মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

প্রবন্ধ * সিদ্ধার্থ সিংহ

 




কৃষ্ণকীর্তনে নতুন সংযোজন-- রাধাদাস


সিদ্ধার্থ সিংহ

'রাউলে পেপারস' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল কবি রাউলের খ্যাতি। কিন্তু রাউলে কে?
প্রশ্ন শুনে মুখ খুলল এক ছোট্ট বালক। সে বলল, 'রাউলে ছিলেন মধ্যযুগের এক ধর্মযাজক। তিনি প্রচুর কবিতা, গল্প, গদ্য লিখেছিলেন। কিন্তু কখনওই তা লোকচক্ষুর সামনে আনেননি। পুরোনো গির্জার একটা সিন্দুকে সেগুলো তিনি রেখে দিয়েছিলেন। সেগুলোই উদ্ধার করেছে সে। আরও প্রচুর লেখা আছে।'
এই সব কথা যে বলেছিল, নিদারুণ দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুজে উঠতে না পেরে মাত্র আঠারো বছর বয়সেই সে আত্মহত্যা করে।
আবিষ্কারক মারা যেতে পারে, কিন্তু আবিষ্কার? সেগুলো তো আর উবে যেতে পারে না! সে তো বলেছিল, আরও লেখা আছে। তা হলে সেগুলো কোথায়?
সন্ধান করতে গিয়ে চমকে উঠলেন সবাই। ফাঁস হয়ে গেল প্রকৃত রহস্য। আসলে রাউলে নামে কেউ কোনও দিন কখনও কোথাও ছিল না। ওই বালক পুরোনো কয়েকটা পুঁথির খোঁজ পেয়েছিল ঠিকই, তবে সেগুলো এগুলো নয়। কিন্তু সেগুলো পড়েই সে এতটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে, সে পৌঁছে যায় সেই পুরোনো পৃথিবীতে। যে সময়ে লেখা হয়েছিল ওই কবিতাগুলো। অবসর সময়ে সে ওগুলো পড়ত। দেখে দেখে টুকত। নকল করতে করতে শুধু প্রাচীন ভাষা বা ছন্দই নয়, নিখুঁত ভাবে আয়ত্ব করে ফেলেছিল পুঁথির সেই অবিকল হস্তাক্ষরও। এক সময় তার প্রভাবে সে নিজেই লিখতে শুরু করে এক-একটা কবিতা। কিন্তু তার মতো এক হতভাগা দরিদ্র বালক কবিতা লিখছে শুনলে কেউ কি সেই কবিতা পড়বে? তাই সে তুলে ধরেছিল মন গড়া এক রাউলের অস্তিত্ব।
পাঠকের কাছে পৌঁছল নতুন তথ্য। বিস্মিত হলেন পণ্ডিত মহল। তাই পরবর্তিকালে আর রাউলে নয়, 'রাউলে পেপারস' গ্রন্থটির জন্য কবি হিসেবে স্বীকৃতি পায় স্বল্পায়ুর সেই বালক--- টমাস চ্যাটারটন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কিডস তাঁকে উৎসর্গ করেন তাঁর 'এনডিমিয়ন' কাব্যগ্রন্থ। শেলি উৎসর্গ করেন তাঁর বিখ্যাত বই--- অ্যাডোনেইস।

না, এ রকম কোনও ঘটনা নয়। পুরুলিয়ার যুধিষ্টির মাজীর বড় ছেলে শিবপ্রসাদ গত ১৯৯৮ সালের ২১ জুন মারা যাওয়ার অনেক আগেই সত্যি সত্যিই উদ্ধার করেছিলেন একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি।
ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা এক অজানা কবির অজানা কাব্য। কবির নাম--- রাধাদাস। না, রাধা দাস নয়, কারণ তখনও নামের শেষাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পদবির সৃষ্টি হয়নি। তাঁর গীতিকাব্যের নাম--- কৃষ্ণলীলামৃত গীত। যে বইটির কথা বৈষ্ণব সাহিত্য রসিকদের কাছে এত দিন অজানাই ছিল।
না, ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত' বইটিতে যে রাধানাথ দাসের কথা উল্লেখ করেছেন, ইনি তিনি নন। উনি ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি এবং অতি দুর্বল পদকর্তা। তাঁর সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক নেই।
এই পাণ্ডুলিপি পাওয়ার পরে বোঝা যায় যে, এই রাধাদাসই বাংলা সাহিত্যে চতুর্দশপদী কবিতার জনক। যদিও তাঁর কাব্যে দশ/বারো লাইনের কিছু কিছু কবিতা আছে। জানি না, কপি করতে গিয়ে লিপিকারের অসচেতনতায় কলমের ফাঁক দিয়ে এ সব কবিতার দু'চারটে শব্দ বাদ পড়ে গেছে কি না! কারণ, যে পাণ্ডুলিপি থেকে কবি রাধাদাসের কাব্যটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটা কিন্তু কবির নিজের হস্তাক্ষরে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি নয়। শ্রী টীকারাম সরাক নামে এক লিপিকার মূল পাণ্ডুলিপি থেকে বা অন্য কারও হস্তাক্ষরে লেখা কোনও প্রতিলিপি থেকে টুকে নিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপির নীচে তারিখ লেখা আছে--- ১৯ আষাঢ়, ১১৯৬ সন।
তাঁর লেখাতে বানানোর প্রচুর গন্ডগোল দেখা গেছে।  'র'-এ দীর্ঘ 'উ' ছাড়া আর অন্য কোনও অক্ষরে দীর্ঘ উ চোখে পড়েনি। 'স'-এর ব্যবহার খুব বেশি। 'শ' স্থান পেয়েছে যেখানে সেখানে। আবার 'ষ'-র চেহারা কোথাও নেই। 'শিশু' শব্দটি কোথাও 'সিসু', কোথাও 'শিশূ', তো কোথাও আবার 'শিসু'। 'ছাওয়াল' শব্দটি 'ছায়াল', 'ছায়বাল', 'ছাআল', 'ছাঅবাল' লেখা হয়েছে। দির্ঘ 'ঈ'-র ব্যবহার খুবই সামান্য। 'গোপি' এবং 'গোপী' দু'ভাবেই বানানটি লেখা হয়েছে। কবি নিশ্চয়ই এই ভুল করেননি।
এ তো গেল বানানের গন্ডগোল। এ ছাড়াও গীতি কবিতার ক্রমিক সংখ্যাতেও ভুল রয়েছে। কিছু কবিতার লাইন অন্য কবিতার মধ্যে ঢুকে গেছে। কয়েকটি কবিতার কিছু কিছু লাইন বাদ পড়ে গেছে। ফলে লিপিকার টিকারাম সরাক এই পাণ্ডুলিপিটি কপি করার সময় কতটা মনোযোগী বা যত্নবান ছিলেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে।
সে যাই হোক, ড. ক্ষুদিরাম দাস এই পাণ্ডুলিপিটিকে অতি মূল্যবান বলে জানালেও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কিন্তু এই কাব্যটিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার ন্যূনতম আগ্রহও দেখায়নি। ফলে যুধিষ্টির মাজী নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বইটা ঠিকঠাক মতো সাজিয়ে, সম্পাদনা করে শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অধ্যাপক ড. দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় যে 'রাধাদাস প্রণীত কৃষ্ণলীলামৃত গীত' প্রকাশ করেছেন, তার জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
এতে ১৩০টি গীতি কবিতার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরা যাওয়ার সময় পর্যন্ত কৃষ্ণলীলাকে তুলে ধরা হয়েছে। মূলত জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ ও‌ ভগবতের কাহিনি নিয়েই এই কাব্য গড়ে উঠেছে। কবি এগুলোকে বলেছেন, সদা গেয়ং। অর্থাৎ এই কবিতাগুলো গানের জন্যই লেখা হয়েছে এবং কোন কবিতা কোন রাগে গাইতে হবে, প্রতিটি কবিতার শুরুতেই তা উল্লেখ করে দিয়েছেন। তার মধ্যে যেমন আছে শ্রী, কামোদ, করুণাশ্রী, মঙ্গল আসোআরি, মঙ্গল ধানসি, মল্লার, ইমন কল্যাণ। তেমনই আছে বেলেআরি, ভাটিআলি, ভাটালি, গাড়া, পাঠমঞ্জরি, বড়ারি, বিহাগাড়া জাতীয় ভারতীয় রাগ-রাগিণীর উল্লেখ। এর পাশাপাশি আছে 'তা তা থোই থোই বলয়ে মাত্র নাচিতে টুলিআ পড়ে'-র মতো নাচের নিখুঁত বর্ণনা। যা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নৃত্যের সঙ্গে তাঁর গভীর পরিচয় ছিল। যার জন্য যে রাগের যে শৈলী, তার সঙ্গে মানানসই শব্দ জোগান দিতে গিয়ে তিনি যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আঞ্চলিক বহু শব্দ ব্যবহার করেছেন, তেমনই করেছেন প্রাচীন বাংলা শব্দ, সংস্কৃত শব্দ এবং ব্রজবুলি শব্দও। যা মধ্যযুগের কোনও বৈষ্ণব সাহিত্যে সচরাচর পাওয়া যায় না। যেমন তুড়ি রাগে গাওয়ার জন্য তিনি লিখেছেন---
তারি অতি চঞ্চল জমুনা পাথার।
রভস পাতিঞা রঙ্গ দেখত কাণ্ডার।।
বিনতি তুমারে স্যাম নিবেদি চরণে।
ধরম দেখিঞা পার কর গোপি গণে।
অবলা গোপের নারী তুমি সে সুজন।
এ কালা জমুনার জলে হারাবে পরাণ।।
তিরি বধ পাতক ঘুচাহ কর পার।
জনমে জনমে জস ঘুসিব সংসার।।
কাতর গোপীর বোল সুনি কাহ্নু হাসে।
উপাএ করিল পার কহে রাধাদাসে।।

আবার সুহই সিন্ধুড়া রাগে গাওয়ার জন্য লিখেছেন---
ধনি হরিনি শ্যাম সোহাগিনি
পুলকি হঞাছে তনু।
দুখিনি দেখিঞা সদয় হইঞা
কহ কোথা গেল কাহ্নু।।
মন হরিল নাগর কালা।
অন্তর বাহির নাহিখ বিচার বিহরে কাহ্নর লিলা (ধ্রু)
হইঞা পুতনা বধে‌ এক জনা
সকট ভাঙ্গএ পায়।
এক তৃনাবর্ত্ত এক নন্দসূত
গলা চাপি মারে তায়।।
কেহো‌ সিসু হঞা হামাগুড়ি দিঞা
ভাণ্ড ভাঙ্গে নুনি খায়।
জামল য়র্জ্জুনে ভাঙ্গিএ বন্ধনে
ঠেকি উদুখল পায়।।
পসু পাখি সনে বিহরে বিপিনে,
কহো না কানুর বেশে।
কহে রাধাদাসে বিবিধ বিলাসে
খুজি বুলে বনদেশে।।

যদিও কাব্যের কোথাও তিনি তাঁর রচনাকাল লিখে যাননি। তবু তিনি যে ষোড়শ শতাব্দীরই কবি, তাঁর লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলেই সহজে বোঝা যায়। যেমন, (১) বড়াই চরিত্রের সার্থক রূপায়ন। (২) ললিতা, বিশাখা-সহ রাধার অষ্টসখী, আয়ান ঘোষ ও রাধার শাশুড়ি-ননদের অনুপস্থিতি। (৩) রাধা চরিত্রের মধ্যে পূর্বরাগ ও ভাব সম্মিলনের অভাব। (৪) রাধা চরিত্রের মধ্যে তার বংশ পরিচয় ও তার স্বকীয়তার অভাব। এমনকী, রাধা নামের বদলে তাকে বারবার গোপী, গোপিনী, গোপনারী, গোপবালা, ব্রজবধূ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এতগুলো কবিতার মধ্যে কেবল ৬/৭টিতে রাধা আর শুধুমাত্র দু'জায়গায় রাই শব্দের উল্লেখ আছে। (৫) রাধার প্রেমকে পুরোপুরি পরকিয়া প্রেমে রূপান্তরিত করা ও তাকে সবলা নায়িকা রূপে তুলে ধরা। (৬) সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে যেটাকে আমরা দুর্গাপুজো বলা শুরু করি, পঞ্চদশ ও ষোড়শ‌ শতাব্দীতে কিন্তু সেটাকেই অম্বিকা পুজো বলা হতো। এই কবির বিভিন্ন লেখায় ধর্মীয় লোক উৎসব হিসেবে আমরা কিন্তু বারবার অম্বিকা পুজোর বিবরণই পাই। (৭) বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ছন্দ, রীতি এবং নাটকীয় সংলাপের প্রভাব এবং তার অবৈষ্ণব সুলভ মানবতাবাদী জীবন দর্শনের প্রভাব। (৮) লেখা শুরু করার আগে চৈতন্য ও নিত্যানন্দের যুগ্ম বন্দনা ষোড়শ‌ শতাব্দীর রীতি। সেই রীতি এই কবির কাব্যেও আছে। (৯) তখনকার রীতি অনুযায়ী চৈতন্যচরিতামৃত বা কৃষ্ণকেলিচরিতামৃত-র মতো এই কবির কাব্যগ্রন্থের নামও--- কৃষ্ণলীলামৃত। (১০) বৈষ্ণব ভাবধারা ও দার্শনিক চিন্তার প্রভাব। (১১) ষোড়শ শতাব্দীর জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (১৫৬০) কিংবা লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল কাব্যে যেমন রাগ-রাগিণীর প্রবল প্রভাব দেখা যায়, তেমনই এই কবির কবিতাতেও নানান ঘরানার মার্গ সঙ্গীতের আনাগোনা লক্ষ করা যায়।
এই সব বিচার বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায়, রাধাদাসের কাব্যগ্রন্থটি ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে রচিত। প্রশ্ন উঠতে পারে, দ্বিতীয় ভাগে লেখা হলে তার প্রায় একশো বছর আগের, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের এত প্রভাব তাঁর উপরে পড়ল কী ভাবে? সম্ভবত, সে সময়েও বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনই মানুষের মন জুড়ে ছিল। হয়তো স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবও ওই কাব্যই পড়তেন। তাই এই কবি তার প্রভাব এড়াতে পারেননি। ফলে এত মিল।
বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা প্রথম দর্শনেই কৃষ্ণের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। পরে কৃষ্ণ ছলে বলে রাধার শরীর ভোগ করেছে। রাধাদাসের কাব্যেও তাই। যদিও রাধাদাসের প্রেম বাস্তব সম্মত। এতে দার্শনিক ভাবনার কোনও অবকাশ নেই। তাঁর মতে, দেহ ছাড়া প্রেম হয় না। কারণ, দৈহিক সৌন্দর্যই নরনারীকে মুগ্ধ করে। প্রেমের পথে নিয়ে যায়। তাই প্রথম দর্শনেই কৃষ্ণের নারীলোভী চরিত্রটা দেখে রাধা বিরক্ত হয়েছিল। পরে আরও বিরক্ত হয়েছিল যখন সে দেখেছিল, কৃষ্ণ গাছের আড়াল থেকে ব্রজবধূদের নগ্ন হয়ে স্নান করা দেখছে। রাধা তার উপরে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে বুঝতে পেরেও, আজকালকার রাস্তার বখাটে ছেলেদের মতো কৃষ্ণ কিন্তু ব্রজবধূদের পিছু ছাড়েনি। নানা অছিলায় তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছে। পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। আঁচল ধরে টানাটানি করেছে। যাকে বলা যায় রীতিমত ইভটিজিং। এখনকার দিনে হলে পাড়ার ছেলেরাই পেঁদিয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করত কিংবা বহু আগেই লক-আপে ঢুকিয়ে দিত।
বহু বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁরা বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন, কখন কোন মহিলা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁর ছাতার তলায় এসে আশ্রয় নেবে। সে রকম কৃষ্ণও যমুনার তীরে নৌকো নিয়ে বসে থাকত। যাতে কখন নৌকো আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ব্রজবধূরা অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর নৌকায় উঠতে বাধ্য হয়। উঠতও কখনও-সখনও। আর এ ভাবেই মাঝে মাঝে সেই নৌকোয় ওঠার ফলে ধীরে ধীরে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার প্রেম হয়ে যায়। শুধু রাধাই নয়, পরকিয়া প্রেমে ডুবে যায় সমস্ত ব্রজবধূই।
মেয়েরা যখন প্রেমে পড়ে, তখন সব উজাড় করে বিলিয়ে দিতে থাকে। এত দিন রাধার পিছনে ঘুরঘুর করত কৃষ্ণ, এ বার রাধাই কৃষ্ণ কৃষ্ণ করতে লাগল। ঘরে তার মন টেকে না। কোনও কাজে মন বসে না। কৃষ্ণের বাঁশি বাজলেই রাধা তার স্বামীকে ঘুম পাড়িয়ে অভিসারে বের হয়। গুরু গরবিত লাজ, কুল, মান, মর্যাদা সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়। প্রতি অঙ্গের সঙ্গে প্রতি অঙ্গের মিলন।
বড়ু চণ্ডীদাসের মতো অতটা খোলাখুলি রগরগে বর্ণনা না দিলেও রাধাদাসও কিন্তু কোনও অংশে কম যাননি। যৌন বিজ্ঞান মেনেই বাস্তব দেহ মিলনেরই বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। রাধাকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণ তার গলায় চুমু খাচ্ছে। বুকের কাপড় সরিয়ে স্তন যুগল উন্মুক্ত করছে। কাম ভাবাবেগে তার স্তনবৃন্ত শক্ত। পরনের কাপড়, মাথার চুল সব এলোমেলো‌। শরীরের সঙ্গে শরীরের ঘষায় দু'জনেই তৃপ্ত। রাধাদাস এখানে বর্ণনা করেছেন---
চারু রম্ভন গণ্ড চুম্বন,
উরজ খণ্ডন ভাতিআ।
বন্ধ বেণীর মুক্ত অঞ্চল,
মনেত ডর ছাড়িঞা।।
তুষি রতিপতি সঙ্গে রসবতী
বৃন্ত নীরস বঞ্ছিঞা।
বেশর ভূষণ কেশ বিগলিত
অঙ্গ অঙ্গ বিভাতিআ।

এ সব কবিতা একটু নাড়াচাড়া করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় প্রেম, মিলন ও বিরহের ক্ষেত্রে কবি রাধাদাস কোনও অবাস্তব দার্শনিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হননি। কৃষ্ণকে তিনি অবতার বলে স্বীকার করেছেন। তাঁকে দিয়ে অলৌকিক কাজকর্ম করিয়েছেন। কিন্তু রাধা তাঁর কলমে শুধুই এক মানবী। আমার মনে হয়, কবির নাম যেহেতু রাধা এবং তিনি নিজেও যেহেতু কৃষ্ণভক্ত, তাই ওই রাধার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখার একটা সূক্ষ্ম ইচ্ছে হয়তো কবির মধ্যে খুব সুপ্ত হলেও, অবচেতন মনে ছিল। তাই রাধাকে দিয়ে তিনি কোনও অসম্ভব কাজ বা দেবীসুলভ আচরণ করাননি। রাধা যেন গোকুলের একজন অতি সাধারণ ব্রজবধূ, যে প্রতিদিন মথুরার হাটে যায়। দই বিক্রি করে সংসার চালায়।
মধ্যযুগের কাব্যে নিখুঁত ট্র্যাজেডির কোনও স্থান ছিল না। অধিকাংশ বৈষ্ণব কাব্যেই রাধার ভাব কাব্যের ট্র্যাজিক ধর্মকে নষ্ট করেছে। অনেক কাব্যের কাহিনিকে আবার কংস বধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার ফলে ট্র্যাজিকের রস জমতে পারেনি। রাধাদাসের কাব্যটি মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রথম এবং শেষ বিয়োগান্ত কাব্য।
আগে যে কোনও কাব্যই লেখা হতো কাহিনি নির্ভর করে। বেশির ভাগই দেবদেবীকে ঘিরে। তাদের গুণকীর্তি বর্ণনা করাই ছিল কাব্যের মূল ধর্ম। আর সেই কীর্তি-কাহিনি যখন সুরের মধ্যে দিয়ে গাওয়া হতো, তাকে বলা হতো গুণকীর্তন। ধীরে ধীরে 'গুণ' বাদ দিয়ে যা পরে হয়ে যায় শুধুই--- কীর্তন।
কীর্তন দু'রকমের--- (১) নামকীর্তন। যা নগর সংকীর্তনেই মূলত শোনা যায়। আর (২) পালা কীর্তন। বৈষ্ণব মহাজনদের লেখা নানা পদে সুরারোপিত সংগীত। এটারও আবার দুটো ভাগ আছে। একটা চৈতন্য পূর্ব। অন্যটা চৈতন্য উত্তর। আগে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে নিয়ে পদ রচনা হতো। পরে সেই জায়গায় আসে রাধা ও কৃষ্ণ। কিন্তু চৈতন্য আসার পরে বলা হয়, চৈতন্য হল যুগল অবতার মূর্তি। তিনি খানিকটা মেয়ে মেয়ে দেখতে ছিলেন বলে বৈষ্ণবেরা বলতেন, তিনি বহিরঙ্গে রাধা আর অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ।
পরে, এই বৈষ্ণবেরাই খোল-করতাল নিয়ে নেমে পড়ে কীর্তনের পুরো বাজারটি দখল করে নেন। যদিও তখনও তাঁরা জানতেন না, শুধু সুগার রোগী নয়, যে কোনও মানুষের পক্ষেই সকালে হাঁটা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ভাল এবং গানে মত্ত হয়ে দু'হাত তুলে ধেই ধেই করে নাচাটাও সাঁতার কাটা বা সাইকেলিং করার চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। শরীর চর্চার এমন আদর্শ ব্যায়াম পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে বৈষ্ণব সাহিত্য নানা ভাবে, নানা রূপে, নানা রসে প্রবাহিত হয়ে সাহিত্য-শিল্প-সংগীত রসিকদের তৃপ্ত করেছে। কে নেই সেই তালিকায়? কবি জয়দেব, কবি বিদ্যাপতি, গৌরচন্দ্রিকা, বৃন্দাবন থেকে শুরু করে বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, কে নেই?
কিন্তু যাঁর নাম এত দিন জানা যায়নি, শোনা যায়নি, সেই কৃষ্ণলীলামৃত গীত-এর পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের পরে এ বার নিশ্চয়ই ওই নামগুলোর পাশে আরও একটি নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হবে। আর সেই নামটি হল--- রাধা দাস। না না থুড়ি, রাধাদাস।


*****************************************************************************************************************

সিদ্ধার্থ সিংহ 


সিদ্ধার্থ সিংহ আশির দশকের সব্যসাচী লেখক। জন্ম কলকাতায়। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। বড়দের এবং ছোটদের জন্য লেখেন কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, সম্পাদকীয় এবং প্রচ্ছদ কাহিনি। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। আইসিএসসি এবং সিবিএসসি বোর্ডের প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। বানিয়েছেন দু'টি তথ্যচিত্র। লিখেছেন বেশ কয়েকটি ছায়াছবির চিত্রনাট্য। তাঁর গল্প নিয়েও সিনেমা হয়েছে। এক সময় আনন্দবাজার সংস্থায় সাংবাদিকতা ছাড়াও নিয়মিত মডেলিংয়ের কাজও করেছেন। ছড়া, কবিতা, অণুগল্প, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, শিশুতোষ, প্রচ্ছদকাহিনি, সম্পাদকীয়, অ্যাঙ্কার স্টোরি এবং বিষয়ভিত্তিক মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তিনশো সাতান্নটি বই। বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদও করেছেন। প্রবর্তন করেছেন 'রতিছন্দ', 'রিয়্যালিটি উপন্যাস' এবং 'ঝলক-গল্প'র। এই কথাসাহিত্যিক একক ছাড়াও, যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ কুমার চক্রবর্তী, শুভঙ্কর সিংহের সঙ্গে এক হাজার সাতটি সংকলন। ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' এবং ২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' সম্মানে ভূষিত হন। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন