জীবনহাটের কড়চা
সুদীপ ঘোষাল
সপ্তম -পর্ব
সকলের জীবন তো সমানতালে চলে না। ছন্দপতন ঘটে যায় নিয়তি আসার মতাে। কে যে আড়ালে থেকে সুতাে ধরে পুতুলের নৃত্যে, নাচায়, তা একমাত্র জগাই ক্ষ্যাপা' জানে। অংশুমানের কাকা যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। তড়িৎ, আলাককাকা, বাবলুকাকা, , বুলুকাকা, দিলীপদা, অমরকাকা, টুলাদা, বুলাদা সবার নাম মুখে মুখে হেমন্তবাবু অকলে চলে যাওয়ার দূঃখ।দিলীপদা তুলে নিলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। আর যে পথিক গােপনে গােপনে নীরবে সংসারের দায়িত্ব পান করে গেছেন তিনি আর কেউ নন, অংশুমানের মেজদা। তার নাম রিলিফ। সকলের, যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার হাত আছে। অংশুমান স্বীকার করে মনের গােপনে নীরবে হাসিমুখে। যাই হােক সেবার ক্লাস সেভেনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে অংশু। গ্রামের বাড়ি পুরুলেতে সদলবলে পুনরাগমন। অংশুমানের বাবা জমি-জায়গা দেখাশোনা করেন আর লিলুয়া থেকে দুই দাদা সুবিধা-অসুবিধায় বাবাকে সাহায্য করেন।
অংশুমান এবার গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্কুলে, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার বাবার সাথে স্কুলে গেল পায়ে হেটে। তখনকার দিনে পাকা পথ ছিল না। জমির আলরাস্তা ধরে স্কুলে গেল অশুমান। পায়ে ব্যথা ছিল। ধানের শিষে পা কেটে গিয়েছিল অংশমানের। স্কুলে একটা পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় খাতা দেখে বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় অংশুমান সফল। আমরা ওকে ভর্তি নেব। ভর্তি হয়ে গেলাস এইটে। এবার অন্য এক জীবন। শহর থেকে এসে গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হল এবার।পরের দিন থেকেই স্কুলে যাওয়া শুর করল অংশু। আল রাস্তা ধরে কাবে কােনাে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। মাঝে একটা কদর আছে। শীতকালে হাঁটু জল। কিন্তু হলে সর না হলে পার হওয়া যাবে না। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী অম্বুজাক্ষ দত্ত মহাশয়। ইংরাজি স্যার ছিলেন শ্রী দিলীপ উট্টোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অংশুমানের বন্ধু জুটে গেল অনেক। অমল, রবীন্দ্রনাথ, বিনয়, টাদ, বিশ্বরূপ, মিল, অধীর, পিনু, শ্যামল ও আরও অনেক ৭। সবার সঙ্গে মেশার এক সহজাত স্বভাব অংশুমানের ছিল চিরদিন। একদিন অমল বলল-সবাই আমরা একসাথে দুর্গাপুর শহরে বেড়াতে যাব।" অংশুমান বলল-"তাহলে কথাটা প্রথমে আমাদের ভূগোল সার, মহিম বাবু কে বলি।" ক্লাসে মহিম কুমার সাধু মহাশয় পড়াতে এলে অংশুমান। বলল-"স্যার, দুর্গাপুর শিল্পনগরী। যদি আপনি নিয়ে যান, তাহলে ভালাে হয়।" মহিমবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুর। সারাদিন ঘোরার পর তারা রাত্রিবেলায় ফিরেছিলাম নদীর ধারে। তখন। বর্যাকাল। অজয় নদীতে প্রবল জলের ঢেউ। রাত্রি মাঝিরা ওপারে ঘুমাচ্ছে। তাহলে নৌকা আনবে কে? মহিম বাবু বলামাত্রই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিখেশ্বর গ্রামের তিনটি সাহসী ছেলে। ভরা নদীর বুকে অতি সহজেই সাঁতার কেটে চলল তিনটি বালক। অংশগুরা পাড় থেকে চিৎকার করে বলছে, "তােরা। সবাই নিরাপদে আছিস তার?" উত্তর আসছে মাঝের নদী থেকে নেই। আমরা ঠিক আছি।” এইভাবে সাড়া দিতে দিতে ওরা ওপ গেল। তারপর নিজেরাই দড়ি খুলে নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করল। নৌকা। এপারে এলে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল-“কি রে, মাঝিদের ডাকলি ।ওরা উত্তর দিল—“সারাদিন খাটুনির পর ওরা একটু নিদ্রামগ্ন, কি করে, কোন লজ্জায় ওদের ঘুম ভাঙাই বল। ওরা আমাদের চেনে। আমরা ওদের ঘরের লােক।”অংশুমান চিন্তা করল, মানুষকে কতটা ভালােবাসে এরা, তারই প্রমাণ এই বাক্য। আবার নতুন করে মানুষকে ভালােবাসতে ইচ্ছে করল অংশুমানের। দশজন করে একটি নৌকায় মােট পাঁচবারে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ নিরাপদে সেই রাত্রে নদীর এপারে চলে এল, ওই তিনজনের অসীম সাহসের ফলে। স্কুলে অংশুমানেরা সেই রাত্রি বেঞ্চিতে শুয়ে কাটালাে। পরদিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই হাঁটা রাস্তা ধরে চলে এল একেবারে নিজের বাড়ি পুরুলে’-তে। গ্রামের নাম ‘পুরুলিয়া’। কেতুগ্রাম থানায় অবস্থিত। সবাই ছােট করে গ্রামটিকে ‘পুরুলে’ বলেই চেনে। অংশুমানের স্বপ্নভূমি এই পুরুলে গ্রাম। -অংশুমান জানালার ধারে বসে ভাবছে গ্রামের কথা। পুরুলেতে পূজা বাড়ি আছে। এই বাড়িটি মােটামুটি দুইশত বছরের পুরােনাে বাড়ি। এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। একটি হাইস্কুল আছে। এটি দান করেছিলেন অতুলবাৰু তার বাবা মহেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। স্কুলটির নাম বর্তমানে মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। তখন স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমােদন পায়নি। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের স্কুলে পড়াশােনা করতে যেত। অংশুমান এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বর্ষা-গ্রীষ্ম-শরতে হেঁটেই স্কুলে যেত। সময় তাে আর থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে অংশুমানের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সমাপ্তও হল। শিবলুন স্টেশনে নেমে অংশুর মন খুশ।। আমের আর মাটির গন্ধে মন ভরপূর আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠত। সেখান খেকে পুরলে প্রায় তিন মাইল পথ। কিন্তু রাস্তার দু-ধারের আখ আর ফাঁকা মাঠ অংশুমানের পথের ক্লান্তি দূর করে দিত। এক পা করে আর সৰ পরিচিত লােকের কস্বর কি গাে দাদাবাবু, অনেকদিন পরে লেখার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই কথার মায়া আর মাটির আর আমি কোথাও পাওয়া যাবে না। হটিতে হটিতে আুমানের মনে পড়ে কবির লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, “এইটি আমার গ্রাম আমার স্বর্গপুরী এইখানেতে হদয় আমার গেছ়ে চুরি।"
বাবু বসে আছে বাইরের বারান্দায়। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, বাবুদা! ৩াড়াতাড়ি চলো, ও পাড়ায় একজন গলায় দড়ি দেবে বলে দোর বন্ধ করেছে, কিছুতেই খুলছে না।"
বাবু চোখের পলক পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে হাজির। গোলার তলায় শাবল ছিল, শাবল দিয়ে দরজাটা ভেঙে দেখল, একটা টুল এনে ছেলেটি গলায় গামছা দিয়ে কড়িকাঠে বাঁধছে। প্রায় ঝুলে পড়ার অবস্থায় বাবু ওর পা-দুটি কাঁধে রেখে বলল, “যা বলছি কর, গলা থেকে গামছা খোল।ছেলেটি বলল, "বাবুদা আমাকে মরতে দাও।”বাবু বলল, “তাের সুবিধা-অসুবিধার বিচার আমরা করব। তুই আগে দড়ি খােল।"বাবুর কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য ছেলেটির ছিল না। দড়ি খুলে শান্ত ছেলের মতাে কাঁধ থেকে নেমে এল। ছেলেটির বাবা-মাকে একটু বকাঝকা করার পরে বাবু ছেলেটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এল। বাবুর সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করল ছেলেটি। মন শান্ত হলে বাড়ি গেল সে। এরকম অসংখ্য কাণ্ডকারখানা বাবুর সামাজিক জীবনে মিলেমিশে আছে। বড়দার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে বৈশাখ মাসে। বিয়ে হবে লাভপুরের আবাায়। বড়দা ও রিলিফদা চাকরি করে। প্রভাতবাবু দুই ছােট ছেলে বাবু আর অংশুমানকে নিয়ে যাবতীয় জোগাড় করলেন। সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে প্রভাতবাবু মেয়েটির রুটি বেলা দেখে পছন্দ করেছিলেন। নিজের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ফলেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান। অংশুমানরা ছােট লাইনে ট্রেনে করে বরযাত্রী গেল। আর বড়দা গেলেন জিপ গাড়ি করে। খুব আদর-আপ্যায়ন হল বিয়ে বাড়ি আবাভায়। পরের দিন সকালবেলায় প্রভাতবাৰু সদলবলে চলে এলেন পুরুলেতে। আর একঘণ্টা পরে এল বরের গাড়ি। কন্যাকে নিয়ে এসে মা রক্ষাকালী’র ধুলাে মাথায় দেওয়া হল। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অংশুমানের বড়দার বিবাহ হয়ে গেল। তখন দিলীপের গ্রামের বাড়ি খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। দিলীপ মনে মনে স্থির করল পাকা বাড়ি করতেই হবে। দিলীপ বাবাকে বলল, “বাবা দেখে নিয়াে, দু-বছরের মধ্যে আমি পাকা বাড়ি করব।" বাবা প্রভাত বললেন, "মা রক্ষাকালীর কৃপা থাকলে সবই হবে। মধুসূদনের কি অশেষ কৃপা। দু-বছরের মধ্যেই দিলীপ পুরুলেতে পাকা বাড়ি গড়ে তুলল। বাবা আশীর্বাদ করলেন, “তুই আরও বড় হৰি। বার, অংশুমান, বড়দার স্ত্রী, প্রভাতবাবু আর গীতাদেবী এই পাঁচজনকে নিয়ে সংসার। দুই বােনের বিয়ে দিলীপ দিয়ে দিয়েছে। আর রিলিফ ও দিলীপ নিজে দুজনে লিলুয়ায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। প্রভাত বাবুর সংসার ভালাে-মন্দে, সুখে-দুঃখে বেশ ভালােভাবেই চলে ছিল। এখন আর বন্যায় বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় নেই। ছেলে পাকা বাড়ি করেছে। প্রভাত বাবুর কষ্টের জীবনে এটা বিরাট বড় ঘটনা।
অষ্টম পর্ব
সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার ছেলে।কতজন যে পাঁচুন্দি বাস স্ট্যান্ডে ওঠানামা করে তার ইয়ত্তা নেই।ঠিক জীবন মরণের মত।যার সময় হয় সে চলে যায়। সৌম্যদীপ সকলের কাছে সৌম বলেই পরিচিত।ছোটো থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। আবার ডানপিটে সাহসীও বটে।কথাগুলো বলছিলেন সোমের দাদু। বিনয় শুনছে। বিনয় সব জানে।তবু শুনছে। দাদু আজ সোমের সাফল্যে খুব খুশি।সাফল্যের পিছনে দাদুর অবদান অনেক।ছোটো থেকে সোম দেখে আসছে দাদু তাকে মায়ের আদরে মানুষ করেছেন। বাবা মায়ের মধ্যে যখন সাংসারিক বিষয়ে তর্কাতর্কি চলতো তখন দাদু সোমকে অট্টহাসের মাঠে,মন্দিরে ঘুরিয়ে আনতেন। অট্টহাসের মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসন দেখে সোম বলেছিলো,আমি অই আসনে বসবো। দাদু বলতেন,ছোটোদের এই আসনে বসতে নেই। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়।
----- সাধনা কি দাদু?
------ এই মনে করো তুমি পড়তে বসার আগে মা সরস্বতীকে প্রণাম করে বসলে। তারপর ফাঁকি না দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করলে। দিনরাত সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে।
------ সিদ্ধিলাভ আবার কেমন?
_------- তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করলে আর তার ফলে পরীক্ষায় ভালো ফল করলে। এই হলো তোমার সিদ্ধিলাভ।
তারপর দাদু সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসার আগে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রোজ পড়তে বসার আগে এই মন্ত্রটা পাঠ করবে।
সোম বলতো দাদুর সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রটা। " মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে, পরমানন্দ মাধবম্।। "
দাদুর কাছেই ছোটোবেলায় জীবনের ভিত শক্তপোক্ত হয়ে গেছিলো সোমের। তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এক একটা ইমারত ফাঁকি দিয়ে তৈরি হয়। তাই সামান্য ভূকম্পে ভেঙ্গে পরে। সোমের ভিত শক্ত বলেই মন ভেঙ্গে পরেনি কোনোদিন। দাদু জানতেন সোমের অন্দরমহলের কথা। তাই কোনোদিন কোনো কাজে দাদু বাধা দেন নি বড়ো প্রিয় তার নাতিকে। মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার পরতে পরতে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সে বড়ো হলো সাফল্যের অনেক সিঁড়ি পার করে।তারপর দাদুর অজান্তে সোম কোথায় যে চলে গেলো,কেউ জানতো না। সোমের দাদু ও বাবা গোমোতে ছিলেন তখন।
সোমের মা কান্নাকাটি করতেন। দাদু তার বাড়ি এসে বলতেন,হীরের টুকরো তোমার ছেলে। ঈশ্বর ঠিক রক্ষা করবেন,চিন্তা কোরো না।সাফল্যের ইতিহাস বেশ জটিল। দাদুকে সোম বলছে নিজের কথা। বিনয় বসে আছে দাদুর পাশে। বাড়ির সবাই বসেছে সোমের সামনে।সৌম বলে চলেছে তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর কথা। সৌম তার জীবনের অজানা অধ্যায় প্রকাশ করছে সকলের কাছে। দাদু আর বাবা তখন গোমোতে চাকরী করতেন। বছরে দুবার আসতেন। আমি তখন সেই সুযোগে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম আমতলা,বেলতলা। গোকুল পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে পুকুরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হয়ে যেতো।সেই পুকুরের গা ছে ভূত থাকতো। শুনেছি। একদিন স্বচক্ষে দেখলাম। হাতে কমন্ডুল নিয়ে গোকুল পুকুরের পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেলো। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। তারপর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ো হলাম। দাদুর সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পাঁচুন্দির হাটে যায় সোম। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা গরু, মোষ,ছাগল, ভেড়ার কারবার করে। সারিদিয়ে পরপর বসে থাকে চালানকাটার ইজারাদার। তারা পাস দেয় কোনো পশু বিক্রি হওয়ার পরে। একটা ছাগল এই হাট থেকে চুরি করে বের করা সহজ নয়। নানাস্থানে থাকে ইজারাদারদের গুপ্তচর। গরু, মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে চকচকে করা হয়। তেলচকচকে পশু হলে ক্রেতার নজরে আসে। বিভিন্ন উপায়ে খোঁচা মেরে পশুদের তাতিয়ে দেয় পাইকারের দল। লাঠির আগায় বাঁধা থাকে পাঁঠার চামড়া আর অনেক ছুঁচ। খোঁচা মেরে।তাড়িয়ে তাদের চনমনে করে তোলে পাইকারের দল। সোম দেখত সব আর প্রশ্ন করত দাদুকে। দাদু তাকে গল্প বলত ভূতের। ভূত তাড়াবার মন্ত্র শেখাতেন।দাদু বলতেন, ভূত-প্রেত প্রভূতি তাড়াতে গেলে, আগে নিজেকে সাবধান হয়ে তারপর রোগী দেখতে যেতে হয়।তা না হলে ভূত-প্রেতের দ্বারা নিজেরই ক্ষতি হয়।মন্ত্র টা হল-"ওঁ পরামাত্ননে পরব্রহ্ম নমঃ।মম শরীরং পাহি পাহি কুরু কুরু স্বাহা।।''-শনিবার অথবা মঙ্গলবারে শুদ্ধাসনে শুদ্ধবস্ত্রে বসে, ধূপ-দীপ জ্বেলে উপরোক্ত মন্ত্র দশ হাজার জপ করলে মন্ত্র সিদ্ধ হয়।-যখন ভূত-প্রেতাদি তাড়াতে কাজে যায় ওঝা, সেই সময় উপরোক্ত সিদ্ধ মন্ত্র বারবার পাঠ করে, নিজের দেহে সাতটি ফুঁ দিয়ে যাবে।রোগীর কাছে গিয়ে বসে ৩ বার আবার উক্ত মন্ত্র পাঠ করে নিজের চারপাশে মাটিতে গণ্ডী কেটে দিয়ে বসবে, তার ফলে ভূত-প্রেত বা অন্য কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।এছাড়া যে কোনও সাধনায় বসার আগে সাধনাস্থল সুরক্ষীত রাখার জন্য, উক্ত সিদ্ধমন্ত্র ৭ বার পাঠ করে আসনের চারপাশে গণ্ডী কেটে দিতে হবে, তার ফলে সাধনা চলাকালীন কোন বিঘ্নতা ঘটবে না।মনে রাখতে হবে তাদের এই মন্ত্রটি একবার সিদ্ধ হয়ে গেলে এটি বিভিন্ন বান-টোনাসহ কালোযাদুর হাত থেকেও আপনাকে রক্ষা করবে।গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে আমার ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা হলো। বেড়িয়ে পরলাম বাড়ি ছেড়ে। ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদে পেয়ে গেলো। মনে পরছে বাবা মায়ের আদর করে খেতে দেওয়া। আর একটু ভাত নে খোকা। কত অভুক্ত শিশুর মুখ ভেসে উঠছে আকাশ জুড়ে। বীরভূম জেলার জয়দেবের কেন্দুলি মেলা চলছিলো। সেখানে চলে এলাম। মচ্ছব খেলাম। তারপর এক বটগাছের তলায় ঝুড়ি নামা বটগাছের মতোই জটাজুট ধারি এক সাধুবাবা বসে আছেন। দেখলাম ওর থালায় অনেক পয়সা। আমি মজা করে কাড়াকাড়ি করছি।সাধুবাবা দেবেন না। আমিও ছাড়বো না। হঠাত্ সাধু হু হু করে কান্না শুরু করলেন। আমি তাড়াতাড়ি সাধুর থালা ছেড়ে দিলাম।সাধু বললেন,না না আমি থালার জন্য কাদি নাই।এই নে তোর থালা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,তাহলে কি জন্য কাঁদছেন।
সাধু বললেন,রত্নার জন্য। সে আমাকে ল্যাং মেরে পালিয়েছে।
আমি ভাবলাম,এই বয়সেও সে রত্নার জন্য অনুরাগ পুষে রেখেছে। কি বিচিত্র মানবজীবন।
পাশ দিয়ে কোপাই নদী বয়ে চলেছে। লাল মাটির উচুনীচু ঢিবি। মন কেড়ে নেওয়া হাওয়া। সব কিছু ছাড়িয়ে সাধুর হায় হায় স্বর হাওয়া বাতাস ছাড়িয়ে নদীর জলে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার চিন্তার সুতো সরিয়ে সাধুবাবা বলে উঠলেন,কি গো কিছু বলো।
আমি বললাম,আপনি রত্নাকে ভালোবাসতেন?
তবু ও চলে গেলো কিসের লোভে।
সাধু বললেন, ছি ছি ওকথা বলো না। ও আমার। মেয়ের মতো। হু হু হু...
আমি বললাম, কি কারণ বলুন। আমি শুনতে চাই।
সাধু বললেন,আমি গান লিখেছি অনেক। রত্না সব গান নিয়ে পালিয়ে গেছে। ও দরদি আর একমুঠো আকাশ দে... , বড়ো মানুষের মন লো,এইসব গান শোনো নি।
----- হ্যাঁ শুনেছি, সবাই শুনেছে। সব বিখ্যাত গান। রত্না লাহার কন্ঠে।
আমি বললাম আপনার নাম কি?
সাধু বললেন,কাউকে বোলো না। আমি হিয়ানন্দ চট্টরাজ।
আমি তো অবাক। বলে কি লোকটা। হতেও পারে। ছাই সরিয়ে সোনা,একবার দেখলি না কানা।
সঙ্গে সঙ্গে আমি সাধুকে নিয়ে চলে এলাম বোলপুর। দাড়ি,গোঁফ কামানোর পর সবাই চিনতে পারলেন।
বিশ্বনব বিশ্বভারতীর এক প্রফেসর বললেন,ইনিই সেই হিয়ানন্দ। সুরকার,গীতিকার। আর তুই সোম শোন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়ে যা। পড়াশোনা শুরু কর।স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি আমার সকল সমস্যা দূর করলেন।হিয়ানন্দবাবু আবার লেখা শুরু করলেন। কবি, লেখকের মৃত্যু নেই। পাঠকের হৃদয়ে তারা চির অমর।তারপর আমার পালে হাওয়া উঠলো। তর তর করে এগিয়ে গেলো পানসি।
আমার মনে পড়ছে,কোপাই নদীর ধারে আশ্রম করেছিলাম। মহিলা ও পুরুষের পায়খানা ঘর তৈরি করেছিলাম পাঁচটা গ্রামে চাঁদা তুলে। কি সুন্দর পরিবেশ। সহজ সরল লোকের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিয়েছিলো কৃত্রিম শহুরে জীবন।একবার রাতে আমার ভালোবাসার লোকেরা খবর দিলো, বটগাছের তলায় অপ্সরা নামেন আকাশ থেকে।
---- কাছে গেয়েছিস কোনোদিন?
---- না বাবা ভয় লাগে। অমর বললো।
----- তাহলে চ, আজকে চ, সবাই দেখে আসি।
পাঁচজন গেলাম। তখন এক মহিলা বললেন,টাকা এনেছিস?
আর একজন বললো, ফেলো কড়ি মাখো তেল....
আর বুঝতে বাকি থাকলো না। ওরা অপ্সরা নয়, বেশ্যা। রোজগার করে, কষ্টের সংসারে।
মনে পড়ছে,গ্রামের সহজ সরল লোকগুলোকে
কিছু ঠগ ঠকিয়ে রোজগার করে। একটা সুড়ঙ্গ। তার ভিতরে মা মনসা থাকেন। সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দে ওদের ভয় পায়। ঠাকুরের নাম করে সবাই দু টাকা, পাঁচ টাকা দেয়। আর ওই টাকা মদ আর মাংসে খরচ করে খচ্চর গুলো।
একদিন আমি একা সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে দেখলাম কেউ নেই, কিছু নেই। হাওয়ার শব্দ। মানুষের ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো রোজগার। ওদের রাগ হলো। ষড়যন্ত্র শুরু করলো ওরা।
আমার ভক্ত রহিম বললো,বিরাজুলের কাছে শুনলাম আপনাকে আজ রাতে আক্রমণ করবে খচ্চরের দল। সাবধানে থাকবেন।
সেদিন একটা লাঠি হাতে ওদের খেলা দেখালাম।
মারতে এসে ওরা বসে পরলো আমার খেলা দেখার জন্য। দশটা টালি পর পর সাজিয়ে ভেঙ্গে দেখালাম।
ওদের একজন বললো,এ ব্যাটা সাধু না ডাকাত। তারপর আমার মারমুখী মূর্তি দেখে ওরা ভালো মানুষের মতো বললো,আমরা আপনার এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। অন্য কিছু নয়।
তারপর থেকে আর ওরা কোনো অসুবিধা করে নি। ওরাও ভক্তের দলে নাম লিখিয়েছিলো। ঈশ্বর দর্শন আমার হলো সহজ সরল মানুষের মাঝে।
নবম পর্ব
আজ আমি আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছি। তবু ভুলতে পারি না বাল্যবন্ধুদের।
কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।
শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো
না।ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়।
সোম বলে যাচ্ছে তার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। পট দেখানো শিল্পীর মুগ্ধতায় সবাই শুনছেন তার জীবন কাহিনী। যে কাহিনী শুধু সোমের। তার আনন্দের সাক্ষী শুধু তার সফল হৃদয়। হৃদমাঝারে জেগে ওঠে রাখালিয়া বাঁশির সুর। সে বলে চলেছে স্কুল জীবনের কথা।
আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে।
বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
***********************************************
আগামী পর্বে
***********************************************
সুদীপ ঘোষাল
সুদীপ ঘোষাল গল্প, উপন্যাস লিখতে ভালোবাসেন।সৃষ্টিসুখ থেকে, অন্তরে আলো জ্বলে ও এবং ছাপাছাপি থেকে, তিন এ নেত্র,এই দুটি গল্পসংকলন বের হয়েছে কলকাতা বইমেলায়।।এছাড়াও আরও পাঁচটি বই আছে বিভিন্ন প্রকাশনার।গল্প দিয়ে শুরু লেখা,ছোটোবলার স্কুলে পড়তে পড়তেই। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরে বাস করেন লেখক।জন্ম ১৯৬৫ সাল। সানন্দা ব্লগ ঈশানকোণ, আরম্ভ,ধুলামন্দির,অক্ষর ওয়েব,দৈনিক সংবাদ,তথ্যকেন্দ্র,যুগশঙ্খ,আবহমান,অপরজন,কৃত্তিবাসী ওয়েব,ম্যাজিকল্যাম্প,জয়ঢাক,অংশুমালী,প্রভাতফেরী,দৈনিক গতি প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত।