জীবনহাটের কড়চা
সুদীপ ঘোষাল
চতুর্থ পর্ব
কেতুগ্রামের এদিকে অজয় তীরে নেমে এলো সন্ধ্যা চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকারে প্রকৃতি ছিল ঢাকা। কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যায় আকাশের তারা, অগুন্তি তারা। তবু তার মধ্যেই চলে সময় প্রবাহ। আবার সকাল হয়। কলরবে মেতে যায়,গ্রাম। আর পাশের এলাকার গুমটিতে পুরুলিয়া মুসলমানের বসতি কম। তবু কেতুগ্রাম রাউন্দী এলাকায় মুসলমান বসতি আছে। বিভিন্ন গ্রামের মুসলমান পাইকার আসে। তারা ভুলকুড়ি, দক্ষিণ দিকে কোপা, কোমডাঙ্গা গ্রাম থেকে গরু ছাগল নিয়ে কেনাবেচা করে। এদিকে প্রবাহিত হয় অজয় নদ সময়ের তালে তালে। ফলে হিন্দু মুসলমান আত্মীয়-স্বজন এখানে। মুসলিম পাড়ার নদের জল মিলিত হয় হিন্দু পাড়ার নদের জলে। তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার সম্পর্কে।
খুব সুন্দর পরিবেশে বড় হয়েছে নুর আলি । আর স্বপনও নুর আলির বন্ধু।
বাবার সঙ্গে ছোট থেকেই নুর আর স্বপন নিজেদের চাষের জমিতে যেত এবং চাষবাস দেখাশোনা করত। মধ্যবিত্ত পরিবার। অভাব থাকলেও সংসার চলে যায় কোন রকমে তাদের। সকালে মাঠে যাওয়ার পথে পা দিতেই স্বপনে ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গিয়ে চনমনে লাগে ঘড়িতে তখন বিকেল চারটে সমস্ত গ্রামটা যেন নিষ্পাপ শিশুর মত লাগে।স্বপন হালদার বয়স 25। গ্রাজুয়েট হয়েছে হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে। টিউশানি করে চুটিয়ে। গ্রামে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করা, টিউশনি করা তার পেশা। বাবা মারা গেছেন দু বছর আগে বাড়িতে মারছোট ভাই আছে।স্বপনের অনেক বন্ধুর মধ্যে কেতুগ্রামের নুর আলি অন্যতম প্রধান বন্ধু। বাড়ি আসে আবার সময় পেলে ওদের বাড়ি যায় স্বপন। আসলে নুর আলির বাবার বন্ধু ছিলেন স্বপনের বাবা। এইভাবে হিন্দু-মুসলমানের পরিবার বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। কবি নজরুল লিখেছিলেন, "আমরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।"স্বপন আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গাইতে গাইতে। " যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এ জীবনে" গাইতে গাইতে যাচ্ছিল! হঠাৎ মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়া যদু মাস্টারের 19 বছরের মেয়ে তনুর সঙ্গে দেখা।সে বলল স্বপনদা মাঠে যাচ্ছ আজ একবার আমাদের বাড়িতে যেও ইংরেজিটা দেখিয়ে দেবে। বাড়িতে বাবা আছেন।বেগুনি আর মুড়ি খেতে খেতে স্বপন আর তনু কথা বলছিল। পাশের ঘরে তনুর বাবা-মা জানে ওদের প্রেমের কথা। ওদের দুই পরিবারের মধ্যে মিলনে কোন বাধা নেই। সকালে মুড়ি খাওয়ার পর হাত ধুয়ে তনু সামনে বসল বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে পনেরোই কার্তিক মাস। নদীর জলে ভরা ঢেউ লাগলো, কেঁপে উঠলো শরীর বাঁশি। দুজনেই বিয়ের আগেই মিলনের অপূর্ব স্বাদ মিটিয়ে নিল। বিধাতার খেলা। কখন যে কার কি হয় কেউ বলতে পারে না।সেদিনের সেই ঘটনার পরে স্বপন চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে। কারণ সাবধানতা অবলম্বন না করায় মা হওয়ার লক্ষন প্রকাশ পেল তনুর দেহে।বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তনুর দাদু মরে যাওয়ায় বিয়ের দিন ঠিক হল এক বছর পরে। এদিকে তো চিন্তায় পরলো স্বপন আর তনু। স্বপন খুব ভোরে মাঠে গিয়েছে।নিজে গিয়ে জমিতে আল বেধেছে। অভ্যাস নেই। তবুও চেষ্টা করছে ।ঠিকই কিন্তু মুনিষ দিয়ে বেশিরভাগই কাজ করায়। কিন্তু ওর ইচ্ছে সব কিছু নিজে চাষ করে ফসল ফলানো।তার মজাই আলাদা।একমাত্র কৃষক ছাড়া কেউ তা অনুভব করতে পারে না। কৃষকের জয় হোক।সেনাবাহিনীর জয় হোক।
পঞ্চম পর্ব
হিমযুগ বা মৃত্যুপুরির নাম শুনেছি এতদিন কিন্তু আমি যে মৃত্যুপুরীতে যেতে পারবো এ কথা ভাবতে পারিনি কখনো। ছোটবেলায় মা ভয় দেখাতেন বাড়ি থেকে বেরোবি না বাইরে। বেরোলেই তোকে ধরবে আর আঘাত করে মেরে দেবে। মায়ের কথা কোনদিন মিথ্যে হয় না না তাই না? আজ দেখি বাইরে বেরোনো কত ভয়, বাইরে বেরোলেই মৃত্যুভয় । এক কালো থাবা নিয়ে বসে আছে বিরাট দৈত্য তার নাম, করোনা। মৃত্যুভয় আমার শুধু নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে গেছে কোন এক ভয়ে। এক দৈত্যের ভয়ে।পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ লকডাউন পালন করছে। লকডাউন মানে ঘরে বসে থাকা।। ঘরে বসে থাকো, বাইরে বেরোবে না বাইরে বেরোলেই মৃত্যুর করাল থাবা বা মহা কাল তোমাকে গ্রাস করবে।কিছু মানুষ সাহস দেখাচ্ছে তারা বাইরে বেরিয়ে কেউ চা খেতে যাচ্ছে কেউ আড্ডা মারতে যাচ্ছে কিন্তু তারা মূর্খ তারা ভেবেও দেখছে না তাদের জন্য তার পরিবার টাও ধ্বংস হবে।বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারপর রোগ নিয়ে ধুঁকছে বাড়িতে হাসপাতলে গিয়ে দেখছে করোনা। টেস্ট করলে করোনা পজেটিভ তখন বাড়ির সমস্ত সদস্যকে কোয়ারান্টিনে রাখা হচ্ছে কে যে কখন মরবে তার কোন গ্যারান্টি নেই।কেমন রূপকথার মতো শোনাচ্ছে তাইনা আমাদের পরের যুগে যে যুগ আসবে তখন কার ছেলেমেয়েরা এইরূপকথা শুনবে আর ভাববে কি সুন্দর লিখে গেছে লেখক। রূপকথা ভুলবার নয়। এ রূপকথা যে সত্যিই তারা বিশ্বাসই করতে চাইবে না।
আমরা যেমন বলি তেপান্তরের মাঠ ছিল না তারপর রূপকথাও ছিল না। সব বানানো গল্প হয়তো সেগুলো ঠিক ছিল, হয়তো সত্যি সেগুলো, আমরা তাদের মিথ্যা বলি কিন্তু এখন যেগুলো ঘটনা ঘটছে সেগুলো তো একদম রূপকথার মতোই তাই বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
জানালা দিয়ে দেখছি কিছু লোক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত কায়দায় কত আর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ঘরে যারা আছে তাদের মূর্খ প্রতিপন্ন করছে। তাদের নামে কুৎসা রটাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে কিছুদিন পরে তারা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চলে যাচ্ছে। তোমাকে ভয় নেই করোনা তাদের, যারা বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আইন অমান্য করে। আর তারাই রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তবে হ্যাঁ বাইরে যেতে হবে বৈকি। খাবারের জোগাড় করতে হবে তার জন্য অস্ত্র চাই তার জন্য বর্মা পরতে হবে। বর্মা কি? মুখে মাক্স নিতে হবে N95, তারপর হাতে গ্লাভস নিতে হবে পায়ে জুতো পরতে হবে সারা অঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে তবে গিয়ে বাইরে বেরোতে হবে বাড়ি থেকে আসার পর সেসব সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে তাদের সাবান দিয়ে ধুয়ে বালতিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে তারপর নতুন কাপড় পরিধান করে এমনকি সবজিগুলো কেউ ধুয়ে নিতে পারলে ভালো হয়।
কিন্তু এত কিছু তো করা যায় না মানুষ তো অলসের জাতি তাই বলে থাক অত কিছু হবেনা আর ওইখানেই তো গন্ডগোল ওইখান থেকেই ছিদ্রপথে করোনাভাইরাস হাসতে হাসতে ঢুকে যায় আর ঢুকে গিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবী।
অংশুমান আর মিলন বাবু জানলায় দুটো বাড়ি পাশাপাশি থাকে তারা জানলা দিয়ে কথাবার্তা বলছে মিলন বাবু তার বক্তব্য রাখছেন যে কিছু লোক আছে যারা বেপরোয়া হয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের রোগের ভয় নেই কিন্তু অজান্তেই তাদের অজান্তেই বের হতো তাদের শরীরে প্রবেশ করেছে। মিলন বাবু জানলা দিয়ে বলছেন, করোনা ভাইরাসের জেরে বিশ্বদুুয়োর বন্ধ। লকডাউন শুরু হল বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে। দোকান, বাজার, হাট স্কুল, কলেজ সব বন্ধ।তবু মিলনবাবু দোকানে গেলেন একবার। তিনি বলেন, আমার কিছু হবে না',।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন এই ভাবনাটাই করোনাকে, বিশ্ব মহামারীতে, পরিণত করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও এ দেশে বাজার-ঘাটে সেই দৃশ্য খুব কমই দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার একটি ঘটনা রীতিমতো আশঙ্কার সৃষ্টি করতে পারে। লকডাউন চলাকালীন মাত্র একবারের জন্য দোকানে গিয়েই করোনা আক্রান্ত হলেন এক ব্যক্তি। অথচ তিনি মাস্ক, গ্লাভস সমস্ত কিছুই পরে গিয়েছিলেন।
মিলনবাবু জানিয়েছেন, তিনি লকডাউন সম্পূর্ণই মেনে চলছিলেন। কিন্তু ঘরে খাবার শেষ হতেই তাঁকে যেতে হয়েছিল দোকানে। তাও একটি দোকানেই গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন পর থেকেই শরীর খারাপ হতে থাকে। জ্বর, শরীরে অসহ্য ব্যথা। এরপরই প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁর করোনা টেস্ট হয়। সেখানেই তাঁর রিপোর্ট পজিটিভ আসে।
মার্কিন এক যুবককে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া হসপিটালে ভরতি করা হয়েছে। ৩১ বছর বয়সী সেই যুবকের নাম বেনজি হা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাস ছড়ায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখলেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির ড্রপলেট অন্য কারও নাক, মুখ, চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই ভাল মাস্ক, চশমা পরাটা আবশ্যক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বেনজির ক্ষেত্রেও সেভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি।
এই কোভিদ নাইনটিন বা করোনা রোগ আসার আগে অংশ মানে জীবন ছিল সহজ সরল তারা বাইরে ঘুরে বেড়াতো নিজের কাজ করতো টিউশনি পড়াতে কোনো বাধা ছিলনা কিন্তু করোনাভাইরাস আসার আগে আসার পরে আর উন্মুক্ত পরিবেশে ঘোরাফেরা করা যায়না তার আগের ঘটনা এখন কিছুটা আমরা বর্ণনা করছি। জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে? লকডাউনের আগে অংশুমানের মনে হত, স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? সজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে কিছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস।
ষষ্ঠ পর্ব
বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের একটা বস্তি নন্দনপাড়। নন্দনপাড়ে গরিব লােকের বাস। আর তার চারধারে বেশ কয়েক বর্গ কিলােমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে শহর। নন্দনপুকুর বলে একটি পুকুর আছে। তার পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বসতি। অংশুমান নন্দনপাড়ের কাছেই দু-কাঠা জমি কিনে তার শখের বাড়িখানা তৈরি করেছে। মােটামুটি দু-খানা ঘর, একটা ডাইনিং আর বাথরুম। অংশুমানের একটি ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর তার স্ত্রী দেবী সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। অংশুমান একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। বেতন সামান্য। তবু সংসার চলে যায় আনন্দে। আজকে অনেক পরিশ্রমের পরে অংশুমান। নন্দনপাড়ে এসে বাড়ি করে শান্তিতে বাস করছে। নন্দনপাড়ের বাসিন্দারা। সবাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কিছু লােক থাকে তারা চিরকাল নিজেদের একইরকমভাবে চালাতে চায়। মানুষের প্রতি ভালােবাসার, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। নিজেকে গুটিয নন্দনপাড়ের এইরক আসর এই গথম। এখনকার লােক দু-চারটে মূর্তি এনে গুজা করে শাস্তি। দিন আনা দিন খাওয় লাকে বাস এখানে। এখানে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ মন ব্যাপার। এ একদিন ছিল, যখন এই নন্দনপাড়ের নামে লোকে ভয় পেত। এই পাড়া মানেই কিছু অসামাজিক প্রকৃৃতির লােকের বাস। সবাই এই মনে করতেন। সত্যি যা রটে তা কিছুটা বটে। তখন বেশ কজন ছিল, যারা চুরি-ডাকাতি করত। নেশা করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অপরের বউকে নিয়ে টানাটানি করত। কিন্তু চিরকাল একভাবে চলে না। অন্যায়-অত্যাচারের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতিকার করে। এক নতুন পথের চিন্তায় থাকে। এ যেন মানুষের সহজাত চিন্তা। পাপী লােক দু-দিন আর গুণবান যুগে যুগে অবস্থান করে মানুষের অন্তরে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত অংশুমানের মন।। | অংশুমান ভাবে, যখন সে এল নন্দন পারে, তখন তার বাড়িঘর হয় নি। ফাঁকা মাঠে এসে বাড়ি করে ফেলল অংশুমান। চিতাভাবনা মা করে, বাড়ি ভাড়া করে থাকত গ্রথমে। তারপর ভাবনা করল।কম দাম দেখে অংশুমান একটা ঘর তৈরি করল। বাঁশের বেড়া দিল চারিদিকে। ন ছেলে পাঁচ বছরের। স্ত্রী দেবী খুব সাহসী মহিলা। তার সাহস না থাকল তো অংশুমানের এখানে এসে থাকা হত না। মানুষ মরে যাওয়ার পরে পেট ভরে ভােজনের রীতি আমাদের সমাজে। এই খাওয়ার পর্ব হয়ে আসছে পুরোনো কাল ধরে। ক্ষমতা থাক বা না থাক এই খাওয়ার রীতি। অংশুমান ভাবছে পাঁচজন মানুষকে খাওয়ালেও শান্তি।বেঁচে থাকতে যে মা ছেলের কষ্টে চোখের জল ফেলতেন, মমতা বলতে কিছু থাকে তাহলে চোখের আড়ালে থেকেও ছেলের কষ্ট সম্বরণ করতে পারবেন না। ভারতবর্ষে অনেক ছেলে আছে যা মায়ের ঠিকমতাে দাহকরতে, শ্মশানে আনার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যায়। অংশুমান ভাবে, তবুসমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হয়। চাকরি-বাকরি পেলেও শুধু বসে থেকে মাথার চুল ছিড়লে হবে না। ব্যবসা করতে হবে, ভগবান যে দু-হাত দিয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে সেই দুই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। মূলধন নেই বলেই তাে অংশুমান ভাবে, টিউশনি আরও বাড়াতে হবে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে বেরােয়। অংশুমান, সাতটা থেকে সাড়ে আটটা একটা তারপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা অবধি আর একটা দল ছাত্র পড়ায় অংশুমান। আবার রাত্রিতে দুটো ব্যাচ। এইভাবেই অংশুমানের সময় কেটে যায় কর্মের মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে সবজি-বাজার, মুদি-বাজার সব করে নিয়ে আসে।। অংশুমান কাটোয়ার বাড়িতে বসেছিল। আজ রবিবার, টিউশনি নেই। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি পুরুলে থেকে ফোন এল মায়ের, "অংশু, একবার বাড়িতে আসতে পারবি? আমার ওযুধ ফুরিয়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে আসবি।” অংশুমান। ফোনে বলল, “আমি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তােমার কাছে যাচ্ছি।" স্ত্রী দেবীকে বলল, “পুরুলে থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে আজ ভাত খাব না। মায়ের কাছেই খাব।" এই বালে অংশুমান সাইকেল নিয়ে ওষুধের দেকানে ওযুধ আর তার সঙ্গে কিছু ফল-মূল, মিষ্টি নিয়ে পুরুলে মা-র কাছে গেল। অংশুমানরা চার ভাই, দুই বােন। দুই বােনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারভাই এখন পৃথক হয়েছে। যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা নেই। মা যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন সেখানেই থাকেন। চার ছেলে চার জায়গায় থাকে। বাবার চাকরি সূত্রে মাকে যেতে হল হাওড়া জেলার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় মা তিনভাইকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। বড়দা অংশুমানের কাকাবাবুর কাছে থেকে গ্রামে পড়াশোনা করে। অংশুমান ভাবে, তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে এতদিন ইলেকট্রিক আলাে দেখেনি অংশুমান। সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা বাবা সুইচ অন করে দিয়েছেন। আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে এল।কোথা থেকে আলাে আসছে অংশুমান বা তার ভাইরা বুতে পারল না। বাবা দেখিয়ে দিলেন আলাের উৎস। উপরে বাতি ঝুলে রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। অংশুর এখনও মনে আছে। তারপর সকাল বেলা বাবা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন অংশুমানদের। অংশুমানের ছোটভাই তখন মাত্র দুই বছরের ছেলে। অংশুমান এবং তার মেজদা মাত্র তিন বছরের তফাত। দু-জনে মিলে স্কুলে ভর্তি হতে গেল। দাদা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হল কিন্তু অংশুমান অঙ্ক একটু ভূল করায় একেবারে নার্সারি এসে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি হলেও এখানে নার্সারিতে ভর্তি হল। তখন থেকেই ভালাে করে পড়াশােনা করার জেদ মাথায় জাকিয়ে বসল। তারপর থেকে সে প্রত্যেকবছর ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। এসব কথা তার মনে আছে। অংশুমানের বন্ধু ছিল অশ্বিনী, মােহিনী, হার, গৌতম, গােরা, শঙ্কর প্রভৃতি বালকেরা। ধীরে ধীরে অংশুমানের পরিবার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় বেশ সুন্দরভাবে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অংশুমান ছােটবেলায় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালােবাসত। ছােট ছােট বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় একটা ভালাে ক্রিকেট দল গঠন করেছিল, ক্যাপ্টেন ছিল সে নিজেই। একটা শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ভিতরে সবাই মিলে কোদাল, কুড়ি, ঝাটা নিয়ে শীতকালে ক্রিকেট খেলার জন্য "পিচ তৈরি করা শুরু করত। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গে অংশুমানের। মাঝে মাঝে ক্রিকেট ম্যাচও খেলা হত। বন্ধুরা সবাই মিলে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার জন্য চাদা তােলা শুরু করল। নিজেরাই বাঁশ পুঁতে নিজেদের মায়েদের, দিদিদের শাড়ি এনে সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করে ফেলল। এখন ঠাকুর আনার পালা। একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে সামনের পটুয়াপাড়া থেকে মূর্তি আনা হল। মূর্তি বসানাে হল বেদিতে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলের কাজ করা হল। অংশুমান দেখেছে বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি হয়। তাই ওরাও সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করবে। কিন্তু রাত যে অনেক বড়। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার পরে অফুরন্ত সময়। এখন কি করবে? ওরা भান করল ডিম-ভাত খাওয়া হবে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জোগাড় করে ওয়া-পাওয়ার জোগাড় শুরু হয়ে গেল। খেতে বসার সময়ে অংশুমানের মনে পড়ল, সরস্বতী পুজোর আগের দিন ‘বারের উপােস না করলেও কোনাে আঁশ জাতীয় খাবার খেতে নেই। পরে কাউকে কিছু না বলে ডিম-ভাত নিয়ে মাকে দিল। আর কোনাে ছেলের কথাটা মনে নেই। কষ্ট দিতে মন চাইল না অংশুমানের। ডিম-ভাত অংশুমান খেল।ঘড়িতে দেখল এগারােটা বাজে। রাতের বেলা প্যান্ডেলে সারারাত কাটানাে মুখের কথা নয়। কিন্তু বন্ধুরা যখন এসবে মাতে তখন কোনাে বাধাই বাধা নয়। সব সমস্যা যার নতে যায়। বন্ধুত্বের শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে প্রত্যেক মানুষই তার জীবন মাধ্যমে এই তত্ত্ব বুঝে থাকেন। মশার কামড়েও যেন আনন্দের সুর। দাগ কাটে না বালক অংশুমানের মনে। পরের দিন সকালবেলা সবাই স্নান করে পুজো মণ্ডপে হাজির।ফল কাটা সব হয়ে গেছে। পুরােহিত এসে গেছেন। পুষ্পগুলি দিয়ে । পুরােহিতের সঙ্গে সবাই একসুরে বলছে, ভদ্রকালী নমঃ নিতং সরসত নমঃ নমঃ"—ভুল ইত্যাদি মন্ত্র। ঢাকের বাজনার সাথে সকলের নাচ হল। প্রসাদ বিতরণের পর মণ্ডপের সামনে একটা বেড়ার আড়াল দেওয়া হল। তারপ স্কুল যাওয়ার পালা। স্কুলে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। আবার পরের দিন সকালে দধিকর্মার পূজা। পূজাশেষে পুষ্পাঞ্জলি। রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জন। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ঢাকের বােলে তালে তালে সবাই নাচতে নাচতে গিয়ে হারুদের পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এল। এইভাবে ভালাে-মন্দে সুখে-দুঃখে অংশুমানের জীবন কাটছিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসও বাড়ছে। ক্লাস সেভেনে উঠে টি.আরজি.আর খেমকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিক্সে প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য অংশুমান এক বই’ পুরস্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে দেখিয়ে সে কি আনন্দ তার। এখনও সব কথা মনে আছে। অংশুমান বন্ধুদের সাথে রেইনের পাশের রাস্তা ধরে স্কুলে যেত। কোনােদিন স্কুল কামাই ত না। তার জন্য শিক্ষক মশাইরা তাকে খুব ভালােবাসতেন।
***********************************************
আগামী পর্বে
************************************************
সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন