও মেনে নিতে সত্যি সত্যিই পারি না । কারণ সেদিন তার চোখেমুখে যে আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছি , তা কি শুধুমাত্রই সন্দেহর বশে এমনটা একজন মানুষ তার স্ত্রীকে নিয়ে শুধু শুধুই ভাবতে পারে কখনও ? বিশ্বাস হয় না তেমন কিছু ও তো !
যাইহোক , এই মহিলার , এই অতি সাধারণ আচার আচরণের ভেতরে কোথাও তো এমন কিছুই মনে হলো না , যা দিয়ে তাকে এতটা নিষ্ঠুর ভাবতে পারে কেউই ।আবার , এই মানুষটি কি তার সন্তানের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে , তার বর্তমান প্রেমিকের মুখে তুলে দিতে পারে ? আরো সে তো দেখলাম মামাকে বিশেষভাবেই আগলাচ্ছে যেন ; আরো আমরা এতদিন কেন তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ , যাওয়া আসা করিনি কেন , সে কথাটাই তুলে ধরতে থাকলো বেশ খানিকটা আকার ইঙ্গিতে যে , সেটাই তো দেখলাম ! মামাকে এমনভাবে সমাদর করতে থাকলো , যা দেখে আমাদেরও ভাবতে বাধ্য করতে লাগলো , সে কতটা অনুগত । সে-ই তো দেখলাম তাড়াতাড়ি আগ বাড়িয়ে কাউকে দোকানে পাঠিয়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া মিষ্টি আনিয়ে আমাদের প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে আপ্যায়ন করতে লাগলো ! মামাকে হাত ধরে টানতে টানতে পেছনের ঘরে নিয়ে যেয়ে হয়তো জিজ্ঞাসাও করতে লাগলো , দেখো এইগুলি ঠিক আছে কিনা ?
এর পর আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে চা পান করতে করতে নানা গল্পগাছাও ফেঁদে নিতে চাইলো দেখলাম ! শুনতে বাদ রাখলো না , আমাদের বাড়িটা ইস্কুলের ঠিক কোন দিকটায় ? মামা কোনোদিন তাকে নিয়ে যায়নি যে , সে অভিযোগটাও করতেও ছাড়ল না । এবং বললোও , ঠিক আছে , নিয়ে যায়নি তো কি , আমিই না হয় একদিন চলে যাবো !
মামার ওখান থেকে যখন বাইরে এলাম তখন ফচন বললো , ঘরের পেছন দিক দিয়ে এসে যে ছেলেটি ঘরের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল , এই মালটাই কি সেই ছেলেটা ? একে তো এক ঠেলা মারলেই পড়ে যাবে রে ! দেখে তো মনে হলো একেবারে সাদামাটা , গোবেচারা ?
সত্যিই তো , আমরা যখন গেলাম , তার একটু পরেই তো একজন ঘরের ভেতর দিয়ে পেছন দিক থেকে এসে সামনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ! তাহলে সেই কি আমাদের আপ্যায়নের মিষ্টি, সিঙারা সব এনে দিলো ? হ্যাঁ , মামাকেও তো দেখলাম স্বাভাবিক কথাবার্তায় তাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো একটু আগেই ! এবং পরের দিকে আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সেও তো পেছনের বেঞ্চিটাতে এসে চুপচাপ শুনতে লাগলো সবকিছুই বেশ সাধারণ ভাবেই !
কই , তার আচার ব্যবহারে কোথাও তো এমন কোনো ভিলেনিও ইঙ্গিত লক্ষ করতে পারিনি তো ! যেন একেবারেই গোবেচারা । ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানে না ! তাহলে ফোচন কীভাবে বুঝতে পারলো , এই ছেলেটিই সেই ছেলেটি , যে কালীদাস মামার জীবনটা তছনছ করে দিতে চাইছে ?!
শঙ্কর বললো , অস্বাভাবিক কিছুই না ।
বললাম , দ্যাখ , মামার কথা যদি ঠিক হয় , তাহলে বলতে হবে সত্যি সত্যিই হয়তো সে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, যা আমরা এইটুকু সময় এসে ঠিক বুঝতে পারছি না, বা হয়তো তার স্ত্রী বুঝতেও দিল না আমাদেরকে একটিবারের জন্যেও , এরকম স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে । তাহলে ধরে নিতে হবে , এসব একটা নিখুঁত অভিনয় এই সবটাই ?
আসলে এখানেই তো কেরামতিটা । নিজের স্বভাবকে অন্যের কাছে ধরা পড়তে না দেওয়া। এখন কোনটা ঠিক , সে কথা আমরা একমুহুর্তের এইটুকু দেখায় , চট করে ধরতে পারবো না। তবে সত্যি হলে , সত্যিই খুব কঠিন ঝামেলা যে এসব , সেকথা বলতেই হবে ।
সে তাতে বললো , ঠিক আছে আমরা আর একদিন এসেই দেখি না কেন , তাহলে খানিকটা অন্তত ধরে তো ফেলা যেতে পারে ? তবে কয়েক দিন পরে । এখনি নয় । কালিদাস মামাকে বলবি , এর পরের দিন আমরা গেলে আমাদের যেন বেশি গুরুত্ব না দেয় ,অত যত্নটত্ন করেন না যেন উনি । একটু চালাকি করতে হবে বুঝলি ?.... ঠিক আছে , এখন চল , যাওয়া যাক । আমার সঙ্গে যদি ইতিমধ্যে দেখা হয় মামার , তাহলে যা বলে দেবার বলে দেবো ওনাকে । চল , এখন যেদিকে যাবো বলে এর আগে মনে করেছিলাম , এখন সেইদিকে চল দেখি ।
মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে এমন ভাবে শামুকের মতো গুটিয়ে যাই , তখন যেন নিজেকে নিয়েই বিভ্রাটে পড়ি ; যা কাউকেই বুঝিয়ে বলে উঠতে পারি না । কেন যে এমন অবস্থা হয় আমার ? আশেপাশে যারা থাকে , যাঁদের ঘিরে এই বাড়ির সংসার , যাদের যাদের ঘিরে সমস্ত আবহটায় প্রতিদিন আমিও হাতমুখ ধুই , পায়খানা পেচ্ছাপ করি , খাইদাই , স্নান করি , ঘুমাই , …. সকলেই তো আমার মতো এমন সব অভ্যাসের সঙ্গে এই তথাকথিত সভ্য সমাজে এইসব কৃয়াকলাপ করেই তো বাঁচে ? তাঁরা সকলেই যেন এই প্রবাহমান অভ্যাসের মধ্যে থেকেও কোনো বিশেষ অনুভবের সংস্পর্শে এসে আমাকে নিয়ে বেশ একটা ধন্ধেই পড়ে যায় , ভাবে....এইটা কি করছে ও ? এগুলি কি ওর মানসিক বিকৃতি ?
এর আগে আমার এইসব নানা ধরণের কাজবাজ নিয়ে কয়েকদিন দিদির বাড়িতে টের পেয়েছি কী সব কথাবার্তা বলাবলি চলছে ওদের সকলের মধ্যে যেন । সেখানে সকলেই রয়েছে ; সে মা দিদি অশোকদা আরো কেউ কেউও হয়তো হবে , কিন্তু শেষপর্যন্ত বিষয়টা বিশেষ বড় ধরণের গুরুত্ব পাইনি হয়তো । সেটাও যে কেন । তাও জানি না ঠিক মতো ।
এরপর পুরো পরিস্থিতি ঘুরেও দাঁড়িয়েছে । তাঁদের সকলের চোখে আমি আবার আগের মতো স্বাভাবিক ও হয়ে গেছি কখন যেন ! কিন্তু আমি আমার নিজের ভেতর এই সবের স্বাভাবিক সমাধান আজও ঠিক মতো পাইনি । সেসব সব একটার পর একটা এমনই ফাঁসে জড়িয়ে গেছে , শেষ পর্যন্ত সেসব আলগা হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছে ।
এমনই এক তাড়নায় আক্রান্ত হয়ে একদিন ওদেশ ছেড়েছিলাম কেন যে , সেকথা আমি ছাড়া আর কে জানে তার আসল কারণটা ? কিছুতেই যেন আজও সে আমার পিছু ছাড়তে চায় না ! খানিকটা যেন একঘেয়েমিতেই ধরা পড়া ? সেই সব ধরণের একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে থেকে একটা এমন অদ্ভুত আবেগপ্রবণতায় পেয়ে বসে কেন যে , সে কথা আর কাকে বলি ?
সেই যে তখন প্রায় প্রতিদিনই তখন বর্ডার পেরোনো মানুষজনের যাতায়াতের রোমাঞ্চিত করা গল্পের প্রভাব এমন ভাবে আমাকে ঘিরে ধরেছিল , যে বিষয়ের বিশেষ কারণটি আমি কাউকেই বুঝিয়ে বলে উঠতেই পারিনি কখনো । এমন কি , এমন যে অত্যন্ত কাছের মানুষ নতুন মামিমা , তাকেও বলতে পারিনি আমার সেই রোমাঞ্চিত হবার মূল কারণটা কী । কেনই বা তার জন্যে আমাকে চলে আসতে হলো । সেও কোনোদিন জানতে পারলো না সেই আসল রহস্যের কারণ । বেদনা জেগেছিল কল্যানীকে নিয়েও । সেই যে নৌকা থেকে নামিয়ে দিয়ে শেষ যেদিন ছিপ বড়শি হাতে করে , বৈঠা নিয়ে , নৌকাটিকে খুঁটিতে বেঁধে রাখার সময় তাকে যে দেখেছিলাম জুলজুল করে চেয়ে থাকতে আমার দিকে , ড্যাবড্যাব করে ; যেন সে টের পেয়েছিল এই হয়তো শেষবারের মতো আমার সঙ্গে তার মাছ ধরতে আসা । তবুও মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি সে । বলতে পারেনি এমন কথা : তোমার মনে পড়বে না তুমি যে এই সব ছেড়ে চলে যাচ্ছ যে ওদেশে ? কোথায় পাবে এমন নবগঙ্গাকে ? এই নৌকা ? কোথায় পাবে এমন জলশ্যাওলার গন্ধ মাখা এমন সব দিন ? যা তুমি এমন নিষ্ঠুর ভাবে ফেলে চলে যাচ্ছো ….?
যেন স্বাভাবিক এসব কিছুই । এমন একটা ভঙ্গিমা দেখিয়ে চলে এসেছিলাম । সে যেন কতবার বলতে চেয়েছিল , এমন একটা দিন কি কোনোদিন তোমার জীবনে আসবে না , যখন তোমার মনে হবে ফিরে যাই , ফিরে যাই আমি আমার সেই পল্লী জীবনে আবার ?
না , কোনোভাবে কেউ-ই প্রকাশ্যে এই সব অনুভবের একটি বর্ণও বিনিময় করেনি সেদিন ।
না , বলে আসা হয়নি সেইভাবে নতুন মামিমাকেও কিছু । অথচ সেই কাইলে মামার সঙ্গেই তো ঐ দেশ ছেড়ে আসতে হলো একদিন খুব ভোরে ভোর উঠে ।
সামান্য সেই আবেগ , সামান্য সেই মুগ্ধতাটুকুকে বুকের ভেতর পুষে , সেই যে নাওভাঙার মানুষজনগুলোকে যে সকাল বেলা হলে দ্রুত হেঁটে যেতে দেখতাম খেয়াঘাটমুখো হনহন করে….. আর সেই সব প্রতিদিন দেখেই না , কি এক আবেগে পেয়ে বসলো আমাকে , মনে হলো , এখনি , এখনি যদি ওদের সঙ্গে সঙ্গে এমন সকাল সকাল আমিও ওদেশে যাবার জন্যে এমন একটা দৃশ্য তৈরি করে রওনা হতে পারতাম ওদের মতো অমন ভাবে , তাহলে সেই সব পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে কত কিছুর না অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হতো আমারও ! সেই আবেশটুকু শরীর মনে লাগিয়ে , আবার না হয় একদিন ফিরে আসতাম এদেশে ।
শুধুই নিজের সেই আবেগটুকুকেই গুরুত্ব দিলাম ? অথচ অন্য কারো কথা একবারের জন্যেও ভাবলাম না ?
আমার এই ক্ষণকালীন একটা সিদ্ধান্ত , কীভাবে সামান্য একটুখানি অনুভবের ঘাড়ের উপর চড়ে , এমন ভাবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে চলে আসতে পারলো ? এবং সত্যি সত্যিই সেটা কি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ? এর জন্যে একদিন না মস্ত বড় খেসারত দিতে হয় । এবং সত্যি সত্যি সে কথা কি ভেবেছিলাম একবারও ? একটিবারের জন্যে হলেও পিছনে ফিরে দেখেছিলাম কি? একটিবারের জন্যেও কারো বিষণ্ণ মুখটির জন্যে তাকিয়ে দেখেছিলাম কি , না ভেবেছিলাম ? আচ্ছা একবারও কি মনে হয়নি , এরা আমাকে ঘিরে কীভাবে এতগুলি দিন , এমন কত অভ্যাসের ভেতরে , নিজেদের স্নেহ ভালোবাসা রাগ অভিমান সব কিছু ঢেলে দিয়ে সেই যে আবৃত করে রেখেছিলো , তার কি কোনো মূল্যই সেদিন আমার কাছে ধরা পড়েনি ?
যদি ধরা নাই পড়ে থাকে, তাহলে
আজ কেন সে সব এমন ভাবে মনে পড়াচ্ছে ? আর যখনই মনে পড়ছে , তখনই ভেতরটা কিরকম দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক কেবলই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে চাইছে ; কেন এমনটা হচ্ছে ? এখন আমি কোন পথে ঘুরে বেড়াই একা একা ?
সকালের প্রথম সূর্যকিরণ চোখেমুখে মাখতে যেয়ে যে পথটা প্রায়দিনই শংকর ওদের সঙ্গে হাঁটি সেই মাঠের দিকের পথ , হোগলা বন, রাণিয়ার তার , বাগদি পাড়ার সকাল , তারও ওপাশে বাচড়া ভর্তি জলাজমি , আবার কোথাও ধানগাছ বোঝাই বা তরিতরকারির ক্ষেতে পরিচর্যা করছে যে চাষি , তাদের সকলের সব কাজের আয়োজন দূর থেকে দেখে কেন যে ভেতরটা হু হু করে ওঠে ! কত কিছুই না মনে পড়ে…. সে সব ঋতুর এক একটি অধ্যায়কে ওদেশের মতো করে ,বা সে সব ভাবতে গেলেই বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই গ্রামখানিরই কথা ….. সেই — নবগঙ্গার কুয়াশামাখা ভোরের রূপটি, কেবলই যেন মনে হয় ঐ তো লঞ্চ চলে আসছে জল কেটে কেটে তীরের মতো হু হু করে…. মাস্তুলটি সামনে ভাসিয়ে,.... কেবলই যেন পাল তোলা টাবুরের ভেসে যাওয়া সারিবদ্ধ ছবির মতো সেইসব দৃশ্যের কথাই মনে পড়ে, আর সেই সব দৃশ্যের মধ্যেই আমি এই সমস্ত মাঠ , ক্ষেত , বাচড়া জমি ,এই সব হোগলা বনের ভেতরে সেই গাঁখানিকেই প্রত্যক্ষ করি এমন ভাবে , আর তখন যে হু হু করে ওঠে বুকের ভেতরটা ; তার কোনো প্রকাশ কারোর সঙ্গেই করে উঠতে পারি না একটুখানি একান্তে । কারণ এরা কেউই বুঝবে না সেই হাহাকারের কথা জানি । শংকর বাংলাদেশের কোনো কিছুই ভালো চোখে দেখে না । সেই বিষয়ে তার সব সময়েই একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করে সে , যা সে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন প্রকাশও করেছে । আর সে জন্যেই তার সঙ্গে আমিও নিয়মিত যেতে চাইনা ওদিকটায় বেশি । দত্তভিলা বাড়িটার মোড় পেরিয়েই থেমে যাই ; বলি , থাক না , আজ না হয় এইখান থেকেই সান রে নিই , সূর্যদেবের উজ্জ্বলতা মাখি শরীরে । চল , আজ আর মাঠের ওদিকে যাবো না । বাড়ি পৌঁছে তাড়াতাড়ি গোরুগুলিকে জাবনা দিতি হবেনে আবার । জটা ভাই এসে যাবে যে …;
শংকর কখনোই ওদের পরিবারের রোজকার কোনো কথাই বলতে চায় না । যদিও আমাদের বাড়ির সকল কথা জানায় তার আগ্রহ আছে । অর্থাৎ সেরকম কোনো অনীহাও নেই । আমিও তাই প্রথম প্রথম এইসব বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিতাম । কিন্তু তারপরে ঐ যা হয় , ধরেও রাখতে পারতাম না সব সময় । কখনো কখনো কিছু কিছু বলেও ফেলতাম । এই হয় সমস্যা , কারো কারো চরিত্রের এই গেঁয়োমি যেতে চায় না যেন ; ওদের বিষয়ে এই জটিলতার কারণটারও একটা সহজ সমাধান এই রকমের করে রেখেছি , আর সেটাকেই মনে হয় বলে থাকে সকলে নাগরিকতা ! এই সরল মনে নিজের কথা না বলতে পারাকে আমি মনে করি , নাগরিক গোপনীয়তা । যাক যা আছে তা ওদের মতোই থাক । ওদের এই সব অবগুন্ঠনকে নাড়িয়ে আমার কী হবে ! ওরা যেভাবে ওদের স্বাভাবিকতাকে আড়াল করছে তেমনই করুকগে । সে সব দিয়ে আমার কী হবে ? ওরা ওদের গোপনীয়তা নিয়ে থাকুক । অথচ অদ্ভুত একটা বিষয় , ওর মা বাবার সঙ্গে সামান্য যেটুকু আলাপ বা দেখা সাক্ষাৎ হয় , তাতে যা অনুভব করেছি কথাবার্তা বলার পরে , তার সঙ্গে শুধু মাত্র ওর ধরণটাই মেলেনি। বরঞ্চ মনে হয়েছে তাঁরা অনেক বেশি ওর থেকে খোলামেলা । আর যেটুকু তাঁরা আড়াল করেও কথাবার্তা বলতে চায় , অর্থাৎ তাঁদের স্বভাবের স্বাভাবিক গতিতে যেটুকু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেখা দেয় , তার পেছনে মনে হয় যেন কোথাও একটা কিছুর নিষেধ মানার ব্যাপার আছে কারোর ; হয়তো শংকরেরই নিষেধ রয়েছে তাতে ! আমাকে এইসব সামলেই চলতে অভ্যস্ত হতে হয় , খানিকটা জোর করেই । কখনো কখনো বিরোধিতা করি না যে তা না , করিও । কিন্তু কী করবো ! এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে এসবে কীরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি …. বুঝতে পারি নাগরিক জীবনের গন্ডীর মধ্যে চলে এসেছি যে …. !
বেশ কদিন থেমে থাকার পর আজ আবার শ্রীকান্তের তৃতীয় খন্ডটি শেষ করবো বলে বসেছিলাম দুপুরের পরের দিকে । যেখানে শ্রীকান্ত এবং রাজলক্ষ্মীর কথপোকথন চলছে ,তারপর একটি জায়গা পড়তে যেয়ে একটুখানি থমকে গেছিলাম । সেখানে শ্রীকান্ত কী বলে বর্ণনা করছে তার জীবনের অনুভবকে সে কথাগুলি আজ এতবছর পেরিয়ে এসেও এখনো কেন জানি না ভুলতে পারিনি আজও ….. “ অনতিকাল পরে কাছে বসিয়া আজ সে আমাকে যাহা খাওয়াইতে বসিল তাহা রোগীর পথ্য । কর্ম-বাটির গুরুপাক বস্তুর সহিত তাহার সম্মন্ধ ছিল না ; বুঝা গেল , আমার আসার পরেই সে স্বহস্তে প্রস্তুত করিয়াছে । তথাপি আসা পর্যন্ত তাহার আচরণ , তাহার কথা কহার ধরণে এমনই কি একটা অনুভব করিতেছিলাম যাহা শুধুই অপরিচিত নয় , অত্যন্ত নুতন । ইহাই খাওয়ানোর সময়ে একেবারে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল । অথচ কিসে এবং কেমন করিয়া যে সুস্পষ্ট হইল , কেহ জিজ্ঞাসা করিলে আমি অস্পষ্ট করিয়াও বুঝাইতে পারিতাম না । হয়ত এই কথাটাই প্রত্যুত্তরে বলিতাম যে , মানুষের অত্যন্ত ব্যথার অনুভূতির প্রকাশ ভাষা বোধ হয় আজও আবিষ্কৃত হয় নাই । রাজলক্ষ্মী খাওয়াইতে বসিল , কিন্তু খাওয়া না-খাওয়া লইয়া তাহার আগেকার দিনের সেই অভ্যস্ত জবরদস্তি ছিল না । ছিল ব্যাকুল অনুনয় । জোর নয় , ভিক্ষা । বাহিরের চক্ষে তাহা ধরা পড়ে না , পড়ে শুধু মানুষের নিভৃত হৃদয়ের অপলক চোখ দুটির দৃষ্টিতে ” …
এই পর্যন্ত পড়ে আমি যেন তারপর আরএকটি পাতাও উল্টাতে পারিছিনা । থমকে পড়লাম এমনই এক অজানার সন্ধানে । মনে পড়তে লাগলো কোন সেই পল্লীপ্রকৃতির কোলে এমনই একজনের কথা মনে হতে লাগলো কেবলই । চলে আসার আগের দিন যে মাতৃস্নেহে সে আমাকে খাইয়েছিল নিজে হাতে রান্না করে , পরিবেশন করার সময় তার মুখের দিকে চেয়ে আমি যা দেখেছিলাম , তার অর্থ তো কোনোদিন এর আগে করতে চাইনি , বা ইচ্ছাও করেনি ! আজ শরৎবাবু তার শ্রীকান্তের মুখ দিয়ে এ কী কথা বলে দিলেন ? . …. “ মানুষের অত্যন্ত ব্যথার অনুভুতি প্রকাশ করিবার ভাষা বোধহয় আজওআবিষ্কৃত হয় নাই ।” …..
***********************************************
আগামী পর্বে
**********************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন