রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

তোমায় খুঁজে ফিরি * রামচন্দ্র দত্ত




শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি

রামচন্দ্র দত্ত


১৮৭৯ সালে আমরা (মনোমোহন ও গোপালচন্দ্র মিত্র এবং রামচন্দ্র) শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট গমন করিয়াছিলাম। বেলা একটার সময় দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তখন তাঁহার ঘরের দ্বার রুদ্ধ ছিল। কাহাকে ডাকিব, কি বলিয়া ডাকিব, -ভাবিতেছি, এমন সময় এক ব্যক্তি আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিলেন।

     ‎তাঁহাকে দেখিয়া আমাদের প্রাণ যেন শীতল হইল। কিন্তু কে তিনি, তখন জানিতে পারিলাম না। ঘরের ভিতরে যাইয়া প্রণামান্তর উপবেশন করিলাম এবং মনে হইল যে ইনিই সেই মহাপুরুষ হইবেন। পরমহংসদেব কখনও কোন প্রকার সাধুর পরিচায়ক বেশভূষা করিতেন না। তন্নিমিত্ত অনেকেই তাঁহাকে দেখিয়াও চিনিতে পারে নাই।

     ‎সে-সময় আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতাম না, কিন্তু তাঁহার উপদেশে আমরা আস্তিক হইয়াছিলাম। উপদেশ অর্থে কেবল মুখের কথা নির্দেশ করিতেছি না। আমার গুরুকরণের বিষয়ে শুনুন।

     ‎আমার প্রথম কন্যাটি যখন মারা গেল, তখন আমার সংসার-সুখের চমক ভাঙ্গিল। ভগবান আছেন কিনা, সাক্ষাৎ ভাবে তাঁর দর্শন হয় কিনা, এবং তাঁকে লাভ করে সম্ভোগ করা যায় কিনা, এইসব প্রশ্ন অন্তরে উঠতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমাদের কুলগুরু এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে মনে করলাম যে হয়ত আমার প্রশ্নের মীমাংসা এঁর দ্বারা হতে পারবে। তাঁকে সমস্ত বলতে তিনি বললেন, এসব প্রশ্নের মীমাংসা তাঁহার দ্বারা তো হবেই না। অপর যে কেউ পারবেন, তাও তাঁর বিশ্বাস নাই। সাক্ষাৎ শিব যদি এসে দেখা দেন, তবে আমার এ রোগের ঔষধ মিলতে পারে। তাঁর এই কথায় প্রথমে আমার হতাশা এসে প্রাণটা আরও শুকিয়ে গেল, পরে ভাবলাম যে সাক্ষাৎ শিবও দয়া দিতে পারেন। তারপরেই ঠাকুরের কাছে গিয়ে পড়া, আর সব প্রশ্ন জল হয়ে গেল।

     ‎আমরা গিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিনি। যেমনি দেখা হওয়া আপনিই বলতে লাগলেন, 'ভগবানকে কে চায় যে পাবে? মানুষ বিষয় হলনা বলে এক ঘটি কাঁদছে, টাকা-ঐশ্বর্য হলনা বলে দু'ঘটি কাঁদছে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবর্গের জন্য দশ ঘটি কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাঁকে পাওয়ার জন্য কি কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে? যে তাঁকে পেতে চায়, যে তাঁর বিরহে চারিদিকে অন্ধকার দেখে, তাঁকে না পেলে যার সোয়াস্তি বোধ হয় না, সে-ই তাঁকে লাভ করে ধন্য হয়।' তাঁর এইরূপ সব কথায় অন্তরের সব প্রশ্নের আপনিই মীমাংসা হয়ে গেল। তিনি হৃদয়টি অধিকার করে বসলেন। …

 

২)

আমরা যখন তাঁহাকে 'ঈশ্বর আছেন কিনা' এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, 'দিনের বেলায় সূর্যের কিরণে একটিও তারা দেখা যায় না, সেইজন্যই তারা নাই একথা বলা যায় না। দুধে মাখন আছে, দুধ দেখিলে কি মাখনের কোন জ্ঞান হয়? মাখন দেখিতে হ'লে দুধকে দই করিতে হয়। পরে তাকে সূর্যোদয়ের আগে মন্থন করিলে মাখন বেরিয়ে আসে। যেমন বড় পুকুরে মাছ ধরতে হলে আগে যারা সেখানে মাছ ধরেছে তাদের কাছে গিয়ে কেমন মাছ আছে, কিসের টোপ খায়, কি চার প্রয়োজন, এই সকল বৃত্তান্ত জেনে নিলে, যে ব্যক্তি মাছ ধরতে যায় সে নিশ্চয়ই সিদ্ধ মনোরথ হয়। ছিপ ফেলামাত্র মাছ ধরা যায় না। স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়, পরে যেই 'ঘাই' ও 'ফুট' দেখতে পায় তার মনে মাছ আছে বলে বিশ্বাস হয়। ক্রমে সে মাছ গাঁথিয়া ফেলে। ঈশ্বর সম্বন্ধেও সেই প্রকার। *সাধুর কথায় বিশ্বাস করে মন-ছিপে, প্রাণ-কাঁটায়, নাম-টোপে, ভক্তি-চার ফেলে অপেক্ষা করতে হয়, তবে ঈশ্বরের ভাবরূপ 'ঘাই' ও 'ফুট' দেখতে পাওয়া যায়। পরে একদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হবেই।'*

     ‎আমরা ঈশ্বরই মানতাম না। আমাদের এই ধারণাই ছিল যে ঈশ্বর নাই। যদি থাকেন, তিনি নিরাকার, ব্রাহ্মসমাজে তাহাই শুনিয়াছিলাম। পরমহংসদেব আমাদের মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, 'ঈশ্বর প্রত্যক্ষ বিষয়। যাঁর মায়া এত সুন্দর ও মধুর, তিনি কি অপ্রত্যক্ষ হতে পারেন?' আমরা বলিলাম, 'সব সত্য, যা আপনি বলছেন, তার বিরুদ্ধে কথা কে বলতে পারবে? কিন্তু এই জন্মে কি তাঁকে পাওয়া যাবে?' তিনি বলিলেন, 'যেমন ভাব তেমনি লাভ, এই মূল প্রত্যয়।' এই বলিয়া একটি গীত গাহিলেন :

     ‎     _ভাবিলে ভাবের উদয় হয়।_

     ‎_যেমন ভাব তেমন লাভ মূল সে প্রত্যয়।_

     ‎     _কালী পদ সুধা হ্রদে, চিত্ত ডুবে রয়।_

     ‎_যাগ যজ্ঞ পূজা বলি কিছুই কিছু নয়।।_

     ‎তিনি পুনরায় বলিলেন, *'যেদিকে যত যাওয়া যায়, বিপরীত দিক ততই পিছিয়ে যায়, পূর্ব দিকে দশ হাত গেলে, পশ্চিম দিক দশ হাত পিছনে হবেই হবে।’* আমরা তথাপি বলিলাম যে ঈশ্বর আছেন বলিয়া প্রত্যক্ষ কিছু না দেখিলে দুর্বল অবিশ্বাসী মন কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। পরমহংসদেব বলিলেন, 'সান্নিপাতিক রোগী এক পুকুর জল খেতে চায়, এক হাঁড়ি ভাত খেতে চায়, কবিরাজ কি সেকথায় কখনও কান দেয়? না, ডাক্তার রোগীর কথায় ওষুধের ব্যবস্থা করতে পারেন? জ্বর পরিপাক পেলে ডাক্তার ওষুধ দেন, রোগীকে কিছু বলতে হয় না।'  আমাদের ব্যস্ত চিত্ত কিছুতেই স্থির হইল না।


৩)

দিনকতক পরে আমাদের মনে নিতান্ত ব্যাকুলতা আসিল। সেই সময়ে একদিন রজনী অবস্থানকালে স্বপ্নে দেখিলাম যে পূর্বপরিচিত এক সরোবরে আমরা স্নান করিয়া উঠিলাম। পরমহংসদেব নিকটে আসিয়া একটি মন্ত্র প্রদানপূর্বক বলিলেন, 'প্রত্যহ স্নানের পর আর্দ্র বস্ত্রে একশতবার জপ করবে।' নিদ্রাভঙ্গের পর আনন্দে শিহরিয়া উঠিলাম এবং তৎক্ষণাৎ দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার নিকটে যাইয়া স্বপ্ন বৃত্তান্ত প্রকাশ করিলাম। সেই কথা শুনিয়া পরমহংসদেব অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং নানাবিধ উপদেশ দিয়া এই বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন যে 'স্বপ্নে মন্ত্র পাওয়া নিতান্তই সৌভাগ্যের কথা'। আমরা এমনই জন্ম-অবিশ্বাসী, ইহাতেও বিশ্বাস হইল না। 'স্বপ্ন মস্তিষ্কের বিকার' -একথা ইংরেজি-বিদ্যা বিশারদ জ্ঞানী-প্রবরেরা বলিয়াছেন। চুপ করিয়া ফিরিয়া আসিলাম।

     ‎তদনন্তর দিন দিন অশান্তি আসিয়া আমাদের হৃদয় অধিকার করিল। তখন আপনা আপনি আক্ষেপ করিয়া কহিতাম, কি কুক্ষণেই পরমহংসদেবের কাছে আমরা গিয়াছিলাম! ঈশ্বর আছেন কিনা, তাহাই স্থির হইল না। এই প্রকার অবস্থায় আমরা কিয়দ্দিবস অতিবাহিত করিলাম। একদিন বেলা এগারটার সময় পটলডাঙার গোলদিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আমরা দুইজনে আমাদের মনের দুঃখের কথা বলাবলি করিতেছিলাম। এমন সময় একটি শ্যামকায় ব্যক্তি নিকটে আসিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, 'ব্যস্ত হচ্ছ কেন, সয়ে থাক'। আমরা চমকিয়া উঠিলাম। কে আমাদের প্রাণের কথা বুঝিয়া অশান্তিরূপ প্রজ্বলিত হুতাশনে আশা-বারি ঢালিয়া দিলেন? তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া দেখি, আর তিনি নাই। কোন্ দিকে যাইলেন, দেখিতে পাইলাম না। আমরা দুজনেই পাতি পাতি করিয়া দেখিলাম, তাহাকে আর দেখা গেল না। বেলা এগারটা, আমরা দুজনে সুস্থদেহ-সুস্থমনে দাঁড়াইয়া ছিলাম। কাহারও চোখের দোষ ছিল না কারণ সকলকে পূর্বের ন্যায় দেখিতেছি, কানের বিকৃতাবস্থা হয় নাই কারণ তাহাতেও পূর্ববৎ শ্রবণ করিতেছি। সেই দিন এই ধারণা হইল যে ঈশ্বর আছেন। পরমহংসদেবকে এই সংবাদ প্রদান করা হইলে তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাস্যে কহিলেন, 'কত কি দেখবে!'


********************************************************

পত্রিকা প্রসঙ্গে


 


স্বরবর্ণ-এ লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----


১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদি ) পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।



* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 




সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড. শুভঙ্কর দে          ড. অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত           দেবাশিস সাহা



প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * উৎপলকুমার বসু

 




উৎপলকুমার বসু
 (৩ আগস্ট ১৯৩৯ - ৩ অক্টোবর ২০১৫) বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন-এর একজন খ্যাতনামা কবি । ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবি হিসাবে পরিচিত ছিলেন । 
তাঁর সমসাময়িক, এমনকি তরুণতর কবিদের তুলনায় তাঁর কবিতা ছিল সম্পূর্ণ নূতন ।নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তুস্বভাবের যথাযথ বর্ণনা তার কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য । বস্তুর অভ্যন্তর সত্যের অভিমুখে কবিতাকে চালনা করেছেন উৎপল । তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবন প্রকৃতি কোনো রহস্যভূমি রচনা না করেই তাঁর কবিতা মেলে ধরে বর্তমান সমাজবাস্তবতা । উৎপলকুমার বসু বহুলব্যবহৃত শব্দগুলোকে কবিতার শরীরে এমনভাবে স্হাপন করেছেন যে তার ফলে তৈরি হয়েছে বাক্যের নূতন মাত্রা । অনেকে অবশ্য বলেন তার কবিতা 'আকারসর্বস্ব'। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার ও আকাদেমি পুরস্কার।‘চৈত্রে রচিত কবিতা’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে এখানে আমরা পড়ছি পাঁচটি কবিতা----



চৈত্রে রচিত কবিতা

উৎপলকুমার বসু 


১.


নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।


শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত

যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে

আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা


তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার

দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল

প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায়

কেন বা এসেছে সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,


নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে–


তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য

যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক

আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে–

সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি


এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর

নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল–ঝরে যাবে–

যদি না আমার

যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকো অসংখ্য কাটায়।



আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক, দৈব অনুরোধ।

যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে

যাবো দূর শূন্যপথে-তারা কেমন বান্ধব বলো

কোন্ ঘড়ি? কোন্ সূর্যরথ?


হয়ত প্রকৃত ঐ নগ্ন জলধারা–

যখন দুপুর কাপে গ্রীষ্মের নতুন সাবানে।


ওদের দৈবতা বলে আমি মানি। ওদের ঘড়ির

সমস্ত খঞ্জনপাখা লক্ষবার শোনায় অস্ফুটে—

আমার বন্ধু কি তুমি?

আমি কি তোমার?


কেন যে এখনো নই প্রাকৃতিক দুঃখজটাজাল?

আমার নিয়তি তুমি ঈর্ষা করো–আমার স্মরণে

যাও দূর তীর্থপথে, ভুল পথে–রক্তিম কাঁটায়

নিজেকে বিক্ষত করো। রোমিও–রোমিও


কেন শূন্যে মেঘলীন কম্পিত চাদর উড়ে গেলে–

অনির্বাণ, স্থির নাটকের যারা ছিল চারিত্রিক,

নেপথ্যে কুশল, প্রেম চেয়েছিল, দুঃখ,

তারা একে একে অম্লান ঝরে যায়?


তবে কি আমিও নই তেমন প্রেমিকা?


বহুদিন ছুঁয়ে যায় বর্তুল, বিস্মৃত পৃথিবী
লাটিম সূর্যের তাপে নানা দেশ-বিপুল শূন্যতা–
সে যেন বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের
গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে–একদিন–শুধু একদিন।

তখন, প্রবল মুহূর্তে আমি জেনেছি অনেক–
সমুদ্র কেমন হয়। কাকে বলে দুর্নিরীক্ষ্য তরু।
আমি কেন রুগ্ন হই। তুমি দূর স্খলিত তারার
কেন বা সমাধি গড়ো বনে বনে।

অথচ আঁধারে ফিরি আমি ক্লান্ত প্রদর্শক আলো,
যারা আসে সহচর রক্ত-লাল, গমের সবুজ,
তারা কেউ ধূর্ত নয়–দয়াশীল, বিনীত ভাষায়
বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার–সমস্ত অক্ষর।’

.

এখনি বৃষ্টির পর আমি পাবো জ্যোৎস্না-ভালোবাসা।
কেননা মেনেছি আমি শোকাকুল তুমিও বন্দিনী
অজেয় শকটে তার। কোনো কোনো রথ
একা যায় ভ্রান্ত পথে–অন্ধকারে–চালকবিহীন

যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে
যেখানে জলের মতো পরিসর, অফুরন্ত বায়ু
ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট–দীর্ণ হাহাকার

তুলেছিলে শূন্যতায় পাহাড়ের উর্বর মৃত্তিকা, তুমি দুঃখ, তুমি প্রেম,
শোনননি সতর্কবাণী। যেন স্রোত সহসা পাথরে
রুদ্ধ হল। এবং স্খলিত
বহু রথ, পদাতিক দেখে আমি মেনেছি এখন

প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালোবাসা।

.

৫.

পৃথিবীর সব তক প্রতিচ্ছায়া খুলে দেয় বসন্তের দিনে।
যখনি তোমাকে ডাকে ‘এসো এসো বিদেহ কলুষ’,
কেন যে লুণ্ঠিত, নীল পরিধান খুলে
তুমি বালিকার স্পষ্টতায় কঁদো–
বসন্তই জানে।

তবুও আমার স্বপ্ন দুপুরের–ঘুমন্ত রাতের–
প্রবল নদীর জলে ধরে রাখে নীল যবনিকা–
সে তোমার পরিচ্ছদ, অন্তরাল, হয়ত বা
যেটুকু রহস্য আমি ভালোবাসি বালিকার কিশোর শরীরে–

এখন বিনিদ্র রাতে পুড়ে যায় সব মোমবাতি!
এবং অলেখা গান নিষ্ফলতা বয়েছিল কত দীর্ঘ দিন
সে নয় প্রেমের দুঃখ? তবু সতর্কতা
ভেঙে ফেলে সুন্দরের প্রিয় পুষ্পধার
বলেছিল, ‘এই প্রেম অন্তিমের, সমস্ত ফুলের’











*********************************************************************


ভ্রমণ কাহিনি * ইন্দ্রনীল মণ্ডল

 


LRK-তে একদিন

ইন্দ্রনীল মণ্ডল 


সুদূর কলকাতা থেকে প্রথমে উড়ে গিয়েছিলাম আমেদাবাদ এবং সেখান থেকে ভাড়া গাড়িতে করে সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে গুজরাটের এক অন্তিম প্রান্তে — কচ্ছের ছোট রাণের (Little Rann of Kutch,LRK) কাছে একটি রিসোর্টে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, এমন ধরনের বন্যপ্রাণ দেখা, যা ভারতবর্ষের আর প্রায় কোথাও সেভাবে দেখা যায় না। 
           এখন অতি ভোর। হালকা কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য পূর্ব দিগন্তে উপস্থিত হবো হবো করছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেলেও এখানে সূর্য একটু দেরিতেই উদিত হয়, অস্তও যায় অনেকটা দেরিতে। সেই কারণে আমাদের মতন কলকাতাবাসীর কাছে সেটা এমন কিছু ভোর নয়। গুজরাটি সজ্জায় সুসজ্জিত যে রিসোর্টে আমরা এসেছি, তার সামনের সামান্য শিশির ভেজা বিস্তৃত মাঠের ওপর কতগুলো ‘লাল-লতিকা হটটিটি’ আর বক দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমরা গাড়িতে করে যাব সাফারি করতে LRK- তে। সূর্য উঠবো না উঠবো না করেও শেষ পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে পূর্ব দিগন্তে হাজির হয়েছে। ভোরের নরম আলোয় চারপাশটা বেশ সুন্দর লাগছিল। শান্ত, নিরিবিলি, গাছগাছালিতে ঢাকা পরিবেশ। বিভিন্ন পাখির মিষ্টি সুরেলা আওয়াজে বোনা ভোরাই পর্ব শেষ করে আমরা যাত্রা করেছিলাম এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশের উদ্দেশ্যে। 
          সাফারির গাড়ি তার নির্দিষ্ট প্রবেশ পথের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল দেখলাম যে, চারদিকে ছোট ছোট কাপাস তুলো চাষ হয়েছে। জানা গেল যে, তুলোর বীজ থেকে প্রচুর ভোজ্য তেল তৈরি হয়। সেই কাপাস তুলোর চাষের জমি ভেদ করে আমাদের সাফারি গাড়ি এসে পৌঁছেছিল কচ্ছের রাণের প্রবেশ পথের কাছে। ভেতরে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেখিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল মেঠো, রুক্ষ শুষ্ক, ফুটিফাটা ভূমির ওপর দিয়ে। যত এগোতে লাগলাম দেখলাম, ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল মাটির রুক্ষতার পরিমান। প্রচুর সরু, সাদা সাদা দাগ মাটির বুকে ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইডকে জিজ্ঞেস করায় সে গুজরাটি হিন্দি মিলিয়ে যা বললো তাতে বোঝা গেল যে, এখানকার মাটির তলা থেকে অদ্ভুতভাবে নোনা জল মাটির ওপরে উঠে আসে এবং সেই নোনা জল সূর্যের আলোয় শুকিয়ে যায়। জলটা বাষ্পীভূত হয়ে গেলে মাটির উপরে শুধু নুনের দানাগুলো জমে থাকে। সাদা দাগগুলো সেই জমাট বাঁধা দানাদার নুনেরই চিহ্ন।
            গাড়ি যত এগোতে লাগলো দেখা গেল যে কেবল নির্দিষ্ট কিছু পথের উপর দিয়েই গাড়িকে যেতে হচ্ছে। চারিদিক কাঁটা গাছের, বিশেষ করে বাবলা জাতীয় গাছের ঝোপে ভর্তি। আমাদের চোখ খুঁজি যাচ্ছিল সেই নির্দিষ্ট জীব –ভারতীয় ‘বন্যগাধা’ 
(Equus hemionus)। কথায় কথায় আমরা অনেককে গর্ধব বা গাধা বলে ডেকে থাকি। কিন্তু অনেকেই চাক্ষুষ কখনো গাধা দেখেনি, বিশেষ করে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। সেক্ষেত্রে এই বন্য গাধা দেখতে আসা, তার সঙ্গে আরো অনেক কিছু। সেগুলো খুবই রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার ছিল। যাত্রা পথে আমাদের ডান দিকের পুরো জায়গাটাই ‘দলদল’ অর্থাৎ কাদা-জলপূর্ণ মাটি, তারপরেই বিশাল জলাশয়। জলাশয়ের মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মতো অংশে স্বল্প কিছু শরবন। আর সেই জলাশয় ছাড়িয়ে বহুদূর আবছা, অস্পষ্ট ভাবে শহুরে সভ্যতার নিদর্শন দেখা যাচ্ছিল। জলাশয়ের খুব কাছে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়নি। তার কারণ নরম মাটি। এখানে মাটি এমন নরম যে ওপর থেকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল না। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সামান্য কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরে মনে হচ্ছিল যে, কেউ যেন আমাকে নিচের দিকে ধীরে ধীরে টেনে নিচ্ছিল, অনেকটা চোরাবালির মত। 
            জলাশয়ের বুকে যে পাখিদের আমরা দেখেছিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও তা ভোলা যাবে না। মূলত আমরা দেখেছি বিশাল বড় বড় পেলিক্যান আর ফ্লেমিঙ্গো। এই সমস্ত পরিযায়ী পাখি বহুদূর থেকে শীতের প্রায় শুরুতেই তারা এই জলাশয় চলে এসেছে তাদের অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করতে। আগামী কয়েক মাস তারা এখানেই নাকি অবস্থান করবে। সূর্যের হলদেটে আলো পেলিক্যানগুলোর ডানায় পড়ে যে দারুন এক দৃশ্যের অবতারণা করেছিল তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না। জলাশয়ের বুকে কেউ কেউ মনের আনন্দে ভাসছে, কেউ ডানা ঝাপটাচ্ছে, কেউ নিমেষে হাঁ করে তার বিশাল লম্বা চঞ্চুর তলায় যে হলুদ থলের মত অংশ রয়েছে, সেখানে তার খাদ্য, মাছ ভরে রাখছে। এটাই এদের বৈশিষ্ট্য। এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতেই গাড়ি এগিয়ে চলল। 
        হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম প্রায় হালকা সাদা, হালকা বাদামী রঙ যুক্ত অনেকগুলো বন্য গাধা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাঁটা গাছের ঝোপগুলোর পাশ থেকে ওদের খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। ওইখানে গাড়ি সরাসরি যাওয়ার উপায় না থাকায় আমাদের চালক ভাই অত্যন্ত দক্ষতা সহকারে প্রায় পথহীন রুক্ষ জমির ওপর দিয়ে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে সুন্দর ভাবে পৌঁছে গেল সেই জায়গায়, যেখানে গাধাগুলো দলবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। বন্য গাধার যে এত সুন্দর রূপ হতে পারে সেটা সামনাসামনি না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে গাধা দেখেছি, কিন্তু তাদের রূপ অন্যরকম ছিল। ছোট, ধূসরবর্ণা এবং তারা মোট বয়তেই সদা ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এই সমস্ত বন্য গাধার দেহের চাকচিক্য, সৌন্দর্য এতই ভালো যে তাদের গাধা বলতে জিভ আটকে যায়। দলটার মধ্যে কেউ ঘাস খাচ্ছিল বা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। সহজ কথায় নিজেদের মধ্যে তারা নিবিষ্ট ছিল। আমরা বাইরের মানুষজন তাদের এই সুন্দর করে গড়া পরিবেশে, তাদের জগতে, জোর করে নাক গলিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে তারা একটু বিরক্ত তো হবেই। তাই কেউ কেউ ঘাস খেতে খেতেই একটু ভয় পেয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল। অবশেষে আমরা বন্য গাধার দলটাকে বেশ সামনে থেকে দেখতে পেলাম। মনের সুখে তাদের ছবি তুললাম বিভিন্ন আঙ্গিকে। আমরা যখন গাড়িটাকে একটু জোরে ছুটিয়ে তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখন অদ্ভুত ভাবে একটা বন্য গাধা কোথা থেকে দলছুট হয়ে আমাদের গাড়ির পাশে পাশে দৌড়েছিল আর অদ্ভুত স্বরে ডাকছিল। গাড়ির শব্দ এবং গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় ভয় পেয়ে গাধাটা দিক পরিবর্তন করে জঙ্গলের দিকে ঢুকে পড়েছিল। 
             প্রায় শ’খানেক গাধার দলকে একসঙ্গে এক জায়গায় দেখতে পেয়ে এক আনন্দদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা খুবই উল্লাসিত ছিলাম। মন কানায় কানায়, ভালো লাগায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছিল। তারা ইতি-উতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছিল। সবুজ ওড়নার বুকে সকালের নরম আলোয় উজ্জ্বলবর্ণা, বেশ স্বাস্থ্যবান, বড় বড়, জৌলুসযুক্ত বন্য গাধাগুলোকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিল।বন্য গাধার রূপে আমরা মোহিত হয়ে গেছিলাম। এই বন্য গাধা এই অঞ্চল ছাড়া আর ভারতবর্ষে বিশেষ কোথাও মুক্ত পরিবেশে জঙ্গলের বাতাবরণে দেখতে পাওয়া যায় না। কচ্ছের ছোট রাণ অঞ্চলে অবস্থিত, ভারতীয় বন্য গাধা অভয়ারণ্যের মোট আয়তন প্রায় ৪,৯০০ বর্গকিলোমিটার। এরা জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রে, মরুভূমি, শুষ্ক তৃণভূমি এবং ঝোপঝাড় সহ আবাসস্থলেই বাস করে। গুজরাটের কচ্ছের রাণে তাদের দেখতেই আমরা উড়ে এসেছি, বহু দূরের কলকাতা মহানগর থেকে।
           বন্য গাধা দেখতে দেখতেই জানতে পারা গেল যে, এই অঞ্চলেই একমাত্র ভিন্নভাবে বড় বড় দানাযুক্ত প্রাকৃতিক নুন তৈরি হয় এই মাটির তলার জল তুলে তাকে শুকিয়ে নিয়ে। অন্য জায়গায় সমুদ্রের জলকে ধরে রেখে সেখান থেকে নুন তৈরি করা হয়। কিন্তু এখানে, এখানকার মাটির তলার জলকে পাম্প করে তুলে বিশাল বড় বড় জমির মধ্যে জলটাকে বেঁধে রাখা হয় ছোট আল দিয়ে। এই ধরে রাখা জলই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং নুন গুলো ওই পুরো জমিটার উপরে পড়ে থাকে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘লবণ চাষ’। অনেক প্রকার চাষের কথা শুনলেও ‘লবণ চাষ’ শব্দটা ছিল আমাদের কাছে সত্যিই এক নতুন চমক এবং কীভাবে তা করে আমরা তা চাক্ষুষ করে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম এবং আনন্দও পেয়েছিলাম। এই নুনগুলোকে সংগ্রহ করে এক জায়গায় জমা করা হয় এবং তাতে এই ক্রিস্টাল বা দানাদার নুনের বড় বড় ঢিপি বা পাহাড়ের মত তৈরি হয়। এই নুনের ঢিপিগুলোর ওপরে রোজকার ধুলো, ময়লা, বৃষ্টির জল ইত্যাদি জমা হতে থাকে। তবে এই বড়বড় দানার নুনকেই আবার কারখানায় আরো সুক্ষভাবে গুঁড়ো করে তার ময়লাগুলোকে দূর করে আরও শোধন করে, পরিমার্জন করে পুনরায় প্যাকেটজাত করা হয়।
            স্থলভাগ ছেড়ে এবার জলভাগের দিকে নজর দেওয়া যাক। আগেই বলেছি যে হাজার হাজার পেলিক্যানদের ডাক, তাদের ওড়াউড়ি, নিজেদের মধ্যে মারপিট, জলে ভেসেভেসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া, এই সবই আমরা আশ্লেষে উপভোগ করেছিলাম। ওর সঙ্গে দেখছিলাম বেশ কিছু সরাল আর পাতিভূতি হাঁসদের যারা জলের স্রোতে, হাওয়ার টানে অদ্ভুতভাবে ভেসে যাচ্ছিল। জলাশয়ের মাঝে মাঝে ছিল কিছু শরবন, যার আশপাশে বিভিন্ন ধরনের বক তাদের এক পা তুলে তুলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। কিছু সারস, তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ করে তাদের উপস্থিতিকে জানান দিচ্ছিল। দেখেছিলাম, কাঁটা ঝোপের মাঝে মাঝে যে কয়েকটা গাছ জন্মেছে, সেই গাছের উঁচু ডালে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন ধরনের বক। যার মধ্যে অন্যতম হলো পেইন্টেড স্টর্ক, খুন্তে বক ইত্যাদি। অনেকগুলো সারস তার দেহের ধূসর পাখা নিয়ে এমন একটা দুলকি চালে জলের কিনারা বরাবর হেঁটে যাচ্ছিল। ফ্লেমিঙ্গদের কথা না বললে এই সাফারির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জলাশয়ের পেলিক্যানদের পাশাপাশি ফ্লেমিঙ্গরাও তাদের দলবল নিয়ে গোলাপি মাথা, পাখার তলায় লালচে রং আর সরু সরু লালচে পা নিয়ে বিশাল লম্বা বাঁকানো গলাটাকে কখনো নামিয়ে, পেঁচিয়ে,কখনো ‘S’এর মত করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তারা খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। এই সমস্ত লেসার ফ্লেমিঙ্গো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছিল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কেউ কেউ জলের মধ্যে সরু, লম্বা লম্বা পা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। সে কিযে এক ভালোলাগার চিত্র তৈরি হয়েছিল তা বলার নয়। এইসব দেখা শেষ করে আমরা ফিরতি পথের যতক্ষণ জলাশয়ের পাশ দিয়ে আসছিলাম যতক্ষণ নানা জাতীয় জলার পাখি, বিভিন্ন হাঁস, বক তাদের বিভিন্ন কেরামতি দেখাতেই ব্যস্ত ছিল। আমরা সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পাচ্ছিলাম না।       
          এইভাবে আমাদের সকালের যাত্রাটা শেষ হলেও একই ‘রাণের’ অন্য একটা দিকে বিকেলে যখন পৌঁছানো পর, দেখতে পেয়েছিলাম ধূ ধূ, জনমানবহীন প্রান্তর। আর তার পশ্চাৎপটে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল দিনের শেষ রবিরশ্মি। এই ধরনের ধূ ধূ পরিবেশে চারদিকে খালি লবণ চাষের কাজ চলছে। আর লবণ চাষের জমির মাঝে মাঝে অনেক দূরে দূরে দু-একটা ছোট ছোট আস্তানা, লবণ চাষীদের। এই রকম নরম মাটির মাঝখান থেকে এলোমেলো ভাবে চলে গেছে কিছু চাকার দাগ। সেই সব চাকার দাগ ধরে বা নতুন পথ তৈরি করে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছিল আরো গভীর অঞ্চলের দিকে। ক্লান্ত অপরাহ্ণের গোধূলি আলোয় আসন্ন সন্ধ্যার মুখে হঠাৎই আমরা এরকম নির্জন মনুষ্যহীন জঙ্গলের সামনে কিছু বন্য গাধাকে দেখতে পেলাম। এরকম ফাঁকা ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝে মাঝে কাঁটাগাছের ঝোপের মধ্যে তারা লুকিয়ে ছিল। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তারা আরো ভিতরের দিকে সরে যেতে লাগলো। আসন্ন সন্ধ্যার প্রেক্ষাপটে বন্য গাধাদের পৃষ্ঠদেশ বরাবর সূর্য ধীরে ধীরে সে দিনের মতো নিদ্রা যাওয়ার চেষ্টা করার যে একটা সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকদিন মনে থাকবে।একটি পেঁচা দেখলাম কাঁটা গাছের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে তার সৌন্দর্য দেখানোর জন্য বসেছিল। 
        ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে গ্রাস করতে থাকায় আমরা যখন ফিরতি পথ ধরেছিলাম তখনই বিপদ শুরু হয়েছিল। সাফারি গাড়ির চালক ওই আধো অন্ধকারে ঠিকমতো গাড়ির চাকার দাগ বুঝতে পারেনি। তাই আপাতত কঠিন অন্য মাটির উপর দিয়ে পথ তৈরি করে নিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎই ভারী গাড়িটা মাটিতে, তথাকথিত কাদায় আটকে যায়। অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটিকে ওই নরম মাটির থেকে ওঠাতে পারা যায়নি। চাকা যত জোরে ঘুরছিল গাড়ি তত আরও নরম মাটিতে বসে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই গাঢ় অন্ধকার আমাদের ঢেকে ফেলেছিল। কেবল আমরা তিনজন আর সাফারি চালক ঐরকম “ন যযৌ ন তস্থৌ" অবস্থায় পড়ে ছিলাম। চারদিকে নিঝুম অন্ধকার, আশপাশে কেউ কোথাও নেই। মোবাইলের নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করছিল না। ফলে আমরা খানিকটা ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। যে আনন্দ বা উল্লাস নিয়ে আমরা সাফারি শুরু করেছিলাম হঠাৎই তা আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। কীভাবে এই দলদল থেকে, এই লবণ জমির থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে রিসোর্ট পৌঁছাবো তা ভাবনা শুরু হয়েছিল। তাহলে কী আমাদের এই ভাবেই সারারাত এখানে কাটাতে হবে? এই সমস্ত নানা আজেবাজে চিন্তায় আমাদের মন মুহূর্তে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। সাফারি গাড়ির চালক আমাদেরকে ফেলে রেখে দূরে বোধহয় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেছিল যাতে আমরা এই অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি পাই। কারণ আমাদেরকে ভালোভাবে অক্ষত ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তারই । স্থানীয় ভাষায় সে কোন রকমে তার অন্য সাথীদের যোগাযোগ করে আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সাহায্যের জন্য অন্য একটি গাড়ি উপযুক্ত সরঞ্জাম নিয়ে চলে আসবে আর আমরা এই অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবো। 
         আশার কথা এই যে, এই ধরনের জঙ্গলে সেরকম হিংস্র কোন শ্বাপদ ছিলনা। শেয়াল, সাপ, বেজি ইত্যাদি ছোটখাটো জীব আর কিছু নিশাচর প্রাণী থাকলেও তারা আমাদের গাড়িতে উঠে ভয়ংকর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সাফারি চাল ক যদিও আমাদেরকে বারবার আশ্বস্ত করছিল এই বলে-- "কুছ নেহি হোগা। আপ চিন্তা মৎ কিজিয়ে। হাম হ্যায় না, সব্ ঠিক হো জায়গা।"
          চারদিকে ঘন অন্ধকার, মেঘহীন আকাশে শুধু তারাগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছিল, আর অনেক দূরে আবছা ভাবে শহরের আলোর কিছু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে মনে খালি ভাবছিলাম কতক্ষণে ওই আলোর কাছাকাছি যেতে পারবো, কতক্ষণে এই বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবো। চারদিকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,রাতচরা পাখিদের ডাক, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা বন্য গাধাদের রাসভ, দূর থেকে বেশি আশা কিছু নিশাচর প্রাণীর ডাক ছাড়া আর কিছুই আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল না। যদি এইখানে বসবাসের ব্যবস্থা থাকত তাহলে হয়তো এই পরিবেশটাই অতি মনোরম, হৃদয়গ্রাহী হয়ে থাকতো। কিন্তু সেইক্ষণে যেহেতু আমরা আটকে পড়েছিলাম এবং কোনভাবেই সুরক্ষিত ছিলাম না, তাই যে পরিবেশ আমাদেরকে মুগ্ধ করতে পারত তা অচিরেই ভীতিময়, আতঙ্কের পরিবেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছিল।       
             এইভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর দূর থেকে দুটি আলোর বিন্দুকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। বুঝতে পারলাম সাহায্যের জন্য গাড়ি এসে গেছে। তখন মনে একটু সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। মন থেকে ভয়ও খানিকটা দূর হয়েছিল। সাহায্যের গাড়ি আরো কাছে আসতে গাড়ির ব্যাটারি থেকে তার নিয়ে আলো জ্বালিয়ে আর আমাদের মোবাইলের আলোর সাহায্যে আমাদের গাড়িটাকে কাদার থেকে উদ্ধার করে, ওই গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ওই সাহায্যকারী গাড়ির পেছনে পেছনে, সাবধানে সেটাকে অনুসরণ করে আমরা ধীরে ধীরে আতঙ্কপূর্ণ অন্ধকার পরিবেশের থেকে শহরের আলোকময় পরিবেশে এসে মুক্তি লাভ করেছিলাম। একটা সন্ধ্যা, একরাশ উদ্বেগ ও ভয়ার্ত মন নিয়ে প্রায় জনমানবহীন সংরক্ষিত অভয়ারণ্যের খোলা আকাশের নিচে নিশ্চুপ ভাবে সময় অতিবাহিত করার যে অভিজ্ঞতা, তা দীর্ঘদিন মনে থাকবে। অবশেষে রিসোর্টে ফিরে, মনের মধ্যে LRK-কে বিভিন্ন রূপে দেখার স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে রাতটাকে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করেছিলাম।




********************************************************************************






                             ইন্দ্রনীল মন্ডল 


শিক্ষাগত যোগ্যতা: M.sc,Ph.D  পেশা : শিক্ষকতা 
বয়স : ৫৯ বছর  কোন একক বই না থাকলেও বিভিন্ন প্রকাশনীর বইতে লেখা রয়েছে।

রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি * প্রভাত ভট্টাচার্য

 



ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ গল্প 

প্রভাত ভট্টাচার্য 

পর্ব * ৪

প্রস্তুতি পর্ব 


এরপর চলে এল আরও বেশ কয়েকজন । তাদের অনেকেরই অপরাধমূলক কাজকর্মের ইতিহাস আছে। সেটা অবশ্য মন্দ নয়। অজয় যা চেয়েছিল সেরকমভাবেই এগোচ্ছে সবকিছু ।

    সেদিন সে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করল হলঘরে।

   আপনারা নিশ্চয়ই জানার জন্য মুখিয়ে আছেন যে কেন আপনাদের এখানে ডেকে আনা হয়েছে ।অজয় বলল। 

    ঠিক তাই। বলল বিতান। 

     তাহলে বলি সবকিছু । এ পৃথিবীতে সবকিছু দখল করে নিতে হয়। তাই আমি পরিকল্পনা করেছি যে এমন একটা বাহিনী তৈরি করব, যা সবকিছুর ওপরে প্রভুত্ব করবে। আপনারা সেই বাহিনীর অংশ ।

   আমরা এই কজনে মিলে সবার ওপরে ছড়ি ঘোরাবো! বলে উঠল রমেশ। 

    সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল নিজেদের মধ্যে । 

  ছড়িয়ে পড়ল মৃদু গুঞ্জন। 

    একটু যেন বিরক্ত হল অজয়। 

    একটু চুপ করুন সবাই। বলে উঠল সে। 

    তার বলার ভঙ্গিতে ফুটে উঠল এক রূঢ় আদেশ। 

    চুপ করে গেল সবাই। 

     আমার সঙ্গে চলুন সবাই। বলে অজয় একদিকের দেওয়ালে একটা বোতাম টিপল।   সবাই সবিস্ময়ে দেখল, বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। তার মধ্যে দিয়ে অজয় এগিয়ে চলল। বাকিরা অনুসরণ করল তাকে। নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে। কিছুটা নামার পর আর একটা বিশাল হলঘরে এসে পৌঁছল সবাই। ওপর থেকে বোঝাই যায় না যে নীচে এরকম একটা ঘর আছে। 

     সেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু যান্ত্রিক অবয়ব। 

   এরা সব রোবট। এরা  নানারকমের অস্ত্র তৈরি করছে, আর তাছাড়াও আরও অনেক কিছু জিনিস তৈরি করছে, যার সাহায্যে সবকিছুর ওপরে কর্তৃত্ব করা যাবে। এই সবকিছুর ইন চার্জ হচ্ছে রবিনসন, আর রবিনসনকে চালাই আমি। 

     সবকিছু দেখে সবাই তো স্তম্ভিত। 

    দারুণ ব্যাপার  ! বলে উঠল বাবলু। 

    অজয়ের মুখে হাসির রেখা। 

    আরে, এই তো রবিনসন। সব ঠিকঠাক তো?

    ফাইন। 

    আজকের মত এই পর্যন্তই।প্রস্তুতি চলুক। এরপর আমি বলে দেব কাকে কি করতে হবে  ।চলুন ওপরে। 

     ওপরে উঠে সবাই যে যার ঘরে চলে গেল। 

   শার্দুল দাঁড়িয়ে রয়েছে । তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলতে লাগল অজয়। 

    কি যে হবে কে জানে! আবদুল বলল অর্জুনের দিকে চেয়ে। 

    দেখা যাক। বলে অর্জুন ঘরে ঢুকে গেল। 

    এক অপার্থিব চীৎকার ভেসে এল জঙ্গল থেকে।












************************************"**************************************************************



প্রভাত ভট্টাচার্য  

তিনি সব্যসাচী--- এক হাতে সামলান চিকিৎসকের গুরুভার দায়িত্ব আর এক হাতে ফোটান সাহিত্য সৃষ্টির ফুল। দ্য হার্ট, মিশন পসিবল, মাই ডটার, রাজবাড়িতে রক্তপাত , ডিটেক্টিভ সূর্য এবং কবিতা সংকলন - কাগজের মানুষ এবং ফিনিক্স পাখি তাঁর উজ্জ্বল সাহিত্যসৃষ্টি । সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর  তিনটি ভিন্ন ধরনের উপন্যাস - দশভুজা, কাগজের মানুষ ও মায়াবী গ্রাম। এছাড়াও তাঁর আর একটি মনভোলানো সৃষ্টি 'গুহা মানবের ডায়েরি'  




উপন্যাস * সুদীপ ঘোষাল




জীবনহাটের কড়চা 

সুদীপ ঘোষাল 

সপ্তম -পর্ব 


সকলের জীবন তো সমানতালে চলে না। ছন্দপতন ঘটে যায় নিয়তি আসার মতাে। কে যে আড়ালে থেকে সুতাে ধরে পুতুলের নৃত্যে,  নাচায়, তা একমাত্র জগাই ক্ষ্যাপা' জানে। অংশুমানের কাকা যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। তড়িৎ, আলাককাকা, বাবলুকাকা, , বুলুকাকা, দিলীপদা, অমরকাকা, টুলাদা, বুলাদা সবার নাম মুখে মুখে হেমন্তবাবু অকলে চলে যাওয়ার দূঃখ।দিলীপদা তুলে নিলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। আর যে পথিক গােপনে গােপনে নীরবে সংসারের দায়িত্ব পান করে গেছেন তিনি আর কেউ নন, অংশুমানের মেজদা। তার নাম রিলিফ। সকলের, যন্ত্রণা ভুলিয়ে  দেওয়ার হাত আছে। অংশুমান স্বীকার করে মনের গােপনে নীরবে হাসিমুখে। যাই হােক সেবার ক্লাস সেভেনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে অংশু।    গ্রামের বাড়ি পুরুলেতে সদলবলে পুনরাগমন। অংশুমানের বাবা জমি-জায়গা দেখাশোনা করেন আর লিলুয়া থেকে দুই দাদা সুবিধা-অসুবিধায় বাবাকে সাহায্য করেন।


অংশুমান এবার গ্রাম থেকে চার  মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্কুলে, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার বাবার সাথে স্কুলে গেল পায়ে হেটে। তখনকার দিনে পাকা পথ ছিল না। জমির আলরাস্তা ধরে স্কুলে গেল অশুমান। পায়ে ব্যথা ছিল। ধানের শিষে পা কেটে গিয়েছিল অংশমানের। স্কুলে একটা পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় খাতা দেখে বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় অংশুমান সফল। আমরা ওকে ভর্তি নেব। ভর্তি হয়ে গেলাস এইটে। এবার অন্য এক জীবন। শহর থেকে এসে গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হল এবার।পরের দিন থেকেই স্কুলে যাওয়া শুর করল অংশু। আল রাস্তা ধরে কাবে কােনাে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। মাঝে একটা কদর আছে। শীতকালে হাঁটু জল। কিন্তু হলে সর না হলে পার হওয়া যাবে না। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী অম্বুজাক্ষ দত্ত মহাশয়। ইংরাজি স্যার ছিলেন শ্রী দিলীপ উট্টোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অংশুমানের বন্ধু জুটে গেল অনেক। অমল, রবীন্দ্রনাথ, বিনয়, টাদ, বিশ্বরূপ, মিল, অধীর, পিনু, শ্যামল ও আরও অনেক ৭। সবার সঙ্গে মেশার এক সহজাত স্বভাব অংশুমানের ছিল চিরদিন। একদিন অমল বলল-সবাই আমরা একসাথে দুর্গাপুর শহরে বেড়াতে যাব।" অংশুমান বলল-"তাহলে কথাটা প্রথমে আমাদের ভূগোল সার, মহিম বাবু কে বলি।" ক্লাসে মহিম কুমার সাধু মহাশয় পড়াতে এলে অংশুমান। বলল-"স্যার, দুর্গাপুর শিল্পনগরী। যদি আপনি  নিয়ে যান, তাহলে ভালাে হয়।" মহিমবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুর। সারাদিন ঘোরার পর তারা রাত্রিবেলায় ফিরেছিলাম নদীর ধারে। তখন। বর্যাকাল। অজয় নদীতে প্রবল জলের ঢেউ। রাত্রি মাঝিরা ওপারে ঘুমাচ্ছে। তাহলে নৌকা আনবে কে? মহিম বাবু বলামাত্রই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিখেশ্বর গ্রামের তিনটি সাহসী ছেলে। ভরা নদীর বুকে অতি সহজেই সাঁতার কেটে চলল তিনটি বালক। অংশগুরা পাড় থেকে চিৎকার করে বলছে, "তােরা। সবাই নিরাপদে আছিস তার?" উত্তর আসছে মাঝের নদী থেকে নেই। আমরা ঠিক আছি।” এইভাবে সাড়া দিতে দিতে ওরা ওপ গেল। তারপর নিজেরাই দড়ি খুলে নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করল। নৌকা। এপারে এলে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল-“কি রে, মাঝিদের ডাকলি ।ওরা উত্তর দিল—“সারাদিন খাটুনির পর ওরা একটু নিদ্রামগ্ন, কি করে, কোন লজ্জায় ওদের ঘুম ভাঙাই বল। ওরা আমাদের চেনে। আমরা ওদের ঘরের লােক।”অংশুমান চিন্তা করল, মানুষকে কতটা ভালােবাসে এরা, তারই প্রমাণ এই বাক্য। আবার নতুন করে মানুষকে ভালােবাসতে ইচ্ছে করল অংশুমানের। দশজন করে একটি নৌকায় মােট পাঁচবারে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ নিরাপদে সেই রাত্রে নদীর এপারে চলে এল, ওই তিনজনের অসীম সাহসের ফলে। স্কুলে অংশুমানেরা সেই রাত্রি বেঞ্চিতে শুয়ে কাটালাে। পরদিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই হাঁটা রাস্তা ধরে চলে এল একেবারে নিজের বাড়ি পুরুলে’-তে। গ্রামের নাম ‘পুরুলিয়া’। কেতুগ্রাম থানায় অবস্থিত। সবাই ছােট করে গ্রামটিকে ‘পুরুলে’ বলেই চেনে। অংশুমানের স্বপ্নভূমি এই পুরুলে গ্রাম। -অংশুমান জানালার ধারে বসে ভাবছে গ্রামের কথা। পুরুলেতে পূজা বাড়ি আছে। এই বাড়িটি মােটামুটি দুইশত বছরের পুরােনাে বাড়ি। এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। একটি হাইস্কুল আছে। এটি দান করেছিলেন অতুলবাৰু তার বাবা মহেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। স্কুলটির নাম বর্তমানে মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। তখন স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমােদন পায়নি। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের স্কুলে পড়াশােনা করতে যেত। অংশুমান এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বর্ষা-গ্রীষ্ম-শরতে হেঁটেই স্কুলে যেত। সময় তাে আর থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে অংশুমানের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সমাপ্তও হল। শিবলুন স্টেশনে নেমে অংশুর মন খুশ।। আমের আর  মাটির গন্ধে মন ভরপূর আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠত।  সেখান খেকে পুরলে প্রায় তিন মাইল পথ। কিন্তু রাস্তার দু-ধারের আখ আর ফাঁকা মাঠ অংশুমানের পথের ক্লান্তি দূর করে দিত। এক পা করে আর সৰ পরিচিত লােকের কস্বর কি গাে দাদাবাবু, অনেকদিন পরে লেখার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই কথার মায়া আর মাটির আর আমি কোথাও পাওয়া যাবে না। হটিতে হটিতে আুমানের মনে পড়ে কবির লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, “এইটি আমার গ্রাম আমার স্বর্গপুরী এইখানেতে হদয় আমার গেছ়ে চুরি।"

বাবু বসে আছে বাইরের বারান্দায়। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, বাবুদা! ৩াড়াতাড়ি চলো, ও পাড়ায় একজন গলায় দড়ি দেবে বলে দোর বন্ধ করেছে,  কিছুতেই খুলছে না।"


বাবু চোখের পলক পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে হাজির। গোলার তলায় শাবল ছিল, শাবল দিয়ে দরজাটা ভেঙে দেখল, একটা টুল এনে ছেলেটি গলায় গামছা দিয়ে  কড়িকাঠে বাঁধছে। প্রায় ঝুলে পড়ার অবস্থায় বাবু ওর পা-দুটি কাঁধে রেখে বলল, “যা বলছি কর, গলা থেকে গামছা  খোল।ছেলেটি বলল, "বাবুদা আমাকে মরতে দাও।”বাবু বলল, “তাের সুবিধা-অসুবিধার বিচার আমরা করব। তুই আগে দড়ি খােল।"বাবুর কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য ছেলেটির ছিল না। দড়ি খুলে শান্ত ছেলের মতাে কাঁধ থেকে নেমে এল। ছেলেটির বাবা-মাকে একটু বকাঝকা করার পরে বাবু ছেলেটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এল। বাবুর সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করল ছেলেটি। মন শান্ত হলে বাড়ি গেল সে। এরকম অসংখ্য কাণ্ডকারখানা বাবুর সামাজিক জীবনে মিলেমিশে আছে। বড়দার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে বৈশাখ মাসে। বিয়ে হবে লাভপুরের আবাায়। বড়দা ও রিলিফদা চাকরি করে। প্রভাতবাবু দুই ছােট ছেলে বাবু আর অংশুমানকে নিয়ে যাবতীয় জোগাড় করলেন। সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে প্রভাতবাবু মেয়েটির রুটি বেলা দেখে পছন্দ করেছিলেন। নিজের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ফলেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান। অংশুমানরা ছােট লাইনে ট্রেনে করে বরযাত্রী গেল। আর বড়দা গেলেন জিপ গাড়ি করে। খুব আদর-আপ্যায়ন হল বিয়ে বাড়ি আবাভায়। পরের দিন সকালবেলায় প্রভাতবাৰু সদলবলে চলে এলেন পুরুলেতে। আর একঘণ্টা পরে এল বরের গাড়ি। কন্যাকে নিয়ে এসে মা রক্ষাকালী’র ধুলাে মাথায় দেওয়া হল। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অংশুমানের বড়দার  বিবাহ হয়ে গেল। তখন দিলীপের গ্রামের বাড়ি খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। দিলীপ মনে মনে স্থির করল পাকা বাড়ি করতেই হবে। দিলীপ বাবাকে বলল, “বাবা দেখে নিয়াে, দু-বছরের মধ্যে আমি পাকা বাড়ি করব।" বাবা প্রভাত বললেন, "মা রক্ষাকালীর কৃপা থাকলে সবই হবে।  মধুসূদনের কি অশেষ কৃপা। দু-বছরের মধ্যেই দিলীপ পুরুলেতে পাকা বাড়ি গড়ে তুলল। বাবা আশীর্বাদ করলেন, “তুই আরও বড় হৰি। বার, অংশুমান, বড়দার স্ত্রী, প্রভাতবাবু আর গীতাদেবী এই পাঁচজনকে নিয়ে সংসার। দুই বােনের বিয়ে দিলীপ দিয়ে দিয়েছে। আর রিলিফ ও দিলীপ নিজে দুজনে লিলুয়ায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। প্রভাত বাবুর সংসার ভালাে-মন্দে, সুখে-দুঃখে বেশ ভালােভাবেই চলে ছিল। এখন আর বন্যায় বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় নেই। ছেলে পাকা বাড়ি করেছে। প্রভাত বাবুর কষ্টের জীবনে এটা বিরাট বড় ঘটনা।



অষ্টম পর্ব 


সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার ছেলে।কতজন যে পাঁচুন্দি বাস স্ট্যান্ডে ওঠানামা করে তার ইয়ত্তা নেই।ঠিক জীবন মরণের মত।যার সময় হয় সে চলে যায়।  সৌম্যদীপ সকলের কাছে সৌম বলেই পরিচিত।ছোটো থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। আবার ডানপিটে সাহসীও বটে।কথাগুলো বলছিলেন সোমের দাদু। বিনয় শুনছে। বিনয় সব জানে।তবু শুনছে। দাদু আজ সোমের সাফল্যে খুব খুশি।সাফল্যের পিছনে দাদুর অবদান অনেক।ছোটো থেকে সোম দেখে আসছে দাদু তাকে মায়ের আদরে মানুষ করেছেন। বাবা মায়ের মধ্যে যখন সাংসারিক বিষয়ে তর্কাতর্কি চলতো তখন দাদু সোমকে অট্টহাসের মাঠে,মন্দিরে ঘুরিয়ে আনতেন। অট্টহাসের মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসন দেখে সোম বলেছিলো,আমি অই আসনে বসবো। দাদু বলতেন,ছোটোদের এই আসনে বসতে নেই। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়।


----- সাধনা কি দাদু?

------ এই মনে করো তুমি পড়তে বসার আগে মা সরস্বতীকে প্রণাম করে  বসলে। তারপর ফাঁকি না দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করলে। দিনরাত সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে।

------ সিদ্ধিলাভ আবার কেমন?

_------- তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করলে আর তার ফলে পরীক্ষায় ভালো ফল করলে। এই হলো তোমার সিদ্ধিলাভ।

তারপর দাদু সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসার আগে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রোজ পড়তে বসার আগে এই মন্ত্রটা পাঠ করবে।


সোম বলতো দাদুর সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রটা। " মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে, পরমানন্দ মাধবম্।। "


দাদুর কাছেই ছোটোবেলায় জীবনের ভিত শক্তপোক্ত হয়ে গেছিলো সোমের। তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এক একটা ইমারত ফাঁকি দিয়ে তৈরি হয়। তাই সামান্য ভূকম্পে ভেঙ্গে পরে। সোমের ভিত শক্ত বলেই মন ভেঙ্গে পরেনি কোনোদিন। দাদু জানতেন সোমের অন্দরমহলের কথা। তাই কোনোদিন কোনো কাজে দাদু বাধা দেন নি বড়ো প্রিয় তার নাতিকে। মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার পরতে পরতে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সে বড়ো হলো সাফল্যের অনেক সিঁড়ি পার করে।তারপর দাদুর অজান্তে সোম কোথায় যে চলে গেলো,কেউ জানতো না। সোমের দাদু ও বাবা গোমোতে ছিলেন তখন।


সোমের মা কান্নাকাটি করতেন। দাদু তার বাড়ি এসে বলতেন,হীরের টুকরো তোমার ছেলে। ঈশ্বর ঠিক রক্ষা করবেন,চিন্তা কোরো না।সাফল্যের ইতিহাস বেশ জটিল। দাদুকে সোম বলছে নিজের কথা। বিনয় বসে আছে দাদুর পাশে। বাড়ির সবাই বসেছে সোমের সামনে।সৌম বলে চলেছে তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর কথা। সৌম তার জীবনের অজানা অধ্যায় প্রকাশ করছে সকলের কাছে। দাদু আর বাবা তখন গোমোতে চাকরী করতেন। বছরে দুবার আসতেন। আমি তখন সেই সুযোগে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম আমতলা,বেলতলা। গোকুল পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে পুকুরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হয়ে যেতো।সেই পুকুরের গা ছে ভূত থাকতো। শুনেছি। একদিন স্বচক্ষে দেখলাম। হাতে কমন্ডুল নিয়ে গোকুল পুকুরের পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেলো। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। তারপর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ো হলাম।  দাদুর সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পাঁচুন্দির হাটে যায় সোম। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা গরু, মোষ,ছাগল, ভেড়ার কারবার করে। সারিদিয়ে পরপর বসে থাকে চালানকাটার ইজারাদার। তারা পাস দেয় কোনো পশু বিক্রি হওয়ার পরে। একটা ছাগল এই হাট থেকে চুরি করে বের করা সহজ নয়। নানাস্থানে থাকে ইজারাদারদের গুপ্তচর। গরু, মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে চকচকে করা হয়। তেলচকচকে পশু হলে ক্রেতার নজরে আসে। বিভিন্ন উপায়ে খোঁচা মেরে পশুদের তাতিয়ে দেয় পাইকারের দল। লাঠির আগায় বাঁধা থাকে পাঁঠার চামড়া আর অনেক ছুঁচ। খোঁচা মেরে।তাড়িয়ে তাদের চনমনে করে তোলে পাইকারের দল। সোম দেখত সব আর প্রশ্ন করত দাদুকে। দাদু তাকে গল্প বলত ভূতের। ভূত তাড়াবার মন্ত্র শেখাতেন।দাদু বলতেন, ভূত-প্রেত প্রভূতি তাড়াতে গেলে, আগে নিজেকে সাবধান হয়ে তারপর রোগী দেখতে যেতে হয়।তা না হলে ভূত-প্রেতের দ্বারা নিজেরই ক্ষতি হয়।মন্ত্র টা হল-"ওঁ পরামাত্ননে পরব্রহ্ম নমঃ।মম শরীরং পাহি পাহি কুরু কুরু স্বাহা।।''-শনিবার অথবা মঙ্গলবারে শুদ্ধাসনে শুদ্ধবস্ত্রে বসে, ধূপ-দীপ জ্বেলে উপরোক্ত মন্ত্র দশ হাজার জপ করলে মন্ত্র সিদ্ধ হয়।-যখন ভূত-প্রেতাদি তাড়াতে কাজে যায় ওঝা, সেই সময় উপরোক্ত সিদ্ধ মন্ত্র বারবার পাঠ করে, নিজের দেহে সাতটি ফুঁ দিয়ে যাবে।রোগীর কাছে গিয়ে বসে ৩ বার আবার উক্ত মন্ত্র পাঠ করে নিজের চারপাশে মাটিতে গণ্ডী কেটে দিয়ে বসবে, তার ফলে ভূত-প্রেত বা অন্য কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।এছাড়া যে কোনও সাধনায় বসার আগে সাধনাস্থল সুরক্ষীত রাখার জন্য, উক্ত সিদ্ধমন্ত্র ৭ বার পাঠ করে আসনের চারপাশে গণ্ডী কেটে দিতে হবে, তার ফলে সাধনা চলাকালীন কোন বিঘ্নতা ঘটবে না।মনে রাখতে হবে তাদের এই মন্ত্রটি একবার সিদ্ধ হয়ে গেলে এটি  বিভিন্ন বান-টোনাসহ কালোযাদুর হাত থেকেও আপনাকে রক্ষা করবে।গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে আমার ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা হলো। বেড়িয়ে পরলাম বাড়ি ছেড়ে। ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদে পেয়ে গেলো। মনে পরছে বাবা মায়ের আদর করে খেতে দেওয়া। আর একটু ভাত নে খোকা। কত অভুক্ত শিশুর মুখ ভেসে উঠছে আকাশ জুড়ে। বীরভূম জেলার জয়দেবের কেন্দুলি মেলা চলছিলো। সেখানে চলে এলাম।  মচ্ছব খেলাম। তারপর এক বটগাছের তলায় ঝুড়ি নামা বটগাছের মতোই জটাজুট ধারি এক সাধুবাবা বসে আছেন। দেখলাম ওর থালায় অনেক পয়সা। আমি মজা করে কাড়াকাড়ি করছি।সাধুবাবা দেবেন না।  আমিও ছাড়বো  না। হঠাত্ সাধু হু হু করে কান্না শুরু করলেন। আমি তাড়াতাড়ি সাধুর থালা ছেড়ে দিলাম।সাধু বললেন,না   না আমি থালার জন্য কাদি  নাই।এই নে তোর থালা।


আমি জিজ্ঞাসা করলাম,তাহলে কি জন্য কাঁদছেন।

সাধু বললেন,রত্নার জন্য। সে আমাকে ল্যাং মেরে পালিয়েছে।

আমি ভাবলাম,এই বয়সেও সে রত্নার জন্য অনুরাগ পুষে রেখেছে। কি বিচিত্র মানবজীবন।

পাশ দিয়ে কোপাই নদী বয়ে চলেছে। লাল মাটির উচুনীচু ঢিবি। মন কেড়ে  নেওয়া হাওয়া। সব কিছু ছাড়িয়ে সাধুর হায় হায় স্বর হাওয়া বাতাস ছাড়িয়ে নদীর জলে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমার চিন্তার সুতো সরিয়ে সাধুবাবা বলে উঠলেন,কি গো কিছু বলো।

আমি বললাম,আপনি রত্নাকে ভালোবাসতেন?  

তবু ও চলে গেলো কিসের লোভে।

সাধু বললেন, ছি ছি ওকথা বলো না। ও আমার। মেয়ের মতো। হু হু হু...

আমি বললাম, কি কারণ বলুন। আমি শুনতে চাই।

সাধু বললেন,আমি গান লিখেছি অনেক। রত্না সব গান নিয়ে পালিয়ে গেছে। ও দরদি আর একমুঠো আকাশ দে... , বড়ো মানুষের মন লো,এইসব গান শোনো নি।

----- হ্যাঁ শুনেছি, সবাই শুনেছে। সব বিখ্যাত গান। রত্না লাহার কন্ঠে।

আমি বললাম আপনার নাম কি?

সাধু বললেন,কাউকে বোলো না। আমি  হিয়ানন্দ চট্টরাজ।

আমি তো অবাক। বলে কি লোকটা। হতেও পারে। ছাই সরিয়ে সোনা,একবার দেখলি না কানা।

সঙ্গে সঙ্গে আমি সাধুকে নিয়ে চলে এলাম বোলপুর। দাড়ি,গোঁফ কামানোর পর সবাই চিনতে পারলেন।


বিশ্বনব বিশ্বভারতীর এক প্রফেসর বললেন,ইনিই সেই হিয়ানন্দ। সুরকার,গীতিকার। আর তুই সোম শোন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়ে যা। পড়াশোনা শুরু কর।স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি আমার সকল সমস্যা দূর করলেন।হিয়ানন্দবাবু আবার লেখা শুরু করলেন। কবি, লেখকের  মৃত্যু নেই। পাঠকের হৃদয়ে তারা চির অমর।তারপর আমার পালে হাওয়া উঠলো। তর তর করে এগিয়ে গেলো পানসি।


আমার মনে পড়ছে,কোপাই নদীর ধারে আশ্রম করেছিলাম। মহিলা ও পুরুষের পায়খানা ঘর তৈরি করেছিলাম পাঁচটা গ্রামে চাঁদা তুলে। কি সুন্দর পরিবেশ। সহজ সরল লোকের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিয়েছিলো কৃত্রিম শহুরে জীবন।একবার রাতে আমার ভালোবাসার লোকেরা খবর দিলো, বটগাছের তলায় অপ্সরা নামেন আকাশ থেকে।


---- কাছে গেয়েছিস কোনোদিন?

---- না বাবা ভয় লাগে। অমর বললো।

----- তাহলে চ, আজকে চ, সবাই দেখে আসি।


পাঁচজন গেলাম। তখন এক মহিলা বললেন,টাকা এনেছিস?

আর একজন বললো, ফেলো কড়ি মাখো তেল....

আর বুঝতে বাকি থাকলো   না। ওরা অপ্সরা নয়, বেশ্যা। রোজগার করে, কষ্টের সংসারে।

মনে পড়ছে,গ্রামের সহজ সরল লোকগুলোকে

কিছু ঠগ ঠকিয়ে রোজগার করে। একটা সুড়ঙ্গ। তার ভিতরে  মা মনসা থাকেন। সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দে ওদের ভয় পায়। ঠাকুরের নাম করে সবাই দু টাকা, পাঁচ টাকা দেয়। আর ওই টাকা মদ আর মাংসে খরচ করে খচ্চর গুলো।


একদিন আমি একা সুড়ঙ্গ দিয়ে  নেমে দেখলাম কেউ নেই, কিছু নেই। হাওয়ার শব্দ। মানুষের ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো রোজগার। ওদের রাগ হলো। ষড়যন্ত্র শুরু করলো ওরা।

আমার ভক্ত রহিম বললো,বিরাজুলের কাছে শুনলাম আপনাকে আজ রাতে আক্রমণ করবে খচ্চরের দল। সাবধানে থাকবেন।

সেদিন একটা লাঠি হাতে ওদের খেলা দেখালাম।

মারতে এসে ওরা বসে পরলো আমার খেলা দেখার জন্য। দশটা টালি পর পর সাজিয়ে ভেঙ্গে দেখালাম।

ওদের একজন বললো,এ ব্যাটা সাধু না ডাকাত। তারপর আমার মারমুখী মূর্তি দেখে ওরা ভালো মানুষের মতো বললো,আমরা আপনার এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। অন্য কিছু নয়।

তারপর থেকে আর ওরা কোনো অসুবিধা করে নি। ওরাও ভক্তের দলে নাম লিখিয়েছিলো। ঈশ্বর দর্শন আমার হলো সহজ সরল মানুষের মাঝে।



নবম পর্ব 


আজ আমি আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছি। তবু ভুলতে পারি না বাল্যবন্ধুদের।

কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।


শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে  নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো


 না।ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো।   আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। 

সোম বলে যাচ্ছে তার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। পট দেখানো শিল্পীর মুগ্ধতায় সবাই শুনছেন তার জীবন কাহিনী। যে কাহিনী শুধু সোমের। তার আনন্দের সাক্ষী শুধু তার সফল হৃদয়। হৃদমাঝারে জেগে ওঠে রাখালিয়া বাঁশির সুর। সে বলে চলেছে স্কুল জীবনের কথা।


আমরা চার বন্ধু।  রমেন, জীবন, বিশু আর আমি।  যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা।  নেতা তো এমনি এমনি হয় না।  তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো।  একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে।  বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো।  ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক।  চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়।  আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা।  চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে।


বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে।  একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ।  বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে।  ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে।  মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।


***********************************************

আগামী পর্বে 

***********************************************



 সুদীপ ঘোষাল 

সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প  দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব  বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ  ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত



উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল

 


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * ১২

বিশ্বনাথ পাল

আঠেরো

 

আজ এসেছি আমার মাধ্যমিক পাশের স্কুলে। সঙ্গে এনেছি ভেরিফিকেশন রোলের কপি। সরকারি চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার পরই জয়েনিং হয়। কিন্তু আমার হাইকোর্টে চাকরির বেতন সরকারি তহবিল থেকে হলেও যেহেতু হাইকোর্ট সরাসরি সরকারের অধীনস্থ নয় এবং হাইকোর্টের দ্রুত কাজের লোক দরকার ছিল, তাই পুলিশ ভেরিফিকেশনের আগেই আমার নিয়োগ হয়েছে। ফলে এখন সেই ভেরিফিকেশন রোল পূরণ করে আমাকে জমা দিতে হবে। গত পরশু অ্যাকাউন্টস সেকশন থেকে আমাকে ডেকেছিল। সেখানে একজন ইউ ডি অ্যাসিট্যান্ট কুশলদা আমার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা পূরণ করে আমাকে জমা দাও। তুমি যত তাড়াতাড়ি জমা দেবে আমরা তত তাড়াতাড়ি এটা পুলিশের কাছে পাঠাতে পারব

ফর্মটা হাতে নিয়ে দেখি সেটা ভেরিফিকেশন রোল। সরকারি কাজে নিযুক্ত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ঠিকঠাক কিনা বা তার কোনও অপরাধের ইতিহাস আছে কিনা তা পুলিশ মারফৎ যাচাই করাই এর লক্ষ্য। কুশলদাকে বললাম, কতদিনের মধ্যে জমা দিতে হবে?

দাও না, যত তাড়াতাড়ি পারো।

আজ সেই ফর্ম নিয়েই এসেছি স্কুলে। অফিসে সি এল নিয়েছি। ফর্মের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আছে প্রাইমারি বাদে যে যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করেছি সেখানে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ লেখার ঘর। আমার সাল মনে আছে। নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই। তাই স্কুলে এসেছি যদি স্কুলের রেজিস্টার দেখে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ উদ্ধার হয়। হেড স্যার অমলকুমার কুণ্ডুর ঘরে বসে আছি। হেডস্যার বললেন, একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে যান। দেখছি কী করা যায়

শুনে আমার মাথায় হাত। বললাম, দেখুন না যদি আজকেই পাওয়া যায়।

হেডস্যার চুপ। মুখ দেখে মনে হল আমি কোনও অসঙ্গত আবদার করে ফেলেছি। তিনি এবার মুখ খুললেন, সঙ্গে সঙ্গে হয়? আপনার অফিসে গেলে সঙ্গে কাজ করে দেন?

যা বাবাঃ!কী বলব? আজ যদি কাজটা না হয় তবে আমাকে আরেক দিন অফিস ছুটি নিয়ে আসতে হবে। এই হেডস্যার নতুন। আমার পরিচিত নন। আমি স্কুল ছাড়ার পরে জয়েন করেছেন। অমলবাবুর মুখে এমন এক দৃঢ় অসম্মতির ভাব ফুটে উঠেছে যে আমার শত অনুরোধেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। উঠব উঠব করছি এমন সময় ঘরে তড়িৎস্যারের প্রবেশ। আপনাদের হয়তো মনে আছে আমার মায়ের কথায় এই স্যার আমাকে বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন। স্যার জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার?

স্যারকে সংক্ষেপে বললাম সব। হাইকোর্টে চাকরি পাওয়ার খবর স্যার জানতেন। কারণ জয়েন করার পর একদিন মিস্টি নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। স্যার হেডস্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সোমনাথ  আমাদের স্কুলের খুব ভাল ছাত্র ছিল। বলে হেডস্যারের কোনও অনুমতির তোয়াক্কা না করে আমাকে বললেন, তুই আমার সঙ্গে আয়।

স্যারকে অনুসরণ করলাম। স্যার আমাকে স্কুলের ক্লারিকাল স্টাফ নির্মল্বাবুর ঘরে নিয়ে গেলেন। বললন, নির্মলদা, সত্যজিতের কাজটা একটু করে দিন তো।

ব্যস! আমার কাজ হয়ে গেল।

এরপর বৈকুন্ঠপুর শিক্ষানিকেতনে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি ও পাশ করে বেরনোর তারিখ পেতে সমস্যা হল না। কারণ এই স্কুলে আমি আড়াই বছর শিক্ষকতা করেছি। কলেজ আর বিশ্ব বিদ্যালয়ে আর ছুটিনি। তারিখের বদলে মাস ও সাল লিখে দিলাম ফর্মে।

*

ভেরিফিকেশন রোল পূরণ করার পর একজন গেজেটেড অফিসারের শংসাপত্রের প্রয়োজন ছিল। ফর্মের দ্বিতীয় পাতার নীচে ছাপানো বয়ান পূরণ করে তলায় গেজেটেড অফিসারের স্বাক্ষরের স্থান। এটি না হওয়া পর্যন্ত জমা দিতে পারব না।

আমার মনে পড়ে গেল গোপাল মুখার্জীর কথা। ডেপুটি সেত্রেটারি পদে পি এস সি-তে কর্মরত গোপালবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ বাপিদার মাধ্যমে। বাপিদা মাঝেমধ্যে গোপালবাবুর কাছে অ্যাটেস্টেড করাতে যেত। আমিও সঙ্গে যেতাম অ্যাটেস্টেড করাতে। সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছাড়ার পরেও কয়েকবার একাই গিয়েছি। যে সময়ের কথা বলছি তখনও অনলাইনে চাকরির আবেদন করার ব্যবস্থা চালু হয়নি। ফলে আমাদের ফর্ম তুলে তার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার সমস্ত সার্টিফিকেট বা মার্কশীটের কপি অ্যাটেস্টেড করে জমা দিতে হত।

হাইকোর্টের ইন্টারভিউ দেওয়ার পর সামনে যখন মিসসেলেনিয়াসের ইন্টারভিউ তখনও একদি এসেছিলাম এই গোপাল স্যারের বাড়ি। স্যার আমার ইন্টারভিউয়ের কথা শুনে বললেন, ইন্টারভিউতে কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কী করো। তখন প্যারাটিচারি করার কথা বল্বে না। বলবে টিউশনি করি।প্যারাটিচারির থেকে টিউশনি করি বলা অনেক সম্মানের।

স্যারের এই পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম। ইন্টারভিউতে আমাকে বোর্ডের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করেছিলেন, তা সোমনাথ , কী করো তুমি?

বললাম, আমি টিউশনি করি। মিথ্যে বলা হল না। কারণ প্যারাটিচারি করা ছাড়াও টিউশনি তো করতামই।

কিন্তু চেয়ারম্যান বললেন, না, পড়াশোনা ছাড়া আর কী করো? মানে তোমার সখ কী?

আমি কবিতা লিখি।

কবিতা লেখো। তা তোমার প্রিয় কবি কে?

বললাম, জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি। এছাড়া জীবিত কবিদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, জয় গোস্বামী, বিনয় মজুমদার।

বিনয় মজুমদার তো কিছুদিন আগে মারা গেলেন।

আচ্ছা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভাল লাগে না?

চেয়ারম্যান ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার একপ্রস্থ আলোচনাই হয়ে গেল কবিতা নিয়ে। ইন্টারভিঊয়ের ভীতি তখন কোথায় যে উড়ে গেল! হঠাৎ চেয়ারম্যানের মোবাইল বেজে উঠল। তিনি ফোনটা রিসিভ করে উঠে পায়চারি করতে করতে কথা বলতে থাকলেন আর ইশারায় বোর্ডের অন্য দুই সদস্যকে প্রশ্ন করতে বললেন।

আমি একটা মাসিক পত্রিকায় রাজ্য সিভিল সার্ভিসে সফল এক চাকরিপ্রার্থীর সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম ইন্টারভিউয়ের মাঝে বোর্ড মেম্বারের ফোন আসাটা নাকি পরিকল্পিত। এতে চাকরিপ্রার্থীর একাগ্রতা পরীক্ষা করা হয়।

যাইহোক, বোর্ডের বাকি দু’জনের একজন আমাকে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে এবং অন্যজন ইকনমিক্স নিয়ে প্রশ্ন করলেন। সব না পারলেও মিনিট কুড়ির ইন্টারভিউ খারাপ হয়নি।

গোপাল স্যারকে সঙক্ষাপে বললাম আমার হাইকোর্টে চাকরি পাওয়ার বৃত্তান্ত। ওয়েটিং লিস্টের এক নম্বর থেকে চাকরির শিকে ছেঁড়ার কথা শুনে বললেন, তুমি লটারি কাটো। লাখে একটা ঘটে এরকম ঘটনা।

আমার ভেরিফিকেশন রোলে স্বাক্ষর করে দিলেন খুব খুশি মনে।

 

মাস দুই পরে একদিন অফিসে বসে কাজ করছি এমন সময় আমার মোবাইল বেজে উঠল। দেখি বাড়ির ফোন। মা বলল, রিজেন্ট পার্ক থানা থেকে একজন অফিসার এসেছে তোর কী ভেরিফিকেশনের ব্যাপারে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়।

বললাম, ওনাকে কিছু চা-টা দিয়েছ তো?

বলেছিলাম, কিন্তু উনি খাবেন না।

আচ্ছা, দাও ফোনটা।

হ্যালো। আমি রিজেন্ট পার্ক থানার সাব ইন্সপেক্টর শুভময় ঘোষ বলছি।

বলুন স্যার।

আপনার ভেরিফিকেশন কপি আমাদের কাছে এসেছে। আপনি আপনার স্কুল কলেজের সমস্ত অরিজিনাল মার্কশীট ও সার্টিফিকেট নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। সঙ্গে আনবেন আপনার স্থায়ী বাসিন্দা, নাগরিকত্বের প্রমাণ। আমার মোবাইল নাম্বারটা  লিখে নিন।

পরের শনিবার মাসের দ্বিতীয় শনিবার। অফিস নেই। মনে মনে ভাবছি যে আজ থানায় গিয়ে ডকুমেন্টগুলো ভেরিফাই করিয়ে আসব। ওমা মিনিট দুয়েক পড়েই দেখি স্ক্রিনে শুভময় ঘোষের নাম দেখিয়ে আমাম্র মোবাইল বেজে উঠল।

হ্যালো স্যার বলুন।

কোথায় আপনি এলেন না তো?

শুভময়বাবু এসেছিলেন গত সপ্তাহের শুক্রবার। পরদিন শনিবারও অফিস ছিল। এই কাজে অফিস ছুটি নিতে চাইনি। তাই দ্বিতীয় শনিবারের অপেক্ষায় ছিলাম। বললাম, এই তো স্যার আজই যাচ্ছি।

খানিক ক্ষণের মধ্যে সাইকেল নিয়ে কাগজপত্র একটা প্লাস্টিক প্যাকেটে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

 

উনিশ

 

আমি শুনেছিলাম পুলিশ ঘুষ খায় এবং চাকরির ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে তো খায়ই। হয়তো ঘুষ নামে খায় না। বলে মিষ্টি খাওয়ার জন্য দিন। না দিলে ওরা ভেরিফিকেশন রোল মাসের পর মাস আটকে রাখে। সরকারি চাকরিপ্রার্থীর জয়েনিং-ও ঝুলে থাকে ভেরিফিকেশন রোলের অপেক্ষায়। এই কারণে বেচারা চাকরিপ্রার্থী হিসেব করে দেখে যে জয়েনিং এক মাস পিছনো মানে এক মাসের মায়না হাতছাড়া। তারচেয়ে মায়নার পাঁচ-দশ শতাংশ যদি পুলিশকে মিষ্টি খাওয়া বাবদ দিতে হয় দোষের কী! কিন্তু আমার ঘুষ দেওয়ার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং ঘুষ  দেওয়া ও নেওয়া দুটোকেই অপরাধ(সমান কিনা জানি না) মনে করায় বেশ সমস্যায় পড়ে গেলাম। দুরু দুরু বক্ষে থানায় গিয়ে পৌঁছলাম। নিজের কাছে নিজের ভাবমূর্তি  অনেকটা যুধিষ্ঠির গোছের। সততাই শ্রেষ্ঠ পথ। সেই পথ কি আজ আমায় ছাড়তে হবে? যদি আমার কাছে পুলিশ ঘুষ চায় কী বলব তখন? এইসব ভাবতে ভাবতে মাথায় এল ভেরিফিকেশন আটকে আমার অর্থক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই। কারণ আমি তো চাকরিতে নিযুক্ত হয়েই আছি। মায়নাও পাচ্ছি। হাইকোর্টের চাকরি। সরাসরি সরকার বাহাদুরের নয়। তবে ভেরিফিকেশনে যদি দেখা যায় আমি কোনও মিথ্যা তথ্য সরবারাহ করেছি তাহলে হয়তো চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হবে।

একজন কনস্টেবল আমাকে সাব ইন্সপেক্টর শুভময় ঘোষের ঘর দেখিয়ে দিলেন। তিরিশ-বত্রিশের ঝকঝকে শুভময় ঘোষকে দেখে বেশ সম্ভ্রম হয়। ফরসা সৌম্য চেহারা এবং পেটমোটা নয়। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই বসতে বললেন।

একে একে আমার সমস্ত কাগজপত্র দেখালাম। এমনকী আমার ঠাকুরদার পাশপোর্টটা পর্যন্ত দেখালাম। এটা একটা পুরনো বাক্সে পেয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঠাকুরদা যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিল পাশপোর্ট করেই এসেছিল।

শুভময়বাবু যখন আমার কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখছেন আমার মনে আশঙ্কার মেঘ জমছে, এই বুঝি এক ভয়ানক ত্রুটি আবিষ্কার করে বললেন এত টাকা দিলে ত্রুটি দূর হবে।

শুভময়বাবু আমার কাগজপত্রে সন্তুষ্ট হলেন। আমি তাও বসে আছি, ভাবছি  এবার হয়তো ‘মিস্টিমুখ’-এর কথা পাড়বেন। আর সেক্ষেত্রে আমি কী উত্তর দেব জানি না। এমন সময় উনি বললেন, যান, হয়ে গেছে।

আমি কাগজপত্র গুছিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। এমন সময় ওসি সাহেব আমাকে ডাকলেন। তাঁর নাম মৃগাঙ্কবাবু। তিনি আমার সঙ্গে খানিক গল্প করলেন। আমি কবিতা লিখি শুনে খাতির করে চা খাওয়ালেন।

কার মুখ দেখে যে উঠেছি আজ। পুলিশকে মিস্টি খাওয়াতে হল না। বরং পুলিশই আমাকে চা খাওয়াল। আমার একটা ভুলও ভাঙল। সব মানুষ যেমন সমান নয়। সব পুলিশও সমান নয়। সবাই ঘুষখোর নয়। পুলিশবিভাগে শুভময়বাবুর মতো ভাল মানুষরাও আছেন।

 

আজ এত বছর পর সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করতে বসে সব যে ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছি এমন দাবি করি না। মৌমিতা একদিন আমার অফিস দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। বললাম, বেশ তো একদিন ফোন করে চলে আয়।

এমনিতে মৌমিতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে আমার নিজের অত্যুৎসাহের ফল বলে মনে হত। এই সুযোগে তাও কিছু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।

সেইমতো একদিন সকালে মৌমিতার ফোন পেলাম, সোমনাথ  শোন আজ তোর অফিস দেখতে যাব।

অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতাম আমি সত্যি সত্যি হাইকোর্টে চাকরি পেয়েছি কিনা সেই সন্দেহ মেটাতে আসছে। কিন্তু মৌমিতার ক্ষেত্রে তা মনে হল না। বরং এক হালকা খুশির রেশ আমাকে ছেয়ে থাকল। মেয়েটা একটু অন্য রকম। গড়পড়তা সাধারণ মেয়ের থেকে আলাদা বলেই আমার চোখে লেগেছিল।

কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার মনে আশঙ্কা দেখা দিল। কোনও সমবয়সি সুন্দরি মেয়ে (যদিও বিবাহিতা)অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে এটাকে সহকর্মীরা কীভাবে নেবে। পিছনে লাগবে না তো?

কিন্তু সে সব হল না। মৌমিতা ফোনে আমার দিকনির্দেশ শুনে নিজেই হাইকোর্টের মেইন বিল্ডিঙের তিন তলায় উঠে এল একেবারে অ্যাপয়ন্টমেন্ট সেকশনের সামনে। কিন্তু ভিতরে ঢুকল না বা আমিও বললাম না। দরজার সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে আমি ওকে আমার টেবিল দেখালাম। সহকর্মীদের কেউ বোধহয় আমাদের খেয়ালও করল না।

মৌমিতা বলল, কম্পিউটার নেই?

আমার টেবিলে নেই। আমাদের সেকশনে মাত্র দুজনকে দিয়েছে। আমাকে হাতে লিখে নোটশীট করতে হয়। চিঠির ড্রাফট হাতে লিখে বাবুয়াদাকে দিই টাইপ করার জন্য। দিনে দুটোর বেশি চিঠি করতে দিলে বাবুয়াদা বিরক্ত হয়। আমাকে বলে, তুই তো একাই সবার চাকরি খেয়ে নিবি। বিকেলের দিকে বাবুয়াদার টাইপ মেসিন ফাঁকা পেলে আমি নিজেই টুকটুক করে কচ্ছপের গতিতে টাইপ করি।

শুনে মৃদু হেসে মৌমিতা বলল, ভালই লাগছে কাজটা কী বল?

এখন লাগছে। তবে আরও দিন গেলে হয়তো একঘেয়ে লাগতে পারে।

ওকে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। হাইকোর্ট চত্বরে রকমারি খাবারের দোকান। কোথাও গরম গরম এগরোল-চাউমিন পরিবেশিত হচ্ছে, তো কোথাও আবার পাউরূটি ঘুগনি। আবার কোথাও বেশ বড় বড় সাইজের জিলাপি। সস্তায় বেশ মুখরোচক খাবার।মাঝেমধ্যেই টিফিনের সময় এইসব খাবারের স্বাদ গ্রহণ করি। বললাম, কী খাবি?

আমরা দুজন চাউমিন খেলাম।

খেতে খেতে ও বলল, চাকরি পাওয়ার খাওয়াটা এই খাইয়ে মেটালে হবে না কিন্তু।

বললাম, বেশ। তোকে একদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াব, অবশ্য আমার সঙ্গে যেতে যদি তোর আপত্তি না থাকে।

ও মাথা নেড়ে জানাল আপত্তি নেই।

এমনিতে কোনও বিবাহিত মেয়েকে এই প্রস্তাব দিতে হয়তো বাধো বাধো ঠেকত। কিন্তু ওর স্বামীর সঙ্গে অশান্তি চলছিল। বাপের বাড়িতেই থাকছিল সে সময়।

দাঁড়িয়ে খানিক কথাবার্তার পর বললাম, তুইও ডবলুবিসিএস পরীক্ষায় বসতে পারিস। বিডিও হলে অনেক টাকা স্যালারি।

কত টাকা?

এই ধর ষোলো হাজার।

সেই সময় বিডিওর বেসিক আট হাজার। এইচ আর এ এবং ডি এ নিয়ে ষোলো হাজার দাঁড়াত মায়না।

বলল, তেরো হাজার তো আমার এখনই রোজগার। এই অবধি বলে মৌমিতা থামতে পারত। কিন্তু থামল না। যোগ করল, আর দিলে ডবলুবিসিএস কেন, দেখি আইএএস-এ বসতে পারি।

এই হচ্ছে মৌমিতা। নিজের সম্বন্ধে অত্যধিক উচ্চধারণা, উৎকট রকমের আত্মবিশ্বাস। ও জানে না সরকারি চাকরি পাওয়া কত কঠিন। আইএএস-এ যারা বসে তারা ডবলুবিসিএস-কেও হেলাফেলা ভাবে না। তবু মেয়েটা আমাকে কী করে যে বশ করে রেখেছে!

মৌমিতাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আমি অফিসে ফিরে এলাম।

 

হাইকোর্টে যোগ দেওয়ার তিন মাসের মধ্যেই আরেকটা ভাল খবর পেলাম। সেই সময়টা স্মার্ট ফোনের নয়। ইন্টারনেট সংযোগহীন সাধারণ ফোন ব্যবহার করতাম। ফলে মেল চেক করতে বা পিএসসি-র ওয়েবসাইট দেখতে সাইবার কাফেতে যেতাম। দশ-কুড়ি টাকা দিলে পরে সাইবার কাফের কম্পিউটার একটি ঘণ্টার জন্য ব্যবহারের ছাড়পত্র মিলত। তো এভাবেই একদিন সাইবার কাফেতে পিএসসি-র ওয়েবসাইট খুলে দেখি মিসসেলেনিয়াস রিক্রুটমেন্ট সার্ভিসেসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। হাইকোর্ট এবং মিসসেলেনিয়াসের চাকরির ইন্টারভিউয়ের খবর একই মাসে জেনেছিলাম। গত ডিসেম্বরে। দীপুদার কথামতো মিসসেলেনিয়েসের জন্য একটা ইন্সটিটিউটেও ভর্তি হয়েছিলাম একহাজার টাকার বিনিময়ে। সেখানে দাশগুপ্ত স্যারের অধীনে সপ্তাহে একদিন করে দু’মাস তালিম নিলাম ইন্টারভিউতে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে হয়, মাথা ঠান্ডা রেখে কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় সেই বিষয়ে। প্রথমদিন দাশগুপ্ত স্যারের ক্লাসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।রাস্তায় জ্যাম ছিল। ক্লাস শুরু গিয়েছিল। দরজা ভেজানো একটি ঘরে চলছিল ক্লাস। আমি দরজাটা আলতো ফাঁক করে বলেছিলাম, আসব স্যার?

স্যার খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, না। ক’টা বাজে? যারা সময় মেনে চলে না তাদের কিস্যু হবে না জীবনে।

অপমানে আমার মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। আরও চাকরি প্রার্থীরা আমার দিকে হাঁ করে দেখছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, দরকার নেই এই স্যারের ক্লাস করে। বাড়ি ফিরে যাই। এক হাজার টাকা জলে যায় যাক। নিজে যা পারি তা-ই ইন্টারভিউতে বলব।

তবে বেশিক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। একটু পরেই স্যার বললেন, যাও, এরকম দেরি যেন আর না হয়। 

 

আজ যেন সেই অপমান হজমেরও প্রতিদান পাওয়া গেল। সারা পশ্চিমবঙ্গের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা হয়েছিল। অন্তত একলাখ তো বসেছিল বলে মনে হয় প্রিলিমিনারিতে। সেই বাধা টপকালে মেইন। তারপর ইন্টারভিউ বা পার্সোনালিটি টেস্ট। এই শেষ ধাপে শুনেছি শুন্যপদের তিনগুণ পরীক্ষার্থীকে ডাকা হয়। তালিকায় আমার নাম শোভা পাচ্ছে একুশ নম্বরে। যতদূর জানি এই সাজানোটা র‍্যাঙ্ক অনুসারে। তারমানে লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে আমার স্থান একুশ! অথচ এই ছেলেই কিনা ফেল করার ভয়ে এমএসসিতে ড্রপ দিয়েছিল! কে বলে জীবন গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর?

এটা আমার প্রথম স্থায়ী চাকরি নয়, দ্বিতীয়। কারণ হাইকোর্টে আমার স্থায়ী চাকরির প্রথম স্বাদগ্রহণ। তবু কী এক অনির্বচনীয় আনন্দের স্রোত যেন বয়ে গেল সারা শরীর মন জুড়ে। পরক্ষণেই আফশোস হতে লাগল। ইস! এই খবরটা যদি বাবা  জেনে যেতে পারত। ভগবান যদি বাবার মৃত্যুটাকে আর একটা বছর পিছিয়ে দিত। বাবার বিশ্বাস ছিল আমি একেবারেই চাকরির পড়াশোনা করতাম না। লোকজনের কাছে বলে বেড়াত, ও পড়ে নাকি? ওই রাত্রে একটু খবরের কাগজ নাড়েচাড়ে।

বাবার হয়তো ধারণা ছিল না যে খবরের কাগজও চাকরির পরীক্ষার অন্যতম স্টাডি ম্যাটিরিয়াল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একটি সিলেবাসের বিষয়। কিন্তু আমি খবরের কাগজ ছাড়াও টুকটাক বইও পড়তাম। পড়ার পাশাপাশি ভাবতামও। বাড়ির প্রায় সবাই শুয়ে পড়লে রাত ১১ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত পড়তাম। সবদিন হয়তো হত না। কিন্তু এই রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করতাম। আজ সেই চেষ্টার ফল লাভ করলাম।

শুধুমাত্র একটা ব্যাপারেই আমি বাবার গর্বের কারণ হতে পেরেছিলাম জীবনে। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তাম, সপ্তাহে একদিন করে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ক্লাস নিতে আসতেন আমাদের। সাম্মানিক ক্লাস। বাবাকে সে খবর জানাতে বাবা গর্বে সারা পাড়ায় বলে বেড়াত, ও অর্থমন্ত্রীর কাছে পড়ে। আসলে বাবা খুব সরল ছিল। অর্থমন্ত্রী বেশ পরিচিত মুখ। টিভিতে প্রায়ই দেখা যেত খবরে। সেই অর্থমন্ত্রীর ছাত্র হওয়া যে গর্বের বাবার মুখে শুনে শুনে আমারও বিশ্বাস জন্মেছিল।

তো যাইহোক সারা পশ্চিমবঙ্গব্যাপী অনুষ্ঠিত একটি গ্রাজুয়েট লেভেলের চাকরির পরীক্ষায় একুশতম স্থান অধিকার নিশ্চয়ই কম যোগ্যতার নয়। হতে পারে এটা রাজ্য সিভিল সার্ভিস নয়। গ্রুপ এ চাকরি নয়। কিন্তু অফিসার অবশ্যই। রাজ্য সরকারের গ্রুপ বি অফিসার।

বাড়ি ফিরে সবার আগে মাকে খবরটা দিলাম। মা বলল, আমারও মন বলছিল তোর আরও চাকরির খবর আসবে।

এই কথা আমাকেও অনেকে বলেছে। চাকরি পাচ্ছি না যখন, বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছি, তখন কৌশিক একদিন বলেছিল, দেখবি একবার একটা চাকরি লেগে গেলে পর পর আরও লাগতে থাকবে। রেকর্ড তাই বলছে। যারা চাকরি পায়, তাদের বেশির ভাগই অনেক গুলো চাকরি পায়।

এর কারণ হিসেবে ও বলেছিল, আসলে পড়াশোনার মানটাকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে গেলে একাধিক চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য আসে। সিলেবাস তো প্রায় কাছাকাছিই থাকে।

মাকে বললাম, কই আমাকে বলোনি তো?

তোর দিদিকে বলেছি। তাছাড়া আমাকে একজন হাত দেখে অনেক আগে বলেছিল, এখন আপনার স্বামীর আন্ডার সংসার আছে তো, যখন ছেলের আন্ডারে যাবে তখন দেখবে্ন সংসারের উন্নতি হবে। 

মায়ের এই কথায় সায় দেওয়া মানে বাবার অনুপস্থিতিকে মঙ্গলজনক মনে করা। মানে বাবা যেন ছিল অপয়া নাম্বার ওয়ান। আজ বাবা নেই তাই নিয়তি আমাদের উন্নতির রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছে। 

মনে মনে আবার ভগবানকে বললাম, ঠাকুর, আর একটা বছর বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে না? লোকটা সংসারের মেঘ বয়ে বেড়াল সারা জীবন। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন কেমন জানলই না। কখনও কোথাও বেড়াতে যেতে পারল না। পুরী তো দূরের কথা দিঘার সমুদ্রও দেখা হল না মানুষটার। মনোজগতে শুধু ভাতকাপড়ের চিন্তা ছাড়া আর কোনও সৌন্দর্যের ভাগ পেল না তোমার সৃষ্টির।





*********************************************

আগামী পর্বে


********************************************