রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

অণুগল্প * ঈপ্সিতা রায়





অ-পরাজিতা  

ঈপ্সিতা রায়

অষ্টমীর সকাল। মাইকে পাড়ার মন্ডপ থেকে ভেসে আসছে ঠাকুরমশাইয়ের কণ্ঠ- ওম জয়ন্তী মঙ্গলা কালী....ড্রয়িং রুম থেকে রুদ্র তাড়া দিল কি-গোও হলো তোমার? অঞ্জলী শুরু হয়ে গেছে সেই কখন, সেকেন্ড রাউন্ড চলছে। একটু তাড়াতাড়ি করো। শাড়ীর আঁচলটা ব্লাউজের সাথে পিন করতে করতে অপরাজিতা বললো- হ্যাঁ আর পাঁচ মিনিট। শাড়ী পড়তে খুব ভালোবাসলেও রোজকার ব্যস্ত জীবনে শাড়ী আর সেভাবে কোথাও পড়া হয়ে ওঠে না তাই এই বিশেষ দিনগুলিতে শাড়ী পড়ার সুযোগ একদমই হাতছাড়া করে না সে। এই শাড়ীটা রুদ্র নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে, লাল রঙের ঢাকাই জামদানি- অপরাজিতার প্রিয় রঙ। ড্রয়ার থেকে অর্নামেন্টসের বাক্সটা বের করে ম্যাচিং নেকলেস টা গলিয়ে নিল ঝটপট। ঝুমকো টা নিয়ে বাঁ-কানে হাত দিতেই থমকে গেলো - তার বা কান যে আর দুল পড়ার উপযুক্ত নেই। সাত বছর হয়ে গেল, এখনও মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। অতীতে ফিরে যায় অপরাজিতা- ডিসেম্বরের এক শীতের বিকেলে কলেজ থেকে ফিরছিল, অটো থেকে নেমে মোড়টা পেরিয়ে গলির রাস্তাতে ঢুকতেই একটা জলের ঝাঁপটা এসে পড়ল মুখের বাঁদিকে, দুটো ছেলে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো পাশ দিয়ে। তারপরের ঘটনাগুলো ভালো মনে নেই, লোকজনের  ছুটে আসা, কয়েকটা অস্পষ্ট শব্দ- অ্যাসিড, জল, হাসপাতাল...কেউ একজন জল এনে মুখে গলায় জল দিতে লাগলো। তারপর আর বিশেষ কিছু মনে পড়েনা। যখন জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে। মুখে হাতে ব্যান্ডেজ জড়ানো। হাসপাতালের লড়াই শেষ হতে না হতেই শুরু হলো থানা, পুলিশ, কোর্টের লড়াই। জীবনে অনেক লড়েছে সে, আর এই প্রত্যেকটা লড়াইয়ে যে মানুষটাকে সব সময় পাশে পেয়েছে সে হলো রুদ্র। এই ঘটনার পর সম্পর্কটা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি অপরাজিতা, বড্ড লজ্জা লাগতো তার এই পোড়া মুখটা নিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতে। প্রথমবার আয়নায় নিজের বিভৎস পোড়া মুখটা দেখে নিজেই আঁতকে উঠেছিল- যে মুখটা ও নিজে মেনে নিতে পারছে না সেটা অন্য একটা মানুষ কি-করে মেনে নেবে। শুরুতে মনে হতো এটা হয়তো সহানুভূতি, রুদ্র ওর ওপর দয়া করছে। খুব রাগ হত, নিজেকে আরও অসহায় মনে হতো। বহুবার চেষ্টা করেছে অ্যাভয়েড করার, যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু ছেড়ে যায়নি রুদ্র। প্রত্যেকটা প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যতবার হেরেছে ততবার রুদ্রই সাহস যুগিয়েছে- তাকে লড়তে হবে, সেই স্বাধীনচেতা ডানপিটে মেয়েটাকে হারতে দিলে চলবে না- মনকে শক্ত করতে হবে। যারা তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল আর যারা এই ঘটনার জন্য তার চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিল তাদের সামনে দাঁড়াতে হবে হাসিমুখে। প্রমাণ করতে হবে অ্যাসিড শুধু তার মুখটা পুড়িয়েছে, তার অস্তিত্ব নয়। অপরাজিতার মাঝে মাঝে মনে হয় যারা তার দিকে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল আর যারা এই ঘটনার জন্য তাকেই দায়ী করেছিল তাদের মানসিকতার মধ্যে কি খুব পার্থক্য আছে! এখনও মনে পড়ে কথাগুলো - 'ভালো মেয়েদের সাথে এসব হয়না'। শুরুতে খুব কষ্ট হতো, সমাজের বাঁকা দৃষ্টির সামনে নিজেকে বড্ড গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে হতো। দীর্ঘ সময় লেগেছিল এই বাঁকা দৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগাতে, সবার চোখে চোখ রেখে মাথা তুলে দাঁড়াতে। পড়াতে খুব ভালোবাসত, ইচ্ছে ছিলো টিচার হবে। বি.এড করে অনেক স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েও রিজেক্টটেড হয়েছে, অনেক কটূক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে- এরকম মুখ দেখলে তো বাচ্চারা ভয় পাবে, কেউ পড়তে চাইবে নাহ....অনেকেই বলতো অন্য প্রফেশনের জন্য চেষ্টা করা উচিত। অপরাজিতা নাছোড়বান্দা সে টিচার-ই হবে তাতে যত সময় লাগুক, যতবারই রিজেক্টটেড হোক না কেনো- পড়ানোর জন্য মুখ টা একমাত্র যোগ্যতা কখনোই হতে পারেনা। প্রত্যেকবার ব্যর্থ হওয়ার পর নিজেকে বোঝতো পরের বার নিশ্চয় হবে... বারো বার রিজেক্টটেড  হওয়ার পর অবশেষে সফল হয় সে। প্রথমবার যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পায় সেদিন খুব কেঁদেছিল অপরাজিতা- এ কান্না বিজয়ের, প্রাপ্তির, স্বস্তির.....

দেরী হচ্ছে দেখে রুদ্র বেডরুমে ঢুকলো। অপরাজিতা অন্যমনস্ক হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে, রুদ্র এসে পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো...মুখের কাছে মুখ টা এনে আয়নায় অপরাজিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো- এই তো আমার 'অ-পরাজিতা '.....










 ***************************************************************                                      




ঈপ্সিতা রায়

জন্ম ১৯৯৫, উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়।  কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের স্নাতক। বর্তমানে রাজ্য সরকারের আধিকারিক। শৈশব থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক এবং তারই ফলশ্রুতিতে লেখালেখির শুরু। সাহিত্যের জগতে সদ্যাগতা।

২টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অপরাজিতা আর রুদ্রের ভালোবাসা, অপরাজিতাকে যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তোমার লেখায় তা সবই অনুভব করা যায়, যা ভাষার উপর তোমার চমৎকার দখল প্রতিফলিত করে ।

      মুছুন