ফাঁদ
যুগল কিশোর দাস অধিকারী
বেচুদা গুম মেরে পার্কের এক কোণে বেঞ্চিতে বসে থাকে। পাশে একটা নেড়ি কুত্তা শুয়ে আছে। উনি একবার ওকে দেখে তো কুত্তাতাও ওনাকে দেখে। দুজনের মধ্যে কিছু কথা না বলেও যেন কিছু ভাবের লেনদেন হয়।দুজনের কোথাও হয়তো মিল আছে।
মনের মধ্যে গুমট ভাব , মেঘ করেছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। মনের মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি। কিছু একটা কোন গোপন জায়গায় আঘাত করছে।তার পার্কের সঙ্গী ছড়িবাবু অনেক দিনের আলাপ। উনি জানেন যে ওনাকে একবার খোঁচা দিলেই বলতে আরম্ভ করবে, আরম্ভ করলে আর থামতে চায় না। খেজুর গাছে ঝোলান কলসিতে ঢিল মারলে যেমন হয়। পুরো রস গলগল না বেরোনো পর্যন্ত খান্ত হবে না।
তো ছড়ি বাবু ইচ্ছে করেই বেচুদাকে খোঁচা দিয়ে বললো । কি দাদা আজ বড় চুপ চাপ বাড়িতে কোন কেস খেয়েছেন নাকি?
বেচুবাবু পাত্তা না দিয়ে কানে পায়রার পালক দিয়ে চুলকোতে লাগলো, কিছু লোক আছে পারের বাড়িতে উঁকি মারতে ভালো বাসে। পরচর্চা ভীষণ মুখোরোচক। তাই বেচুদা কেমন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
ছড়িবাবু আর একটু খোঁচা দিয়ে বলল কানের চুলকানি টা বেশ বেড়েছে নাকি?
আরে দুরসালা তোদের জ্বালায় শান্তিতে দুদণ্ড পার্কে ও বসতে পারবো না।
শুধু লোকের বাড়ির হেঁসেলে উঁকি মারা অভ্যেস। তোকে বললে তুই কি বুঝবি? না কোন সুরাহা করতে পারবি?
না দাদা তবু মনের কথা কাউকে খুলে বললে মনের ভার খানিকটা হালকা হয়। আমার ও কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। দুঃখ ভাগ করলে অনেকটা ভার কমে যায়। এই । তুমি যদি বন্ধুর মত ভাব তাহলে বলতে পার ।
ঠিক আছে, তবে ধৈর্য ধরে শুনতে পারবি তো?
তা পারবো। আপনার কথা শুনতে বেশ লাগে, সময়টাও কেটে যায়।
তবে শুনতে থাক। মাঝ পথে পালাবি না।
দেখ খন্ড খন্ড ইট দিয়ে বহুতলের যেমন ভিত হয়। জীবনটাও তেমনি। সময়, সংগ্রামের ইট দিয়ে ধাপে ধাপে তৈরি পোড় খাওয়া ইমারত। আমা ইট থাকলে নোনা ধরে খসে পড়ে পলেস্তরা। বহু জোড়াতাপ্পি দিয়ে ও তাকে পূর্বঅবস্থায় ফিরানো প্রায় দায় । হাল ছেড়ে দিই। জীবনের সব হিসেব নিকেষ মেলে না। ঠিক তো?
ছড়ি মাথা নেড়ে সায় দেয় তা ঠিক বটে।
আবার শুরু।
দেখবি জীবনের শেষে ব্যালেন্সশিট এ সম্পদের চেয়ে দায় বেশি।
অবহেলা, স্বেচ্ছাচারিতার খরস্রোত, স্বার্থপরতার দুর্দমনীয় উচ্চাভিলাষ শান্তির পারদ ক্রমশ নিম্নগামী হয়। হৃদয়ের লেনদেন, বাক্য বিনিময় যৎসামান্য, একছাদে থাকলে যা টুকু না হলে নয়! লোক দেখন হাসিমুখ নিয়ে কত ভালবাসির অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়। এ যেন উইন্ডো ড্রেসিং অফ বালান্সশীট।
ও দিকে অন্তরের আগ্নেয়গিরির তরল লাভা যেন বাইরে বেরুতে না পেরে গুমরে গুমরে মরে।
উত্তাল হয়। বাইরের কেউ তার আঁচ পায় না। তখন সেই যন্ত্রনা ভোলার জন্য বাইরের তরল আগুন গলায় ঢেলে ভিতরের আগ্নেয়গিরিকে শীতল করতে হয় । ঠিক তখন লেগে যায় মাতাল তকমা।
এই দ্বিচারিতা, অভিনয়, বিপন্নতার হাত থেকে মুক্তি পেতে খোলা থাকে একটাই পথ তা কি ? তা হল মৃত্যু!
ছড়ি বাবু মাথা চুকোচ্ছে। হাবার মতো তাকিয়ে কাঁচু মাচু হয়ে বলল দাদা - আজ কথাগুলো কেমন যেন ভারি ভারি ঠেকছে , ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
ওই জন্যই বলেছিলাম শুনতে পারবি তো।
ঠিক আছে আবার শুরু করুন ।
যন্ত্রনা দগ্ধ জীবন জীবন থেকে মুক্তি পেতে একটা রাস্তা খোলা থাকে যা হলো আত্মহত্যা কিন্তু তা ও সহজলভ্য নয়। আত্মহত্যা করলে উৎসুক চোখ কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করবে, কি জন্য আত্মহত্যা কে দায়ী কি কারন আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কি জ্বালা। মরে ও শান্তি নেই।
আর তুমি যদি বিশিষ্ট হও সে জ্বালা আরো বড়।
সাধারন হলে লোকে বলে এলেবেলে। কোন এলেম নেই। কি ই বা করেছে জীবনে? সালা অকর্মার ঢেঁকি।তাই মধ্য পন্থাই শ্রেয়। না উপর না নীচ। বিশিষ্টরা বিচ্ছিন্নতার গভীরে নেমে সুড়ঙ্গএ হারিয়ে পথ গুলিয়ে ফেলে - কখনো আলো কখনো চরম অন্ধকারে ডুবে যায়। সেখান থেকে ফিরবে কি ফিরবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।তাই ভয়। অবিরত মানসিক ক্ষয়। ভয় থেকে নিশ্চিত পরাজয়।
জীবনে যখন জোয়ার- অনেক দেয়, ভাটার টানে সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। পড়ে থাকে কাদামাটি, বিবস্ত্র উলঙ্গ বেলাভূমি, কেউ তাতে সৌন্দর্য খুঁজে পায়, কেউ দেখে আবর্জনা, পায়ে পায়ে হাজার মানুষ হেঁটে যায় বুকে তার চিহ্ন ফেলে যায়। শত আবর্জনা বুকে নিয়েও সে থাকে নীরব, নিশ্চল। মরুভূমি দেখেছিস কোনদিন?
না তার সৌভাগ্য হয়নি।
মরুভূমিতে খুব তেষ্টা পায়, অভিযাত্রী জলের আশায় মরীচিকার পিছনে ছোটে । কিন্তু জল পায় না। ক্লান্ত হয় ।উদ্যম উৎসাহ ক্রমশ হ্রাস পায়।শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
ব্ল্যাকহোলের নাম শুনেছিস।
হুম শুনেছি কিন্তু স্পষ্ট ধারনা নেই ওই ভাসা ভাসা ।
কৃষ্ণ গহ্বরে সব আলো পথ হারিয়ে ফেলে, মাধ্যাকর্ষণ ও নিষ্ক্রিয় প্রায়।
বারমুডা ট্রা়াঙ্গেলের ট্র্যাপে পড়লে সব শক্তি নিষ্ক্রিয়, কোন যুক্তি কাজ করে না ,তখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়।
ছড়িবাবু বললো দাদা মগজের গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিই হাঁপিয়ে গেছি।
দে আমাকে ও একটা খাঁকি ছাড়।
আবার শুরু।
ফিরে যাই পরিবারে। এই পরিবার হল প্রাচীন সংস্থা এখন প্রাগৈতিহাসিক। মিউজিয়ামে রাখাই শ্রেয়। ডারুইনবাদ এর উপর প্রভাব ফেলে ক্রম বিবর্তনে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পরিণত, পরিমাপে ও মননে।
পাথর ভাঙতে ভাঙতে যেমন ক্ষুদ্র বালুকনায় রূপান্তরিত হয়। দায়িত্ব, অস্তিত্ব, হৃদয়বত্তা, সহমর্মিতা, মায় হাসিঠাট্টা সব কিছুর ক্ষয়। মানবতার পরাজয়। বড় যান্ত্রিক - কেঠো।
সবেতেই ঠুনকো প্রত্যাঘাতের জন্য সর্বদা খড়্গহস্ত। বিচারের সূক্ষ্মতা নেই। পদে পদে অপরের দোষ খুঁজে।সুতীক্ষ্ণ কথার বাল্লমে পরস্পরকে বিদ্ধ করে । কেউ ছোট হতে চায় না। সবাই সবেতেই জিততে চায় -যে কোন কৌশলে। কিন্তু যুদ্ধে তো একপক্ষ হারে! অভিমন্যুর মতো মৃত্যু। আঘাতে আঘাতে দীর্ণ হতে হতে হৃদয় বস্তুটা নরম থেকে কঠিনে পরিণত হয়। সুকুমার বৃত্তি হারায়। মানুষ তার দুঃখ, যন্ত্রণা গুলোকে লুকিয়ে রাখার কুলুঙ্গি তৈরী করে, অবদমনের কৌশল রপ্ত করে।
তুই উজান মাছ ধরা দেখেছিস? দু ধার দিয়ে অল্প অল্প জল ছাড়া হয় মাঝে গোলাকার গর্ত করা থাকে , মাছ যেই জল বেয়ে উপরে ওঠে অমনি ওই গর্তে পড়ে।
যে ফাঁদ পেতে ছিল সে ট্প করে ধরে হাঁড়িতে পুরে নেয়। কি বোকা না মাছগুলো!!!
আর না । কার যেন একটা লেখা ভীষণ মনে পড়ছে এটা শুনিয়ে শেষ করি...........
তাহাদের দুঃখ গুলি মিশে যায় আকাশগঙ্গায়,
সোনারোদ ফুরালে চুপি চুপি অন্ধকার আসে ,
সংবেদন সোদাগন্ধ ভেসে আসে শিশিরের ঘাসে ,
ক্ষুদ্র নিয়ে খুশী থাকি, উপেক্ষিত বৃহতের ভাঁড়ে,
জাগ্রত সুসুপ্তি - সাদা থানে আজ ঢাকা পড়ে,
বেদনা স্পটিক অনায়াসে মিশে যায় সন্ধ্যাতারায়,
এ বিশ্ব অনন্ত রহস্যে ঢাকা বড় মায়াময়।
অতি দুঃখে ও আঁখিতে আসে না আর জল,
অতি আবেগে ও কণ্ঠে আসে না সুর
সব কিছু দিয়ে - আমি কি হয়েছি ফতুর?
আমাদের বিস্বাদ গুলো অভিনয় হাসি দিয়ে ঢাকা,
জীবনের প্রতিপদে ঠোক্কর খেয়ে, হয়েছি যে অভিনেতা পাকা।
তারা জানে ভালো করে যত কর ধানাই পানাই,
যত পাক অবহেলা পালাবার উপায় তো নেই।
এইখানে পাতা আছে কৌশলী ফাঁদ,
পালাবার বৃথা খোঁজ পথ,
এখানেই জীবনাবসান।
*********************************************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন