রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

গল্প * প্রদীপ কুমার দে

 



আদ্যাপাঠের মাহাত্ম্য

প্রদীপ কুমার দে


দরদর করে ঘামছি, মাথা থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম শরীর বেয়ে মেঝেতে টপাটপ করে ঝরে পড়ছে, অবশ্যই যদিও এখন গরম কাল। অফিস থেকে সবে বাড়িতে ঢুকেছি আর মোবাইলে খবর বেজে উঠলো, বাজনা থামিয়ে কলটা একসেপ্ট করতেই ওপর প্রান্ত থেকে প্রোজেক্ট অপারেটর ওমবাবুর ভারী গলা ভেসে এল,
--  বিপদ হয়ে গেছে স্যার, লোকটা মারা গেছে, হলের মধ্যেই ......

জামাপ্যান্ট ছাড়িনি। ভয়ে হাত পা ভিতরে। কুলকুল করে ঘামছি। এ আমি কি করলাম? সব দায়িত্ব যে আমার, আমি না ম্যানেজার? কারোর বারণ তখন শুনলাম না। সব্বাইতো মানা করেছিলো? এবার কি হবে? কি করে নিজেকে বাঁচাবো?

ভয়ে ইষ্টকে স্মরণ করা ছাড়া আর অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না। তাই করলাম, পরিস্থিতি প্রতিকূল যে ....

মনমরা হয়ে গেছি। বাড়ির সকলেই বুঝে গেছে যে কোন কারণে আমি বিপদগ্রস্থ। দুশ্চিন্তার ছাপ যে স্পষ্ট প্রকাশমান আমার চোখেমুখে, অভিব্যক্তিতে।
ওরা জানার জন্য অধীর, ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি হয়তো সবটা বলে হালকা হতেই চাইছি এবং বলতেই হবে, আর তখনই চমকে দিয়ে আবার মোবাইলাটা বেজে উঠলো, স্থানীয় একটি থানার ওসির ফোন, কন্ট্যাক্ট সেভ নম্বর সহ।

অপর প্রান্তের ওসির জাঁদরেল গলায় খোস মেজাজী সুর,
--  দাদা,  বাড়ি ফিরেছেনতো? সব শুনেছেন নিশ্চয়ই। টেনশন নেবেন না,চিন্তার কিছু নেই। সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমরাতো আছিই। কাল হলে আসুন, আমরা যাবো সব জানিয়ে দেবো। ডোন্ট ওরি, বি হ্যাপি, গুডনাইট।

আচমকা ফোন কেটে দিল। আমি আশ্বস্ত হয়েও হলাম না, ক্ষিপ্র গতিতে হলের ল্যান্ডলাইনের ফোনে কল লাগালাম। প্রথমবার বেজে গেল। কেই রিসিভ করলো না। রাত বারোটা বেজে গেছে। কি করি?
দ্বিতীয়বার করলাম। এক লাইটম্যান ধরলো,
--  হ্যাঁ স্যার, থানা থেকে বডি নিয়ে গেছে। ঝামেলা কিছু নেই। সব শান্ত! কাল আপনি আসলে ওরা আসবে, বলে গেছে ভয়ের কিছু নেই। .....

কিছুটা আশ্বস্ত হলেও অশান্তিতেই রইলাম। ভয় ক্রমাগতই যেন গ্রাস করে নিতে চাইছে। যতোই পাওয়া দুটি ফোনে আশ্বস্তের কথা ভাবি আর নিজেকে হালকা করে সাময়িক চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছে করি, ততোই কে যেন টেনে সেই ভয়ের সাগরেই আমাকে নিমর্জিত করে। ভাবলাম ঝামেলা একটা হবেই। থানার ব্যাপারস্যাপার আমার কাছে বেশ ঝামেলার। সেই কথায় আছে না,
' বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা '

যদিও এক্ষেত্রে এক‌টি কথা বলে রাখি নামীদামী সিনেমাহলে পুলিশের বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়। মনে রাখবেন সিনেমা হলের মালিকেরা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী এবং শিক্ষিত হন যেটা আমরা অনেকেই জানি না। তাই তাদেরকেও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম মেনে অনেক সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হয়। স্থানীয় থানার সঙ্গে সব বিষয়ে পূর্বালোচনা করে এগোতে হয়। সম্পর্ক গভীর আর মধুর হয়ে যায়। একই পরিবারের মতো, বিপদে ত্রাতার ভূমিকা নেয় থানা - পুলিশ। আর এই কাজটির মাধ্যম হন সেই হলের ম্যানেজাররাই। মালিকদের আর থানার ওসিদের মধ্যে সেতুর ভূমিকা নেয় এই ম্যানেজার। সর্বস্থানের কথা জানি না কিন্তু আমাদের মূল শহরের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাই চলে। থানায় ম্যানেজারের ফোননম্বর সেভ থাকে প্রাধান্যতায়। নিত্যদিন টিকিট কাটা, ব্ল্যাকারদের ঝামেলা, মারামারি, গুন্ডামি, মাতলামি এইসব ছাড়াও অনেক অনেক ঝামেলা লেগেই থাকে। নতুন বই এলে এবং বই হিট করলেতো আর কথাই নেই। আমি সেই সময়কার কথাই বলছি যখন আমাদের কাছে সিনেমার জগৎ একমাত্রই এন্টারটেইনমেন্টের প্রধান এবং অবশ্যম্ভাবী বিষয় ছিল। আর সিনেমাহলটি যদি নামী এবং শহরের মূলকেন্দ্রে অবস্থিত হয়। আমি এরকমই একটি  বিখ্যাত হলের কথাই বলছি।

বিধ্বস্ত অবস্থায় আমি, পরিবার উৎকণ্ঠায়, সবাই সব কাজ ভুলে আমায় ঘিরে ধরলো, সত্যিই এবার সব জানাতেই হবে .....
ঘটনাটি বলতে শুরু করে দিলাম।

আজ হঠাৎই বিকালের শেষ দিকে ফোন পেয়ে আমার সিনিয়র জয়েন্ট ম্যানেজার প্রানদা আমাকে জানালো,
--  বিপদ হয়ে গেছে বুঝলে, বাড়িতে কাকিমা পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে, আমাকে এখনই চলে যেতে হবে...

--  সে কি?

--  হ্যাঁ। তুমি সামলে নাও আজ নাইটশোটা প্লীজ,

--  সে নাহোক হল, কিন্তু?

--  কিন্তু তোমার মুখে আজ আর আদ্যাপাঠ শোনা হল না।

এখানে প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ওনার সাথে আমার এক মধুর সম্পর্ক ছিল। আমরা একই গুরুর শিষ্য।  আমি যা করি ওনার চোখে তাই ভাল। ওনাকে প্রায়ই আমার ফেরার আগে আদ্যাপাঠ করে আসতে হত। আমি বারোটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সামালাই। উনি দুপুর তিনটে থেকে রাত দশটা সামলান।  ক্যাশের হিসাব আমাকেই নিতে হয় কারণ উনি ক্যাশ গুনতে পারেন না। প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার লেনদেন হয়। হলে স্পেশাল লকার আর ব্যাংকের সাথে স্পেশাল ব্যবস্থা করা ছিল সব নিঁখুতভাবেই সাজানো, কোন অসুবিধার বা বিপদের আশংকা বহির্ভূত। তবে এখানে সে বিষয় অপ্রাসঙ্গিক বটেই।

উনি চলে গেলেন। টিকিটকাউন্টারে বলে দিলাম,
রাতের শোর টিকিট রাত নটা দশে বন্ধ করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ যেন চটজলদি আমার ক্যাশ চেম্বারে নিয়ে আসে। ওরা আমায় ভালোবাসে, ওদের অনেকেই আবার হলের কোয়ার্টারেই থাকে। 

যথারীতি খুব তাড়াতাড়ি ওরা টাকা দিয়ে গেল। আমি গুনে বান্ডিল করে ব্যাংকের দেওয়া ট্যাগ লাগাচ্ছি, স্টেপল করছি, এমন সময়ে নীচের তলায় খুব চিৎকার হচ্ছে কানে এল। আমি অগ্রাহ্য করে নিজের কাজ সারতেই ব্যস্ত, বাড়ি ফিরতে হবে যে ...

কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে একজন সিকিউরিটি গার্ড দৌড়ে এল,
--  স্যার, আপনাকে একবার নীচে যেতে হবে। একটা লোক খুব ঝামেলা করছে।

-- আচ্ছা, তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।

আমি গুপ্তধনের অন্দরে ঢুকে সব গুছিয়ে আমার বসার তিন তিনটি বসার যায়গা একেবারে সিল করে নামছি, যাতে নীচের ঝামেলা মিটিয়ে সোজা বাড়ির পথে এগোতে পারি।

সুদৃশ্য ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নামছি আর দেখছি একটি সাস্থবান বেঁটে লোক খুব চেঁচাচ্ছে আর আমাদের হলের গার্ড, লাইটম্যান, ইলেক্ট্রিশিয়ান, মেশিম্যান ওকে না বুঝিয়ে ওকে ধমকিয়ে ততোধিক জোরে চিৎকার করছে।

আমাকে নামতে দেখে সবাই একটু সামলে নিল, একজন বয়স্ক স্টাফ জানালেন,
--  আসুন স্যার, দেখুন এই লোকটা টিকিট ছাড়া হলের মধ্যে  ঢুকতে চাইছে।

আমি সামনে যাওয়ার আগেই লোকটি বুঝেই আমার সামনে চলে এল। উগ্র পানীয়ের গন্ধে আমার নাসিকা জাগ্রত হলো। ব্যাপারটা বুঝতে আমি ওকে ভালো করে দেখলাম। 

ভালো জামাপ্যান্ট পরিহিত, গায়ের রঙ ফর্সা। দেখতে ভালো তবে বেঁটে, হাত পা গোলগাল। অবিন্যস্ত চেহারা, মাথার চুল এলোমেলো, একবার দেখে যেটা মনে হয় ও গরীব নয়। এত পরিমাণে আকন্ঠ পান করেছে যে সোজা হয়ে না পারছে দাঁড়াতে, না পারছে কথা বলতে।
জড়িয়ে জড়িয়ে জানালো,
--  স্যার আমায় বাঁচান, আমায় একটা টিকিট দিন।

আমি একজন  টিকিট ম্যানকে ইশারা করলাম, উনি জানালেন,
--  কাউন্টার তো বন্ধ হয়ে গেছে।

--  তাতে কি? একটা টিকিট এমনি দিয়ে দাও।

--  স্যার শেষ  টিকিট নম্বর দিয়ে প্রোডিউসার রেজিস্টার নোট করা হয়ে গেছে যে। কেস খেয়ে যাবেন। ইন্সপেক্টর হল ঘুরে দর্শক গুনে সই করেও দিয়েছে যে ....।

সত্যিই আমারই ভুল। এরা অনেক নিয়ম জানে। ফ্লিম ডিভিশনের ভিতর ঢুকলে তবেই বোঝা যায়, বাইরে থেকে সবকিছু  ভুল জানা হয়। টিকিট বিক্রির টাকা প্রোডিউসারের, হলের মালিকের নয়। আমরা পার্সেন্টেজে পাই। 

মাতাল বুঝেও অবুঝ। এবার আমার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়লো,
--  স্যার যত টাকা লাগে নিয়ে নিন, আমার টিকিট লাগবে না, আমায় শুধু ভিতরে একটু ঠান্ডা হতে দিন, আমি সিনেমা দেখবো না। প্লীজ হেল্প মি। ভীষণ গরম লাগছে আমি মরেই যাবো ....।

হলের বিজ্ঞ অপারেটর আমাকে ইশারায় আবারও মানা করে জানালো
--  স্যার সাবধান। আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো।

অন্যরা সবাই মানা করছে, 
--  লোকটা পাড় মাতাল ওকে সাহায্য করে লাভ নেই।

--  কিন্তু ও যে মরে যাবে। এটা তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?

--  সেটা ঠিকই।  আপনি ডিসিশন দিন ...

--  আমার কোটায় বসিয়ে দাও। আমি পাশ লিখে দিচ্ছি। 

ম্যানেজারের তেইশটা ভি আই পি কোটা থাকে। আমি লিখে দিলাম। লোকটি টলতে টলতে উঠে হলে ঢুকতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, আমাকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে নমস্কার জানিয়ে গেল,
-- আপনি আমার ভগবান।

আমি হেসে ওকে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলাম। ও অগ্রাহ্য করে পা টেনে টেনে হলে ঢুকে গেল। আমি টাকাটা একজনের হাতে দিয়ে বললাম বেরোনোর সময় ওকে দিয়ে দিও।

সবাই খুশী হল। বললো,
--  আপনার এই ক্ষমতা আছে আমাদের নেই। খুব ভাল হল। যান অনেক দেড়ি হয়ে গেছে এবার নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।

আমি হল ছাড়লাম। ঝামেলা মিটে গেছে। সবাই খুশী। ঝামেলা মেটাতে আমি একাই কাফি!

ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই এই সাফল্যের হাসিটা আমার মুখ থেকে মিলিয়ে গেল যখন বাড়ি ফিরেই হল মারফত মোবাইলে ওই ব্যক্তিটির মৃত্যু সংবাদ পেলাম।

তারপর থেকেই ছটফটানি শুরু হল। খাওয়াদাওয়া গেল, সারারাত অনিদ্রায় দুশ্চিন্তার জাল বিস্তার হল। কখন সকাল হবে, কখন হলে যাবো? এই নিয়েই অর্ধমৃত অবস্থায় সময় কাটালাম।

যখন অফিস পৌঁছুলাম তখন হলের সব কাজ যথারীতি তার নিয়মেই চলছে, দেখলাম। অফিস ঘরে বসতেই সিনিয়র প্রোজেক্ট অপারেটর ওমসাব এসে হেসে আমায় সম্ভাষণ জানালো,
--  গুডমর্নিং স্যার।

--  গুডমর্নিং ওমবাবু  ....

--  কাল শো শেষের পর লাইটম্যান কালু গিয়ে দেখে ওই ভদ্রলোক চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছে। যারা ছিল তারা গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়েও কিছু ফারাক বুঝে উঠতে পারে না। আমায় ফোন করে আমি থানায় ফোন করে জানাই। আপনাকেও জানাই কিন্তু আপনাকে অতো রাতে আর বেশি ঝামেলায় ফেলতে চাইনি। থানা থেকে দুজন এসে ওনাকে পরীক্ষা করে জানান সম্ভবত মারা গেছেন।ওনারা বডি নিয়ে চলে যান হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
আজ আসবেন আপনার কাছে।  এসব নিয়ে ভাববেন না। সিনেমা হল মানেই ঝামেলার পীঠস্থান।

ওমবাবু মাদ্রাসী। খুব ভালো কাজ জানেন। আর অন্তর দিয়ে এই কর্মক্ষেত্রের হলকে ভালোবাসেন। হলের সব কাজে সব আলোচনায় মালিক ওনার সাহায্য নেন। আমার সাথেও মধুর সম্পর্ক। পাশের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন। ওনার সহায়তায় হলের মধ্যে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা আছে এবং প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের সিন্নি হয়। ব্রাহ্মন মাসোহারা ব্যবস্থায় রক্ষিত আছেন।

ফোনে ওসিকে জানালাম আমার আসার খবর।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে এসে সেকেন্ড অফিসার নিচের কাঁচের চেম্বারে বসে বিস্তারিত জানালেন,
--  দেখুন এই সব মদেমাতালে লোকদের নিয়ে  চলতে চলতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আর টেনশন ফেনশন কিছু হয় না। আপনাদের মালিকরা এত স্বজন মানুষ, তার উপর যখন শুনলাম প্রানবাবুও নেই আপনিও নেই, তখন যা কিছু করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কাগজপত্র করে হসপিটাল পাঠিয়ে দিয়েছি। পথেঘাটে মাতালের পড়ে হার্টফেল হওয়ার কেস খুবই স্বাভাবিক। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওর কেউ নেই তাই নোট দিয়ে চালান এরপর বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে হসপিটাল তাদের কাজ তারাই করবে। আপনাদের কি করার আছে?
এই দুটি জিনিস শুধু আপনি রেখে দিন, একটি গোল্ডেন কালারের রিস্টওয়াজ আর এই একটি ছোট্ট মোবাইল।

আমি থতমত খেলাম। মৃত্যু সংবাদ আমাকে বড় পীড়িত করে তার উপর সদ্য গতরাতে যে আমার পায়ে ধরেছিল, তার মৃত্যু বড় বেদনাদায়ক লাগছে আমার কাছে।  আমি বড় আবেগপ্রবণ। মেনে নিতে পারলাম না। ব্যথিত, দুঃখিত। তার উপর এই জিনিসগুলো নেওয়া  আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল,
আমি জানালাম,
--  প্লীজ,  এগুলো আমায় দেবেন না,  আমি রাখতে অপারগ। এসব আপনারাই রাখুন।

--  সরি স্যার , এসব আমাদের হেফাজতে নিতে গেলে অনেক নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। লোকটি বেঁচে থাকলে রাখা যেত। আর আপনি কেন রাখবেন? এতবড় হলের কোন স্থানে ফেলে রেখে দেবেন। গুডবাই,  যা হবার হয়ে গেছে ভুলে যান, ওনার নিয়তি এটাই ছিল।

প্রানদাই মিমাংসার নিস্পত্তি করলো, মজা করে হেসে বললে, তুমিই তো ইয়াং উত্তরাধিকার! 

ওনারা চলে যেতেই অনান্য সকলেই মত দিল সামনের আলমারিতে রেখে দিতে। আমি সকলকে দেখিয়ে চকচকে ঘড়িটি আর পুরানো ছোট মোবাইলটা আলমারিতে সাজিয়ে দিলাম।

সবাই কাজে মেতে গেল। শো শুরু হবে, দর্শকদের ভিড় বাড়ছে, হিট হিন্দি বই চলছে। সবাই ব্যস্ত! আমিও আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

দিন আসে দিন যায়, মাস কাটে। ভবিষ্যতের খবরাখবর কেউ আগাম জানতে পারে না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর ঘটনাটি ঘটে গেল ঠিক এই ঘটনা ঘটার মাস তিনেক পর যখন আমি সব ভুলে গেছি।

একদিন অফিসে ব্যস্ত, উপরের ঘরে খবর এল,
--  স্যার, আপনাকে নীচে একজন খোঁজ করছে।

বিরাট হল। আমায় সর্বত্র বিচরণ করতে হতো। প্রানবাবু বাইরের  প্রয়োজনীয় কাজ নিয়েই ব্যস্ত। বারবার ওঠানামা করতেই হতো। কত লোক কত কাজে আসে। নিচে নেমে কাঁচঘেরা চেম্বারে বসতেই বেয়ারা আমার অনুমতি নিয়ে ভিতরে একজনকে পাঠালো।

লোকটি কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই একগাল হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
--  কি স্যার,  আমাকে চিনতে পারছেন?

--   না ...

--  সে কি স্যার? ভালো করে দেখুন না .....

আমি দেখলাম বেঁটেখাটো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর স্বাস্থ্যের উত্তরাধিকারী এক পুরুষ। আমি চিন্তার জাল বিস্তার করছি কিন্তু জাল টানতে পারছি না এমন সময়ে উনিই একগাল হেসে জানালেন,
--  কি মনে পড়ছে না সেদিন আপনিই আমাকে বাঁচিয়েছলেন নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে?

আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই সে ঘটনা ভোলার নয়, মনে পড়ে গেল। কিন্তু একি শুনছি বা দেখছি, এযে অবিশ্বাস্য! লোকটি আবার হেসে জানালো,
--  আমিই সেইজন। সেদিন একটু বেশি নেশা করে ফেলেছিলুম, আর মাতালের কথার কি দাম? বলুন, কে শোনে? কিন্তু আপনি শুনেছিলেন তাই সেদিন আমি বেঁচে গেছিলাম।

আমি হতবাক। মুখ দিয়ে কোন শব্দ নির্গত হল না। লোকটিকে বারবার মাপতে লাগলাম। এবার যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। পুনরায় সব সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। ততক্ষণে বাইরে কয়েকজন স্টাফ কিছু একটা অনুমান করেছে। আমি ওমবাবু সহ কয়েকজনকে ডাক দিলাম। ওরা এসেই কিন্তু চিনে ফেললো।

লোকটি সকলের সামনে জানালো,
--  হসপিটাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি আসার সময় হসপিটাল কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছিল থানায় যেতে। ওরাই নাকি হসপিটালে পাঠিয়েছিল। আমি থানায় যেতেই বড়বাবু আপনার কাছে পাঠিয়ে দিল, অনেক উপকার করেছেন এবার যদি আমার ঘড়ি আর মোবাইলটা ফেরত দেন, তাহলে বড় খুশি হই। 

সবার চোখ আলমারিতে। চকচক করছে ওনার সম্পদ দূটি। সেদিন ওসির দেওয়া ঐ দুটি জিনিস যে আজ এত মুল্যবান হবে তা ভাবিনি তাই আমি বাধ্য ছেলের মতো হতবুদ্ধি হয়ে অজান্তেই ওগুলো বার করে ওনার হাতে তুলে দিলাম সঙ্গে সযত্নে রক্ষিত সেই পঞ্চাশ টাকার নোটটি। উনি আর একপ্রস্থ সকলকে নমস্কার জানিয়ে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেলেন। পুরো ঘটনাটা এক নিমেষে ঘটে গেল, যেন কোন ভৌতিক রহস্যের শুটিং হয়ে গেল।

আমি দেখলাম আমার জ্যান্ত ঈশ্বর হেঁটে যাচ্ছে ...
বহুদিন আগের ঘামে ভেজা শরীর ঠান্ডা হল যে .....

ওমবাবু আমার নাম ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন, হো হো হাসির শব্দে, সব্বাইকে নিয়ে খুশিতে হেসে উঠলো আনন্দে, প্রানের আনন্দে।
আর আমি ...? তখন আর 'আমিতে' নেই।

সিনিয়র ম্যানেজার কাম গুরুভাই কাম দাদা কাম বন্ধু প্রানদা ফিরতেই ওনাকে আদ্যোপান্ত সব জানালাম। উনি মাটির মানুষ, আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন, সঙ্গে আবদার করলেন,
--  আজ পুরো আদ্যাপাঠ করে আমায় শোনাতে হবে, আর অন্যদেরও সকলকে শুনতেই হবে ......
দিজ ইজ মাই অর্ডার। পিন্টু তুমি টাইপ করে নোটিশ ঝোলাও, এখনই। 

---------------------  আদ্যাপাঠের মাহাত্ম্য এটাই।

পুনশ্চ :
এটি একটি গল্পই। কাল্পনিক। সব চরিত্র আমার অকেজো মস্তিষ্কজনিত ফসল মাত্রই।




                       প্রদীপ কুমার দে


প্রদীপ দে বা পুরোনাম প্রদীপ কুমার দে, নামে কি আসে যায়, কর্মেই জীবনের পরিচয় যদিও নাম একটা লাগে সারাজীবনের স্বাক্ষী হিসাবেই, জন্ম যেভাবেই হোক হিসাব মিলিয়ে দেওয়াই ছিল যার কর্মজীবনের অঙ্গীকার, যেখানে অন্যের হিসাব মিলাতে গিয়ে নিজের হিসাব অগুছালো হয়ে যায়, তাতেও জীবনযুদ্ধে খামতি আসে না, টগবগিয়ে ছুটে চলে তার মনের সাধ আর ইচ্ছেগুলো।পিতা ছিলেন শিল্পী মানুষ স্বর্গীয় বনমালী দে আর মাতা তাঁরই সহযোগী স্বর্গীয়া মীরা দে।
মধ্যকলকাতার বইপাড়ায় যার জন্ম তার হাতে কলম উঠে আসবে এতে আর চিন্তার অবকাশ কোথায়? হাজারো প্রতিকূলতা কাটিয়ে অসম লড়াই চালিয়ে আজও কলমকে মনের মাধুরী মিশিয়ে জাগ্রত রাখার আপ্রান প্রয়াস যে জারি রেখেছি তার অকাট্য প্রমান আমার স্বরচিত আটটি গ্রন্থ প্রকাশের পর প্রাপ্ত আনন্দ।

_______________





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন