['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১৮
দীপংকর রায়

শুরু হয়ে গেল কালীকে সন্তানসম্ভবা করার লড়াই। আর অন্য দিকে নিতাইদার সঙ্গ পেয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি। যে কোনো দিকে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যখন তখন । সুযোগ পেলেই সিনেমা হলে ঢুকে পড়া। না হলে সন্ধ্যাবেলা ঊনিশ পয়সার তাঁবুতে। যা পাওয়া যায় সেটাই দেখা চাই। আসা যাওয়ার পথে বিপ্লবাত্মক আলোচনা।
রাশিয়ান সাহিত্যের জোগানদারও নিতাইদা। তাতেও মন ভরছে না। বাংলা অনুবাদে পড়ছি যদিও। ঝরঝরে গদ্য। কোথাও কোনো জটিলতা নেই। সে একেবারে ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে তলস্তয়, পুশকিন লেলিনের জীবনকথাও…. গোর্কির মা পড়ে অনেক জায়গায় ভীষণ ভালো লাগছে। আবার কিছু জায়গায় অনেকটাই বুঝতে পারছি না। তলস্তয়ও একই দশা। পড়তে বাধছে না। অর্থ বুঝতে বেশ ধাক্কা খাচ্ছি। ওদিকে কার্ল মার্কসের জীবন কথা, পথে চলতে চলতে নিতাইদার মুখ থেকে গল্পের মাধ্যমে শুনছি। যদিও আমার ভেতরে কেন জানি না ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে গড়ে ওঠা যে কোনো কাহিনীই—- আমাকেও সেই সময়ের একজন তৈরি করে নেয় মনেমনে। সুভাষ বোসের জীবন পড়ে, বিনয় বাদল দীনেশের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের আগের মুহুর্তের কাহিনী পড়ে, থরথর করে কাঁপতে থাকি আবেগে। মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন পড়ে, সেই সময়ের সহযাত্রী হয়ে যাই যেন মনে মনে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াই যে…. তার ঠিক থাকে না। আর এই সব কারণেই হয়ত পরবর্তীতে আমার লেখালেখির মোড়ও ঘুরে যেতে দেখি একেবারে ।
এভাবেই চলছিলো ।
ওদিকে সামনের বাড়ির মাসিমাদের সম্প্রতি তৈরি হওয়া পাকা ঘরের পেছনের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু যে সব ঝাউগাছ গুলির আকাশছোঁয়া দোলা লাগানো চেহারা, তাতে একেকটি ঋতু পরিবর্তনের আবহে যে যে পটভূমি তৈরি হয়ে ওঠে…. ঐ ঝাউগাছ গুলির মাথা নাড়া দুলুনিতে, তাতে কত চাঁদনি রাত থাকে…. কতো আলো অন্ধকার …. কতো অন্ধকার রাতের নক্ষত্রলোকে উঁকিঝুঁকির ভেতর কতো আকাশ কালো হয়… সাদা … নীল হয়.. আমার চেতনালোক জুড়ে, তাঁদের জানা অজানা কতো ভাবাবেগের ভেতর যে, এই বাড়ির এই একটুকরো বারান্দার কোণাটায় বসে বসে একটি প্রাণের কত রকমের জগত তৈরি হয় যে, সে খবর কেই বা রাখে! আর সে সব কি বলে-কয়ে কারো কাছে হালকা হবার জিনিস? সে কথা তো সেই জানে একমাত্র, যাকে বহন করে চলি ভেতরে ভেতরে। অন্য কাউকে তো সেসব বুঝোনো যায় না বলে!
বৃষ্টি হয় সমস্ত রাত। কুয়াশায় কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায় চারদিক। মাসিমাদের বাড়ির স্থলপদ্ম করবী গাছটির থেকে কী যে অপূর্ব সুবাস ভেসে আসে, অনুভব করি সবটাই দূর থেকে— কাছে না যেয়েও যেন কতো সুগন্ধ পাই!
সমস্ত আবহ জুড়ে এই যে শহরতলীর রূপ, সদ্য সেজে ওঠা পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে একটু একটু করে নাগরিক চাহিদারা এসে সকাল সন্ধ্যা ছোটাছুটি করে যেন কত রূপে… ! এটা ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসে নতুন সময় কত বস্তুতে রঙ্গিন করে তুলছে যে একেকটি গৃহকোণও ; যেন কতো মঞ্জুরিতে মঞ্জুরিতে ভরে উঠছে সমস্ত উঠোনময় তুলসী গাছগুলিও… । কৃষ্ণকলি ফুলে ফুলে ছেয়ে যাচ্ছে দেখি এক একটি গৃহপ্রাঙ্গন। আর তার মধ্যেই মাথা গলিয়ে ঢুকে পড়ছে এক একটি বাড়িতে এক এক ধরণের আধুনিক আসবাবপত্রের সরঞ্জাম। কারো বা বাড়ির সিমেন্টের মেঝে ভেঙ্গে পাথর বসছে। তার ঘসঘস শব্দে সমস্ত পাড়া প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে। কারো বাড়িতে নতুন টেলিভিশন আসছে। তার আওয়াজে গমগম করে উঠছে চারদিকটা। বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াতের পথে মানুষজন খানিকটা সময় সেই বাড়ির খোলা জানলায় একটুখানি থমকে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে কী কী নতুন অনুষ্ঠান চলছে এখন টেলিভিশনে।
অথচ এইতো, কিছুদিন আগেও দুবেলা আকাশবাণী বিভিদভারতীর অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে সুড়কির রাস্তা পার করতো কত মানুষজন! আর আজ সেখানে টেলিভিশনের সকাল সন্ধ্যা কলকাকলি। একেবারে সোরগোল পড়ে গেছে চারদিকে। আর এখনো যাদের এইসব ঘরে আসেনি, তারাও অন্য বাড়িতে তাদের ঘরের ভেতর বসে পড়ছে টেলিভিশন দেখতে হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে। ওদিকে কারো বাড়িতে ঠেলাগাড়ি চড়ে কিংম্বা সাইকেল ভ্যানে চড়ে মস্ত ঠান্ডা মেশিন এসে যায় দেখি একেবারে মাথা উঁচু করে।
সবটাই কি এই বারান্দাও আমার সঙ্গে সঙ্গে বসে বসে দেখে? যেমন মাসিমাদের বাড়ির পেছনের ঝাউ গাছগুলিদের সারি আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় কোথায় কোথায় ইচ্ছে মতোন অনুভবের রথে চড়িয়ে নিয়ে …. ! তেমনি হঠাৎ হঠাৎ আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে যে প্রতিবেশীরা এখন বেশ একটু অন্যরকমভাবে আধুনিক হয়ে উঠছে, তাদের হাঁটাচলা কথাবার্তা সবই নজরে পড়ে। যদিও আমাদের এসব কেনার ক্ষমতা নেই। কিংম্বা হয়তো চাহিদার কথাও ওঠে না কখনো। সেই সকাল-সন্ধ্যা বা দুপুরবেলা গুলিতে যেভাবে সেই ইলেকট্রিক রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে যেটুকু গানবাজনা খবর-টবর শোনাশুনি… । শোনা, বিভিদভারতীর গানের অনুষ্ঠান। কখনো কখনো ছুটিছাটার দিনে বোরোলিনের সংসার। বারোটা বাজলে এইসবের মধ্যেই কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় ভরে যায় মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত বাড়িটাই। খানিকটা সময় একটা দমবন্ধ অবস্থা চলতে থাকে। আবার কিছুক্ষণ বাদেই সব স্বাভাবিক। চায়ের মগ নিয়ে বসে দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে বিসনি ভাই তার দেশের গল্প বলে। একেকদিন কাজের দিদি সকাল সন্ধ্যায় তাঁর একমাত্র বোনঝির সংসারেই তার শেষ আশ্রয় যে, সেই সব কথা গল্প করে বলে। ডান পাশের লম্বা গোরুর ঘরের যে অংশের কোণায় দানাভুসি বিচালী থাকে, কিম্বা যেখানটায় গোরুর জাবনার টবগুলিতে দুইহাত প্রবেশ করিয়ে বিসনি ভাই জাবনা মাখিয়ে গোরুগুলির মুখের সামনে ধরে, সেই জায়গাটায় সকাল-সন্ধ্যায় যে রৌদ্র-ছায়া চলাচল করে, সেখানেও আমি যেন কতো কথার মালা গাঁথতে বসি আপন মনে একাকী ….।
সময়ের ব্যবহারিক এইসব সরঞ্জামের সরাসরি একটা প্রভাব মানুষজনের ভেতরে অনুভব করতেই হয়। তার টান একেবারে যে আমাদের ভেতরেও কখনো পড়ে না, তেমনটা নয়। দিদির বাড়িতে তো সেসব সব অনেক আগেই প্রবেশ করেছে। তাদের ওখানে গেলে গরমের সময় ফ্রিজের জল খেতেও তো বেশ লাগে। একগ্লাস সরবতও পেয়ে যাই মাঝে-মধ্যেই।
টেলিভিশনে সন্ধ্যার দিকে বাংলা সিনেমার টানেও তো মাঝে-মধ্যেই ওর ওখানে যেয়ে উপস্থিত হই । তাতে ভাগ্নেদের সঙ্গে সময় কাটানোও তো বাড়তি একটা টান। মাও তো তাঁর অফিস ফেরত ঐদিক দিয়েই রোজকার ঘুরে যাওয়া-যায়ি থাকেই, এ ছাড়াও কখনো কখনো দিদির ফোন পেলেই ছুটে আসে এই বলে,‘ঠিক আছে তোরা বেরিয়ে যা। ছায়া তো রয়েছে। আমি ঠিক সময় মতো তোদের ওখানে পৌঁছে যাবো।’
এ ঘটনা প্রায়শই ঘটে। তার বিশেষ কারণ হলো ওদের একটু এদিক ওদিকে বাইরে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করতে বেরোনো নিশ্চন্তে। মাও ওদের ওখানে সেই সময়টুকু উপস্থিত থাকলে, ছেলেদের রেখে বাইরে চলে যাবে যে দিদিরা একা ছায়ার উপরে রেখে দিয়ে, সেখানে মা থাকলে, সেও নিশ্চিন্তে বাইরে যেতে পারে এই আর কি।
এই বিষয়টি ছাড়াও মায়ের অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে একবার মেয়ের ওখানে হয়ে বাড়ি ফিরলেই মানসিক শান্তিও বটে। তাই এটা প্রায় একরকম রোজকার রুটিনই বলা চলে। তাই এইসব ক্ষেত্রে দিদি ফিরে এলেও মা আরো কিছুক্ষণ মেয়ের বাড়িতে কাটিয়ে টেলিভিশন দেখে-টেখে রাত দশটা এগারোটা বাজিয়ে তারপর ঘরে ফেরার কথাটা ভাবে হয়তো।
তাই সেসব ভেবে আমার দিদির বাড়িতে যেতে ইচ্ছে থাকলেও নানা চিন্তাই করতাম যেতে। ভাবতাম আমি যদি এরকম প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ফিরি, তাহলে এদিকের অবস্থাটা কী হয়। একে তো ছোটো ভাই স্কুল থেকে ফিরে স্কুল ব্যাগটিকে খাটের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোনোরকমে নাকেমুখে দুটো ভাত তরিতরকারি গুঁজে দিয়ে সেই যে খেলার মাঠের দিকে ছুটলো, এরপর সন্ধ্যা ঘুরে গেলে এক হাঁটু কাদা মেখে ধুলো মেখে বাড়ি ফেরে। তার পরে কোনোরকমে গায়ে হাত-পায়ে জল ঢেলে সেই যে বিছানায় এলিয়ে পড়লো, আর ওঠার নাম গন্ধ থাকে না তার। মা প্রায় দিনই বাড়ি ফিরে তাকে ডেকে-ডুকে রাতের খাবার খেতে তুলবে এসে। তখন তার চোখে ঘুম। মা ডাকাডাকি করলেও কোনোদিন উঠে ঘুম চোখে খায় তো কোনোদিন উঠতেই পারে না হয়তো।
তাহলে এমনটা প্রায়শই ঘটতে থাকলে পরের দিনের স্কুলের পড়া কখন আর মুখস্থ করবে সে। তাই পরের দিন যেটুকু হলো সেটুকুই হোলো। এর পর পিঠে ব্যাগ গলিয়ে নিয়ে কোনোরকমে নিয়মটা পালন করা তার। তা না হলে, আজ পড়া তৈরি হয়নি বলে সেদিনের মতো আর তার স্কুল মুখো যাওয়াই হলো না হয়ত।
মাকে দেখেও বুঝি, সে যে এইসব নিয়ে ভাবে না তা না। কিন্তু তার জন্যে এখনি যে কঠিন ভূমিকা নিতে হবে তার ভালোর জন্যেই, সেটা ঠিক সেও পেরে ওঠে না। যে কোনো ভাবেই হোক সেও যেন নিজের জীবনে একটুখানি শান্তির খোঁজে, আনন্দের খোঁজে, দিদির বাড়ির টান, নাতিদের টানকে কোনোভাবেই এড়িয়ে থাকতে পারে না।
এই ক্ষেত্রে আমার ভূমিকাও খুবই অসহায়ের। রোজ সংসারের এই দুরবস্থার জন্যে ভেবে ভেবে যতোটা সংসারের এই জলস্রোতের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছি, আর ভাবছি নানা কথা। সে কি শুধুই ভাই-এর জন্যে? হয়ত না, নিজের জীবনটাকে নিয়েও ভাবছি। ভাবছি এই যে প্রথার বাইরে চলাতে গিয়ে, একটা অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করছি না কি আমিও?
যদিও সেই একই পথের অনুসারী ছোটো ভাই তো নয় মোটেই! তাহলে? সে তো এখনো পড়াশোনার জীবনের প্রাথমিক স্তরটিও পেরোতে পারেনি। সেইটুকু না পেরিয়ে ও কী করবে? সেইসব ভাবনাও চলে আসছে এখন ভীষণ ভাবে।
এ ছাড়াও ইদানীং দেখতে পাচ্ছি সংসারের টাকাপয়সাও না-বলে এদিক ওদিক করে ফেলছে সে ফাঁক পেলেই, সংসারের জন্যে যেটুকু তোলা থাকে ঘরের আলমারিতে। প্রায় দিনই এইসব নিয়ে মায়ের অফিস যাওয়াই হয়তো বন্ধ হয়ে যায় একেকদিন। এরপর চিৎকার চেঁচামেচি হোইচোই ঝগড়া অশান্তি এসবও দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনো সমাধানের পথ খুঁজে বার করা যেন কারো পক্ষেও সম্ভব নয়। ইদানীং সে আমাকেও কিছু বললে গালিগালাজ করছে। হিংসা করছে। এও বলতে ছাড়ছে না,‘ তুই কি করিস? ঐ তো গোরু বাছুরের দানাভুসি আনা আর সারাদিন বই মুখে গুঁজে পড়ে থাকিস বিছানায় উপুড় হয়ে। এই তো তোর কাজ। ওতে তুই কোন দিগ্গজ হবি? তার আবার আমাকে বলতে আসিস।’
এই ভাষা ওর নয় তো! এই পরিস্থিতি কোনোদিন এদেশে এসেও তো আমি এতকাল অনুভব করিনি! ও যে এতোটা পাল্টে যাচ্ছে কীভাবে? সে ভেবে ভেবে নিজেও অসহায় হয়ে পড়ছি দিন দিন।
ভীষণ অসহায় লাগছে। না পারি বোঝাতে, না পারি শাসন করতে। মনে মনে কষ্ট পাই। আবার ভাবি, ও তো ঠিকই বলেছে। আমি কি উচ্চ ডিগ্রি ধারণ করতে পেরেছি! না চেয়েছি? সত্যিই তো আমার এই লেখাপড়ার মূল্য কি? এর তো সামাজিক স্বীকৃতি নেই কোনো! আচ্ছা, সেটা যদি থাকতোও, তাহলেও কি ও আমার কথা শুনতো? না পাল্টে ফেলতো এই সব ধারণাগুলি ওর!
শুধুই ভাবি। অথচ কী করেই বা বলি, ওরে, আমি যা যা করে কাটাই, যা নিয়ে পড়ে থাকি, তুই যদি সেরকমেরও থাকতিস, তাহলে তোকে নিয়ে হয়ত এতটা চিন্তা থাকতো না। কারণ আর যাই হোক আজ যা তুই করছিস, সেটা অন্তত করতে পারতিস না। তুই আজ যে পথে বন্ধুবান্ধব সঙ্গ করে ছুটে চলেছিস। একদিন বুঝতে পারবি সত্যটি কতোটা কঠিন। কষ্ট পাবি। সেদিন কিন্তু তোর ফেরার আর কোনো উপায় থাকবে না।
নানা ভাবে এইসব ভেবে ভেবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই তাকে এই কথাগুলি বোঝাতে পারছি না। চেষ্টা করছি। ভালো অবস্থায় একটুখানি পেলেই তাকে আর একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে দেখি। যদিও দেখছি সে সময় হয়তো বুঝলো বেশ শান্তভাবে। আবার নিয়মিত হলোও স্কুলে। কিছুদিন গেলেই আবার যে-কে সেই। অনিয়মের পাল্লা ভারি হয়ে উঠলো। পড়া তৈরি হয়নি বলে স্কুল কামাই। প্রাইভেট টিউশন দিতে এসে মাস্টার মশাই রাতে ছাত্রকে খুঁজে পায় না সময় মতো।
এইসব নানা কিছু নিয়ে ভেবে ভেবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যেই দিদি খবর পাঠালো সে পাড়ার কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ-জনের সঙ্গে নেপাল ভ্রমণে যাবে। কিন্তু জামাইবাবু অশোকদা এই সময় সঙ্গে যেতে পারবে না তার। সেই জন্যে সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়ছে। একেবারে এখান থেকে বাস-যোগে ভ্রমণ।
সংসারের নানা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করবো! নানা কিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম।
এক দিকে ছোটো ভাই-এর এলোমেলো চলাফেরা। স্কুল কামাই। এরপর কাজের লোকের সঙ্গেও ইদানীং নিত্য অশান্তি লেগেই আছে তার। কাজের লোকজনও বিগড়ে যাচ্ছে তার যখন তখন নানা ফাইফরমাজ খাটতে খাটতে। সবটা মিলে একটা খাপছাড়া পরিস্থিতি।
এ সব ভুলেও রাজি হয়ে গেলাম। একদিন একটা সকাল বেলায় ছোটো একটি ব্যাগের ভেতরে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে দিদির সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠে রওনা হলাম বেহালায়। যেখান থেকে বাস ছাড়বে সব যাত্রীদের একত্রিত করে নিয়ে।
বাস চললো বর্ধমান আসানসোল হয়ে। পথে এক জায়গায় দুপুরবেলার খাওয়া-দাওয়া করানো হলো সকলকে। জীবনে প্রথম চিনলাম ধাবা কাকে বলে। মনে মনে ভাবতে থাকলাম এই ধরণের পথের ধারের হোটেলগুলিকে ধাবা বলে কেন?
ফাল্গুনের মাঝামাঝির দিকে যাত্রা করেছিলাম মনে আছে। কলকাতায় তখন বেশ গরম। অথচ মাঝ-রাতে বিহারের কোনো একটি জায়গায় বাস দাঁড় করিয়ে পেচ্ছাপ করবার সময় যখন দেওয়া হলো, বাস থেকে নেমে খুবই সাদামাটা ভাবে একটি পাতলা জামা ছিলো গায়ে, ওমা, একি! এ যে হাড় হিম করা ঠান্ডা! খুঁজে পাচ্ছিলাম না নিজেই নিজের পুরুষাঙ্গটি।
তখন কেবলই মনে হচ্ছে, না এলেই মনে হয় ভালো ছিলো। অথচ কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে; এই সময়ে এখানে যেমন কলকাতার সঙ্গে একেবারে আলাদা আবহাওয়া। তেমনি কতো বিচিত্র স্বভাবের মানুষ-জনের সঙ্গ অনুভব করছি এর মধ্যেই। এগুলি কি ঘরে বসে থাকলে মিলতো? না জানতে পারতাম? তারপরে আরো কত বৈচিত্র্য আছে পড়ে!
বর্ধমান পর্যন্ত একরকমের ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি বাংলা দেশের জলহাওয়ার মধ্যেই রয়েছি। সন্ধ্যাবেলার দিকে বাস যখন আসানসোল পৌঁছালো, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলো, তখন থেকেই কেন যেন মনে হচ্ছিলো একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব চারদিকে। এর পর বিহার ঢুকলে, সেই রাতে যখন সকলেই পেচ্ছাপ করতে নামলো, আমার তো সে কি অবস্থা ঠান্ডায়, কি আর বলি! এই ফাল্গুন মাসের এই সময়ে কলকাতায় যখন ফ্যান চলছে, আর এখানে তখন এই রকমের হাড় হিম করা ঠান্ডা!
অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বাস যখন রকসৌল বীরগঞ্জ বর্ডারে রাত্রি বাসের আয়োজনে দাঁড়ালো, তখন তো আর এক পরিস্থিতি।
এর আগের দিন তো সমস্ত রাত বাসের ভেতরেই কেটেছে। দুপুর বেলায়ও ঐ রকম পথের পাশে বিহারী ধাবায় খাটিয়ায় বসে মোরগার ঝোল আর চাল চাল ভাত। এবং পরদিন রাত্রে বীরগঞ্জের হোটেল। সম্ভবত সেটা নেপাল বর্ডার সংলগ্ন ছোট্ট একটি গঞ্জ শহর মতন হবে হয়তো। সেখানে যেয়ে আবার বিহারী খাদ্য খাবারের ঘরানাটিও একেবারে পাল্টে গেলো। সে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতি। একদিকে হোটেলে জায়গার সংকুলান না হওয়া, আর একদিকে রন্ধন প্রণালীতে যে বেস্বাদ সে যেন বর্ণনার বাইরে। সমস্ত রান্নাতে একটা উৎকট কীসের যেন গন্ধ। রসুনের কথা বললো পালদা। কেন যেন মনে হলো সবটা রসুনের দোষও না হয়ত। মুরগির মাংসে কামড় দিলে রক্ত-রঙের একটা লালচে লালচে ভাব তখনো পর্যন্ত লেগে আছে যেন। মনে মনে ভাবছি, যে দেশে যেমন, কী আর করা …! কিন্তু কথাটা একইরকম ভাষায় বললো খানিকটা পালদাই।
পালদা আমাদের দিদিদের পাড়ার মোড়ের একমাত্র প্রতিষ্টিত মুদিখানার দোকানের মালিক।
এই পালদাই এখন আমাদের একমাত্র কাছের মানুষ। বাকি আর সকলেই তো অপরিচিত।
পালদা রসিক মানুষ ভারি। দেখতে একটু ছোটোখাটো স্থুলকায়, ভুরি আছে বেশ বড়সড় একটি। আর এই পালদার সম্পর্কে এক শ্যালক, যার সঙ্গে ইতিমধ্যে খানিকটা কথাবার্তা বলার মতো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেহেতু সে বয়সে আমার থেকে একটু বড়ো তাই তার প্রতিটি কথার মোড়কের মধ্যে তার নানা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের পরিধির একটা ইঙ্গিতপূর্ণ দেখনদারী ভাব তো চলছেই সবসময় কথা বার্তার মধ্যেই। প্রথম প্রথম তার সঙ্গে মিশতে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো। পরে ভেবে দেখলাম এই পথযাত্রায় এমন কেউই নেই যে আমার কিছুটা হলেও সমবয়সী। এ ছাড়া সে অফিসের কেরানি থেকে বড়বাবু মেজবাবু ছোটোবাবু মুদি মনোহারী জামাকাপড়ের দোকানদার থেকে একটুখানি উঁচু মহলের ছোটো বড় কর্তার ফ্যামেলিরাও আছে যদিও এই সঙ্গে। কিন্তু এমন একটি কোনো পরিবার বা এমন একজন কেউ নেই, যার চোখে চোখ রেখে, তার মুখের ঔজ্জ্বল্য মনকে একটুখানি আকৃষ্ট করতে পারে। তাই এই ছেলেটির সঙ্গে সঙ্গেই একটু এদিক ওদিক। বাস যখন কোথাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন আমরা একটু ঘোরাঘুরি করছি বা কথাবার্তা বলছি নিজেদের মতো কোনো একটা বিষয় নিয়ে। জানতে পারলাম সে সদ্য সদ্য আবহবার্তা বিভাগে চাকরিসূত্রে কাজকর্ম আরম্ভ করেছে। তার জানা-চেনা সবটাই বিজ্ঞান বিষয়ক। যেখানে শিল্প সাহিত্যের কোনো প্রবেশ পথ থাকার সুযোগ নেই একেবারেই। যদিও সে আবার প্রকৃতি প্রেমিক বলে দাবি করছে সবসময়। এই নিয়েই জানতে পারলাম তার এর আগে নানান জায়গায় ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা।
একেবারে আমার মতো আনকোরা নয়। তাই তার ঐ প্রকৃতি প্রেমের পথ ধরেই যা কিছু কথা বলাবলি একটুআধটু।
দূরে দেখা যাচ্ছে যে প্রকান্ড গিরিশৃঙ্গ, সূর্য লাল হয়ে উঠছে ভোরের বেলায় …. তার একটি বর্ণনা দিলো সে এরকমই — ঐ যে দেখছো পাহাড়টা, কতো কাছে মনে হচ্ছে না?
************-**********************************
আগামী পর্বে
***********************************************