বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

প্রসঙ্গ * স্বরবর্ণ




স্বরবর্ণে লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----


১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদি ) পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।



* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 




সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড. শুভঙ্কর দে          ড. অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত           দেবাশিস সাহা

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

প্রভাত ভট্টাচার্য * ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি





শার্দুলের আবির্ভাব

প্রভাত ভট্টাচার্য  

পর্ব-৩



আমি এখানে এসেছি একটা বিজ্ঞাপন দেখে। কাগজে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয়েছিল যে পিছুটান নেই এরকম কয়েকজন শক্তসমর্থ লোকের দরকার। কি কাজের জন্য, তা বলা হয় নি। বিতান বলল। 

    আমিই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। তা আপনার তো তাহলে কোনো পিছুটান নেই। কি করেন এখন?

    তেমন কিছুই না। একসময় আমি সার্কাসে কাজ করতাম। তারপর ঘোড়দৌড়ের মাঠে জকির কাজ। আরো অনেক টুকটাক কাজ করেছি। 

   জেলে গেছেন কখনো?

   একটু ইতস্তত করে বিতান বলল, দু একবার। 

   কি জন্য?

   স্মাগলিং এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম কিছুদিন। 

   বন্দুক চালাতে পারেন?

   হ্যাঁ, পারি। 

   বাঃ ,আপনি সব দিক দিয়েই উপযুক্ত আমার কাজের জন্য। আপনি আজ থেকেই আমার দলের লোক হয়ে গেলেন। 

    কিন্ত কাজটা কি?

    পরে জানতে পারবেন। অত তাড়াহুড়োর কি আছে। আর হ্যাঁ, আমার ব্যাপারে, এবং কোনো ব্যাপারেই কৌতুহল দেখাবেন না। তাহলে অযথা সমস্যা হতে পারে। ঠিক আছে তো। 

   ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। 

   শার্দুল ....হাঁক দিল অজয়। 

   একজন বিশাল চেহারার লোক এসে দাঁড়াল। চোখে তার ক্রুর দৃষ্টি। বিতানের অস্বস্তি হল তার তীব্র চাহনিতে। 

    অজয় বিতানের দিকে হাসিমুখে চেয়ে বলল, এ হল শার্দুল আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এর  আবার একটু মাথাগরম আছে, সমঝে চলাই ভালো। শার্দুল, যাও ওকে নিয়ে যাও, আর থাকার জায়গা দেখিয়ে দাও। আর ওর কাছে অস্ত্র থাকলে নিয়ে নাও। 

    শার্দুল মাথা নোয়ালো আর ইশারায় বিতানকে ওর সঙ্গে আসতে বলল। 

   ঘোড়াটার কি হবে?

   ও আমার আস্তাবলে থাকবে। আর কোনো প্রশ্ন আছে?

   না। 

    বিতান ওর পিস্তলটা শার্দুলকে দিয়ে চলল তার সঙ্গে। সে বুঝতে পারল যে এরা খুব একটা সহজ লোক নয়। কিন্ত কি আর করা যাবে। এসেই পড়েছে যখন। আর যা মনে হয় এদের কবল থেকে বার হওয়া খুবই মুশকিল।  দেখা যাক কি হয়। 

     শার্দুল একটা ঘরে নিয়ে গেল তাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিল যে এটাই এখানে তার থাকার জায়গা । লোকটা বোবা নাকি। 

     ছোট ঘর, কিন্ত চলে যায়। ছোট একটা খাট আর চেয়ার রয়েছে । বিতান বসল খাটের ওপরে। এবারে বেশ ক্লান্ত লাগছে। 

     অজয় গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। হঠাৎই তার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল বাইকের আওয়াজে। বেরিয়ে এসে দেখল একজন এসেছে বাইকে চড়ে। আগের জন আসলো ঘোড়ায় চড়ে, আর এ যান্ত্রিক ঘোড়ায়। 

    লোকটা বাইক থেকে নেমে বলল, আমি এখানে কাজের জন্য এসেছি। 

   আসুন ভেতরে। অজয় ডেকে নিল তাকে। 

   বিজ্ঞাপন দেখে এসেছেন নিশ্চয়ই। আশা করি কোন পিছুটান নেই। নাম কি আপনার?

   কি করছেন এখন  ?

   আমার নাম বাবলু। একটা কারখানায় কাজ করতাম, সে কাজটা চলে গেছে। 

   ঠিক আছে। তাহলে থেকে যান এখানে। 

   জানা গেল যে বাবলুর কোনো অপরাধের ইতিহাস নেই। 

   আচ্ছা, কোনো ব্যাপারেই কৌতুহল দেখাবেন না। কাজের ব্যাপারে পরে কথা হবে। আর বাইক আমার কাছেই থাকবে। এই বলে অজয় আবার শার্দুলকে ডাকল বাবলুকে নিয়ে যাবার জন্য। 

    শার্দুলকে দেখে বাবলুর তো অবস্থা খারাপ। যাই হোক, চলল তার সঙ্গে। সবকিছুই কেমন যেন  ।

   তার জায়গা হল বিতানের পাশের ঘরে। 

   তার দিকে একটা শীতল চাহনি দিয়ে চলে গেল শার্দুল।




************************************"**************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, রাজবাড়িতে রক্তপাত , ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর  তিনটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস - দশভুজা, কাগজের মানুষ ও মায়াবী গ্রাম। এছাড়াও তাঁর আর একটি মনভোলানো সৃষ্টি 'গুহা মানবের ডায়েরি'  




উপন্যাস * সুদীপ ঘোষাল




জীবনহাটের কড়চা 

সুদীপ ঘোষাল 

চতুর্থ পর্ব


কেতুগ্রামের এদিকে অজয় তীরে নেমে এলো সন্ধ্যা চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রকৃতি ছিল ঢাকা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যায় আকাশের তারা, অগুন্তি তারা। তবু তার মধ্যেই চলে সময় প্রবাহ। আবার সকাল হয়। কলরবে মেতে যায়,গ্রাম। আর পাশের এলাকার গুমটিতে পুরুলিয়া মুসলমানের বসতি কম। তবু কেতুগ্রাম রাউন্দী এলাকায় মুসলমান বসতি আছে। বিভিন্ন গ্রামের মুসলমান পাইকার আসে। তারা ভুলকুড়ি,  দক্ষিণ দিকে কোপা, কোমডাঙ্গা  গ্রাম থেকে গরু ছাগল নিয়ে কেনাবেচা করে।  এদিকে প্রবাহিত হয় অজয় নদ সময়ের তালে তালে। ফলে হিন্দু মুসলমান  আত্মীয়-স্বজন এখানে। মুসলিম পাড়ার নদের জল মিলিত হয় হিন্দু পাড়ার নদের জলে।  তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার সম্পর্কে।

খুব সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছে নুর আলি । আর   স্বপনও নুর আলির বন্ধু।

বাবার সঙ্গে ছোট থেকেই নুর আর স্বপন নিজেদের চাষের জমিতে যেত এবং চাষবাস দেখাশোনা করত। মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাব থাকলেও সংসার চলে যায় কোন রকমে তাদের।  সকালে মাঠে যাওয়ার পথে পা দিতেই স্বপনে ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গিয়ে চনমনে লাগে ঘড়িতে তখন বিকেল চারটে সমস্ত গ্রামটা যেন নিষ্পাপ শিশুর মত লাগে।স্বপন হালদার বয়স 25। গ্রাজুয়েট হয়েছে হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে। টিউশানি করে চুটিয়ে।  গ্রামে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করা, টিউশনি করা তার পেশা। বাবা মারা গেছেন দু বছর আগে বাড়িতে মারছোট ভাই আছে।স্বপনের অনেক বন্ধুর মধ্যে কেতুগ্রামের নুর আলি অন্যতম প্রধান বন্ধু। বাড়ি আসে আবার সময় পেলে ওদের বাড়ি যায় স্বপন।  আসলে নুর আলির বাবার বন্ধু ছিলেন স্বপনের বাবা।  এইভাবে হিন্দু-মুসলমানের পরিবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কবি নজরুল লিখেছিলেন, "আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।"স্বপন আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গাইতে গাইতে।  " যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এ জীবনে" গাইতে গাইতে যাচ্ছিল! হঠাৎ মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়া যদু মাস্টারের 19 বছরের মেয়ে তনুর সঙ্গে দেখা।সে বলল স্বপনদা মাঠে যাচ্ছ আজ একবার আমাদের বাড়িতে যেও ইংরেজিটা দেখিয়ে দেবে। বাড়িতে বাবা আছেন।বেগুনি আর মুড়ি খেতে খেতে স্বপন আর  তনু কথা বলছিল। পাশের ঘরে তনুর বাবা-মা  জানে ওদের প্রেমের কথা। ওদের দুই পরিবারের মধ্যে মিলনে কোন বাধা নেই। সকালে মুড়ি খাওয়ার পর হাত ধুয়ে তনু সামনে বসল বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে  পনেরোই কার্তিক মাস। নদীর জলে ভরা ঢেউ লাগলো, কেঁপে উঠলো শরীর বাঁশি।  দুজনেই বিয়ের আগেই মিলনের অপূর্ব স্বাদ মিটিয়ে নিল। বিধাতার খেলা। কখন যে কার কি হয় কেউ বলতে পারে না।সেদিনের সেই ঘটনার পরে স্বপন চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে। কারণ সাবধানতা অবলম্বন না করায়  মা হওয়ার লক্ষন প্রকাশ পেল তনুর দেহে।বিয়ে  হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তনুর দাদু মরে যাওয়ায়  বিয়ের দিন ঠিক  হল এক বছর পরে। এদিকে তো চিন্তায় পরলো স্বপন আর তনু। স্বপন খুব ভোরে মাঠে গিয়েছে।নিজে গিয়ে জমিতে আল বেধেছে। অভ্যাস নেই। তবুও চেষ্টা করছে ।ঠিকই কিন্তু মুনিষ দিয়ে বেশিরভাগই কাজ করায়। কিন্তু ওর ইচ্ছে সব কিছু  নিজে চাষ করে ফসল ফলানো।তার মজাই আলাদা।একমাত্র কৃষক ছাড়া কেউ তা অনুভব করতে পারে না। কৃষকের জয় হোক।সেনাবাহিনীর জয় হোক।


 পঞ্চম পর্ব

হিমযুগ বা মৃত্যুপুরির নাম শুনেছি এতদিন কিন্তু আমি যে মৃত্যুপুরীতে যেতে পারবো এ কথা ভাবতে পারিনি কখনো। ছোটবেলায় মা ভয় দেখাতেন  বাড়ি থেকে বেরোবি না বাইরে। বেরোলেই তোকে ধরবে আর আঘাত করে মেরে দেবে। মায়ের কথা কোনদিন মিথ্যে হয় না না তাই না? আজ দেখি বাইরে বেরোনো কত ভয়, বাইরে বেরোলেই মৃত্যুভয় । এক কালো থাবা নিয়ে বসে আছে বিরাট দৈত্য তার নাম, করোনা। মৃত্যুভয় আমার  শুধু নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে গেছে কোন এক ভয়ে। এক দৈত্যের ভয়ে।পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ লকডাউন পালন করছে। লকডাউন মানে ঘরে বসে থাকা।। ঘরে বসে থাকো, বাইরে বেরোবে না বাইরে বেরোলেই মৃত্যুর করাল থাবা বা  মহা কাল তোমাকে গ্রাস করবে।কিছু মানুষ সাহস দেখাচ্ছে তারা বাইরে বেরিয়ে কেউ চা খেতে যাচ্ছে কেউ আড্ডা মারতে যাচ্ছে কিন্তু তারা মূর্খ তারা ভেবেও দেখছে না তাদের জন্য তার পরিবার টাও ধ্বংস হবে।বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারপর রোগ নিয়ে ধুঁকছে বাড়িতে হাসপাতলে গিয়ে দেখছে করোনা। টেস্ট করলে করোনা পজেটিভ তখন বাড়ির সমস্ত সদস্যকে কোয়ারান্টিনে রাখা হচ্ছে কে যে কখন মরবে তার কোন গ্যারান্টি নেই।কেমন রূপকথার মতো শোনাচ্ছে তাইনা আমাদের পরের যুগে যে যুগ আসবে তখন কার ছেলেমেয়েরা এইরূপকথা শুনবে আর ভাববে কি সুন্দর লিখে গেছে লেখক। রূপকথা ভুলবার নয়। এ রূপকথা যে সত্যিই তারা বিশ্বাসই করতে চাইবে না।

আমরা যেমন বলি তেপান্তরের মাঠ ছিল না তারপর রূপকথাও ছিল না। সব বানানো গল্প হয়তো সেগুলো ঠিক ছিল, হয়তো সত্যি সেগুলো, আমরা তাদের মিথ্যা বলি কিন্তু এখন যেগুলো ঘটনা ঘটছে সেগুলো তো একদম রূপকথার মতোই তাই বিশ্বাস না করে উপায় নেই।

জানালা দিয়ে দেখছি কিছু লোক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত কায়দায় কত আর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ঘরে যারা আছে তাদের মূর্খ প্রতিপন্ন করছে। তাদের নামে কুৎসা রটাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে কিছুদিন পরে তারা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চলে যাচ্ছে। তোমাকে ভয় নেই করোনা  তাদের, যারা বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আইন অমান্য করে। আর তারাই রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে হ্যাঁ বাইরে যেতে হবে বৈকি। খাবারের জোগাড় করতে হবে তার জন্য অস্ত্র চাই তার জন্য বর্মা  পরতে হবে। বর্মা কি? মুখে মাক্স নিতে হবে N95, তারপর হাতে গ্লাভস নিতে হবে পায়ে জুতো পরতে হবে সারা অঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে তবে গিয়ে বাইরে বেরোতে হবে বাড়ি থেকে আসার পর সেসব সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে তাদের সাবান দিয়ে ধুয়ে বালতিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে তারপর নতুন কাপড় পরিধান করে এমনকি সবজিগুলো কেউ ধুয়ে নিতে পারলে ভালো হয়।

কিন্তু এত কিছু তো করা যায় না মানুষ তো অলসের জাতি তাই বলে থাক অত কিছু হবেনা আর ওইখানেই তো গন্ডগোল ওইখান থেকেই ছিদ্রপথে করোনাভাইরাস হাসতে হাসতে ঢুকে যায় আর ঢুকে গিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবী। 

অংশুমান আর মিলন বাবু জানলায় দুটো বাড়ি পাশাপাশি থাকে তারা জানলা দিয়ে কথাবার্তা বলছে মিলন বাবু তার বক্তব্য রাখছেন যে কিছু লোক আছে যারা বেপরোয়া হয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের রোগের ভয় নেই কিন্তু অজান্তেই তাদের অজান্তেই বের হতো তাদের শরীরে প্রবেশ করেছে। মিলন বাবু জানলা দিয়ে বলছেন, করোনা ভাইরাসের জেরে বিশ্বদুুয়োর বন্ধ। লকডাউন শুরু হল বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে। দোকান, বাজার, হাট স্কুল, কলেজ সব বন্ধ।তবু মিলনবাবু দোকানে গেলেন একবার। তিনি বলেন, আমার কিছু হবে না',।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা  বলছেন এই ভাবনাটাই করোনাকে, বিশ্ব মহামারীতে, পরিণত করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও এ দেশে বাজার-ঘাটে সেই দৃশ্য খুব কমই দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার একটি ঘটনা রীতিমতো আশঙ্কার সৃষ্টি করতে পারে। লকডাউন চলাকালীন মাত্র একবারের জন্য দোকানে গিয়েই করোনা আক্রান্ত হলেন এক ব্যক্তি। অথচ তিনি মাস্ক, গ্লাভস সমস্ত কিছুই পরে গিয়েছিলেন। 

মিলনবাবু  জানিয়েছেন, তিনি লকডাউন সম্পূর্ণই মেনে চলছিলেন। কিন্তু ঘরে খাবার শেষ হতেই তাঁকে যেতে হয়েছিল দোকানে। তাও একটি দোকানেই গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন পর থেকেই শরীর খারাপ হতে থাকে। জ্বর, শরীরে অসহ্য ব্যথা। এরপরই প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর করোনা টেস্ট হয়। সেখানেই তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে। 

মার্কিন এক যুবককে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া হসপিটালে ভরতি করা হয়েছে। ৩১ বছর বয়সী সেই যুবকের নাম বেনজি হা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাস ছড়ায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখলেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির ড্রপলেট অন্য কারও নাক, মুখ, চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই ভাল মাস্ক, চশমা পরাটা আবশ্যক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেনজির ক্ষেত্রেও সেভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি। 

এই কোভিদ নাইনটিন বা করোনা রোগ আসার আগে অংশ মানে জীবন ছিল সহজ সরল তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতো নিজের কাজ করতো টিউশনি পড়াতে কোনো বাধা ছিলনা কিন্তু করোনাভাইরাস আসার আগে আসার পরে আর উন্মুক্ত পরিবেশে ঘোরাফেরা করা যায়না তার আগের ঘটনা এখন কিছুটা আমরা বর্ণনা করছি। জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে? লকডাউনের আগে অংশুমানের মনে হত, স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? সজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে কিছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস। 


 ষষ্ঠ পর্ব 

বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের একটা বস্তি নন্দনপাড়। নন্দনপাড়ে গরিব লােকের বাস। আর তার চারধারে বেশ কয়েক বর্গ কিলােমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে শহর। নন্দনপুকুর বলে একটি পুকুর আছে। তার পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বসতি। অংশুমান নন্দনপাড়ের কাছেই দু-কাঠা জমি কিনে তার শখের বাড়িখানা তৈরি করেছে। মােটামুটি দু-খানা ঘর, একটা ডাইনিং আর বাথরুম। অংশুমানের একটি ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর তার স্ত্রী দেবী সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। অংশুমান একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। বেতন সামান্য। তবু সংসার চলে যায় আনন্দে। আজকে অনেক পরিশ্রমের পরে অংশুমান। নন্দনপাড়ে এসে বাড়ি করে শান্তিতে বাস করছে। নন্দনপাড়ের বাসিন্দারা। সবাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কিছু লােক থাকে তারা চিরকাল নিজেদের একইরকমভাবে চালাতে চায়। মানুষের প্রতি ভালােবাসার, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। নিজেকে গুটিয নন্দনপাড়ের এইরক আসর এই গথম। এখনকার লােক দু-চারটে মূর্তি এনে গুজা করে শাস্তি। দিন আনা দিন খাওয় লাকে বাস এখানে। এখানে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ মন  ব্যাপার। এ একদিন ছিল, যখন এই নন্দনপাড়ের নামে লোকে ভয় পেত।  এই পাড়া মানেই কিছু অসামাজিক প্রকৃৃতির লােকের বাস। সবাই এই  মনে করতেন। সত্যি যা রটে তা কিছুটা বটে। তখন বেশ কজন ছিল, যারা চুরি-ডাকাতি করত। নেশা করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অপরের  বউকে নিয়ে টানাটানি করত। কিন্তু চিরকাল একভাবে চলে না। অন্যায়-অত্যাচারের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতিকার করে।  এক নতুন পথের চিন্তায় থাকে। এ যেন মানুষের সহজাত চিন্তা। পাপী লােক দু-দিন আর গুণবান যুগে যুগে অবস্থান করে মানুষের অন্তরে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত অংশুমানের মন।। | অংশুমান ভাবে, যখন সে এল নন্দন পারে, তখন তার বাড়িঘর হয়  নি। ফাঁকা মাঠে এসে বাড়ি করে ফেলল অংশুমান।  চিতাভাবনা মা করে, বাড়ি ভাড়া করে থাকত গ্রথমে। তারপর ভাবনা করল।কম দাম দেখে অংশুমান একটা ঘর তৈরি করল। বাঁশের বেড়া দিল চারিদিকে। ন ছেলে পাঁচ বছরের। স্ত্রী দেবী খুব সাহসী মহিলা। তার সাহস না থাকল তো অংশুমানের এখানে এসে থাকা হত না।  মানুষ মরে যাওয়ার পরে পেট ভরে ভােজনের রীতি আমাদের সমাজে।  এই খাওয়ার পর্ব হয়ে আসছে পুরোনো কাল ধরে। ক্ষমতা থাক বা না থাক এই খাওয়ার রীতি।  অংশুমান ভাবছে পাঁচজন মানুষকে খাওয়ালেও  শান্তি।বেঁচে থাকতে যে মা ছেলের কষ্টে চোখের জল ফেলতেন,  মমতা বলতে কিছু থাকে তাহলে চোখের আড়ালে থেকেও ছেলের কষ্ট সম্বরণ করতে পারবেন না। ভারতবর্ষে অনেক ছেলে আছে যা মায়ের ঠিকমতাে দাহকরতে, শ্মশানে আনার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যায়। অংশুমান ভাবে, তবুসমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হয়। চাকরি-বাকরি পেলেও শুধু বসে থেকে মাথার চুল ছিড়লে হবে না। ব্যবসা করতে হবে, ভগবান যে দু-হাত দিয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে সেই দুই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। মূলধন নেই বলেই তাে অংশুমান ভাবে, টিউশনি আরও বাড়াতে হবে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে বেরােয়। অংশুমান, সাতটা থেকে সাড়ে আটটা একটা তারপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা অবধি আর একটা দল ছাত্র পড়ায় অংশুমান। আবার রাত্রিতে দুটো ব্যাচ। এইভাবেই অংশুমানের সময় কেটে যায় কর্মের মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে সবজি-বাজার, মুদি-বাজার সব করে নিয়ে আসে।। অংশুমান কাটোয়ার বাড়িতে বসেছিল। আজ রবিবার, টিউশনি নেই। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি পুরুলে থেকে ফোন এল মায়ের, "অংশু, একবার বাড়িতে আসতে পারবি? আমার ওযুধ ফুরিয়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে আসবি।” অংশুমান। ফোনে বলল, “আমি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তােমার কাছে যাচ্ছি।" স্ত্রী দেবীকে বলল, “পুরুলে থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে আজ ভাত খাব না। মায়ের কাছেই খাব।" এই বালে অংশুমান সাইকেল নিয়ে ওষুধের দেকানে ওযুধ আর তার সঙ্গে কিছু ফল-মূল, মিষ্টি নিয়ে পুরুলে মা-র কাছে গেল। অংশুমানরা চার ভাই, দুই বােন। দুই বােনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারভাই এখন পৃথক হয়েছে। যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা নেই। মা যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন সেখানেই থাকেন। চার ছেলে চার জায়গায় থাকে। বাবার চাকরি সূত্রে মাকে যেতে হল হাওড়া জেলার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় মা তিনভাইকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। বড়দা অংশুমানের কাকাবাবুর কাছে থেকে গ্রামে পড়াশোনা করে। অংশুমান ভাবে, তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে  এতদিন ইলেকট্রিক আলাে দেখেনি অংশুমান। সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা বাবা সুইচ অন করে দিয়েছেন।  আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে এল।কোথা  থেকে আলাে আসছে অংশুমান বা তার ভাইরা বুতে পারল না। বাবা দেখিয়ে দিলেন আলাের উৎস। উপরে বাতি ঝুলে রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। অংশুর এখনও মনে আছে। তারপর সকাল বেলা বাবা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন অংশুমানদের। অংশুমানের ছোটভাই তখন মাত্র দুই বছরের ছেলে। অংশুমান এবং তার মেজদা মাত্র তিন বছরের তফাত। দু-জনে মিলে স্কুলে ভর্তি হতে গেল। দাদা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হল কিন্তু অংশুমান অঙ্ক একটু ভূল করায় একেবারে নার্সারি এসে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি হলেও এখানে নার্সারিতে ভর্তি হল। তখন থেকেই ভালাে করে পড়াশােনা করার জেদ মাথায় জাকিয়ে বসল। তারপর থেকে সে প্রত্যেকবছর ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। এসব কথা তার মনে আছে। অংশুমানের বন্ধু ছিল অশ্বিনী, মােহিনী, হার, গৌতম, গােরা, শঙ্কর প্রভৃতি বালকেরা। ধীরে ধীরে অংশুমানের পরিবার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় বেশ সুন্দরভাবে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অংশুমান ছােটবেলায় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালােবাসত। ছােট ছােট বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় একটা ভালাে ক্রিকেট দল গঠন করেছিল, ক্যাপ্টেন ছিল সে নিজেই। একটা শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ভিতরে সবাই মিলে কোদাল, কুড়ি, ঝাটা নিয়ে শীতকালে ক্রিকেট খেলার জন্য "পিচ তৈরি করা শুরু করত। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গে অংশুমানের। মাঝে মাঝে ক্রিকেট ম্যাচও খেলা হত। বন্ধুরা সবাই মিলে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার জন্য চাদা তােলা শুরু করল। নিজেরাই বাঁশ পুঁতে নিজেদের মায়েদের, দিদিদের শাড়ি এনে সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করে ফেলল। এখন ঠাকুর আনার পালা। একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে সামনের পটুয়াপাড়া থেকে মূর্তি আনা হল। মূর্তি বসানাে হল বেদিতে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলের কাজ করা হল। অংশুমান দেখেছে বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি হয়। তাই ওরাও সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করবে। কিন্তু রাত যে অনেক বড়। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার পরে অফুরন্ত সময়। এখন কি করবে? ওরা भান করল ডিম-ভাত খাওয়া হবে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জোগাড় করে ওয়া-পাওয়ার জোগাড় শুরু হয়ে গেল। খেতে বসার সময়ে অংশুমানের মনে পড়ল, সরস্বতী পুজোর আগের দিন ‘বারের উপােস না করলেও কোনাে আঁশ জাতীয় খাবার খেতে নেই।  পরে কাউকে কিছু না বলে ডিম-ভাত নিয়ে  মাকে দিল। আর কোনাে ছেলের কথাটা মনে নেই। কষ্ট দিতে মন চাইল না অংশুমানের। ডিম-ভাত অংশুমান খেল।ঘড়িতে দেখল এগারােটা বাজে। রাতের বেলা প্যান্ডেলে  সারারাত কাটানাে মুখের কথা নয়। কিন্তু বন্ধুরা যখন এসবে মাতে তখন কোনাে বাধাই বাধা নয়। সব সমস্যা যার নতে যায়। বন্ধুত্বের শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে প্রত্যেক মানুষই তার জীবন মাধ্যমে এই তত্ত্ব বুঝে থাকেন। মশার কামড়েও যেন আনন্দের সুর। দাগ কাটে না বালক অংশুমানের মনে। পরের দিন সকালবেলা সবাই স্নান করে পুজো মণ্ডপে হাজির।ফল কাটা সব হয়ে গেছে। পুরােহিত এসে গেছেন। পুষ্পগুলি দিয়ে । পুরােহিতের সঙ্গে সবাই একসুরে বলছে, ভদ্রকালী নমঃ নিতং সরসত নমঃ নমঃ"—ভুল ইত্যাদি মন্ত্র। ঢাকের বাজনার সাথে সকলের নাচ হল। প্রসাদ  বিতরণের পর মণ্ডপের সামনে একটা বেড়ার আড়াল দেওয়া হল। তারপ স্কুল যাওয়ার পালা। স্কুলে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। আবার পরের দিন সকালে দধিকর্মার পূজা। পূজাশেষে পুষ্পাঞ্জলি। রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জন। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ঢাকের বােলে তালে তালে সবাই নাচতে নাচতে গিয়ে হারুদের পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এল। এইভাবে ভালাে-মন্দে সুখে-দুঃখে অংশুমানের জীবন কাটছিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসও বাড়ছে। ক্লাস সেভেনে উঠে টি.আরজি.আর খেমকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিক্সে প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য অংশুমান এক বই’ পুরস্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে দেখিয়ে সে কি আনন্দ তার। এখনও সব কথা মনে আছে। অংশুমান বন্ধুদের সাথে রেইনের পাশের রাস্তা ধরে স্কুলে যেত। কোনােদিন স্কুল কামাই ত না। তার জন্য শিক্ষক মশাইরা তাকে খুব ভালােবাসতেন।



***********************************************

আগামী পর্বে 

************************************************



 সুদীপ ঘোষাল 

সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প  দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব  বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ  ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত




উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল

  



 

[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * ১১

বিশ্বনাথ পাল


সতেরো 

এর মাস ছয়েক পরের ঘটনা। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। দুপুরে আমি যথারীতি স্কুলে গিয়েছি। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ওপারে আমার বোনের গলায় বেশ উত্তেজনা, হাইকোর্ট থেকে তোর একটা চিঠি এসেছে। তোর চাকরির অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার।

কেমন সন্দেহ হল। আমার বোন কী পড়তে কী পড়েছে তার ঠিক নেই। বললাম, তুই একবার পড় তো কী লিখেছে।

ও পড়তে শুরু করল, সোমনাথ  পাল, ইস হেয়ারবাই অফারড অ্যান অ্যাপয়ন্টমেন্ট টু দ্য পোস্ট অব লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট...।

ওকে থামালাম, আর পড়তে হবে না।

নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। হাইকোর্টের লোক নেওয়া তো হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমার নামে আবার অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার আসার মানে কী? কে জানে বাবা! অত ভেবে কাজ নেই। ওপরওয়ালার কারিশ্মা বোঝা দায়।

ভাবলাম, এই খুশির খবর এখনই কাউকে দেব না। আগে বাড়িতে গিয়ে নিজে চোখে নিয়োগপত্রটা দেখি, তারপর না হয় বলা যাবে। তা ছাড়া খবরটা যদি ভুঁয়ো হয়, পাঁচকান করার পরে যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয়, লজ্জার একশেষ।

ভাবলাম বটে, কিন্তু স্টাফরুমের দিকে যেতেই অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা। এবং তাকে খুশির খবরটা দিয়েই দিলাম। স্যারও বেশ খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। তারপর বললাম চন্দনদাকে। চন্দনদা তো আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

বাড়ি ফিরে দেখি বোনের কথা সত্যি। হাইকোর্টের অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে আছে একটা মেডিকেল এক্সামিনেশনের প্রোফর্মা। ওটা কোনও সরকারি ডাক্তারের দ্বারা পূরণ করে শিগগির হাইকোর্টে জয়েন করতে বলেছে।

পরদিন শুক্রবার।অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারটা স্কুলে নিয়ে অমলেন্দুবাবুকে দেখালাম। উনি পড়ে বললেন,“আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমেটির সেক্রেটারি প্রদীপবাবু আজ স্কুলে আসবেন। ওঁর বন্ধু ডাক্তার এবং সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে উঁচু পদে আছেন। প্রদীবাবুর সঙ্গে তুই কথা বল, তোর মেডিকেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বিকেলে সেক্রেটারি প্রদীপবাবু স্কুলে আসলে আমি তাঁকে আমার চাকরির কথা বলি এবং অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারও দেখাই। উনি আমাকে একটি চিঠি লিখে দিলেন। তাঁর ডাক্তা্র-বন্ধু দিবাকরবাবুউদ্দেশে লেখা। আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট করে দেওয়ার অনুরোধ।দিবাকরবাবু স্কুলের কাছাকাছিই থাকেন। তাঁর বাড়ির অবস্থানও আমাকে বুঝিয়ে দিলেন প্রদীপবাবু।

স্কুলছুটির পর অন্যান্য দিন বাড়ি চলে আসি। সেদিন স্কুলেই খানিক অপেক্ষার পর সাইকেল নিয়ে ছুটলাম দিবাকরবাবুর বাড়ি। অরিন্দমদা বলে যারা বাড়ি গিয়ে টিউশন পড়ায়, হাতে ঠিকানা থাকলে তাদের বাড়ি খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। আমারও হল না। দিবাবকরবাবু আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার মন দিয়ে দেখে বললেন, মেডিকেল সার্টিফিকেটের প্রোফর্মাটা আমার কাছে থাক। তুমি সোমবার দিন সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। চেনো তো? শিয়ালদায় এন আর এসের পাশে। আমার নাম দিবাকর স্যানাল বললেই যে কেউ আমার ঘর দেখিয়ে দেবে।

সোমবার স্কুলে না গিয়ে ছুটলাম শিয়ালদা। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে দিবাকর স্যানালের ঘর খুঁজে পেতে কোনও বেগ পেতে হল না। দিবাকরবাবু সত্যিই খুব উঁচু পদাধিকারী। ডেপুটি ডিরেক্টর। ঘরের দরজায় নামফলক। উনি দেখলাম প্রোফর্মা অনুসারে আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট টাইপ করিয়ে রেখেছেন। কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই কাগজটা হাতে তুলে দিলেন। আমি প্রণাম করতেই ডান হাতটা আশির্বাদের ভঙ্গিতে উঁচু করে বললেন, মন দিয়ে কাজ করো।

মঙ্গলবার ছুটলাম হাইকোর্টে। বাঙালের হাইকোর্ট দর্শনের যে বাকি ছিল তা পূর্ণ করতে। ঠাকুরের আসনে সমস্ত ঠাকুর-দেবতার পাশাপাশি বাবার ছবিতেও প্রণাম করলাম। প্রণাম করলাম মা-কেও। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগেও মাকে প্রণাম করে যেতাম। এটা আমার বরাবরের অভ্যেস। সরকারি চাকরিতে প্রথম দিন। মনে আনন্দ মেশানো উত্তেজনার পাশাপাশি সংশয়ের ঢেউ। কী জানি কপালে কী আছে। ঠিকঠাক জয়েন করতে পারব তো? নাকি গিয়ে শুনব অমুক কাগজ লাগবে, তমুক রিপোর্ট আনোনি কেন? এমনিতে আমার নিজের সম্বন্ধে খুব ভাল ধারণা নেই। কোনও কাজ প্রথম বারের চেষ্টায় আমার ক’বার হয়েছে তা বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। কিংবা হয়তো গিয়ে শুনব চিঠিটা ভুল করে আমার ঠিকানায় চলে গিয়েছে। সত্যি সত্যি চাকরি আমার হয়নি। আমার কাঁধের ব্যাগেঅ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার ও মেডিকেল সার্টিফিকেট। সঙ্গে আরও কাগজপত্র। যেমন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির মার্কশীট, সার্টিফিকেট। যদি দেখতে চায়। যদিও ইন্টারভিউয়ের দিন এগুলি একবার ভেরিফাই হয়েছিল। এসপ্লানেড পর্যন্ত মেট্রোতে গিয়ে বাকি রাস্তা রাজভবন, আকাশবাণীর পাশ দিয়ে হেঁটেই পৌঁছলাম। রাজভবনের পাশ দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালই লাগল। মনে হল বিশাল কোনও বাগানবাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছি। বড় বড় গাছের ডালপালা গ্রিলের রেলিং টপকে ফুটপাতটাকে ছায়াময় করে রেখেছে। 

কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে গ্রাউন্ডফ্লোরে এস্টাবলিশমেন্ট সেকশন খুঁজে বার করলাম। সেখানকার বড়বাবুই আমার জয়েনিং-এর ব্যবস্থা করবেন। মাথায় হালকা টাক, লম্বা, মধ্যবয়স্ক বড়বাবু আমার হাত থেকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারটা নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা ইন্টারভিঊয়ের পরে আমি রেজাল্ট দেখতে এসেছিলাম। দেখেছি আমার চাকরি হয়নি। তাহলে আবার এখন অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার ইস্যু হল কী করে?

বড়বাবু বললন, যাদের চাকরি হয়েছিল, তাদের মধ্যে একটি ছেলে পুরনো চাকরি ছেড়ে এখানে জয়েন করেনি। আর তাই ছ’মাস অপেক্ষা করার পরে ওয়েটিং লিস্টের প্রথম জনকে চাকরির অফার করা হল। বুঝলে তুমিই ছিল ওয়েটিং লিস্টে এক নম্বরে।

আমার দিদির কথা মনে পড়ল। দিদি বলেছিল, দেখবি এই পরীক্ষাতেই তোর চাকরি হয়ে যাবে। সেই কথা যে এভাবে ফলে যাবে— কল্পনাও করতে পারিনি। মনে মনে ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানালাম। তোমার কারিশ্মা সত্যিই বোঝা দায়।

ফাইলপত্তর বগলদাবা করে নিয়ে খানিকক্ষণ পরে বড়বাবু আমাকে নিয়ে ছুটলেন দোতলায় রেজিস্টার জেনারেলের ঘরে। হাইকোর্টের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তা। এমনিতে পদমর্যাদায় সর্বোচ্চ স্থানে প্রধান বিচারপতি। দোতলার একটা বেশ বড় ঘরে ঢুকলাম।  রেজিস্টার জেনারেলের টেবিলের সামনে আরেক ভদ্রলোক বসে আছেন। কালো কোর্ট গায়ে। তিনি আমার কোয়ালিফিকেশন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ইকনমিক্সে এমএস-সি.।

শুনেই তিনি রেজিস্টার জেনারেল স্যারকে বললেন, এই ছেলেটিকে আমাকে দাও। সুধন্য ছেলেটা ঠিকমতো কাজ করতে চাইছে না। ওকে ক্রিমিনালে ট্রান্সফার করে দাও।

রেজিস্টার জেনারেলের গলায় সংশয় ভেসে উঠল,“ইকনমিক্সে এম. এস-সি…. এখানে থাকলে হয়।

এবার বড়বাবু আমাকে নিয়ে চললেন তিনতলায় অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে। সেখানেই আমি কাজে যোগ দেব। রেজিস্টার জেনারেলের ঘরে আমাকে যিনি চাইলেন বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করে তাঁর পরিচয় জানলাম। তিনি রেজিস্টার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের প্রশাসনিক প্রধান।

হাইকোর্টের অ্যাপিলেড সাইডের অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে সুধন্যবাবুর টেবিলে আমার বসার ব্যবস্থা হল। হঠাৎ বদলির নির্দেশে সুধন্যদা যে একেবারেই খুশি নন আমাকে তা বুঝিয়ে দিলেন কোনও চার্জ না বুঝিয়ে। 

যাইহোক, হাইকোর্টের মেন বিল্ডিঙের তিনতলার একটা বড় ঘর হল অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশন। সেখানকার সর্বোচ্চ আধিকারিক অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার নিখিলবাবু। বড় ঘরটার এক কর্নারে কাঠের পার্টিশন বসিয়ে তাঁর জন্য একটি চেম্বার করা। সামনের দিকে পর্দা। খুবই নিরীহ মানুষ, কোনও হাবভাব নেই। কারণটা বোধহয় কেরানি থেকে প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে ওইপদে গেছেন, তাই অহংকার ছুঁতে পারেনি। জামা গুঁজে পরেন না। পায়ে চামড়ার চটি। অথচ প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করা অনেক নারী-পুরুষকে দেখতাম কী ফিটফাট হয়ে অফিস যান। গলায় টাইয়ের পেণ্ডলাম, পায়ের জুতোয় মুখ দেখা যায়। আমার বেশ ভাল লাগল। মনে হল সরকারি চাকরিতে বাইরের প্যাকেজিং নয়, ভেতরের গুণমাণ বিচার্য। নিখিলবাবুর দিকে মুখ করে পরদা থেকে দু-তিন মিটার দূরে আমার টেবিল।

আমার সহসা উপস্থিতিতে কিছুক্ষণের জন্য ঘরটায় যেন এক হইহই কান্ড। আমার সামনের টেবিলের সমীরণদা চেঁচিয়ে আনন্দপ্রকাশ করছে টি-ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হল বলে। জাকিরদা চা করে এনে খাওয়াল। প্রথম দিনের আতিথেয়তা। সমীরণদাকে দেখলাম অনেকে টি-ক্লাবের ম্যানেজার বলে ডাকল। বুঝলাম চা খাওয়ার মাসিক চাঁদা ওকেই দিতে হয়। জাকিরদা ঘরের এক কোণে টেবিলে ইলেকট্রিক কেটলিতে চা বানিয়ে পরিবেশন করে। প্রত্যেকেরই টেবিলের ড্রয়ারে নিজস্ব পেয়ালা। সমীরণদা আমাকে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। প্রায় চোদ্দ-পনেরো জন। প্রথম চোটে সকলের নাম আমার মুখস্ত হল না। যাইহোক, প্রথম দিনের আন্তরিক উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাকে মুগ্ধ করল।

প্রথম দিন কাজ সামান্যই করতে হল। একটা নোটশীট লেখা। ফেরার সময় ক্ষুদিরামের মূর্তি যখনঅতিক্রম করেছি দেখি হেড স্যারের ফোন। ধরলাম, হ্যাঁ স্যার বলুন।

তুই হাইকোর্টের পাশে কোনও অফিসে চাকরি পেয়েছিস, না?

বললাম, না স্যার। হাইকোর্টেই চাকরি পেয়েছি।

স্যারের কথা শুনে মনে হল তাঁর স্কুলের প্যারাটিচার ছেলেটি যে সত্যি সত্যি হাইকোর্টে চাকরি পেয়েছে তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। হোক না ক্লার্কের কাজ, কিন্তু হাইকোর্ট তো।

 

সুধন্যদা তো আমাকে কোনও চার্জ তো বুঝিয়ে দিয়ে গেল না। কিন্তু আমার টেবিলের বাঁদিকে পেয়ে গেলাম সুশোভনদাকে। সেও একজন ইউ ডি এ বা আপার ডিভিশন অ্যাসিট্যান্ট। হাইকোর্টে নোটশীট লেখার যে বিশেষ রীতি পদ্ধতি, সুশোভনদা আমাকে তা ভাল করে বুঝিয়ে দিল।

রাজ্য সিভিল সার্ভিসের থেকে পদমর্যাদায় সামান্য উপরে আরেকটি সার্ভিসের নাম ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিসিয়াল সার্ভিস বা সংক্ষেপে ডবলুবিজেএস। পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত এই পরীক্ষায় পাশ করে যারা, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বিভিন্ন জেলা বা মহকুমা আদালতে পোষ্টিং পান তাঁদের নিয়োগ, ছুটি ও জমি-বাড়ি কেনার আবেদনসহ নানান কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব হাইকোর্টের অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের। অর্থাৎ জেলা আদালতের বিচারকদের হেড অফিস যেন হাইকোর্ট। অথচ কোর্ট বলতে এতদিন তো বিচারালয় বুঝতাম যেখানে  কালো আলখাল্লা পড়ে বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলরা সওয়াল-জবাব করেন। আর উঁচু বেদীতে বসে বিচারক সব পক্ষের বক্তব্য শোনেন। শৃঙ্খলায় গোলযোগ বা বিঘ্ন দেখা দিলেকাঠের হাতুড়ি টেবিলে পিটিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলেন ‘অর্ডার’ ‘অর্ডার’ বলে। সমস্ত পক্ষের সমস্ত বিষয় শোনা হয়ে গেলে রায়দানের দিন ঘোষণা করেন এবং নির্দিষ্ট দিনে রায় দেন। কোর্ট সম্পর্কে এই ধারণা গড়ে উঠেছে বাংলা বা হিন্দি সিনেমার সৌজন্যে।

কিন্তু এর বাইরেও যে কোর্টের বিশাল কর্মকাণ্ড, তা বুঝতে পারলাম চাকরি করতে এসে। আমার উপরে দায়িত্ব বর্তাল জেলা আদালতের বিভিন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অর্জিত ছুটি, তাঁদের জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার আবেদন, তাঁদের বিদেশযাত্রার অনুমতি চেয়ে আবেদন ইত্যাদি সংক্রান্ত ফাইলগুলির। ধরাযাক কেউ ফ্ল্যাট কিনবেন বলে আবেদন করেছেন। সেক্ষেত্রে বেতনের টাকা থেকে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে যে টাকা হাতে থাকবে তাতে তাঁর সংসার চলবে কিনা তারও আনুমানিক হিসেব কষে নোটশীট করতে হত। আমার বেশ মজাই লাগত। চাকরি মানেই বোরিং ব্যাপার নয়। এখানেও ফাইলে ফাইলে গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে। তো, সেই নোটশীট প্রথমে বড়বাবু, তারপর সেকশন অফিসার, তারপর অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টারের টেবিল হয়ে পৌঁছত রেজিস্টার অ্যাডিমিনিস্ট্রেশন মানেমহেশ্বর ঘোষের চেম্বারে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী জাকিরদা ফাইল নিয়ে যেত ঘোষ সাহেবের কাছে। কখনও কোনও জরুরিকথা বলার থাকলে আমি নিজেও যেতাম বা তাঁর কিছু জানার থাকলে ডেকে পাঠাতেন যদি আরও কোনও ডকুমেন্ট চাওয়ার থাকে আবেদনকারীর কাছে তাহলে রেজিস্টার সাহেব তা নোটশীটে লিখে ফাইল ফেরত পাঠাতেন। সেই নির্দেশ মেনে আমার করা চিঠি ডেসপ্যাচের মাধ্যমে যেত সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর কাছে। ইন্টারনেট সেসময় চালু হলেও এমন বহুল প্রচলিত হয়নি। অন্তত সরকারি ব্যবস্থায়। আর যদি নতুন কোনও ডকুমেন্টের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে রেজিস্টার সাহেব নোটশীট অনুমোদন করে লে নোট লেখার নির্দেশ দিতেন। আমাকেই লিখতে হত রেজিস্টার জেনারেলের জবানিতে। লেখা হলে এবং যদি কোনও সংশোধন না থাকে তবে রেজিস্টার সাহেব সেই লে নোট’-এ স্বাক্ষর করে ফাইলটি নিয়ে যেতেন মাননীয় বিচারকের কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। সেসময় এমন একজন বিচারক ছিলেন অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের দায়িত্বে, গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়দানের সূত্রে যাঁর নাম প্রায়ই খবরের কাগজে আসত। পুরো ব্যাপারটাই লিখতে হত ইংরেজি ভাষায়। আর হাইকোর্টের ইংরেজি লেখার একটা বাঁধা গত আছে, যা আমাকে বুঝতে সাহায্য করল সুশোভনদা। বুঝলাম ইন্টারভিউতে আমাকে কেন হায়ার সেকেন্ডারিতে ইংরেজির নম্বর জানতে চাওয়া হয়েছিল।

অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে আমার সম বয়সি এবং আমারই ব্যাচের দু-জন সহকর্মী পেলাম। সুবিমল ও শংকর। তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য তারা আমার থেকে ছ’মাস আগে কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু বেশ বন্ধুত্ব হল এই ছেলে দুটির সঙ্গে। একদিন শংকরের করা প্রশ্নে উত্তরে জানালাম বাড়িতে কে কে আছে। বলল, সোমনাথ, তোমার বাবা নেই আর আমার মা নেই। ছোট বেলায় মা মারা গেছেন।

সুবিমলের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। এখানে বেলঘড়িয়ায় এক মেসে থেকে অফিস করে আর সপ্তাহান্তে বাড়ি যায়। আমাকে ওদের বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল।

হাইকোর্টের লোকজন আমাকে বেশ আপন করে নিল। তিনজন দিদিকেও পেলাম—সুতপাদি, গীতাদি, ও রঞ্জনাদি। এছাড়াও দাদা হিসেবে আরও অনেককে। তাদের মধ্যে অন্যতম আমার পাশের টেবিলের সুশোভনদা।

সুশোভনদা খুব মন দিয়ে কাজ করত যেমন আবার সহকর্মীদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কিও মারত। তবে তা কখনও কাউকে কষ্ট দিত না। স্কুলে পড়াতে গিয়ে যেমন দেখেছি কাউকে কষ্ট দিয়ে, চক ছুঁড়ে আনন্দলাভ, এখানে তা বিরল। সুশোভনদা একদিন আমাকে কর্মচারী সংগঠনের সদস্য হতে বলল। শাসকদলের মতাদর্শী সংগঠন। তখন সারা রাজ্য জুড়ে বিরোধিতার ঝড়   বইছে। বিরোধী জোটের নেতৃত্বে জনমানসেও তার তীব্র প্রভাব। জমি আন্দোলন তুঙ্গে। শিল্পের জন্য দুই ফসলী তিন ফসলী জমি কিছুতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। অপর পক্ষের যুক্তি শিল্পের মাধ্যমে বেকার ছেলে-মেয়েদের কর্ম সংস্থান হবে। জমি না নিলে শিল্প কি আকাশে হবে? আমার মনের পালেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারহাওয়া।কিন্তু তা সত্ত্বেও সুশোভনদার কথায় না করতে পারলাম না। শাসকপন্থী কর্মচারী সংগঠনের সদস্য হয়ে গেলাম। হওয়ার আগে মনে পড়ল অমলেন্দুবাবুর একটা কথা। হাইকোর্টে চাকরির নিয়োগপত্র আসার পর বলেছিলেন, শোন, তোকে একটা কথা বলি। ওখানে গেলে পরেই তোকে কর্মী-সংগঠেনের সদস্য হতে বলবে। তুই কিন্তু হয়ে যাবি, না করবি না। এমন অনেকেই আছে যারা পাড়ায় বিরোধী দলের সমর্থক, কিন্তু অফিসে বড় সংগঠনের সদস্য।

স্যার আমার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই হয়তো এমন পরামর্শ দিয়েছেন। তো, যাইহোক, সুশোভনদাকে একদিন টেবিলে মাথা গুঁজে খুব মন দিয়ে কাজ করতে দেখে বলেই ফেললাম, তোমাকে কখনও ফাঁকি মারতে দেখি না।

বলল, দ্যাখ, মাস গেলে কুড়ি হাজার টাকা থুতু দিয়ে গুণে নিয়ে যাই। আমার থেকে আরও অনেক কোয়ালিফাইড ছেলেমেয়ে বাজারে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে। কাজ পায়নি। আমি পেয়েছি—ভাগ্যবান। কাজ করব না কেন রে?

সুশোভনদার এই উত্তর আমার বেশ লাগল। ভাবলাম, অনেকে যে বলে হাইকোর্ট খুব ঘুষের জায়গা, তারা বোধহয় ঠিক জানে না। পুরো ব্যবস্থাটা ঘুণধরা নয়। হয়তো বেশির ভাগ মানুষেরই প্রবণতা সৎ। কিন্তু তা প্রচারযোগ্য হয় না।

হাইকোর্টে যোগ দেওয়ার দিন দশেক পরে একদিন স্কুল থেকে ফোন পেলাম। অমলেন্দুবাবুর গলা, শোন, আগামী শনিবার তোর অফিস আছে?

বললাম, না স্যার, সেকেন্ড সাটারডে, ছুটি।

বেশ। তাহলে ওইদিন দুপুর দেড়টা নাগাদ তুই স্কুলে চলে আয়। দুটোর সময় তোকে আমরা ফেয়ার ওয়েল দেব।

ফেয়ারওয়েলে স্কুল থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই, পার্কারের পেন, ফুলের তোড়া ও মিস্টি উপহার পেলাম। স্যাররা আমার সম্বন্ধে ভাল ভাল কথা বললে। আমাকেও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হল। না, কোনও তিক্ততা ছিল না সেই বক্তব্যে। কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করলাম—

পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই—

সবারে আমি প্রণাম করে যাই।।

ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি রাখি না আর ঘরের দাবি

                  সবার আজি প্রসাদবাণী চাই

অনেকদিন ছিলাম প্রতিবেশী,

দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।

প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি, নিবিয়া গেল কোণের বাতি—

পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই।



*******************************************************************************************


আগামী পর্বে 

*************************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়




['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৮  

দীপংকর রায়

     

      

শুরু হয়ে গেল কালীকে সন্তানসম্ভবা করার লড়াই। আর অন্য দিকে নিতাইদার সঙ্গ পেয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি। যে কোনো দিকে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যখন তখন । সুযোগ পেলেই সিনেমা হলে ঢুকে পড়া। না হলে সন্ধ্যাবেলা ঊনিশ পয়সার তাঁবুতে। যা পাওয়া যায় সেটাই দেখা চাই। আসা যাওয়ার পথে বিপ্লবাত্মক আলোচনা। 

           রাশিয়ান সাহিত্যের জোগানদারও নিতাইদা। তাতেও মন ভরছে না। বাংলা অনুবাদে পড়ছি যদিও। ঝরঝরে গদ্য। কোথাও কোনো জটিলতা নেই। সে একেবারে ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে তলস্তয়, পুশকিন লেলিনের জীবনকথাও…. গোর্কির মা পড়ে অনেক জায়গায় ভীষণ ভালো লাগছে। আবার কিছু জায়গায় অনেকটাই বুঝতে পারছি না। তলস্তয়ও একই দশা। পড়তে বাধছে না। অর্থ বুঝতে বেশ ধাক্কা খাচ্ছি। ওদিকে কার্ল মার্কসের জীবন কথা, পথে চলতে চলতে নিতাইদার মুখ থেকে গল্পের মাধ্যমে শুনছি। যদিও আমার ভেতরে কেন জানি না ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে গড়ে ওঠা যে কোনো কাহিনীই—- আমাকেও সেই সময়ের একজন তৈরি করে নেয় মনেমনে। সুভাষ বোসের জীবন পড়ে, বিনয় বাদল দীনেশের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের আগের মুহুর্তের কাহিনী পড়ে, থরথর করে কাঁপতে থাকি আবেগে। মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন পড়ে, সেই সময়ের সহযাত্রী হয়ে যাই যেন মনে মনে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াই যে…. তার ঠিক থাকে না। আর এই সব কারণেই হয়ত পরবর্তীতে আমার লেখালেখির মোড়ও ঘুরে যেতে দেখি একেবারে ।

        

          এভাবেই চলছিলো । 


          ওদিকে সামনের বাড়ির মাসিমাদের সম্প্রতি তৈরি হওয়া পাকা ঘরের পেছনের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু যে সব ঝাউগাছ গুলির আকাশছোঁয়া দোলা লাগানো চেহারা, তাতে একেকটি ঋতু পরিবর্তনের আবহে যে যে পটভূমি তৈরি হয়ে ওঠে…. ঐ ঝাউগাছ গুলির মাথা নাড়া দুলুনিতে, তাতে কত চাঁদনি রাত থাকে…. কতো আলো অন্ধকার ….  কতো অন্ধকার রাতের নক্ষত্রলোকে উঁকিঝুঁকির ভেতর কতো আকাশ কালো হয়… সাদা …  নীল হয়.. আমার চেতনালোক জুড়ে, তাঁদের জানা অজানা কতো ভাবাবেগের ভেতর যে, এই বাড়ির এই একটুকরো বারান্দার কোণাটায় বসে বসে একটি প্রাণের কত রকমের জগত তৈরি হয় যে, সে খবর কেই বা রাখে! আর সে সব কি বলে-কয়ে কারো কাছে হালকা হবার জিনিস? সে কথা তো সেই জানে একমাত্র, যাকে বহন করে চলি ভেতরে ভেতরে। অন্য কাউকে তো সেসব বুঝোনো যায় না বলে! 


         বৃষ্টি হয় সমস্ত রাত। কুয়াশায় কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায় চারদিক। মাসিমাদের বাড়ির স্থলপদ্ম করবী গাছটির থেকে কী যে অপূর্ব সুবাস ভেসে আসে, অনুভব করি সবটাই দূর থেকে—  কাছে না যেয়েও যেন কতো সুগন্ধ পাই!


         সমস্ত আবহ জুড়ে এই যে শহরতলীর রূপ, সদ্য সেজে ওঠা পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে একটু একটু করে নাগরিক চাহিদারা এসে  সকাল সন্ধ্যা ছোটাছুটি করে যেন কত রূপে… ! এটা ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসে নতুন সময় কত বস্তুতে রঙ্গিন করে তুলছে যে একেকটি গৃহকোণও ; যেন কতো মঞ্জুরিতে মঞ্জুরিতে ভরে উঠছে সমস্ত উঠোনময় তুলসী গাছগুলিও… ।  কৃষ্ণকলি ফুলে ফুলে ছেয়ে যাচ্ছে দেখি এক একটি গৃহপ্রাঙ্গন। আর তার মধ্যেই মাথা গলিয়ে ঢুকে পড়ছে এক একটি বাড়িতে এক এক ধরণের আধুনিক আসবাবপত্রের সরঞ্জাম। কারো বা বাড়ির সিমেন্টের মেঝে ভেঙ্গে পাথর বসছে। তার  ঘসঘস শব্দে সমস্ত পাড়া প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে। কারো বাড়িতে নতুন টেলিভিশন আসছে। তার আওয়াজে গমগম করে উঠছে চারদিকটা। বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াতের পথে মানুষজন খানিকটা সময় সেই বাড়ির খোলা জানলায় একটুখানি থমকে দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছে কী কী নতুন অনুষ্ঠান চলছে এখন টেলিভিশনে।


          অথচ এইতো, কিছুদিন আগেও দুবেলা আকাশবাণী বিভিদভারতীর অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে সুড়কির রাস্তা পার করতো কত মানুষজন! আর আজ সেখানে টেলিভিশনের সকাল সন্ধ্যা কলকাকলি। একেবারে সোরগোল পড়ে গেছে চারদিকে। আর এখনো যাদের এইসব ঘরে আসেনি, তারাও অন্য বাড়িতে তাদের ঘরের ভেতর বসে পড়ছে টেলিভিশন দেখতে হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে।   ওদিকে কারো বাড়িতে ঠেলাগাড়ি চড়ে কিংম্বা সাইকেল ভ্যানে চড়ে মস্ত ঠান্ডা মেশিন এসে যায় দেখি  একেবারে মাথা উঁচু করে।


           সবটাই কি এই বারান্দাও আমার সঙ্গে সঙ্গে বসে বসে দেখে? যেমন মাসিমাদের বাড়ির পেছনের ঝাউ গাছগুলিদের সারি আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় কোথায় কোথায় ইচ্ছে মতোন অনুভবের রথে চড়িয়ে নিয়ে …. ! তেমনি হঠাৎ হঠাৎ আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে যে প্রতিবেশীরা এখন বেশ একটু অন্যরকমভাবে আধুনিক হয়ে উঠছে, তাদের হাঁটাচলা কথাবার্তা সবই নজরে পড়ে। যদিও আমাদের এসব কেনার ক্ষমতা নেই। কিংম্বা হয়তো চাহিদার কথাও ওঠে না কখনো। সেই সকাল-সন্ধ্যা বা দুপুরবেলা গুলিতে যেভাবে সেই ইলেকট্রিক রেডিওটা চালিয়ে দিয়ে যেটুকু গানবাজনা খবর-টবর শোনাশুনি… । শোনা, বিভিদভারতীর গানের অনুষ্ঠান। কখনো কখনো ছুটিছাটার দিনে বোরোলিনের সংসার। বারোটা বাজলে এইসবের মধ্যেই কয়লার উনুনের ধোঁয়ায় ভরে যায় মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত বাড়িটাই। খানিকটা সময় একটা দমবন্ধ অবস্থা চলতে থাকে। আবার কিছুক্ষণ বাদেই সব স্বাভাবিক। চায়ের মগ নিয়ে বসে দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে বিসনি ভাই তার দেশের গল্প বলে। একেকদিন কাজের দিদি সকাল সন্ধ্যায় তাঁর একমাত্র বোনঝির সংসারেই তার শেষ আশ্রয় যে, সেই সব কথা গল্প করে বলে। ডান পাশের লম্বা গোরুর ঘরের যে অংশের কোণায় দানাভুসি বিচালী থাকে, কিম্বা যেখানটায় গোরুর জাবনার টবগুলিতে দুইহাত প্রবেশ করিয়ে বিসনি ভাই জাবনা মাখিয়ে  গোরুগুলির মুখের সামনে ধরে, সেই জায়গাটায় সকাল-সন্ধ্যায় যে রৌদ্র-ছায়া চলাচল করে, সেখানেও আমি যেন কতো কথার মালা গাঁথতে বসি আপন মনে একাকী ….। 

    

            সময়ের ব্যবহারিক এইসব  সরঞ্জামের সরাসরি একটা প্রভাব মানুষজনের ভেতরে অনুভব করতেই হয়। তার টান একেবারে যে আমাদের ভেতরেও কখনো পড়ে না, তেমনটা নয়। দিদির বাড়িতে তো সেসব সব অনেক আগেই প্রবেশ করেছে। তাদের ওখানে গেলে গরমের সময় ফ্রিজের জল খেতেও তো বেশ লাগে। একগ্লাস সরবতও পেয়ে যাই মাঝে-মধ্যেই। 

             টেলিভিশনে সন্ধ্যার দিকে বাংলা সিনেমার টানেও তো মাঝে-মধ্যেই ওর ওখানে যেয়ে উপস্থিত হই । তাতে ভাগ্নেদের সঙ্গে সময় কাটানোও তো বাড়তি একটা টান। মাও তো তাঁর অফিস ফেরত ঐদিক দিয়েই রোজকার ঘুরে যাওয়া-যায়ি থাকেই, এ ছাড়াও কখনো কখনো দিদির ফোন পেলেই ছুটে আসে এই বলে,‘ঠিক আছে তোরা বেরিয়ে যা। ছায়া তো রয়েছে। আমি ঠিক সময় মতো তোদের ওখানে পৌঁছে যাবো।’

     

          এ ঘটনা প্রায়শই ঘটে। তার বিশেষ কারণ হলো ওদের একটু এদিক ওদিকে বাইরে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করতে বেরোনো নিশ্চন্তে। মাও ওদের ওখানে সেই সময়টুকু উপস্থিত থাকলে, ছেলেদের রেখে বাইরে চলে যাবে যে দিদিরা একা ছায়ার উপরে রেখে দিয়ে, সেখানে মা থাকলে, সেও নিশ্চিন্তে বাইরে যেতে পারে এই আর কি।

 

           এই বিষয়টি ছাড়াও মায়ের অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে একবার মেয়ের ওখানে হয়ে বাড়ি ফিরলেই মানসিক শান্তিও বটে। তাই এটা প্রায় একরকম রোজকার রুটিনই বলা চলে। তাই এইসব ক্ষেত্রে দিদি ফিরে এলেও মা আরো কিছুক্ষণ মেয়ের বাড়িতে কাটিয়ে টেলিভিশন দেখে-টেখে রাত দশটা এগারোটা বাজিয়ে তারপর ঘরে ফেরার কথাটা ভাবে হয়তো।

             তাই  সেসব ভেবে আমার দিদির বাড়িতে যেতে ইচ্ছে থাকলেও নানা চিন্তাই করতাম যেতে। ভাবতাম আমি যদি এরকম প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ফিরি, তাহলে এদিকের অবস্থাটা কী হয়। একে তো ছোটো ভাই স্কুল থেকে ফিরে স্কুল ব্যাগটিকে খাটের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোনোরকমে নাকেমুখে দুটো ভাত তরিতরকারি গুঁজে দিয়ে সেই যে খেলার মাঠের দিকে ছুটলো, এরপর সন্ধ্যা ঘুরে গেলে এক হাঁটু কাদা মেখে ধুলো মেখে বাড়ি ফেরে। তার পরে কোনোরকমে গায়ে হাত-পায়ে জল ঢেলে সেই যে বিছানায় এলিয়ে পড়লো, আর ওঠার নাম গন্ধ থাকে না তার। মা প্রায় দিনই বাড়ি ফিরে তাকে ডেকে-ডুকে রাতের খাবার খেতে তুলবে এসে। তখন তার চোখে ঘুম। মা ডাকাডাকি করলেও কোনোদিন উঠে ঘুম চোখে খায় তো কোনোদিন উঠতেই পারে না হয়তো। 

              তাহলে এমনটা প্রায়শই ঘটতে থাকলে পরের দিনের স্কুলের পড়া কখন আর মুখস্থ করবে সে। তাই পরের দিন যেটুকু হলো সেটুকুই হোলো। এর পর পিঠে ব্যাগ গলিয়ে নিয়ে কোনোরকমে নিয়মটা পালন করা তার। তা না হলে, আজ পড়া তৈরি হয়নি বলে সেদিনের মতো আর তার স্কুল মুখো যাওয়াই হলো না হয়ত।


            মাকে দেখেও বুঝি, সে যে এইসব নিয়ে ভাবে না তা না। কিন্তু তার জন্যে এখনি যে কঠিন ভূমিকা নিতে হবে তার ভালোর জন্যেই, সেটা ঠিক সেও পেরে ওঠে না। যে কোনো ভাবেই হোক সেও যেন নিজের জীবনে একটুখানি শান্তির খোঁজে, আনন্দের খোঁজে, দিদির বাড়ির টান, নাতিদের টানকে কোনোভাবেই এড়িয়ে থাকতে পারে না। 

             এই ক্ষেত্রে আমার ভূমিকাও খুবই অসহায়ের। রোজ সংসারের এই দুরবস্থার জন্যে ভেবে ভেবে যতোটা সংসারের এই জলস্রোতের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছি, আর ভাবছি নানা কথা। সে কি শুধুই ভাই-এর জন্যে? হয়ত না, নিজের জীবনটাকে নিয়েও ভাবছি। ভাবছি এই যে প্রথার বাইরে চলাতে গিয়ে, একটা অনিশ্চয়তাকে আলিঙ্গন করছি না কি আমিও?


            যদিও সেই একই পথের অনুসারী ছোটো ভাই তো নয় মোটেই! তাহলে? সে তো এখনো পড়াশোনার জীবনের প্রাথমিক স্তরটিও পেরোতে পারেনি। সেইটুকু না পেরিয়ে ও কী করবে? সেইসব ভাবনাও চলে আসছে এখন ভীষণ ভাবে। 

            এ ছাড়াও ইদানীং দেখতে পাচ্ছি সংসারের টাকাপয়সাও না-বলে এদিক ওদিক করে ফেলছে সে ফাঁক পেলেই, সংসারের জন্যে যেটুকু তোলা থাকে ঘরের আলমারিতে। প্রায় দিনই এইসব নিয়ে মায়ের অফিস যাওয়াই হয়তো বন্ধ হয়ে যায় একেকদিন। এরপর চিৎকার চেঁচামেচি হোইচোই ঝগড়া অশান্তি এসবও দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনো সমাধানের পথ খুঁজে বার করা যেন কারো পক্ষেও সম্ভব নয়। ইদানীং সে আমাকেও কিছু বললে গালিগালাজ করছে। হিংসা করছে। এও বলতে ছাড়ছে না,‘ তুই কি করিস? ঐ তো গোরু বাছুরের দানাভুসি আনা আর সারাদিন বই মুখে গুঁজে পড়ে থাকিস বিছানায় উপুড় হয়ে। এই তো তোর কাজ। ওতে তুই কোন দিগ্গজ হবি? তার আবার আমাকে বলতে আসিস।’  

   

            এই ভাষা ওর নয় তো! এই পরিস্থিতি কোনোদিন এদেশে এসেও তো আমি এতকাল অনুভব করিনি! ও যে এতোটা পাল্টে যাচ্ছে কীভাবে? সে ভেবে ভেবে নিজেও অসহায় হয়ে পড়ছি দিন দিন। 


            ‌ভীষণ অসহায় লাগছে। না পারি বোঝাতে, না পারি শাসন করতে। মনে মনে কষ্ট পাই। আবার ভাবি, ও তো ঠিকই বলেছে। আমি কি উচ্চ ডিগ্রি ধারণ করতে পেরেছি! না চেয়েছি? সত্যিই তো আমার এই লেখাপড়ার মূল্য কি? এর তো সামাজিক স্বীকৃতি নেই কোনো! আচ্ছা, সেটা যদি থাকতোও, তাহলেও কি ও আমার কথা শুনতো? না পাল্টে ফেলতো এই সব ধারণাগুলি ওর!

            শুধুই ভাবি। অথচ কী করেই বা বলি, ওরে, আমি যা যা করে কাটাই, যা নিয়ে পড়ে‌ থাকি‌, তুই যদি সেরকমেরও থাকতিস, তাহলে তোকে নিয়ে হয়ত এতটা চিন্তা থাকতো না। কারণ আর যাই হোক আজ যা তুই করছিস, সেটা অন্তত করতে পারতিস না। তুই আজ যে পথে বন্ধুবান্ধব সঙ্গ করে ছুটে চলেছিস। একদিন বুঝতে পারবি সত্যটি কতোটা কঠিন। কষ্ট পাবি। সেদিন কিন্তু তোর ফেরার আর কোনো উপায় থাকবে না।


            নানা ভাবে এইসব ভেবে ভেবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই তাকে এই কথাগুলি বোঝাতে পারছি না। চেষ্টা করছি। ভালো অবস্থায় একটুখানি পেলেই তাকে আর একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে দেখি। যদিও দেখছি সে সময় হয়তো বুঝলো বেশ শান্তভাবে। আবার নিয়মিত হলোও স্কুলে। কিছুদিন গেলেই আবার যে-কে সেই। অনিয়মের পাল্লা ভারি হয়ে উঠলো। পড়া তৈরি হয়নি বলে স্কুল কামাই। প্রাইভেট টিউশন দিতে এসে মাস্টার মশাই রাতে ছাত্রকে খুঁজে পায় না সময় মতো।


          এইসব নানা কিছু নিয়ে ভেবে ভেবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যেই দিদি খবর পাঠালো সে পাড়ার কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ-জনের সঙ্গে নেপাল ভ্রমণে যাবে। কিন্তু জামাইবাবু অশোকদা এই সময় সঙ্গে যেতে পারবে না তার। সেই জন্যে সে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়ছে। একেবারে এখান থেকে বাস-যোগে ভ্রমণ।


          সংসারের নানা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করবো! নানা কিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম।


          এক দিকে ছোটো ভাই-এর এলোমেলো চলাফেরা। স্কুল কামাই। এরপর কাজের লোকের সঙ্গেও ইদানীং নিত্য অশান্তি লেগেই আছে তার। কাজের লোকজনও বিগড়ে যাচ্ছে তার যখন তখন নানা ফাইফরমাজ খাটতে খাটতে। সবটা মিলে একটা খাপছাড়া পরিস্থিতি। 

           এ সব ভুলেও রাজি হয়ে গেলাম। একদিন একটা সকাল বেলায় ছোটো একটি ব্যাগের ভেতরে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে দিদির সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠে রওনা হলাম বেহালায়। যেখান থেকে বাস ছাড়বে সব যাত্রীদের একত্রিত করে নিয়ে। 

            বাস চললো বর্ধমান আসানসোল হয়ে। পথে এক জায়গায় দুপুরবেলার খাওয়া-দাওয়া করানো হলো সকলকে। জীবনে প্রথম চিনলাম ধাবা কাকে বলে। মনে মনে ভাবতে থাকলাম এই ধরণের পথের ধারের হোটেলগুলিকে ধাবা বলে কেন?


           ফাল্গুনের মাঝামাঝির দিকে যাত্রা করেছিলাম মনে আছে। কলকাতায় তখন বেশ গরম। অথচ মাঝ-রাতে বিহারের কোনো একটি জায়গায় বাস দাঁড় করিয়ে পেচ্ছাপ করবার সময় যখন দেওয়া হলো, বাস থেকে নেমে খুবই সাদামাটা ভাবে একটি পাতলা জামা ছিলো গায়ে, ওমা, একি! এ যে হাড় হিম করা ঠান্ডা! খুঁজে পাচ্ছিলাম না নিজেই নিজের পুরুষাঙ্গটি।


            তখন কেবলই মনে হচ্ছে, না এলেই মনে হয় ভালো ছিলো। অথচ কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে; এই সময়ে এখানে যেমন কলকাতার সঙ্গে একেবারে আলাদা আবহাওয়া। তেমনি কতো বিচিত্র স্বভাবের মানুষ-জনের সঙ্গ অনুভব করছি এর মধ্যেই। এগুলি কি ঘরে বসে থাকলে মিলতো? না জানতে পারতাম? তারপরে আরো কত বৈচিত্র্য আছে পড়ে! 


             বর্ধমান পর্যন্ত একরকমের ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি বাংলা দেশের জলহাওয়ার মধ্যেই রয়েছি। সন্ধ্যাবেলার দিকে বাস যখন আসানসোল পৌঁছালো, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলো, তখন থেকেই কেন যেন মনে হচ্ছিলো একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব চারদিকে। এর পর বিহার ঢুকলে, সেই রাতে যখন সকলেই পেচ্ছাপ করতে নামলো, আমার তো সে কি অবস্থা ঠান্ডায়, কি আর বলি! এই ফাল্গুন মাসের এই সময়ে কলকাতায় যখন ফ্যান চলছে, আর এখানে তখন এই রকমের হাড় হিম করা ঠান্ডা!

 

            অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বাস যখন রকসৌল বীরগঞ্জ বর্ডারে রাত্রি বাসের আয়োজনে দাঁড়ালো, তখন তো আর এক পরিস্থিতি। 

         এর আগের দিন তো সমস্ত রাত বাসের ভেতরেই কেটেছে। দুপুর বেলায়ও ঐ রকম পথের পাশে বিহারী ধাবায় খাটিয়ায় বসে মোরগার ঝোল আর চাল চাল ভাত। এবং পরদিন রাত্রে বীরগঞ্জের হোটেল। সম্ভবত সেটা নেপাল বর্ডার সংলগ্ন ছোট্ট একটি গঞ্জ শহর মতন হবে হয়তো। সেখানে যেয়ে আবার বিহারী খাদ্য খাবারের ঘরানাটিও একেবারে পাল্টে গেলো। সে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতি। একদিকে হোটেলে জায়গার সংকুলান না হওয়া, আর একদিকে রন্ধন প্রণালীতে যে বেস্বাদ সে যেন বর্ণনার বাইরে। সমস্ত রান্নাতে একটা উৎকট কীসের যেন গন্ধ। রসুনের কথা বললো পালদা। কেন যেন মনে হলো সবটা রসুনের দোষও না হয়ত। মুরগির মাংসে কামড় দিলে রক্ত-রঙের একটা লালচে লালচে  ভাব তখনো পর্যন্ত লেগে আছে যেন। মনে মনে ভাবছি, যে দেশে যেমন, কী আর করা …!  কিন্তু কথাটা একইরকম ভাষায় বললো খানিকটা পালদাই।

 

           পালদা আমাদের দিদিদের পাড়ার মোড়ের একমাত্র প্রতিষ্টিত মুদিখানার দোকানের মালিক। 

           এই পালদাই এখন আমাদের একমাত্র কাছের মানুষ। বাকি আর সকলেই তো অপরিচিত। 

           পালদা রসিক মানুষ ভারি। দেখতে একটু ছোটোখাটো স্থুলকায়, ভুরি আছে বেশ বড়সড় একটি। আর এই পালদার সম্পর্কে এক শ্যালক, যার সঙ্গে ইতিমধ্যে খানিকটা কথাবার্তা বলার মতো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেহেতু সে বয়সে আমার থেকে একটু বড়ো তাই তার প্রতিটি কথার মোড়কের মধ্যে তার নানা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের পরিধির একটা ইঙ্গিতপূর্ণ দেখনদারী ভাব তো চলছেই সবসময় কথা বার্তার মধ্যেই। প্রথম প্রথম তার সঙ্গে মিশতে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো। পরে ভেবে দেখলাম এই পথযাত্রায় এমন কেউই নেই যে আমার কিছুটা হলেও সমবয়সী। এ ছাড়া সে অফিসের কেরানি থেকে বড়বাবু মেজবাবু ছোটোবাবু মুদি মনোহারী জামাকাপড়ের দোকানদার থেকে একটুখানি উঁচু মহলের ছোটো বড় কর্তার ফ্যামেলিরাও আছে যদিও এই সঙ্গে। কিন্তু এমন একটি কোনো পরিবার বা এমন একজন কেউ নেই, যার চোখে চোখ রেখে, তার মুখের ঔজ্জ্বল্য মনকে একটুখানি আকৃষ্ট করতে পারে। তাই এই ছেলেটির সঙ্গে সঙ্গেই একটু এদিক ওদিক। বাস যখন কোথাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন আমরা একটু ঘোরাঘুরি করছি বা কথাবার্তা বলছি নিজেদের মতো কোনো একটা বিষয় নিয়ে। জানতে পারলাম সে সদ্য সদ্য আবহবার্তা বিভাগে চাকরিসূত্রে কাজকর্ম আরম্ভ করেছে। তার জানা-চেনা সবটাই বিজ্ঞান বিষয়ক। যেখানে শিল্প সাহিত্যের কোনো প্রবেশ পথ থাকার সুযোগ নেই একেবারেই। যদিও সে আবার প্রকৃতি প্রেমিক বলে দাবি করছে সবসময়। এই নিয়েই জানতে পারলাম তার এর আগে নানান জায়গায় ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা। 

           একেবারে আমার মতো আনকোরা নয়। তাই তার ঐ প্রকৃতি প্রেমের পথ ধরেই যা কিছু কথা বলাবলি একটুআধটু।

 

            দূরে দেখা যাচ্ছে যে প্রকান্ড গিরিশৃঙ্গ, সূর্য লাল হয়ে উঠছে ভোরের বেলায় ….  তার একটি বর্ণনা দিলো সে এরকমই — ঐ যে দেখছো পাহাড়টা, কতো কাছে মনে হচ্ছে না? 



************-**********************************

আগামী পর্বে

***********************************************


জীবন সরখেল




জীবন সরখেল * দুটি কবিতা 


 বৈশাখ 

শিরোধার্য পরিবর্তনসূত্রেই মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণের বদলে গেল 

স্থানাঙ্ক; 

মধুসূদন ওরফে মাধবমাসের আস্তিনে এল বঙ্গাব্দের প্রথম 

স্থান!

রাধাচূড়া-জারুল-কামিনী-নাগেশ্বর-বকুলেরা হাত ধরাধরি 

করেই মানুষের শুভ ইচ্ছে হয়ে ফুটলো সুপ্রভাতে 

ভালো কাজের জন্য সময় বা পরিবেশ নয়;আজও সমস্ত 

অজুহাত ঠেলে উদার নিঃস্বার্থ হৃদয়বত্ত্বাই এগিয়ে নিয়ে যেতে 

পারে আলোকিত রং মশাল....

আকাশে মৃগশিরা নক্ষত্র হোক বা বিশাখা নক্ষত্রের উপস্থিতি 

অন্যকে রঙ মাখানোর আগে নিজের হাতে খুব ভালো করে 

জীবনের রঙ মাখতে জানলেই ঠিক হতে পারে প্রকৃত দিন-

মাস বা বছরের শুভারম্ভ....











বৃষ্টি

 

জমা যত দুঃখ কষ্ট গ্লানি মুছে দেওয়ার অছিলায় ঠিক সময়েই 

'সে' আসে...

পূর্ণতার সামগানে বাজে আলো-মাটির সহজিয়া সুর; 

মিষ্টি সুগন্ধে ভরে ওঠে পৃথিবীর কোল

চিরন্তনী ভালোবাসার রিংটোনে আজও বৃন্দাবন-অকল্যান্ড-

প্যারিস-সান্তিয়াগো সব হয়ে যায় একাকার!

'অন্তর্বাহিনী চির-সঞ্চারমান স্রোত' সঙ্কীর্ণতার সমস্ত বেড়া 

ভেঙে কেবল 'তার' উদার প্রশ্রয়েই আজও সর্বজনীন হয়ে 

উঠতে চায়....












****************************************************************




জীবন সরখেল

১৯৮০খৃষ্টাব্দের ২৪শে অক্টোবরে জন্ম। পেশায় স্কুল শিক্ষক হলেও, কবিতা লেখা নেশা। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন । উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল "বিবেকদানি" ও "পরিণতি"।