রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

তোমায় খুঁজে ফিরি * রামচন্দ্র দত্ত




শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি

রামচন্দ্র দত্ত


১৮৭৯ সালে আমরা (মনোমোহন ও গোপালচন্দ্র মিত্র এবং রামচন্দ্র) শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট গমন করিয়াছিলাম। বেলা একটার সময় দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তখন তাঁহার ঘরের দ্বার রুদ্ধ ছিল। কাহাকে ডাকিব, কি বলিয়া ডাকিব, -ভাবিতেছি, এমন সময় এক ব্যক্তি আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিলেন।

     ‎তাঁহাকে দেখিয়া আমাদের প্রাণ যেন শীতল হইল। কিন্তু কে তিনি, তখন জানিতে পারিলাম না। ঘরের ভিতরে যাইয়া প্রণামান্তর উপবেশন করিলাম এবং মনে হইল যে ইনিই সেই মহাপুরুষ হইবেন। পরমহংসদেব কখনও কোন প্রকার সাধুর পরিচায়ক বেশভূষা করিতেন না। তন্নিমিত্ত অনেকেই তাঁহাকে দেখিয়াও চিনিতে পারে নাই।

     ‎সে-সময় আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিতাম না, কিন্তু তাঁহার উপদেশে আমরা আস্তিক হইয়াছিলাম। উপদেশ অর্থে কেবল মুখের কথা নির্দেশ করিতেছি না। আমার গুরুকরণের বিষয়ে শুনুন।

     ‎আমার প্রথম কন্যাটি যখন মারা গেল, তখন আমার সংসার-সুখের চমক ভাঙ্গিল। ভগবান আছেন কিনা, সাক্ষাৎ ভাবে তাঁর দর্শন হয় কিনা, এবং তাঁকে লাভ করে সম্ভোগ করা যায় কিনা, এইসব প্রশ্ন অন্তরে উঠতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমাদের কুলগুরু এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখে মনে করলাম যে হয়ত আমার প্রশ্নের মীমাংসা এঁর দ্বারা হতে পারবে। তাঁকে সমস্ত বলতে তিনি বললেন, এসব প্রশ্নের মীমাংসা তাঁহার দ্বারা তো হবেই না। অপর যে কেউ পারবেন, তাও তাঁর বিশ্বাস নাই। সাক্ষাৎ শিব যদি এসে দেখা দেন, তবে আমার এ রোগের ঔষধ মিলতে পারে। তাঁর এই কথায় প্রথমে আমার হতাশা এসে প্রাণটা আরও শুকিয়ে গেল, পরে ভাবলাম যে সাক্ষাৎ শিবও দয়া দিতে পারেন। তারপরেই ঠাকুরের কাছে গিয়ে পড়া, আর সব প্রশ্ন জল হয়ে গেল।

     ‎আমরা গিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিনি। যেমনি দেখা হওয়া আপনিই বলতে লাগলেন, 'ভগবানকে কে চায় যে পাবে? মানুষ বিষয় হলনা বলে এক ঘটি কাঁদছে, টাকা-ঐশ্বর্য হলনা বলে দু'ঘটি কাঁদছে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবর্গের জন্য দশ ঘটি কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাঁকে পাওয়ার জন্য কি কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে? যে তাঁকে পেতে চায়, যে তাঁর বিরহে চারিদিকে অন্ধকার দেখে, তাঁকে না পেলে যার সোয়াস্তি বোধ হয় না, সে-ই তাঁকে লাভ করে ধন্য হয়।' তাঁর এইরূপ সব কথায় অন্তরের সব প্রশ্নের আপনিই মীমাংসা হয়ে গেল। তিনি হৃদয়টি অধিকার করে বসলেন। …

 

২)

আমরা যখন তাঁহাকে 'ঈশ্বর আছেন কিনা' এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, 'দিনের বেলায় সূর্যের কিরণে একটিও তারা দেখা যায় না, সেইজন্যই তারা নাই একথা বলা যায় না। দুধে মাখন আছে, দুধ দেখিলে কি মাখনের কোন জ্ঞান হয়? মাখন দেখিতে হ'লে দুধকে দই করিতে হয়। পরে তাকে সূর্যোদয়ের আগে মন্থন করিলে মাখন বেরিয়ে আসে। যেমন বড় পুকুরে মাছ ধরতে হলে আগে যারা সেখানে মাছ ধরেছে তাদের কাছে গিয়ে কেমন মাছ আছে, কিসের টোপ খায়, কি চার প্রয়োজন, এই সকল বৃত্তান্ত জেনে নিলে, যে ব্যক্তি মাছ ধরতে যায় সে নিশ্চয়ই সিদ্ধ মনোরথ হয়। ছিপ ফেলামাত্র মাছ ধরা যায় না। স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়, পরে যেই 'ঘাই' ও 'ফুট' দেখতে পায় তার মনে মাছ আছে বলে বিশ্বাস হয়। ক্রমে সে মাছ গাঁথিয়া ফেলে। ঈশ্বর সম্বন্ধেও সেই প্রকার। *সাধুর কথায় বিশ্বাস করে মন-ছিপে, প্রাণ-কাঁটায়, নাম-টোপে, ভক্তি-চার ফেলে অপেক্ষা করতে হয়, তবে ঈশ্বরের ভাবরূপ 'ঘাই' ও 'ফুট' দেখতে পাওয়া যায়। পরে একদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হবেই।'*

     ‎আমরা ঈশ্বরই মানতাম না। আমাদের এই ধারণাই ছিল যে ঈশ্বর নাই। যদি থাকেন, তিনি নিরাকার, ব্রাহ্মসমাজে তাহাই শুনিয়াছিলাম। পরমহংসদেব আমাদের মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, 'ঈশ্বর প্রত্যক্ষ বিষয়। যাঁর মায়া এত সুন্দর ও মধুর, তিনি কি অপ্রত্যক্ষ হতে পারেন?' আমরা বলিলাম, 'সব সত্য, যা আপনি বলছেন, তার বিরুদ্ধে কথা কে বলতে পারবে? কিন্তু এই জন্মে কি তাঁকে পাওয়া যাবে?' তিনি বলিলেন, 'যেমন ভাব তেমনি লাভ, এই মূল প্রত্যয়।' এই বলিয়া একটি গীত গাহিলেন :

     ‎     _ভাবিলে ভাবের উদয় হয়।_

     ‎_যেমন ভাব তেমন লাভ মূল সে প্রত্যয়।_

     ‎     _কালী পদ সুধা হ্রদে, চিত্ত ডুবে রয়।_

     ‎_যাগ যজ্ঞ পূজা বলি কিছুই কিছু নয়।।_

     ‎তিনি পুনরায় বলিলেন, *'যেদিকে যত যাওয়া যায়, বিপরীত দিক ততই পিছিয়ে যায়, পূর্ব দিকে দশ হাত গেলে, পশ্চিম দিক দশ হাত পিছনে হবেই হবে।’* আমরা তথাপি বলিলাম যে ঈশ্বর আছেন বলিয়া প্রত্যক্ষ কিছু না দেখিলে দুর্বল অবিশ্বাসী মন কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। পরমহংসদেব বলিলেন, 'সান্নিপাতিক রোগী এক পুকুর জল খেতে চায়, এক হাঁড়ি ভাত খেতে চায়, কবিরাজ কি সেকথায় কখনও কান দেয়? না, ডাক্তার রোগীর কথায় ওষুধের ব্যবস্থা করতে পারেন? জ্বর পরিপাক পেলে ডাক্তার ওষুধ দেন, রোগীকে কিছু বলতে হয় না।'  আমাদের ব্যস্ত চিত্ত কিছুতেই স্থির হইল না।


৩)

দিনকতক পরে আমাদের মনে নিতান্ত ব্যাকুলতা আসিল। সেই সময়ে একদিন রজনী অবস্থানকালে স্বপ্নে দেখিলাম যে পূর্বপরিচিত এক সরোবরে আমরা স্নান করিয়া উঠিলাম। পরমহংসদেব নিকটে আসিয়া একটি মন্ত্র প্রদানপূর্বক বলিলেন, 'প্রত্যহ স্নানের পর আর্দ্র বস্ত্রে একশতবার জপ করবে।' নিদ্রাভঙ্গের পর আনন্দে শিহরিয়া উঠিলাম এবং তৎক্ষণাৎ দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার নিকটে যাইয়া স্বপ্ন বৃত্তান্ত প্রকাশ করিলাম। সেই কথা শুনিয়া পরমহংসদেব অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং নানাবিধ উপদেশ দিয়া এই বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন যে 'স্বপ্নে মন্ত্র পাওয়া নিতান্তই সৌভাগ্যের কথা'। আমরা এমনই জন্ম-অবিশ্বাসী, ইহাতেও বিশ্বাস হইল না। 'স্বপ্ন মস্তিষ্কের বিকার' -একথা ইংরেজি-বিদ্যা বিশারদ জ্ঞানী-প্রবরেরা বলিয়াছেন। চুপ করিয়া ফিরিয়া আসিলাম।

     ‎তদনন্তর দিন দিন অশান্তি আসিয়া আমাদের হৃদয় অধিকার করিল। তখন আপনা আপনি আক্ষেপ করিয়া কহিতাম, কি কুক্ষণেই পরমহংসদেবের কাছে আমরা গিয়াছিলাম! ঈশ্বর আছেন কিনা, তাহাই স্থির হইল না। এই প্রকার অবস্থায় আমরা কিয়দ্দিবস অতিবাহিত করিলাম। একদিন বেলা এগারটার সময় পটলডাঙার গোলদিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আমরা দুইজনে আমাদের মনের দুঃখের কথা বলাবলি করিতেছিলাম। এমন সময় একটি শ্যামকায় ব্যক্তি নিকটে আসিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, 'ব্যস্ত হচ্ছ কেন, সয়ে থাক'। আমরা চমকিয়া উঠিলাম। কে আমাদের প্রাণের কথা বুঝিয়া অশান্তিরূপ প্রজ্বলিত হুতাশনে আশা-বারি ঢালিয়া দিলেন? তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া দেখি, আর তিনি নাই। কোন্ দিকে যাইলেন, দেখিতে পাইলাম না। আমরা দুজনেই পাতি পাতি করিয়া দেখিলাম, তাহাকে আর দেখা গেল না। বেলা এগারটা, আমরা দুজনে সুস্থদেহ-সুস্থমনে দাঁড়াইয়া ছিলাম। কাহারও চোখের দোষ ছিল না কারণ সকলকে পূর্বের ন্যায় দেখিতেছি, কানের বিকৃতাবস্থা হয় নাই কারণ তাহাতেও পূর্ববৎ শ্রবণ করিতেছি। সেই দিন এই ধারণা হইল যে ঈশ্বর আছেন। পরমহংসদেবকে এই সংবাদ প্রদান করা হইলে তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাস্যে কহিলেন, 'কত কি দেখবে!'


********************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন