[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]
বামনের চন্দ্রাভিযান
পর্ব * ১১
বিশ্বনাথ পাল
সতেরো
এর মাস ছয়েক পরের ঘটনা। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। দুপুরে আমি যথারীতি স্কুলে গিয়েছি। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ওপারে আমার বোনের গলায় বেশ উত্তেজনা, “হাইকোর্ট থেকে তোর একটা চিঠি এসেছে। তোর চাকরির অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার।”
কেমন সন্দেহ হল। আমার বোন কী পড়তে কী পড়েছে তার ঠিক নেই। বললাম, “তুই একবার পড় তো কী লিখেছে।”
ও পড়তে শুরু করল, “সোমনাথ পাল, ইস হেয়ারবাই অফারড অ্যান অ্যাপয়ন্টমেন্ট টু দ্য পোস্ট অব লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট...।”
ওকে থামালাম, “আর পড়তে হবে না।”
নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। হাইকোর্টের লোক নেওয়া তো হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও আমার নামে আবার অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার আসার মানে কী? কে জানে বাবা! অত ভেবে কাজ নেই। ওপরওয়ালার কারিশ্মা বোঝা দায়।
ভাবলাম, এই খুশির খবর এখনই কাউকে দেব না। আগে বাড়িতে গিয়ে নিজে চোখে নিয়োগপত্রটা দেখি, তারপর না হয় বলা যাবে। তা ছাড়া খবরটা যদি ভুঁয়ো হয়, পাঁচকান করার পরে যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয়, লজ্জার একশেষ।
ভাবলাম বটে, কিন্তু স্টাফরুমের দিকে যেতেই অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা। এবং তাকে খুশির খবরটা দিয়েই দিলাম। স্যারও বেশ খুশি হয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। তারপর বললাম চন্দনদাকে। চন্দনদা তো আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
বাড়ি ফিরে দেখি বোনের কথা সত্যি। হাইকোর্টের অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে আছে একটা মেডিকেল এক্সামিনেশনের প্রোফর্মা। ওটা কোনও সরকারি ডাক্তারের দ্বারা পূরণ করে শিগগির হাইকোর্টে জয়েন করতে বলেছে।
পরদিন শুক্রবার।অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারটা স্কুলে নিয়ে অমলেন্দুবাবুকে দেখালাম। উনি পড়ে বললেন,“আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমেটির সেক্রেটারি প্রদীপবাবু আজ স্কুলে আসবেন। ওঁর বন্ধু ডাক্তার এবং সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে উঁচু পদে আছেন। প্রদীপবাবুর সঙ্গে তুই কথা বল, তোর মেডিকেল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
বিকেলে সেক্রেটারি প্রদীপবাবু স্কুলে আসলে আমি তাঁকে আমার চাকরির কথা বলি এবং অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারও দেখাই। উনি আমাকে একটি চিঠি লিখে দিলেন। তাঁর ডাক্তা্র-বন্ধু দিবাকরবাবুরউদ্দেশে লেখা। আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট করে দেওয়ার অনুরোধ।দিবাকরবাবু স্কুলের কাছাকাছিই থাকেন। তাঁর বাড়ির অবস্থানও আমাকে বুঝিয়ে দিলেন প্রদীপবাবু।
স্কুলছুটির পর অন্যান্য দিন বাড়ি চলে আসি। সেদিন স্কুলেই খানিক অপেক্ষার পর সাইকেল নিয়ে ছুটলাম দিবাকরবাবুর বাড়ি। অরিন্দমদা বলে যারা বাড়ি গিয়ে টিউশন পড়ায়, হাতে ঠিকানা থাকলে তাদের বাড়ি খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। আমারও হল না। দিবাবকরবাবু আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার মন দিয়ে দেখে বললেন, “মেডিকেল সার্টিফিকেটের প্রোফর্মাটা আমার কাছে থাক। তুমি সোমবার দিন সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। চেনো তো? শিয়ালদায় এন আর এসের পাশে। আমার নাম দিবাকর স্যানাল বললেই যে কেউ আমার ঘর দেখিয়ে দেবে।”
সোমবার স্কুলে না গিয়ে ছুটলাম শিয়ালদা। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরে দিবাকর স্যানালের ঘর খুঁজে পেতে কোনও বেগ পেতে হল না। দিবাকরবাবু সত্যিই খুব উঁচু পদাধিকারী। ডেপুটি ডিরেক্টর। ঘরের দরজায় নামফলক। উনি দেখলাম প্রোফর্মা অনুসারে আমার মেডিকেল সার্টিফিকেট টাইপ করিয়ে রেখেছেন। কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই কাগজটা হাতে তুলে দিলেন। আমি প্রণাম করতেই ডান হাতটা আশির্বাদের ভঙ্গিতে উঁচু করে বললেন, “মন দিয়ে কাজ করো।”
মঙ্গলবার ছুটলাম হাইকোর্টে। বাঙালের হাইকোর্ট দর্শনের যে বাকি ছিল তা পূর্ণ করতে। ঠাকুরের আসনে সমস্ত ঠাকুর-দেবতার পাশাপাশি বাবার ছবিতেও প্রণাম করলাম। প্রণাম করলাম মা-কেও। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগেও মাকে প্রণাম করে যেতাম। এটা আমার বরাবরের অভ্যেস। সরকারি চাকরিতে প্রথম দিন। মনে আনন্দ মেশানো উত্তেজনার পাশাপাশি সংশয়ের ঢেউ। কী জানি কপালে কী আছে। ঠিকঠাক জয়েন করতে পারব তো? নাকি গিয়ে শুনব অমুক কাগজ লাগবে, তমুক রিপোর্ট আনোনি কেন? এমনিতে আমার নিজের সম্বন্ধে খুব ভাল ধারণা নেই। কোনও কাজ প্রথম বারের চেষ্টায় আমার ক’বার হয়েছে তা বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। কিংবা হয়তো গিয়ে শুনব চিঠিটা ভুল করে আমার ঠিকানায় চলে গিয়েছে। সত্যি সত্যি চাকরি আমার হয়নি। আমার কাঁধের ব্যাগেঅ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার ও মেডিকেল সার্টিফিকেট। সঙ্গে আরও কাগজপত্র। যেমন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির মার্কশীট, সার্টিফিকেট। যদি দেখতে চায়। যদিও ইন্টারভিউয়ের দিন এগুলি একবার ভেরিফাই হয়েছিল। এসপ্লানেড পর্যন্ত মেট্রোতে গিয়ে বাকি রাস্তা রাজভবন, আকাশবাণীর পাশ দিয়ে হেঁটেই পৌঁছলাম। রাজভবনের পাশ দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালই লাগল। মনে হল বিশাল কোনও বাগানবাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছি। বড় বড় গাছের ডালপালা গ্রিলের রেলিং টপকে ফুটপাতটাকে ছায়াময় করে রেখেছে।
কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে গ্রাউন্ডফ্লোরে এস্টাবলিশমেন্ট সেকশন খুঁজে বার করলাম। সেখানকার বড়বাবুই আমার জয়েনিং-এর ব্যবস্থা করবেন। মাথায় হালকা টাক, লম্বা, মধ্যবয়স্ক বড়বাবু আমার হাত থেকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটারটা নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা ইন্টারভিঊয়ের পরে আমি রেজাল্ট দেখতে এসেছিলাম। দেখেছি আমার চাকরি হয়নি। তাহলে আবার এখন অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার ইস্যু হল কী করে?”
বড়বাবু বললন, “যাদের চাকরি হয়েছিল, তাদের মধ্যে একটি ছেলে পুরনো চাকরি ছেড়ে এখানে জয়েন করেনি। আর তাই ছ’মাস অপেক্ষা করার পরে ওয়েটিং লিস্টের প্রথম জনকে চাকরির অফার করা হল। বুঝলে তুমিই ছিল ওয়েটিং লিস্টে এক নম্বরে।”
আমার দিদির কথা মনে পড়ল। দিদি বলেছিল, “দেখবি এই পরীক্ষাতেই তোর চাকরি হয়ে যাবে।” সেই কথা যে এভাবে ফলে যাবে— কল্পনাও করতে পারিনি। মনে মনে ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ জানালাম। তোমার কারিশ্মা সত্যিই বোঝা দায়।
ফাইলপত্তর বগলদাবা করে নিয়ে খানিকক্ষণ পরে বড়বাবু আমাকে নিয়ে ছুটলেন দোতলায় রেজিস্টার জেনারেলের ঘরে। হাইকোর্টের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তা। এমনিতে পদমর্যাদায় সর্বোচ্চ স্থানে প্রধান বিচারপতি। দোতলার একটা বেশ বড় ঘরে ঢুকলাম। রেজিস্টার জেনারেলের টেবিলের সামনে আরেক ভদ্রলোক বসে আছেন। কালো কোর্ট গায়ে। তিনি আমার কোয়ালিফিকেশন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, “ইকনমিক্সে এম. এস-সি.।”
শুনেই তিনি রেজিস্টার জেনারেল স্যারকে বললেন, “এই ছেলেটিকে আমাকে দাও। সুধন্য ছেলেটা ঠিকমতো কাজ করতে চাইছে না। ওকে ক্রিমিনালে ট্রান্সফার করে দাও।”
রেজিস্টার জেনারেলের গলায় সংশয় ভেসে উঠল,“ইকনমিক্সে এম. এস-সি…. এখানে থাকলে হয়।”
এবার বড়বাবু আমাকে নিয়ে চললেন তিনতলায় অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে। সেখানেই আমি কাজে যোগ দেব। রেজিস্টার জেনারেলের ঘরে আমাকে যিনি চাইলেন বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করে তাঁর পরিচয় জানলাম। তিনি রেজিস্টার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের প্রশাসনিক প্রধান।
হাইকোর্টের অ্যাপিলেড সাইডের অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে সুধন্যবাবুর টেবিলে আমার বসার ব্যবস্থা হল। হঠাৎ বদলির নির্দেশে সুধন্যদা যে একেবারেই খুশি নন আমাকে তা বুঝিয়ে দিলেন কোনও চার্জ না বুঝিয়ে।
যাইহোক, হাইকোর্টের মেন বিল্ডিঙের তিনতলার একটা বড় ঘর হল অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশন। সেখানকার সর্বোচ্চ আধিকারিক অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টার নিখিলবাবু। বড় ঘরটার এক কর্নারে কাঠের পার্টিশন বসিয়ে তাঁর জন্য একটি চেম্বার করা। সামনের দিকে পর্দা। খুবই নিরীহ মানুষ, কোনও হাবভাব নেই। কারণটা বোধহয় কেরানি থেকে প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে ওইপদে গেছেন, তাই অহংকার ছুঁতে পারেনি। জামা গুঁজে পরেন না। পায়ে চামড়ার চটি। অথচ প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করা অনেক নারী-পুরুষকে দেখতাম কী ফিটফাট হয়ে অফিস যান। গলায় টাইয়ের পেণ্ডলাম, পায়ের জুতোয় মুখ দেখা যায়। আমার বেশ ভাল লাগল। মনে হল সরকারি চাকরিতে বাইরের প্যাকেজিং নয়, ভেতরের গুণমাণ বিচার্য। নিখিলবাবুর দিকে মুখ করে পরদা থেকে দু-তিন মিটার দূরে আমার টেবিল।
আমার সহসা উপস্থিতিতে কিছুক্ষণের জন্য ঘরটায় যেন এক হইহই কান্ড। আমার সামনের টেবিলের সমীরণদা চেঁচিয়ে আনন্দপ্রকাশ করছে টি-ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হল বলে। জাকিরদা চা করে এনে খাওয়াল। প্রথম দিনের আতিথেয়তা। সমীরণদাকে দেখলাম অনেকে টি-ক্লাবের ম্যানেজার বলে ডাকল। বুঝলাম চা খাওয়ার মাসিক চাঁদা ওকেই দিতে হয়। জাকিরদা ঘরের এক কোণে টেবিলে ইলেকট্রিক কেটলিতে চা বানিয়ে পরিবেশন করে। প্রত্যেকেরই টেবিলের ড্রয়ারে নিজস্ব পেয়ালা। সমীরণদা আমাকে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। প্রায় চোদ্দ-পনেরো জন। প্রথম চোটে সকলের নাম আমার মুখস্ত হল না। যাইহোক, প্রথম দিনের আন্তরিক উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাকে মুগ্ধ করল।
প্রথম দিন কাজ সামান্যই করতে হল। একটা নোটশীট লেখা। ফেরার সময় ক্ষুদিরামের মূর্তি যখনঅতিক্রম করেছি দেখি হেড স্যারের ফোন। ধরলাম, “হ্যাঁ স্যার বলুন।”
“তুই হাইকোর্টের পাশে কোনও অফিসে চাকরি পেয়েছিস, না?”
বললাম, “না স্যার। হাইকোর্টেই চাকরি পেয়েছি।”
স্যারের কথা শুনে মনে হল তাঁর স্কুলের প্যারাটিচার ছেলেটি যে সত্যি সত্যি হাইকোর্টে চাকরি পেয়েছে তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। হোক না ক্লার্কের কাজ, কিন্তু হাইকোর্ট তো।
সুধন্যদা তো আমাকে কোনও চার্জ তো বুঝিয়ে দিয়ে গেল না। কিন্তু আমার টেবিলের বাঁদিকে পেয়ে গেলাম সুশোভনদাকে। সেও একজন ইউ ডি এ বা আপার ডিভিশন অ্যাসিট্যান্ট। হাইকোর্টে নোটশীট লেখার যে বিশেষ রীতি পদ্ধতি, সুশোভনদা আমাকে তা ভাল করে বুঝিয়ে দিল।
রাজ্য সিভিল সার্ভিসের থেকে পদমর্যাদায় সামান্য উপরে আরেকটি সার্ভিসের নাম ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিসিয়াল সার্ভিস বা সংক্ষেপে ডবলুবিজেএস। পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত এই পরীক্ষায় পাশ করেন যারা, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বিভিন্ন জেলা বা মহকুমা আদালতে পোষ্টিং পান। তাঁদের নিয়োগ, ছুটি ও জমি-বাড়ি কেনার আবেদনসহ নানান কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব হাইকোর্টের অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের। অর্থাৎ জেলা আদালতের বিচারকদের হেড অফিস যেন হাইকোর্ট। অথচ কোর্ট বলতে এতদিন তো বিচারালয় বুঝতাম যেখানে কালো আলখাল্লা পড়ে বাদী-বিবাদী পক্ষের উকিলরা সওয়াল-জবাব করেন। আর উঁচু বেদীতে বসে বিচারক সব পক্ষের বক্তব্য শোনেন। শৃঙ্খলায় গোলযোগ বা বিঘ্ন দেখা দিলেকাঠের হাতুড়ি টেবিলে পিটিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলেন ‘অর্ডার’ ‘অর্ডার’ বলে। সমস্ত পক্ষের সমস্ত বিষয় শোনা হয়ে গেলে রায়দানের দিন ঘোষণা করেন এবং নির্দিষ্ট দিনে রায় দেন। কোর্ট সম্পর্কে এই ধারণা গড়ে উঠেছে বাংলা বা হিন্দি সিনেমার সৌজন্যে।
কিন্তু এর বাইরেও যে কোর্টের বিশাল কর্মকাণ্ড, তা বুঝতে পারলাম চাকরি করতে এসে। আমার উপরে দায়িত্ব বর্তাল জেলা আদালতের বিভিন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অর্জিত ছুটি, তাঁদের জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার আবেদন, তাঁদের বিদেশযাত্রার অনুমতি চেয়ে আবেদন ইত্যাদি সংক্রান্ত ফাইলগুলির। ধরাযাক কেউ ফ্ল্যাট কিনবেন বলে আবেদন করেছেন। সেক্ষেত্রে বেতনের টাকা থেকে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ করে যে টাকা হাতে থাকবে তাতে তাঁর সংসার চলবে কিনা তারও আনুমানিক হিসেব কষে নোটশীট করতে হত। আমার বেশ মজাই লাগত। চাকরি মানেই বোরিং ব্যাপার নয়। এখানেও ফাইলে ফাইলে গল্প লুকিয়ে থাকতে পারে। তো, সেই নোটশীট প্রথমে বড়বাবু, তারপর সেকশন অফিসার, তারপর অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্টারের টেবিল হয়ে পৌঁছত রেজিস্টার অ্যাডিমিনিস্ট্রেশন মানেমহেশ্বর ঘোষের চেম্বারে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী জাকিরদা ফাইল নিয়ে যেত ঘোষ সাহেবের কাছে। কখনও কোনও জরুরিকথা বলার থাকলে আমি নিজেও যেতাম বা তাঁর কিছু জানার থাকলে ডেকে পাঠাতেন। যদি আরও কোনও ডকুমেন্ট চাওয়ার থাকে আবেদনকারীর কাছে তাহলে রেজিস্টার সাহেব তা নোটশীটে লিখে ফাইল ফেরত পাঠাতেন। সেই নির্দেশ মেনে আমার করা চিঠি ডেসপ্যাচের মাধ্যমে যেত সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর কাছে। ইন্টারনেট সেসময় চালু হলেও এমন বহুল প্রচলিত হয়নি। অন্তত সরকারি ব্যবস্থায়। আর যদি নতুন কোনও ডকুমেন্টের প্রয়োজন না থাকে, তাহলে রেজিস্টার সাহেব নোটশীট অনুমোদন করে ‘লে নোট’ লেখার নির্দেশ দিতেন। আমাকেই লিখতে হত রেজিস্টার জেনারেলের জবানিতে। লেখা হলে এবং যদি কোনও সংশোধন না থাকে তবে রেজিস্টার সাহেব সেই ‘লে নোট’-এ স্বাক্ষর করে ফাইলটি নিয়ে যেতেন মাননীয় বিচারকের কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। সেসময় এমন একজন বিচারক ছিলেন অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের দায়িত্বে, গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়দানের সূত্রে যাঁর নাম প্রায়ই খবরের কাগজে আসত। পুরো ব্যাপারটাই লিখতে হত ইংরেজি ভাষায়। আর হাইকোর্টের ইংরেজি লেখার একটা বাঁধা গত আছে, যা আমাকে বুঝতে সাহায্য করল সুশোভনদা। বুঝলাম ইন্টারভিউতে আমাকে কেন হায়ার সেকেন্ডারিতে ইংরেজির নম্বর জানতে চাওয়া হয়েছিল।
অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনে আমার সম বয়সি এবং আমারই ব্যাচের দু-জন সহকর্মী পেলাম। সুবিমল ও শংকর। তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য তারা আমার থেকে ছ’মাস আগে কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু বেশ বন্ধুত্ব হল এই ছেলে দুটির সঙ্গে। একদিন শংকরের করা প্রশ্নের উত্তরে জানালাম বাড়িতে কে কে আছে। বলল, “সোমনাথ, তোমার বাবা নেই আর আমার মা নেই। ছোট বেলায় মা মারা গেছেন।”
সুবিমলের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে। এখানে বেলঘড়িয়ায় এক মেসে থেকে অফিস করে আর সপ্তাহান্তে বাড়ি যায়। আমাকে ওদের বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল।
হাইকোর্টের লোকজন আমাকে বেশ আপন করে নিল। তিনজন দিদিকেও পেলাম—সুতপাদি, গীতাদি, ও রঞ্জনাদি। এছাড়াও দাদা হিসেবে আরও অনেককে। তাদের মধ্যে অন্যতম আমার পাশের টেবিলের সুশোভনদা।
সুশোভনদা খুব মন দিয়ে কাজ করত যেমন আবার সহকর্মীদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কিও মারত। তবে তা কখনও কাউকে কষ্ট দিত না। স্কুলে পড়াতে গিয়ে যেমন দেখেছি কাউকে কষ্ট দিয়ে, চক ছুঁড়ে আনন্দলাভ, এখানে তা বিরল। সুশোভনদা একদিন আমাকে কর্মচারী সংগঠনের সদস্য হতে বলল। শাসকদলের মতাদর্শী সংগঠন। তখন সারা রাজ্য জুড়ে বিরোধিতার ঝড় বইছে। বিরোধী জোটের নেতৃত্বে জনমানসেও তার তীব্র প্রভাব। জমি আন্দোলন তুঙ্গে। শিল্পের জন্য দুই ফসলী তিন ফসলী জমি কিছুতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। অপর পক্ষের যুক্তি শিল্পের মাধ্যমে বেকার ছেলে-মেয়েদের কর্ম সংস্থান হবে। জমি না নিলে শিল্প কি আকাশে হবে? আমার মনের পালেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারহাওয়া।কিন্তু তা সত্ত্বেও সুশোভনদার কথায় না করতে পারলাম না। শাসকপন্থী কর্মচারী সংগঠনের সদস্য হয়ে গেলাম। হওয়ার আগে মনে পড়ল অমলেন্দুবাবুর একটা কথা। হাইকোর্টে চাকরির নিয়োগপত্র আসার পর বলেছিলেন, “শোন, তোকে একটা কথা বলি। ওখানে গেলে পরেই তোকে কর্মী-সংগঠেনের সদস্য হতে বলবে। তুই কিন্তু হয়ে যাবি, না করবি না। এমন অনেকেই আছে যারা পাড়ায় বিরোধী দলের সমর্থক, কিন্তু অফিসে বড় সংগঠনের সদস্য।”
স্যার আমার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই হয়তো এমন পরামর্শ দিয়েছেন। তো, যাইহোক, সুশোভনদাকে একদিন টেবিলে মাথা গুঁজে খুব মন দিয়ে কাজ করতে দেখে বলেই ফেললাম, “তোমাকে কখনও ফাঁকি মারতে দেখি না।”
বলল, “দ্যাখ, মাস গেলে কুড়ি হাজার টাকা থুতু দিয়ে গুণে নিয়ে যাই। আমার থেকে আরও অনেক কোয়ালিফাইড ছেলেমেয়ে বাজারে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে। কাজ পায়নি। আমি পেয়েছি—ভাগ্যবান। কাজ করব না কেন রে?”
সুশোভনদার এই উত্তর আমার বেশ লাগল। ভাবলাম, অনেকে যে বলে হাইকোর্ট খুব ঘুষের জায়গা, তারা বোধহয় ঠিক জানে না। পুরো ব্যবস্থাটা ঘুণধরা নয়। হয়তো বেশির ভাগ মানুষেরই প্রবণতা সৎ। কিন্তু তা প্রচারযোগ্য হয় না।
হাইকোর্টে যোগ দেওয়ার দিন দশেক পরে একদিন স্কুল থেকে ফোন পেলাম। অমলেন্দুবাবুর গলা, “শোন, আগামী শনিবার তোর অফিস আছে?”
বললাম, “না স্যার, সেকেন্ড সাটারডে, ছুটি।”
“বেশ। তাহলে ওইদিন দুপুর দেড়টা নাগাদ তুই স্কুলে চলে আয়। দুটোর সময় তোকে আমরা ফেয়ার ওয়েল দেব।”
ফেয়ারওয়েলে স্কুল থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই, পার্কারের পেন, ফুলের তোড়া ও মিস্টি উপহার পেলাম। স্যাররা আমার সম্বন্ধে ভাল ভাল কথা বললেন। আমাকেও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হল। না, কোনও তিক্ততা ছিল না সেই বক্তব্যে। কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করলাম—
পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই—
সবারে আমি প্রণাম করে যাই।।
ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি রাখি না আর ঘরের দাবি
সবার আজি প্রসাদবাণী চাই
অনেকদিন ছিলাম প্রতিবেশী,
দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।
প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি, নিবিয়া গেল কোণের বাতি—
পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই।
*******************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন