রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫

ভ্রমণ কাহিনি * ইন্দ্রনীল মণ্ডল

 


LRK-তে একদিন

ইন্দ্রনীল মণ্ডল 


সুদূর কলকাতা থেকে প্রথমে উড়ে গিয়েছিলাম আমেদাবাদ এবং সেখান থেকে ভাড়া গাড়িতে করে সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে গুজরাটের এক অন্তিম প্রান্তে — কচ্ছের ছোট রাণের (Little Rann of Kutch,LRK) কাছে একটি রিসোর্টে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, এমন ধরনের বন্যপ্রাণ দেখা, যা ভারতবর্ষের আর প্রায় কোথাও সেভাবে দেখা যায় না। 
           এখন অতি ভোর। হালকা কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য পূর্ব দিগন্তে উপস্থিত হবো হবো করছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেলেও এখানে সূর্য একটু দেরিতেই উদিত হয়, অস্তও যায় অনেকটা দেরিতে। সেই কারণে আমাদের মতন কলকাতাবাসীর কাছে সেটা এমন কিছু ভোর নয়। গুজরাটি সজ্জায় সুসজ্জিত যে রিসোর্টে আমরা এসেছি, তার সামনের সামান্য শিশির ভেজা বিস্তৃত মাঠের ওপর কতগুলো ‘লাল-লতিকা হটটিটি’ আর বক দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমরা গাড়িতে করে যাব সাফারি করতে LRK- তে। সূর্য উঠবো না উঠবো না করেও শেষ পর্যন্ত আড়মোড়া ভেঙে পূর্ব দিগন্তে হাজির হয়েছে। ভোরের নরম আলোয় চারপাশটা বেশ সুন্দর লাগছিল। শান্ত, নিরিবিলি, গাছগাছালিতে ঢাকা পরিবেশ। বিভিন্ন পাখির মিষ্টি সুরেলা আওয়াজে বোনা ভোরাই পর্ব শেষ করে আমরা যাত্রা করেছিলাম এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশের উদ্দেশ্যে। 
          সাফারির গাড়ি তার নির্দিষ্ট প্রবেশ পথের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল দেখলাম যে, চারদিকে ছোট ছোট কাপাস তুলো চাষ হয়েছে। জানা গেল যে, তুলোর বীজ থেকে প্রচুর ভোজ্য তেল তৈরি হয়। সেই কাপাস তুলোর চাষের জমি ভেদ করে আমাদের সাফারি গাড়ি এসে পৌঁছেছিল কচ্ছের রাণের প্রবেশ পথের কাছে। ভেতরে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেখিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল মেঠো, রুক্ষ শুষ্ক, ফুটিফাটা ভূমির ওপর দিয়ে। যত এগোতে লাগলাম দেখলাম, ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল মাটির রুক্ষতার পরিমান। প্রচুর সরু, সাদা সাদা দাগ মাটির বুকে ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইডকে জিজ্ঞেস করায় সে গুজরাটি হিন্দি মিলিয়ে যা বললো তাতে বোঝা গেল যে, এখানকার মাটির তলা থেকে অদ্ভুতভাবে নোনা জল মাটির ওপরে উঠে আসে এবং সেই নোনা জল সূর্যের আলোয় শুকিয়ে যায়। জলটা বাষ্পীভূত হয়ে গেলে মাটির উপরে শুধু নুনের দানাগুলো জমে থাকে। সাদা দাগগুলো সেই জমাট বাঁধা দানাদার নুনেরই চিহ্ন।
            গাড়ি যত এগোতে লাগলো দেখা গেল যে কেবল নির্দিষ্ট কিছু পথের উপর দিয়েই গাড়িকে যেতে হচ্ছে। চারিদিক কাঁটা গাছের, বিশেষ করে বাবলা জাতীয় গাছের ঝোপে ভর্তি। আমাদের চোখ খুঁজি যাচ্ছিল সেই নির্দিষ্ট জীব –ভারতীয় ‘বন্যগাধা’ 
(Equus hemionus)। কথায় কথায় আমরা অনেককে গর্ধব বা গাধা বলে ডেকে থাকি। কিন্তু অনেকেই চাক্ষুষ কখনো গাধা দেখেনি, বিশেষ করে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। সেক্ষেত্রে এই বন্য গাধা দেখতে আসা, তার সঙ্গে আরো অনেক কিছু। সেগুলো খুবই রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার ছিল। যাত্রা পথে আমাদের ডান দিকের পুরো জায়গাটাই ‘দলদল’ অর্থাৎ কাদা-জলপূর্ণ মাটি, তারপরেই বিশাল জলাশয়। জলাশয়ের মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মতো অংশে স্বল্প কিছু শরবন। আর সেই জলাশয় ছাড়িয়ে বহুদূর আবছা, অস্পষ্ট ভাবে শহুরে সভ্যতার নিদর্শন দেখা যাচ্ছিল। জলাশয়ের খুব কাছে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়নি। তার কারণ নরম মাটি। এখানে মাটি এমন নরম যে ওপর থেকে দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল না। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সামান্য কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরে মনে হচ্ছিল যে, কেউ যেন আমাকে নিচের দিকে ধীরে ধীরে টেনে নিচ্ছিল, অনেকটা চোরাবালির মত। 
            জলাশয়ের বুকে যে পাখিদের আমরা দেখেছিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও তা ভোলা যাবে না। মূলত আমরা দেখেছি বিশাল বড় বড় পেলিক্যান আর ফ্লেমিঙ্গো। এই সমস্ত পরিযায়ী পাখি বহুদূর থেকে শীতের প্রায় শুরুতেই তারা এই জলাশয় চলে এসেছে তাদের অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করতে। আগামী কয়েক মাস তারা এখানেই নাকি অবস্থান করবে। সূর্যের হলদেটে আলো পেলিক্যানগুলোর ডানায় পড়ে যে দারুন এক দৃশ্যের অবতারণা করেছিল তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না। জলাশয়ের বুকে কেউ কেউ মনের আনন্দে ভাসছে, কেউ ডানা ঝাপটাচ্ছে, কেউ নিমেষে হাঁ করে তার বিশাল লম্বা চঞ্চুর তলায় যে হলুদ থলের মত অংশ রয়েছে, সেখানে তার খাদ্য, মাছ ভরে রাখছে। এটাই এদের বৈশিষ্ট্য। এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতেই গাড়ি এগিয়ে চলল। 
        হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম প্রায় হালকা সাদা, হালকা বাদামী রঙ যুক্ত অনেকগুলো বন্য গাধা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাঁটা গাছের ঝোপগুলোর পাশ থেকে ওদের খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। ওইখানে গাড়ি সরাসরি যাওয়ার উপায় না থাকায় আমাদের চালক ভাই অত্যন্ত দক্ষতা সহকারে প্রায় পথহীন রুক্ষ জমির ওপর দিয়ে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে সুন্দর ভাবে পৌঁছে গেল সেই জায়গায়, যেখানে গাধাগুলো দলবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। বন্য গাধার যে এত সুন্দর রূপ হতে পারে সেটা সামনাসামনি না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে গাধা দেখেছি, কিন্তু তাদের রূপ অন্যরকম ছিল। ছোট, ধূসরবর্ণা এবং তারা মোট বয়তেই সদা ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এই সমস্ত বন্য গাধার দেহের চাকচিক্য, সৌন্দর্য এতই ভালো যে তাদের গাধা বলতে জিভ আটকে যায়। দলটার মধ্যে কেউ ঘাস খাচ্ছিল বা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। সহজ কথায় নিজেদের মধ্যে তারা নিবিষ্ট ছিল। আমরা বাইরের মানুষজন তাদের এই সুন্দর করে গড়া পরিবেশে, তাদের জগতে, জোর করে নাক গলিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে তারা একটু বিরক্ত তো হবেই। তাই কেউ কেউ ঘাস খেতে খেতেই একটু ভয় পেয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল। অবশেষে আমরা বন্য গাধার দলটাকে বেশ সামনে থেকে দেখতে পেলাম। মনের সুখে তাদের ছবি তুললাম বিভিন্ন আঙ্গিকে। আমরা যখন গাড়িটাকে একটু জোরে ছুটিয়ে তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখন অদ্ভুত ভাবে একটা বন্য গাধা কোথা থেকে দলছুট হয়ে আমাদের গাড়ির পাশে পাশে দৌড়েছিল আর অদ্ভুত স্বরে ডাকছিল। গাড়ির শব্দ এবং গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারায় ভয় পেয়ে গাধাটা দিক পরিবর্তন করে জঙ্গলের দিকে ঢুকে পড়েছিল। 
             প্রায় শ’খানেক গাধার দলকে একসঙ্গে এক জায়গায় দেখতে পেয়ে এক আনন্দদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা খুবই উল্লাসিত ছিলাম। মন কানায় কানায়, ভালো লাগায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছিল। তারা ইতি-উতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছিল। সবুজ ওড়নার বুকে সকালের নরম আলোয় উজ্জ্বলবর্ণা, বেশ স্বাস্থ্যবান, বড় বড়, জৌলুসযুক্ত বন্য গাধাগুলোকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিল।বন্য গাধার রূপে আমরা মোহিত হয়ে গেছিলাম। এই বন্য গাধা এই অঞ্চল ছাড়া আর ভারতবর্ষে বিশেষ কোথাও মুক্ত পরিবেশে জঙ্গলের বাতাবরণে দেখতে পাওয়া যায় না। কচ্ছের ছোট রাণ অঞ্চলে অবস্থিত, ভারতীয় বন্য গাধা অভয়ারণ্যের মোট আয়তন প্রায় ৪,৯০০ বর্গকিলোমিটার। এরা জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রে, মরুভূমি, শুষ্ক তৃণভূমি এবং ঝোপঝাড় সহ আবাসস্থলেই বাস করে। গুজরাটের কচ্ছের রাণে তাদের দেখতেই আমরা উড়ে এসেছি, বহু দূরের কলকাতা মহানগর থেকে।
           বন্য গাধা দেখতে দেখতেই জানতে পারা গেল যে, এই অঞ্চলেই একমাত্র ভিন্নভাবে বড় বড় দানাযুক্ত প্রাকৃতিক নুন তৈরি হয় এই মাটির তলার জল তুলে তাকে শুকিয়ে নিয়ে। অন্য জায়গায় সমুদ্রের জলকে ধরে রেখে সেখান থেকে নুন তৈরি করা হয়। কিন্তু এখানে, এখানকার মাটির তলার জলকে পাম্প করে তুলে বিশাল বড় বড় জমির মধ্যে জলটাকে বেঁধে রাখা হয় ছোট আল দিয়ে। এই ধরে রাখা জলই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং নুন গুলো ওই পুরো জমিটার উপরে পড়ে থাকে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘লবণ চাষ’। অনেক প্রকার চাষের কথা শুনলেও ‘লবণ চাষ’ শব্দটা ছিল আমাদের কাছে সত্যিই এক নতুন চমক এবং কীভাবে তা করে আমরা তা চাক্ষুষ করে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম এবং আনন্দও পেয়েছিলাম। এই নুনগুলোকে সংগ্রহ করে এক জায়গায় জমা করা হয় এবং তাতে এই ক্রিস্টাল বা দানাদার নুনের বড় বড় ঢিপি বা পাহাড়ের মত তৈরি হয়। এই নুনের ঢিপিগুলোর ওপরে রোজকার ধুলো, ময়লা, বৃষ্টির জল ইত্যাদি জমা হতে থাকে। তবে এই বড়বড় দানার নুনকেই আবার কারখানায় আরো সুক্ষভাবে গুঁড়ো করে তার ময়লাগুলোকে দূর করে আরও শোধন করে, পরিমার্জন করে পুনরায় প্যাকেটজাত করা হয়।
            স্থলভাগ ছেড়ে এবার জলভাগের দিকে নজর দেওয়া যাক। আগেই বলেছি যে হাজার হাজার পেলিক্যানদের ডাক, তাদের ওড়াউড়ি, নিজেদের মধ্যে মারপিট, জলে ভেসেভেসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া, এই সবই আমরা আশ্লেষে উপভোগ করেছিলাম। ওর সঙ্গে দেখছিলাম বেশ কিছু সরাল আর পাতিভূতি হাঁসদের যারা জলের স্রোতে, হাওয়ার টানে অদ্ভুতভাবে ভেসে যাচ্ছিল। জলাশয়ের মাঝে মাঝে ছিল কিছু শরবন, যার আশপাশে বিভিন্ন ধরনের বক তাদের এক পা তুলে তুলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। কিছু সারস, তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ করে তাদের উপস্থিতিকে জানান দিচ্ছিল। দেখেছিলাম, কাঁটা ঝোপের মাঝে মাঝে যে কয়েকটা গাছ জন্মেছে, সেই গাছের উঁচু ডালে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন ধরনের বক। যার মধ্যে অন্যতম হলো পেইন্টেড স্টর্ক, খুন্তে বক ইত্যাদি। অনেকগুলো সারস তার দেহের ধূসর পাখা নিয়ে এমন একটা দুলকি চালে জলের কিনারা বরাবর হেঁটে যাচ্ছিল। ফ্লেমিঙ্গদের কথা না বললে এই সাফারির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জলাশয়ের পেলিক্যানদের পাশাপাশি ফ্লেমিঙ্গরাও তাদের দলবল নিয়ে গোলাপি মাথা, পাখার তলায় লালচে রং আর সরু সরু লালচে পা নিয়ে বিশাল লম্বা বাঁকানো গলাটাকে কখনো নামিয়ে, পেঁচিয়ে,কখনো ‘S’এর মত করে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তারা খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। এই সমস্ত লেসার ফ্লেমিঙ্গো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছিল এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কেউ কেউ জলের মধ্যে সরু, লম্বা লম্বা পা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। সে কিযে এক ভালোলাগার চিত্র তৈরি হয়েছিল তা বলার নয়। এইসব দেখা শেষ করে আমরা ফিরতি পথের যতক্ষণ জলাশয়ের পাশ দিয়ে আসছিলাম যতক্ষণ নানা জাতীয় জলার পাখি, বিভিন্ন হাঁস, বক তাদের বিভিন্ন কেরামতি দেখাতেই ব্যস্ত ছিল। আমরা সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে পাচ্ছিলাম না।       
          এইভাবে আমাদের সকালের যাত্রাটা শেষ হলেও একই ‘রাণের’ অন্য একটা দিকে বিকেলে যখন পৌঁছানো পর, দেখতে পেয়েছিলাম ধূ ধূ, জনমানবহীন প্রান্তর। আর তার পশ্চাৎপটে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল দিনের শেষ রবিরশ্মি। এই ধরনের ধূ ধূ পরিবেশে চারদিকে খালি লবণ চাষের কাজ চলছে। আর লবণ চাষের জমির মাঝে মাঝে অনেক দূরে দূরে দু-একটা ছোট ছোট আস্তানা, লবণ চাষীদের। এই রকম নরম মাটির মাঝখান থেকে এলোমেলো ভাবে চলে গেছে কিছু চাকার দাগ। সেই সব চাকার দাগ ধরে বা নতুন পথ তৈরি করে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছিল আরো গভীর অঞ্চলের দিকে। ক্লান্ত অপরাহ্ণের গোধূলি আলোয় আসন্ন সন্ধ্যার মুখে হঠাৎই আমরা এরকম নির্জন মনুষ্যহীন জঙ্গলের সামনে কিছু বন্য গাধাকে দেখতে পেলাম। এরকম ফাঁকা ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝে মাঝে কাঁটাগাছের ঝোপের মধ্যে তারা লুকিয়ে ছিল। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তারা আরো ভিতরের দিকে সরে যেতে লাগলো। আসন্ন সন্ধ্যার প্রেক্ষাপটে বন্য গাধাদের পৃষ্ঠদেশ বরাবর সূর্য ধীরে ধীরে সে দিনের মতো নিদ্রা যাওয়ার চেষ্টা করার যে একটা সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকদিন মনে থাকবে।একটি পেঁচা দেখলাম কাঁটা গাছের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে তার সৌন্দর্য দেখানোর জন্য বসেছিল। 
        ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে গ্রাস করতে থাকায় আমরা যখন ফিরতি পথ ধরেছিলাম তখনই বিপদ শুরু হয়েছিল। সাফারি গাড়ির চালক ওই আধো অন্ধকারে ঠিকমতো গাড়ির চাকার দাগ বুঝতে পারেনি। তাই আপাতত কঠিন অন্য মাটির উপর দিয়ে পথ তৈরি করে নিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎই ভারী গাড়িটা মাটিতে, তথাকথিত কাদায় আটকে যায়। অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটিকে ওই নরম মাটির থেকে ওঠাতে পারা যায়নি। চাকা যত জোরে ঘুরছিল গাড়ি তত আরও নরম মাটিতে বসে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই গাঢ় অন্ধকার আমাদের ঢেকে ফেলেছিল। কেবল আমরা তিনজন আর সাফারি চালক ঐরকম “ন যযৌ ন তস্থৌ" অবস্থায় পড়ে ছিলাম। চারদিকে নিঝুম অন্ধকার, আশপাশে কেউ কোথাও নেই। মোবাইলের নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করছিল না। ফলে আমরা খানিকটা ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। যে আনন্দ বা উল্লাস নিয়ে আমরা সাফারি শুরু করেছিলাম হঠাৎই তা আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। কীভাবে এই দলদল থেকে, এই লবণ জমির থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে রিসোর্ট পৌঁছাবো তা ভাবনা শুরু হয়েছিল। তাহলে কী আমাদের এই ভাবেই সারারাত এখানে কাটাতে হবে? এই সমস্ত নানা আজেবাজে চিন্তায় আমাদের মন মুহূর্তে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। সাফারি গাড়ির চালক আমাদেরকে ফেলে রেখে দূরে বোধহয় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেছিল যাতে আমরা এই অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি পাই। কারণ আমাদেরকে ভালোভাবে অক্ষত ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তারই । স্থানীয় ভাষায় সে কোন রকমে তার অন্য সাথীদের যোগাযোগ করে আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সাহায্যের জন্য অন্য একটি গাড়ি উপযুক্ত সরঞ্জাম নিয়ে চলে আসবে আর আমরা এই অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবো। 
         আশার কথা এই যে, এই ধরনের জঙ্গলে সেরকম হিংস্র কোন শ্বাপদ ছিলনা। শেয়াল, সাপ, বেজি ইত্যাদি ছোটখাটো জীব আর কিছু নিশাচর প্রাণী থাকলেও তারা আমাদের গাড়িতে উঠে ভয়ংকর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সাফারি চাল ক যদিও আমাদেরকে বারবার আশ্বস্ত করছিল এই বলে-- "কুছ নেহি হোগা। আপ চিন্তা মৎ কিজিয়ে। হাম হ্যায় না, সব্ ঠিক হো জায়গা।"
          চারদিকে ঘন অন্ধকার, মেঘহীন আকাশে শুধু তারাগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছিল, আর অনেক দূরে আবছা ভাবে শহরের আলোর কিছু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে মনে খালি ভাবছিলাম কতক্ষণে ওই আলোর কাছাকাছি যেতে পারবো, কতক্ষণে এই বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবো। চারদিকে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,রাতচরা পাখিদের ডাক, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা বন্য গাধাদের রাসভ, দূর থেকে বেশি আশা কিছু নিশাচর প্রাণীর ডাক ছাড়া আর কিছুই আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল না। যদি এইখানে বসবাসের ব্যবস্থা থাকত তাহলে হয়তো এই পরিবেশটাই অতি মনোরম, হৃদয়গ্রাহী হয়ে থাকতো। কিন্তু সেইক্ষণে যেহেতু আমরা আটকে পড়েছিলাম এবং কোনভাবেই সুরক্ষিত ছিলাম না, তাই যে পরিবেশ আমাদেরকে মুগ্ধ করতে পারত তা অচিরেই ভীতিময়, আতঙ্কের পরিবেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছিল।       
             এইভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর দূর থেকে দুটি আলোর বিন্দুকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। বুঝতে পারলাম সাহায্যের জন্য গাড়ি এসে গেছে। তখন মনে একটু সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। মন থেকে ভয়ও খানিকটা দূর হয়েছিল। সাহায্যের গাড়ি আরো কাছে আসতে গাড়ির ব্যাটারি থেকে তার নিয়ে আলো জ্বালিয়ে আর আমাদের মোবাইলের আলোর সাহায্যে আমাদের গাড়িটাকে কাদার থেকে উদ্ধার করে, ওই গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ওই সাহায্যকারী গাড়ির পেছনে পেছনে, সাবধানে সেটাকে অনুসরণ করে আমরা ধীরে ধীরে আতঙ্কপূর্ণ অন্ধকার পরিবেশের থেকে শহরের আলোকময় পরিবেশে এসে মুক্তি লাভ করেছিলাম। একটা সন্ধ্যা, একরাশ উদ্বেগ ও ভয়ার্ত মন নিয়ে প্রায় জনমানবহীন সংরক্ষিত অভয়ারণ্যের খোলা আকাশের নিচে নিশ্চুপ ভাবে সময় অতিবাহিত করার যে অভিজ্ঞতা, তা দীর্ঘদিন মনে থাকবে। অবশেষে রিসোর্টে ফিরে, মনের মধ্যে LRK-কে বিভিন্ন রূপে দেখার স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে রাতটাকে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করেছিলাম।




********************************************************************************






                             ইন্দ্রনীল মন্ডল 


শিক্ষাগত যোগ্যতা: M.sc,Ph.D  পেশা : শিক্ষকতা 
বয়স : ৫৯ বছর  কোন একক বই না থাকলেও বিভিন্ন প্রকাশনীর বইতে লেখা রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন